Join to Our Community
Community Grows With You

জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কথা ও মহাপ্রসাদ মাহাত্ম্য

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কথা ও মহাপ্রসাদ মাহাত্ম্যসেই সঙ্গে আলোচনা করেছি শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রা-প্রণামমন্ত্র, কেন জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদকে মহাপ্রসাদ বলা হয়, প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদনের সময় সূচী, ৫৬ ভোগ (ছাপ্পান ভোগ) কি কি, পুরীধামের রান্নাঘরের মাহাত্ম্য প্রভৃতি। 

এর পাশাপাশি আলোচনা করেছি জগন্নাথ লীলা যেমন- লাণ্ডিমাতার নিমপাতা বাটা, কর্মাবাঈয়ের খিচুড়ি ভোগ, লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী

শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রা-প্রণামমন্ত্র

নীলাচল-নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।

বলভদ্র-সুভদ্রাভ্যাম্‌ জগন্নাথায় তে নমঃ।।

ভগবান জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ মাহাত্ম্য

পুরান মতে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত রামেশ্বরম ধামে স্নান করেন, উত্তরে অবস্থিত বদ্রীনাথ ধামে ধ্যান করেন, পূর্বে অবস্থিত পুরী ধামে আহার গ্রহণ করেন ও পশ্চিমে অবস্থিত দ্বারকায় শয়ন করেন। 

এই চার ধামের মধ্যে ভগবান জগন্নাথদেব শ্রীক্ষেত্র পুরী ধামেই নিত্য আহার করেন, তাই পুরী ধামের ভোগের মাহাত্ম্য এত অসীম। এই পুরী ধামে শ্রী ভগবানের নিত্য সেবা হয় ৫৬ রকমের ভোগ দিয়ে, যা ‘ছাপ্পান ভোগ’ নামে খ্যাত। স্বয়ং মাতা লক্ষী দেবীই যেন প্রতিদিন প্রভু জগন্নাথদেবের জন্য এই ভোগ রান্না করেন।

➢ কেন জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদকে মহাপ্রসাদ বলা হয়?

ভোগ তৈরির পরে, এটি মূল মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রাকে নিবেদন করা হয়। এরপর শ্রীমন্দিরে মাতা বিমলা দেবীর (দূর্গা দেবী) কাছে ভোগ নিবেদন করা হয়। উভয় মন্দিরে ভোগ নিবেদনের পর এই প্রসাদ মহাপ্রসাদে পরিণত হয়।

শ্রী মন্দিরে প্রধানতঃ চার প্রকার রন্ধন প্রনালী ব্যবহৃত হয় যেমন, ‘ভীমপাক’, ‘নলপাক’, ‘সৌরিপাক’‘গৌরীপাক’। আশ্চর্যের বিষয় হলো রান্নার পর ভোগ থেকে কোন সুগন্ধ আসে না, তবে এটি প্রসাদ হবার পরে তা থেকে খাবারের সুস্বাদু সুবাস আসতে শুরু করে। তখন এই মহাপ্রসাদ ভক্তদের গ্রহণের জন্য ব্যবহার করা হয়।

শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রাভু ‘মহাপ্রসাদ’ শব্দটি প্রথম প্রচলন করেন। চৈতন্য চরিতামৃত অনুসারে, কৃষ্ণকে নিবেদিত অন্নই হল ভোগ, সেই ভোগ শ্রীকৃষ্ণ গ্রহণ করলে তাকে বলে প্রসাদ, সেই প্রসাদ ভগবানের পার্ষদরা গ্রহণ করলে তাকে বলে মহাপ্রসাদ। এরপর সেই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে ভক্ত। মনে রাখতে হবে, মহাপ্রসাদের উপর নিবেদিত ব্যক্তির আর কোন অধিকার থাকে না, বরং তা হয়ে যায় সকল ভক্তের।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার সন্যাস জীবনের ২৪ বছরের মধ্যে ১৮ বছর জগন্নাথ পুরীধামেই কাটিয়ে দেন। সেই সময় মহাপ্রভু চৈতন্য অনুগামীরা এই বঙ্গদেশ থেকে পায়ে হেঁটে তার দর্শন ও সান্নিধ্য পাবার আশায় আসতেন, আর মহাপ্রভু স্বয়ং নিজের হাতে আকন্ঠ মহাপ্রসাদ সেই ভক্তদের খাওয়াতেন।

মহাপ্রসাদ সম্পূর্ণরূপে সাত্ত্বিক, নিরামিষ এবং প্রাকৃতিক শাকসবজি ইত্যাদির মিশ্রণ। জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ দুই ধরনের – ‘সংকুরি মহাপ্রসাদ’ (অর্থাৎ এর মধ্যে থাকে – সাদা ভাত, ঘি ভাত, জিরে হিং আদা ও নুন মিশ্রিত ভাত, মিষ্টি ডাল, সবজি ডাল, শাক ভাজা, যব ইত্যাদি) এবং ‘সুখীলা মহাপ্রসাদ’ (অর্থাৎ এর মধ্যে থাকে শুকনো মিষ্টি)।

এখানে আরও একপ্রকারের প্রসাদ পাওয়া যায় যার নাম ‘নির্মলা প্রসাদ‘। নির্মলা প্রসাদে প্রধানত শুকনো চাল থাকে যা মন্দিরের কাছে কোইলি বৈকুণ্ঠে তৈরি করা হয়। কথিত আছে যে, এই প্রসাদটি যদি কোন মৃত ব্যক্তিকে নিবেদন করা হয় তবে সে মোক্ষ লাভ করে এবং তার সমস্ত পাপ দূর হয়।

প্রবাদ আছে, গঙ্গার পবিত্র জলও অপবিত্র হতে পারে, কিন্তু মহাপ্রসাদ নয়।

➢ প্রত্যহ জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদনের সময় সূচী

পুরীধামে দিনে ৬ বার ভোগ নিবেদন করা হয় ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা দেবীকে। যেমন – 

সকাল ৮.৩০ টায় — গোপাল বল্লভ ভোগ (জল খাবার)

● বেলা ১০টায় —  সকাল ধূপ ( সকালের আহার)

● বেলা ১১ টায় —  ভোগ মণ্ডপ (সকাল ও মধ্যাহ্নভোজের মাঝে আহার)

● দুপুর ১২.৩০টায় — মধ্যাহ্ন ধূপ ( মধ্যাহ্নভোজ বা দ্বি-প্রাহরিক আহার)

● সন্ধ্যে ৭টায় — সন্ধ্যা ধূপ (সান্ধ্যভোজ বা সান্ধ্যকালীন আহার)

● রাত ১১টায় — বড় সিঙ্ঘারা ভোগ (নৈশভোজ বা রাত্রিকালীন আহার)

➢ ৫৬ ভোগ (ছাপ্পান ভোগ) কি কি?

ভাতের থালা

১) সাদা অন্ন – জলে রান্না করা সাধারণ ভাত

২) ঘি অন্ন – ঘি মেশানো ভাত

৩) কণিকা – চাল, ঘি এবং চিনি দিয়ে তৈরি সুগন্ধী ভাত। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কুইন্টাল চাল এবং ২০ থেকে ২৪ কুইন্টাল ডাল এবং সব্জি দিয়ে রান্না করা হয় এই ‘কণিকা’ মহাপ্রসাদ৷

৪) দই পাখাল – দই ভাত এবং জল

৫) আদা পাখাল – চাল, আদা এবং জল

৬) মিঠা পাখাল – চাল, চিনি এবং জল

৭) ওড়িয়া পাখাল – চাল, ঘি, লেবু এবং লবণ

৮) থালি খিচড়ি – মসুর ডাল, চিনি এবং ঘি দিয়ে মেশানো খিঁচুড়ি

৯) টাটা খিচড়ি – মসুর ডালের সাথে চাল মেশানো শুকনো খিঁচুড়ি

১০) সাগা নাড়িয়া নারকেলের দুধ দিয়ে মাখা ভাত

মিষ্টি

১১) খাজা গম দিয়ে তৈরি

১২) গজা – গম, চিনি এবং ঘি দিয়ে তৈরি

১৩) লাড্ডু  (চিনি, গম এবং ঘি দিয়ে তৈরি), জিরা লাড্ডু মাগাজা লাড্ডু

১৪) বুন্দিয়া বোঁদে

১৫) মাথাপুলি (অর্থাৎ পুলি পিঠে)– মটরশুটির ঘন পেস্ট, আদা ও ঘি দিয়ে তৈরি পিঠে

১৬) খুরুমা – চিনি, গম এবং লবণ দিয়ে তৈরি

১৭) জগন্নাথ বল্লভ – গম, ঘি এবং চিনি

১৮) কাকারা – ঘি এবং গম দিয়ে তৈরি

১৯) লুনি খুরুমা ঘি, গম এবং লবণ দিয়ে তৈরি নোনতা বিস্কুট

২০) মরীচ লাড্ডু গম, চিনি এবং লঙ্কা দিয়ে তৈরি ঝাল লাড্ডু

পিঠা ও মন্ডা

২১) পোড়া পিঠা – চালের গুঁড়ো, উরদ ডাল (বিউলির ডাল), নারকেল গুঁড়ো, গুড় এবং ঘি দিয়ে তৈরি

২২) চিত্তাউ – চাল, নারকেল, চিনি, ঘি দিয়ে তৈরি

২৩) ঝিল্লি – চালের গুঁড়ো, ঘি এবং চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরণের পিঠা

২৪) কান্তি – চালের গুঁড়ো এবং ঘি দিয়ে তৈরি

২৫) মন্ডা – চাল, নারকেল গুঁড়ো, গুড়, পনির এবং ঘি দিয়ে তৈরি

২৬) আমালু – গমের আটা, ঘি এবং চিনি দিয়ে তৈরি (মিষ্টি লুচি)

২৭) পুরি – গমের আটা এবং ঘি দিয়ে তৈরি

২৮) লুচি – চালের গুঁড়ো এবং ঘি দিয়ে তৈরি

২৯) বড়া – দই, ঘি এবং মটরশুটি দিয়ে তৈরি ভাজা বড়া ও দই বড়া – উরদ ডাল এবং দই দিয়ে তৈরি

৩০) এন্ডুরি – নারকেল দিয়ে তৈরি কেক

৩১) আরিসা – চালের গুঁড়ো, ঘি এবং গুড় দিয়ে তৈরি চ্যাপ্টা মিষ্টি ভাজা পিঠা

৩২) ত্রিপুরি – চালের গুঁড়ো এবং ঘি দিয়ে তৈরি আরেকটি  চ্যাপ্টা মিষ্টি ভাজা পিঠা

৩৩) রসপাইক – গমের আটা এবং ঘি দিয়ে তৈরি কেক।

দুধের প্রস্তুতি

৩৪) খিড়ি – দুধ, ভাত ও চিনি

৩৫) পাপুড়ি – শুধুমাত্র দুধের ক্রিম থেকে তৈরি

৩৬) খুয়া  দুধ ফুটিয়ে তৈরি খোয়া ক্ষীর

৩৭) ক্ষিরা – দুধ, ছানা, চিনি এবং ঘি দিয়ে তৈরি

৩৮) রসবালি – দুধ, চিনি এবং গমের আটা দিয়ে তৈরি

৩৯) তাড়িয়া – তাজা ছানা, দুধ এবং চিনি দিয়ে তৈরি

৪০) ছেনা খাই – তাজা ছানা, দুধ এবং চিনি দিয়ে তৈরি

৪১) মালপুয়া- ময়দা, দুধ, চিনি এবং ঘি দিয়ে তৈরি 

৪২) সরপুল্লি – এটি সবচেয়ে বিখ্যাত দুধের খাবার। ক্রিম, দুধ এবং চিনি দিয়ে তৈরি।

ডাল ও তরকারি

৪৩) মিষ্টি ডাল

৪৪) বিরি ডাল

৪৫) ছানার ডাল

(উপরের তিনটি ডাল তৈরিতে মসুর ডাল ব্যবহার করা হয়)।

৪৬) ​​ মুগা ডাল / মুগা ডালমা 

৪৭) ডালমা – ডাল এবং সবজির সংমিশ্রণ, সাধারণত মটরশুটি, বেগুন, মিষ্টি আলু, নারকেল এবং বোধি নামক একপ্রকার শুকনো গাছের মূল ব্যবহার করা হয় যা দেখতে অনেকটা মাশরুমের মতো এবং এতে প্রোটিন বেশি থাকে। ডালমাতে টমেটো ব্যবহার করা হয় না, কারণ জগন্নাথ মন্দিরের খাবার তৈরিতে টমেটো ব্যবহার করা হয় না।

৪৮) রাইতা – শসা, মূলা এবং দই সহযোগে একপ্রকার টক জাতীয় খাবার

৪৯) মহুরা – মিশ্র সবজির তরকারি বা লাবরা

৫০) বেসরা – কালো সরিষা সহযোগে মিশ্র সবজির তরকারি

৫১) শাগ – একটি পালংশাকের খাবার

৫২) পটল রসা – আলু, পটল, নারকেল দুধ দিয়ে তৈরি ঝোল

৫৩) গোটি বেইগন – ছোট গোটা বেগুন, নারকেল কুরো দিয়ে তৈরি তরকারি

৫৪) বেইগন – ভাজা বেগুন

৫৫) পিট্টা – নিম গাছের ফুল ভাজা

৫৬) খাট্টা একটি টক জাতীয় চাটনি। আম বা আপেল-এর সাথে আঙ্গুর মিশ্রিত করে এই চাটনি তৈরি করা হয়।

আমেরিকার ওয়াশিংটনে প্রথম ইস্কনের রথযাত্রা শুভ সূচনার সময় ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা শ্রীলপ্রভুপাদ উপস্থিত ছিলেন সেখানে। ৫৬ রকমের ভোগ দিতে গিয়ে দেখা যায় বহু বিদেশীরাই ভারতীয় রান্নার এতগুলি নিরামিষ পদ রপ্ত করতে পারছিলেন না। তখন তিনি নিজের তত্বাবধানে নিরামিষ পদ কেক, প্যাটিস বানানো শিখিয়েছিলেন বিদেশী ভক্তদের।

➢ পুরীধামের রান্নাঘরের মাহাত্ম্য

তবে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামের রান্নাঘরের মাহাত্ম্য সম্পর্কে সকলেরই জানা দরকার

● রান্নাঘরটির দৈর্ঘ্য ১৫০ ফুট, প্রস্থ ১০০ ফুট এবং উচ্চতা ২০ ফুট এবং মন্দিরের বাইরের প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। রান্নাঘরে প্রতিদিন ৭৫২টি উনুনে রান্না হয়। রন্ধনশালার প্রায় সমস্ত উনুন মাটি দিয়ে তৈরি, মাত্র ১০ টি উনুন সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। তাতে পিঠা তৈরি করা হয়। মাটির উনুন বানানোর দায়িত্বে আছে কুম্ভকার নিজোগ সোসাইটি। রান্নাঘরে ৩ ধরনের উনুন ব্যবহার করা হয় যেমন “অন্ন চুলি”, পিঠা চুলি” এবং “টুনা চুলি” বা “অহিয়া চুলি”। 

অন্ন চুলিতে (উনুনে) ভাত বা অন্ন রান্না করা হয় এবং সেই উনুনগুলি দৈর্ঘ্যে ৪ ফুট, প্রস্থে ২/ফুট ও উচ্চতায় ২ ফুট। পাত্র বসাবার জন্য প্রতিটি উনুনে ৬টি ঝিক থাকে। দুটি অন্ন চুলির মাঝের আয়তাকার জায়গাটিতে থাকে আহিয়া চুলি এবং এখানে সব ধরণের ডাল ও সবজি রান্না করা হয়। আর পিঠে বানানো হয় পিঠা চুলিতে এবং এইগুলি কেবলমাত্র কংক্রিটের তৈরি।

রান্নাঘরের আগুন “বৈষ্ণব অগ্নি” নামে পরিচিত এবং এটি বিশ্বাস করা হয় যে মা মহালক্ষ্মী পরম যত্ন এবং ভক্তি সহকারে ভগবান জগন্নাথদেবের জন্য রান্না করেন। এই বৈষ্ণব অগ্নি কখনো নিভিয়ে দেওয়া হয় না।

● প্রতিদিন ৭৫২টি উনুনে রান্না হয়। ৭০০-৮০০ জন বিশেষ সেবাইত (যাদের ‘সুয়ারা’ বলে) যার মধ্যে ৪০০-৫০০ জন রাঁধুনি এবং বাকি ৩০০ জন তাদের সহযোগী রান্না করেন এই মহাপ্রসাদ৷ ভগবানের নাম চিন্তা করতে করতে এবং মুখ বন্ধ করে (কোন রকম গান গাওয়া, কথা বলা এমনকি পান বা তামাক জাতীয় পদার্থ পর্যন্ত চিবানো নিষেধ) রান্না করা হয় ভোগ, যাতে তার মধ্যে কোনওভাবে থুথু বা লালা পড়ে এঁটো বা দূষিত না হয়ে যায়৷ সেবাইতরা এই কাজ করেন নিষ্ঠা সহকারে কারন, তাদের ছোট থেকেই (১২ বছর হলেই) প্রশিক্ষন (ট্রেনিং) দেওয়া হয় এই ব্যাপারে। এরপর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তারা নিয়োজিত থাকে জগন্নাথদেবের ভোগ রান্নায়।

● জগন্নাথ দেবের রান্নায় সব সবজি লাগলেও কিছু সবজি একেবারেই নিষিদ্ধ যেমন – সাধারণ আলু (একমাত্র ক্ষামআলু ব্যবহার করা হয়), লঙ্কা, গাজর, রসুন, পিয়াজ, টমেটো প্রভৃতি।

● জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘরে প্রসাদ তৈরির সময় বিশুদ্ধতার খেয়াল রাখা হয়, পাশাপাশি প্রসাদ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় রান্নাঘরের কাছে দুটি কূপের মিষ্টি জল এবং এই কূপ দুটির নাম গঙ্গা-যমুনা। কথিত আছে, গঙ্গা আর যমুনা নদী একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে এই রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে, যদিও তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। কুয়াগুলির ব্যাস ১০ ফুট এবং গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট।

● আশ্চর্যের বিষয় এই পাকশালায় কোনো বৈদ্যুতিক বাতি নেই। কুপি বা তেলের ল্যাম্প জ্বেলে ঝুলিয়ে রাখা হয়। দক্ষ পাণ্ডারা এই রান্না করে যাচ্ছেন সেই অতীত থেকে আজ পর্যন্ত একই ভাবে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই মহাপ্রসাদের এমনই গুণ যে, ভক্ত হাজার হাজার হাজার হোক বা লাখ লাখ কোনও দিন সেখানে প্রসাদ বাড়তিও হয় না, আবার নষ্টও হয় না। 

● এই ঐতিহ্যবাহী রান্নার পদ্ধতিতে, লাল রঙের মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়, কোনো ধাতব পাত্র ব্যবহার করা হয় না। এই পাত্রগুলির আকর্ষণীয় নাম রয়েছে যেমন, বাই হাঁড়ি, সামাদি, বড়মাথা কুদুয়া, সনমাথা কুদুয়া, সনা তাদা, বড় তাদা, অধরা হাঁড়ি ইত্যাদি। এখানে কোন পুরাতন পাত্রে রান্না করা হয় না। প্রত্যেকদিন রান্নার জন্য নতুন পাত্রে রান্না করা হয়।

মহাপ্রসাদ রান্নার বিশেষ রীতি রয়েছে এখানে। মহাপ্রসাদ তৈরি করতে প্রধানত ৭টি (ক্ষেত্রবিশেষে ৯-১২টি) বড় মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয় এবং সেগুলো একটির ওপরে রাখা হয়। প্রসাদ তৈরিতে কাঠের আগুন ব্যবহার করা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো নিচে থাকে গনগনে উননের আগুন তা সত্বেও উপরের হাঁড়ির রান্না শেষ হয় সবার প্রথমে এবং তারপর নিচের পাত্রে এক এক করে খাবার রান্না হয়। এমন বিচিত্র লীলা ভগবানের দ্বারাই একমাত্র সম্ভব।

জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কথা

ভগবান নারায়ণের মহাপ্রসাদের একটুকরো কণা পেতে চান সকল ভক্তবৃন্দ, সেরকম একদিন নারদ মুনির ইচ্ছা হল মহাপ্রসাদ পাবার। কিন্তু সেই মহাপ্রসাদ এক ও একমাত্র পান লক্ষ্মী দেবী। তাহলে উপায় কী? এই ঘটনার মাধুর্যময় বর্ণন রয়েছে পুরাণ শাস্ত্রে। 

এক সময় নারদ মুনি ভগবান নারায়ণের দর্শন পেতে প্রতিদিন বৈকুণ্ঠধামে যেতেন, আর প্রভুকে দেখে ফিরে আসতেন। এই রুটিন প্রতিদিন চলত। একদিন নারদ মুনি দেখলেন মাতা লক্ষ্মীদেবী ভগবানকে খাবার পরিবেশন করছেন এবং সেই দেখে নারদ মুনির  ইচ্ছা হল ভগবানের মহাপ্রসাদ পাবার।

এই ভেবে তিনি লক্ষ্মী দেবীর কাছে শরণাপন্ন হলেন এবং অনুরোধ করলেন, “মাতা, আপনি আমাকে ভগবানের প্রসাদ দান করুন, তবে আমি কৃতার্থ হই।” কিন্তু মাতা লক্ষ্মী দেবী বলেন, “ভগবানের প্রসাদ পাওয়া এত সহজ নয়। এর জন্য ভগবানের নির্দেশ খুবই প্রয়োজন। আমি প্রভুর অনুমতি ছাড়া কাউকে সেই ভগবানের প্রসাদ দিতে পারি না।”

এরপর নারদ মুনি ভগবানকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ১২ বছর কঠোর তপস্যা করলেন, কিন্তু ভগবানের সন্তুষ্টি লাভ করা এত সহজ কাজ নয়। এত তপস্যা করেও ভগবানের প্রসাদ পেলেন না। তিনি হতাশ না হয়ে আবার ভাবতে লাগলেন “এখন এমন কি করা যায় যাতে ভগবানের প্রসাদ পেতে পারি!”

তখন নারদ মুনি পরিকল্পনা করলেন যে, আমি যদি এখন ভগবানের গৃহে সেবা করি, তাহলে হয়তো ভগবানের প্রসাদ পাব। এই ভেবে তিনি নারী রূপ ধারণ করলেন। শাড়ি পরিধান করে তিনি প্রতিদিন দুপুর ২টা-৩টায় আসতেন এবং বৈকুণ্ঠধাম সুসজ্জিত করে রাতের অন্ধকারে চলে যেতেন।

এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। লক্ষ্মীদেবী প্রতিদিন সকালে বৈকুণ্ঠধামকে নতুনভাবে সুসজ্জিত দেখে অবাক হতেন। তখন মাতা সিদ্ধান্ত নিলেন এমন কাজ যে করছে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। সেজন্য তিনি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন এমন ঘটনা দেখার জন্যে। তারপর দিনের ঠিক সময়ে, এক মহিলাকে ভগবানের ধাম পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে সুসজ্জিত করতে দেখলেন।

তখন লক্ষ্মীদেবী পেছন থেকে এসে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কে, আপনার পরিচয় কি? কেন আপনি প্রতিদিন নীরবে এসে বৈকুণ্ঠধাম সুসজ্জিত করেন? আপনার উদ্দেশ্য কি? এইভাবে একবারে অনেক প্রশ্ন মাতা লক্ষ্মীদেবী করে বসলেন।

তখন নারদ মুনি তার আসল রূপ ধারণ করে মাতা লক্ষ্মীদেবীকে বললেন “মাতা আমি নারদ। আমি ভগবানের প্রসাদ পাওয়ার মনোবাসনা নিয়ে ভগবানের সেবায় নিযুক্ত করছি। যাতে ভগবান সন্তুষ্ট হন এবং প্রসাদ দান করেন।” দেখেশুনে লক্ষ্মীদেবী অবাক হলেন, “দেবর্ষী তুমি দীর্ঘ ১২ বছর তপস্যা করেও প্রসাদ পাওনি আর এখন প্রসাদ পেতে পরিচর্যা করছ!”

তিনি তখন মাতাকে কাতর অনুরোধ করতে লাগলেন, তিনি যেন ভগবান নারায়ণের মহাপ্রসাদ অবশেষ কৃপা করে দেন। অনুরোধ শুনে লক্ষ্মী দেবীর মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। “আমার প্রিয় পুত্র, প্রভুর নির্দেশ ছাড়া আমি তোমাকে প্রসাদ দিতে পারব না, দয়া করে আমার কাছে ভগবানের প্রসাদ ছাড়া অন্য কিছু চাও”। নারদ প্রসাদ পেতে অবিচল ছিলেন। তিনি নারদ মুনিকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং তিনি তার আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য কী করা যেতে পারে তা দেখবেন। 

দেবী লক্ষ্মী দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পরবর্তীতে যখন তিনি খাবার পরিবেশন করছিলেন, তখন তিনি প্রভুর কাছে সমস্ত কিছু বর্ণনা করলেন  এবং প্রভু যেন দেবর্ষীর অনুরোধ গ্রহণ করেন। ভগবান নারায়ণ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে লক্ষ্মীদেবীকে হেসে বললেন, তুমি গিয়ে নারদের জন্য ৫৬ রকমের অন্ন তৈরি কর। তিনি কেবল একদিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করবেন এবং তিনি নারদকে নৈবেদ্য প্রসাদ দিতে পারবেন। লক্ষ্মী খুব খুশি হলেন।

এবং তিনি নারায়ণকে দেওয়া প্রসাদটি নারদকে দিলেন। যে মুহূর্তে নারদ প্রসাদ গ্রহণ করলেন, তিনি আনন্দিত মেজাজে চলে গেলেন। নিজেকে একেবারে ভুলে গিয়ে গান গাইতে শুরু করলেন। সমস্ত চৌদ্দ জগৎ পেরিয়ে সে তার পথ নাচিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেল কৈলাসে!

এরপর মাতা লক্ষ্মীদেবী ভগবানের অনুমতি পেয়ে ৫৬ ধরনের খাবার রান্না করে ভগবানকে অর্পণ করলেন। ভোগ খাওয়ার পর ভগবানের অবশিষ্ট প্রসাদ দেবর্ষীকে দিতে বললেন। তারপর মাতা লক্ষ্মীদেবী ভগবানের আদেশে নারদকে ভগবানের প্রসাদ দিলেন।

নারদমুনি খুব খুশি হয়ে পুরো প্রসাদটি খুব তৃপ্তির সাথে উপভোগ করলেন। প্রসাদ পাবার আনন্দে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ভগবানের পবিত্র নাম ‘নারায়ন’ জপ এবং পরম আনন্দে নাচতে লাগলেন। ভগবানের প্রসাদ গ্রহনের ফলে ভগবানের নাম জপের ফল কোটি গুণ বেড়ে গেল। উত্তেজিত ও আবেগতারিত হয়ে নারদ মুনি তার বীণাতে টান দিতে দিতে পাগলের মতো বৈকুণ্ঠধাম থেকে বিভিন্ন লোকে ছুটতে লাগলেন। অবশেষে তিনি শিবের আবাসস্থল কৈলাস পর্বতে পৌঁছলেন।

ভগবান শিব বিস্মিত হলেন দেবর্ষীকে এমন উচ্ছ্বসিত অবস্থায় জপ ও নৃত্যরত দেখে। ভগবান শিব নারদ মুনিকে শান্ত করলেন। “দেবর্ষী, আমি জানি আপনি সর্বদা পরমানন্দে থাকেন কারণ আপনি সর্বদা ভগবান নারায়ণের নাম জপ করেন। কিন্তু তোমাকে এমন অবস্থায়  কখনও দেখিনি! তোমার সাথে কি হল?”

তখন নারদ মুনি শান্ত হয়ে সব বুঝিয়ে বললেন। “প্রভুর মহাপ্রসাদ গ্রহনের পর আমার আনন্দ বহু গুনে বেড়ে গেছে। আমি নাচ এবং জপ থামাতে পারছি না। আমি ধন্য, নারায়ণ-নারায়ণ।” নারদ নিঃশ্বাসে চিৎকার করে বললেন। এরপর দেবাদিদেব শিব বললেন, “হে দেবর্ষী! তুমি অনেক সৌভাগ্যবান যে তুমি ভগবান নারায়ণের মহাপ্রসাদ আস্বাদন করেছ।” আশা নিয়ে তিনি বললেন “প্রিয় দেবর্ষী, আমিও সেই প্রসাদ উপভোগ করতে চাই, আমাকে প্রসাদের একটু ভাগ দাও।”

নারদ মুনি খুব দুঃখিত বোধ করে বললেন, “ভগবানের প্রসাদ খাওয়ার সময় নারায়ণের স্মরন ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারলাম না, মহাআনন্দে প্রতিক্ষিত মহাপ্রসাদ উপভোগ করেছি মাত্র।”

তখন শিবের দৃষ্টি নারদের হাতের নখের কোনায় পড়ল, প্রসাদের একটি টুকরো তার নখের সাথে আটকে আছে। মহাপ্রসাদের সেই ছোট্ট টুকরোটি ভগবান নারায়ণকে স্মরণ করে মহাদেব জিহ্বায় স্পর্শ করা মাত্রই তিনি প্রচন্ড আনন্দ থেকে মহাআনন্দ অনুভব করলেন, তখন তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। ভগবান নারায়ণে আরও মগ্ন হয়ে তিনি নৃত্য আরম্ভ করলেন। সময়ের সাথে পরমানন্দের তীব্রতা বাড়তে লাগল সাথে বাড়তে লাগল নৃত্য। তাঁর নৃত্য এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে তিনি তাণ্ডব প্রকাশ করেছিলেন, তাণ্ডব নৃত্য ধ্বংসের সময় নির্দেশ করে। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড কাঁপতে লাগল। সমস্ত দেবতারা আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে লাগল, ” দেবাদিদেবের কি এমন হল? কেন অসময়ে তিনি তাণ্ডব নৃত্য করছেন? এখন আর ধ্বংসের সময় নয়।”

শিবের ধ্বংসাত্মক নৃত্যতে বাধা দেওয়ার মতো সাহস কারোর ছিল না। দেবতারা মাতা পার্বতীর কাছে অনুরোধ করলেন প্রভুকে শান্ত করতে, অন্যথায় সমগ্র বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। মাতা পার্বতী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং স্বামী শিবকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আনন্দে তাণ্ডব নৃত্য করতে দেখেন। মাতা পার্বতী নম্রভাবে ভগবান শিবের কাছে গেলেন এবং যখন তিনি তার বাহ্যিক জ্ঞানে এলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রিয় নাথ! কিসের কারণে আপনি মহাআনন্দে নৃত্য করছেন, দয়া করে বলুন।”

শিব সম্পূর্ণ ঘটনাটি ব্যাখ্যা করলেন এবং তিনি কীভাবে নারদ মুনির কাছ থেকে ভগবান নারায়ণের মহাপ্রসাদ পেয়েছিলেন। পার্বতী দেবী অত্যাশ্চর্য হলেন। “হে নাথ, আপনি কি আমার জন্য কোন মহাপ্রসাদ রেখেছেন?” শিব নিরুত্তর রইলেন। তখন মাতা পার্বতী ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন “আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী হওয়া স্বত্বেও ভগবানের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হলাম। আপনি যদি একটি দানা পেতেন, তার অর্ধেক আমার কি প্রাপ্য ছিল না প্রভু?”

অবশেষে ব্রহ্মার নেতৃত্বে সমস্ত দেবতারা ভগবান নারায়ণকে জানাতে বৈকুণ্ঠে গেলেন। অবস্থা শুনে ভগবান গরুড়ের পিঠে চড়ে কৈলাসে যাত্রা করেন। ভগবানকে দেখে শিব ও নারদ শান্ত হলেন। কিন্তু পার্বতী তখনও ক্ষুব্ধ। ভগবান নারায়ণ তাকে সান্ত্বনা দেন এবং তার প্রসাদের একটি অংশের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মাতা পার্বতী বিনম্রতার সাথে আক্ষেপ প্রকাশ করেন “আপনার মহাপ্রসাদ আমার সমস্ত সন্তানকে, জীবিত সত্ত্বাকে দিতে অনুরোধ করছি। আপনার মহাপ্রসাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার মতো আমার সন্তানদের এমন কষ্ট দেখতে চাই না।”

মায়ের এমন আকুতিতে ভগবান তুষ্ট হলেন। তিনি পার্বতীকে প্রতিজ্ঞা করলেন “আমি কলিযুগে নীলাচলধামে (পুরী) দারু ব্রহ্ম রূপে অর্থাৎ কাঠের মধ্যে জীবনী শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হব। আমাকে চিনবে সকলে “জগন্নাথ” অর্থাৎ ‘জগতের নাথ’ রূপে। সেখানে আমার ৫৬ প্রকারের ভোগ তৈরি করা হবে, সেই ভোগ আমাকে নিবেদন করার পর সর্বপ্রথম প্রসাদটি  তোমাকে দেওয়া হবে। তাই তোমার মন্দিরও একই উঠানে স্থাপিত হবে। সেখানে তুমি “মাতা বিমলা দেবী” নামে বিখ্যাত হবে এবং তোমার সন্তানের দ্বারা পূজিত হবে। তোমার প্রসাদ গ্রহণ হলে সেই প্রসাদ মহাপ্রসাদে পরিণত হবে এবং বিনা পার্থক্যে সকলের কাছে সমানভাবে বিতরণ করা হবে। এই মহাপ্রসাদ পেয়ে সকল মানুষ ধন্য হবে এবং তাদের সকল পাপের অবসান হবে।

জগন্নাথ মন্দির চত্বরের ভিতরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোণে অবস্থিত বিমলা মন্দির। পাশেই রয়েছে পবিত্র রোহিণীকুণ্ড

পুরীধামে জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ গ্রহণের জন্য নীচ-উচ্চ-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই। জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ এতটাই শুদ্ধ যে শাস্ত্রমতে একজন ব্রাহ্মণ কুকুরের মুখ থেকে মহাপ্রসাদ নিতে পারে। এটি কখনই দূষিত হতে পারে না।

ভগবানের এই মহাপ্রসাদ পেতে দেবতাদেরও অনেক তপস্যা করতে হয়। আর আমরা সবাই ভগবান জগন্নাথদেবের কল্যাণে এই মহাপ্রসাদ অনায়াসেই পেতে পারি। এই মহাপ্রসাদের মহিমা অপরিসীম।

আজও মহাপ্রসাদের স্বাদ বাহিরে অনুকরণ করা যায় না। ভিতরের ভক্তদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, রান্নাঘর থেকে যখন ভোগকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তা অতি সাধারন তাতে কোনো সুগন্ধ (মিষ্টি সুবাস) থাকে না। কিন্তু মহাপ্রসাদ হবার পর যখন মন্দির থেকে বাইরে আনা হয়, তখন তা থেকে মিষ্টি সুগন্ধ বের হতে থাকে।

মহাপ্রসাদের আরেকটি নাম হল “কৈবল্য”, যা মোক্ষ, মোক্ষ বা মুক্তি দেয়। কথিত আছে যে, কেউ যদি ভগবান জগন্নাথদেবের এই খাবারটি গ্রহণ করেন তবে তিনি কেবল শারীরিক সুস্থতাই নয়, আধ্যাত্মিক জ্ঞানও প্রাপ্ত করেন।

কথিত আছে যে মাতা লক্ষ্মীদেবীর তত্বাবধানে ভোগ তৈরি হয়। যদি ভোগ তৈরিতে মাতা অসন্তুষ্ট হন, তবে একটি কুকুর রহস্যজনকভাবে মন্দিরের চত্বরে উপস্থিত হবে। যেহেতু কোনও কুকুরকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, এই কুকুরটিকে কুটামা চণ্ডী (KUTAMA CHANDI) বলা হয়, যা খাদ্য শুদ্ধির দায়িত্বে নিযুক্ত একজন তান্ত্রিক দেবী। কুকুর দেখা গেলে, সমস্ত খাবার পুঁতে ফেলতে হবে এবং আবার নতুন ভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

কেন ভগবানকে ৫৬ ভোগ (ছাপ্পান ভোগ) দেওয়া হয়?

ভগবানের এই মহাপ্রসাদে কেন মাত্র 56 ধরনের খাবার রাখা হয়েছে? কেন তা ৫৭ বা ৫৪ বা কমবেশি হয় না। এর মধ্যেও রয়েছে রহস্য।

ভাগবত পুরাণে ছাপ্পান ভোগের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তার আগে আমাদের জানা দরকার, ইন্দ্র কোন একজন দেবতার নাম নয়, এটি স্বর্গে দেবতাদের রাজার পদ বা উপাধি। যিনি এই সিংহাসনে বসেন তিনি ‘ইন্দ্র’ উপাধি পান। শাস্ত্র মতে, এখনও পর্যন্ত ১৪ জন ইন্দ্রের অভিষেক হয়েছে, যারা হলেন যজ্ঞ, বিপশ্চিত, শীবি, বিধু, মনোজব, পুরন্দর, বালী, অদ্ভুত, শান্তি, বিশ, ঋতুধাম, দেবাস্পতি এবং সুচি

এটাও সত্যি যে, ইন্দ্রের পদে যিনি বসেন, তিনি সর্বদায় হীনমন্যতায় ভোগেন যে তার সিংহাসন এই বুঝি কেউ ছিনিয়ে নিল।  যার কারণে তিনি কোনও সন্ন্যাসী ও রাজাকে ক্ষমতাবান হতে দেননি। তাদেরকে অপ্সরাদের দ্বারা মোহিত করার প্রচেষ্টা চালাত, কখনও বা রাজাদের যজ্ঞের ঘোড়া চুরি করে তিনি তাদেরকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা চালাত। আবার রাবন, মহিসাসুর থেকে অন্যান্য অসুরেরা ব্রহ্মা বা শিবের দ্বারা বরপ্রাপ্ত হয়েই প্রথমেই ইন্দ্রকে পদচ্যুত করে স্বর্গের সিংহাসন দখল করত। স্বর্গসুখ কেই বা হারাতে চায়! কেই বা পেতে না চায়!

দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লীলা বিলাস করেছিলেন বৃন্দাবনে। কৃষ্ণের অবতারের আগে, ব্রজধামে পূর্ণ আড়ম্বর সহকারে ইন্দ্রোৎসব পালিত হত। বৃন্দাবন বাসিন্দারা দেবরাজ ইন্দ্রকে (ঝড়বৃষ্টির ও বজ্রপাতের দেবতা) তুষ্ট করতে নিয়মিতভাবে প্রচুর অন্ন অর্পণ করতেন। যাতে ইন্দ্রদেব ক্রোধান্বিত না হয়ে পড়েন। তারা বিশ্বাস করতেন, ইন্দ্র তুষ্ট হলে যজ্ঞের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে মেঘ তৈরি করবেন, সেই মেঘ থেকে তিনি বৃষ্টি করাবেন, সেই বৃষ্টির জলে শস্যদানা অঙ্কুরিত হয়ে পোষণ লাভ করে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদিত হবে।

শ্রীকৃষ্ণ যখন সময়ের সাথে বেড়ে উঠলেন, ব্রজে ইন্দ্রের পূজা বন্ধ করে দেন। তিনি ব্রজবাসীদের বললেন তোমরা কোন দেবতার পূজা করো না বরং পরমেশ্বর ভগবানের সেবা কর। ব্রজবাসী জানান, ইন্দ্রের পূজা বন্ধ হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বৃষ্টি বন্ধ করে দেবে, তাহলে গরু চারণ হবে কী করে? এর জন্য কৃষ্ণ বললেন, আমরা কেন এমন দেবতার পূজা করব যে আমাদের ভয় দেখায়। যদি আমাদের নৈবেদ্য এবং পূজা করতেই হয়, তবে ইন্দ্রোৎসব নয়, গোবর্ধন পর্বতের পূজা করুন।

দেবরাজ ইন্দ্র যখন এই কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং বরুণদেবকে ব্রজবাসীদের উপর প্রলয়ের মতো বৃষ্টির আদেশ দেন, যাতে মানুষ ডুবে যায় এবং ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। ইন্দ্রের নির্দেশে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয় এবং বৃষ্টি তীক্ষ্ণ তীরের ফলার মতো ভেদ করে পড়তে লাগল। বন্যায় ঘরবাড়ি প্লাবিত হলে ব্রজবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়েন, তখন ছোট্ট কৃষ্ণ সকলকে তাদের পালিত পশুপাখি সমেত গোবর্ধন পর্বতে আশ্রয় নিতে বলে। সবাই তাদের পালিত গাভীদের নিয়ে পৌঁছে গেল গোবর্ধন পর্বতের পাদদেশে।

কৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে ইন্দ্র, তার যজ্ঞের সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে এমন প্রলয় ঘটাচ্ছে, এটি ইন্দ্রের ইচ্ছাকৃত ক্রোধের প্রদর্শনী। সে নিজেই নিজেকে সর্বোচ্চ মনে করে তার মহান ক্ষমতা দেখিয়েছে। আমি সকলের নিয়ন্ত্রাতা, আমি পরমেশ্বর এবং আমি  তার ক্ষমতার মিথ্যা অহঙ্কার কেড়ে নেব। সব দেবতারা আমার ভক্ত, আর তাই তাদের পক্ষে আমার আধিপত্য ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।  আমি বৃন্দাবনে আমার শুদ্ধ ভক্তদের সুরক্ষা দেব, যারা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে আমার করুণার উপর নির্ভরশীল। আমার অতীন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা আমি অবশ্যই তাদের রক্ষা করব।

যেই ভাবা সেই কাজ! সকলেই বিস্ময়ের সাথে দেখল, ছোট্ট কৃষ্ণ তার কনিষ্ঠ আঙুলে গোবর্ধন পর্বত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক যেমন একটি শিশু মাটি থেকে একটি মাশরুম তুলে নেয়। ফলে পর্বতের নিচে সকলে নিরাপদে আশ্রয় নেয়, যেখানে বৃষ্টি-বজ্রপাত-প্রলয়ের কোনো প্রভাব পড়েনি।

ক্ষুব্ধ ইন্দ্র ইন্দ্রলোক থেকে ঐরাবতে চড়ে বৃন্দাবনে এলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের উপর বজ্রাঘাত শুরু করলেন। কিন্তু সবই বিফলে, গোবর্ধন পর্বতের গায়েও সামান্যটুকু আঁচ লাগল না। পর্বতের নীচে ব্রজবাসীরা মহাআনন্দে রয়েছেন। এরপর ইন্দ্র বুঝতে পারলেন কেন কোন কিছুতেই তার বজ্র কাজ করছে না, যাকে তিনি ছোট্ট বালক ভেবেছিলেন তিনি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনি আদি পুরুষ, নচেৎ কেমন করে একটি বালক কনিষ্ঠ অঙ্গুলাগ্রে এত বিশাল পর্বত ধারণ করবেন? তিনি নিজ কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে শ্রী কৃষ্ণের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। প্রভু অহংকারে অন্ধ হয়েছিলাম, এখন বুজেছি আমার সীমাবদ্ধতা কতখানি। কৃষ্ণ অত্যন্ত দয়ালু, সুন্দর এবং করুণাময়, তিনি সর্বদা ভক্তদের রক্ষা করেন, ভুল হলে ক্ষমা করে দেন। অবশেষে, ইন্দ্র প্রত্যাবর্তন করলেন।

তখন থেকেই পৃথিবীতে ইন্দ্রের পূজা বন্ধ হয়ে যায় এবং গোবর্ধন পূজা শুরু হয়।

ইতিমধ্যে সাত দিন অতিক্রান্ত। এই সাত দিন ধরে কৃষ্ণ এক ইঞ্চি নড়াচড়া না করে, খাবারের একটি দানাও মুখে না নিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ আঙুলের অগ্রভাগের উপর পর্বতকে ধরে রেখেছিলেন। সঙ্কট মিটলে ভগবান গোবর্ধন পর্বতকে আবার যথাস্থানে রাখলেন। ততক্ষনে গ্রামবাসীরা কৃষ্ণকে ৫৬ রকমের বিশেষ ভোগ বা নৈবেদ্য দিয়ে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে ‘ছাপ্পান ভোগ’ প্রচলিত হয়।

কিভাবে 56 গণনা?

ভগবানকে দিনে ৮ বার ভোগ দেওয়া হয়।

তিনি ৭ দিন অনাহারে ছিলেন সুতরাং ৭ x ৮ = ৫৬

আজও প্রত্যেক দিন জগন্নাথ মন্দিরে ৫৬ প্রকার ভোগ তৈরি করা হয়।

আয়ুর্বেদ অনুসারে, ছয়টি মৌলিক স্বাদ রয়েছে: মিষ্টি (মধুর), টক (আমলা), মশলাদার (তিখতা), তিক্ত (কাতু), নোনতা (লাভান) এবং কষাকষি (কশায়)। কিন্তু এই ছয়টি মৌলিক স্বাদ ৫৬ ধরনের সংমিশ্রণ করতে পারে-তারই নাম ছাপ্পান ভোগ।”

ভগবানের নৈবেদ্যে কিছু জিনিস ব্যবহার করা হয় না। বিদেশ থেকে যা কিছু এসেছে, তার মানে যেগুলো প্রথম থেকেই ভারতে ছিল না, তারা অনেক পরে বিদেশ থেকে ভারতে এসেছে। যা নিম্নরূপ:

টমেটো – আলু – ভিন্ডি (ঢেঁড়স) – বাঁধাকপি – ফুলকপি – করলা – ছোলা- ক্যাপসিকাম – লঙ্কা – পেঁয়াজ – রসুন

এই সমস্ত জিনিস ভগবান জগন্নাথের প্রসাদে অন্তর্ভুক্ত নয়।

শ্রী জগন্নাথ লীলা: লাণ্ডিমাতার নিমপাতা বাটা

এক সময় পুরীধামে লাণ্ডিমাতা নামে একজন বৃদ্ধা থাকতেন, তিনি ছিলেন জগন্নাথদেবের এক অনুরক্ত ভক্ত। শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতি তার বিশেষ ভাব অন্তরে উদিত হয়েছিল, সেই ভাবভক্তির কারনে প্রভুকে তিনি তার পুত্র বলে ভাবতেন। প্রতিদিন লাণ্ডিমাতা প্রভুর জন্য কিছু নিমপাতা বাটা নিয়ে আসতেন। তিনি মনে মনে ভাবতেন, শ্রীজগন্নাথ প্রতিদিন আটবার ভোজন করেন, যার মধ্যে থাকে ছাপ্পান্ন রকমের অন্ন ব্যাঞ্জন, কতরকমের মিষ্টি, কত রকমের ঘি। তিনি অবশ্যই এত ধরণের গুরুপাক খাবার দাবার ভোজন করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এবং তার হয়তো কিছু পেটের সমস্যা হয়েছে। তাই যদি কিছু নিমপাতা বাটা খাওয়ানো যায় তাহলে তার পক্ষে তা খুবই ভালো হবে। এইরকম মনোভাব নিয়ে লাণ্ডিমাতা প্রতিদিন মন্দিরে যেতেন তার পুত্রকে নিমপাতা বাটা খাওয়াতে।

একদিন পাত্রটি হাতে নিয়ে লাণ্ডিমাতা মন্দির প্রবেশ দ্বারে পৌঁছালেন, কিন্তু মন্দির প্রবেশের আগেই কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষী তাকে আটকে দিয়ে বলল, “তোমার হাতে রাখা ওই পাত্রেতে কি নিয়ে ভেতরে যাচ্ছো?”

লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, “আমি আমার পুত্রের জন্য কিছু নিমপাতা বাটা নিয়ে যাচ্ছি।”

রক্ষী বলল, তোমার পুত্র কি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে? লাণ্ডিমাতা উত্তর দিলেন, “আমার পুত্র রত্নসিংহাসনে বসে আছে, তার চোখ দুটি বিশাল, সে আমার এই নিমপাতার তৈরী পদটি ভোজন করার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমাকে ভিতরে যেতে দাও।”

রক্ষী রেগে গিয়ে বৃদ্ধাকে বলল, “তুমি কি বলছো? জগন্নাথ তোমার ছেলে? প্রভু জগন্নাথদেবকে কত ধরণের অন্নব্যাঞ্জন নিবেদন করা হয় তা জানো। তোমার কি মনে হয় সেই সব ভোজন করে তিনি তৃপ্ত নন? তিনি কেবল তোমার ওই নিমপাতা বাটা ভোজনের জন্য অপেক্ষা করছেন?” নিরাপত্তারক্ষী লাণ্ডিমাতাকে মন্দিরের মধ্যে যেতে দিলেন না, উল্টে নিমপাতা বাটার পাত্রটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন।

ভগ্নহৃদয়ে লাণ্ডিমাতা তার কুটীরে ফিরে এলেন। আমার ছেলে নিশ্চয়ই তার এই নিমপাতার জন্য অপেক্ষা করে আছে, এমন ভাবতে ভাবতে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন। শ্রীজগন্নাথদেব লাণ্ডিমাতার অন্তরের ভাব উপলদ্ধি করলেন এবং তার সঙ্গে বাৎসল্য রস উপভোগ করার জন্য তিনি সেই রাত্রে তার কুটীরে আবির্ভূত হলেন। হঠাৎই এক উজ্জল আলোকপ্রভায় লাণ্ডিমাতার ঘরটি ভরে উঠল এবং তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন যে তার প্রিয় পুত্র জগন্নাথ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মুখটি বেশ শুষ্ক ও বিষাদগ্রস্ত।

জগন্নাথদেব বললেন, “মা আজ কত রকমের ভোগ, মিষ্টান্ন ভোজন করেছি। তাই ত আমার পেটে কষ্ট হচ্ছে, তুমি আমাকে একটু নিমপাতা বাটা দাও না মা।”

লাণ্ডিমাতার মন ভীষন খুশিতে এক অজানা তৃপ্তিতে ভরে গেল। তাড়াতাড়ি উঠৈ নিমপাতা বাটা আনতে পা বাড়ালেন এবং উত্তরে কিছু বলার চেষ্টা করলে কোনও উত্তর আসে না, তার আগেই জগন্নাথদেব তার গৃহ থেকে অন্তর্ধান হলেন। সেই রাতে প্রভু শ্রীজগন্নাথদেব পুরীর রাজার কাছে স্বপ্নে আর্বিভূত হলেন এবং তাকে বললেন, “রাজা! লাণ্ডিমাতা আমাকে তার পুত্র হিসাবে প্রীতি করেন। তিনি আমার মা, আর প্রতিদিন তিনি আমার জন্য অত্যন্ত প্রীতিসহকারে, অত্যন্ত যত্নে বাৎসল্যপ্রেম মিশ্রিত করে নিমপাতা বাটা নিয়ে আসেন। তোমার নিরাপত্তারক্ষী তাকে প্রবেশেদ্বারে থামিয়েছে এবং তার হাত থেকে নিমপাতা বাটার পাত্রটি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, তাতে আমি ব্যাথিত হয়েছি। কারন তার তৈরী নিমাপাতা বাটা খেতে আমি খুবই ভালোবাসি। আগামীকাল খুব ভোরে অবশ্যই তুমি তার কাছে যাবে এবং তাকে বলবে, সে যেন আমাকে ভোজন করাবার জন্য নিমাপাতা বাটা নিয়ে আসে।”

পরদিন খুব ভোরে রাজা তার মন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরের অনতিদূরে অবস্থিত লাণ্ডিমাতার ছোট্ট কুটিরে গেলেন। এত সকালে তার গরীব কুটিরে রাজা ও তার মন্ত্রিদের দেখে লাণ্ডিমাতা খুব অবাক হলেন। রাজা তাকে বললেন, “হে মাতা! মন্দিরের পাহারাদার রক্ষী আপনার প্রতি এক মহাঅপরাধ করেছে। আমি তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনার হাতে তৈরী নিমপাতা বাটা শ্রীজগন্নাথদেবের খুবই পছন্দ। আপনি শ্রীজগন্নাথদেবের একজন মহান ভক্ত এবং আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবতী যে তিনি আপনার বাৎসল্যপ্রীতির ভাবটি ভগবান গ্রহণ করেছেন এবং আপনাকে তিনি নিজে মাতা জ্ঞান করেন। আজ থেকে আপনার কুটীরটি লাণ্ডিমাতা মঠ নামে প্রসিদ্ধ হবে। এই স্থানটি একটি পবিত্র তীর্থ হিসাবে বিবেচিত হবে।

এই পৃথিবীতে আপনি যতদিন থাকবেন, প্রতিদিন আপনি শ্রীজগন্নাথদেবকে নিমপাতা বাটা খাওয়াবেন। এমনকি আপনি দেহত্যাগ করার পরেও আপনার স্মৃতিতে শ্রীজগন্নাথদেবকে এই পদটি নিবেদন করা হবে।” রাজার কাছ থেকে এমন প্রীতিপূর্ণ কথা শুনে লাণ্ডিমাতা তার সৌভাগ্যের কথা ভেবে খুবই আনন্দিত হলেন। ভক্তের আনন্দে আনন্দিত হলেন স্বয়ং ভগবান জগন্নাথদেব। 

বর্তমানে নিমপাতা বাটার পরিবর্তে জগন্নাথদেব ছাপ্পান্ন ব্যাঞ্জনপদ ভোজন করার পর তিতোভোগ নামে একটি পদ ভোজন করেন এবং তারপর মিঠিজল বা মিষ্টি জল পান করেন।

শ্রী জগন্নাথ লীলা: কর্মাবাঈয়ের খিচুড়ি ভোগ

কর্মাবাঈ নামে একজন মহিলা পুরীতে বাস করতেন। তিনি জগন্নাথকে নিজের পুত্র রূপে দেখতেন। জগন্নাথের বালক রূপের পুজো করতেন তিনি। একদিন কর্মাবাঈর মনে ইচ্ছা জাগল যে জগন্নাথকে ফল খেতে দেওয়ার পরিবর্তে নিজের হাতে কিছু রেঁধে তাঁকে ভোগ নিবেদন করবেন।

তিনি জগন্নাথকে নিজের ইচ্ছা সম্পর্কে জানালেন। তখন জগন্নাথদেব বললেন, “মা যাই বানিয়েছ, তাই খাইয়ে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

জগন্নাথদেবের ইচ্ছায় মাতা আনন্দিত হলেন। কর্মাবাঈ খিচুড়ি বানিয়ে ছিলেন এবং জগন্নাথকে তাই সস্নেহে খেতে দিলেন। জগন্নাথদেব পরমানন্দে সেই খিচুড়ি খেতে শুরু করলেন। তখন কর্মাবাঈ জগন্নাথকে পাখা করতে শুরু করলেন। গরম খিচুড়ি……
খেতে গিয়ে যদি জগন্নাথের মুখ পুড়ে যায়…… তা ভেবে কর্মাবাঈ জোরে জোরে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন ।

জগন্নাথ সেই গরম খিচুড়ি খেয়ে এতটাই খুশী হয়েন যে তিনি বলেই ফেললেন, “মা! খিচুড়ি খেতে খুব ভালো। তোমার হাতের খিচুরি অতুলনীয়। আমার জন্য তুমি রোজ খিচুড়ি রান্না করে দেবে। আমি রোজ এখানে এসে খিচুড়ি খেয়ে যাব।”

কর্মাবাঈ রোজ স্নান না-করেই খুব সকালে উঠে পুত্র জগন্নাথের জন্য খিচুড়ি রান্না করতেন। আর জগন্নাথ দেব তাঁর বালকরূপ ধরে সেখানে গিয়ে খিচুড়ি খেয়ে আসতেন।

এভাবে বেশ ভালোই চলছিল।

হঠাৎ একদিন কর্মাবাঈর বাড়িতে এক সাধু এলেন। তিনি দেখলেন কর্মাবাঈ স্নান না করেই খিচুড়ি বানিয়ে জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদন করছেন। তিনি কর্মাবাঈকে এমন করতে নিষেধ করে দিলেন। আর সেই সাথে জগন্নাথের ভোগ রান্না ও নিবেদনের বিশেষ নিয়ম বলে দিলেন।

পরের দিন সাধুর কথামতো কর্মাবাঈ স্নান সেরে নিয়ম মেনে যখন জগন্নাথ দেবকে খিচুড়ি ভোগ দিলেন তখন বেলা গড়িয়ে মন্দিরে দুপুরের ভোগের সময় হয়ে গিয়েছিল।

এদিকে সকাল থেকে কিছু না খেতে পেয়ে জগন্নাথের খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল। খিচুড়ি হতেই ক্ষুধার্থ জগন্নাথ হাপুস হুপুস করে সেই খিচুড়ি খেয়ে নিলেন। মন্দিরের পুরোহিতরা দেখলেন যে জগন্নাথ কিছু খাচ্ছেন না।তাঁর মুখে খিচুড়ি লেগে রয়েছে।

তখন তাঁরা জগন্নাথদেবকে জিগ্যেস করলেন কেন তিনি এরকম করছেন? 

উত্তরে জগন্নাথদেব সেই সাধুর গেঁড়োপাকামি কীর্তিকাহিনী ব্যক্ত করলেন।

জগন্নাথের মুখে সমস্ত কথা শুনে মন্দিরের পুরোহিতেরা খুব লজ্জিত এবং অনুতপ্ত হলেন। তাঁরা তখন কর্মাবাঈয়ের কাছ গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং বললেন “মাতা কর্মাবাঈ! আপনি আগের মতোই সকালে স্নান না-করে জগন্নাথের জন্য খিচুড়ি রান্না করবেন এবং ভোগ নিবেদন করবেন।”

আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সকালে বালক ভোগে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। মনে করা হয় এটি কর্মাবাঈয়ের খিচুড়ী l

—–জয় জগন্নাথ

শ্রী জগন্নাথ লীলা মহিমা: লক্ষ্মীদেবী ও শ্রীয়া চণ্ডালিনী

অগ্রহায়ণ মাসে উড়িষ্যার অধিবাসীগণ লক্ষ্মীদেবীর বিশেষ পূজা করে থাকেন। এই মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার গৃহের মহিলারা বিবিধ নিয়ম-রীতি ও উপচার সহকারে সাড়ম্বরে লক্ষ্মীদেবীর পূজার আয়োজন করে থাকেন। ঐদিন লক্ষ্মীদেবী শ্রীজগন্নাথের অনুমতিক্রমে মন্দির থেকে বাইরে আসেন তাঁর ভক্তদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

একবার অগ্রহায়ণ মাসের এক শুভ বৃহস্পতিবারের সকালে লক্ষ্মীদেবী এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন গৃহ পরিদর্শন করতে গেলেন। এক বণিক-গৃহে গিয়ে দেখলেন, তাঁরা তখনও শয্যাত্যাগ করে নি, সেজন্য তাঁদের বাড়ীঘরও পরিষ্কার করা হয় নি। তিনি ঐ গৃহের এক মহিলাকে ঐ বিশেষ দিনে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা করার গুরুত্ব বোঝালেন। কিন্তু ঐ বৃদ্ধা লক্ষ্মীদেবীর কথায় কর্ণপাত না করায় তিনি তাঁদের গৃহ থেকে সকল ঐশ্বর্য অপহরণ করলেন এবং ক্রমশঃ ঐ পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র হয়ে পড়ল এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহন করল।

তারপর লক্ষ্মীদেবী একটি গ্রামে গেলেন যেখানে চণ্ডালেরা থাকে। তিনি শ্রীয়া চণ্ডালিনীর গৃহে গেলেন। তিনি ঐদিন ব্রত পালন করেছেন, তাই খুব ভোরে উঠে সমস্ত গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে লক্ষ্মীদেবীর পূজার উদ্দেশ্যে আল্পনাদি দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন। এসব দেখে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে আরও ধন ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ করে সকল মনস্কামনা পূর্ণ করলেন।

ইতিমধ্যে ভগবান শ্রীজগন্নাথ ও প্রভু বলদেব প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে লক্ষ্মীদেবীকে চণ্ডালের গৃহ থেকে প্রত্যাবর্তন করতে দেখলেন। এতে বলদেব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে জগন্নাথদেবকে কঠোর ভাষায় বললেন – “তোমার স্ত্রী আজকাল চণ্ডালের গৃহে যাচ্ছে। তারা অপবিত্র, সদাচারহীন – কোনো বিধিনিয়ম পালন করে না। কিভাবে এমন চণ্ডালের গৃহে যাবার পর ইনি আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন? আমাদের মন্দির অপবিত্র হয়ে যাবে। তোমাকে অবশ্যই তাঁকে পরিত্যাগ করতে হবে।” জগন্নাথ বলদেবকে এই বলে শান্ত করার চেষ্টা করলেন যে লক্ষ্মীদেবীকে এইবার মার্জনা করা হোক এবং আর কখনও এমন না করার জন্য সাবধান করা হবে। কিন্তু বলরাম তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন যে তাঁকে আর মন্দিরে প্রবেশের অনুমোদন দেয়া হবে না। “তুমি যদি লক্ষ্মীদেবীকে প্রবেশের অনুমতি দাও, তাহলে তোমার আমাকে ছাড়তে হবে। আমি মন্দিরের বাইরে অবস্থান করব।” যেহেতু জগন্নাথের অগ্রজ ভাইয়ের প্রতি অত্যন্ত বাধ্য, সেজন্য তিনি শ্রীবলরামের আজ্ঞা পালন করে লক্ষ্মীদেবীকে ডেকে বললেন যে তাঁর মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই।

জগন্নাথদেবের মুখ থেকে একথা শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। বিবাহের সময় শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর পিতার এই কথায় সম্মত হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর স্ত্রী-কৃত দশটি অপরাধ ক্ষমা করবেন। তাছাড়া তাঁর এই গ্রাম পরিদর্শন অপরাধমূলক ছিল না, কেননা সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়েছিল যে মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ) মাসের বৃহস্পতিবার তিনি তাঁর ভক্তদের আশিস (শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ) দান করার জন্য গ্রামগুলি পরিদর্শন করতে বাইরে যেতে পারেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হল। এর ফলে তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিতা হলেন এবং জগন্নাথদেবকে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে আগামী ১২ বছর তিনি নিজেকে পরিতৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট আহার্য পাবেন না এবং তিনি কেবল লক্ষ্মীদেবীর রন্ধন করা ও পরিবেশন করা খাদ্যদ্রব্য ভোজন করতে সমর্থ হবেন। জগন্নাথকে অভিশাপ দানের পর তিনি যখন তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ত্যাগ করলেন, তখন মন্দির ঐশ্বর্যশূণ্য, শ্রীহীন হয়ে উঠল। ভাণ্ডারঘর শূণ্য হল।

পরদিন সকালে জগন্নাথ ও বলরাম প্রাতরাশের (Breakfast) জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কিছুই এল না। বলরাম জগন্নাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের প্রাতরাশের কি হল? এত বিলম্ব হচ্ছে কেন?” জগন্নাথ উত্তরে বললেন, “কোনও প্রাতরাশ তৈরি করা হয় নি, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল পরিচারিকাসহ মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেজন্য রান্না করার কেউ নেই এখানে।” তখন বলরাম ও জগন্নাথ কিছু আহার্য প্রস্তুত করার জন্য রন্ধনশালায় প্রবেশ করলেন। মন্দির থেকে তাঁদের দেবীকে বরখাস্ত করায় ক্রোধান্বিতা হয়ে লক্ষ্মীদেবীর অনুচরগণ রন্ধনশালার সমস্ত উনুনগুলি ভেঙে দিয়ে গেছে। তারা দু’ভাই রান্নার কিছু উপকরণ সংগ্রহের জন্য ভাণ্ডাঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, ঘর শূণ্য, কিছুই নেই সেখানে, কেননা লক্ষ্মীদেবী তাঁর সকল শ্রী-ঐশ্বর্য মন্দির থেকে অপসৃত করেছিলেন। সেই সময় দুই ভ্রাতা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লেন। লক্ষ্মীদেবীর উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং ক্ষুধায় ক্লিষ্ট হয়ে, তাঁরা উভয়ে ভিক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে মনস্থ করলেন।

আমাদের জানতে হবে যে যদিও ভগবানই সকল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর এবং প্রত্যেকের পালনকারী, তবুও তিনি একজন সাধারণ ভিক্ষুকের মতো ভিক্ষা করতে যাওয়ার এই বিশেষ লীলাটি করেছিলেন তাঁর ভক্তের মহত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য। এইভাবে শ্রীজগন্নাথ ও শ্রীবলদেব দুজন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করে গৃহে গৃহে ভিক্ষা করার জন্য নগরে গেলেন। লক্ষ্মীদেবী থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাঁদের উভয়কেই অত্যন্ত অসহায়, বিষাদগ্রস্ত, অশুভ দেখাচ্ছিল এবং সেজন্য কেউই তাঁদের ভিক্ষা দিচ্ছিলেন না।

ইতিমধ্যে, লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে সূর্যদেব সূর্যের তাপ বৃদ্ধি করেছিলেন। দুই ভাইকেই অত্যন্ত উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়ে অত্যন্ত কষ্ট করে হাঁটতে হচ্ছিল। তাঁরা একটি সুন্দর পুষ্করিণী দেখতে পেয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কাছাকাছি আসামাত্র জল শুকিয়ে গেল। ফল শুকিয়ে পচে যায়। অবশেষে তাঁরা বৃক্ষের কচিপাতা ভক্ষণের উদ্দেশ্যে বৃক্ষের কাছে যাওয়া মাত্রই বৃক্ষের পত্ররাজি শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। উভয়েই খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত, তাঁরা মন্দিরে এতই ঘন ঘন ভোজন করতেন যে একবার ভোজনের পর হাত ধোওয়া মাত্রই পরবর্তী ভোজনের সময় সমাগত হত। সেদিন সারাদিন অতিবাহিত হল, কিন্তু তাঁরা কিছুই ভোজন করতে পারলেন না।

শীঘ্রই তাঁরা একটি মন্দিরে গেলেন যেখানে তখন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছিল। বহু মানুষ সেখান থেকে প্রসাদ নিয়ে গৃহে ফিরছিল। জগন্নাথ ও বলরাম প্রসাদসহ প্রত্যাগমনরত মহিলাদের একজনের কাছে গেলে দয়াবশতঃ তিনি তাঁদেরকে কিছু প্রসাদ দিতে সম্মত হলেন। তাঁর কাছে কিছু নিবেদন করা মুড়ি প্রসাদ ছিল, তিনি তাঁদেরকে যেই একমুঠো মুড়ি দিতে যাবেন, ঠিক তখনই লক্ষ্মীদেবীর নির্দেশে প্রবল দমকা বাতাস এসে সমস্ত মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেল। দুই ভাই কিছু আহার পাওয়ার এই সুযোগটিও হারালেন।

পরিশেষে, কোথায় আহার্য পাওয়া যাবে এ সম্বন্ধে লোকদের জিজ্ঞেস করলে তাঁদের একজন তাঁদেরকে চণ্ডালদের গ্রামে যেতে বলল, সেখানে অত্যন্ত দানশীল একজন ব্যক্তি থাকেন। জগন্নাথ ও বলরাম সেই গৃহে গিয়ে কিছু আহার্য চাইলেন। গৃহস্থ তাঁদের ভোজন করাতে পারবেন জেনে অত্যন্ত প্রীত হলেন, কিন্তু বলরাম একজন চণ্ডালের রান্না করা আহার্য ভোজন করতে সম্মত হলেন না। বরং তিনি নিজেই রান্না করে আহার্য প্রস্তুত করবেন বলে গৃহস্থকে কিছু অরন্ধিত আহার্যদ্রব্য ও রান্নার সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে বললেন। একটি নতুন উনুন তৈরি করে দেওয়া হল এবং রান্নার জন্য নূতন কিছু মাটির পাত্র তাঁদের দেওয়া হল। জগন্নাথ রান্না শুরু করার জন্য প্রস্তুত হলেন – কিন্তু কিছুতেই উনুনে আগুন ধরাতে পারলেন না, আহার তৈরীর কথা তো বলাই বাহুল্য।

বলরাম জগন্নাথকে তাঁর অপারদর্শিতার জন্য ভৎর্সনা করলেন এবং নিজে আহার্য প্রস্তুত করতে গেলেন। কিন্তু যখন বলরাম কাঠে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলেন, কাঠ কিছুতেই জ্বলল না, কেবল প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হতে লাগল। তাঁদের চোখ থেকে জল পড়তে লাগল,আর সকলেই কাশতে লাগল। তখন বলরাম ও জগন্নাথ গৃহপতিকে কিছু রান্নাকৃত খাবার আনতে বললে গৃহের পরিচারিকারা দুই ভাইকে আহার্য পরিবেশন করলেন। তাঁরা যখন ভোজন করেছিলেন, তখন তাঁরা সহমত হলেন যে ঐ খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু, বস্তুতঃ মন্দিরে পরিবেশিত আহার্যের মতোই সুস্বাদু, যেখানে লক্ষ্মীদেবী রান্না করেন। ভোজনের শেষে তাঁদের কিছু সুস্বাদু পিঠে পরিবেশন করা হল। সচরাচর মন্দিরে ভোজনের শেষে লক্ষ্মীদেবী তাঁদের বিশেষ পিঠে খেতে দিতেন। লক্ষ্মীদেবী অবশ্যই এই গৃহে বিরাজ করছেন – জগন্নাথ ও বলরাম ভাবলেন। অন্য কেউ কিভাবে জানতে পারবে যে তাঁরা ভোজনের শেষে বিশেষ পিঠে আহার করেন? জগন্নাথের অগ্রজ হওয়ায় বলরাম লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারতেন না, কেননা তিনি তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী; উড়িষ্যায় এটাই রীতি। বলরাম জগন্নাথকে লক্ষ্মীদেবীর নিকটে গিয়ে মার্জনা চাইতে এবং হাত ধরে তাঁকে মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে অনুরোধ করলেন। তিনি লক্ষ্মীদেবীকে বলতে বললেন যে তাঁর ভক্তবৃন্দকে পরিদর্শন করতে মন্দিরের বাইরে যেতে আর কখনোই বাধা দেবেন না আর তিনি যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারবেন, তবে সর্বদা তাঁকে মন্দিরে ফিরে আসতে হবে।

জগন্নাথের নিকট সবকিছু শ্রবণ করে লক্ষ্মীদেবী পরিতৃপ্ত হলেন। তিনি জগন্নাথকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে জগন্নাথের প্রসাদ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে উঁচু জাতি বা নিচু জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য করা হবে না। অদ্যাবধি জগন্নাথ মন্দিরে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলকে প্রসাদ পরিবেশন করা হয়। এখানে ব্রাহ্মণ ও চণ্ডাল এক পাত্রে প্রসাদ ভোজন করতে পারেন।

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.