এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি ভগবদগীতা মাহাত্ম্য (Bhagavad Gita Mahatmya) ও তার তাৎপর্য ।
শ্রীল প্রভুপাদ “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ” গ্রন্থের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেই ভগবদ্গীতার মূলভাব ব্যক্ত হয়েছে।
আমরা যখন কোন ঔষধ খাই, তখন যেমন আমরা আমাদের ইচ্ছামতো সেই ঔষধ খেতে পারি না, ডাক্তারের নির্দেশ বা ঔষধের শিশিতে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে সেই ঔষধ খেতে হয়, তেমনই ভগবদ্গীতাকে গ্রহণ করতে হবে ঠিক যেভাবে তার বক্তা তাঁকে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ভগবদ্গীতার বক্তা হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবদ্গীতার প্রতিটি পাতায় বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। ভগবদ্গীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবানবলে স্বীকার করে নিতেই হবে। স্বীকার করে নিয়ে বিনম্র মনোভাব সহকারে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবদ্গীতা পড়লে আমরা সহজে বুঝতে পারব এবং অন্তরে গীতার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারব। যদি এই মনোভাব নিয়ে গীতা গ্রন্থটি না পড়ি তা হলে আমাদের কাছে এই অমূল্য শাস্ত্রগ্রন্থটি চিরকালই ভীষণ রহস্যাবৃত হয়ে থাকবে।
সংসারসাগরং ঘোরং ত্যক্তুমিচ্ছতি যো নরঃ।
গীতানাবম্ সমাসাদ্য পারম্ যাতি সুখেন সঃ।।
অনুবাদ : যে ব্যক্তি ঘোর সংসার-সাগর থেকে উত্তীর্ণ হতে চান, তিনি গীতারূপ নৌকার আশ্রয়ে সুখেই পার হতে পারেন।
যোহধীতে বিষ্ণুপর্বাহে গীতাং শ্রীহরিবাসরে।
স্বপন্ জাগ্রৎ চলনতিষ্ঠন্ শত্রুভির্ন ন হীয়তে ।।
অনুবাদ : যে ব্যাক্তি বিষ্ণুপর্বদিনে বিশেষত শ্রীহরিবাসর তিথি একাদশীতে গীতা অধ্যয়ন করেন, তিনি নিদ্রিত বা জাগ্রত অবস্থায় গমন বা অবস্থান কালে কখনই শত্রু দ্বারা পরাভুত হয় না ।
শালগ্রামশিলায়াং বা দেবাগারে শিবালয়ে।
তীর্থে নদ্যাম্ পঠেদ্গীতাং সৌভাগ্যম্ লভতে ধ্রুবম্ ৷৷
অনুবাদ : যিনি শালগ্রামশিলার সামনে, দেবাগারে বা শিবালয়ে, তীর্থে ও নদীতটে গীতা পাঠ করেন, তিনি নিশ্চিত সৌভাগ্য লাভের অধিকারী হন।
■ ভগবদগীতা মাহাত্ম্য (Bhagavad Gita Mahatmya) ■
ভগবদ্গীতা আসলে কি? ভগবদ্গীতার উদ্দেশ্য হচ্ছে অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। প্রতিটি মানুষই নানাভাবে কষ্ট পাচ্ছে। যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় অর্জুন এক মহাসমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অর্জুন ভগবানের কাছে আত্মসমপর্ণ করার পর ভগবান তাঁকে ভগবদগীতার দিব্য বানী দান করে মোহমুক্ত করলেন।
এই জড় জগতে কেবল অর্জুনই নন, আমরা প্রত্যেকেই সর্বদাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জর্জরিত — তাই আমরা সকলে যদি ভগবদগীতা পড়ি, ভগবদগীতার জ্ঞান লাভ করি এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করি এটাই হলো সবচেয়ে বড় ভগবদগীতার মাহাত্ম্য। কেননা গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে হয় বা গঙ্গাদেবী তাকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু ভগবদ্গীতা নিজেই ঘরে ঘরে গিয়ে ভক্তের মুক্তির মার্গ উন্মুক্ত করে দেন। গঙ্গায় যে স্নান করে সে অন্যকে পবিত্র করতে পারে না কিন্তু গীতারুপিনী গঙ্গাতে যে ডুব দিয়েছে সে নিজে যেমন মুক্ত ও পবিত্র হয়ে থাকে তেমনি অন্যকেও মুক্ত হতে বা পবিত্র হতে সাহায্য করে। যদিও গঙ্গা ভগবানের চরণ থেকে উৎপন্ন এবং ভগবদগীতা সাক্ষাৎ ভগবানের মুখপদ্ম হতে নিঃসৃত।
ভগবান স্বয়ং বলেছেন বরাহপুরাণে —
গীতাশ্রয়েহহম্ তিষ্ঠামি গীতা মে চ উত্তমম্ গৃহম্ ।
গীতাজ্ঞানমুপাশ্রিত্য ত্রিলোকান্ পালয়াস্যহম্ ॥
অনুবাদ : “আমি গীতার আশ্রয়ে থাকি। গীতা আমার শ্রেষ্ঠ গৃহ। গীতার জ্ঞানকে আশ্রয় করেই আমি ত্রিলোক পালন করি।”
এছাড়াও শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৩য় অধ্যায়ের ৩১ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন —
যে মে মতম্ ইদম্ নিত্যম্ অনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তঃ অনসূয়ন্তঃ মুচ্যন্তে তে অপি কর্মভিঃ ॥
অনুবাদ : আমার নির্দেশ অনুসারে যে সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরা কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন। ─── (ভগবদ্গীতা ৩।৩১)
শুধু তাই নয়, শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৮ অধ্যায়ের ৭০ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
অধ্যেষ্যতে চ যঃ ইমম্ ধৰ্ম্যম্ সংবাদম্ আবয়োঃ ।
জ্ঞান যজ্ঞেন তেন অহম্ ইষ্টঃ স্যাম্ ইতি মে মতিঃ ॥
অনুবাদ : আর যিনি আমাদের উভয়ের এই পরিত্র কথোপকথন অধ্যয়ন করবেন, তাঁর সেই জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা আমি পূজিত হব। এটিই আমার অভিমত। ─── (ভগবদ্গীতা ১৮। ৭০)
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকলের উদ্দেশ্যে আবেদনই হোক বা নির্দেশই হোক যাই হোক না কেন স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করেছেন যে যদি কেউ তাঁর এবং অর্জুনের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের রনাঙ্গনের অব্যয় নিস্কাম যোগের শিক্ষাটি শুধুমাত্র অধ্যয়ন করেন তাহলে তার সেই অধ্যবসায়ই কৃষ্ণ পূজা বলে বিবেচিত হবে। অর্থ হলো এই যে এত সহজ পদ্ধতিতে পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা যে করা যায় তা শুধুমাত্র পরম করুণাময় ভগবানই ব্যক্ত করতে পারেন অন্য আর কেউ নয়।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা হলো ৭০০ শ্লোক এবং আঠারোটি অধ্যায় সমন্বিত এক শাস্ত্র গ্রন্থ যা পরমেশ্বর ভগবানের নিজমুখ নিসৃত বাণী যেটি জীবজগতের অভিধান স্বরূপ।
গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্ বিনিঃসৃতা ৷৷
অনুবাদ : স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান পদ্মনাভের মুখপদ্ম বিনিঃসৃত পরম বাণীসমৃদ্ধ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করাই পরম কর্তব্য। তা পাঠ করার পর অন্যান্য শাস্ত্র পাঠ করার প্রয়োজন পড়ে না। ─── (গীতা মাহাত্ম্য-৪)
গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়মিতভাবে ভগবদগীতা শ্রবণ ও কীর্তন করলে আমাদের অন্তর্নিহিত সুপ্ত আধ্যাত্মিক চেতনার (ভগবদ্ভক্তির) বিকাশ হয়। বর্তমান জগতে মানুষেরা অলস ও নানা রকম কাজে এতই ব্যস্ত থাকে যে, তাদের পক্ষে সমস্ত বৈদিক সাহিত্য পাঠ করা সম্ভব নয়। সমস্ত বৈদিক সাহিত্য পড়বার প্রয়োজনও নেই। এই একটি গ্রন্থ ভগবদগীতা পাঠ করলেই মানুষ সমস্ত বৈদিক জ্ঞানের সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারবে, কারণ ভগবদগীতা হচ্ছে বেদের সার এবং এই গীতা স্বয়ং ভগবানের মুখনিঃসৃত উপদেশ বাণী৷
ব্যবহারিক জীবনদর্শন কি হওয়া উচিত তা এই শাস্ত্ৰ গ্রন্থের আঠারটি অধ্যায়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণিত হয়েছে। মানব জীবনের সকল প্রকার সমস্যা বা তার সমাধান সম্বন্ধে অতি প্রাঞ্জল ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বিভিন্ন দিকে ধাবিত না হয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে, একটি শাস্ত্র, একটিমাত্র ভগবান এবং একটি বৃত্তির কথা এই শাস্ত্রে বলা হয়েছে যাতে সমগ্রবিশ্বের মানুষ বিচলিত, দিশাহীন এবং উদ্ভ্রান্ত না হয়।
একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্
একো দেবো দেবকীপুত্র এব ।
একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি
কর্মাপ্যেকম্ তস্য দেবস্য সেবা ৷৷
অনুবাদ :
● “একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্” — অর্থাৎ দেবকীর পুত্র শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা গীত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য হোক একক শাস্ত্র।
● “একো দেবো দেবকীপুত্র এব” — অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বচরাচরে শ্রীকৃষ্ণই হলেন এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভগবান।
● “একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি” — অর্থাৎ একক মন্ত্ৰ, একক প্রার্থনা, একক স্তোত্র হোক তাঁর নাম কীর্তন –
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
● “কর্মাপ্যেকং তস্য দেবস্য সেবা”— অর্থাৎ সমস্ত মানুষের তাঁর শ্রীপাদপদ্মে অর্পিত সেবাই ভগবৎ-সেবা বা জীবের একমাত্র কর্ম।
─── (গীতা মাহাত্ম্য-৭)
■ ভগবদ্গীতার জ্ঞান (Bhagavad Gita Gyan) কি সকলের জন্য ? ■
এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন গীতার জ্ঞান কি সকল বর্ণের, সকল আশ্রমের বা সকল জাতির লোক গ্রহণ করতে পারে? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৯ম অধ্যায়ের ৩২ নং শ্লোকে এই গুহ্যজ্ঞান ভগবান প্রদান করেছেন —
মাম্ হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যে অপি স্যুঃ পাপয়োনয়ঃ।
স্ত্ৰিয়ো বৈশ্যাঃ তথা শূদ্রাঃ তে অপি যান্তি পরাম্ গতিম্।।
অনুবাদ : হে পার্থ! যারা আমাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করে, তারা স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র আদি নীচকুলে জাত হলেও অবিলম্বে পরাগতি লাভ করে। ─── (ভগবদ্গীতা ৯।৩২)
এই শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ উল্লেখ করেছেন ভক্তিযোগ সকলেরই সমান অধিকার, এতে কোন জাতি-কুল আদির ভেদাভেদ নেই। জড়-জাগতিক জীবন ধারায় এই প্রকার ভেদাভেদ আছে। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি অপ্রাকৃত সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তির কাছে তা নেই।
এক সময় বিদেশ থেকে এক উড়োজাহাজ আসছিল ভারতে। সেই সময় কোন কারণবশতঃ উড়োজাহাজটি ডিসব্যালেন্স হয়ে যায় আর সমস্ত যাত্রীরা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো আর সেই সময় একজন বিদেশী ভক্ত ছিলেন তিনি নির্ভয়ে খুব জোরে জোরে হরিনাম করতে শুরু করলেন, মুখে এক উজ্জ্বল প্রশান্তির চিহ্ন — উনি উচ্চস্বরে বললেন জোরে জোরে আমার সঙ্গে হরিনাম করুন—বিপদ চলে যাবে—সত্যি তাই হলো।
সকলে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি ভাবে নির্ভয়ে ছিলেন?” ভক্তটি উত্তর দিলেন গীতা পড়ার ফলে — এটাই গীতার জ্ঞান লাভ করার মাহাত্ম্য। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৮ম অধ্যায়ের ৬ নং শ্লোকে ভগবান কথা দিয়েছেন
যম্ যম্ বা অপি স্মরন্ ভাবম্ ত্যজতি অন্তে কলেবরম্ ।
তম্ তম্ এব এতি কৌন্তেয় সদা তৎ ভাব ভাবিতঃ ৷৷
অনুবাদ : হে কৌন্তেয়, অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন। ─── (ভগবদ্গীতা ৮।৬)
আর সব থেকে বড় কথা, হরিনাম করতে করতে যদি কেউ দেহ ত্যাগ করবে, আর কখনও এই জড় জগতে সে ফিরে আসবে না (গীতা ১৫/৬নং শ্লোক) তাহলে আর কখনও জাহাজ থেকে পড়ে অকাল মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না—তাই আপনারা সকলেই শ্রীল প্রভুপাদের গীতা পড়ুন আর গীতা পড়ার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করুন।
ন তৎ ভাসয়তে সূর্যঃ ন শশাঙ্কঃ ন পাবকঃ।
যৎ গত্বা ন নিবর্তন্তে তৎ ধাম পরমম্ মম ৷৷
অনুবাদ : পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধাম — কৃষ্ণলোক বা গোলোক বৃন্দাবনে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না, আমার সেই পরম ধামকে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আলোকিত করে না। ─── (ভগবদ্গীতা ১৫।৬)
■ ভগবদ্গীতা পাঠের মাহাত্ম্য (Benefits of Reading Bhagavad Gita) ■
ভগবদ্গীতার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হলে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে স্বীকার করে নিতেই হবে। স্বীকার করে নিয়ে বিনম্র মনোভাব সহকারে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভগবদ্গীতা পড়লে আমরা সহজে বুঝতে পারব এবং অন্তরে ভগবদ্গীতার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারব।
শাস্ত্রে বহু জায়গায় গীতার মাহাত্ম্য উল্লেখ আছে তবে স্কন্দ পুরাণে অবন্তি খণ্ডে শ্রীল ব্যাসকৃত গীতা মাহাত্ম্য (৬) উল্লেখ আছে।
গীতোধ্যায়ঃ পঠেদ্ যস্তু শ্লোকম্ শ্লোকা ধর্মের বা।
ভবপাপবিনির্মুক্তো যাতি বিষ্ণোঃ পরম্ পদম্।।
অনুবাদ : যিনি গীতার একটি অধ্যায়, একটি শ্লোক কিংবা অর্ধ শ্লোক মাত্র পাঠ করেন, তিনি সংসার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুধামে গমন করেন।
শ্রীশঙ্করাচার্য প্রণীত গীতা মাহাত্ম্য উল্লেখ আছে—
গীতাশাস্ত্রমিদম্ পুণ্যম্ যঃ পঠেৎ প্রযতঃ পুমান্ ।
বিষ্ণোঃ পদমবাপ্নোতি ভয়শোকাদিবর্জিতঃ ।। ১ ।।
অনুবাদ : শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নির্দেশকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে পারলে, অতি সহজেই সমস্ত ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এই জীবনে ভয় ও শোকাদি থেকে মুক্ত হয়ে পরবর্তী জীবনে বিষ্ণুপাদপদ্মে চিন্ময় স্বরূপ অর্জন করা যায়।
গীতাধ্যায়নশীলস্য প্রাণায়ামপরস্য চ।
নৈব সন্তি হি পাপানি পূৰ্বজন্ম কৃতানি চ ৷৷ ২ ৷॥
অনুবাদ : কেউ যদি আন্তরিকভাবে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভগবদ্গীতা পাঠ করে, তা হলে ভগবানের করুণায় তার অতীতের সমস্ত পাপকর্মের ফল তার উপর আর কার্যকর হবে না।
মলনির্মোচনম্ পুংসাম্ জলস্নানম্ দিনে দিনে।
সকৃদ্গীতান্তসি স্নানং সংসারমলনাশনম্ ৷৷ ৩৷৷
অনুবাদ : প্রতিদিন জলে স্নান করে মানুষ নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু কেউ যদি ভগবদ্গীতার গঙ্গাজলে একটি বারও স্নান করে, তা হলে তার জড় জীবনের মলিনতা একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।
যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্ বিনিঃসৃতা ৷৷ ৪ ৷৷
অনুবাদ : স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান পদ্মনাভের মুখপদ্ম বিনিঃসৃত পরম বাণীসমৃদ্ধ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ করাই পরম কর্তব্য। তা পাঠ করার পর অন্যান্য শাস্ত্র পাঠ করার প্রয়োজন পড়ে না।
ভারতামৃতসর্বস্বং বিষ্ণোর্বক্ত্রাদ বিনিঃসৃতম্ ।
গীতাগঙ্গোদকং পীত্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ৷৷ ৫॥
অনুবাদ: ভগবদ্গীতা মহাভারতের অমৃতরস, যা আদিবিষ্ণু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলে গেছেন। গঙ্গাজল পান করলে নিশ্চিতভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, আর যিনি ভগবদ্গীতার পুণ্য পীযূষ পান করেছেন, তাঁর পুনর্জন্ম কখনই হবে না।
সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ৷৷ ৬ ৷৷
অনুবাদ : সমস্ত উপনিষদের সারাতিসার এই গীতোপনিষদ্, ভগবদ্গীতা ঠিক একটি গাভীর মতো এবং রাখাল বালকরূপে প্রসিদ্ধ ভগবান শ্রীকৃষ্ণই এই গাভীকে দোহন করেছেন। অর্জুন যেন ঠিক গোবৎসের মতো এবং জ্ঞানীগুণী ও শুদ্ধ ভক্তেরা ভগবদ্গীতার সেই অমৃতময় দুগ্ধ পান করে থাকেন।
একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্
একো দেবো দেবকীপুত্র এব ।
একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি
কর্মাপ্যেকম্ তস্য দেবস্য সেবা ৷৷ ৭ ৷৷
অনুবাদ :
● “একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্” — অর্থাৎ দেবকীর পুত্র শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা গীত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য হোক একক শাস্ত্র।
● “একো দেবো দেবকীপুত্র এব” — অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বচরাচরে শ্রীকৃষ্ণই হলেন এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভগবান।
● “একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি” — অর্থাৎ একক মন্ত্ৰ, একক প্রার্থনা, একক স্তোত্র হোক তাঁর নাম কীর্তন –
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
● “কর্মাপ্যেকং তস্য দেবস্য সেবা”— অর্থাৎ সমস্ত মানুষের তাঁর শ্রীপাদপদ্মে অর্পিত সেবাই ভগবৎ-সেবা বা জীবের একমাত্র কর্ম।
—- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ, ভক্তিবেদান্ত স্বামী শ্রীল প্রভুপাদ
■ ভগবদগীতার জ্ঞান কাউকে দান বা প্রচার করলে কি লাভ হয় ? ■
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন,
🌀১/
যঃ ইদম্ পরমম্ গুহ্যম্ মৎ ভক্তেষু অভিধাস্যতি ৷
ভক্তিম্ ময়ি পরাম্ কৃত্বা মাম্ এব এষ্যতি অসংশয়ঃ ৷৷
অনুবাদঃ যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এ পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ দান করলে, তিনি অবশ্যই পরাভক্তি লাভ করে নিঃসন্দেহে আমার কাছে ফিরে আসবেন। ─── (ভগবদ্গীতা-১৮/৬৮)।
🌀২/
ন চ তস্মাৎ মনুষ্যেষু কশ্চিৎ মে প্রিয়কৃত্তমঃ ৷
ভবিতা ন চ মে তস্মাৎ অন্যঃ প্রিয়তরঃ ভুবি ৷৷
অনুবাদঃ এ পৃথিবীতে মানুষের মতো তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার আর কেউ নেই এবং তার চেয়ে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর কেউ হবে না। ─── (ভগবদ্গীতা-১৮/৬৯)।
■ ভগবদগীতার ১৮ অধ্যায়ের উপকারিতা (Bhagavad Gita Chapter Wise Benefits) ■
গীতার সমস্ত অধ্যায় সমূহ বিশ্লেষণ করলে আমরা জীবন দর্শনের একটি স্পষ্ট এবং সাবলীল রূপ রেখা দেখতে পাই।
● ১ম অধ্যায় (বিষাদযোগ) পাঠ করলে ব্যাক্তির মন পবিত্র হয়।
● ২য় অধ্যায় (সাংখ্যযোগ) পাঠে নির্মলতা লাভ করে।
● ৩য় অধ্যায় (কর্মযোগ) পাঠে সর্বপাপ দূর হয়।
● ৪র্থ অধ্যায় (জ্ঞানযোগ) পাঠে ব্রহ্মহত্যা ও স্ত্রীহত্যাজনিত পাপ তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে যায়।
● ৫ম অধ্যায় (কর্মসন্ন্যাসযোগ) পাঠ করলে চৌর্যমহাপাপ দূর হয়।
● ৬ষ্ঠ অধ্যায় (ধ্যানযোগ) পাঠে মন্দ ভাগ্য নাশ হয়।
● ৭ম অধ্যায় (বিজ্ঞানযোগ) পাঠে বুদ্ধি নির্মলতা লাভ করে।
● ৮ম অধ্যায় (অক্ষরব্রহ্মযোগ) পাঠে অখাদ্য ও অপেয়জাত সকল প্রকার পাপ দূর হয়।
● ৯ম অধ্যায় (রাজগুহ্যযোগ) পাঠে পৃথিবী দানের মত সম্পূর্ণ লাভ হয়।
● ১০ম অধ্যায় (বিভূতিযোগ) পাঠে সর্বপাপ বিনষ্ট হয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান প্রাপ্ত হয়।
● একাদশ অধ্যায় (বিশ্বরূপযোগ) পাঠে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে মুক্তি লাভ হয়।
● দ্বাদশ অধ্যায় (ভক্তিযোগ) পাঠে ভগবানের প্রতি বিশুদ্ধ ভক্তি জন্মায়।
● ত্রয়োদশ অধ্যায় (প্রকৃতিপুরুষবিবেকযোগ) পাঠে জ্ঞানচক্ষু বিকাশের ফলে মুক্তিলাভ হয়।
● চতুর্দশ অধ্যায় (গুণত্রয়বিভাগযোগ) পাঠে অশ্বমেধ যজ্ঞের মহাফল লাভ করা যায়।
● পঞ্চদশ অধ্যায় (পুরুষোত্তমযোগ) পাঠে নির্মল জ্ঞান লাভ করে যোগী হওয়া যায়।
● ষোড়শ অধ্যায় (দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ) পাঠে মানবজাতি সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করে।
● সপ্তদশ অধ্যায় (শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ) পাঠে ভক্তজনের রাজপেয় নামক যজ্ঞের ফল লাভ করে।
● অষ্টাদশ অধ্যায় (মোক্ষযোগ) পাঠে জ্ঞানরূপ অগ্নি দ্বারা পাপ দূরীভূত হয়।
১ম (প্রথম) অধ্যায় — বিষাদযোগ
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সেনা পর্যবেক্ষণ
কুরুক্ষেত্রের রনাঙ্গনে অপেক্ষমান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে, মহাবাহো অর্জুন উভয় পক্ষের সৈন্য সজ্জার মধ্যে উপস্থিত তার সমস্ত আত্মীয় পরিজনদের, আচার্যবর্গ, বন্ধু বান্ধবদের সকলকে যুদ্ধাভিলাসী হয়ে উন্মত্ত দেখে শোকে, দুঃখে, করুনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে তিনি যুদ্ধ না করার সংকল্প নিলেন অর্থাৎ অজ্ঞানতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে প্রকৃত কর্তব্য কর্ম থেকে চ্যুত হলেন ঠিক যেমন প্রতিটি জীব তার ব্যবহারিক জীবনে এই রকম অজ্ঞানতার ফলে কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পড়ে। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থা থেকে স্থায়ী মুক্তিলাভের জন্য গীতা উপদেশ শুরু করলেন।
২য় ( দ্বিতীয়) অধ্যায় — সাংখ্যযোগ
গীতার বিষয়বস্তুর সারমর্ম পরিবেশিত
“ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ করলেন যে যুদ্ধ পরিত্যাগ করার দ্বারা অর্জুন অন্যদেরকে আত্মারূপে দেখতে অক্ষম হচ্ছেন, তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং তিনি একজন স্থিতপ্রজ্ঞ যোগী হতে পারবেন না।”
বিভ্রান্তি এবং সিদ্ধান্তহীনতার শিকার হয়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পন করেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি ভগবানের কাছে এর সমাধানের জন্য প্রার্থনা করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অনিতা জড় দেহ এবং শাশ্বত চিন্ময় আত্মার মূল পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে অর্জুনকে উপদেশ দিতে থাকেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে নিষ্কাম (নিঃস্বার্থ) সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞান লাভের পন্থা ও মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সিদ্ধান্ত দেন “স্থিত্বাসামন্ত কালেহপি ব্রহ্মনির্বানমৃচ্ছতি” জীবনের সমস্ত রকম কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে নিস্পৃহ নিরহঙ্কার ও মমত্ব বোধ রহিত হয়ে ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ করে এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবতধামে প্রবেশ করা যায়।
৩য় (তৃতীয়) অধ্যায় — কর্মযোগ
কৃষ্ণভাবনা মগ্ন হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, “প্রত্যেক ব্যক্তিকেই অনাসক্ত হয়ে, উচ্চতর উদ্দেশ্যগুলো মনে রেখে কর্ম করতেই হবে; অন্যথায় সে সর্বগ্রাসী কাম নামক দুর্জয় শত্রুর শিকার হবে”।
এই জড়জগতে প্রত্যেককেই কোন না কোন কাজে সর্বদা নিযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কর্ম সকল মানুষকে এই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করতেও পারে আবার তা থেকে মুক্ত করে দিতেও পারে। ইন্দ্রিয় তৃপ্তির চিন্তা বর্জন করে পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কর্ম করার মাধ্যমে মানুষ তার কর্মের কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে এবং আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব সম্বন্ধে দিব্য জ্ঞান লাভ করতে পারে।
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ অন্যত্র লোকঃ অয়ম্ কর্মবন্ধনঃ।
তৎ অর্থম্ কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।
অনুবাদ: বিষ্ণুর প্রীতিবিধান করার জন্যই কেবল কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ হয়। হে কৌন্তেয়, তাই তাঁর সন্তুষ্টিবিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদা বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। ─── (ভগবদ্গীতা ৩।৯)
জড় জীবনে আমরা স্বাভাবিকভাবেই কামপ্রবৃত্তি ও জড় প্রকৃতিকে ভোগ করবার ইচ্ছার দ্বারা প্রভাবিত হই। জড় প্রকৃতির উপর আধিপত্য করা এবং জড় ইন্দ্রিয় উপভোগ করার বাসনা বদ্ধজীবের চরম শত্রু; কিন্তু কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করার ফলে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমাদের কার্যকলাপ এবং কর্তব্যকর্মগুলিকে মুহূর্তের মধ্যে হয়তো ত্যাগ করা সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের অন্তরে কৃষ্ণভাবনার বিকাশ হবার ফলে আমরা সুচিন্তিত উন্নত বুদ্ধির মাধ্যমে জড় ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে শুদ্ধ পারমার্থিক (আধ্যাত্মিক) স্তরে স্থিত হতে পারি। উন্নত বুদ্ধিযোগের দ্বারা কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন করলে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
ভগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে (৪৩ শ্লোকে) ভগবান বলছেন —
এবম্ বুদ্ধেঃ পরম্ বুদ্ধা সংস্তভ্য আত্মানম্ আত্মনা ৷
জহি শত্রুম্ মহাবাহো কামরূপম্ দুরাসদম্ ৷৷
অনুবাদ: হে মহাবীর অর্জুন, এভাবে নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধির ঊর্ধে জেনে সুচিন্তিত উন্নত বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং চিন্ময় শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর। ─── (ভগবদ্গীতা ৩।৪৩)
৪র্থ (চতুর্থ) অধ্যায় — জ্ঞানযোগ
অপ্রাকৃত পারমার্থিক (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের প্রকাশ
ভগবান বললেন অর্জুনকে, “মানুষকে এই কাম জয় করার উপায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি অনন্তকাল ধরে যুগে যুগে নানা দিব্য রূপে এই জড় জগতে অবতীর্ণ হই, যে জ্ঞান এখন আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করব এবং তা গুরু-শিষ্য পরম্পরাক্রমে চলতে থাকবে” ।
আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ তত্ত্ব এবং ভগবান ও সাধারণ জীবাত্মার সম্পর্ক —এই অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তি দানকারী। এই প্রকার জ্ঞান হলো নিষ্কাম ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার পরম্পরা ধারার ইতিহাস এবং এই অব্যয় জ্ঞান বিতরণের জন্য জড়জগতে যুগে যুগে তাঁর অবতরনের উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য এবং কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সদ্গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করছেন এবং সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে একমাত্র গুরুদেবই তার আশীর্বাদদ্বারা আধ্যাত্মিক সিদ্ধি প্রদান করতে পারেন।
তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানম্ জ্ঞানিনঃ তত্ত্ব দর্শিনঃ।।
অনুবাদ: সদ্গুরুর শরণাগত হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা কর। বিনম্রচিত্তে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট কর। তা হলে সেই তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষ তোমাকে জ্ঞান প্রদান করবেন। ─── (ভগবদ্গীতা ৪।৩৪)
৫ম (পঞ্চম) অধ্যায় — কর্মসন্ন্যাসযোগ
কর্মফল পরিত্যাগের মাধ্যমে আনন্দপ্রাপ্তি
ভগবান আরো বললেন, “আমার জন্য কর্ম করলে কর্তার বৈরাগ্য পূর্ণতা লাভ করে, কারণ ভগবান হিসেবে আমিই সমস্ত কর্মের প্রকৃত ভোক্তা, সকলের মালিক, এবং সকলের সর্বোত্তম সুহৃদ।”
সুতরাং আপাতদৃষ্টির বিচারে আমরা সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল ভগবানের উদেশ্যে পরিত্যাগ করার মাধ্যমে জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নির দ্বারা পরিশুদ্ধ হয়ে শান্তি, নিরাসক্তি, সহনশীলতা, চিন্ময় অন্তর্দৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।
ভোক্তারম্ যজ্ঞ তপসাম্ সর্বলোক মহেশ্বরম্।
সুহৃদম্ সর্বভূতানাম্ জ্ঞাত্বা মাম্ শান্তিম্ ঋচ্ছতি।।
অনুবাদ: আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তিলাভ করেন। ─── (ভগবদ্গীতা ৫।২৯)
৬ষ্ঠ (ষষ্ঠ) অধ্যায় — ধ্যানযোগ
ভক্তিযোগের মাধ্যমে ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হওয়া
“যদিও অষ্টাঙ্গ যোগ ও ধ্যানের কঠিন পথ ক্রমান্বয়ে অবশেষে আমাতেই এসে উপনীত হয়, কিন্তু আমার প্রতি অর্পিত ভক্তিমূলক কর্ম যোগীকে তৎক্ষণাৎ আমার সাথে সংযুক্ত করে এবং সেই কারণে ভক্তই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।”
“যদিও অষ্টাঙ্গ যোগ ও ধ্যানের কঠিন পথ ক্রমান্বয়ে অবশেষে আমাতেই এসে উপনীত হয়, কিন্তু আমার প্রতি অর্পিত ভক্তিমূলক কর্ম যোগীকে তৎক্ষণাৎ আমার সাথে সংযুক্ত করে এবং সেই কারণে ভক্তই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী”।
কঠিন নিয়মের দ্বারা ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন, মন-ইন্দ্ৰিয় সমূহ নিয়ন্ত্রণ এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে একাগ্র করা এবং পরিশেষে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।
তাই ভগবানের সিদ্ধান্ত হলো —
তপস্বিভ্যঃ অধিকঃ যোগী জ্ঞানিভ্যঃ অপি মতঃ অধিকঃ।
কর্মিভ্যঃ চ অধিকঃ যোগী তস্মাৎ যোগী ভব অর্জুন ।।
অনুবাদ: যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। অতএব হে অর্জুন, সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও। ─── (ভগবদ্গীতা ৬।৪৬)
যোগের অর্থ পরম তত্ত্বের (ভগবানের) সঙ্গে চেতনার সংযোগ। বিভিন্ন অনুশীলনকারীরা ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ বিশেষ পন্থা অবলম্বন করে এই যোগ সাধনা সম্পন্ন করেন। যেমন, কর্মের মাধ্যমে কেউ যখন চেতনাকে ভগবানের সঙ্গে সংযুক্ত করেন, তখন তাকে বলা হয় কর্মযোগ; পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে তা করলে তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ এবং ভক্তির মাধ্যমে যখন ভগবানের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ। সমস্ত যোগের চরম পরিণতি বা পরম পূর্ণতা হচ্ছে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনা।
ভক্তিযোগ হচ্ছে পরম তত্ত্বজ্ঞান এবং তাই তাকে কোন কিছুই অতিক্রম করতে পারে না। আত্মতত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত তপশ্চর্যা নিরর্থক অর্থাৎ ভগবানে শরণাগতি না হলে গবেষণামূলক জ্ঞানও নিরর্থক। আর কৃষ্ণভাবনা ব্যতীত সকাম কর্ম (কামনা বাসনা যুক্ত কর্ম) কেবল সময়ের অপচয়মাত্র। তাই সমস্ত যোগের মধ্যে এখানে ভক্তিযোগকেই শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৭ম (সপ্তম) অধ্যায় — বিজ্ঞানযোগ
পরম তত্ত্বের সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান
ভগবান বললেন, “আমাতে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে কর্ম করল সেই যোগী সর্বত্র, এমনকি আমার নিকৃষ্টা জড়া শক্তিতেও আমাকে দেখতে পান, যার ফলে তিনি আর মনোধর্মী জল্পনা-কল্পনা বা নানাবিধ দর্শনের দ্বারা বিচলিত হন না।”
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমতত্ত্ব, সর্ব কারণের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সকল বস্তুর প্রাণশক্তি। পরম জ্ঞানীগণ ভক্তি সহকারে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন পক্ষান্তরে আসুরিক ভাবাপন্ন ব্যক্তিরা (অধার্মিক জীবাত্মারা) অন্যান্য জড় বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে রাখে, এই সমস্ত মূঢ় ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিবর্গ কখনো ভগবানকে জানতে পারে না— “মূঢ়ঃ অয়ম ন অভিজানাতি।”
সাধিভূত অধিদৈবম্ মাম্ সাধিযজ্ঞম্ চ যে বিদুঃ।
প্রয়াণকালে অপি চ মাম্ তে বিদুঃ যুক্তচেতসঃ।।
অনুবাদ: যাঁরা অধিভূত তত্ত্ব, অধিদৈব তত্ত্ব ও অধিযজ্ঞ তত্ত্বসহ আমাকে পরমেশ্বর ভগবান বলে অবগত হন, তাঁরা আমাতে আসক্তচিত্ত, এমনকি প্রয়াণকালেও তাঁরা আমাকে জানতে পারেন। ─── (ভগবদ্গীতা ৭।৩০)
৮ম (অষ্টম) অধ্যায় — অক্ষরব্রহ্মযোগ
পরম তত্ত্ব লাভ
“যে ব্যক্তি আজীবন আমার জন্য কর্ম করেন তিনি মৃত্যুকালে আমাকে স্মরণ করতে পারেন, যার ফলে তাকে আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরতে হয় না এবং এটা এমন একটা মহত্তর ফল যা তপস্যা, দান, যজ্ঞ বা দেবদেবীর উপাসনা থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ।”
সমগ্রজীবন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণের মাধ্যমে বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাকে স্মরণ করে মানুষ জড় জগতের উর্দ্ধে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।
বেদেষু যজ্ঞেষু তপঃসু চ এব দানেষু যৎ পুণ্যফলম্ প্রদিষ্টম্ ।
অত্যেতি তৎ সর্বম্ ইদম্ বিদিত্বা যোগী পরম্ স্থানম্ উপৈতি চ আদ্যম্ ।।
অনুবাদ: ভক্তিযোগ অবলম্বন করলে তুমি কোন ফলেই বঞ্চিত হবে না। বেদপাঠ, যজ্ঞ অনুষ্ঠান, তপস্যা, দান আদি যত প্রকার জ্ঞান ও কর্মের সাধন আছে, সেই সমুদয়ের ফল যোগী বা ভক্ত ভক্তিযোগ দ্বারা লাভ করে আদি পরম ধাম প্রাপ্ত হন। ─── (ভগবদ্গীতা ৮।২৮)
৯ম (নবম) অধ্যায় — রাজগুহ্যযোগ
গূঢ়তম জ্ঞান
“আমিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সর্বব্যাপ্ত হলেও স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে বিদ্যমান থাকি, সবকিছুতে থেকেও কোনখানেই নেই এবং আমার ভক্তের অর্পিত প্রীতিপূর্ণ সরল আহার্য ও সেবার দ্বারা তাঁদের প্রেমে বাঁধা পড়ে যাই।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য। কেবলমাত্র অপ্রাকৃত অপ্রাকৃত ভগবৎ-সেবা (প্রেমময়ী দিব্য সেবা) বা ভক্তির মাধ্যমে প্রত্যেক জীবাত্মা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। মানুষের শুদ্ধভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরমধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।
শ্রীকৃষ্ণ সাধারণ কোন মানুষ নন, তিনি স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। তাঁর দেহ, তাঁর মন ও তিনি স্বয়ং অদ্বয় পরম তত্ত্ব। তাঁর শ্রীঅঙ্গ জড় নয়, তিনি সম্পূর্ণ সচ্চিদানন্দময়। শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা উচিত প্রেমভক্তি সহকারে। তাকেই বলা হয় ভক্তি। প্রত্যেকের নিরন্তর কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করা উচিত। সেই অনুশীলনটি কিভাবে করা উচিত? সদ্গুরুর প্রশিক্ষনে শিক্ষাগ্রহণ করাই কৃষ্ণতত্ত্বের অনুকূল অনুশীলন।
মধুর কৃষ্ণকথা মানুষের মধ্যে ভক্তির সঞ্চার করে এবং মানুষকে ভক্ত হতে সহায়তা করে। তা না করে যদি কোন অবাঞ্ছিত ব্যক্তির কাছে কৃষ্ণতত্ত্ব জানবার চেষ্টা করা হয়, তা হলে সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। “
কিছু মানুষ জনসাধারণকে কৃষ্ণভক্তি থেকে বিপথগামী করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। কিছু আসুরিকভাবাপন্ন মানুষও শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করে; কিন্তু তাদের চিন্তা শ্রীকৃষ্ণের মাতুল কংসের মতোই বিদ্বেষপূর্ণ। তার সব সময় উদ্বেগ হতো যে, কখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে হত্যা করতে আসবেন। কংসও সদাসর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করত, কিন্তু সে শ্রীকৃষ্ণকে শত্রুরূপে চিন্তা করত। এই ধরনের নেগেটিভ চিন্তার কোন ফল লাভ হয় না।
মন্মনাঃ ভব মৎ ভক্তো মৎ যাজী মাম্ নমস্কুরু।
মাম্ এব এষ্যসি যুত্বৈবম্ আত্মানম্ মৎপরায়ণঃ ।।
অনুবাদ: তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে প্রণাম কর। এভাবে আমাতে উৎসর্গীকৃত হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিবিষ্ট হলে নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে। ─── (ভগবদ্গীতা ৯।৩৪)
১০ম (দশম) অধ্যায় — বিভূতিযোগ
পরব্রহ্মের ঐশ্বর্য
“হে অর্জুন, এই জগতে যা কিছু সর্বোত্তম বস্তু রয়েছে তার মধ্যে তুমি আমাকে দেখতে পার, যদিও সেগুলো আমার বিভূতির অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।”
জড় জগত বা চিন্ময় জগতের শ্রী, শৌর্য, আড়ম্বর, উৎকর্ষ এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয় শ্রীকৃষ্ণের দিব্য অচিন্ত্য শক্তি ও পরম অনন্ত ঐশ্বর্যাবলীর আংশিক প্রকাশ মাত্র। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে প্রত্যেকটি অনুপরমাণুর মধ্যে তিনি পরমাত্মারূপে প্রবিষ্ট হয়ে এই জড় জগতের সর্বত্র বিরাজমান। সর্ব কারণের পরম কারণ, সব বিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে শ্রীকৃষ্ণ সর্বজীবের পরমারাধ্য বিষয়।
তাই ভগবান এখানে অর্জুনকে বলছেন যে, ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকপূর্ণ এই জগতের কোন কিছুর সম্বন্ধে জানার কোন প্রয়োজন নেই। এটিই কেবল জানতে হবে যে, সব কিছুরই অস্তিত্ব রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। মহোত্তম জীব ব্রহ্মা থেকে শুরু করে একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়ে পর্যন্ত সকলেরই অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে ভগবান তাদের মধ্যে পরমাত্মারূপে প্রবেশ করার জন্য এবং তিনিই তাদের সকলকে প্রতিপালন করছেন।
যে কোন দেবদেবীর আরাধনা করে পরমেশ্বর ভগবানের কাছে বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে বলে অনেকে প্রচার করে থাকে। কিন্তু এখানে দেবদেবীদের পূজা করতে সম্পূর্ণরূপে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ ব্রহ্মা ও শিবের মতো শ্রেষ্ঠ দেবতারাও কেবল ভগবানের অনন্ত বিভূতির অংশমাত্র। ভগবানই সকলের উৎস এবং তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। তিনি অসমোর্ধ্ব, অর্থাৎ তাঁর সমান অথবা তাঁর থেকে ঊর্ধ্বে আর কেউ নেই। পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেবদেবীর সমান বলে মনে করে — এমনকি তাঁরা ব্রহ্মা বা শিব যেই হোন না কেন — তা হলে সে তৎক্ষণাৎ নাস্তিকে পরিণত হয়।
শুদ্ধ ভক্তেরা তাই সর্বতোভাবে ভগবৎ-সেবার মাধ্যমে তাঁদের মনকে কৃষ্ণচেতনায় কেন্দ্রীভূত করেন; সেভাবেই তাঁরা সর্বদা অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত থাকেন।
অথবা বহুনা এতেন কিম্ জ্ঞাতেন তব অর্জুন।
বিষ্টভ্য অহম্ ইদম্ কৃৎস্নম্ এক অংশেন স্থিতো জগৎ।।
অনুবাদ: হে অর্জুন, এই প্রকার বহু জ্ঞানেরই বা কি প্রয়োজন? আমি আমার এক অংশের দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে সমগ্র জগতে স্থিত আছি। ─── (ভগবদ্গীতা ১০।৪২)
১১শ (একাদশ) অধ্যায় — বিশ্বরূপদর্শনযোগ
ভগবানের দিব্য ঐশ্বর্যের প্রকাশ
“হে পার্থ, তোমার প্রার্থনা অনুসারে তুমি দিব্য চক্ষুর দ্বারা আমার অতি অদ্ভুত, অত্যাশ্চার্য ও মহাকালসহ দর্শন করো, যদিও সেই রূপ আমার দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপ হতে অনেক নিকৃষ্ট।”
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করলেন এবং তাঁর সম্মুখে ভগবান চিত্তাকর্ষক অনন্ত বিশ্বরূপ প্রকাশ করলেন। এই রূপেই তিনি তাঁর দিব্যতত্ত্ব, অসীমত্ব, সর্বব্যপ্ততা অবিসংবাদিত ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি আদিদেব, পুরাণপুরুষ এবং এই বিশ্বের পরম আশ্রয়, তিনি সব কিছুর জ্ঞাতা, তিনিই জ্ঞেয় এবং গুণাতীত পরম ধাম স্বরূপ। সমগ্র জগত তাঁর অনন্ত রূপদ্বারা পরিব্যাপ্ত। শ্রীকৃষ্ণ এখানে প্রতিপন্ন করেছেন যে, তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যময় মানব রূপই (দ্বিভূজক্তমুরলীধর গোপবেশ বেণুকর রূপই) তাঁর আদিরূপ। একমাত্র অনন্য ভক্তি বা শুদ্ধ ভগবত সেবার মাধ্যমেই জীব ভগবানের এই রূপের উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম হয়।
মৎকর্মকৃৎ মৎপরমঃ মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ ৷
নির্বেরঃ সর্বভূতেষু যঃ সঃ মামেতি পাণ্ডব ৷৷
অনুবাদ: হে পাণ্ডব, যিনি ভক্তিযুক্ত হয়ে আমার সেবা করেন, আমার প্রতি নিষ্ঠাপরায়ণ, আমার ভক্ত, জড় বিষয়ে আসক্তিরহিত এবং সমস্ত প্রাণীর প্রতি শত্রুভাবরহিত, তিনি অবশ্যই আমাকে লাভ করেন। ─── (ভগবদ্গীতা ১১।৫৫)
১২শ (দ্বাদশ) অধ্যায় — ভক্তিযোগ
কৃষ্ণপ্রেম লাভের পন্থা
“ভক্তি ও প্রীতি সহকারে আমাকে স্মরণ করাই হচ্ছে পন্থা যা মৎপরায়ণ হয়ে কর্ম করার দ্বারা বা অন্ততঃ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার দ্বারা ক্রমান্বয়ে লাভ হয় এবং এটি নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনা থেকে উৎকৃষ্ট।”
চিন্ময় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের জন্য ভক্তিযোগ সাধন বা শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে শুদ্ধ ভক্তিই হলো একমাত্র এবং সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। যাঁরা এই পরম পন্থার অনুসরণ করেন, তাঁরা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপালাভে সমর্থ হন।
যে তু ধর্ম অমৃতম্ ইদম্ যথা উক্তম্ পর্যুপাসতে ৷
শ্রদ্দধানাঃ মৎপরমাঃ ভক্তাঃ তে অতীব মে প্রিয়াঃ ৷৷
অনুবাদ: যাঁরা আমার দ্বারা কথিত এই ভক্তিযোগরূপ ধর্মামৃতের উপাসনা করেন, সেই সকল শ্রদ্ধাবান মৎপরায়ণ ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়। ─── (ভগবদ্গীতা ১২।২০)
১৩শ (ত্রয়োদশ) অধ্যায় — প্রকৃতিপুরুষবিবেকযোগ
জড় বন্ধন থেকে মুক্তি
“পরমাত্মা হিসেবে আমি সকল জীবাত্মার মধ্যে অবস্থান করছি, এমনকি যারা আমাকে অবজ্ঞা করে এবং বিভিন্ন প্রজাতিতে নানা দেহে জড় ইন্দ্রিয়সুখের পশ্চাতে ধাবিত হয়, তাঁদের মধ্যেও আমি রয়েছি।”
ক্ষেত্র (দেহ), ক্ষেত্রজ্ঞের (আত্মা) এবং উভয়ের ঊর্ধ্বে পরমাত্মার মধ্যে পার্থক্য যিনি উপলব্ধি ও অনুধাবন করতে পারেন, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভে সমর্থ হন।
ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞয়োঃ এবম্ অন্তরম্ জ্ঞানচক্ষুষা ৷
ভূত প্রকৃতি মোক্ষম্ চ যে বিদুর্যান্তি তে পরম্ ৷৷
অনুবাদ: যাঁরা এভাবে জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা ক্ষেত্র (দেহ) ও ক্ষেত্রজ্ঞের (আত্মা) পার্থক্য দর্শন করেন এবং জড় প্রকৃতির বন্ধন থেকে জীবগণের মুক্ত হওয়ার পন্থা জানেন, তাঁরা পরম গতি লাভ করেন। ─── (ভগবদ্গীতা ১৩।৩৫)
১৪শ (চতুর্দশ) অধ্যায় — গুণত্রয়বিভাগযোগ
জড় প্রকৃতির ত্রিগুণ বৈশিষ্ট্য
“একজন অজ্ঞ জীব যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জন্য কর্ম করে প্রকৃতির তিন গুণকে অতিক্রম না করছে, ততক্ষণ সে জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণের দ্বারা মোহিত হয়ে থাকে।”
সমস্ত দেহধারী জীবাত্মামাত্রই সত্ত্ব, রজো ও তমো — জড় প্রকৃতির এই তিন গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই তিন গুণের অধীশ্বর কিন্তু তিনি এই গুণ দ্বারা প্রভাবিত নন। তিনি এই গুণ সমূহ কিরূপে দেহধারী জীবের ওপর ক্রিয়াশীল এবং কিরূপে জীবাত্মা সেই সমস্ত গুণ সমূহ অতিক্রম করে অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারে তার লক্ষণ সকল বর্ণনা করেছেন এবং পরিশেষে কিভাবে পরম ব্রহ্মকে প্রাপ্ত করতে পারেন তা ব্যক্ত করেছেন।
মাম্ চ যোঃ অব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে ৷
সঃ গুণান্ সমতীত্য এতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে ৷৷
অনুবাদ: যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি প্রকৃতির সমস্ত গুণকে অতিক্রম করে ব্রহ্মভূত স্তরে উন্নীত হন। ─── (ভগবদ্গীতা ১৪।২৬)
১৫শ (পঞ্চদশ) অধ্যায় — পুরুষোত্তমযোগ
পরম পুরুষের যোগতত্ত্ব
“যদিও জীবেরা এই জড় জগতের বটবৃক্ষ-সদৃশ গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছে, তবুও আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থান করে তাদেরকে আমার দিকে এবং আমার চিন্ময় ধামের দিকে পরিচালিত করি।”
বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হলো জড়জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ এবং পরমেশ্বর ভগবানরূপে শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যিনি শ্রীকৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁর ভক্তিমূলক সেবায় নিয়োজিত হন তিনি জড় জগত থেকে মুক্ত হতে পারেন। যারা তীব্র বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রের দ্বারা দৃঢ়মূল এই জড়াজাগতিক বন্ধনকে ছেদন করে সত্য বস্তুর অনুসন্ধান করেন, অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্য-অনিত্য বিচার পরায়ণ, কামনা-বাসনা বর্জিত, সুখ-দুঃখ আদি দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত এবং মোহমুক্ত তারাই পরমপুরুষোত্তমকে লাভ করতে সমর্থ হন।
নির্মাণ মোহাঃ জিতসঙ্গদোষা আধ্যাত্ম নিত্যা বিনিবৃত্ত কামাঃ।
দ্বন্দ্বৈঃ বিমুক্তাঃ সুখদুঃখ সংজ্ঞৈঃ গচ্ছন্তি অমূঢ়াঃ পদম্ অব্যয়ম্ তৎ।।
অনুবাদ: যাঁরা অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষরহিত, নিত্য বিচারপরায়ণ, কামনাবর্জিত, সুখ ও দুঃখের দ্বন্দ্বসমূহ এবং বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত, তাঁরাই সেই অব্যয়পদ লাভ করেন। ─── (ভগবদ্গীতা ১৫।৫)
১৬শ (ষোড়শ) অধ্যায় — দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ
দৈব ও আসুরিক প্রকৃতিগুলির পরিচয়
“দৈবী ভাবাপন্ন লোকেরা আমার নির্দেশনা মেনে চলে কিন্তু আসুরিক লোকেরা কাম, ক্রোধ, লোভ, ও দম্ভের কারণে শাস্ত্রবিধি মানে না এবং ইন্দ্রিয় উপভোগের জন্য তাঁদের অদম্য বাসনার ফলে তারা ঘোর নরকে অধঃপতিত হয়” ।
মানবজীবনের তিনটি শত্রু – কাম, ক্রোধ ও লোভ থেকে সর্বদাই সতর্ক থাকতে হবে। কাম, ক্রোধ ও লোভ হল নরকের দ্বার এবং এর থেকে মানুষ যতই মুক্ত হয়, তার জীবন ততই নির্মল হয়। তখন সে ধীরে ধীরে বৈদিক শাস্ত্রে লিখিত বিধিনিষেধ (অবশ্যই চার নিয়ম) পালন করতে সক্ষম হয়। এই বিধিনিষেধগুলি অনুশীলন করার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে আত্মজ্ঞান লাভের স্তরে উন্নীত হতে পারে এবং কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে।
এতৈঃ বিমুক্তঃ কৌন্তেয় তমোদ্বারৈঃ ত্রিভিঃ নরঃ।
আচরতি আত্মনঃ শ্রেয়ঃ ততঃ যাতি পরাম্ গতিম্।।
অনুবাদ: হে কৌন্তেয়, এই তিন প্রকার তমোদ্বার থেকে মুক্ত হয়ে যে মানুষ আত্মার শ্রেয় আচরণ করেন, তিনি অনন্তর পরাগতি লাভ করে থাকেন। ─── (ভগবদ্গীতা ১৬।২২)
যারা আসুরিক গুণাবলী অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে তারা ক্রমে হীন জন্ম ও অধিকতর জড় জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যারা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে বিধিবদ্ধ জীবনযাপন করেন তারা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করেন কারণ দৈবী সম্পদ মুক্তির অনুকুল এবং অসুরিক সম্পদ বন্ধনের কারণ।
বদ্ধজীব প্রধানত চার প্রকার দোষযুক্ত — ভ্রম (ভুল করার প্রবণতা), প্রমাদ (মোহগ্রস্ত হওয়া), বিপ্রলিপ্সা (প্রবঞ্চনা করার প্রবণতা) ও করণাপাটব (ত্রুটিপূর্ণ ইন্দ্রিয়াদি)৷ এই চারটি প্রধান দোষযুক্ত থাকার কারনে বদ্ধজীব শাস্ত্রীয় বিধিনিয়ম পালন করতে অক্ষম। সেই কারণেই শাস্ত্রোক্ত বিধিনিয়মগুলি এই চার প্রকার দোষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত বলে সমস্ত মহান ঋষি, আচার্য ও মহাত্মাগণ সেগুলিকে কোন রকম পরিবর্তন না করেই গ্রহণ করেছেন।
তস্মাৎ শাস্ত্রম্ প্রমাণম্ তে কার্য অকার্য ব্যবস্থিতৌ ৷
জ্ঞাত্বা শাস্ত্র বিধান উক্তম্ কর্ম কর্তুম্ ইহ অর্হসি ৷৷
অনুবাদ: অতএব কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত কর্ম সম্বন্ধে জেনে তুমি সেই কর্ম সম্পাদন করতে যোগ্য হও। ─── (ভগবদ্গীতা ১৬।২৪)
১৭শ (সপ্তদশ) অধ্যায় — শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ
শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসের স্তরবিন্যাস
“প্রকৃত আধ্যাত্ম-মার্গ জল্পনা-কল্পনা করে নির্ণয় করা যায় না, কারণ এমনকি শ্রদ্ধা এবং যজ্ঞও প্রকৃতির তিন গুণের নির্দেশনায় হয়ে থাকে ।”
জড় প্রকৃতির ত্রিগুণ থেকে উদ্ভূত বিষয় ও সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরনের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফললাভ করে। পক্ষান্তরে, শাস্ত্রীয় অনুশাসনাদি মতে অনুষ্ঠিত সাত্ত্বিক গুণময় কার্যাবলী হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে এবং শুদ্ধ ভক্তিভাব জাগ্রত করে তোলে। কালক্রমে তখন মানুষ পরমতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং এই আকর্ষণ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন সে ভগবৎ প্রেমলাভে সমর্থ হয়।
পরমেশ্বর ভগবানকে অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা করে কোনও কার্যকলাপ, তা যজ্ঞ হোক, দান হোক বা তপস্যা হোক, সেই সমস্ত কর্মই অর্থহীন, জঘন্য। ভগবানের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে এবং যথার্থ পথপ্রদর্শক না থাকলে কখনই শুদ্ধ ভক্তি (বা ভগবৎ প্রেম ) সম্ভব নয়। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের মূল লক্ষ্য হল পরম তত্ত্বের (ভগবানের) প্রতি বিশ্বাসপরায়ণ হওয়া। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশাদির অনুসরণের চরম লক্ষ্য হল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা। এই নীতি অনুসরণ না করলে কেউই সাফল্যলাভ করতে পারে না। তাই সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে ভক্তিযোগের অনুশীলন করাই হল শ্রেষ্ঠ পন্থা। সব কর্মই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে পরমব্রহ্মের জন্য করা উচিত। সব কিছু সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার এটিই পরম উপায়।
অশ্ৰদ্ধয়া হুতম্ দত্তম্ তপঃ তপ্তম্ কৃতম্ চ যৎ।
অসৎ ইতি উচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্রেত্য নো ইহ।।
অনুবাদ: হে পার্থ, অশ্রদ্ধা সহকারে অনুষ্ঠিত হোম, দান বা তপস্যা আদি ক্রিয়াসমূহকে ‘অসৎ’ বলা হয়। সেই সমস্ত ক্রিয়া ইহলোকে ও পরলোকে ফলদায়ক হয় না। ─── (ভগবদ্গীতা ১৭।২৮)
১৮শ (অষ্টাদশ) অধ্যায় — মোক্ষযোগ
ত্যাগসাধনার সার্থক উপলব্ধি
“হে অর্জুন! যুদ্ধ করার দ্বারা তুমি আমার জন্য কর্ম করবে, তোমার স্বাভাবিক কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করবে এবং একই সাথে একজন পরিশুদ্ধ যোগী হবে, কেননা তোমার প্রেমময়ী সেবার ফলে আমি তোমাকে সমস্ত জড় কলুষতা থেকে পরিত্রাণ করব; প্রিয় সখা! এখন তোমার যা মনোপূত হয় তা করো।”
ভগবতগীতার সার হল মোক্ষ যোগ। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন ত্যাগের অর্থ এবং মানুষের ভাবনা ও কার্যকলাপের উপর প্রকৃতির তিন গুণাবলীর প্রতিক্রিয়া, ব্রহ্ম-উপলব্ধি, ভক্তি যোগের মাহাত্ম্য এবং পরিশেষে একমাত্র পন্থা যা হলো সমস্ত কিছু পরিত্যাগ পূর্বক পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ যার ফলে সর্ব পাপ থেকে মুক্তিলাভ হয়, আত্মাজ্ঞান লাভ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের শাশ্বত চিন্ময় পরম ধামে প্রত্যাবর্তনের যোগ্যতা অর্জন করা যায়।
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মাম্ একম্ শরণম্ ব্রজ।
অহম্ ত্বাম্ সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।
অনুবাদ: সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না। ─── (ভগবদ্গীতা ১৮।৬৬)
ভগবদ্গীতাতে ভগবান অর্জুনকে নানা রকম জ্ঞান ও ধর্মের বর্ণনা করেছেন — পরমাত্মার জ্ঞান, সমাজ জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ এবং আশ্রমের জ্ঞান, আশ্রমের জ্ঞান, বৈরাগ্যের জ্ঞান, মন ও ইন্দ্রিয়ের দমন, ধ্যান ইত্যাদি। এখন, ভগবদগীতার সারাংশে ভগবান অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন, সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল তাঁর শরণাগত হওয়া উচিত। সেই শরণাগতি তাঁকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করবে, কারন ভগবান নিজেই তাঁকে রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য অন্য কোন কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র আমাদের উচিত শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত জীবের পরম পরিত্রাতারূপে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করা এবং ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে তাঁর শরণাগত হওয়া। কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।
■ ভগবদগীতার শিক্ষণীয় বিষয় (Life Lessons From Bhagavad Gita) ■
১) যা ঘটছে তা অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য। আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, যাই ঘটছে তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই ঘটছে। এর মধ্যে হস্তক্ষেপ করার বা একে থামানোর কোন অধিকার আমাদের নেই।
২) ভগবত গীতা আপনাকে শুধু ফলের চিন্তা না করে কর্ম করে যাওয়ার অনুমতি দেয়। কর্মফলের ওপর আমাদের কোন অধিকার নেই।
৩) আত্মা অবিনাশী, আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর আত্মা কেবল শরীর পরিবর্তন করে। আত্মা কখনোই ভিজে না বা আগুনে পুড়ে না।
৪) খালি হাতেই জন্ম হয়েছে এবং খালি হাতেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। মৃত্যুর পর আমরা আমাদের সাথে কোন পার্থিব সম্পদ বয়ে নিয়ে পারব না।
৫) লোভ, লালসা, ক্রোধ ও অহংকার বিষ-তুল্য, এগুলি মানুষের প্রকৃতি ও চরিত্রকে নষ্ট করে। একটি শান্তিপূর্ণ জীবন যার পথ আমাদেরকে মহিমান্বিত করতে পারে তার জন্যে গীতা আমাদেরকে এই চারটি অশুভ রিপু দ্বারা ভুগতে দেয় না।
৬) সন্দেহ পরিত্যাগ না করলে, মানসিক শান্তি পাওয়ার আশা করতে পারব না।
৭) প্রতিটি ব্যক্তি নিজের ভেতর থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে থাকে, কারণ সে নিজেই নিজের পরম বন্ধু বা শত্রু। সে নিজেই নিজের চিন্তা ও ধারণা থেকে বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়ে থাকে ও সেই অনুযায়ী কর্ম করে থাকে।
৮) আপনার কর্ম সর্বদা ভগবানের উদ্দেশ্যে সাধিত হবে এবং কর্মফল ভগবানের চরণে অর্পণ করতে হবে। মৃত্যুর পর আমাদের কর্মের জন্য আমাদেরকে দণ্ডিত বা পুরস্কৃত করা হবে। বিচার কেবলমাত্র মৃত্যুর পরই সম্পন্ন হবে এবং এটিই মৃত ব্যক্তির শেষ পরিণতি নির্ধারণ করবে।
৯) অন্য কারোর কাছ থেকে সম্মান পেতে হলে, আমাদেরকে আগে তাদেরকে সম্মান দিতে হবে। আপনি নিজে যাকে সম্মান করেন না তার কাছ থেকে আপনি সম্মান পাওয়ার আশা করতে পারেন না।
১০) জীবনের সম্পদ বা অসুবিধা কিছুই আপনি নিজে বেছে নিতে পারেন না। জীবন আপনাকে যা দেবে সেটাই আপনার মেনে নেওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়গুলি আপনার পূর্বকৃত- কর্মফলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
১১) একই জায়গায় স্থবির হয়ে থাকা মনুষ্য জাতির উদ্দেশ্য নয়। কর্ম দ্বারা তাদেরকে অগ্রসর ও বিকশিত হতে হবে। মানুষের কর্মের ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বর তাদের পথ নির্ধারণ করবেন।
১২) জগত ও সৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবে ক্ষয়িষ্ণু, তার ফলে এক না একদিন উভয়েরই অন্ত আসবে। পূর্ব নির্ধারিত দিন বা সময়ে পরিসমাপ্তির সাথে মিলিত হওয়া থেকে আপনি তাদের আটকাতে পারবেন না।
১৩) যেহেতু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগত ও সৃষ্টির পালক, আপনাকে শুধু আপনার কর্ম ও ক্রিয়া তাঁকে উৎসর্গ করতে হবে। আপনার জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে দিন।
১৪) জগত-সংসার ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই সৃষ্টি এবং সবই তাঁর ইচ্ছাশক্তিতে ঘটছে। একজন মানুষ হিসাবে, এর বাইরে কিছু নিয়ে চিন্তা করার অধিকার আপনার নেই।
১৫) ধন-সম্পদ ও কামনার দাস বা হাতের পুতুল হয়ে পড়লে, তা আপনার প্রকৃতি ও চরিত্রে একটা নিশ্চিত অধঃপতন নিয়ে আসতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এর ফল, চরম ব্যর্থতা হতে পারে।
■ ভগবদগীতা কী কী সমস্যার সমাধান প্রদান করে ■
শ্রীমদ্ভগবদগীতা আমাদেরকে নিমোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান প্রদান করে —
১। সকল শোক ও উদ্বেগ থেকে কিভাবে মুক্ত হওয়া যায়? (ভঃগীঃ ২/২২)
২। শান্তি লাভের জন্য স্থির মন ও দিব্য বুদ্ধিমত্তা লাভের উপায় কি? (ভঃগীঃ ২/৬৬)
৩। কেবল ভগবৎপ্রসাদেই কেন গ্রহণ করা উচিত? (ভঃগীঃ ৩/৩১)
৪। কর্তব্যকর্মে নিয়োজিত থেকে মন নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব কি? (ভঃগীঃ ৩/৪৩)
৫। কিভাবে জীবনে পূর্ণতা লাভ করা যায়? (ভঃগীঃ ৪/৯)
৬। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ কিভাবে অর্জন করা যায়? (ভঃগীঃ ৪/১১)
৭। কিভাবে সদগুরু শরণাগত হতে হয়? (ভঃগীঃ ৪/৩৪)
৮। পাপীরা দুঃখের সাগর অতিক্রম করবে কিভাবে? (ভঃগীঃ ৪/৩৬)
৯। মানুষ কেন দুঃখের ফাঁদে আটকে পড়ে? (ভঃগীঃ ৫/২২)
১০। শান্তির সূত্র কি? (ভঃগীঃ ৫/২৯)
১১। মন কার শত্রু ও কার বন্ধু? (ভঃগীঃ ৬/৬)
১২। মন নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা সম্ভব কি? (ভঃগীঃ ৬/৭)
১৩। চঞ্চল মনকে কিভাবে জয় করা যায়? (ভঃগীঃ ৬/৩৫)
১৪। পূর্ণ জ্ঞান কি? (ভঃগীঃ ৭/২)
১৫। কিভাবে মুক্তি অর্জন করা যায়? (ভঃগীঃ ৭/৭)
১৬। মায়াকে অতিক্রম করার গোপন রহস্য কি? (ভঃগীঃ ৭/১৪)
১৭। পাপ কত প্রকার? কিভাবে পাপকে দগ্ধীভূত করতে হয়? (ভঃগীঃ ৯/২)
১৮। আমাদের পরম লক্ষ্য কি? (ভঃগীঃ ৯/১৮)
১৯। মানুষ কি তার পছন্দমত গ্রহলোকে যেতে পারে? (ভঃগীঃ ৯/২৫)
২০। আমাদের অর্পিত দ্রব্যসমগ্রী কি ভগবান গ্রহন করেন? (ভঃগীঃ ৯/২৬)
২১। এই জড় জগতে সুখ লাভের উপায় কি? (ভঃগীঃ ৯/৩৪)
২২। মানব জীবনের পরম সিদ্ধি কি? (ভঃগীঃ ১০/১০)
২৩। আমাদের হৃদয়ে সঞ্চিত কলুষতা কিভাবে দূর করা যায়? (ভঃগীঃ ১০/১১)
২৪। পরম পুরুষোত্তম ভগবান কে? (ভঃগীঃ ১০/১২-১৩)
২৫। কৃষ্ণ অর্জুনের নিকট বিশ্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন কেন? (ভঃগীঃ ১১/১)
২৬। ভগবদগীতার সার কথা কি, আমাদের ক্লেশের কারণ কি? (ভঃগীঃ ১১/৫৫)
২৭। রজো ও তমো গুণের কারণ কি? (ভঃগীঃ ১৪/২৬)
২৮। আমরা কি ভগবানকে দেখতে পারি, কথা বলতে পারি এবং তাঁর কথা শ্রবণ করতে পারি? (ভঃগীঃ ১৫/৭)
২৯। দেহত্যাগের সময় জীব তার সাথে কি নিয়ে যায়? (ভঃগীঃ ১৫/৮)
৩০। কিভাবে ভগবানের কাছে পৌঁছাতে হয়? (ভঃগীঃ ১৮/৬৬)
► আরও পড়ুন: আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ কয় প্রকার ও তাদের গুণাবলী
► আরও পড়ুন: গীতা জয়ন্তীর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ৷৷ ইসকন
► আরও পড়ুন: ভগবান “শ্রীকৃষ্ণের অবতরন”-এর উদ্দেশ্য কি?
► আরও পড়ুন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ১০টি প্রতিজ্ঞা মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে
► আরও পড়ুন: ৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী ||ইসকন