◼️ অক্ষয় তৃতীয়া কি? ◼️
(What is Akshaya Tritiya)
প্রতি বছরের বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিটিকে বলা হয় ‘অক্ষয় তৃতীয়া’ (Akshaya Tritiya)। হিন্দু ও জৈনদের জন্য একটি পবিত্র দিন হল অক্ষয় তৃতীয়া, যা ‘আখা তীজ’ (Akha Teej) নামেও পরিচিত।
‘অক্ষয়’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না ’ অথবা ‘যার ক্ষয় বা বিকার নেই ’। ‘তৃতীয়া’ অর্থ ‘চাঁদের তৃতীয় দশা ’ (the third phase of the moon) কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া ব্যাপারটি কি?
এটি বছরের মাহাত্ম্যপূর্ণ পবিত্র দিন। ধর্মশাস্ত্র অনুসারে এই দিনে কোনো শুভকর্ম সম্পন্ন করলে ফলস্বরূপ অনেক বৃহৎ ফল প্রাপ্তি হয়। এই দিনে কোন শুভকর্ম করলে তার কোন ক্ষয় হয় না অর্থাৎ শেষ হয় না সেই জন্য একে অক্ষয় তৃতীয়া বলা হয়। এই দিনে ভালো কাজ করার ফলে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আর খারাপ কাজ করার ফলে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। তাই এদিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত। এই কারণে এই দিন নানা প্রকার শুভ কাজ করার বিধান শাস্ত্রে দেওয়া আছে।
এই তিথিকে ‘অক্ষয়তীজ্’ বা ‘পরশুরাম জয়ন্তী’ও বলা হয়। আবার এই দিনটি যদি হয় সোমবার আর রোহিণী নক্ষত্র সমাসীন, তবে এই অক্ষয় তৃতীয়ার গুরুত্ব বেড়ে যায়। দিনটি আরও বেশী বিশিষ্টতা পায়। বৈশাখ মাসের এই বিশেষ দিনে বহু মহান কর্মের সূচনা হয়েছে, যা পৌরাণিক কাল থেকে আজও নিরবধি বয়ে চলেছে। শুভকর্মের সুফল আজও সমানভাবে অক্ষত রয়েছে। তাই তো পৌরাণিক কাল থেকে এই দিনে অনুষ্ঠিত যে কোন শুভ কার্যানুষ্ঠানের পুণ্যফল অক্ষয় রূপে ধার্য হয়। ‘অক্ষয় তৃতীয়া’ আখ্যা তাই সার্থক। ভবিষ্য পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অক্ষয় তৃতীয়ার তারিখ এবং শুভ সময়
◼️ অক্ষয় তৃতীয়ার তারিখ ও শুভ সময় ◼️
◉ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 10-মে-2024 (শুক্রবার)।
◉ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
আজ থেকেই চন্দনযাত্রা আরম্ভ যা ২১ দিন ধরে চলবে।
◼️ অক্ষয় তৃতীয়া মাহাত্ম্য ◼️
(Akshaya Tritiya Mahatya)
🟥 মৎস্য পূরানে বলা হয়েছে:━
❝ বৈশাখে মাসি শুক্লায়াং তৃতীয়ায়াং জনার্দ্দন:।
যবানুত্পাদয়ামাস যুগন্চ কৃতবান্ কৃতম্॥ ❞
অনুবাদ: ভগবান হরি বৈশাখ মাসের “শুক্লা তৃতীয়াতে” যবের সৃষ্টি ও সত্য যুগের বিধান করেন।
এই তিথি যে বাস্তবিকই অক্ষয়, তার প্রমাণস্বরূপ অতীতকালে পুরাণে সমস্ত ঘটনাবলী বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে। তারই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হল ━━
✤ (১) সত্যযুগের সমাপ্তি এবং ত্রেতাযুগের সূচনা :–
পবিত্র পুরাণ অনুসারে, এই দিনটি সত্যযুগের সমাপ্তি এবং ত্রেতাযুগের সূচনা করেছিল। এই দিনটিকে ত্রেতাযুগের উগাদি তিথি (Ugadi thithi for Treta Yuga) হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মহাভারত অনুসারে, এই দিনে মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল এবং দ্বাপর যুগের অবসান হয়েছিল।
✤ (২) রাজা ভগীরথের দ্বারা স্বর্গ থেকে গঙ্গা দেবীর অবতরণ :–
এই তিথিতে রাজা ভগীরথের হাজার হাজার বছরের তপস্যার ফলস্বরূপ পুণ্যতোয়া, পুণ্যসলিলা ভগবতীদেবী গঙ্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে অবতরণ করেন। তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অক্ষয় জলসম্ভার নিয়ে মর্ত্যবাসীর জীবনদায়িনী ও পাপনাশিনী নদীরূপে বয়ে চলেছে। তাই এই দিনে গঙ্গা নদীতে স্নান করলে জীবনের সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
✤ (৩) পরশুরামদেবের আবির্ভাব তিথি :–
ভগবানের দশ অবতারের অন্যতম ষষ্ঠ অবতার ‘পরশুরামদেব’ এই তিথিতেই আবির্ভূত হন মর্ত্যলোকে। তিনি হলেন চিরঞ্জীবী (অর্থাৎ অমরত্বের অধিকারী)। অমর, অক্ষয় আয়ু নিয়ে আজও মর্ত্যচারী। তাই এ তিথির আর এক নাম “পরশুরাম জয়ন্তী”।
✤ (৪) মহাভারত রচনা শুরু :–
এই তিথিতেই মহর্ষি বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে গণপতি গণেশ ‘মহাভারত’ রচনা শুরু করেন। মহাভারতের মধ্যে ২৫ থেকে ৪২ পর্যন্ত আঠারো অধ্যায় ‘ভগবতগীতা ’ রূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী উল্লেখ রয়েছে, যা অনন্তকাল থেকে মানুষদের জড়জাগতিক দুঃখালয় উত্তরণের অক্ষয় পথপ্রদর্শক।
✤ (৫) মাতা অন্নপূর্ণার আবির্ভাব তিথি :–
দেবী পার্বতীর অন্য এক রূপ ‘মাতা অন্নপূর্ণা’ রূপে এই তিথিতেই আবির্ভূতা হয়ে মহাদেবকে অন্নভিক্ষা দেন। তারপর থেকে অন্নের অক্ষয় উৎসস্বরূপা রূপে দেবী পুজিতা হন।
✤ (৬) দ্বারকাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সুদামার প্রথম সাক্ষাৎ :–
এই তিথিতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম বান্ধব সুদামা (তিনি ছিলেন বিপ্র অর্থাৎ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) দ্বারকাতে তাঁর প্রাসাদে আসেন, তাঁর দারিদ্রাবস্থার কথা জানিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য পাবার আশায়। কিন্তু ‘অতিথি দেবঃ ভবঃ’ এবং ‘ব্রাহ্মণ নিত্য পূজ্য’ ━ এই জ্ঞানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে যে আতিথেয়তা করেন, তাতে মুগ্ধ হয়ে সুদামা আর নিজের দৈন্যাবস্থার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। এমনকী কৃষ্ণের প্রাসাদে সম্পদের বৈভব দেখে, তার জন্য আনা কাপড়ে বাধা ভিক্ষা করে সঞ্চিত সামান্য চালভাজাটুকুও লজ্জায় আর দিতে পারেননি সুদামা।
কিন্তু ভক্তবৎসল ভগবান বাসুদেব যে ভাবগ্রাহী। তিনি কেবল ভেট (উপহার) প্রহণ করেন না, ভক্তের ভাবটুকু প্রহণ করেন। তিনি অনন্তযামী, ভক্তের মনের ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করেন। তাই নিজেই সেই চালভাজা চেয়ে খেয়ে পরমতৃপ্ত হন। আর সুদামা বিপ্র নিজমুখে কিছু না চাইলেও, বাড়িতে ফিরে দেখেন যে তার ছোট্ট কুটীর পরিবর্তিত হয়ে বৃহৎ অট্টালিকা অবস্থান করছে সেখানে। শ্রীভগবান অযাচিত করুণাভরে সবকিছু সাজিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁর একান্ত প্রিয় বান্ধব তথা ভক্তপ্রবর সুদামাকে।
এই লীলার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, ভক্তের চাওয়ার অপেক্ষা করেন না ভগবান। তাঁর নিষ্কাম ভক্তের জন্য অহৈতুকী অযাচিত কৃপা অক্ষয়রূপে তিনি নিজে থেকেই করেন। সত্যি, তাঁর মতো প্রকৃত সুহৃদ, তার মতো পরম বান্ধব আর কে আছেন?
✤ (৭) দুঃশাসন দ্বারা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা :–
দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করার চেষ্টা করেছিলেন এই তিথিতেই। রাজসভায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য প্রমুখ
অন্যায়ের প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি, একমাত্র মন্ত্রী বিদুর ছাড়া। অসহায় দ্রৌপদী একহাতে শাড়ির কোঁচড় ধরে অন্যহাত উপরে তুলে ভগবানকে ডাকতে লাগলেন, কিন্তু শেষমেশ তিনি বুঝলেন তিনি শেষ রক্ষা করতে পারবেন না, তখন নিঃসংকোচে পূর্ণ বিশ্বাসসহ শরণাগতি স্বীকার করে আত্মনিবেদন করলেন মনে মনে শ্রীকৃষ্ণের চরণে, তখন ভগবান অনন্ত বস্ত্রের যোগান দিয়ে তার সম্মান রক্ষা করেন, লজ্জা নিবারণ করেন।
এই লীলার দ্বারা এটাই নিদর্শন করে যে, পূর্ণরূপে ভগবানের চরণকমলে আত্মনিবেদিত হতে পারলে ভগবানই রক্ষাকর্তা হয়ে অক্ষয় কৃপা করেন।
✤ (৮) পান্ডবদের বনবাসের সময় সূর্যদেব কর্তৃক ‘অক্ষয় পাত্র’ দান :–
কথিত আছে ━ অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই সূর্যদেব পান্ডবদের বনবাসের সময় ‘অক্ষয় পাত্র’ দান করেছিলেন। একথালা অন্ন দ্রৌপদী আহার গ্রহণের আগে পর্যন্ত যতজন উপস্থিত থাকতো তাদেরকে খাওয়ানো যেত। একবার দ্রৌপদীর আহার হয়ে গেলে, দুর্বাসা মুনি ও তার শিষ্যরা বনের ছোট্ট কুটীরে উপস্থিত হন। ফলে অক্ষয় পাত্র ছিল খালি। ভোজনের পূর্বে গুরু শিষ্য সকলে স্নানে গেলে দ্রৌপদী মনে মনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরনাগতি হন। ভক্তের ডাকে ভগবান উপস্থিত হলেন। সব দেখে শুনে তিনি একটি মাত্র অন্ন দানা মুখে দিয়ে দুর্বাসা মুনির শিষ্য সহ ক্ষুধার জ্বালার নিবারণ করেছিলেন এবং পঞ্চপাণ্ডব কে দুর্বাসার অভিশাপ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
এই লীলার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, ভক্তের বিপদে ভগবান পাশে থেকে রক্ষা করেন। শুধু প্রয়োজন ভক্তিতে শরনাগতি।
✤ (৯) মহাদেব কর্তৃক যক্ষরাজ কুবেরকে স্বর্গের কোষাধ্যক্ষের পদ প্রদান :–
শিবপুরম নামক স্থানে দীর্ঘকাল তপস্যার পর মহাদেবকে প্রসন্ন করে যক্ষরাজ কুবের স্বর্গের কোষাধ্যক্ষের পদ প্রদান করেছিলেন এই তিথিতেই। কথিত আছে যে দেবী মহালক্ষ্মী কুবেরকে সোনা প্রদান করেছিলেন।
✤ (১০) প্রতিবছর পুরীতে জগন্নাথদেবের রথ নির্মাণকার্যের শুভ সূচনা:–
এই তিথিতেই প্রতিবছর পুরীতে জগন্নাথদেবের (নন্দিঘোষ), বলরামদেবের (তালধ্বজা) এবং সুভদ্রার (দর্পদলান) তিনটি রথ নির্দিষ্ট গাছের কাঠ দিয়ে নতুনভাবে নির্মাণকার্যের শুভ সূচনা হয়। ভক্তবৎসল জগন্নাথদেব ভক্ত দর্শনের জন্য রথযাত্রা করেন, আর ভক্তদের প্রতিও তার অক্ষয় কৃপা যে স্বয়ং ভগবান মন্দির থেকে পথে আসেন তাঁদের দর্শনসুখ দিতে।
✤ (১১) শঙ্করাচার্যের ‘কলকাধার’ নামক বিখ্যাত শ্লোকের রচনা :–
প্রবাদ আছে, এই তিথিতেই ভিক্ষা করতে গিয়ে আদি শঙ্করাচার্য এক নিঃসম্বল দম্পতির থেকে, তাদের কুটীরের একমাত্র খাদ্যদ্রব্য হিসাবে একটি টেপারি ফল (ছোট্ট কুলজাতীয় টক মিষ্টি স্বাদ যুক্ত ফল) দান পেলেন। নিদারুণ দৈন্যাবস্থা সত্বেও ক্ষুধায় কাতর দম্পতির ভিক্ষাদানে এমন আগ্রহ দেখে শঙ্করাচার্য ‘কলকাধার’ নামক বিখ্যাত শ্লোকটি রচনা করেন, যা তার এক অক্ষয় কীর্তি।
✤ (১২) প্রতিবছর সিংহাচলম মন্দিরে ভগবান নরসিংহদেবের অভিষেক :–
অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে সিংহাচলম (Simhachalam) মন্দিরে ভগবান নরসিংহদেবকে সারাবছর চন্দন পেস্ট দিয়ে আবৃত রাখা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে (যা নরসিংহ জয়ন্তীর অর্থাৎ ভগবান নরসিংহদেবের আবির্ভাব দিবসের ১১ দিন আগে পালিত হয়) সারা বছর ধরে মাখানো শুকনো চন্দনের পেস্ট তুলে একত্রিত করা হয় এবং ভগবান নরসিংহদেবকে অভিষেক করা হয়। বছরের এই দিনেই কেবল ভক্তরা প্রভুর রূপ দেখতে পান। আবার ঐ সন্ধ্যায়, ভগবান নরসিংহদেবকে আবার চন্দন পেস্ট মাখিয়ে সজ্জিত করা হয়।
✤ (১৩) পরশুরাম ক্ষেত্র :–
‘গোয়া’ ও ‘কেরল’ এই তিথিতেই পরশুরাম ক্ষেত্র নামে চিহ্নিত হয়।
✤ (১৪) ব্রহ্মার পুত্র অক্ষয় কুমারের জন্ম:–
এই তিথিতেই ব্রহ্মার পুত্র অক্ষয় কুমার জন্ম গ্রহণ করেন।
✤ (১৫) নর-নারায়ণের অবতারণা :–
অক্ষয় তৃতীয়ায় নর-নারায়ণ অবতারণা করেছিলেন, তাই এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
✤ (১৬) অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে তীর্থযাত্রীদের জন্য চার ধাম খুলে দেওয়া হয় :–
উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত চার ধাম হল কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী। মন্দিরগুলি ছয় মাস শীতকালে বন্ধ থাকে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে তীর্থযাত্রীদের জন্য মন্দিরগুলি আবার খুলে দেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দ্বীপ তখনও প্রজ্বলিত যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল।
✤ (১৭) বছরে একবার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বাঁকে বিহারী মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের চরণ দর্শন :–
১৬) অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে, বৃন্দাবনে অবস্থিত বিশ্ব বিখ্যাত বাঁকে বিহারী মন্দিরে বছরে একবার শ্রীকৃষ্ণের চরণ দেখা যায়। অক্ষয় তৃতীয়ায় ভগবান বাঁকে বিহারীর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সারা শরীরে চন্দনের পেস্ট লাগানো হয়। এ জন্য দক্ষিণ ভারত থেকে চন্দন কাঠ এনে কয়েক মাস আগে থেকে ঘষা শুরু করা হয়।
✤ (১৮) চন্দন যাত্রা (ভগবানের শ্রীঅঙ্গে চন্দন লেপন) শুরু:–
মাধবেন্দ্র পুরীপাদ এই তিথিতে ভগবানের শ্রীঅঙ্গে চন্দন লেপন করে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিক তুলে ধরেন।
অক্ষয় তৃতীয়ার এই শুভ দিনে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার অন্তর্গত রেমুনা নামক স্থানে ক্ষীরা-চোরা গোপীনাথ মন্দিরে (Khirachora Gopinatha Temple) গোপীনাথ (মাঝে), গোবিন্দ (গোপীনাথের ডান দিকে অবস্থিত), এবং মদন-মোহন (গোপীনাথের বাম দিকে অবস্থিত) -এর বিগ্রহে চন্দনের পেস্ট লাগানো হয়। কথিত আছে যে ভগবান রামচন্দ্র তাঁর তীর দিয়ে গোপীনাথের বিগ্রহ খোদাই করেছিলেন এবং সীতা দেবী চিত্রকূটে সেই বিগ্রহের পূজা করেছিলেন। উৎকলের রাজা লাঙ্গুলা নরসিংহদেব ১৩শ শতাব্দীতে ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে চিত্রকূট থেকে সেই বিগ্রহকে রেমুনায় নিয়ে এসে শ্রী গোপীনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
পরবর্তীতে গোবিন্দ ও মদন-মোহন এই দুই বিগ্রহকে ১৯৩৮ সালে বৃন্দাবন থেকে এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৫০০ বছরেরও বেশি আগে, মাধবেন্দ্র পুরী বৃন্দাবনের গোবর্ধন পর্বতের চূড়ায় গোপালের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছিলেন মহান বৈষ্ণব এবং কৃষ্ণ ভক্ত। একবার গোপাল (শ্রীনাথজি) বিগ্রহ মাধবেন্দ্র পুরীর কাছে স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে জানান গরমে তাঁর শরীরে কষ্ট হচ্ছে, তাই তিনি যেন জগন্নাথ পুরী থেকে চন্দনের পেস্ট এবং কর্পূর এনে শরীরে লাগিয়ে দেন। ভগবানের আদেশ মতো মাধবেন্দ্র পুরী যাত্রা শুরু করেন এবং পুরী যাওয়ার পথে রেমুনাতে পৌঁছান, যেখানে গোপীনাথ অবস্থিত। তিনি গোপীনাথের মন্দির পরিদর্শন করেন এবং ভগবানের দর্শন পেয়ে আনন্দে বিগলিত হয়ে যান। তিনি প্রাণ ভরে কীর্তন করতে করতে নাচলেন এবং তৃপ্ত জপ করলেন।
ভগবানের জন্য ভোগের আয়োজনের উৎকর্ষতা দেখে তিনি মনে মনে ঠিক করলেন আমিও ঠিক এমন করে গোপালকে ভোগ নিবেদন করতে চাই। এরপর তিনি একজন পুরোহিতকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন প্রত্যহ ভগবানের জন্য কিরকম ভোগের ব্যবস্থা করা হয়? পুরোহিত জানালেন, “সন্ধ্যায় শ্রী গোপীনাথ ভগবানকে বারোটি মাটির হাঁড়িতে বিশেষ পায়েস (মিষ্টি ভাত) নিবেদন করা হয়। এর স্বাদ অমৃতের মতোই উত্তম বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে অমৃত-কেলি এবং সারা বিশ্বে এই পায়েস ভোগ নিবেদন ‘গোপীনাথ-ক্ষীরা’ নামে পালিত হয়। এটি বিশ্বের অন্য কোথাও দেওয়া হয় না।
মাধবেন্দ্র পুরী পাদ ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছে এই কথা শুনে মনে মনে ভাবলেন, “যদি, আমায় লুকিয়ে একটু সুস্বাদু মিষ্টি পায়েস দিত, তবে আমি তার মধুর স্বাদ আস্বাদন করে ধন্য হতাম এবং আমার গোপালকে নিবেদনের জন্য অনুরূপ ভোগ প্রস্তুত করে দিতে পারতাম।”
তিনি ভগবানের কাছে ভোগ নিবেদনের আগে স্বাদ গ্রহণ করতে চেয়েছেন ━ তিনি অবিলম্বে তাঁর অপরাধ বুঝতে পেরে অত্যন্ত লজ্জিত হন ও অপবিত্র চিন্তার কারণে অনুতপ্ত হন। ইতিমধ্যে ভগবানকে নৈবেদ্য দেওয়া সম্পন্ন হয় এবং আরতি অনুষ্ঠান শুরু হয়। আরতি শেষ হওয়ার পর, অনুতপ্ত মাধবেন্দ্র পুরী পাদ ভগবানকে প্রণাম সেরে মন্দির ছেড়ে প্রভুর পবিত্র নাম জপ করার জন্য একটি খালি জায়গায় চলে যান, বস্তুত জায়গাটি ছিল গ্রামের বাজার।
মাধবেন্দ্র পুরী পাদ সর্বদা ভিক্ষা এড়িয়ে যেতেন। তিনি পার্থিব বিষয়ের প্রতি সম্পূর্ণরূপে অসংলগ্ন এবং উদাসীন ছিলেন। যদি, ভিক্ষা ছাড়া কেউ তাকে কিছু খাবার দিত তবে তা তিনি গ্রহণ করতেন; অন্যথায় তিনি উপবাসে থাকতেন।
তাঁর মতো এমন পরমহংস সর্বদা ভগবানের প্রেমময় সেবায় সন্তুষ্ট থাকতেন। পার্থিব ক্ষুধা-তৃষ্ণা তার ভক্তিতে বাধা হতে পারত না। কেমন করে তিনি ভগবানের জন্য নিবেদিত মিষ্টি পায়েসের স্বাদ নিতে চাইলেন, কেনই বা তা খাওয়ার ইচ্ছা হল ━ এই ভাবতে ভাবতে তিনি অপরাধবোধে কাতর হয়ে পরলেন।
সেই রাতে, ভগবান গোপীনাথ মন্দিরের পুরোহিতকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, “হে পুরোহিত, দয়া করে উঠে মন্দিরের দরজা খোল। আমি আমার ভক্ত মাধবেন্দ্র পুরীর জন্য এক হাঁড়ি মিষ্টি পায়েস তুলে রেখেছি, যা আমার পোশাকের ঠিক পিছনে আড়াল করে রেখেছি। আমার মায়ার কারণে সেটি তুমি বা অন্য কেউ দেখতে পায়নি। আমার সে পরম ভক্ত অভুক্ত অবস্থায় খালি বাজারে বসে আমার নাম নিরন্তর জপ করে চলেছে। দয়া করে আমার পোশাকের আড়ালে রাখা সেই মিষ্টি পায়েসের হাঁড়িটি নিয়ে তার কাছে পৌঁছে দাও।”
স্বপ্ন থেকে জেগে পুরোহিত স্তম্ভিত হয়ে উঠে বসলেন, এরপর স্নান সেরে মন্দিরের দরজা খুলে ভগবানের নির্দেশ মতো নির্দিষ্ট জায়গায় পোশাকের আড়ালে মিষ্টি পায়েসের হাঁড়ি দেখতে পেলেন এবং সেটি নিয়ে বাজারের দিকে মাধবেন্দ্র পুরীপাদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লেন। নাম ধরে অনেক ডাকাডাকি অনেক খোঁজাখুজির পর সেই পরম ভক্তের সন্ধান পেলেন। মাধবেন্দ্র পুরী পাদ পুরোহিতের কাছ থেকে সবকিছু শুনে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন, তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণ প্রেমে মগ্ন হয়ে পড়েন। চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না, কেবল বলেন “ভক্তের ডাকে ভগবান আসেন এবং ভক্তের মনোবাসনা পরম করুণাময় ঠিক পূর্ণ করেন।” তৃপ্তি ভরে প্রসাদ গ্রহণের পর, তিনি মাটির ভাঁড়টি ধুয়ে টুকরো টুকরো করে কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে সুন্দরভাবে রেখে দিলেন। প্রতিদিন, মাধবেন্দ্র পুরী পাদ সেই মাটির পাত্রের এক টুকরো খেতেন এবং তা খাওয়ার পর তিনি অবিলম্বে আনন্দে অভিভূত হয়ে যেতেন। সেই রাতে তিনি যমুনার তীরে কৃষ্ণ ও রাধাকে নৃত্যরত ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এরপর থেকে ভগবান গোপীনাথ ‘ক্ষীর চোরা’ নামে পরিচিত হন, যিনি একজন ভক্তের জন্য পায়েস চুরি করেছিলেন।
গোস্বামী মাধবেন্দ্র পুরী পাদ ফের তাঁর যাত্রা শুরু করেন এবং অবশেষে পুরীতে পৌঁছালে মহারাজ গজপতি রাজ যথেষ্ট পরিমাণে গোপালের জন্য চন্দন পেস্ট এবং কর্পূর দান করেছিলেন এবং বোঝা বহন করবার জন্য একজন সেবকও দিয়েছিলেন। বাড়ি ফেরার পথে মাধবেন্দ্র পুরীপাদ আবার এলেন রেমুনার গোপিনাথ মন্দিরে। শীর্ণ অশতিপর বৃদ্ধ ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। সেখানে তিনি ভগবানের থেকে স্বপ্নাদেশ পেলেন আবার একটি স্বপ্ন দেখেন যাতে বৃন্দাবনের গোপাল দেবতা তাকে চন্দনকে পিষে, কর্পূরের সাথে মিশিয়ে গোপীনাথ দেবতার শরীরে লাগাতে বলেন। ভগবান গোপাল বলেছিলেন যে তিনি গোপীনাথের দেবতা থেকে আলাদা ছিলেন না। মাধবেন্দ্র পুরী ভগবান গোপালের আদেশ পালনের সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন।
গোবর্ধনের গোপাল তার স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে বলেন তিনি যেন গোপীনাথের শরীরে চন্দন ও কর্পূরের মিশ্রণ ভালো করে লাগিয়ে দেন এতে তার শরীর ঠান্ডা হবে। তিনি আরও বলেন, গোপাল ও গোপীনাথ এক ও অভিন্ন।
আজও মন্দিরে এই রীতি অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে পালিত হচ্ছে। গোপীনাথের শরীরে ৪২ দিন (গ্রীষ্মকালে) চন্দন লাগানোর প্রথা আজও প্রচলিত আছে। শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্যও এই স্থান পরিদর্শন করেছেন। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে চন্দন-যাত্রা উদযাপন উপলক্ষ্যে মদন-মোহন, গোবিন্দ এবং গোপীনাথ বিগ্রহে চন্দন পেস্ট প্রয়োগ করা হয়।
✤ (১৯) বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দিরে আগামী ২১ দিনের জন্য চন্দন যাত্রা শুরু:–
বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দিরে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে আগামী ২১ দিনের জন্য চন্দন যাত্রা শুরু হয় যেখানে ভগবান কৃষ্ণ এবং রাধারাণীকে বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড তাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য চন্দন পেস্ট মাখানো হয়।
✤ (২০) অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে বার্লির উৎপত্তি :–
ত্রেতাযুগে হোম বা যজ্ঞ ছিল ভগবানকে সাধনা করার অন্যতম উপায়। এই প্রথা ছিল ত্রেতাযুগের যুগধর্ম। এই যজ্ঞে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হত যব বা বার্লি (Barley), যা এই অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে উৎপত্তি হয়েছিল।
✤ (২১) শ্রীল প্রভুপাদ ‘লীগ অফ ডিভোটিস’ নামক ভক্ত সংগঠন তৈরি করেন:–
২০) ভক্তিবেদান্ত শ্রীল প্রভুপাদ আচার্য হলেন ইসকনের (ISKCON) প্রতিষ্ঠাতা। ISKCON-এর সম্পূর্ণ নামটি হল – ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসিয়াসনেস’ (International Society for Krishna Consciousness)। ইসকন শুরু করার আগে শ্রীল প্রভুপাদ ১৯৫৩ সালের ১৬মে অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসিতে ‘লীগ অফ ডিভোটিস’ (League of Devotees) নামে ভারতে একটি ভক্ত সমাজ গড়ে তুলেছিলেন।
অতএব, এ থেকে পরিষ্কার যে, অক্ষয় তৃতীয়া তিথি পরম মহিমাময়। এই তিথিতে যা শুভকর্ম করা হয়, তার ফল অক্ষয় পুণ্যদায়িনী। যা জ্ঞান আহরণ করা হয়, এই তিথিতে ━তাও অক্ষয় প্রভাব ফেলে বুদ্ধিতে, চিত্তে। দানের ফলও অক্ষয় হয়। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তাহলে এই তিথিতে যদি ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতে যদি কোন পাপকর্ম করে ফেলি, তবে সেটাও অক্ষয় পাপ হয়ে কর্মফলের খাতায় লেখা থাকে। তাই সতর্ক থাকাটাই শ্রেয়।
◼️ অক্ষয় তৃতীয়া তাৎপর্য ◼️
(Akshaya Tritiya Significance)
(০১) অক্ষয় তৃতীয়াকে অক্ষয় কেনো বলা হয় এর উত্তরে ভবিষ্য পুরাণে বর্ণিত রয়েছে ━
❝ অস্যাং তিথৌ ক্ষয়মুপৈতি হুতং ন দত্তং তেনাক্ষয়া।
চ মুনিভিঃ কথিতা তৃতীয়া॥ ❞
━━┉┈┈(ভবিষ্যপুরানম্, উত্তরপর্ব, ১৬/১৯)
অনুবাদ: “এই তিথিতে দানাদি সকলকর্মের ফল অক্ষয় হয়ে থাকে।তাই এই তিথিকে অক্ষয় তৃতীয়া বলা হয়।”
শাস্ত্রানুসারে এই দিনে ভালো বা খারাপ কাজ যা-ই করুন না কেন তার ফল অক্ষয় হবে বা অনন্তকাল ভোগ করতে হবে।তবে এই দিনে দান করার অসীম ফল রয়েছে।
এই দিনে শুভ কাজের অনেক গুরুত্ব বলা হয়েছে। এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে অক্ষয় তৃতীয়ায়, বাড়িতে অন্তত একজন গরীব বা অভাবীকে সম্মানের সাথে খাওয়ানো শুভ। এতে দাম্পত্য জীবনে সুখ-শান্তি আসে এবং জীবনে অর্থ ও শস্যের অভাব হয় না।
(০২) এই অক্ষয় তৃতীয়া শ্রীহরির অত্যন্ত প্রিয়। এতে স্নান, দান, অর্চনা, শ্রাদ্ধ, জপ এবং পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করলে তার সমস্তই অক্ষয় হয় বলে এই তৃতীয়াকে বলে অক্ষয় তৃতীয়া।
❝ বৈশাখস্য সিতে পক্ষে তৃতীয়াহক্ষয় সংজ্ঞকা।
অক্ষয়া লোচ্যতে লোকে তৃতীয়া হরিবল্লভা ॥
স্নানে, দানেহর্চ্চনে, শ্রাদ্ধে, জপে, পূর্বজতর্পণে ।
যে অর্চ্চয়ন্তি যবৈর্বিষ্ণুং, শ্রাদ্ধং কুর্বন্তি যত্নতঃ॥
তস্যাং কুর্বন্তি পুণ্যানী, ধন্যান্তে বৈষ্ণবা নরাঃ॥ ❞
━━┉┈┈(ভবিষ্যপুরানম্, উত্তরপর্ব, ১৬/১৯)
(০৩) এছাড়াও, এই দিনে বিবাহ, স্বর্ণ-রৌপ্য, যানবাহন, জমি-বাড়ি ইত্যাদি ক্রয়, গৃহ প্রবেশ, ভিত পূজা, কোন নতুন কাজ শুরু করা, মুণ্ডন অনুষ্ঠান প্রভৃতির জন্য কোনও বিশেষ শুভ সময়ের প্রয়োজন হয় না কারণ এই দিনটি খুবই ফলদায়ক।
✸ এই দিনে কী কাজ করা অনুচিত ✸
===========================
যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আবার যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। তাই এই দিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত, প্রতিটি কথা বলা উচিত।
◉ অজান্তেও কোন পাপ বা বৈষ্ণব অপরাধ, সেবাপরাধ, নামাপরাধ না করে ফেলি বা কোন কুভাবনা না ভাবি ━ সে বিষয়ে সজাগ থাকাটাই সমীচীন।
◉ অক্ষয় তৃতীয়ার তিথিতে কখনও তুলসী পাতা তুলবেন না। এতে শ্রীবিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মী অত্যন্ত রুষ্ট হন।
◉ এই দিনে কারও মনে দুঃখ বা আঘাত লাগে এমন কথা বলা যাবে না।
✸ এই দিনে কী কাজ করা উচিত ✸
==========================
এই দিন কী কাজ করা উচিত —
◉ এই শুভ দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করবেন ।
◉ স্নানের পর পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করবেন।
◉ এরপর বাড়ির মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাবেন ।
◉ তুলসী গাছে জল সিঞ্চন, আরতি ও পরিক্রমা করবেন।
◉ গঙ্গাজল, অগুড় (সুগন্ধি), দুধ দিয়ে ভগবানের অভিষেক করবেন।
◉ এই শুভ দিনে দেবী লক্ষ্মী এবং ভগবান বিষ্ণুর পূজার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীকে ভোগ নিবেদন করতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন যে, ঈশ্বরকে শুধুমাত্র সাত্ত্বিক ভোগ দেওয়া হয়। এই দিনে আরও বেশি করে ঈশ্বরের উপাসনা করুন এবং ঈশ্বরের ধ্যান করুন।
◉ ভোগ নিবেদনের পর আরতি করবেন।
◉ এই মাহাত্মপূর্ণ তিথিতে ভাগবত শ্রবণ, শ্রীনামসংকীর্তন, গ্রন্থ অধ্যয়ন, অর্চন-বন্দন, শ্রীগুরুসেবা, সাধুসঙ্গ, মালা জপ ━ বেশী করে মনকে গৌর-গোবিন্দের শ্রীচরণসেবায় ব্যস্ত রাখতে হবে।
❝ যার থাকবে গৌরপ্রেমে রতি,
কলি তার করবে কোন্ ক্ষতি? ❞
অক্ষয় তৃতীয়ায় ক্ষয়হীন কৃপা এভাবেই একমাত্র লব্ধ করা সম্ভব।
◼️ অক্ষয় তৃতীয়া সম্পর্কিত পৌরাণিক গল্প ◼️
অক্ষয় তৃতীয়া সম্পর্কিত পৌরাণিক গল্পটি হল:-
🕉️ একবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির মহারাজ মহামুনি শতানিককে অক্ষয় তৃতীয়া তিথির মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে বললেন। শতানিক মুনি প্রসন্ন চিত্তে বর্ণনা শুরু করলেন। পুরাকালে খুব ক্রোধসর্বস্ব, নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, ধর্মকর্মে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একদিন এক দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ তার কাছে সামান্য অন্ন এবং জল ভিক্ষা চাইলে ব্রাহ্মণ উচ্চ তীব্র স্বরে কটু ভাষায় তাঁর দুয়ার থেকে ভিখারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন আর বললেন যে, এই ত্রিসীমানায় সে যেন ঘোরাফেরা না করে অন্যত্র ভিক্ষার চেষ্টা করে। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ভিখারীকে বিষণ্ণ মনে চলে যেতে দেখে ব্রাহ্মণ পত্নী সেখানে তড়িঘড়ি উপস্থিত হলেন। ব্রাহ্মণ পত্নী সুশীলা অতিথির অবমাননা দেখতে না পেরে স্বামীর কাছে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ করলেন ভরদুপুরে অতিথি সৎকার না হলে সংসারের অমঙ্গল হবে এবং গৃহের ধন সমৃদ্ধি লোপ পাবে।
🕉️ স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিখারীকে তিনি ডাকলেন এবং দুয়ারে বসতে বললেন, তার অন্যত্র যাবার প্রয়োজন নেই। সুশীলা খুব শীঘ্র তার জন্য অন্নজল আনবার ব্যবস্থা করলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি অতিথি ভিক্ষুকের সামনে সুশীতল জল এবং অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে খাবার জন্য দিলেন। দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ ভোজন করে অতীব সন্তুষ্ট হলেন এবং যাত্রার সময় সুশীলাকে হৃদয় থেকে আশীর্বাদ করে সেই অন্নজল দানকে অক্ষয় দান বলে অভিহিত করে চলে গেলেন।
🕉️ বহু বছর পর সেই ব্রাহ্মণের অন্তিমকাল উপস্থিত হল। যমদূতেরা এসে তার ঘরে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণের দেহপিঞ্জর ছেড়ে তার প্রাণবায়ু বের হ’ল বলে। তার শেষের সেই ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত হল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তার কন্ঠ ও তালু শুকিয়ে গেল। তার উপর যমদূতদের কঠোর অত্যাচার।
🕉️ ব্রাহ্মণ তাদের কাছে দুফোঁটা জল চাইল এবং তাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করতে বলল। যমদূতেরা তখন বলল ━ ‘‘তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারীকে নির্জ্জলা বিদায় করেছিলে মনে নেই?” বলতে বলতে তারা ব্রাহ্মণকে টানতে টানতে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে গেল।
🕉️ ধর্মরাজ ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন ━ ‘‘এঁকে কেন আমার কাছে এনেছ? ইনি মহা পুণ্যবান ব্যক্তি। বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে এনার পত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন। এই দান অক্ষয় দান। সেই পুণ্যে ইনি পুণ্যাত্মা। আর সেই পুণ্যফলের জন্য এনার নরক গমন হবে না । ব্রাহ্মণকে তোমরা জল দাও। শীঘ্রই ইনি স্বর্গে গমন করবেন !!”
আপনি যদি কৃষ্ণকে ভুলে যেতে চান, তাহলে তিনি আপনাকে বিস্মৃতিই প্রদান করবেন। আবার আমরা যদি কৃষ্ণকে স্মরণ করতে চাই, তাহলে তিনি আমাদের স্মৃতিশক্তি দান করবেন। স্বভাবতই ভক্তরা কৃষ্ণকে স্মরণ করতে চায়। তাই কৃষ্ণের কাছে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, ‘‘আমি যেন সর্বদা আপনাকে স্মরণ করতে পারি এবং কখনো যেন আপনাকে ভুলে না যাই”। এভাবেই আমরা শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি।