Join to Our Community
Community Grows With You

✸ভগবদগীতায় অর্জুনের ১৬টি প্রশ্ন✸Arjuna 16 Questions in Gita✸

ভগবদগীতায় অর্জুনের ১৬টি প্রশ্ন (Arjuna 16 Questions in Gita) জানার আগে ভগবদ্‌গীতার কিছু তথ্য প্রদান করার প্রয়াস করা হল, ━

১। ভগবদ্‌গীতা কোন্ শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত?

উঃ ভগবদ্গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি অংশ। ২৫ অধ্যায় থেকে ৪২ অধ্যায় পর্যন্ত এই ১৮ টি অধ্যায়কে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা বা গীতোপনিষদ বলা হয়।

২। ১৮ অধ্যায় সমন্বিত ভগবদ্গীতাকে বৈষ্ণব আচার্যরা মুখ্যতঃ কয়ভাগে বিভক্ত করেছেন? সেগুলি কি কি?

উঃ ১৮. অধ্যায় ভগবদ্‌গীতাকে মুখ্যতঃ তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম ৬টি অধ্যায় (১ম-৬ষ্ঠ) কে বলা হয় কর্মষটক্‌,
মধ্যের ৬টি অধ্যায় (৬ষ্ঠ-১২শ) কে বলা হয় ভক্তিষটক্ এবং
শেষ ৬টি অধ্যায়কে (১৩শ-১৮শ) বলা হয় জ্ঞানষটক্‌

৩। প্রত্যেক ষটকের মধ্যে ৬টি অধ্যায়ের নাম কি কি?

উঃ আবার প্রত্যেক ষটকের মধ্যে ৬টি করে অধ্যায় রয়েছে,
কর্মষটকে্র‌ মধ্যে ৬টি অধ্যায় হল ━ (১) বিষাদযোগ, (২) সাংখ্যযোগ, (৩) কর্মযোগ, (৪) জ্ঞানযোগ, (৫) কর্মসন্ন্যাসযোগ, (৬)  ধ্যানযোগ
ভক্তিষটকে্র‌ মধ্যে ৬টি অধ্যায় হল ━ (৭) বিজ্ঞানযোগ, (৮) অক্ষরব্রহ্মযোগ, (৯) রাজগুহ্যযোগ, (১০) বিভূতিযোগ, (১১) বিশ্বরূপদর্শনযোগ, (১২) ভক্তিযোগ
জ্ঞানষটকে্র‌ মধ্যে ৬টি অধ্যায় হল ━ (১৩) প্রকৃতিপুরুষ বিবেকযোগ, (১৪) গুণত্রয় বিভাগযোগ, (১৫) পুরুষোত্তম যোগ, (১৬) দৈবাসুরসম্পদ বিভাগযোগ, (১৭) শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগযোগ, (১৮) মোক্ষ যোগ

৪। শ্রীমদ্ভ‌গবদ্গীতায় কোন্ পাঁচটি বিষয় বা তত্ত্ব মুখ্যতঃ আলোচিত হয়েছে?

উঃ ভগবদ্‌গীতায় জীব, ইশ্বর, প্রকৃতি, কর্ম এবং কাল এই পাঁচটি তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।

৫। গীতাজ্ঞান কে কাকে কোন্ স্থানে প্রদান করেছিলেন?

উঃ গীতাজ্ঞান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সখা ও শিষ্য অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুদ্ধের পূর্ব মুহুর্তে প্রদান করেছিলেন।

৬। শ্রীমদ্ভ‌গবদ্গীতায় কটি শ্লোক রয়েছে?

শ্রীমদ্ভ‌গবদ্গীতায় ৭০০টি শ্লোক রয়েছে, তার মধ্যে কে কটি শ্লোক বলেছিলেন তা হল,
(১) ধৃতরাষ্ট্র ━      ১টি শ্লোক
(২) সঞ্জয় ━      ৪০টি শ্লোক
(৩) অর্জুন ━    ৮৫টি শ্লোক (এর মধ্যে ১৬ টি প্রশ্ন করেছিলেন)
(৪) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৫৭৪ শ্লোক
এই হলো মোট গীতার ৭০০টি শ্লোক।

TABLE OF CONTENTS

Toggle

꧁◼️প্রশ্ন:১ স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির লক্ষণ কি? (২/৫৪)◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – দ্বিতীয় অধ্যায় – সাংখ্যযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিম্‌ প্রভাষেত কিম্‌ আসীত ব্ৰজেত কিম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ২/৫৪)

অনুবাদ: হে কেশব, স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কী? তিনি কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে অবস্থান করেন এবং কীভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্।
আত্মনি এব আত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদা উচ্যতে॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ২/৫৫)

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পার্থ, জীব যখন মানসিক জল্পনা থেকে উদ্ভূত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়।


◼️প্রশ্ন:২ কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? (৩/১-২)◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ জ্যায়সী চেৎ কর্মণস্তে মতা বুদ্ধিঃ-জনার্দন।
তৎ কিং কর্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব ॥১॥
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সী-ইব মে।
তৎ-একং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়ঃ-অহম্‌-আপ্নুয়াম্ ॥২॥❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৩/১-২)

অনুবাদ: অজুর্ন বললেন হে জনার্দন! হে কেশব! যদি তোমার মতে সকাম কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই হিসাংত্মক কর্মে (যুদ্ধে) কেন নিযুক্ত করছেন? ॥ ১ ॥

তোমার দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের দ্বারা আমার মন বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাই দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে শ্রেয়ষ্কর (কল্যাণকারী)? ॥ ২ ॥

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ লোকেহস্মিন দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়া-অনঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাম্ কর্মযোগেন যোগিনাম্‌ ॥ ৩ ॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর শ্রীভগবান বললেন ━ হে নিষ্পাপ অর্জুন! এই জগতে দুই প্রকার মোক্ষলাভের পথ আমি পূর্বে নির্দেশ করেছি-জ্ঞানাধিকারীদের জন্য জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগীদের জন্য কর্মযোগ।

❝ ন কর্মণাম্‌-অনারম্ভাৎ নৈষ্কর্ম্যং পুরুষঃ-অশ্নুতে ।
ন চ সন্ন্যসনাৎ-এব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥ ৪ ॥ ❞

অনুবাদ: কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।

❝ ন হি কশ্চিৎ ক্ষণম্‌-অপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।
কার্যতে হি-অবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ ॥ ৫ ॥ ❞

অনুবাদ: কেউ কখনও ক্ষণকালের জন্যও কর্ম না করে থাকতে পারে না। প্রাকৃতজাত গুণের (সত্ত্ব, তম, রজ: এই তিনটি গুণের) প্রভাবেই মানুষ কর্ম করতে বাধ্য হয়। তম ও রজ: গুণের কারণে মানুষের মধ্যে রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। এই তিন গুণের বশবতী হয়েই মানুষ কর্মে ব্রতী হয়।

❝ কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য যঃ আস্তে মনসা স্মরন্‌ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়-আত্মা মিথ্যাচারঃ সঃ উচ্যতে ॥ ৬ ॥ ❞

অনুবাদ: যে মূঢ় ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ, রস আদি ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি স্মরণ করতে থাকে, সেই মূঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং লোকে তাকে মিথ্যাচারী ভণ্ড বলে।

❝ যস্ত্ব-ইন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্য-আরভতে-অর্জুন।
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগম্‌-অসক্তঃ সঃ বিশিষ্যতে ॥ ৭ ॥ ❞

অনুবাদ: যিনি বিবেকযুক্ত মনের দ্বারা চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয় সংযত করেন এবং অনাসক্তভাবে কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।

❝ নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হি-অকর্মণঃ।
শরীরযাত্রা-অপি চ তে ন প্রসিদ্ধ্যেৎ-অকর্মণঃ ॥ ৮ ॥ ❞

অনুবাদ: তুমি শাস্ত্রবিহিত নিত্য কর্ম কর। কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। কর্মহীন হলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হবে না।

❝ যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ-অন্যত্র লোকঃ-অয়ম্‌ কর্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥ ৯ ॥ ❞

অনুবাদ: ঈশ্বরের প্রীতির জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ঈশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি অনাসক্ত হয়ে শাস্ত্রসম্মতভাবে তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

এবং প্রবর্তিতং চক্রং ন-অনুবর্তয়তি-ইহ যঃ
অঘায়ুঃ ইন্দ্রিয়ারামঃ মোঘং পার্থ সঃ জীবতি॥ ১৬ ॥ ❞

অনুবাদ: হে অর্জুন! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।

❝ যঃ-তু-আত্মরতিঃ-এব স্যাৎ-আত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।
আত্মনি-এব চ সন্তুষ্টঃ-তস্য কার্যং ন বিদ্যতে॥ ১৭ ॥ ❞

অনুবাদ: কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত এবং আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁরা কোন কর্তব্যকর্ম নেই।

অর্থাৎ যিনি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় এবং কৃষ্ণসেবায় যিনি সম্পূর্ণভাবে মগ্ন, তাঁর অন্য কোন কর্তব্য নেই। কৃষ্ণভক্তি লাভ করার ফলে তাঁর অন্তর সম্পূর্ণভাবে কলুষমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়। তিনি আত্মজ্ঞানী। হাজার হাজার যজ্ঞ অনুষ্ঠানেও যে ফল লাভ করা যায় না, কৃষ্ণভক্তির প্রভাবে তা মুহূর্তের মধ্যে সাধিত হয়। এভাবে চেতনা শুদ্ধ হলে জীব পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁর নিত্যকালের সম্পর্ক উপলব্ধিই করতে পারেন। তিনি আর বৈদিক নির্দেশ অনুসারে কর্তব্য-অকর্তব্যের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। তার আর জড় বিষয়াসক্তি থাকে না এবং কামিনী-কাঞ্চনের প্রতি তাঁর আর কোন মােহ থাকে না। 

❝ নৈব তস্য কৃতেন-অর্থঃ ন-অকৃতেন-ইহ কশ্চন।
ন চ-অস্য সর্বভূতেষু কশ্চিৎ-অর্থ-ব্যপাশ্রয়ঃ॥ ১৮ ॥ ❞

অনুবাদ: আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং কর্ম থেকে বিরত থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর (দেব-দেবীর) উপর নির্ভর করতেও হয় না।

অর্থাৎ যে মানুষ ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন তিনি অবশ্যই জানতে পেরেছেন যে, তিনি হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাই হল তার এক ও একমাত্র কর্তব্যকর্ম। তবে কৃষ্ণভক্তি এতো সহজ নয়, কৃষ্ণভক্তি মানে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে- শয়নে-স্বপনে কৃষ্ণ নাম করা, কৃষ্ণসেবা করা, শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করা, তাই কৃষ্ণভক্তেরা এক মুহূর্তের জন্য সময় নষ্ট হতে দেন না। তাই তো ভগবান আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিষ্কর্মা, অলস, আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষ কৃষ্ণভক্তি করতে পারে না। ভগবানের নির্দেশে কৃষ্ণভক্তেরা বুঝে গিয়েছে, ভগবানের সেবা করার অর্থই হল সকল দেব-দেবীর সেবা করা, আলাদা করে দেব-দেবীর পূজা করার প্রয়োজন নেই।

❝ তস্মাৎ অসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হি আচরন্ কর্ম পরম্ আপ্নোতি পুরুষঃ॥ ১৯ ॥ ❞

অনুবাদ: অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করো৷ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে।

❝ কর্মণা-এব হি সংসিদ্ধিম্-আস্থিতাঃ জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহম্-এব-অপি সংপশ্যন্ কর্তুম্-অর্হসি ॥২০॥ ❞

অনুবাদ: জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি (সফলতা) প্রাপ্ত হয়েছিলেন ৷ অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।

❝ যৎ যৎ-আচরতি শ্রেষ্ঠঃ তৎ তৎ-এব-ইতরঃ জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকঃ-তৎ-অনুবর্ততে ॥২১॥ ❞

অনুবাদ: শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারেই অনুসরণ করে।

ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন
ন-অনবাপ্তম্‌-অবাপ্তব্যম্‌ বর্ত এব চ কর্মণি ॥২২॥ ❞

অনুবাদ: হে পার্থ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।

❝ যদি হি-অহম্ ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণি-অতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্ম-অনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ॥২৩॥ ❞

অনুবাদ: হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে


◼️প্রশ্ন:৩ জীব অনিচ্ছা সত্বেও কেন পাপকর্ম করে? (৩/৩৬)◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ অথ কেন প্রযুক্তঃ-অয়ম্ পাপম্ চরতি পূরুষঃ।
অনিচ্ছন্-অপি বার্ষ্ণেয় বলাৎ-ইব নিয়োজিতঃ॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৩/৩৬)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন━হে বার্ষ্ণেয়! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণ-সমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধি-এনম্‌-ইহ বৈরিণম্ ॥ ৩৭ ॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ হে অর্জুন, রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই (কামনাই) মানুকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী (অর্থাৎ ভোগের দ্বারা কখনো তৃপ্ত হয় না) ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।

❝ ধূমেন-আব্রিয়তে বহ্নিঃ-যথা-আদর্শঃ মলেন চ।
যথা-উল্বেন-আবৃতঃ গর্ভস্তথা তেন-ইদম্-আবৃতম্॥ ৩৮ ॥ ❞

অনুবাদ: অগ্নি যেমন ধূম (ধোঁয়া) দ্বারা আবৃত্ত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত্ত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই কামের দ্বারা জ্ঞান অর্থাৎ বিবেক আবৃত থাকে।

অর্থাৎ, জীবের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু,কর্ন,নাসিকা,জিহ্বা এবং ত্বক) ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় (হস্ত, পদ, বাক্‌ বা কথা, পায়ু বা মলদ্বার, উপস্থ বা যোনিদ্বার) , সংকল্প-বিকল্পাত্মক মন (বাসনা ও সংশয় যুক্ত মন) এবং অনিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি (অল্পবুদ্ধি) হল কামের আশ্রয়। এদের দ্বারা বিবেকজ্ঞান আবৃত হলে কাম দেহাভিমানী জীবকে ভ্রান্ত করে।

বিবেক প্রকটিত হয় বুদ্ধিতে। বুদ্ধি তিন প্রকারের সাত্ত্বিক, রাজসিক,তামসিক। সাত্ত্বিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির কর্তব্য-অকর্তব্য সম্বন্ধে স্পষ্ট জ্ঞান থাকে। কিন্তু রাজসিক ও তামসিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির গীতা জ্ঞান বা ধর্ম পথে মতি থাকে না, অজ্ঞ হয়, কৃষ্ণ ভজনা করে না তাই এমন ব্যক্তির কামনার দ্বারা বিবেক অন্ধকার হয়ে থাকে।

তাই বিষয়-বাসনা যুক্ত বিবেকে কখনই আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না। অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন বা বিবেকবর্জিত লোকেরা জাগতিক ভোগ ও ঐশ্বর্যে আসক্ত থাকার কারণে তাদের বুদ্ধি বা ভক্তি একনিষ্ঠ হয় না। যেমন ধূম (ধোঁয়া) অপসারিত হলে অগ্নি প্রকাশিত হয়, ধূলিরাশি অপসারিত হলে দর্পণের স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়, প্রসবের দ্বারা জরায়ূ প্রসারিত হলে ভ্রুণের প্রকাশ হয়, সেইরূপ বিষয়-বাসনা বিদূরিত হলে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হলে ভগবানকে জানার ইচ্ছা প্রকাশ হয়, জানার ইচ্ছা থেকে ভগবানকে লাভ করার ইচ্ছা প্রকাশ হয়। তখন ভগবানের কৃপায় বিবেকে জাগ্রত হয় নিশ্চয়াত্মিকা ভক্তি বা একনিষ্ঠ ভক্তি বা নিশ্চল ভক্তি। 

❝ আবৃতং জ্ঞানম্-এতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণ-অনলেন-চ॥ ৩৯ ॥ ❞

অনুবাদ: কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।

❝ ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিঃ-অস্য-অধিষ্ঠানম্-উচ্যতে।
এতৈঃ-বিমোহয়তি-এষঃ জ্ঞানম্-আবৃত্য দেহিনম্॥ ৪০ ॥ ❞

অনুবাদ: ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।

❝ তস্মাৎ-ত্বম্-ইন্দ্রিয়াণি-আদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ।
পাপ্মানং প্রজহি হি-এনম্ জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্॥ ৪১ ॥ ❞

অনুবাদ: অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।

❝ ইন্দ্রিয়াণি পরাণি-আহুঃ-ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ॥ ৪২ ॥ ❞

অনুবাদ: আমাদের স্থুলদেহ (শরীর) থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেষ্ঠ (বা বলশালী) , ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেষ্ঠ (বা বলশালী), মন থেকে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ (বা বলশালী), বুদ্ধি হইতে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই আত্মা। সেই হলে তুমি। হে অর্জুন! সেইজন‍্য তুমি ইন্দ্রিয়সমূহ, মন এবং বুদ্ধি নিরুদ্ধ করতে সক্ষম।

এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্য-আত্মানম্-আত্মনা
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্॥ ৪৩ ॥ ❞

অনুবাদ: হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির (ঈশ্বরের প্রতি অটুট ভক্তিতে সাহায্যকারী বুদ্ধি) দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির (ভগবান থেকে প্রাপ্ত চিন্ময় শক্তি) দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।


◼️প্রশ্ন:৪ সূর্যদেবের পরে জন্ম গ্রহণ করেও, কৃষ্ণ কিভাবে তাঁকে জ্ঞান দান করলেন? (৪/৪)◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।
কথম্-এতৎ বিজানীয়াং ত্বম্-আদৌ প্রোক্তবান্-ইতি॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৪/৪)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন━সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার অনেক পূর্বে। তুমি যে পুরাকালে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলে, তা আমি কেমন করে বুঝব?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চ-অর্জুন।
তানি-অহম্ বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থু পরন্তপ ॥৫॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ হে পরন্তপ! হে অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।

❝ অজঃ-অপি সন্-অব্যয়াত্মা ভূতানাম্-ঈশ্বরঃ-অপি সন্।
প্রকৃতিং স্বাম্-অধিষ্ঠায় সম্ভবামি-আত্মমায়য়া ॥৬॥ ❞

অনুবাদ: যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

❝ যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিরর্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম্‌-অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥৭॥ ❞

অনুবাদ: হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।

❝ পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥৮॥ ❞

অনুবাদ: সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।


◼️প্রশ্ন:৫ কর্মত্যাগ (কর্মসন্ন্যাস) ও কর্মযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? (৫/১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – পঞ্চম অধ্যায় – কর্মসন্ন্যাসযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ সন্ন্যাসং কর্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগং চ শংসসি।
যৎ-শ্রেয়ঃ এতয়োরেকং তন্মে ব্রূহি সুনিশ্চিতম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৫/১)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন━ হে শ্রীকৃষ্ণ, প্রথমে তুমি আমাকে কর্ম ত্যাগ করতে বললে এবং তারপর কর্মযোগের অনুষ্ঠার করতে বললে। এই দুটির মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর তা সুনিশ্চিতভাবে আমাকে বল।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরৌ-উভৌ।
তয়োস্তু কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে ॥২॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ কর্মত্যাগ (সন্ন্যাস) ও কর্মযোগ (নিষ্কামভাবে কর্ম) উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু, এই দুটির মধ্যে কর্মযোগ কর্মসন্ন্যাস থেকে শ্রেয়।

❝ জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে ॥৩॥ ❞

অনুবাদ: হে মহাবাহো! যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্নাসী বলে জানবে। এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দ্বরহিত (রাগ-দ্বেষ শূন্য ব্যক্তি অর্থাৎ যে পুরুষ কারোর প্রতি রাগ-দ্বেষ করেন না) এবং তিনি পরম সুখে আনন্দপূর্বক সংসার রূপ বন্ধন (কর্মবন্ধন) থেকে মুক্তি লাভ করেন।

❝ ব্রহ্মণি-আধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যত্ত্বা করোতি যঃ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রম্-ইব-অম্ভসা॥ ১০॥ ❞

অনুবাদ: যিনি সমস্ত কর্মের ফল পরমেশ্বর ভগবানকে অর্পণ করে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করেন, কোন পাপ তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারে না, ঠিক যেমন জল পদ্মপাতাকে স্পর্শ করতে পারে না।


◼️প্রশ্ন:৬ তোমার উপদেশ অনুসারে যোগের দ্বারা চঞ্চল মনকে স্থির করতে পারছি না কেন? (৬/৩৩-৩৪) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – ষষ্ঠ অধ্যায় – ধ্যানযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ যো-অয়ম্ যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন।
এতস্য-অহম্ ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৬/৩৩)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন━ হে মধুসূদন! তুমি সর্বত্র সমদর্শনরূপ যে যোগ উপদেশ করলে, মনের চঞ্চল স্বভাববশত আমি তার স্থায়ী স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।

❝ চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবৎ-দৃঢ়ম্।
তস্য-অহম্ নিগ্রহং মন্যে বায়োঃ-ইব সুদুষ্করম্॥৩৪॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৬/৩৪)

অনুবাদ: হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, বিক্ষোভকারী, অত্যন্ত দৃঢ় ও বলবান। তাই একে নিগ্রহ (দমন) করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে॥৩৫॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন— হে মহাবাহো! নিঃসন্দেহে মন চঞ্চল এবং তাকে বশে রাখা কঠিন। কিন্তু হে কৌন্তেয়! ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যর দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়।

❝ অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যঃ-অবাপ্তুম্-উপায়তঃ॥৩৬॥ ❞

অনুবাদ: অসংযত চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে আত্ম-উপলব্ধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায়  অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন। সেটিই আমার অভিমত।


◼️প্রশ্ন:৭ পতিত যোগীর কী গতি লাভ হয়? (৬/৩৭-৩৯) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – ষষ্ঠ অধ্যায় – ধ্যানযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ অযতিঃ শ্রদ্ধয়া-উপেতো যোগাৎ-চলিতমানসঃ।
অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৬/৩৭)

অনুবাদ: অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন━ হে কৃষ্ণ! যিনি প্রথমে শ্রদ্ধা সহকারে যোগে যুক্ত থাকার পরেও চিত্তচাঞ্চল্য হেতু ভ্রষ্ট হয়ে যোগে সিদ্ধিলাভ (অর্থাৎ ভগবদ্ সাক্ষাৎকার লাভ) করতে না পারেন, তবে সেই ব্যর্থ যোগীর কি গতি লাভ হয়?

❝ কচ্চিৎ-ন-উভয়বিভ্ৰষ্টঃ  ছিন্নাভ্রম্-ইব নশ্যতি।
অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৬/৩৮)

অনুবাদ: হে মহাবাহো কৃষ্ণ! কর্ম ও যোগ হতে ভ্রষ্ট ব্যক্তি ব্রহ্ম লাভের (ঈশ্বরপ্রাপ্তির) পথ থেকে বিমূঢ় (বিভ্রান্ত) হয়ে যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে,  তবে সে কি ছিন্ন মেঘের মতো একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে?

এতন্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুম-অর্হসি-অশেষতঃ
ত্বদন্যঃ সংশয়স্য-অস্য ছেত্তা ন হি-উপপদ্যতে॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৬/৩৯)

অনুবাদ: হে কৃষ্ণ! তুমিই কেবল আমার এই সংশয় দূর করতে সমর্থ। কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউই আমার এই সংশয় দূর করতে পারবে না।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে।
ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি॥৪০॥❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন— হে পার্থ! শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদের (ঈশ্বর লাভের জন্য যাঁরা কর্ম করেন) ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি  হয় না। হে বৎস! তার কারণ, কল্যানকারীর কখনও অধোগতি (দুর্গতি প্রাপ্ত) হয় না।

❝ প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ।
শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টঃ-অভিজায়তে॥৪১॥ ❞

অনুবাদ: যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুণ্যাত্মাগণের প্রাপ্যলোক অর্থাৎ স্বর্গাদি উত্তমলোক লাভ করে তাতে বহুকাল বাস করে পুনরায় সদাচারসম্পন্ন ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা ধনীর গৃহে জন্নগ্রহণ করেন।

❝ অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্।
এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যৎ-ঈদৃশম্॥৪২॥ ❞

অনুবাদ: অথবা (দীর্ঘ সাধনার কারণে) যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেইসকল লোকে না গিয়ে জ্ঞানবান যোগীর কুলে জন্মগ্রহণ করেন ৷ এরূপ জন্ম জগতে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুর্লভ ৷

তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্বদেহিকম্
যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন॥৪৩॥

অনুবাদ: হে কুরুনন্দন! সেই প্রকার জন্মগ্রহণ করার ফলে তিনি তাঁর পূর্বজন্মের সুকৃতির কারণে পারমার্থিক চেতনার বুদ্ধিসংযোগ লাভ করে এবং তার প্রভাবে পুনরায় পরমাত্মলাভের জন্য তিনি পূর্বাপেক্ষা তীব্রভাবে চেষ্টা করেন ৷ 

❝ পূর্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হি-অবশঃ-অপি সঃ।
জিজ্ঞাসুর-অপি যোগস্য শব্দব্রহ্ম-অতিবৰ্ততে॥৪৪॥ ❞

অনুবাদ: তিনি (শ্রীসম্পন্ন সদাচারী ব্যক্তির গৃহে জন্মগ্রহণকারী) যোগভ্রষ্ট হয়েও পূর্বজন্মের অভ্যাসবশে ভগবানের প্রতি (যোগ-সাধনের প্রতি) আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্রের জিজ্ঞাসু পুরুষ বেদে-বর্ণিত সকাম কর্মমার্গকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ সকাম কর্মমার্গে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, তার থেকে উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন।

❝ প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ।
অনেকজন্ম-সংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্॥৪৫॥ ❞

অনুবাদ: কিন্তু যত্নশীল অভ্যাসকারী যোগী, বিগত বহুপূর্বজন্মের সঞ্চিত সাধন সংস্কারের প্রভাবে ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্নবান হয়ে এই জন্মেই পাপ মুক্ত হয়ে যান এবং তৎকালেই পরমগতি লাভ করেন। 

❝ তপস্বিভ্যঃ-অধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যঃ-অপি মতোহধিকঃ।
কর্মিভ্যশ্চ-অধিকো যোগী তস্মাদযোগী ভবার্জুন॥৪৬॥ ❞

অনুবাদ: যোগী তপস্বীদের থেকে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানীদের (অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণের) থেকে শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মীদের থেকেও শ্রেষ্ঠ। অতএব, হে অর্জুন! সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।

◼️যোগী কাকে বলে? ◼️

ভগবত গীতার ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের শুরুতেই ভগবান অর্জুনকে বলছেন, ━

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নিঃ-ন চ-অক্রিয়ঃ॥১॥❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন— কেবল অগ্নিত্যাগী ব্যক্তি (যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন) এবং কর্মত্যাগী ব্যক্তি (দৈহিক চেষ্টাশূন্য) তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নন। যিনি কর্মফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে তাঁর কর্তব্য কর্ম করেন, তিনিই যথার্থ সন্ন্যাসী বা যোগী।

❝ যং সন্ন্যাসম্-ইতি প্রাহুরর্যোগং তং বিদ্ধি পান্ডব।
ন হি-অসন্ন্যস্তসঙ্কল্পঃ যোগী ভবতি কশ্চন॥২॥ ❞

অনুবাদ: হে পান্ডব! যাকে সন্ন্যাস বলা যায়, তাকেই যোগ বলা যায়, কারণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনই যোগী হওয়া যায় না।

◼️সমস্ত প্রকার যোগীদের মধ্যে কোন প্রকার যোগী শ্রেষ্ঠ? ◼️

❝ যোগিনাম্-অপি সর্বেষাং মদগতেন-অন্তরাত্মনা।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ॥৪৭॥ ❞

অনুবাদ: যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্‌গত চিত্তে আমার ভজনা করেন, তিনিই সর্বদা অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।

আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: — যিনি শ্রদ্ধা সহকারে ‘মদ্‌গত চিত্তে’ অর্থাৎ কৃষ্ণভাবনাময় চিত্তে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন, শ্রীকৃষ্ণেতেই আসক্ত হয়ে অন্তরে সবসময় তাঁর কথা চিন্তা করেন তিনি শ্রেষ্ঠ যোগী। তিনি সব থেকে অন্তরঙ্গ ভাবে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকেন।


◼️প্রশ্ন:৮ ব্রহ্ম কি? (৮/১-২) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – অষ্টম অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্মযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ কিং তদ্-ব্রহ্ম কিং অধ্যাত্মাং কিং কর্ম পুরুষোত্তম।
অধিভুতং চ কিং প্রোক্তম্‌-অধিদৈবং কিং উচ্যতে॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৮/১)

অনুবাদ: অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন━ হে পুরুষোত্তম! ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কি? কর্ম কি? অধিভুত ও অধিদৈবই বা কাকে বলে? অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্পষ্ট করে বল।

❝ অধিযজ্ঞঃ কথং কোহত্র দেহে-অস্মিন্-মধুসূদন।
প্রয়াণকালে চ কথং জ্ঞেয়ঃ-অসি নিয়তাত্মভিঃ॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ৮/২)

অনুবাদ: হে মধুসূদন! এই দেহে অধিযজ্ঞ কে, এবং এই দেহের মধ্যে তিনি কীরূপে অবস্থিত? মৃত্যুকালে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কীভাবে তোমাকে জানতে পারেন?

|শ্রীভগবানুবাচ|

অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবঃ-অধ্যাত্মম্-উচ্যতে
ভূতভাবোদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ॥৩॥❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন— নিত্য বিনাশহীন জীবকে বলা হয় ব্রহ্ম এবং তার নিত্য স্বভাবকে বলে অধ্যাত্ম। এই জীবেদের (ভূতগণের) উৎপত্তি ও বৃদ্ধি নিয়ে সংসারই (যেখানে নানা যজ্ঞাদি সম্পন্ন হয়) হল কর্ম

আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: — ব্রহ্ম বলতে জীবকে বোঝায় এবং পরব্রহ্ম বলতে পরমেশ্বর ভগবানকে বোঝায়। পরব্রহ্মের (ভগবানের) অনুসদৃশ অংশ হল ব্রহ্ম (জীব)। জড় চেতনায় জীব সর্বদা জড়ের উপর আধিপত্য করতে চায়, কিন্তু পারমার্থিক চেতনায়, জীব কৃষ্ণভাবনামৃত হয়ে ভগবানের সেবা করতে চায়। জড় প্রকৃতিতে জীব তার কর্ম অনুসারে চুরাশি লক্ষ যোনীর বিভিন্ন দেহের যে কোনও একটি দেহপ্রাপ্ত হয় যেমন, মানুষ, পশু, পাখি প্রভৃতি। মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে নানা রকম সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার জন্য সে কখনও কখনও যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, কিন্তু তার সেই পুণ্যকর্মফলগুলি যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সে এই পৃথিবীতে পতিত হয়ে আবার মনুষ্যদেহ ধারণ করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় কর্ম । এই প্রক্রিয়াটি হল – 

জীবের যখন অর্জিত পুণ্যকর্মফল শেষ হয়ে যায়, তখন তার জীবাত্মা বৃষ্টির মাধ্যমে এই পৃথিবীতে পতিত হয়; তারপর সে শস্যকণায় পরিণত হয়। মানুষ সেই শস্য আহার করে এবং তা বীর্যে পরিণত হয়, তারপর সেই বীর্য নারীকে গর্ভবতী করে। এভাবেই জীবাত্মা আবার মনুষ্যদেহ প্রাপ্ত হয়ে যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূর্বক একই ক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে। এভাবেই জীব প্রতিনিয়ত এই জড় জগতে গমনাগমন করতে থাকে।

কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্ত অবশ্য এই ধরনের যজ্ঞানুষ্ঠান পরিহার করেন। তিনি সরাসরিভাবে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্ভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন এবং ভগবতধামে অর্থাৎ ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন।

অধিভুতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চ-অধিদৈবতম্
অধিযজ্ঞঃ-অহম্-এব-অত্র দেহে দেহভৃতাং বর॥৪॥

অনুবাদ: হে নরশ্রেষ্ঠ! সমস্ত নশ্বর পদার্থ (জড়া প্রকৃতি) হল অধিভূত। সূর্য, চন্দ্র আদি সমস্ত দেবতাদের সমষ্টিরূপ বিরাট পুরুষ হল অধিদৈব এবং বিষ্ণুর অংশসম্ভূত সমস্ত দেহে অন্তর্গত অন্তর্যামীরূপে আমিই অধিযজ্ঞ

❝ অন্তকালে চ মামেব স্মরন্-মুক্তা কলেবরম্।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ॥৫॥ ❞

অনুবাদ: মৃত্যুর সময়ে যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ৷

❝ যং যং বা-অপি স্মরন্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্।
তং তং-এব-এতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ॥৬॥ ❞

অনুবাদ: অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন।

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুষ্মর যুধ্য চ
ময়ি-অর্পিতমনোবুদ্ধিঃ-মাম্‌-এব-এষ্যসি-অসংশয়ম্॥৭॥

অনুবাদ: অতএব হে অর্জুন ! তুমি সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাব বিহিত যুদ্ধ করো ৷ আমাতে মন ও বুদ্ধি অর্পণ করলে তুমি আমাকেই লাভ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

❝ অভ্যাসযোগযুক্তেন চেতসা ন-অন্যগামিনা।
পরমং পুরুষং দিব্যং যাতি পার্থ-অনুচিন্তয়ন্॥৮॥ ❞

অনুবাদ: হে পার্থ! অভ্যাস যোগে যুক্ত হয়ে অনন্যগামী (একাগ্র) চিত্তে যিনি অনুক্ষণ (নিরন্তর) পরম পুরুষের (পরমেশ্বরের) চিন্তা করেন, তিনি অবশ্যই তাঁকেই লাভ করেন।


◼️প্রশ্ন:৯ ভগবানের বিভূতি সকল জানার ইচ্ছা করি (১০/১৬-১৭) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – দশম অধ্যায় – বিভূতিযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ বক্তুম্-অর্হসি-অশেষেণ দিব্যাঃ হি-আত্মবিভূতয়ঃ।
যাভিঃ-বিভূতিভিঃ-লোকান্-ইমান্-ত্বম্ ব্যাপ্য তিষ্ঠসি॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১০/১৬)

অনুবাদ: তুমি যে সমস্ত বিভূতির দ্বারা এই লোকসমূহে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছ, সেই সমস্ত তোমার দিব্য বিভূতিগুলি তুমিই কেবল বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে সমর্থ।

কথং বিদ্যাম্‌-অহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়ন্ ।
কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্তোঽসি ভগবন্নয়া॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১০/১৭)

অনুবাদ: হে যোগেশ্বর, কীভাবে সর্বদা তোমার চিন্তা করব এবং কীভাবে আমি তোমাকে জানতে পারব? হে ভগবান, কোন কোন বিবিধ রূপের মাধ্যমে আমি তোমাকে চিন্তা করব?

বিস্তরেণ-আত্মনঃ যোগং বিভূতিম্-চ জনার্দন ।
ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তিরৰ্হি শৃণ্বতো নাস্তি মে-অমৃতম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১০/১৮)

অনুবাদ: হে জনার্দন, তোমার যোগশক্তি ও বিভূতি বিস্তারিতভাবে পুনরায় আমাকে বল। কারণ তোমার উপদেশামৃত শ্রবণ করে আমার পরিতৃপ্তি হচ্ছে না; আমি আরো শ্রবণ করতে ইচ্ছা করি।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হি-আত্মবিভূতয়ঃ ।
প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে॥১৯॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ হে কুরুশ্রেষ্ঠ! আমি আমার দিব্য প্রধান বিভূতিসমূহ তোমাকে বলব, যেহেতু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই।

❝ অহম্-আত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ ।
অহম্‌-আদিশ্চ মধ্যম্-চ ভূতানামন্ত এব চ ॥২০॥ ❞

অনুবাদ: হে গুড়াকেশ, আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত।

❝ আদিত্যানাম্‌-অহং বিষ্ণুরর্জ্যোতিষাং রবিরঅংশুমান্ ।
মরীচিঃ-মরুতাম্-অস্মি নক্ষত্রাণাম্-অহম্ শশী॥২১॥ ❞

অনুবাদ: আদিত্যদের (অদিতির দ্বাদশ পুত্রের) মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের (জ্যোতিসমূহের) মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের (অন্তরীক্ষে প্রবহমান পঞ্চাশ রকমের বায়ু) মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র

❝ বেদানাং সামবেদো-অস্মি দেবানাম্‌-অস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চ-অস্মি ভূতানাম-অস্মি চেতনা॥২২॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা

❝ রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চ-অস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাং পাবকশ্চ-অস্মি মেরুঃ শিখরিণাম্‌-অহম্॥২৩॥ ❞

অনুবাদ: একাদশ রুদ্রদের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি ধনাধিপতি কুবের, অষ্টবসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের (উচ্চ গিরিশৃঙ্গের) মধ্যে আমি সুমেরু

❝ পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্।
সেনানীনাম্‌-অহং স্কন্দঃ সরসাম্‌-অস্মি সাগরঃ ॥২৪॥ ❞

অনুবাদ: হে পার্থ ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান দেবগুরু বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি দেবসেনাপতি কার্তিকেয় এবং জলাশয়সমূহের মধ্যে আমি সাগর

❝ মহর্ষীণাং ভৃগুর-অহং গিরাম্-অস্মি-একম্-অক্ষরম্।
যজ্ঞানাং জপযজ্ঞঃ-অস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ॥২৫॥ ❞

অনুবাদ: মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি ওঁকার। যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপ-যজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয় পর্বত।

❝ অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ ।
গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ॥২৬॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ বৃক্ষ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে আমি কপিল মুনি

❝ উচ্চৈঃশ্রবসম্‌-অশ্বানাং বিদ্ধি মাম্‌-অমৃতোদ্ভবম্ ।
ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাম্-চ নরাধিপম্ ॥২৭॥ ❞

অনুবাদ: অশ্বসমূহের মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে ৷ শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট (রাজা)।

❝ আয়ুধানাম্‌-অহং বজ্রং ধেনূনাম্‌-অস্মি কামধুক্ ।
প্রজনশ্চ-অস্মি কন্দর্পঃ সৰ্পাণাম্‌-অস্মি বাসুকিঃ ॥২৮॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। শাস্ত্রোক্ত নিয়মানুসারে সুসন্তান উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব (কন্দর্প) এবং সর্পদের মধ্যে আমিই সর্পরাজ বাসুকি

❝ অনন্তশ্চ-অস্মি  নাগানাং বরুণো যাদসাম্‌-অহম্ ।
পিতৃণাম্‌-অর্যমা চ-অশ্মি যমঃ সংযমতাম্‌-অহম্ ॥২৯॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত নাগগণের মধ্যে আমি অনন্ত শেষনাগ এবং জলচর প্রাণীদের মধ্যে তাদের অধিপতি আমি বরুণ। পিতৃগণের মধ্যে আমি পিতৃরাজ অর্যমা এবং দণ্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম

❝ প্রহ্লাদশ্চ-অস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তাম্‌-অহম্ ।
মৃগাণাম্-চ মৃগেন্দ্ৰঃ-অহম্ বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্‌ ॥৩০॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত দৈত্যদের মধ্যে আমি প্রহ্লাদ, বশীকারীদের (গণনাকারীদের) মধ্যে আমি কাল (সময়), পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়

❝ পবনঃ পবতাম্-অস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতাম্-অহম্।
ঝষাণাম্ মকরঃ-চ-অস্মি স্রোতসাম্-অস্মি জাহ্নবী ॥৩১॥ ❞

অনুবাদ: আমি পবিত্রকারীদের মধ্যে বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যকুলের মধ্যে আমি মকর (কুমির) এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা

❝ সর্গাণাম্-আদিঃ-অন্তঃ-চ মধ্যম্ চ-এব-অহম্-অর্জুন।
অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাম্ বাদঃ প্রবদতাম্-অহম্ ॥৩২॥ ❞

অনুবাদ: হে অর্জুন! সমগ্র সৃষ্টির আদি, মধ্য ও অন্তও আমি৷ সমস্ত বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ ও পরস্পর বিবাদকারীদের মধ্যে আমি সিদ্ধান্তবাদ

❝ অক্ষরাণাম্-অকারঃ-অস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ।
অহম্-এব-অক্ষয়ঃ কালঃ ধাতা-অহম্ বিশ্বতোমুখঃ ॥৩৩॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অ-কার, সমাসসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমাস, সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা

❝ মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চ-অহম্-উদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্ ।
কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা॥৩৪॥ ❞

অনুবাদ: সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সকলের সর্বগ্রাসী মৃত্যু এবং উদ্ভূতকারীদের উৎপত্তির কারণ ৷ নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাক্ (বাণী), স্মৃতি, মেধা, ধৃতি এবং ক্ষমা

❝ বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসাম্-অহম্ ।
মাসানাং মার্গশীর্ষঃ-অহম্‌-ঋতূনাম্ কুসুমাকরঃ॥৩৫॥ ❞

অনুবাদ: সামবেদের গীতসমূহের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং সমস্ত ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী, মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং সকল ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত

❝ দৃত্যং ছলয়তাম্-অস্মি তেজঃ-তেজস্বিনাম্-অহম্ ।
জয়ঃ-অস্মি ব্যবসায়ঃ-অস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতাম্-অহম্॥৩৬॥ ❞

অনুবাদ: ছলনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া (বাজি রেখে খেলা), প্রভাবশালী (তেজস্বী) ব্যক্তিদের প্রভাব (তেজ) আমি, আমি বিজয়ীগণের বিজয় , অধ্যবসায়শীল ব্যক্তিদের অধ্যবসায় এবং সাত্ত্বিক পুরুষদের সত্ত্বগুণও আমিই।

❝ বৃষ্ণীনাং বাসুদেবঃ-অস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ ।
মুনীনাম্-অপি-অহম্ ব্যাসঃ কবীনাম্-উশনা কবিঃ ॥৩৭॥ ❞

অনুবাদ: বৃষ্ণিবংশীয়দের মধ্যে আমি বাসুদেব অর্থাৎ তোমার সখা, পাণ্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন অর্থাৎ তুমি, মুনিদের মধ্যে আমি বেদব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি উশনা অর্থাৎ শুক্রাচার্য (দৈত্যগুরু)।

❝ দণ্ডো দময়তাম্-অস্মি নীতিঃ-অস্মি জিগীষতাম্ ।
মৌনম্-চ-এব-অস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতাম্-অহম্॥৩৮॥ ❞

অনুবাদ: আমি দমনকর্তাদের দণ্ড (শক্তি) , জয় লাভ ইচ্ছুকদের নীতি, গোপনীয় বিষয়সমূহের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানীদের মধ্যে আমি তত্ত্বজ্ঞান


◼️প্রশ্ন:১০ ভগবানের ঐশ্বরীয় রূপ (বিশ্বরূপ) দেখতে ইচ্ছা করি (১১/৩-৪) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – একাদশ অধ্যায় – বিশ্বরূপদর্শনযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ এবম্-এতৎ যথাত্থ ত্বম্-আত্মানম্ পরমেশ্বর।
দ্রষ্টুম্‌-ইচ্ছামি তে রূপম্‌-ঐশ্বরম্‌ পুরুষোত্তম্‌॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১১/৩)

অনুবাদ: হে পরমেশ্বর! তোমার সম্বন্ধে যেরূপ বলেছ, যদিও আমার সম্মুখে তোমাকে সেই রূপেই দেখতে পাচ্ছি, তবুও হে পুরুষোত্তম ! তুমি যেভাবে এই সৃষ্টিতে প্রবেশ করেছ, আমি তোমার সেই জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য এবং তেজ-যুক্ত ঐশ্বর্যময় রূপ (বিশ্বরূপ) দেখতে ইচ্ছা করি।

❝ মন্যসে যদি তৎ-শক্যম্ ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো।
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়-আত্মানম্-অব্যয়ম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১১/৪)

অনুবাদ: হে প্রভু! আমাকে যদি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করার যোগ্য মনে কর—তাহলে হে যোগেশ্বর! আমাকে তোমার সেই অনন্ত নিত্যস্বরূপের দর্শন দান কর।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশঃ-অথ সহস্ৰশঃ ।
নানাবিধানি দিব্যানি নানাবৰ্ণাকৃতীনি চ॥৫॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ হে পার্থ, এবার তুমি আমার নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট শত শত ও সহস্র সহস্র বিভিন্ন দিব্য (অলৌকিক) রূপসমূহ দর্শন করো।

❝ পশ্য-আদিত্যান্ বসূন্ রুদ্রান্-অশ্বিনৌ মরুতঃ-তথা।
বহূনি-অদৃষ্টপূর্বাণি পশ্য-আশ্চর্যাণি ভারত ॥৬॥ ❞

অনুবাদ: হে ভরতবংশীয় অর্জুন! তুমি আমার মধ্যে দ্বাদশ আদিত্য (অদিতির পুত্র), অষ্ট বসু, একাদশ রূদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ও ঊনপঞ্চাশ মরুতগণ (বায়ু) দর্শন করো এবং আগে যা কখনো দেখোনি, তেমন বহু আশ্চর্যময় রূপ দর্শন করো।

❝ ইহ-একস্থম্ জগৎ কৃৎস্নম্ পশ্যাদ্য সচরাচরম্।
মম দেহে গুড়াকেশ যচ্চান্যদ্ দ্রষ্টুম্-ইচ্ছসি॥৭॥ ❞

অনুবাদ: হে গুড়াকেশ (অর্জুন)!  আমার এই বিরাট শরীরে একত্রে অবস্থিত সমগ্র স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বজগত এবং অন্য যা কিছু দেখতে ইচ্ছা কর, তা এক্ষণে দর্শন করো।

❝ ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুম্-অনেন-এব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগম্-ঐশ্বরম্॥৮॥ ❞

অনুবাদ: কিন্তু তুমি তোমার বর্তমান প্রাকৃত চক্ষুর দ্বারা আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে না। তাই, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু (অর্থাৎ অলৌকিক চক্ষু) প্রদান করছি। তার সাহায্যে তুমি আমার অচিন্ত্য যোগৈশ্বর্য দর্শন করো !


◼️প্রশ্ন:১১ ভগবানের উগ্ররূপের পরিচয় কি? (১১/৩১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – একাদশ অধ্যায় – বিশ্বরূপদর্শনযোগ*****

অর্জুনের একাদশতম প্রশ্ন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের একত্রিংশতি নং শ্লোকে উল্লেখ করেছেন—

|অর্জুন উবাচ |

❝ আখ্যাহি মে কো ভবান্-উগ্ররূপো নমোহস্তু তে দেববর প্রসীদ।
বিজ্ঞাতুম্ ইচ্ছামি ভবন্তম্ আদ্যম্ ন হি প্রজানামি তব প্ৰবৃত্তিম্॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১১/৩১)

অনুবাদ: উগ্রমূর্তিরূপে তুমি কে, কৃপা করে আমাকে বল। হে দেবশ্রেষ্ঠ! তোমাকে নমস্কার করি, তুমি প্রসন্ন হও। তুমি হচ্ছ আদিপুরুষ। আমি তোমার প্রবৃত্তি অবগত নই, আমি তোমাকে বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছা করি।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ কালঃ-অস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তম্-ইহ প্রবৃত্তঃ ।
ঋতে-অপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে যে-অবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ॥৩২॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ আমি লোকবিনাশক (লোকক্ষয়কারী) প্রবৃদ্ধ কাল, এখন লোকসংহারে প্রবৃত্ত হয়েছি। তুমি যদি যুদ্ধ না করো , তবুও তোমরা (পাণ্ডবেরা) ছাড়া উভয়পক্ষের কোনো যোদ্ধাই জীবিত থাকবে না অর্থাৎ এঁদের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।

আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ 
===================
🌸অর্জুন একাদশতম প্রশ্নে ভগবানকে বলছেন,  উগ্রমূর্তি তুমি কে, কৃপা করে আমাকে বল। হে দেবশ্রেষ্ঠ! তোমাকে নমস্কার করি, তুমি প্রসন্ন হও। তুমি হচ্ছ আদিপুরুষ। আমি তোমার প্রবৃত্তি অবগত নই, আমি তোমাকে বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছা করি।
 
🌸এখন প্রশ্ন হতে পারে অর্জুনের মনে এই রকম প্রশ্নের উদয় হলো কেন? তার সহজ সরল উত্তর পেতে গেলে আমাদের আগের শ্লোকের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা দেখতে পাই দশম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে ভগবান বলেছেন,

অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তব-অর্জুন
বিষ্টভ্য-অহম্-ইদম্  কৃৎস্নম্-একাংশেন স্থিতো জগৎ।। (১০/৪২)

হে অর্জুন! অথবা এই প্রকার বহু জ্ঞানের দ্বারা তোমার কি প্রয়োজন? আমি আমার এক অংশের দ্বারা সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত আছি। এই কথা শোনার পর অর্জুনের মনে প্রশ্ন জাগল কিভাবে তিনি সর্বব্যাপ্ত হয়ে আছেন তা আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তা হলে কি ভগবানের কথায় অর্জুনের সংশয় আছে—না, অর্জুন ভগবানের যশ যাতে মানুষ আরো ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে সেই কারণে দেখতে চাইছেন। কারণ পরবর্তীতে যদি কেউ নিজেকে ভগবান বলে জাহির করতে চান তাহলে তাকে অবশ্যই বিশ্বরূপ দেখাতে হবে। তাছাড়া ভগবানের অদ্ভূত কার্যকলাপ দেখে মানুষ সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এই রকম অনেক কারণকে কেন্দ্র করেই অর্জুন ভগবানের বিশ্বরূপ দেখতে চেয়েছিলেন। আর ভক্তবৎসল পরম করুণাময় ভগবান ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য ১১।৫-৭ নং শ্লোকে চারবার ‘পশ্য’ মানে ‘দ্যাখো’ কথাটি উল্লেখ করেছেন। অর্জুন দশম অধ্যায়ের গুণাগুণ শ্রবণ করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ভগবানকে ‘পদ্মপলাশলোচন’ বলে সম্বোধন করে বিশ্বরূপ দেখার অভিলাষ করলেন।

🌸ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন —

ন তু মাং শক্যসে দ্রষ্টুম্-অনেন-এব স্বচক্ষুষা।
দিব্যং দদামি তে চক্ষুঃ পশ্য মে যোগম্-ঐশ্বরম্॥১১/৮॥

কিন্তু তুমি তোমার বর্তমান চক্ষুর দ্বারা আমাকে দর্শন করতে সক্ষম হবে না। তাই, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। তুমি আমার অচিন্ত্য যৌগেশ্বর্য দর্শন কর। দিব্য চক্ষু মানে দেবতাদের চক্ষু। তাহলে আমাদের মনে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসবে অর্জুনের আগে কোন্ চক্ষু ছিল? তার উত্তর হচ্ছে অর্জুনের চক্ষু ছিল চিন্ময় কারণ ভগবানের শরীর ছিল পূর্ণ সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। ভগবানের আংশিক প্রকাশ ছিল এই বিশ্বরূপ। এই বিশ্বরূপ হচ্ছে ভগবানের জড়রূপ, তাই ভগবান অর্জুনকে দান করলেন – দেবতাদের চক্ষু বা দিব্যচক্ষু যা জড় রূপ দেখতে সক্ষম হবে।

ভগবান অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন একই রথের উপর উপবিষ্ট হয়ে দর্শন করছিলেন, হাজার হাজার গ্রহলোক শ্রীকৃষ্ণের শরীরে অবস্থান করছে—তাই অর্জুন ভগবানকে করজোড়ে প্রণাম নিবেদন করছেন। অর্জুন দেখছেন, ঊর্ধ্বলোক ব্রহ্মলোক থেকে শুরু করে নিম্নলোক অনন্তশেষ পর্যন্ত অর্থাৎ সনাতন ধর্মের রক্ষা এবং সনাতন পরমপুরুষ।

🌸অর্জুনই কেবল বিশ্বরূপ দর্শন করেন নি, অন্যান্য গ্রহলোকের অধিবাসীরাও দর্শন করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য গ্রহলোকের অধিবাসীরা এই বিশ্বরূপ দর্শন করে ভয় পান নি কিন্তু অর্জুন কেন ভয় পেলেন? তার উত্তর হল ভগবান অর্জুনকে কেবল দিব্যচক্ষু প্রদান করেছিলেন কিন্তু ‘দিব্যমন’ প্রদান করেন নি—তাই অর্জুনের মন ভয়ের দ্বারা বিচলিত হয়েছিল। তাই অর্জুন ভগবানকে ‘হে দেবেশ’, ‘হে জননিবাস’ বলে সম্বোন্ধন করে বলেছেন, আমি শান্তি পাচ্ছি না। অর্জুন দেখলেন, ভগবানের জলন্ত মুখবিবরে কি ভাবে দুই পক্ষের রথী ও মহারথীরা প্রবেশ করছেন। তিনি এও দেখলেন পিতামহ ভীষ্ম, গুরুদেব দ্রোণাচার্য ও কর্ণও কি ভাবে প্রবেশ করছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেবল তিন জনের নাম কেন বললেন? এর উত্তর হচ্ছে পিতামহ ও গুরুদেবের প্রতি অর্জুনের প্রবল আসক্তি ছিল আর কর্ণ হচ্ছে তার প্রধান প্রতিদ্বন্ধী । অর্জুন যদিও শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর সখা ও পরমেশ্বর বলে জানতেন, তবুও শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা প্রদর্শিত অসংখ্য মূর্তি দেখে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে এই রকম প্রশ্ন করেছিলেন।

🌸ভগবান অর্জুনের প্রশ্ন শ্রবণ করে বললেন —

 কালঃ-অস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তম্-ইহ প্রবৃত্তঃ ।
ঋতে-অপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে যে-অবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ॥১১/৩২॥

শ্রীভগবান বললেন—আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল এবং এই সমস্ত লোক সংহার করতে এক্ষণে প্রবৃত্ত হয়েছি। তোমরা (পাণ্ডবেরা) ছাড়া উভয় পক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধারাই নিহত হবে। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন” নিমিত্ত মাত্র হয়ে যুদ্ধ কর এবং যশ লাভ কর। ইতিমধ্যেই আমি তাদের হিত করে রেখেছি। ভগবান বোঝাতে চাইলেন, যারা আমার দ্বারা ইতিপূর্বেই নিহত হয়ে আছে তাদের তুমি হত্যা কর। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্রথ এবং অন্যান্য বীরগণ পূর্বেই আমার দ্বারা নিহত হয়েছে। সুতরাং তুমি তাদের বধ কর এবং বিচলিত হয়ো না। তুমি যুদ্ধে শত্রুদের নিশ্চয়ই জয় করবে। অতএব যুদ্ধ কর। (গীতা ১১।৩৪)

🌸অর্জুন ভুলুণ্ঠিত হয়ে ভগানের কাছে তাঁর পূর্ব-কার্যকলাপের জন্য ক্ষমাকৃপা ভিক্ষা চেয়ে ভগবানের চতুর্ভূজ রূপ দর্শন করতে চাইলেন। —প্রথমতঃ এর থেকে এটি প্রমাণ করে যে, শ্রীকৃষ্ণ যে কোন রূপ ধারণ করতে সক্ষম —দ্বিতীয়তঃ ভগবানের বিশ্বরূপ হচ্ছে ভগবানের আংশিক প্রকাশ, তার ঊর্ধ্বরূপ চতুর্ভূজ রূপ দর্শন করিয়ে পরে দ্বিভূজ শ্যামসুন্দর রূপ দর্শন করিয়েছিলেন।

এরপর শ্রীভগবান বললেন, হে অর্জুন, অনন্য ভক্তির দ্বারাই যে কেউ আমাকে দর্শন করতে সমর্থ হয় এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়।


◼️প্রশ্ন:১২ অনন্য ভক্তিযোগী ও নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপাসকের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? (১২/১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – দ্বাদশ অধ্যায় – ভক্তিযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্ত্বাং পর্যুপাসতে।
যে চ-অপি-অক্ষরম্-অব্যক্তম্ তেষাং কে যোগবিত্তমাঃ॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১২/১)

অনুবাদ: অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- এভাবেই নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যে সমস্ত ভক্তেরা যথাযথভাবে তোমার আরাধনা করেন এবং যাঁরা ইন্দ্ৰিয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তাঁদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ ময়ি আবেশ্য মনঃ যে মাম্ নিত্যযুক্তাঃ উপাসতে ।
শ্রদ্ধয়া পরয়া-উপেতাঃ-তে মে যুক্ততমাঃ মতাঃ॥২॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন━ যাঁরা তাঁদের মনকে আমার সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট (একাগ্র) করে নিত্য-নিরন্তর আমার ভজন-ধ্যানে নিযুক্ত থাকে এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার উপাসনা করেন, আমার মতে তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

❝ যে তু-অক্ষরম্-অনির্দেশ্যম্-অব্যক্তম্ পর্যুপাসতে ।
সর্বত্রগম্-অচিন্ত্যম্-চ কুটস্থম্-অচলম্ ধ্রুবম্॥৩॥
সংনিয়ম্য-ইন্দ্রিয়গ্রামম্ সর্বত্র সমবুদ্ধয়ঃ।
তে প্ৰাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ॥৪॥ ❞

অনুবাদ: যাঁরা সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযত করে, সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন হয়ে এবং সর্বভূতের কল্যাণে মগ্ন হয়ে আমার অক্ষর (যার কখনো কোনো কারণে বিনাশ হয় না), অনির্দেশ্য (কোনো যুক্তি বা উদাহরণ দ্বারা যার স্বরূপ বলা বা বোঝানো যায় না), অব্যক্ত (যাকে ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা জানা সম্ভব নয়, যার কোনো রূপ বা আকৃতি নেই), সর্বত্রগ (যিনি আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপী), অচিন্ত্য (যিনি চিন্তার অতীত অর্থাৎ যাকে মন-বুদ্ধি দিয়ে জানা যায় না), কুটস্থ (যার কখনও কোনো কারণে পরিবর্তন হয় না, অর্থাৎ যিনি  সর্বদা একভাবে থাকে), অচল (যিনি নড়া-চড়া বা চলা-ফেরা ক্রিয়া থেকে সর্বতোভাবে রহিত), ধ্রুব (যা নিত্য এবং নিশ্চিত—অর্থাৎ যার অস্তিত্বে কোনোরূপ সংশয় নেই) ও নির্বিশেষ স্বরূপকে (ব্রহ্মের) উপাসনা করেন, তাঁরা অবশেষে আমকেই প্রাপ্ত হন।

◼️তাঁরা আমাকেই লাভ করেন”—এই কথাটির কী অভিপ্ৰায় ? ◼️

উত্তর: এই কথায় ভগবান ব্রহ্মকে তাঁর থেকে অভিন্ন বলে জানিয়েছেন। অভিপ্রায় হল যে উপরোক্ত উপাসনার ফল যে নির্গুণ ব্রহ্মের প্রাপ্তি, তা বাস্তবিক আমাকেই প্রাপ্ত হওয়া ; কারণ ব্রহ্ম আমা হতে ভিন্ন নন এবং আমিও ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নই। সেই ব্ৰহ্ম আমিই, এই ভাবার্থ ভগবান চতুর্দশ অধ্যায়ের সাতাশতম শ্লোকে ব্ৰহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহম্ অর্থাৎ আমি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, এই কথায় প্রতিপন্ন করেছেন।

◼️উভয়েরই যখন পরমেশ্বর লাভ হয়, তখন দ্বিতীয় শ্লোকে সগুণ-উপাসকদের (অনন্য ভক্তিযোগীদের) শ্রেষ্ঠ বলার অর্থ কী? ◼️

আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: — একাদশ অধ্যায়ে ভগবান বলেছেন যে অনন্য ভক্তির দ্বারা মানুষ আমাকে দেখতে, তত্ত্বতঃ জানতে এবং লাভ করতে পারে (১১।৫৪)। এর দ্বারা এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, পরমাত্মাকে তত্ত্বতঃ জানা এবং প্রাপ্ত হওয়া – এই দুটি তো নির্গুণ উপাসকের (অর্থাৎ নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপাসকের) পক্ষেও সম্ভব ; কিন্তু নির্গুণ উপাসকদের সগুণ রূপে দর্শন দেওয়ার জন্য ভগবান বাধ্য নন; কিন্তু সগুণ-উপাসকদের (অর্থাৎ অনন্য ভক্তিযোগীদের) ভগবদ্দর্শনও হয়ে থাকে—এই হল তাদের বিশেষত্ব ৷

❝ ভক্ত্যা তু-অনন্যয়া শক্যঃ অহম্-এবং-বিধঃ-অর্জুন।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুম্-চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুম্-চ পরন্তপ॥১১/৫৪॥ ❞

অনুবাদ: হে পরন্তপ অর্জুন। একনিষ্ঠ ভক্তি দ্বারাই শুধু আমাকে জানতে, প্রত্যক্ষ (দর্শন) করতে এবং প্রাপ্ত করতে অর্থাৎ আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করতে আমার ভক্তরা সমর্থ হন। অন্য কোন উপায়ে নয়।


◼️প্রশ্ন:১৩ প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় কি? (১৩/১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – ত্রয়োদশ অধ্যায় – ক্ষেত্র’ক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ প্রকৃতিং পুরুষং চৈব ক্ষেত্রং ক্ষেত্রজ্ঞম্-এব চ।
এতদ্-বেদিতুম্-ইচ্ছামি জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চ কেশব॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১৩/১)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন – হে কেশব, আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় – এই সমস্ত তত্ত্ব জানতে ইচ্ছা করি।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রম্- ইতি-অভিধীয়তে।
এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ॥২॥ ❞

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন ━ হে কৌন্তেয়, এ দেহকে ক্ষেত্র বলে এবং যিনি ক্ষেত্রকে জানেন তিনি হলেন ক্ষেত্রজ্ঞ।।

জমিতে বীজ বপন করলে যেমন বীজের অনুরূপ ফসল সময় মত ফলে, সেইরুপ মনুষ্যদেহে কৃতকর্মসমূহের ফল সময়মতো উপস্থিত হয়। এই জন্য দেহকে ‘ক্ষেত্র’ বলা হয় ৷ এই দেহ বা ক্ষেত্র প্রতিমুহূর্তে ক্ষয় হতে থাকে, তাই পুরুষোত্তম যোগে একে ‘ক্ষর পুরুষ’ বলা হয়েছে ৷

❝ ক্ষেত্রজ্ঞম্-চ-অপি মাম্ বিদ্ধি সর্ব্বক্ষেত্রেষু ভারত।
ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞয়োঃ-জ্ঞানম্ যৎ-তৎ জ্ঞানং মতং মম॥৩॥ ❞

অনুবাদ: হে অর্জুন ! আমিই ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা)। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞকে জানাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত।

❝ তৎ ক্ষেত্রং যচ্চ যাদৃক্ চ যদ্ বিকারি যতশ্চ যৎ।
স চ যো যৎপ্রভাবশ্চ ত সমাসেন মে শৃণু॥৪॥ ❞

অনুবাদ: সেই ক্ষেত্র কি, তার কি প্রকার, তার বিকার কি, তা কার থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞের স্বরূপ কি, তাঁর প্রভাব কিরূপ—সেই সব সংক্ষেপে আমার কাছে শ্রবণ কর।

❝ ঋষিভিঃ-বহুধা গীতং ছন্দোভিঃ-বিবিধৈঃ পৃথক্।
ব্রহ্মসূত্রপদৈঃ-চ-এব ব হেতুমদ্ভিঃ-বিনিশ্চিতৈঃ॥৫॥ ❞

অনুবাদ: ঋষিগণ বিভিন্ন বেদবাক্যের দ্বারা নানা ছন্দে পৃথক পৃথক ভাবে এই ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। আবার ব্রহ্মসূত্রে যুক্তিসঙ্গত ও সুমীমাংসিতভাবে এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ।

❝ জ্যোতিষাম্ অপি তৎ জ্যোতিঃ তমসঃ পরম্ উচ্যতে।
জ্ঞানম্ জ্ঞেয়ম্ জ্ঞানগম্যম্ হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্॥১৮॥ ❞

অনুবাদ: তিনি (পরমব্রহ্ম) সমস্ত জ্যোতিষ্কের পরম জ্যোতি। তিনি মায়ার অন্ধকারের সম্পূর্ণ অতীত (অর্থাৎ তিনি অন্ধকারময় জড় জগত থেকে মুক্ত)। তিনিই বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনিই জ্ঞেয় (যাহা জানা উচিত; জানার বিষয়), তিনিই জ্ঞানগম্য (জ্ঞানের দ্বারা লভ্য), তিনি সর্ব্বভূতের (সর্বপ্রাণীর) হৃদয়ে অবস্থিত আছেন।

(আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: —সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ইত্যাদির সমস্ত বাহ্যিক জ্যোতি ; মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়াদির সর্বপ্রকার আধ্যাত্মিক জ্যোতি; এবং বিভিন্ন লোকাদি ও বস্তুসমূহের অধিষ্ঠাতৃ-দেবতাদের যে দেবজ্যোতিসমূহ (দিব্যজ্যোতিসমূহ) —সেই সবেরই প্রকাশক হলেন সেই পরমাত্মা। তাই তিনি সমস্ত জ্যোতিসমূহেরও জ্যোতি অর্থাৎ সকলকে প্রকাশ প্রদানকারী, সকলের প্রকাশক। অন্য কেউ তার প্রকাশক নয়। শ্রুতিতেও বলা হয়েছে—

‘ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি৷৷ (কঠোপনিষদ্ ২।২।১৫ ; শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৬।১৪) —অর্থাৎ সেখানে সূর্য অথবা চন্দ্র অথবা নক্ষত্রগণ কেউই আলোকিত করে না। সেখানে বিদ্যুৎও আলো দেয় না, তবে অগ্নির আর কথাই কী। তিনি প্রকাশিত হলেই এই সব আলোকিত হয় এবং তাঁর প্রকাশেই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়। গীতায়ও পঞ্চদশ অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে (১৫/১২) বলা হয়েছে যে যে তেজ সূর্যে স্থিত হয়ে সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করে এবং যে তেজ চন্দ্র ও অগ্নিতে স্থিত, সেই তেজকে তুমি আমার তেজ বলে জানবে।)

❝ প্রকৃতিং পুরুষঞ্চৈব বিদ্ধি-অনাদী উভৌ-অপি।
বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্ৰকৃতিসম্ভবান্॥২০॥ ❞

অনুবাদ: প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলে জানবে। দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হয়েছে জানবে।

(আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: —সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ইত্যাদির সমস্ত বাহ্যিক জ্যোতি ; মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়াদির সর্বপ্রকার আধ্যাত্মিক জ্যোতি; এবং বিভিন্ন লোকাদি ও বস্তুসমূহের অধিষ্ঠাতৃ-দেবতাদের যে দেবজ্যোতিসমূহ (দিব্যজ্যোতিসমূহ) —সেই সবেরই প্রকাশক হলেন সেই পরমাত্মা। তাই তিনি সমস্ত জ্যোতিসমূহেরও জ্যোতি অর্থাৎ সকলকে প্রকাশ প্রদানকারী, সকলের প্রকাশক। অন্য কেউ তার প্রকাশক নয়। শ্রুতিতেও বলা হয়েছে—

‘ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি৷৷ (কঠোপনিষদ্ ২।২।১৫ ; শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ ৬।১৪) —অর্থাৎ সেখানে সূর্য অথবা চন্দ্র অথবা নক্ষত্রগণ কেউই আলোকিত করে না। সেখানে বিদ্যুৎও আলো দেয় না, তবে অগ্নির আর কথাই কী। তিনি প্রকাশিত হলেই এই সব আলোকিত হয় এবং তাঁর প্রকাশেই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়। গীতায়ও পঞ্চদশ অধ্যায়ের দ্বাদশ শ্লোকে (১৫/১২) বলা হয়েছে যে যে তেজ সূর্যে স্থিত হয়ে সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করে এবং যে তেজ চন্দ্র ও অগ্নিতে স্থিত, সেই তেজকে তুমি আমার তেজ বলে জানবে।)

◼️প্রশ্ন:১৪ ত্রিগুণাতীত পুরুষের লক্ষণ ও আচরণ কি? (১৪/২১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়বিভাগযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ কৈর্লিঙ্গৈস্ত্রীন্‌ গুণান্-এতান্-অতীতো ভবতি প্রভো।
কিমাচারঃ কথম্-চ-এতান্-ত্রীন্ গুণান্-অতিবর্ততে॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১৪/২১)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন – হে ভগবান্! এই তিনগুণের অতীত ব্যক্তির কী কী লক্ষণ, তাঁর আচরণ কেমন? হে প্রভু! মানুষ কী উপায়ে এই তিনগুণ অতিক্রম করতে পারেন ?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ প্রকাশং চ প্রবৃত্তিং চ মোহম্-এব চ পাণ্ডব।
ন দ্বেষ্টি সম্প্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি॥২২॥ ❞

অনুবাদ:পরমেশ্বর ভগবান বললেন ━ হে অর্জুন! সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ, রজোগুণের কার্য প্রবৃত্তি ও তমোগুণের কার্য মোহ আবির্ভূত হলে যিনি দ্বেষ করেন না এবং এই সকলের নিবৃত্তিরও আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনি গুণাতীত।

❝ উদাসীনবৎ-আসীনঃ গুণৈর্যো ন-বিচাল্যতে।
গুণা বর্তন্ত ইত্যেব যঃ-অবতিষ্ঠতি ন-ইঙ্গতে॥২৩॥ ❞

অনুবাদ:যেমন সাক্ষীর ন্যায় স্থিত হয়ে (উদাসীনসদৃশ) ব্যক্তি গুণাদির দ্বারা বিচলিত হন না এবং গুণই গুণেতে আবর্তিত হচ্ছে, এরূপ জেনে যিনি সচ্চিদানন্দঘন পরমাত্মাতে অভিন্নভাবে স্থিত হন এবং সেই স্থিতি থেকে কখনও বিচ্যুত হন না, — (তিনিই গুণাতীত)।

❝ সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সম-লোষ্ট-অশ্ম-কাঞ্চনঃ।
তুল্য-প্রিয়-অপ্রিয়ঃ ধীরঃ-তুল্য-নিন্দা-আত্মসংস্তুতিঃ॥২৪॥ ❞

অনুবাদ:যিনি নিরন্তর আত্মভাবে স্থিত , সুখ-দুখে সমবুদ্ধি , মাটি পাথর ও স্বর্ণে সমভাবাপন্ন , জ্ঞানী , প্রিয়-অপ্রিয়ে সমজ্ঞান , নিন্দা-স্তুতিতে সমভাবসম্পন্ন, — (তিনিই গুণাতীত)

❝ মান-অপমানয়োঃ-তুল্যঃ তুল্যঃ-মিত্র-অরি-পক্ষয়োঃ।
সর্ব-আরম্ভ-পরিত্যাগী গুণাতীতঃ সঃ উচ্যতে॥২৫॥ ❞

অনুবাদ:যিনি মান-অপমানে সমভাবসম্পন্ন, শত্রু-মিত্রেও সমভাবসম্পন্ন এবং সর্ব কর্মে অহংকর্তৃত্ব ভাব বর্জিত (অহংকেন্দ্রিক উদ্যোগত্যাগী), সেই ব্যক্তিকেই বলা হয় গুণাতীত।


◼️প্রশ্ন:১৫ শাস্ত্র বহির্ভূত শ্রদ্ধা কিরূপ? (১৭/১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – সপ্তদশ অধ্যায় – শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ*****

|অর্জুন উবাচ |

❝ যে শাস্ত্রবিধিম্-উৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়া-অন্বিতাঃ।
তেষাম্ নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বম্-আহো রজস্তমঃ॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১৭/১)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন – হে কৃষ্ণ! যেসব ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে দেব-দেবীর পূজা করেন, তাদের সেই নিষ্ঠা কীরূপ ? সাত্ত্বিক, রাজসিক না তামসিক ?

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাং সা স্বভাবজা।
সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি তাং শৃণু॥২॥ ❞

অনুবাদ:পরমেশ্বর ভগবান বললেন ━ মানুষের শাস্ত্রীয় সংস্কাররহিত শুধুমাত্র স্বভাবজাত শ্রদ্ধা তিন প্রকারের হয়—সাত্ত্বিকী , রাজসী ও তামসী ৷ এখন সেই সম্বন্ধে শ্রবণ কর।

❝ সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত।
শ্রদ্ধাময়ঃ-অয়ম্ পুরুষো যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ॥৩॥ ❞

অনুবাদ:হে ভারত [অর্জুন] ! প্রত্যেক মানুষের শ্রদ্ধা তার অন্তঃকরণ অনুযায়ী হয়ে থাকে ৷ মানুষ শ্রদ্ধাময়। তাই যে ব্যক্তি যে রূপ গুণের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত, সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।

❝ যজন্তে সাত্ত্বিকাঃ দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ।
প্রেতান্ ভূতগণাংশ্চ-অন্যে যজন্তে তামসা জনাঃ॥৪॥ ❞

অনুবাদ:সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবতাদের পূজা করে, রাজসিক ব্যক্তিগণ যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা করে, এবং তামসিক ব্যক্তিগণ ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা করে।

❝ অশাস্ত্রবিহিতং ঘোরং তপ্যন্তে যে তপো জনাঃ।
দম্ভ-অহঙ্কারসংযুক্তাঃ কাম-রাগ-বল-অন্বিতাঃ॥৫॥ 
কর্ষয়ন্তঃ শরীরস্থং ভূতগ্রামম্ অচেতসঃ।
মাং চৈব-অন্তঃশরীরস্থং তান্ বিদ্ধি-আসুরনিশ্চয়ান্॥৬॥ ❞

অনুবাদ:যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি শাস্ত্রবিধিবর্জিত হয়ে শুধুমাত্র মনঃকল্পিত ঘোর তপস্যা করে এবং দম্ভ-অহংকারযুক্ত এবং কামনা, আসক্তি ও বলের অভিমানে যুক্ত হয়ে তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মারূপ আমাকে ক্লেশ প্রদান করে, সেই অজ্ঞানী ব্যক্তিদের তুমি নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।

(আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: পঞ্চ মহাভূত (মৃত্তিকা, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ), মন, বুদ্ধি, অহংকার, প্রধান (অপ্রকাশিত অবস্থায় প্রকৃতির তিনটি গুণ), পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক), পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি/হাত, পাদ/পা, পায়ু ও উপস্থ/জননেন্দ্রিয়) ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বিষয় (রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ)— এই চব্বিশটি তত্ত্বকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় ‘কর্মক্ষেত্র‘ বা ভূত (প্রাণী) সমূহ‘। ত্রয়োদশ অধ্যায়ের পঞ্চম শ্লোকে ক্ষেত্রের নামে এর বর্ণনা করা হয়েছে।)

 


◼️প্রশ্ন:১৬ সন্ন্যাস ও ত্যাগ শব্দের পৃথক তাৎপর্য কি? (১৮/১) ◼️

****শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – অষ্টাদশ অধ্যায় – মোক্ষসন্ন্যাসযোগ *****

|অর্জুন উবাচ |

❝ সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বম্-ইচ্ছামি বেদিতুম্।
ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্ কেশিনিষূদন॥ ❞

━┉┈┈(ভগবদ্গী‌তা, ১৮/১)

অনুবাদ: অর্জুন বললেন – হে মহাবাহো, হে হৃষীকেশ, হে কেশিনিসূদন, আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের তত্ত্ব পৃথকভাবে জানতে ইচ্ছা করি।

|শ্রীভগবানুবাচ|

❝ কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ।
সর্বকর্মফলত্যাগং প্রাহুঃ-ত্যাগম্‌ বিচক্ষণাঃ॥২॥ ❞

অনুবাদ:পরমেশ্বর ভগবান বললেন ━ পণ্ডিতগণ কাম্যকর্মসমূহের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ সমস্ত কর্মফল ত্যাগকে ত্যাগ বলে থাকেন।

(আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা: — স্ত্রী, পুত্র, ধন ও স্বর্গ ইত্যাদি প্রিয় বস্তু প্রাপ্তির জন্য এবং রোগ-সংকট ইত্যাদি অপ্রিয় নিবৃত্তির জন্য যজ্ঞ, দান, তপস্যা, উপাসনা ইত্যাদি যেসব শুভ কর্মের শাস্ত্রে বিধান আছে অর্থাৎ যেসব কর্মের বিধানে এসব বলা হয়েছে যে অমুক ফলের ইচ্ছা হলে মানুষ এই কর্ম করবে, কিন্তু ঐ ফলের ইচ্ছা না হলে সেটি না করলে কোনো ক্ষতি নেই—এরূপ শুভ কর্মের নাম কাম্যকর্মপণ্ডিতগণের মতে সন্ন্যাসী তাঁরাই, যাঁরা কাম্যকর্মের অনুষ্ঠান না করে শুধুমাত্র নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্তব্য-কর্মগুলিই বিধিবৎ পালন করেন।

যে বর্ণ ও যে আশ্রমে স্থিত মানুষের জন্য শাস্ত্রে যে কর্তব্যকর্মের বিধান রয়েছে এবং যা না করলে নীতি, ধর্ম ও কর্মের পরম্পরাতে বাধা আসে— সেই সমস্ত কর্মের বাচক হল এই ‘সর্বকর্ম‘ শব্দটি এবং এই সকল কর্মের ফলরূপে প্রাপ্ত স্ত্রী, পুত্র, ধন, মান, মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা, স্বর্গসুখ ইত্যাদি ইহলোক ও পরলোকে যত ভোগ আছে —সেই সবের কামনা চিরতরে ত্যাগ করা, কোনো কর্মের সঙ্গে কোনো প্রকার ফলের সম্বন্ধ যোগ না করা, এই সমস্ত কর্মের ফলত্যাগ করে কেবল কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠানের পালনকেই বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ ত্যাগ মনে করেন।)

❝ যজ্ঞ-দান-তপঃ-কর্ম ন ত্যাজ্যং কার্যমেব তৎ।
যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্ ॥৫॥ ❞

অনুবাদ:যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাজ্য নয়, তা অবশ্যই করা কর্তব্য ৷ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা মনীষীদের পর্যন্ত পবিত্র করে।

❝ এতানি-অপি তু কর্মাণি সঙ্গম্ ত্যক্তা ফলানি চ।
কর্তব্যানি-ইতি মে পার্থ নিশ্চিতম্ মতম্-উত্তমম্ ॥৬॥ ❞

অনুবাদ:হে পার্থ! আসক্তিফলের আশা পরিত্যাগ করে এই সমস্ত কর্ম (যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম) কর্তব্যবোধেই সম্পন্ন করা উচিত। এই হল আমার নিশ্চিত ও উত্তম অভিমত।

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.