daextlwcn_print_scripts(false);
ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ

4 min


221
190 shares, 221 points

꧁◼️ব্রহ্মসংহিতা কি?◼️

ব্রহ্মসংহিতা (সংস্কৃত: ब्रह्मसंहिता) হল ব্রহ্মা কর্তৃক পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণের মহিমান্বিত প্রার্থনার শ্লোকের সমন্বয়ে উচ্চারিত স্তব। 

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর মতে উচ্চপর্যায়ের পারমার্থিক বিষয় অবগত হওয়ার জন্য ব্রহ্মসংহিতার মতো আর অন্য কোন শাস্ত্র নেই। ভগবানের বিভিন্ন গুনমহিমা, অচিন্ত্য ভেদাভেদতত্ত্ব, অপ্রাকৃত জগতের বিবরন, গোবিন্দের অপ্রাকৃত লীলাবিলাস, ভগবানের প্রতি ভালোবাসা, ভক্তির পর্যায়, গোলোকের অত্যন্ত রহস্যময় বর্ণনা প্রভৃতি ব্রহ্মসংহিতার আলোচ্য বিষয়।

❝ সিদ্ধান্ত-শাস্ত্র নাহি ব্রহ্মসংহিতার সম।
গোবিন্দমহিমা জ্ঞানের পরম কারণ ॥
অল্পাক্ষরে কহে সিদ্ধান্ত অপার।
সকল বৈষ্ণবশাস্ত্র মধ্যে অতি সার ॥ ❞ ‌

      ━┉┈( চৈতন্য চরিতামৃত মধ্য, ৯। ২৩৯-২৪০)

ব্রহ্মসংহিতা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র গ্রন্থ। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায় আদি কেশব মন্দির থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এই পঞ্চম অধ্যায়ে অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। এই অধ্যায়ে ভগবদ্ভক্তির পন্থা, অষ্টাদশাক্ষর মন্ত্র, আত্মা, পরমাত্মা, সকাম কর্ম, কামগায়ত্রী, কামবীজ, কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, কৃষ্ণধামের চিৎবৈশিষ্ট্য, গণেশ, গর্ভোদকশারী বিষ্ণু, গায়ত্রীর উৎপত্তি, গোকুল, গোবিন্দের রূপ, স্বরূপতত্ত্ব ও ধাম, জীবতত্ত্ব, জীবের প্রাপ্য স্বরূপ, দুর্গা, তপঃ, পঞ্চভূত, প্রেম, ব্রহ্ম, ব্রহ্মার দীক্ষা, ভক্তিচক্ষু, ভক্তিসোপান, মন, মহাবিষ্ণু, যোগনিদ্রা, রমা, রাগমার্গীয় ভক্তি, রাম প্রভৃতি অবতার, শ্রীবিগ্রহ, বদ্ধজীব, তার সাধন, বিষ্ণুতত্ত্ব, বেদসার স্তব, শম্ভু, বৈদিক শাস্ত্র, স্বকীয়, পরকীয়, সদাচার, সূর্য ও হৈমাণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।


꧁◼️ব্রহ্মসংহিতার পুনঃআবিষ্কার ◼️

🌸যদিও ব্রহ্মসংহিতার রচয়িতা হলেন ব্রহ্মা কিন্তু পুনঃআবিষ্কর্তা হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু।

🌸১৫ শতকের শুরুতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু ২ বছরের জন্য দাক্ষিণাত্যে তীর্থযাত্রা করেন। এই সময় তিনি পুরী ধাম থেকে শ্রীরঙ্গক্ষেত্র, রাম সরোবর, কন্যাকুমারী হয়ে পয়স্বিনী নদী ধরে দক্ষিণ ভারতের একটি প্রাচীন মন্দির আদি কেশব মন্দিরে উপস্থিত হন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মধ্যলীলা নবম পরিচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের পয়স্বিনী নদীতে স্নান করে তীরবর্তী মন্দিরে আদি কেশবকে দর্শন করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একস্থানে বসার পর ভক্তদের সঙ্গে ভগবৎ তত্ত্ব আলোচনা করছিলেন এবং সেইসময় তিনি বিশেষ ভাব অনুভব করছিলেন (প্রেমাবিষ্ট হলেন)। এরপর তিনি ভক্তদের তার বসার স্থানের নীচের মাটি খননের আদেশ দিলেন। তৎক্ষণাৎ ভক্তরা মাটি খুড়তে খুড়তে কিছু কর্দমাক্ত মাটির নিচে ব্রহ্মসংহিতা খুঁজে পেলেন। পান্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ রূপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাটির নিচে পোকাদের আক্রমণে। শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টি অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই বর্তমানে শতাধ্যায়ী ব্রহ্ম সংহিতার শুধুমাত্র ৫ম অধ্যায়টিই পাওয়া যায়।

গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, যেহেতু অনেক কাল আগে থেকে এইটি এইভাবে গুপ্ত ছিল তাই শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, নিম্বার্কাচার্য বা অন্য কোনো আচার্যদের গ্রন্থে এই ব্রহ্মসংহিতার নাম উল্লেখ নেই। যুক্তিবাদ ও ঐতিহাসিকতার দিক থেকে ব্রহ্মসংহিতার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও যেহেতু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এইটিকে অনুমোদন করেছেন তাই এইটি গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কাছে স্বীকৃত শাস্ত্র।

🌸পুরী ফিরে এসে মহাপ্রভু বাসুদেব সার্বভৌম এবং রামানন্দ রায়কে ব্রহ্মসংহিতার বিষয় অবগত করিয়ে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। এভাবে ব্রহ্ম সংহিতার প্রচার শুরু হল।

🌸১৯৭০ সালে বিখ্যাত রকসঙ্গীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ব্রহ্মসংহিতা নিয়ে “রাধাকৃষ্ণ মন্দির” নামে অ্যালবাম প্রকাশিত করেন। তিনি ব্রহ্মসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অতি উচ্চস্তরের আবেগময় প্রার্থনাসমূহকে গানে রূপ দিয়েছিলেন (বর্তমানে youtube-এ পাওয়া যায়)।

🌸শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ১৯৩২ সালে শ্রীল জীব গোস্বামী প্রদত্ত ব্রহ্মসংহিতার টিকা ইংলিশ এ অনুবাদ কাজ সম্পাদন করেন।


꧁◼️ব্রহ্মসংহিতার শ্লোকসমূহ ◼️

ভগবানের ভক্তদের কাছে ৫ম অধ্যায়ের শ্লোক ১ এবং শ্লোক ২৯-৫৬ পর্যন্ত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তার তাৎপর্য অপরিসীম।

ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—১

❝ ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদির-আদিরর্গোবিন্দঃ সর্বকারণ-কারণম্ ॥❞ ‌

ঈশ্বরঃ—ঈশ্বর; পরমঃ—পরম; কৃষ্ণঃ—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ; সৎ—নিত্য স্থিতি; চিৎ—পরম জ্ঞান; আনন্দ—পরম আনন্দ; বিগ্রহঃ—যাঁর রূপ; অনাদিঃ—অনাদি; আদিঃ—আদি; গোবিন্দঃ—শ্রীগোবিন্দ; সর্ব-কারণ-কারণম্—সমস্ত কারণের পরম কারণ ।

অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামেও পরিচিত, তিনি হচ্ছেন পরম ঈশ্বর। তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময় (নিত্য, জ্ঞানময় ও আনন্দময়)। তিনি অনাদি, সকলেরই আদি এবং সকল কারণের কারণ (অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন সব কিছুর পরম উৎস। তিনি অনাদি, অর্থাৎ তাঁর কোন উৎস নেই, তিনি সকলেরই আদি এবং তিনি চিৎ-অচিৎ সব কিছুর উৎসের কারণ তাই তিনি হচ্ছেন সমস্ত কারণের পরম কারণ।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 1

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ—শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর। ভগবানের অসংখ্য অবতার আছে। সেই অবতারদেরও ঈশ্বর বা ভগবান বলা হয়। কিন্তু সমস্ত ঈশ্বরদের ঈশ্বর বা পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সমস্ত অবতারদের উৎস তাই শ্রীকৃষ্ণ হলেন অবতারী। নিজস্ব নিত্য নাম, নিত্য রূপ, নিত্য গুণ ও নিত্য লীলা বিশিষ্ট শ্রীকৃষ্ণই সর্বোপরি বিরাজমান পরম তত্ত্ব। ঈশ্বরঃ পরমঃ। পরমেশ্বর। তাঁর নাম কৃষ্ণ। তিনি সবাইকেই আকর্ষণ করেন। সর্বাকর্ষক। ‘কৃষ্ণ’ নামটি তাঁর প্রেমাকর্ষণ লক্ষণ সমন্বিত নিত্য নাম। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ—অসংখ্য অবতার থাকলেও পরম ঈশ্বর হচ্ছেন কৃষ্ণ, যাঁর থেকে সমস্ত অবতার উৎপত্তি হয়েছেন।

সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ—সৎ-চিৎ-আনন্দময় দ্বিভূজ শ্যামসুন্দর মুরলীধর রূপই তাঁর নিত্য রূপ। তাঁর রূপটি চিরন্তন। ক্ষণিকের জন্য নয়। সৎ বা নিত্য রূপ। কোনও জড় জাগতিক রূপ নয়। চিন্ময় রূপ। জ্ঞানময় রূপ। চিৎ বা জ্ঞানময়। তিনি কোনও বিমর্ষ বা দুঃখী রূপে প্রকাশিত নন। তিনি নিরানন্দময় নন। আনন্দময়। সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ। আমরা যেমন চিৎকণা আত্মা যেটি দেখা যায় না। আমরা যে স্থুল দেহটি ধারণ করেছি সেটি জড় এবং অনিত্য। আমাদের যে সূক্ষ্ম দেহ বা মন-বুদ্ধি-অহংকার যুক্ত দেহটি রয়েছে, তা হর্ষ-বিমর্ষ-দুঃখ সমন্বিত। আমাদের নাম, আমাদের দেহের রূপ ও আমাদের আত্মার রূপ আলাদা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের দেহ ও আত্মা এক । সৰ্ব্বদা আনন্দময়। যারা নির্বিশেষবাদী, তারা বলে যে, ভগবানের কোনও রূপ নেই, আকার নেই। তা ব্রহ্মজ্যোতি মাত্র। বলা হয়, সেই ব্রহ্মজ্যোতি হচ্ছে রূপময় শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গপ্রভা মাত্র ।

অনাদিরাদিঃতিনি অনাদি, সকলেরই আদি তিনি গোবিন্দ ৷ কৃষ্ণ স্বয়ংরূপে অনাদি। যখন কিছুই ছিল না, তখন তিনিই ছিলেন। যখন কিছুই থাকবে না, তখন তিনিই থাকবেন। তাই কৃষ্ণ অনাদি। তাঁর থেকেই সবকিছু উৎপত্তি। অহং সর্বস্য প্রভবঃ, (গীতা)। সব কিছুরই আদি আছে, অন্ত আছে। কিন্তু কৃষ্ণের আদি বা অন্ত নেই। তাই কৃষ্ণ অনাদি ও অনন্ত।  ব্রহ্মজ্যোতি এবং পরমাত্মা যাঁর থেকে উৎপত্তি তিনি সবার আদি।  স্বয়ংরূপে অনাদি এবং তিনি ব্রহ্মজ্যোতি ও পরমাত্মার আদি। অনাদিরাদিঃ।

গোবিন্দঃতিনি গোবিন্দ। ‘গো’-অর্থে জ্ঞান, ইন্দ্ৰিয়, গাভী, জগৎ বোঝায় এবং ‘বিন্দ’-অর্থে সমন্বিত, আনন্দ, তুষ্টিসাধন ও পালন বোঝায়। তিনি সমস্ত জ্ঞান সমন্বিত, সর্ব ইন্দ্রিয়ের আনন্দ স্বরূপ, সুরভী আদি গাভীদের পালনকর্তা, জগতের পোষণ কর্তা। তিনি লীলা লক্ষণ লক্ষিত, গোপতি, গোপপতি, গোপীপতি, গোকুলপতি ও গোলোকপতি গোবিন্দ। আমাদের একাদশ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সেব্য অভিধেয় অধিদেব গোবিন্দ।

সর্বকারণ কারণম্—তিনি সমস্ত কারণেরও কারণ। সমগ্র জগতের মূল হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। আমরা কিছু করতে চাই, কিছু পেতে চাই। তার কারণ কি? কারণ হলো আমাদের কিছু অভাব আছে, যা পেলে সুখী হবো। কিন্তু ভগবানের কিছু অভাব নেই। তিনি ভাবময় ব্যক্তিত্ব। তিনি চান ‘বহু স্যাম্‌ ভব’ আমি নিজেকে বিস্তার করব এবং আমার ইচ্ছা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাব অনুসারে চলবে আমাকে সমাদর করবে, কিংবা নিজ নিজ ইচ্ছায় আমাকে সমাদর না করেও চলতে পারে। কৃষ্ণ যে সর্বকারণের মহান স্রষ্টা কারণোদকশায়ী ভগবানেরও কারণ, সেই কথা মাতা দেবকী কৃষ্ণের স্তব করে বলছেন

যস্যাংশাংশাংশভাগেন বিশ্বোৎপত্তিলয়োদয়াঃ।
ভবন্তি কিল বিশ্বাত্মংস্তং ত্বাদ্যাহং গতিং গতা ॥ ❞ ‌

হে আদিপুরুষ (আদ্য), নিখিল-অন্তর্যামী (বিশ্বাত্মা), যাঁর অংশ হচ্ছেন মহাবিষ্ণু (যস্যাংশ), তাঁর অংশ হচ্ছেন প্রকৃতি বা মায়া, মায়ার অংশ পরমাণু (যস্যাংশাংশাংশভাগেন) দ্বারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার ক্রিয়া (বিশ্বোৎপত্তিলয়োদয়াঃ) সাধিত হয় (ভবন্তি), হে পরমেশ্বর সেই আপনাকে আমি আশ্রয় করেছি (ত্বাং গতিং গতা)।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—২৯ 

❝ চিন্তামণি-প্রকর-সদ্মসু কল্পবৃক্ষ
লক্ষাবৃতেষু সুরভীর-অভিপালয়ন্তম্‌।
লক্ষ্মী-সহস্রশত-সংভ্রম-সেব্যমানং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: যিনি লক্ষ-লক্ষ-কল্পবৃক্ষে আবৃত, চিন্তামণিসমূহ দিয়ে গঠিত গৃহসমূহে সুরভী গাভীদেরকে (অর্থাৎ কামধেনুগনকে) লালন পালন করছেন এবং যিনি শত-সহস্র লক্ষীগণেদের দ্বারা সাদরে পরিসেবিত হচ্ছেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 29

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

চিন্তামণি প্রকরসদ্মসু—গোলোক ধামের গৃহগুলি চিন্ময় রত্ন দিয়ে গঠিত। চিন্তামণি হচ্ছে অভীষ্ট ফলপ্রদ রত্ন বিশেষ। যা যেরকম চিন্তা করা হবে সেই মণি সেইরকম অভীষ্ট পূরণ করবে। মায়াশক্তি যেরকম জড় পঞ্চভূত (মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ) দিয়ে জড়জগৎ গঠন করেন, চিৎশক্তি সেইরকম চিন্তামণি দিয়ে চিৎজগৎ রচনা করেন। গোলোকে ভগবানের আবাস যে চিন্তামণি দিয়ে গঠিত, সাধারণ চিন্তামণি অপেক্ষা সেই চিন্তামণি অধিকতর দুর্লভ ও উপাদেয় (সূক্ষ্ম ও উত্তম)।

জড়জগতে ঘর বানাতে হলে উপযুক্ত জড় উপাদান লাগবে। ভালো মিস্ত্রী লাগবে। যন্ত্রপাতি লাগবে। সময় লাগবে। অর্থকড়ি লাগবে। তবুও মনের মতো গৃহ না তৈরি হতে পারে।

কিন্তু ভগবদ্ধামে চিন্তন মাত্রই মনোরম অসংখ্য গৃহ প্রকাশিত হয়ে থাকে ৷

কল্পবৃক্ষ লক্ষাবৃতেষু—গোলোকের মনোরম গৃহগুলো লক্ষ লক্ষ কল্পবৃক্ষে ঘেরা। সাধারণ কল্পবৃক্ষ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ রূপ ফল প্রদান করে । আর, শ্রীকৃষ্ণের আবাসে কল্পবৃক্ষগণ প্রেমবৈচিত্র রূপ অনন্ত ফল দিয়ে থাকেন।

সুরভীর-অভিপালয়ন্তম্‌—কামধেনুগণকে কৃষ্ণ সর্বতোভাবে পালন করছেন। সাধারণ কামধেনুগণ দোহন করা মাত্র প্রচুর দুধ দেয়। আর, গোলোকের কামধেনুগণ শুদ্ধ ভক্তজীবদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের জন্য চিদানন্দ স্রাবী দুধ-সমুদ্র সর্বদা ক্ষরণ করে। সেই দুধ পান করা মাত্র হৃদয়ে প্রেমানন্দ উথলে ওঠে।

লক্ষ্মী সহস্ৰশত সন্ত্রমসেব্যমানং—অসংখ্য লক্ষ্মী অর্থাৎ গোপীগণ কর্তৃক সম্ভ্রম বা যত্ন সহকারে কৃষ্ণ পরিসেবিত হচ্ছেন। সহস্ৰশত লক্ষ্মী বলতে বোঝায় অসংখ্য গোপসুন্দরী। তাঁরা অত্যন্ত যত্ন সহকারে শ্রীগোবিন্দের সেবা করছেন। সম্ভ্রম বলতে বোঝায় সাদরে বা প্রেমে আপ্লুত হয়ে। লক্ষ্মী-শব্দে বোঝায় গোপসুন্দরী

গোবিন্দমাদিপুরুষং—আদিপুরুষ গোবিন্দ। আদিপুরুষ বলতে যিনি সকলেরই আদি ব্যক্তিত্ব গোবিন্দ ।

তমহং ভজামি— তাঁকে আমি ভজনা করি। সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মা । তিনি শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করছেন। কৃষ্ণের অংশ মহাবিষ্ণু, তাঁর অংশ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার জন্ম। ব্রহ্মা কর্তৃক শ্রীগোবিন্দের সুন্দর বন্দনা শ্রীশ্রীব্রহ্মসংহিতা শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩০ 

❝ বেণুং ক্বণন্তম্‌ অরবিন্দ-দলায়তাক্ষং
বর্হা-অবতংসম্‌ অসিতাম্বুদ-সুন্দরাঙ্গম্।
কন্দর্পকোটি-কমনীয় বিশেষ-শোভং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি॥ ❞

অনুবাদ: যিনি বেণু বাদনে রত, যাঁর পদ্ম পাপড়ির ন্যায় প্রফুল্ল নয়ন, শিরোভূষণ ময়ূর পুচ্ছে শোভিত, নীল জলভরা মেঘের মতো সুন্দর অঙ্গবর্ণ, কোটি কোটি কন্দর্পের (কামদেবের) কমনীয় কান্তি (বিশেষশোভা) বিশিষ্ট, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 30

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

গোলোক ধামে শ্রীকৃষ্ণের অতুল শোভা ভক্তিরূপ সমাধিতে ব্রহ্মা যা দর্শন করছেন তাই-ই বর্ণনা করছেন ।

 বেণুং ক্বণন্তং— বাঁশী বাজাচ্ছেন। বাঁশীতে এমন মধুর সুর উত্থিত হচ্ছে যে, সমস্ত ব্যক্তির চিত্ত হরণ হয়ে যাচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণের আকর্ষণীয় বেণুমাধুরী সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৩৫/১৫) বলা হয়েছে, কৃষ্ণ যখন বাঁশী বাজান, তখন শিব, ব্রহ্মা, ইন্দ্ৰ প্রমুখ মহাপণ্ডিত মহাত্মারাও মোহিত হয়ে যান। তাঁরা গম্ভীর হয়ে যান এবং বিনয় ভাবে তাঁদের মস্তক অবনত হয়ে যায়। বিদগ্ধ মাধব গ্রন্থে শ্রীল রূপ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর অপূর্ব সুন্দর সুরের প্রভাবে শিবের ডমরু বাজানো বন্ধ হয়ে যায়। বহু চর্তুষ্কুমার প্রমুখ ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ হয়। সৃষ্টিকার্যে লিপ্ত ব্রহ্মা চমকিত হয়ে ওঠেন এবং সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডগুলিকে ধারণকারী অনন্তদেব মাথা দোলাতে শুরু করেন।

 অরবিন্দ দলায়ত-অক্ষম্— পদ্ম পাপড়ির মতো আয়ত (দীর্ঘ, বিশাল) চক্ষু। কমলদল যেমন স্নিগ্ধতা দান করে, তেমনই শ্রীকৃষ্ণের দুটি চক্ষু তাঁর মুখচন্দ্রের অসীম শোভা বিস্তার করে।

বর্হা-অবতংসম্— ময়ূরের পালক শিরে শোভিত। কৃষ্ণের শিরোদেশে ময়ূরের পালক শোভিত থাকে।

অসিত-অম্বুদ-সুন্দর-অঙ্গম্— নীল জলভরা মেঘের মতো সুন্দর শরীর। চিন্ময় রূপ-রং-আকৃতির বর্ণনা অনুপম। কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবুও জড়জগতের কোনও বস্তুর উপমা দিলে জড়বদ্ধ জীবের কিঞ্চিৎ ধারণা জন্মায়। সেই জন্য মাহাত্মাগণ কৃপা পূর্বক জাগতিক দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন। সমস্ত সৌন্দর্যের উৎস স্বয়ং কৃষ্ণ। ময়ূরের পালক ও মেঘের মতো দেহবর্ণ বিশিষ্ট গোবিন্দ অপূর্ব মধুর বলে নির্ধারিত হয়। জড় জগতে কোনও মানুষের শরীরে নীলবর্ণ লেপন করে, পরচুলা মাথায় লাগিয়ে ময়ূরের পালক তাতে সিঁটিয়ে দিলে সেই সৌন্দর্যের ধারণার এক বিন্দুও কাছে যাবে না ।

কন্দর্প-কোটি-কমনীয়-বিশেষ-শোভং— কোটি কোটি কন্দর্পের কমনীয় কান্তি বিশিষ্ট। কন্দৰ্প বা কামদেব এই জড়জগতে সবচেয়ে মোহনীয় রূপ। এরকম কোটি কোটি গুণ কন্দর্পের মোহনীয় রূপ একত্র করে দেখলে বা কল্পনা করলেও শ্রীকৃষ্ণের রূপের মোহনীয়তা তার চেয়ে বহুগুণে অধিক মোহনীয়। কোটি কমনীয় বিশেষ শোভং। কোটি কোটি কমনীয়তা অপেক্ষাও অধিক এবং বিশেষ রূপে শোভনীয়। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের রূপের মধুরিমা কারও কোনও রূপের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না ।

গোবিন্দম-আদি-পুরুষম্ তম-অহং ভজামি— সেই অতুলনীয় অপূর্ব মধুর রূপ সম্পন্ন আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩১ 

❝ আলোল-চন্দ্রক-লসৎ-বনমাল্য-বংশী-
-রত্নাঙ্গদং প্রণয়কেলি-কলা-বিলাসম্ ।
শ্যামং ত্রিভঙ্গ-ললিতং নিয়তপ্রকাশং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥ ❞

অনুবাদ: চাঁদের ন্যায় শোভিত দোদুল্যমান বনমালা যাঁর গলায়, যাঁর হাতে বংশী ও বাহুতে রত্নাঙ্গদ (অর্থাৎ রত্নখচিত বাজুবন্ধ), যিনি সর্বদা প্রণয় কেলি বিলাস যুক্ত (অর্থাৎ প্রেমানুরাগ বিলাসে সুনিপুণ), ললিত (সুন্দর) ত্রিভঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপই যাঁর নিত্যপ্রকাশ, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 31

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

আলোল-চন্দ্ৰক-লসৎ— আ-লোল (ইষৎ চঞ্চল বা দোলায়িত) চন্দ্রক (চাদের মতো চিহ্ন) লসদ্ (শোভিত)। অর্ধ চন্দ্রাকৃতির মতো উজ্জ্বল চিহ্ন সমন্বিত ভূষণে শোভিত।

বনমাল্য-বংশী-রত্নাঙ্গদং— বনমালা, বাঁশী ও রত্নময় বাজু। শ্রীকৃষ্ণের গলায় বনফুলের মালা, তাঁর দুই হাতে বাঁশী ধরে থাকেন, তাঁর দুই বাহুতে রত্নাঙ্গদ।

প্রণয়-কেলিকলা বিলাসম— সর্বদা যিনি প্রণয় কেলি বিলাসে যুক্ত। প্রেমপূর্ণ লীলা বিলাসে যুক্ত শ্রীকৃষ্ণের চৌষট্টি গুণ স্বরূপ কেলি বিলাস ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে রূপ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন।

মধুর রস বর্ণনে যত কিছু চিন্ময় ব্যাপার বর্ণিত হতে পারে সে সবই এই প্রণয় কেলি বিলাসের অন্তর্গত। শ্রীকৃষ্ণের সেই ৬৪ গুণ হলো—

(১) তাঁর সারা শরীর অপূর্ব মাধুর্য মণ্ডিত। (২) সমস্ত শুভ লক্ষণ চিহ্ন সমন্বিত । (৩) অত্যন্ত মনোরম। (৪) জ্যোতির্ময়। (৫) বলবান। (৬) নিত্য নব যৌবন সম্পন্ন। (৭) সমস্ত ভাষায় পারদর্শী। (৮) সত্যবাদী। (৯) প্রিয়ভাষী। (১০) বাক্‌পটু। (১১) পরম পণ্ডিত। (১২) পরম বুদ্ধিমান। (১৩) অপূর্ব প্রতিভাশালী। (১৪) বিদগ্ধ শিল্পকলায় পারদর্শী। (১৫) অত্যন্ত চতুর। (১৬) পরম দক্ষ। (১৭) কৃতজ্ঞ। (১৮) দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। (১৯) স্থান, কাল ও পাত্র সম্বন্ধে বিচার করতে অত্যন্ত সুদক্ষ। (২০) বৈদিক তত্ত্বজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শন করতে এবং উপদেশ দিতে অত্যন্ত পারদর্শী। (২১) পবিত্র (২২) সংযত। (২৩) অবিচলিত। (২৪) জিতেন্দ্রিয়। (২৫) ক্ষমাশীল। (২৬) গম্ভীর। (২৭) আত্মতৃপ্ত। (২৮) সমদৃষ্টি সম্পন্ন। (২৯) উদার। (৩০) ধার্মিক। (৩১) বীর। (৩২) কৃপাময়। (৩৩) শ্রদ্ধাবান্ (৩৪) বিনীত। (৩৫) বদান্য। (৩৬) লজ্জাশীল। (৩৭) শরণাগত জীবের রক্ষক। (৩৮) সুখী। (৩৯) ভক্তদের হিতৈষী। (৪০) প্রেমের বশীভূত। (৪১) সর্ব মঙ্গলময়। (৪২) সব চাইতে শক্তিশালী। (৪৩) পরম যশস্বী। (৪৪) জনপ্রিয়। (৪৫) ভক্তবৎসল। (৪৬) সমস্ত স্ত্রীলোকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। (৪৭) সকলের আরাধ্য। (৪৮) সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী। (৪৯) সকলের মাননীয়। (৫০) পরম নিয়ন্তা ।

এই ৫০টি গুণ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে পূর্ণরূপে বিদ্যমান। ব্রহ্মা ও শিবের মধ্যে আংশিক রূপে বিদ্যমান।

(৫১) অপরিবর্তনশীল। (৫২) সর্বজ্ঞ। (৫৩) চির নবীন। (৫৪) সৎ, চিৎ, আনন্দময় বা নিত্য আনন্দময় রূপ বিশিষ্ট। (৫৫) সব রকম যোগসিদ্ধির অধিকারী। (৫৬) অচিন্ত্য শক্তি সম্পন্ন। (৫৭) তাঁর দেহ থেকে অসংখ্য কোটি ব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত হয়। (৫৮) তিনি সমস্ত অবতারের আদি উৎস। (৫৯) তাঁর দ্বারা নিহত শত্রুদের তিনি মুক্তিদান করেন। (৬০) মুক্ত আত্মাদের তিনি আকর্ষণ করেন।

এই অধিক দশটি গুণ নারায়ণের মধ্যেও বিদ্যমান। এই দিব্য গুণগুলি অদ্ভুত ভাবে শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপে প্রকাশিত হয়।

(৬১) লীলা মাধুরী— তিনি নানারকম অদ্ভুত লীলা বিলাস করেন। যেমন তাঁর বাল্যলীলা ।

(৬২) প্রেমমাধুরী— তিনি অপূর্ব প্রেমমণ্ডিত ভক্তদের দ্বারা পরিবৃত থাকেন।

(৬৩) বেণু মাধুরী— তিনি তাঁর বাঁশী বাজিয়ে জগতের সমস্ত জীবকে আকর্ষণ করতে পারেন।

(৬৪) রূপ মাধুরী—তিনি অতুলনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত।

এই চারটি অসাধারণ গুণ যুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে ৬৪টি গুণ পূর্ণ রূপে বিদ্যমান।

শ্যামং ত্রিভঙ্গ-ললিতং নিয়তপ্রকাশং— শ্যামবর্ণ ললিত ত্রিভঙ্গ নিত্য প্রকাশমান। ললিত ত্রিভঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপই যাঁর নিত্য প্রকাশ। কৃষ্ণ সবুজ বর্ণ নয়, নীলবর্ণও নয়, গৌরবর্ণও নয়, কালোও নয়, ধূসর বর্ণও নয়। চিন্ময় রঙকে জড় জগতের কোনও বিশেষ রঙ উল্লেখ করে সীমিত করা যায় না। কখনও বা বলা হয় কৃষ্ণের অঙ্গবর্ণ নবঘন শ্যাম বা জলভরা উজ্জ্বল মেঘের মতো ৷ জলভরা মেঘ সুন্দর মনোরম না হতে পারে। শ্যামসুন্দরের অঙ্গ কান্তি অত্যন্ত হৃদয়াকর্ষী।

শ্যামং ত্রিভঙ্গ বলতে বোঝায় তাঁর শরীরের তিন স্থান গ্রীবা বা ঘাড়, কটি বা কোমর এবং পদ বা চরণের বঙ্কিম ভাব। বাঁকা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গী ।

ললিতং বলতে বোঝায় কমনীয় মনোহর বা বাঞ্ছিত। মনোহর ত্রিভঙ্গ রূপ।

নিয়ত প্রকাশং বলতে বোঝায় নিয়ম মতো প্রকাশিত হন। নিয়ত শব্দে নিয়মিত, সংযত বোঝায়। এমন নয় যে, পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণ ত্রিভঙ্গ না হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, কিংবা অপরকে নিজের চেহারা দেখান ত্রিভঙ্গ ভাবে। তিনি বিশেষ লীলা বিলাস কালে এই রকম ত্রিভঙ্গ রূপে প্রায়ই প্রকাশিত হন। জড় বুদ্ধি লোক যদি ত্রিভঙ্গ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তবে ভালো দেখাবে না। কিন্তু শ্যামসুন্দরের ত্রিভঙ্গ মূর্তি মহাত্মাদের চিত্ত হরণ করে থাকে।

আদিপুরুষম্ তম্ অহং ভজামি— সেই মনোহর রত্নভূষণ বংশী ধারণকারী প্রণয় কেলি বিলাসে যুক্ত ত্রিভঙ্গ মূর্তি শ্যামসুন্দর গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩২ 

❝ অঙ্গানি যস্য সকলেন্দ্রিয়-বৃত্তিমন্তি
পশ্যন্তি পান্তি কলয়ন্তি চিরং জগন্তি ।
আনন্দ-চিন্ময়-সদুজ্জ্বল-বিগ্রহস্য
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥ ❞

অনুবাদ: যাঁর বিগ্রহ আনন্দময়, চিন্ময়, ও সন্ময় (সদা পরম উজ্জ্বল); সেই বিগ্রহগত সমস্ত অঙ্গের প্রত্যেকেই সকল-ইন্দ্রিয়-বৃত্তি বিশিষ্ট (অর্থাৎ প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় নিজ কার্য ছাড়াও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্য সম্পন্ন করতে সক্ষম) এবং যিনি চিৎ ও অচিৎ অনন্ত জগৎসমূহকে নিত্যকাল দর্শন, পালন ও নিয়ন্ত্রন করেন সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 32

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

অঙ্গানি যস্য সকল-ইন্দ্রিয়-বৃত্তিমন্তি— অঙ্গানি (অঙ্গ সমূহ) সকলেন্দ্রিয় বৃত্তিমন্তি (সব ইন্দ্রিয়েরও বৃত্তিযুক্ত) অর্থাৎ যাঁর প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় অন্যান্য সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারে। আমরা যেমন চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, জিহ্বা দিয়ে আহার্য আস্বাদন করি। কিন্তু, আমরা চোখ দিয়ে খাবার খেতে পারি না, চোখ দিয়ে কোনও কথা শ্রবণ করতে পারি না, কান দিয়ে কিছু ভোজন করতে পারি না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ পারেন। অঙ্গানি সকলেন্দ্রিয় বৃত্তিমন্তি। একটা ইন্দ্ৰিয়ই অন্যান্য সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কার্য সম্পাদন করতে পারে। যে কোনও ইন্দ্রিয় অন্য সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ করতে পারে।

পশ্যন্তি পান্তি কলয়ন্তি চিরং জগন্তি— পশ্যন্তি (দর্শন করেন), পান্তি (পালন করেন), কলয়ন্তি (নিয়মন বা নিয়ন্ত্রণ করেন) চিরং (চিরকাল) জগন্তি (ব্রহ্মাণ্ড সমূহকে)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত চিন্ময় জগৎ এবং অনন্ত জড় জগৎ সমূহকে নিত্যকাল দর্শন, পালন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন।

আনন্দ-চিন্ময়-সদ্-উজ্জ্বল বিগ্ৰহস্য— আনন্দময়, চিন্ময়, সন্ময় উজ্জ্বল শরীরের। আনন্দ (আনন্দময়) চিন্ময় (চিয়) সদ্ (নিত্য) উজ্জ্বল (অতিশয় শোভমান) বিগ্ৰহস্য (বিশিষ্ট রূপ সমন্বিত দেহ যাঁর)।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন, জড় জ্ঞানে আবদ্ধ ব্যক্তিদের একটি বিষম সংশয় উদিত হয়। কৃষ্ণলীলা বর্ণনা শুনে তারা সেসব কল্পনা মনে করে। ব্রহ্মা বলছেন, কৃষ্ণের শরীরটি সচ্চিদানন্দময়। তাঁর বিশেষ রূপ ও বিচিত্রতা নিত্য বর্তমান। শ্রীকৃষ্ণের নাম, শ্রীকৃষ্ণের ধাম, শ্রীকৃষ্ণের রূপ, শ্রীকৃষ্ণের গুণ, শ্রীকৃষ্ণের লীলা সচ্চিদানন্দময়। তাই শুদ্ধ চিন্ময় বুদ্ধি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে কেবল কৃষ্ণলীলা আস্বাদনযোগ্য হয়। জড়বদ্ধ জীবের দেহ ও আত্মা আলাদা আলাদা। চিৎস্বরূপে দেহ ও আত্মা কোনও ভেদ নেই। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত একজন ব্যক্তি। তাঁর প্রত্যেক অঙ্গই পূর্ণ কৃষ্ণ। সমস্ত চিন্ময় কার্য তাঁর সমস্ত অঙ্গে আছে। তিনি অখণ্ড পূর্ণ চিৎ-তত্ত্ব।

জীবাত্মা ও কৃষ্ণ, উভয়েই চিৎস্বরূপ। অর্থাৎ উভয়েই চিৎবস্তু বলে একই। কিন্তু উভয়ের ভেদ এই যে, সমস্ত চিন্ময় গুণ জীবাত্মার স্বরূপে অণু রূপে আছে এবং শ্রীকৃষ্ণে বিভূ রূপে বা ব্যাপকরূপে আছে। জীবের মধ্যে অণু পরিমাণে যে চিন্ময় গুণগুলি আছে তা প্রকাশিত হবে যখন জীব শুদ্ধ চিন্ময় স্বরূপ লাভ করে। জড়জাগতিক বুদ্ধিতে তার সেই গুণ প্রকাশিত হবে না। শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় জীব শুদ্ধ চিন্ময় স্বরূপ লাভ করে। যদিও বা শ্রীকৃষ্ণের গুণ শুদ্ধ জীবের মধ্যেও অণু পরিমাণে বিদ্যমান বলা হয়, তবুও পঞ্চাশটি গুণ ব্রহ্মার মধ্যে, ষাটটি গুণ নারায়ণের মধ্যে, চৌষট্টিটি গুণ কৃষ্ণের মধ্যে বিদ্যমান। অর্থাৎ আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দের চারটি গুণ অধিক—রূপমাধুরী, বেণুমাধুরী, লীলামাধুরী প্রেমমাধুরী

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহং ভজামি—সেই আনন্দময়, চিন্ময়, শাশ্বত শোভমান পরম রূপ সমন্বিত আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দের আমি ভজনা করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৩ 

❝ অদ্বৈতম্‌ অচ্যুতম্‌ অনাদিম্‌ অনন্ত-রূপং
আদ্যং পুরাণ-পুরুষং নবযৌবনঞ্চ।
বেদেষু দূর্লভম-অদূর্লভম আত্ম-ভক্তৌ
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥ ❞

অনুবাদ: যিনি—অদ্বৈত (যাঁর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রূপে দ্বিতীয় বস্তুর অস্তিত্ব নেই), অচ্যুত (যিনি স্থান, কাল, পাত্র, লক্ষ্য, সিদ্ধান্ত কোন কিছু থেকেই চ্যুত বা ভ্রষ্ট হন না; যিনি অমর অর্থাৎ অবিনাশী। যিনি অক্ষয়), অনাদি (যিনি আদিহীন অর্থাৎ  উৎপত্তিহীন), অনন্ত রূপে পরিব্যাপ্ত, আদ্য (তিনি সকলের আদি), পুরাণ-পুরুষ হয়েও সর্বদাই নবযৌবনসম্পন্ন সুন্দর পুরুষ। যাঁরা শ্রেষ্ঠ শুদ্ধ ভক্ত সর্বক্ষণ ভগবানকে এই রুপে দর্শন করেন। বেদেরও অগম্য, কিন্তু শুদ্ধ আত্মভক্তিরই লভ্য সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 33

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

অদ্বৈতম্— অদ্বৈত বলতে বোঝায় অদ্বয় জ্ঞান অখণ্ড তত্ত্ব। গোবিন্দ হচ্ছেন অদ্বৈত অর্থাৎ তাঁর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রূপে দ্বিতীয় বস্তুর অস্তিত্ব নেই। তাঁর থেকে অনন্ত ব্রহ্ম প্রভা বা জ্যোতি বেরিয়ে এলেও তিনি একই থাকেন। তাঁর অংশ রূপে পরমাত্মা প্রকাশিত হলেও তিনি অখণ্ড ।

অচ্যুতম্— গোবিন্দ হচ্ছেন অচ্যুত। তাঁর স্বাংশ রূপে কোটি কোটি অবতার প্রকাশিত হলেও তিনি সম্পূর্ণই থাকেন। তাঁর বিভিন্নাংশ রূপে অনন্ত কোটি জীব নিঃসৃত হলেও তিনি পরমপূর্ণ। অচ্যুত বলতে বোঝায় পরিপূর্ণ সর্বার্থ, তাঁর কোনও ত্রুটি বিচ্যুতি নেই। তাঁর কোনও ক্ষয়ক্ষতি নেই। তাঁর কোনও খরচ বা ঘাটতি নেই। তাঁর কোনও বিচ্ছিন্নতা বা বিয়োগ নেই ৷ তিনি যা বলেন, তাই করেন। তাঁর সংকল্প তিনি বিকৃত করেন না। তিনি যাঁকে যে কথা দেন, তা কখনও খেলাপ করেন না ৷ তাই তিনি অচ্যুত। শ্রীল জীব গোস্বামী বলেছেন, মহাপ্রলয়েও যাঁর ভক্তদের বিচ্যুতি ঘটে না, তিনি অচ্যুত ৷

অনাদিম্— অনাদি বলতে বোঝায় যাঁর আদি নেই, যাঁর জন্ম নেই, যাঁর সৃষ্টি নেই। সমগ্র সৃষ্টির আগেও তিনি বিদ্যমান। তাঁর থেকে সবকিছু সৃষ্টি। তাঁর থেকে সব কিছু বিস্তার। তিনি স্বয়ং কোথাও কোথাও জন্মলীলা প্রকাশ করলেও তিনি অনাদি।

অনন্তরূপম্— অনন্ত বলতে বোঝায় তাঁর কোনও অন্ত বা শেষ নেই ৷ অনন্ত রূপতাঁর রূপও অনন্ত, লীলাও অনন্ত, তাঁর অবতারও অনন্ত, অসংখ্য। তাঁর শক্তিও অনন্ত। গোবিন্দ জন্মলীলা প্রকাশ করলেও যেমন অজ বা অনাদি, তেমনই প্রকটলীলা অপ্রকট করেও তিনি অনন্ত, অমর, অশেষ। অন্ত বলতে বোঝায় শেষ, সীমা, বদ্ধতা। কিন্তু, অনন্ত বলতে বোঝায় অসীম। তাঁর শেষ নেই। তাঁর কোন বদ্ধতা নেই ।

আদ্যম্ পুরাণ পুরুষম্ নবযৌবনঞ্চআদ্য বলতে বোঝায় প্রথম, মুখ্য, কারণ, সবার আদি, সর্বকারণের কারণ

পুরাণ পুরুষ বলতে বোঝায় যে, ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি প্রভৃতির পূর্বেও বর্তমান। সেই আদি পুরুষোত্তম শ্রীগোবিন্দ ৷

নব যৌবন বলতে বোঝায়, নতুন যৌবন বয়স। অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ সবার চেয়ে আদি হলেও, সৃষ্টির আগে তিনি থাকলেও তিনি বৃদ্ধ নন, তিনি নব যৌবন সম্পন্ন। তিনি অনন্ত অসংখ্য কোটি কোটি বর্ষ ধরে থাকলেও তিনি চির কিশোর রূপ সম্পন্ন। তিনি কেবল কিশোর বা যৌবন রূপ সম্পন্ন হয়ে স্থিত নন, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নতুন রূপে, নব নবায়মান রূপে যৌবন সম্পন্ন। জরা, বার্ধক্য, অবসন্নতা তাঁর মধ্যেই নেই। তিনি সর্বাঙ্গসুন্দর নিত্য সমুজ্জ্বল মনোহর নব নবায়মান রূপ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। শ্রীগোবিন্দ সনাতন পুরুষ হয়েও নিত্য নব যৌবন সম্পন্ন।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ব্যাখ্যা করেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ বহুবিধ বিরুদ্ধ গুণযুক্ত হলেও সেই গুণগুলি সর্বত্র অচিন্ত্য শক্তিতে সামঞ্জস্য সমন্বিত। তাঁর সুন্দর মুরলীধর শ্যাম ত্রিভঙ্গ রূপ সব সময়ই নব যৌবন সম্পন্ন। চিন্ময় জগতে অতীত ও ভবিষ্যৎ নেই। সেখানে নিত্য বর্তমান কালই বিরাজমান। জড় জগতে জীবের জ্ঞানবৃত্তি মায়িক বা জড়। সব সময়ই দেশ-কাল প্রভৃতি দোষে দূষিত হয়ে জড় জগতের জীব মায়িক ভাব পরিত্যাগ করতে পারে না। জড় বদ্ধ জীবের জ্ঞানবৃত্তি যদি চিন্ময় বস্তু উপলব্ধি না করে তবে আর কোনও বৃত্তি নেই যাতে তার শুদ্ধ চিন্ময় বিশেষের অনুভব হবে। সেই জন্য ব্রহ্মা বলছেন সেই চিন্ময় ব্যাপার বেদের অগম্য।

বেদেষু দুর্লভম্— বেদ হচ্ছে শব্দমূলক এবং শব্দ হচ্ছে প্রকৃতিমূলক। সুতরাং বেদ সরাসরি চিন্ময় গোলোক ধাম দেখাতে পারেন না। বেদ যখন চিৎ (চিন্ময়) শক্তিতে ভাবিত হন, তখনই শ্রীভগবান প্রসঙ্গে কিছু কিছু কথা বলেন

অদুর্লভম্ আত্ম ভক্তৌ— একাত্ম ভক্তিতে সেই সচ্চিদানন্দময় স্বরূপ উপলব্ধ হয়। ভক্তির আনন্দদায়িনী বৃত্তি অসীম। তা শুদ্ধ চিজ্ঞানময়ী। সেই জ্ঞান, সেই ভক্তির সঙ্গে একাত্মভাবে অর্থাৎ নিজের পৃথক জ্ঞানত্বের পরিচয় না দিয়ে, কেবল ভক্তির পরিচয়ে কেউ গোলোক তত্ত্বকে আবিষ্কার করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের উক্তি, ভক্ত্যা মাম্ অভিজানাতি।┈(গীতা) অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তির দ্বারা কেউ আমাকে জানতে পারে

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহম্ ভজামি—শুদ্ধ আত্মভক্তিরই লভ্য সেই আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দকে আমি ভজনা করি ৷


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৪ 

❝পন্থাস্তু কোটি-শত-বৎসর-সংপ্রগম্যো
বায়োঃ-অথাপি মনসো মুনি-পুঙ্গবানাম্।
সোহপ্যস্তি যৎ প্রপদসীম্ন্য অবিচিন্ত্যতত্ত্বে
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

পন্থাঃ—পথ; তু—কিন্তু; কোটি-শত বৎসর—শতকোটি বছর; সংপ্রগম্যঃ— গমনযোগ্য; বায়োঃ—বায়ুর; অথ অপি—অথবা; মনস্যঃ—মনের; মুনি-পুঙ্গবানাম্—নির্ভেদ ব্রহ্ম অনুসন্ধানী জ্ঞানীগণের; সঃ অপি—সেই পথও; অস্তি—বিদ্যমান; যৎ—যাঁর; প্রপদ—পাদপদ্মযুগলের; সীম্নি—অগ্রভাগের বা বহির্দেশে; অবিচিন্ত্য তত্ত্বে—জড় চিন্তার অতীত তত্ত্বে; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদি পুরুষম্—আদি পুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: জড়জাগতিক চিন্তার অতীত তত্ত্বে গমন করতে ইচ্ছুক প্রাণায়াম অনুশীলনকারী যোগীগণেরা শ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করে বায়ু নিয়ন্ত্রণের পন্থা অনুসরণ করেই হোক অথবা নির্ভেদ (অ-বিভেদহীন; অপৃথকীকৃত; Undifferentiated) ব্রহ্মানুসন্ধানকারী মহান ঋষিগণেরা মনগড়া জ্ঞানচর্চার পন্থাই হোক শত-কোটি বছর ধরে অনুসরণ করেও যাঁর পাদপদ্মের আঙুলের অগ্রভাগমাত্র প্রাপ্ত হয়, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 34

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

পন্থাঃ তু কোটি শত বৎসর সংপ্রগম্যঃ— যে পথের শেষ প্রান্ত শতকোটি বছর ধরে গিয়ে পৌঁছানো যায় বড়ো জোর ব্রহ্ম সাযুজ্য মুক্তি স্তর অবধি।

বায়োঃ অথাপি মনসঃ মুনিপুঙ্গবানাম্— মুনি শ্রেষ্ঠ গণের অর্থাৎ ব্রহ্মানুসন্ধানী জ্ঞানীগণের প্রাণায়ামের দ্বারা রুদ্ধ বায়ুর কিংবা মনের বা মনোধর্মীর দ্বারা কৈবল্য বা সমাধি লাভ হতে পারে।

সঃ অপি অস্তি যৎ প্রপদসীম্নি— যোগীদের কৈবল্য ও মায়াবাদীদের ব্রহ্ম সাযুজ্য এ সবই হলো যাঁর পাদপদ্ম-যুগলের অগ্রভাগ বা বহির্দেশ মাত্র

অবিচিন্ত্য তত্ত্বেজড় চিন্তার তত্ত্বে। চিন্ময় বৈচিত্র। এই স্তরে অষ্টাঙ্গ যোগী কিংবা ব্রহ্ম সাযুজ্যকামী জ্ঞানীরা প্রবেশ করতে পারে না। শ্রীল জীব গোস্বামী বলছেন, নরাকাসুরকে নিধন করে এসে শ্রীকৃষ্ণ একজন একই সময়ে পৃথক ভাবে ষোলো হাজার মন্দিরে ষোলো হাজার রাজকন্যাকে বিবাহ করেছেন- এটি বিচিত্র ব্যাপার ভেবে নারদ মুনি দ্বারকায় এলেন এবং দেখলেন প্রত্যেক মহলে শ্রীকৃষ্ণ আলাদাভাবে কাজকর্মে ব্যস্ত এবং নারদ মুনিকে প্রত্যেক মহলেই নতুন রূপে অভ্যর্থনা করা হচ্ছিল। ব্রহ্মাও দেখেছিলেন, একজন কৃষ্ণ হাজার হাজার গোপবালক ও বাছুর রূপে প্রকাশিত হয়ে যে যার স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান ।

দেবহূতি দেবী বলছেন, হে ভগবান, যদিও আপনার করনীয় কিছু নেই। তবুও আপনি আপনার শক্তিকে প্রকৃতির গুণের পারস্পরিক ক্রিয়ায় বিভক্ত করেছেন। যার ফলে জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সম্পাদিত হয়। হে ভগবান, আপনি সত্য-সংকল্প এবং সমস্ত জীবের পরমেশ্বর। তাদের জন্য আপনি এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আপনি যদিও এক, তবুও আপনার বিবিধ শক্তি নানা ভাবে কাজ করতে পারে। সেটাই আমাদের কাছে অচিন্ত্য।

শ্রীল প্রভুপাদ বলছেন, আমরা সকলেই আমাদের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য শ্রীভগবানের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু আমরা কখনও বলতে পারি না যে, ভগবানের বাসনাও অন্যের উপর নির্ভরশীল। সেটাই তাঁর অচিন্ত্য শক্তি ।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহং ভজামি— জড় ভাবনার অতীত তত্ত্ব সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ব্রহ্মসংহিতার এই শ্লোকের তাৎপর্যে বলছেন যে, শুভ ভক্তির আস্বাদনই শ্রীগোবিন্দ চরণারবিন্দ লাভ। অষ্টাঙ্গিক যোগীরা শতকোটি বছর যাবৎ সমাধিক্রমে যে কৈবল্য লাভ করেন এবং অদ্বৈতবাদী মুনিরাও শতকোটি বছর যাবৎ চিৎ-অচিৎ বিচার করতে বসেন। ‘নেতি নেতি’ ‘এটা নয়, ওটা নয়’ এভাবে জড়বস্তু একটি একটি করে পরিত্যাগ করার পর অবশেষে যে নির্বিশেষ নিরাকার ব্রহ্মে লয় পেতে চান, তা শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলের অঙ্গুলের অগ্রভাগের বহিঃস্থিত প্রদেশ মাত্র।  চরণকমল নয়। মূল কথা হলো, ‘কৈবল্য’‘ব্রহ্মলয়’—এগুলি হচ্ছে জড়জগৎ ও চিন্ময় জগতের মধ্য সীমা। এই দুই অবস্থা অতিক্রম না করলে চিন্ময় বৈচিত্র পাওয়া যায় না। কৈবল্য দশা বা ব্রহ্মসাযুজ্য স্তরটি মায়িক সম্বন্ধ জনিত দুঃখের অভাব মাত্র, কিন্তু সুখ নয়। ঐ স্তরে কষ্ট নেই, তাই কিছুটা সুখও বলা যায়, তবুও তা অতি অল্প ও তুচ্ছ। জড়জাগতিক অবস্থা নাশ হলেই সুখে থাকবে, তা নয়। জীবের চিন্ময় অবস্থায় স্থিতিতে যে পরমানন্দ বা শাশ্বত সুখ পাওয়া যায় তা কেবলমাত্র চিৎস্বরূপা ভক্তির কৃপায় পাওয়া যায়। প্রেমপূর্ণ ভগবৎ সেবায় পাওয়া যায়। নীরস চিন্তা মার্গে, নির্বিশেষ ধ্যান মার্গে তা পাওয়া যায় না।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৫ 

❝একোঽঅপি-অসৌ রচয়িতুং জগদণ্ডকোটিং
যৎ-শক্তির অস্তি জগদণ্ডচয়া যদন্তঃ।
অণ্ডান্তরস্থ-পরমাণুচয়-অন্তরস্থং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

একঃ অপি—এক তত্ত্ব হয়ে; অসৌ—এই গোবিন্দ; রচয়িতুম্—সৃষ্টি করতে; জগৎ-অণ্ড—ব্রহ্মাণ্ড; কোটিম্—কোটি কোটি; যৎ-শক্তিঃ—যাঁর শক্তি; অস্তি—আছে; জগৎ-অণ্ডচয়াঃ—ব্রহ্মাণ্ড সমূহ; যৎ-অন্তঃ—যাঁর মধ্যে; অণ্ড-অন্তরস্থ—ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত; পরমাণুচয়—পরমাণুরাশির; অন্তরস্থম্—প্রত্যেকটির অভ্যন্তরে বিরাজমান; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: শক্তিশক্তিমানের কোন পার্থক্য নেই বলে তিনি হলেন অভেদ-সত্ত্বা (একতত্ত্ব)। কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করা সত্বেও তাঁর শক্তি অবিচ্ছেদ্য (অবিভক্ত) আছে। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মধ্যে বর্তমান এবং তিনি যুগপৎ (একই সময়ে, একসঙ্গে) সমস্ত ব্রহ্মান্ডের সমস্ত পরমাণুতে পূর্ণরূপে বিরাজমান, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 35

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

একঃ অপি অসৌ রচয়িতুং জগদণ্ডকোটিংএকতত্ত্ব (শক্তি ও শক্তিমান, সৃষ্টি ও স্রষ্টা) হয়েও এই গোবিন্দ কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড রচনা ও পরিচালনা করছেন। অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড আছে।  কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হচ্ছে, আবার কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হচ্ছে। আবার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সমস্ত রচনা করছেন পরম শক্তিমন্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এক্ষেত্রে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিলাস মূর্তি নারায়ণ রূপে, নারায়ণের অংশ থেকে মহাবিষ্ণু (কারনোদকশায়ী বিষ্ণু) রূপে, মহাবিষ্ণুর অংশ থেকে গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু রূপে, ও গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর অংশ থেকে ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু (পরমাত্মা) রূপে বিস্তার করে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি পরমাণুর মধ্যে স্থিত হয়ে পরিচালনা করেন এবং গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডের জন্য একজন করে ব্রহ্মা সৃষ্টি করে গৌণ সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন করান। ভগবানের বহিঃরাঙ্গা শক্তি অর্থাৎ মায়া শক্তির দ্বারা জড় প্রকৃতি সৃষ্টি করছেন এবং তা পরিচালনা করে চলেছেন ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু রূপে। এখানেই ভগবানের বিশেষত্ব হল – তিনি হলেন স্রষ্টা (শক্তিমান) এবং তাঁর শক্তি থেকে হয় সৃষ্টি এবং সেই সৃষ্টির মধ্যে আবার তিনি স্থিত হয়ে পরিচালনা করেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে শক্তি ও শক্তিমান হল এক ও অভিন্ন। মিষ্টি থেকে যেমন মিষ্টতা আলাদা করা যায় না, লবণ থেকে যেমন লবণাক্ত আলাদা করা যায় না, সূর্য থেকে তাঁর জ্যোতি আলাদা করা যায় না ঠিক তেমনি শক্তি ও শক্তিমানকে আলাদা করা যায় না। এটাই হল একতত্ত্ব। সুতরাং এই ব্রহ্মাণ্ড বা ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে জড় জগত পরিচালনা করার জন্য তিনি কেবল বিভিন্ন রূপে (বা বিভিন্ন পদে) আসীন হয়ে লীলা সম্পন্ন করেন মাত্র কিন্তু তাতে ভগবানের শক্তির এতটুকুও তারতম্য হয় না।      

যৎ শক্তিঃ অস্তিযাঁর শক্তি রয়েছে। কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড রচনা করবার শক্তি যাঁর বিদ্যমান, তিনি হলেন একজন পরম শক্তিমন্ত ব্যক্তিত্ব শ্রীকৃষ্ণ।

জগদণ্ডচয়াঃ যদ অন্তঃব্রহ্মাণ্ডসমূহ যাঁর অভ্যন্তরে বিদ্যমান। একবার বালকেরা যশোদামায়ের কাছে বলল যে, কৃষ্ণ মাটি খাচ্ছে। যশোদা এসে কৃষ্ণকে বললেন, এত ননী মাখন থাকতে তুমি মাটি খাচ্ছো কেন ? বালক কৃষ্ণ বলে, আমি মাটি খাই নি। মা তখন তাকে মুখ খুলতে বলেন। মুখের ভেতরে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড, এমনকি নিজেকেও দেখতে পেয়ে যশোদা মায়ের মাথা ঘুরে যায়। হতবাক্ হয়ে ভাবতে থাকেন, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড এই শিশুর মুখের ভেতর! বাৎসল্য স্নেহময়ী মাকে কৃষ্ণ সেই সব ব্যাপার ভুলিয়ে দেন। শাসন করবার জন্যে দড়ি দিয়ে একসময় মা কৃষ্ণকে বাঁধতে যাচ্ছেন। প্রচুর পরিমাণে লম্বা দড়ি এনেও কৃষ্ণের উদরে বাঁধা গেল না। কারণ ‘বিশ্বস্য ধাম্নে’। বিশ্বসমূহ যাঁর উদরে রয়েছে, মা যশোদা, দড়িগুলো পর্যন্ত সবই যাঁর উদরের মধ্যে, তাঁকে বাঁধা যায় না। যদিও যশোদার বাৎসল্যপ্রেমে ভগবান স্বেচ্ছাক্রমে বাঁধা পড়েছিলেন।

অণ্ডান্তরস্থ-পরমাণুচয়-অন্তরস্থংযিনি ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্গত পরমাণু রাশির প্রত্যেকটির অভ্যন্তরে পূর্ণরূপে বিরাজমান। শ্রীভগবান সম্বন্ধে শ্ৰুতি শাস্ত্রে বলা হয়, অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্। পরমেশ্বর ভগবান এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ক্ষুদ্র বস্তু অণুর অপেক্ষাও ক্ষুদ্র, আবার সবচেয়ে বিশাল বস্তুর অপেক্ষাও বিশাল।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষম্ তম্ অহং ভজামি— এই রকম স্বরূপত এক তত্ত্ব হয়েও অচিন্ত্য শক্তি বলে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড রচনা করছেন যিনি, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ব্রহ্মসংহিতার এই শ্লোকের তাৎপর্যে বলছেন যে, জড় বা মায়িক তত্ত্ব থেকে বিলক্ষণ আর একটি স্বভাব ‘চিৎ’ বস্তু শ্রীকৃষ্ণে বিদ্যমান। তিনি অচিন্ত্য শক্তি দ্বারা স্বেচ্ছাক্রমে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। জগৎ সমস্তই তাঁর শক্তির পরিণাম। আবার তাঁর স্থিতিও পরম অদ্ভুত। সমস্ত চিজগতও সমস্ত জড়জগত তাঁর মধ্যেই অবস্থিত। তিনি সেই একই সময়ে সমস্ত জগতেই অবস্থিত। এমনকি সমস্ত জগতের প্রত্যেক পরমাণুতে তিনি পরিপূর্ণ রূপে অবস্থিত। শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপী। এই সর্বব্যাপিত্ব ধর্ম কেবল শ্রীকৃষ্ণের প্রাদেশিক (বাহ্যিক) ঐশ্বর্যমাত্র। কিন্তু সর্বব্যাপিত্ব সত্ত্বেও মধ্যমাকারে সর্বত্র পূর্ণরূপে অবস্থান করছেন, এই হলো তাঁর লোকাতীত চিৎ ঐশ্বর্য। এই বিচার দ্বারা যুগপৎ অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বই স্বীকৃত হয়েছে এবং মায়াবাদ প্রভৃতি সমস্ত দুষ্টমত দূরীকৃত হয়েছে।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৬ 

❝যদ্ভাব-ভাবিত-ধিয়ো মনুজাঃস্তথৈব
সংপ্রাপ্য রূপমহিমা-আসনযানভূষাঃ।
সূক্তৈর্যম্‌-এব নিগম-প্রথিতৈঃ স্তুবন্তি
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যদ্—যাঁর; ভাব—ভাবে; ভাবিত-ধিয়ঃ— বিভাবিত বুদ্ধি বা ভাবভক্তিপ্রাপ্ত; মনুজাঃ—মানুষেরা; তথা এব—নিজ নিজ সিদ্ধ ভাব অনুরূপ; সংপ্রাপ্য—প্রাপ্ত হয়ে; রূপ—সৌন্দর্য; মহিমা—মহিমা; আসন—আসন; যান—যানবাহন; ভূষাঃ—এবং ভূষণাদি; সূক্তৈঃ—বৈদিক মন্ত্র দ্বারা; যং—যাঁকে; এব—নিশ্চিতভাবে; নিগম-প্রথিতৈঃ–বেদ দ্বারা উক্ত; স্তুবন্তি—স্তব করেন; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই ; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: যাঁর ভাবরূপ ভক্তিতে আপ্লুত চিত্ত মানুষেরা বৈদিক মন্ত্র-সূক্ত দ্বারা তাঁকে স্তব করেন এবং উপযুক্ত সৌন্দর্য (রূপ), মহিমা, আসন (সিংহাসন বা উচ্চপদ), যান (যানবাহন ) ও ভূষণ (অলঙ্কার ) লাভ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 36

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যদ্ ভাব ভাবিত ধিয়ঃ— শ্রীকৃষ্ণের ভাবে বিশেষ ভাবিত বুদ্ধি অর্থাৎ, ভাবভক্তি প্রাপ্তি। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যাঁর ভাবের উদয় হয়েছে, শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁর লক্ষণগুলি বর্ণনা করেছেন। সেই ভাবলক্ষণগুলি হচ্ছে—

১) সময়ের সদ্ ব্যবহার— কখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে না বসে তিনি সব সময় দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা অবিচলিতভাবে ভগবদ্ সেবা করতে আগ্রহী থাকেন। একটি মুহূর্তও ভক্ত অন্য কোন কার্যকলাপে নষ্ট করেন না ।

২) সহিষ্ণুতা— নানা গোলমালের মধ্যেও ভক্ত অবিচলিত থাকেন। ধীর ও প্রশান্ত চিত্ত ব্যক্তি কারও আঘাতে বা অভিশাপেও বিচলিত হন না ।

৩) বিষয়ে অনাসক্তি— নানা প্রলোভনের মধ্যেও যিনি জড় বিষয়ে আসক্ত বা আকৃষ্ট হয়ে পড়েন না ।

৪) অমানীশ্রীকৃষ্ণের সেবার জন্য যিনি ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা তুচ্ছ পদও গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করেন না । ভক্ত সব লাঞ্ছনা হাসি মুখে সহ্য করেন। তাঁর কাজের বিনিময়ে কোন রকম জাগতিক সম্মান আশা করেন না।

৫) আশাবন্ধযেহেতু আমি ভগবদ্ভক্তির নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধগুলি মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, তাই আমি অবশ্যই ভগবানের কাছে ফিরে যাব। এভাবে সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের করুণা প্রত্যাশী হওয়াকে আশাবন্ধ বলা হয়। কখনও বা ব্যথাতুর হৃদয়ে অনুতপ্ত হয়ে ভাবে ‘আমি কেন উল্টোপাল্টা হয়ে গেছি, জীবনের পরম লক্ষ্যের দিকে আমি এগোচ্ছি না। না আমাকে অবশ্যই কৃষ্ণের চরণপদ্মের দিকে যেতেই হবে।‘

৬) সমুৎকণ্ঠাকিছু পেতে হলে মূল্য দিতে হয়। কৃষ্ণভক্তি পাবার মূল্য হলো গভীর উৎকণ্ঠা। ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন আশায় ব্যাকুল হয়ে থাকেন ।

৭) ভগবানের দিব্য নামের প্রতি আসক্তি— ভক্ত ভগবানকে ভুলে থাকতে পারেন না। তাই তিনি সর্বদা কৃষ্ণনাম জপ, স্মরণ, কীর্তন, ধ্যান করে থাকেন।

৮) শ্রীকৃষ্ণের রূপ গুণ লীলা পরিকর বর্ণনায় আগ্রহ— জড়বুদ্ধি লোক প্রজল্প (আজেবাজে কথায় অথবা পরনিন্দা-পরচর্চায়) আগ্রহী। ভক্ত কৃষ্ণকথায় আগ্রহী।

৯) শ্রীকৃষ্ণলীলাস্থলীতে বাস করার আকাঙ্ক্ষা— ভগবানের লীলাস্থলী দর্শন করা, পরিক্রমা করা, প্রণতি নিবেদন করা, বাস করা, ধামমহিমা আলোচনা করা ভক্তদের বৈশিষ্ট্য। এমন কি ভগবৎ লীলাস্থলী থেকে যাঁরা দূরে থাকেন তাঁরাও ভগবৎ লীলাস্থলীর কথা শ্রবণ ও স্মরণ করেন বা ছবি দেখেন।

ভক্তি-ভাব রস বিচারে পাঁচ রকমের। যথা—

১) শান্তকেউ যখন নিরন্তর শুদ্ধ সত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন, তখন তাঁর সেই অবস্থাকে ভগবদ্ভক্তির শান্ত রস বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘আমার স্বরূপে যখন কারও চিত্ত স্থির হয়, তখন তাকে বলা হয় শান্ত রস। সেই অবস্থায় অধিষ্ঠিত না হয়ে কেউ যথার্থ শুদ্ধভক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে না।

২) দাস্যস্বতঃস্ফূর্ত ভগবৎপ্রেমে সেব্য ও সেবকের মধ্যে অন্তরঙ্গ আসক্তি বা মমতা যুক্ত হয়।

৩) সখ্যদাস্য প্রেমে মমতা থাকলেও ভয় ও সম্ভ্রম সহজে উদিত হয়। সেই ভয়-সম্ভ্রম পরিত্যাগ করে একান্ত বিশ্বাস বা বিশ্রম্ভ (প্রণয়) বরণ করলে সখ্য প্রেম হয়। সখ্য রসে কৃষ্ণ ও সখাদের মধ্যে সমতা ভাব উদিত হয় ।

৪) বাৎসল্যসখ্য রসে সমতা ভাব আছে। কিন্তু এই সমতা যখন অধিকতর উন্নত হয়ে স্নেহে পর্যবসিত হয়, তখন বাৎসল্য প্রেমে পরিণত হয়।

৫) মধুরসাধারণ প্রেমে মমতা নেই। দাস্য প্রেমে মমতা থাকলেও বিশ্রম্ভ বা বিশ্বাস নেই। সখ্য-প্রেমে বিশ্রম্ভ থাকলেও নিঃসঙ্কোচ ভাব নেই। কিন্তু এই সব ভাবই রয়েছে মধুর রসে।

মনুজাঃ তথা এর প্রাপ্য– মানুষ নিজ নিজ সিদ্ধ ভাব অনুরূপ উচিত প্রাপ্য স্থান লাভ করেন।

রূপ মহিমা আসন যান ভূষাঃ— রূপ, মহিমা, আসন, যান ও ভূষণ। সেই সেই ভাবের ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের নিয়ত সেবা করে চরমে উচিত প্রাপ্য স্থান লাভ করেন। নিজ নিজ রসের অনুরূপ চিৎস্বরূপ লাভ করেন। উচিত মহিমা, উচিত সেবা -পীঠরূপ আসন, উচিত যাতায়াতের যান এবং নিজ রূপ সমৃদ্ধিকারী চিন্ময় গুণ -ভূষণও লাভ করেন।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এই শ্লোকের তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন—যাঁরা শান্ত রসের অধিকারী তাঁরা শান্তিপীঠ ব্রহ্ম-পরমাত্ম ধাম, যাঁরা দাস্য রসের অধিকারী তাঁরা ঐশ্বর্যগত বৈকুণ্ঠ ধাম, যাঁরা শুদ্ধ সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের অধিকারী তাঁরা সর্বোচ্চ ধাম গোলোক লাভ করেন।

সূক্তৈঃ যং এব নিগমপ্রথিতৈঃ সুবন্তি— ভক্তরা (সূক্তৈঃ এব) মন্ত্র সূত্রের দ্বারা, (যং) যাঁকে, (নিগম প্রথিতৈঃ) শ্রুতি প্রসিদ্ধ, (সুবন্তি) স্তব করেন। ভক্তরা সেই সেই স্থানে নিজ নিজ রসোচিত সমস্ত উপকরণ ও সামগ্রী প্রাপ্ত হয়ে বৈদিক সূক্ত অনুসারে ভগবানের স্তব করেন।

গোবিন্দ আদিপুরুষম্ তম্ অহং ভজামিবিভিন্ন ভাবের ভক্তদের দ্বারা বৈদিক মন্ত্র দ্বারা সুয়মান আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৭ 

❝আনন্দ চিন্ময় রস প্রতিভাবিতাভি-
-স্তাভির্য এব নিজরূপতয়া কলাভিঃ।
গোলোক এব নিবসত্য-অখিলাত্মভূতো
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

আনন্দ—পরম সুখ; চিৎ-ময়—জ্ঞানময়; রস—রস; প্রতি—সব সময় ; ভাবিতাভিঃ—পূর্ণরূপে নিমগ্ন; তাভিঃ—তাঁদের সঙ্গে; —যিনি; এব—অবশ্যই; নিজ-রূপতয়া—যিনি নিজ চিন্ময় দেহের অনুরূপা (সাদৃশ্যপূর্ণ) হ্লাদিনী-শক্তিরূপা আনন্দদায়িনী শ্রীরাধা; কলাভিঃ-রাধারানীর কায়ব্যূহরূপ সখীগণের সঙ্গে; গোলোক এব—গোলোক ধামেই; অখিলাত্মভূতঃ—নিখিল প্রিয়বর্গের আত্মস্বরূপ; নিবসতি— বাস করেন; তম্—সেই; আদিপুরুষং – আদিপুরুষকে; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; অহং—আমি ; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: যিনি চৌষট্টি (৬৪) চিন্ময় গুণসম্পন্ন পরম শক্তির মূর্ত প্রতীক এবং যিনি নিজ চিন্ময় দেহের অনুরূপা (সাদৃশ্যপূর্ণ) হ্লাদিনী-শক্তিরূপা আনন্দদায়িনী শ্রীরাধা ও তৎকায়ব্যূহরূপা (অর্থাৎ শ্রীরাধার দৈহিক রূপের বিস্তৃতি) সখীবর্গের সাথে চৌষট্টি (৬৪) কলা বিদ্যা সহিত চির-আনন্দময় আধ্যাত্মিক (চিন্ময়) রস দ্বারা পরিব্যাপ্ত থেকে নিজ নিত্য গোলোক ধামে বাস করেন, সেই আদিপুরুষকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 37(1)

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

আনন্দ চিন্ময় রস প্রতিভাবিতাভিঃ— উজ্বল নামক যে পরম প্রেমময় রস, তার দ্বারা উদ্ভূত। শক্তি ও শক্তিমান্ একাত্মা হয়েও হ্লাদিনীশক্তি কর্তৃক রাধা ও কৃষ্ণরূপে আলাদা আলাদা হয়ে নিত্য অবস্থান করেন। সেই আনন্দ (হ্লাদিনী) ও চিৎ (কৃষ্ণ) উভয়েই অচিন্ত্য শৃঙ্গার রস বর্তমান। সেই রসের বিভাব দুই রকম—আলম্বন ও উদ্দীপন। আলম্বন দুই রকম—আশ্রয় ও বিষয়। আশ্রয় হলেন স্বয়ং রাধিকা ও তাঁর কায়ব্যূহ সখীগণ। বিষয় হলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। কৃষ্ণই হচ্ছেন গোলোকপতি গোবিন্দ। সেই রসের প্রতিভাবিত আশ্রয় হলেন গোপীগণ। তাঁদের সঙ্গে গোলোকে কৃষ্ণের নিত্য লীলা।

স্তাভির্য এব নিজরূপতয়া কলাভিঃ— যিনি নিজ চিন্ময় দেহের অনুরূপা (সাদৃশ্যপূর্ণ) হ্লাদিনী-শক্তিরূপা আনন্দদায়িনী শ্রীরাধা (নিজ রূপতয়া এব) ও তৎকায়ব্যূহরূপা (অর্থাৎ শ্রীরাধার দৈহিক রূপের বিস্তৃতি) সখীবর্গের (তাভিঃ কলাভিঃ) সাথে চৌষট্টি (৬৪) কলা বিদ্যা নিয়ে নিত্য গোলোকে বিদ্যমান। সেই চৌষট্টি কলা বিদ্যা হলো—

(১) গীত (নানা সুরে, নানা রাগে গান রচনা), (২) বাদ্য, (৩) নৃত্য, (৪) নাট্য (রূপকময়), (৫) আলেখ্য (চিত্র কর্ম) (৬) বিশেষকচ্ছেদ্য (তিলক করার সময় নানা বিচ্ছেদ রচনা), (৭) তণ্ডুল-কুসুম-বলি-বিকার (চাউল ও পুষ্পাদি পূজা-উপহারের বিবিধ প্রকার রচনা), (৮) পুষ্পাস্তরণ (ফুলের বিছানা), (৯) দশনবসনাঙ্গরাগ (দন্ত ও বসনের বা ওষ্ঠের নানা প্রকার রঞ্জন), (১০) মণিভূমিকা কর্ম (ময়দানব নির্মিত পাণ্ডবসভার মতো মনিবদ্ধ ভূমি ক্রিয়া, (১১) শয়ন রচন (খাট পালঙ্কাদি রচনা), (১২) উদক বাদ্য (সরোবর প্রভৃতিতে স্থাপিত ভাণ্ডে কিংবা জলপূর্ণ পাত্রে মধুর মধুর নানা তান উত্থান), (১৩) উদক ঘাত (জল স্তম্ভ বিদ্যা), (১৪) চিত্রযোগ (নানা রকমের অদ্ভুত বস্তুর দর্শন করার সম্যক উপায়), (১৫) মাল্য গ্রন্থণ বিকল্প (মালা রচনার প্রকার ভেদ), (১৬) কেশশেখরাপীড়যোজন (কেশে চূড়াদি বাঁধা), (১৭) নেপথ্যযোগ (অলঙ্কার করণ), (১৮) কর্ণপত্রভঙ্গ (কর্ণাদিতে তিলক রচনা), (১৯) গন্ধযুক্তি (কস্তুরী প্রভৃতি গন্ধ অনুলেপন), (২০) ভূষণ যোজন (অলংকার দিয়ে সাজানো বিদ্যা), (২১) ইন্দ্রজাল (ভেল্কীবাজী), (২২) কৌচুমার যোগ (কুচুমার নামক ব্যক্তির প্রকাশিত নিজেকে নানা রূপ প্রকাশ, (২৩) হস্তলাঘব (চমৎকার দর্শনের জন্য অন্তরালে হস্তাদি সঞ্চালন দ্বারা সেই সেই বস্তুর প্রবর্তন), (২৪) চিত্রশাকাপূপ ভক্ষ্যবিকার ক্রিয়া (পিষ্টক প্রভৃতি ভক্ষ্য বস্তুর নানা প্রকারে নির্মাণ), (২৫) পানকরস রাগাসব যোজন (সরবৎ প্রভৃতি পানীয় রসের নানাবিধ বর্ণ এবং মধুরত্ব রচনা), (২৬) সূচীবাপ কর্ম (বিচিত্র সেলাই কর্ম), (২৭) সূত্রক্রীড়া (সূতো দিয়ে পুতুল প্রভৃতিকে চালনা), (২৮) প্রহেলিকা (গোপন কথার অর্থ পরিজ্ঞান), (২৯) প্রতিমা (সমস্ত বস্তুর প্রতিকৃতি নির্মাণ), (৩০) দুর্বচ যোগ (যা যা বলবার সামর্থ্য হয় না, সেই সেই কথা বলার উপায়), (৩১) পুস্তক বাচন (পুস্তকে কোন কোন বর্ণ না থাকলেও সেই সেই বর্ণ যোগ করে অতি দ্রুত পাঠকরণ), (৩২) নাটিকাখ্যায়িকা দর্শন (নাটকাদি শাস্ত্রের পরিজ্ঞান ও তার নির্মাণ), (৩৩) কাব্য সমস্যা পূরণ (কাব্যে কোনও সংক্ষেপ উক্ত গুপ্ত পদের সহসা পূরণ করতে অসমর্থ হলে অন্য শ্লোকের অংশ দ্বারা পূরণ, (৩৪) পট্টিকা বেত্রবাণ বিকল্প (সূতো দিয়ে চ্যাপ্টা ঘোড়া তাড়ানো চাবুক ও বাণের কল্পনা), (৩৫) তর্ক কর্ম (লোহার শলাকা থেকে সূতো তৈরী করা), (৩৬) তক্ষণ (কাঠের বিচিত্র কাজ), (৩৭) বাস্তুবিদ্যা (গৃহোচিত ভূমি ও গৃহ নির্মাণের নানা অবস্থা জ্ঞান, (৩৮) রৌপ্যরত্ন পরীক্ষা (রূপা প্রভৃতি রত্নের সদসৎ জ্ঞান), (৩৯) ধাতুবাদ (স্বর্ণাদি কল্পনা), (৪০) মণিরাগ (মণি সকলে নানা প্রকার বর্ণ নির্মাণ জ্ঞান), (৪১) আকর জ্ঞান (দেখা মাত্র মণি প্রভৃতির উদ্ভব ভূমির জ্ঞান), (৪২) বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ (বৃক্ষাদি উদ্ভিদ পদার্থের চিকিৎসা জ্ঞান), (৪৩) মেষ কুক্কুট শাবক যুদ্ধবিধি (শেষ শাবক, মুরগী শাবক প্রভৃতির যুদ্ধ বিধি), (৪৪) শুক-শারিকা প্রলাপন, (৪৫) উৎসাদন (মন্ত্রণা দ্বারা পরস্পর আসক্তি ত্যাজন), (৪৬) কেশ মার্জন কৌশল, (৪৭) অক্ষর-মুষ্টিকা কথন (অদৃষ্ট অক্ষর এবং মুষ্টিকার মধ্যে অদৃষ্ট বস্তুর স্বরূপ ও সংখ্যার কথন), (৪৮) ম্লেচ্ছিত বিকল্প (বিবিধ স্লেচ্ছ ভাষা ও ভরতশাস্ত্রের জ্ঞান), (৪৯) বিভিন্ন দেশভাষা জ্ঞান, (৫০) পুষ্প শকটিকা নিমিত্ত জ্ঞান (কিভাবে ফুল দিয়ে খেলনা গাড়ি তৈরি করতে হয় তার জ্ঞান), (৫১) যন্ত্র মাতৃকা (পূজার জন্যে মাতৃকা বর্ণে যন্ত্র নির্মাণ), (৫২) ধারণ মাতৃকা (ধারণের জন্য মাতৃকা বর্ণে যন্ত্র নির্মাণ), (৫৩) সংপাট্য (অভেদ্য হীরা প্রভৃতির দ্বিধাকরণ/সংশয়), (৫৪) মানসী কার্য ক্রিয়া (অন্যের মনে কি আছে, সেই মন বুঝে অনুগামী শ্লোক নির্মাণ), (৫৫) ক্রিয়া বিকল্প (এক এক ক্রিয়ার বহু প্রকারে নিষ্পাদন), (৫৬) ছলিতক যোগ (অপরকে বঞ্চনার উপায়), (৫৭) অভিধান, কোষ ও ছন্দ জ্ঞান, (৫৮) বস্ত্র গোপন (সূতি কাপড়কে রেশমী প্রভৃতি রূপে দেখানো), (৫৯) দ্যূত বিশেষ, (৬০) আকর্ষণ ক্রীড়া (দূরে থাকা দ্রব্যের আনয়ন), (৬১) বালক্রীড়নক (শিশুর খেলনা প্রস্তুতি), (৬২) বৈনায়িকী (বিভিন্ন রকমের লিপি রচনা), (৬৩) বৈজয়িকী (শজয়ের বিবিধ উপায়), (৬৪) বৈতালিকী (স্তব পাঠ ও রচনা)। এই সমস্ত বিদ্যা মূর্তিমতী হয়ে রসপ্রকরণ রূপে গোলোক ধামে নিত্য প্রকটিত। জড়জগতে ব্রজলীলায় যোগমায়া দ্বারা এই সব বিদ্যা প্রশস্তরূপে প্রকটিত হয়েছে।

গোলোক এর নিবসতি অখিলাত্মভূতঃ– অখিল প্রিয়বর্গের আত্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ গোলোক ধামে বাস করেন। গোলোকে সর্বদা নিজ অনন্ত লীলা প্রকাশের সঙ্গে কৃষ্ণ শোভা পাচ্ছেন। কখনও ভৌম জগতে সেই লীলার অন্য প্রকাশ হয় কৃষ্ণ সপরিবারে জন্মলীলা প্রকট করেন। কৃষ্ণের ভাব অনুসারে লীলাশক্তি তাঁর পরিকরদেরও সেই সেই ভাবে বিভাবিত করেন। শ্রীল জীব গোস্বামী বলছেন, কৃষ্ণের প্রকট লীলা যোগমায়া দ্বারা প্রকাশিত হয়। তাতে কতগুলি মায়া প্রত্যায়িত (তত্ত্বাবধানে) কার্য দেখা যায়, তা স্বরূপ তত্ত্বে থাকতে পারে না। যেমন—অসুর সংহার, পরদার (পরস্ত্রী) সংগ্রহ ও জন্ম প্রভৃতি। কেননা চিন্ময় জগতে কৃষ্ণ-উন্মুখ ব্যক্তি বিরাজমান, আসুরিক কৃষ্ণবিমুখ ব্যক্তি নেই। গোপীগণ সবাই শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ শক্তিগত তত্ত্ব। সুতরাং সকলেই কৃষ্ণের স্বকীয়া, তাঁদের কিভাবে পরদারত্ব সম্ভব? শ্রীকৃষ্ণ জন্ম-মৃত্যুর উর্ধ্বের তত্ত্ব। অজ অনাদি অনন্ত। অতএব তাঁর জন্মগ্রহণ ও দেহত্যাগ সমস্ত লীলা কেবল মায়িক প্রত্যয় মাত্র। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন, শ্রীজীব গোস্বামী আমাদের তত্ত্বাচার্য। তিনি কৃষ্ণলীলায় মঞ্জরী বিশেষ। সর্ব তত্ত্ব তাঁর পরিজ্ঞাত। তাঁর আশ্রয় বুঝতে না পেরে কতগুলো লোক মনগড়া অর্থ রচনা করে পক্ষ-বিপক্ষভাবে তর্ক করে থাকে।

শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন, বহু ভাগ্যের ফলে কৃষ্ণকৃপা হলে কেউ জড় প্রপঞ্চ ত্যাগ করে চিন্ময় জগতে প্রবিষ্ট হন। সেখানে গোলোকে বিশুদ্ধ লীলা দর্শন ও আস্বাদন করতে পারবেন। আর, এই প্রপঞ্চে থেকেও ভক্তিসিন্ধিক্রমে কৃষ্ণকৃপায় চিন্ময় রসের অনুভূতি যিনি লাভ করেছেন, তিনি ভৌম গোকুলেও সেই গোলোক লীলা দেখতে পান। বস্তু সিদ্ধি বা স্বরূপ সিদ্ধির তারতম্য অনুসারে ভক্তদের গোলোকলীলা দর্শনের তারতম্য রয়েছে। নিতান্ত মায়াবদ্ধ ব্যক্তিরা ভক্তিচক্ষুহীন। তারা ভক্তিবহির্মুখ জ্ঞানের আশ্রয়ে থাকে।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষং তম্ অহং ভজামি— গোলোকে নিবাসকারী সেই অখিলাত্মভূত বা সর্বান্তর্যামী পরমেশ্বর, সর্বজীবের প্রিয়তম, সর্ব-জীবের উৎস, সর্বপ্রবর্তক গোবিন্দ, সেই আদিপুরুষকে আমি ভজনা করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৮ 

❝প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিত-ভক্তিবিলোচনেন
সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি।
যং শ্যামসুন্দরম্‌  অচিন্ত্যগুণ-স্বরূপং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

প্রেম—ভালোবাসা; অঞ্জন—কাজল; চ্ছুরিত—রঞ্জিত; ভক্তি-বিলোচনেন—ভক্তিচক্ষুতে; সন্তঃ—শ্রীকৃষ্ণে একনিষ্ঠ সাধুগণ; সদা এব—সর্বদাই; হৃদয়েষু—নিজ নিজ শুদ্ধ হৃদয়ে; বিলোকয়ন্তি—দর্শন করে থাকেন; যং—যে; শ্যামসুন্দরম্—শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে; অচিন্ত্য—জড় চিন্তার অতীত; গুণস্বরূপং—আদি পুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: ভক্তিপ্রেমে রঞ্জিত সাধুগণ ভক্তিচক্ষুর দ্বারা যে অচিন্ত্য অগণিতগুণবিশিষ্ট শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে হৃদয়ে দর্শন করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 38

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিত-ভক্তিবিলোচনেন— প্রেমের অঞ্জনে রঞ্জিত ভক্তিচক্ষুতে। কাজল পরলে চোখ যেমন পরিষ্কার ও সুন্দর হয়, তেমনি প্রেমভক্তিভাবিত অবস্থায় দৃষ্টি শুদ্ধ হয়। প্রেম চক্ষুতে ভগবান দর্শন হয়। কাম চক্ষুতে ভগবৎ দর্শন হয় না।

সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি— কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত সাধুগণ তাঁদের হৃদয়েও শ্রীকৃষ্ণকে সর্বদাই দর্শন করেন। সাধনভক্তি যখন ভাব অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন কৃষ্ণকৃপা বলে সেই ভাবভক্তের হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণ দর্শন হয়। সাধনভজন ফলে হৃদয় শুদ্ধ হয়। সেই হৃদয়ে সর্বদা ভক্তিভাবময় ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেন। ভক্তিযোগেন মনসি সম্যক প্রনিহিতে অমলে। অপশ্যৎ পুরুষং পূর্ণম—শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ পূর্ণপুরুষ কেবল ভক্তিভাবিত ভক্তহৃদয়ে উদিত হন। শুদ্ধ মহাত্মাগণ যে কোনও স্থানে থেকেও ব্রজের শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন।

যং শ্যামসুন্দরম্‌ অচিন্ত্যগুণ স্বরূপম্‌ —যে অচিন্ত্যগুণ স্বরূপ অর্থাৎ জড় ধারণার অতীত অগণিতগুণ রূপ সমন্বিত শ্যামসুন্দর। শ্যামসুন্দর বললে সুন্দর শ্যামবর্ণটি জড় কোন বর্ণ নয়। বরং তা চিন্ময় বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ নিত্য পরমানন্দদায়ী বর্ণ। জড় চোখে তা দেখা যায় না ।

ব্রজধামে শ্রীকৃষ্ণের প্রকটকালে ভক্ত ও অভক্ত সকলেই এই চোখে তাঁকে দেখেছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র ভক্তরাই শ্রীকৃষ্ণকে তাঁদের হৃদয়ের পরমধন বলে আদর করেছিলেন। অভক্তরা শ্রীকৃষ্ণকে কোনও বিভীষিকা বা মন্দচরিত বা তাদের মতোই সাধারণ ব্যক্তি বলে দর্শন করেছিল। তাই তারা তাঁকে তেমন শ্রদ্ধা ভক্তি নিবেদন করেনি। শ্রীকৃষ্ণের প্রকটকালীন ভক্তরা হৃদয়নিধি রূপে শ্রীকৃষ্ণকে সমাদর করতেন, কিন্তু বর্তমান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রকটকালীন অবস্থায় ভক্তরা চাক্ষুষ দর্শন না পেলেও ভক্তিভাবিত হৃদয়ে ব্রজধামে কৃষ্ণকে দর্শন করেন। শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণ, লীলা, ধাম, পরিকর সব কিছুই প্রেমচক্ষুতে দর্শন করে থাকেন।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি— সেই অচিন্ত্য গুণ স্বরূপ আদিপুরুষ গোবিন্দকে ভজনা করি ।

শ্রীল জীব গোস্বামী উল্লেখ করেছেন, যদিও শ্রীগোবিন্দ শ্রীগোলোকেই রয়েছেন, তবুও প্রেমচক্ষুতে একনিষ্ঠ ভক্তগণ এই জগতে থেকে দর্শন করতে পারে। যদিও শ্রীকৃষ্ণ অপ্রাকৃত অগণিত গুণরূপ বিশিষ্ট এবং জড় ধারণার অতীত, তবুও ঐকান্তিক প্রেমভক্তিপরায়ণ ব্যক্তি সেই শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারেন।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৩৯ 

রামাদি-মূর্তিষু কলা-নিয়মেন তিষ্ঠন্
নানাবতারম্‌-অকরোদ্-ভুবনেষু কিন্তু
কৃষ্ণ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

রামাদি মূর্তিষু—রামচন্দ্র প্রভৃতি বিভিন্ন রূপে; কলা-নিয়মেন—স্বাংশ কলাদিরূপে; তিষ্ঠন –অবস্থান করে; নানা অবতারম্ –বিভিন্ন অবতার; অকরোৎ—প্রকাশ করে থাকেন; ভুবনেষু—জগতে; কিন্তু—পরন্তু; কৃষ্ণঃ স্বয়ং—নিজেই কৃষ্ণরূপে; সমভবৎ—অবতীর্ণ হন; পরমঃ পুমান্—পরম পুরুষ; যঃ—যিনি; গোবিন্দম্–গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্—আদিপুরুষ ; তম্—তাঁকে ; অহম্—আমি ; ভজাম—ভজন করি।

অনুবাদ: যে পরমপুরুষ স্বাংশ কলাদিরূপে জগতে শ্রীরামচন্দ্র, নৃসিংহদেব, বামন আদি নানা অবতারে প্রকাশ করেছিলেন এবং যিনি স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হয়েছিলেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 39

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্– পরমেশ্বর আদিপুরুষ গোবিন্দ থেকে স্বাংশ ও অংশের অংশ রূপে শ্রীরামচন্দ্র, নৃসিংহদেব, বামন আদি নানা অবতার চিন্ময় জগতে রয়েছেন ।

নানা-অবতারম্-অকরোদ-ভুবনেষু— চিন্ময় জগত থেকে জড় জগতে সেই সমস্ত নানাবিধ অবতার অবতীর্ণ বা প্রকাশিত হন ।

কিন্তু কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্– পরন্তু স্বয়ং রূপ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণও অবতীর্ণ হন (ক্ষেত্র বিশেষে)।

স্বাংশ অবতার রূপে রামচন্দ্র প্রভৃতি অসংখ্য অবতার বৈকুণ্ঠ থেকে জড় জগতে অবতীর্ণ হন। আর, কৃষ্ণ গোলোকের ব্রজধামসহ স্বয়ং এই প্রপঞ্চে (জড় জগতে) অবতীর্ণ হন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ব্যাখ্যা করেছেন, পরমপুরুষ কৃষ্ণাভিন্ন কৃষ্ণচৈতন্যও সেই স্বয়ং রূপেই এই জগতে প্রকটিত হয়েছেন—এটাই গূঢ় তাৎপর্য ।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি— সেই সর্ব অবতারের অবতারী আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দকে ভজনা করি।

শ্রীল রূপ গোস্বামী উল্লেখ করেছেন, অবতারাবলীবীজমবতারী নিগদ্যতে (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ২।১।২০৩)। অবতারীকেই সমস্ত অবতারের বীজ বা কারণ বলা হয়। যেমন, গীতগোবিন্দ গ্রন্থে—যিনি মৎস্য রূপে বেদসমূহ উদ্ধার, কূর্ম রূপে পৃষ্ঠে পৃথিবীকে ধারণ, বরাহ রূপে দন্তোপরি ভূগোল ধারণ, নৃসিংহ রূপে হিরণ্যকশিপুর বক্ষোবিদারণ, বামন রূপে বলিকে ছলনা, পরশুরাম রূপে ক্ষত্রিয়বংশ ধ্বংস, রাম রূপে রাবণ বিনাশ, বলরাম রূপে হলগ্রহণ, বুদ্ধ রূপে কারুণ্য বিস্তার এবং কল্কি রূপে ম্লেচ্ছ সংহার করে থাকেন—দশবিধ রূপ হে শ্ৰীকৃষ্ণ, তোমায় প্রণাম জানাই ।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য অবতার । অবতারাঃ হি অসংখ্যেয়াঃ হরেঃ (ভাগবত ১।৩।২৬)

এই সমস্ত অবতারেরা ভগবানের পুরুষাবতারদের অংশ বা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান। এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্ (ভাগবত ১।৩।২৮)।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪০ 

❝যস্য প্রভা প্রভবতো জগদণ্ডকোটি-
কোটিষ্বশেষ-বসুধাদি বিভূতিভিন্নম্।
তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলম্‌-অনন্তম্‌-অশেষভূতং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যস্য—যাঁর; প্রভা—অঙ্গকান্তি; প্রভবতঃ—প্রভাবশালী; জগদণ্ড কোটিকোটিষু—কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে; অশেষ—অনন্ত; বসুধাদি—গ্রহলোকসমূহ ও অন্যান্য অভিব্যক্তিগুলির সঙ্গে; ভিন্নম্‌—ভিন্ন; তদ্ ব্রহ্ম—সেই ব্ৰহ্ম, নিষ্কলম্‌—নিরুপাধি; অনন্তম্—অপরিসীম; অশেষ ভূতং—অখণ্ড পূর্ণরূপে বিদ্যমান; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে ; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: যাঁর অঙ্গপ্রভা হল উপনিষদে উল্লিখিত নির্বিশেষ (অভিন্ন; আলাদা বা পৃথক করা যায় না এমন) ব্রম্ভের উৎস, অনন্ত কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যাঁর বিভূতি (ভগবানের ঐশ্বর্য বা শক্তি) — ক্ষিতি (ভূমি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ) প্রভৃতি রূপে পরিব্যাপ্ত এবং যিনি নিষ্কল অর্থাৎ অখণ্ড, অনন্ত ও অশেষভূত, আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 40

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যস্য প্রভা প্রভবতঃ— যে প্রভাবশালী গোবিন্দের অঙ্গকান্তি। উপনিষদগণ যাঁকে নির্বিশেষ ব্রহ্ম বলেন। নিরাকার নির্বিশেষ ব্ৰহ্ম জ্যোতি। সেই ব্রহ্ম জ্যোতি শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গ থেকে উৎপত্তি।

জগদণ্ড কোটি কোটিষু অশেষ বসুধাদি বিভূতি ভিন্নম্— গোবিন্দের বিভূতিরূপ কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে অনন্ত পৃথিবী আদি বিভূতি সমূহ থেকে ভিন্ন। অসংখ্য জড় ব্রহ্মাণ্ডগুলি হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের একপাদ বিভূতি । সমগ্র জগতের মধ্যে চার ভাগের একভাগ হচ্ছে অনন্ত কোটি জড় ব্ৰহ্মাণ্ড ।

তদ্‌ ব্রহ্ম নিষ্কলম্ অনন্তম্ অশেষ ভূতং— সেই ব্রহ্ম হচ্ছে কলারহিত, আনন্দ ও অবশিষ্ট তত্ত্ব। শ্রীকৃষ্ণের ত্রিপাদ বিভূতি রূপ চিন্ময় জগৎ। চিন্ময় জগতে রয়েছে অনন্ত কোটি বৈকুণ্ঠ জগৎ। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড জগৎ হচ্ছে চার ভাগের মধ্যে একভাগ এবং তিন ভাগই অনন্ত বৈকুণ্ঠ জগৎ। চিন্ময় জগতের বহিঃপ্রাকারে স্থিত তেজো বা জ্যোতি হচ্ছে ব্রহ্মজ্যোতি স্তর। তা নিষ্কল বা কলা রহিত অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় রূপে প্রতীত। তা অনন্ত।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি — যাঁর প্রভায় প্রভূত ব্রহ্ম অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডে অশেষ বসুধাদি ঐশ্বর্য দ্বারা বিভাগকৃত, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত (আদি ২। ১২) বলা হয়েছে —

তাঁহার অঙ্গের শুদ্ধ কিরণমণ্ডল।
উপনিষৎ কহে তাঁরে ব্রহ্ম সুনির্মল॥

উপনিষদে যাঁকে নির্বিশেষ ব্রহ্ম রূপে অভিহিত করা হয়েছে, তা হচ্ছে সেই পরমপুরুষ শ্রীগোবিন্দের অঙ্গ প্রভা।

মুণ্ডক উপনিষদে (২।২।১০-১২) পরমেশ্বর ভগবানের অঙ্গপ্রভা বা দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করা হয়েছে — জড় আবরণের ঊর্ধ্বে চিৎজগতে অন্তহীন ব্রহ্মজ্যোতি রয়েছে, যা সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত। সেই জ্যোতির্ময় শুভ আলোককে আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিরা সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি বলে জানেন। সেই চিন্ময় লোককে উদ্ভাসিত করার জন্য সূর্যরশ্মি, চন্দ্রকিরণ, অগ্নি কিংবা বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। বাস্তবিকই জড় জগতে যে আলোক দেখা যায়, তা সেই পরম জ্যোতির প্রতিবিম্ব মাত্র। সেই ব্রহ্ম সম্মুখে ও পশ্চাতে, উত্তরে দক্ষিণে, পূর্বে পশ্চিমে এবং উপরে ও নীচে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। পক্ষান্তরে বলা যায়, সেই ব্রহ্মজ্যোতি জড় ও চেতন আকাশের সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত

শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছেন, তদ্ ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্ত মশেষভূতম্ — ব্রহ্মজ্যোতি অন্তহীনভাবে বিচ্ছুরিত হয়। সূর্য যেমন একটি বিশেষ স্থানে অবস্থান করলেও তার রশ্মি বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়, তেমনই পরমতত্ত্ব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর শক্তি বা রশ্মিচ্ছটা ব্রহ্ম অন্তহীনভাবে বিচ্ছুরিত হয়। ব্রহ্ম থেকে জড় জগতের প্রকাশ হয়, ঠিক যেমন সূর্যরশ্মি থেকে মেঘের প্রকাশ হয় (জলচক্রের মাধ্যমে; water cycle)। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি থেকে গাছপালা জন্মায় এবং গাছপালা থেকে ফল-মূল, শাক-সবজি উৎপন্ন হয়, যা আহার করে অন্য সমস্ত প্রাণীরা জীবন ধারণ করে। তেমনই, পরমেশ্বর ভগবানের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির কারণ। ব্রহ্মজ্যোতি নির্বিশেষ, কিন্তু সেই শক্তির উৎস হচ্ছেন সবিশেষ ভগবান। তাঁর ধাম বৈকুণ্ঠে তাঁর থেকে নির্গত এই ব্রহ্মজ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়। তিনি কখনই নির্বিশেষ নন। যেহেতু নির্বিশেষবাদীরা ব্রহ্মের উৎস সম্বন্ধে অবগত নয়, তাই তারা ভ্রমবশতঃ মনে করে যে, নির্বিশেষ ব্রহ্মই হচ্ছে চরম বা পরম লক্ষ্য। কিন্তু উপনিষদে বলা হয়েছে যে, নির্বিশেষ রশ্মিচ্ছটার আবরণ ভেদ করে পরমেশ্বর ভগবানের রূপ দর্শন করতে হয়। কেউ যদি সূর্যকিরণের উৎস সম্বন্ধে জানতে চায়, তাহলে তাকে সূর্যকিরণের স্তর অতিক্রম করে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করতে হবে এবং তারপর সেখানকার অধিষ্ঠাতৃ দেবতা সূর্যদেবকে দর্শন করতে হবে। পরম তত্ত্ব হচ্ছেন পরমপুরুষ ভগবান এবং শ্রীমদ্ভাগবতে সেই তত্ত্বই তাৎপর্য্য করা হয়েছে।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪১ 

মায়া হি যস্য জগদণ্ডশতানি সূতে
ত্রৈগুণ্য-তদ্বিষয়-বেদ-বিতায়মানা
সত্ত্বাবলম্বি-পরসত্ত্বং বিশুদ্ধ-সত্ত্বং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

মায়া—বহিরঙ্গা শক্তি; হি—অবশ্যই; যস্য—যাঁর; জগদণ্ড—ব্রহ্মাণ্ড; শতানি—অসংখ্য; সূতে—প্রসব করে; ত্রৈগুণ্য—সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ সমন্বিত; তদ্-বিষয়—সেই বিষয়; বেদ—বেদশাস্ত্রে; বিতায়মানা—বিস্তৃতভাবে বর্ণিত; সত্ত্ব-অবলম্বি—সমগ্র অস্তিত্বের অবলম্বন; পর-সত্ত্বম্—মায়া স্পর্শশূন্য; বিশুদ্ধ-সত্ত্বং—বিশুদ্ধ সত্ত্ব মূর্তি; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে ; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: ত্রিগুণময়ী (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই জড়জাগতিক ত্রিগুণকে নিয়ন্ত্রণকারী) এবং অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধি বেদজ্ঞান বিস্তারিণী মায়া যাঁর অপরা শক্তি (বাহ্যিক শক্তি), সেই সমগ্ৰ অস্তিত্বের অবলম্বনকারী বিশুদ্ধ সত্ত্ব রূপ আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 41

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

**মায়া হি যস্য জগদণ্ডশতানি সূতে — অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড উৎপাদনকারিণী মায়া যাঁর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অধ্যক্ষতায় মায়া চারাচর ‍বিশ্ব উৎপাদন করে এবং ভগবানের অধ্যক্ষতা হেতু জগৎ বারংবার উৎপন্ন ও লয় হয়। (গীতা ৯।১০)।

ময়া-অধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্
হেতুনা-অনেন কৌন্তেয় জগৎ-বিপরিবর্ততে॥৯/১০॥

অনুবাদ: হে কৌন্তেয়! আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা (পরিচালনায়) জড়া প্রকৃতি এই চারাচর ‍বিশ্ব সৃষ্টি করে। প্রকৃতির নিয়মে এই জগৎ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয় এবং ধ্বংস হয়।

শ্রীভগবানের কটাক্ষ দ্বারা চালিত হয়েই প্রকৃতি এই চরাচর জগৎ বারংবার প্রসব করে থাকে। প্রকৃতি তাঁর অধীনা বলে তাঁর অধ্যক্ষতায় সৃজনশক্তি লাভ করে, নতুবা জড়রূপা প্রকৃতি কোন কিছু সৃজন করতে পারে না। (বিশ্বনাথ চক্রবর্তী)

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত (আদি ৫।৬০) বলা হয়েছে —

কৃষ্ণ-শক্ত্যে প্রকৃতি হয় গৌণ কারণ।
অগ্নি শক্ত্যে লৌহ যৈছে করয়ে জারণ॥

লোহার যেমন দহন করার বা তাপ প্রদান করার শক্তি নেই, কিন্তু অগ্নির সংস্পর্শে তপ্ত হয়ে লোহা অন্য বস্তুকে দহন করতে ও তাপ দিতে সমর্থ হয়। জড়া প্রকৃতি লোহার মতো, কেননা শ্রীবিষ্ণুর সংস্পর্শ ছাড়া তার কার্য করার কোন স্বতন্ত্রতা নেই। শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ কারণোদকশায়ী বিষ্ণুর দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চারিত হলেই প্রকৃতি জড় সৃষ্টির উপাদানগুলি সরবরাহ করার যোগ্যতা অর্জন করে। জড়া প্রকৃতি স্বতন্ত্রভাবে জড় উপাদানগুলি সরবরাহ করতে পারে না। প্রকৃতি বা সমগ্র জড় শক্তি বা মায়া শ্রীভগবানের অধ্যক্ষতায় কার্য করে। সমস্ত জড় উপাদানগুলির উৎস হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু নাস্তিকেরা শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জড়া প্রকৃতিকেই সমস্ত উপাদানগুলির উৎস বলে ভ্রান্ত ধারণা করে।

ত্রৈগুণ্য-তদ্বিষয়-বেদ-বিতায়মানা— মায়ার সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণের কথা বেদে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত আছে। উৎপত্তি বা সৃষ্টি হয় রজোগুণে। উৎপত্তি হয়ে স্থিতি হয় রজো মিশ্রিত সত্ত্বগুণে। এবং বিনাশ হয় তমোগুণে।

সত্ত্ব অবলম্বি পরসত্ত্বং বিশুদ্ধ সত্ত্বং— মায়ার রজঃ ও তমঃ মিশ্রিত যে সত্ত্বগুণ, তার অবলম্বন হচ্ছে অমিশ্র সত্ত্ব বা শুদ্ধ সত্ত্ব, তা অপ্রাকৃত এবং নিত্য বর্তমান ধর্মই পরসত্ত্ব।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহম্ ভজামি— (সেই পরম বিশুদ্ধ চিৎশক্তি-বৃত্তিরূপ সত্ত্ব যাঁর, অর্থাৎ মায়া স্পর্শশূন্য বিশুদ্ধমূর্তি) সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪২ 

❝আনন্দ চিন্ময়-রসাত্মতয়া মনঃসু
যঃ প্রাণিনাং প্রতিফলন্ স্মরতাম্‌-উপেত্য।
লীলায়িতেন ভুবনানি জয়ত্যজস্রং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

আনন্দ—আনন্দময় ; চিন্ময়—জ্ঞানময় ; রস—রসের ; আত্মতয়া—বস্তুর অস্তিত্বের কারণে; মনঃসু—শুদ্ধ হৃদয়ে; যঃ—যিনিং; প্রাণিনাম্—জীবদের; প্রতিফলন্—প্রতিবিম্বরূপে প্রতিফলিত হয়ে; স্মরতাম্ উপেত্য—কন্দর্প স্বরূপতা প্রকাশ করে; লীলায়ি তেন—নিজ লীলা বিলাস দ্বারা; ভুবনানি—ব্রহ্মাণ্ড সমূহকে; জয়তি—জয় করছেন; অজস্রং—নিরন্তর; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে ; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: যিনি আনন্দ চিন্ময় রস স্বরূপে প্রাণীদের হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়ে নিজলীলা বিলাস দ্বারা নিরন্তর ভুবনবিজয়ী হন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 42

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

আনন্দ চিন্ময় রসাত্মতয়া মনঃসু— আনন্দময় চিন্ময় রস স্বরূপে বিভাবিত হৃদয় মধ্যে। উজ্জ্বল রসময় কৃষ্ণের নাম রূপ গুণ লীলা ধাম ভক্তহৃদয়ে স্ফুরিত হয়।

যঃ প্রাণিনাং প্রতিফলন স্মরতাম্ উপেত্য— যিনি মন্মথ মূর্তিরূপে স্মরণকারী প্রাণীদের হৃদয়ে প্রতিফলিত বা উদিত হন। মন্মথ বা মদনদেব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সমস্ত প্রাণীকে মোহিত করেন। সেই মদনদেব যাঁর রূপ দর্শন করে মূর্ছিত হয়ে পড়েন, তিনি হলেন মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ। সেই মোহন মূর্তি শ্রীকৃষ্ণের নাম রূপ গুণ লীলা যাঁরা স্মরণ করেন, তাঁরাই যথার্থ স্মরণকারী। তাঁদের চিত্তেই ধাম ও লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ উদিত হন।

লীলায়িতেন ভুবনানি জয়তি অজস্রং— শ্ৰীকৃষ্ণ নিজলীলা বিলাস দ্বারা ব্রহ্মাণ্ড সমূহকে নিরন্তর জয় করছেন। ভক্তহৃদয়েই ধাম ও লীলাময় শ্রীকৃষ্ণ উদিত হন। সেই উদিত লীলা জড়জগতসমূহের সমস্ত ঐশ্বর্য ও মাধুর্যকে সর্বতোভাবে জয় করে।

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (মধ্যলীলা ২৪) বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ সর্বাকর্ষক, সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক এবং মহারসের আধার। নিজ শক্তির দ্বারা তিনি অন্য সমস্ত রকমের আনন্দের কথা ভুলিয়ে দেন। তাঁর অলৌকিক শক্তিগুণে ও কৃপার প্রভাবে ভক্তের ভুক্তি, মুক্তি, সিদ্ধি সুখের বাসনা দূর হয়ে যায়। কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত আকর্ষণের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, তখন তার আর শাস্ত্রযুক্তি কিংবা সিদ্ধান্তের বিচার থাকে না। ঐশ্বর্য, মাধুর্য ও কারুণ্য আদি গুণে শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ পরিপূর্ণ। তাঁর ভক্তবৎসলতা এতই উদার যে তিনি ভক্তের কাছে নিজেকে পর্যন্ত সমর্পণ করেন।

তাঁর রূপ, রস, সৌরভ আদি বিভিন্ন গুণ বিভিন্ন ভক্তের মন আকর্ষণ করে। যেমন, তাঁর চরণপদ্মে অর্পিত তুলসী সৌরভ চতুষ্কুমারের মন হরণ করে। তাঁর লীলা শ্রবণ শুকদেব গোস্বামীর, তাঁর অঙ্গের রূপ ব্রজ গোপীদের, তাঁর রূপ গুণ কথা শ্রবণ রুক্মিনীদেবীর, তাঁর বংশীধ্বনি লক্ষ্মীদেবীর মন হরণ করে। শ্রীকৃষ্ণের কোনও গুণে যখন ভক্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, তখন চারি পুরুষার্থ অর্থাৎ ধর্ম অনুষ্ঠান, অর্থনৈতিক উন্নতি, ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন এবং মোক্ষ বা নির্বিশেষ ব্রহ্মে বিলীন হওয়া—এই সবই ভক্তের কাছে ফালতু বিষয় রূপে গণ্য হয় ।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহং ভজামি— আনন্দ চিন্ময় রস লীলাময় আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ৷


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৩ 

❝গোলোকনাম্নি নিজধাম্নি তলে চ তস্য
দেবী-মহেশ হরি-ধামসু তেষু তেষু।
তে তে প্রভাবনিচয়া বিহিতাশ্চ যেন
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

গোলোক নাম্নি—গোলোক নামক; নিজ ধান্নি—ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিজ ধাম; তলে চ তস্য—এবং সেই গোলোক ধামের তলদেশে; দেবী-মহেশ-হরি-ধামসু—দেবীধাম, মহেশধাম, হরি বা বৈকুণ্ঠ ধামে। তেষু তেষু—সেই সেই; তে তে—সেই সমস্ত; প্রভাব নিচয়াঃ—ধামোচিত শাস্ত্রাদি প্রসিদ্ধ প্রভাব সমূহ; বিহিতাঃ চ—এবং বিহিত হয়েছে; যেন—যাঁর দ্বারা; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: দেবীধাম, তার উপরে মহেশধাম, তার উপরে হরিধাম বা বৈকুণ্ঠ ধাম এবং সবার উপরে গোলোক নামক নিজধাম, যেই যেই ধামের সেই সেই প্রভাব সকল যিনি বিধান করেছেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 43(1)

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

গোলোক নাম্নি নিজ ধাম্নি —পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিজ ধাম গোলোক বৃন্দাবন । সমগ্র জগতকে চার ভাগ করলে তার একভাগ হল অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড জগৎ বা জড়জগৎ; এবং বাকী তিন ভাগ হল অনন্ত কোটি বৈকুণ্ঠ জগৎ বা চিন্ময় জগৎ। চিন্ময় আকাশের সর্বোচ্চলোক গোলোক। সমস্ত চিন্ময় লোকের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ধাম এই গোলোক ধাম। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কল্পবৃক্ষলতা পরিবেষ্টিত অসংখ্য কামধেনু, চিন্তামনি মন্দির সমন্বিত চিন্তামনি ধামে প্রেমপূর্ণচিত্ত অন্তরঙ্গগণ সঙ্গে মুরলীবদন মোহনসুন্দর গোপীজন বল্লভ বিরাজমান।

তলে চ তস্য দেবী-মহেশ-হরিধামসু — সেই গোলোক ধাম বৈকুণ্ঠ জগতের সবার উপরিভাগে অবস্থিত। আমরা আছি দেবী ধামে। অর্থাৎ ভগবানের বহিরঙ্গা মায়া পরিচালিত জড় ব্রহ্মাণ্ডে আমরা জড়জাগতিক সুখ-দুঃখ ভোগ করে চলেছি। সত্ত্ব, রজঃতমঃ—মায়ার এই ত্রিগুণে বদ্ধ হয়ে নানাবিধ কর্ম করে চলেছি। কর্মবন্ধনে জড়িয়ে জন্মান্তর চক্রে ঘুরপাকও খাচ্ছি। বেশীর ভাগ জীবই রজোগুণে প্রভাবিত হয়ে এই জগতে নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে। অনন্তকাল ধরে এরকম মিথ্যা পাগলামিতে জীব কর্মচক্রে ভ্রমণ করছে এবং নাকানি চুবানি খাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত না সে সাধু-মহাত্মার কৃপায় ভগবৎ-উন্মুখ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার এই নানাবিধ জড় দেহ ধারণ ও পরিত্যাগ করতে করতে মায়ার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-পূর্ণ চক্রে ঘুরপাক খেতে হবে।

দেবী ধামের উপরে মহেশ ধাম বা শিবধাম। শিব ভুক্তিদাতা, মুক্তিদাতা, ভক্তদের ভগবৎভক্তি বর্ধনকারী। তিনি মুক্তসকলের পূজনীয় এবং বৈষ্ণবগণের বল্লভ। সর্বপুরুষার্থ শিরোমনি যে ভগবদ্‌ভক্তি, সেই ভক্তিবিশেষ বর্ধন করে থাকেন শিব। শিবের একনিষ্ঠ ভক্তগণ শিবলোকে থেকে পরমানন্দ ভরে সর্বদা শিবকে অবলোকন করেন। শিব সর্বদা নৃত্যগীত কৌতুক বিস্তার করে তাঁর ভক্তদের সুখী করে থাকেন। শিব নিত্যই প্রেমভরে সহস্রবদন শেষমূর্তি ভগবানের পূজা করে থাকেন। হরিভক্তি কীর্তনকারী ভক্তকে শিব বৈকুণ্ঠ ধামে প্রেরণ করেন।

হরিধাম বা বৈকুণ্ঠলোকে লক্ষ্মী-নারায়ণ রয়েছেন। ভগবদ্‌ভক্তির নয় রকমের অঙ্গ—শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্চন, পাদসেবন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদনএই নববিধা ভক্তির মধ্যে যে কোনও অঙ্গের অনুষ্ঠান দ্বারাই বৈকুণ্ঠলোক লাভ করা যায়। বৈকুণ্ঠে ভগবৎনিষ্ঠ বহু ভক্ত আছেন। সেখানে কোনও বিঘ্ন নেই। যদিও কখনও কখনও ভগবান বলেন, ভক্তরা যেখানে আমার গুণকীর্তন করে আমি সেখানেই থাকি, যোগীহৃদয়ে বা বৈকুণ্ঠে থাকি না। তবুও, ভগবান বিচিত্র সৌন্দর্য ও গুণলীলা মাধুর্য বিস্তার করে বৈকুণ্ঠের মতো আর অন্যত্র সর্বদা দৃষ্ট হন না। হরিধামে সহজেই নিত্য প্রেমভক্তিরসিক সমজাতীয় ভক্তগণের সংসর্গ লাভ হয়ে থাকে। প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় সর্ব বৈভব প্রকট করতে সমর্থ। তবুও, সেখানে কারও মাৎসর্য প্রভৃতি দোষ নেই। পরন্তু, সৌহার্দ্য বিনয় ও সম্মানাদি হাজার হাজার স্বাভাবিক গুণ বর্তমান এবং ঐ গুণগুলি নিত্য ও সত্য। পরস্পর সমভাবেই ছোট বড় লক্ষ লক্ষ রূপে নিজ নিজ প্রভুর সেবা করছেন।

তেষু তেষু তে তে প্রভাব নিচয়া বিহিতাশ্চ যেন — সেই সেই ধামে, সেই সেই প্রভাব সমূহ শ্রীভগবানের দ্বারা বিহিত হয়েছে। যে সমস্ত জীবের যেরকম মনোভাব বা ভাবনাচিন্তা, সেই সমস্ত জীবের সেরকম মনোভাব বা ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী কোনও এক লোকে বাস করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন, ভগবানকে বাদ দিয়ে যারা নিজেরা ভোগ করে সুখী হতে চেয়েছিল, তাদের জন্যই জড় ব্রহ্মাণ্ড জগত তৈরি হয়েছে। সেই সমস্ত জীব মায়াদেবীর অধীনে জড় জগতে আবদ্ধ হয়েছে।

এখানে এসে তারা আবার আমিই ভোগ করব, আমিই কর্তৃত্ব করব, আমিই সবার উপর প্রভুত্ব করব এরকম বাহাদুরীও শুরু করেছে। অবশ্য মায়াদেবীর ত্রিশূলও ঘাড়ে পড়ছে। কেউ যদি মায়াদেবীর জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মজ্যোতিতে চুপচাপ মিশে যেতে চায়, সেই নির্বিশেষ ব্রহ্মবাদীকেও ভগবানের মায়াশক্তি ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বে ব্রহ্মজ্যোতিতে নিক্ষেপ করেন। যারা সত্য শিবভক্ত, তারা ভুক্তি মুক্তি সিদ্ধি লাভের জন্য চেষ্টা করছে, তারা শিবলোকে শিবের মতো শান্তভাবে থেকে সেগুলিও পেতে পারে। যারা লক্ষ্মী-নারায়ণের সম্ভ্রম সহকারে সেবা করতে চান তাঁরা বৈকুণ্ঠ ধামে ঐশ্বর্যময় হরিধামে বাস করবার সৌভাগ্য লাভ করবেন, যাঁরা মাধুর্যময় গোলোক ধামের প্রতি অর্থাৎ শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দের প্রতি আসক্ত তাঁরা গোলোকে উপনীত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন

শ্রীল সনাতন গোস্বামী গোলোকবাসী ভক্তগণেরও বিচিত্র মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। গোলোকে কোটি কোটি বালক, তরুণ ও বয়স্ক গোপগণ বাস করেন। পরন্তু, তাঁরা সকলেই মনে করেন যে, আমিই শ্রীকৃষ্ণের মহা প্রিয় । তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সেই মতো ব্যবহারও করে থাকেন। আর শ্রীকৃষ্ণও তাঁদের প্রতি সেইরকম বিশুদ্ধ ব্যবহার করে থাকেন। ওই সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে কারও কিছুমাত্র কপটতা নেই। তবুও, কখনও কারও মনে তৃপ্তি লাভ হয় না। বরং উত্তরোত্তর প্রেমতৃষ্ণা বর্ধিতই হয়ে থাকে। কারণ, সেই প্ৰেমতৃষ্ণা থেকে দৈন্যই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেখানে কোটি কোটি গোপী বাস করছেন। প্রত্যেকেরই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি পরা-প্রীতি বর্তমান। আর, শ্রীকৃষ্ণেরও তাঁদের প্রতি অনুরূপ কৃপা-আসক্তি বর্তমান। যদিও এই সমস্ত গোপী নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে পরম প্রেম বিশেষের সঙ্গে ক্রীড়া সুখ পরম্পরা সর্বদা অনুভব করে থাকেন, তবুও প্রেম স্বভাবে তাঁরা প্রত্যেকেই মনে করে থাকেন যে, শ্রীকৃষ্ণে আমার প্রেম নেই। এইজন্য, প্রত্যেকেই চিন্তা করে থাকেন, আমার এমন কি সৌভাগ্য হবে যে, শ্রীকৃষ্ণ আমায় অধমা দাসী বলে গণনা করবেন?

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি — বিভিন্ন ধামে বিভিন্ন প্রভাব বিধানকারী সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৪ 

❝সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়সাধন-শক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপম্‌-অপি যস্য চ চেষ্টতে সা
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-সাধনশক্তি—সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সাধনকারিনী শক্তি; একা—একমাত্র; ছায়া ইব—ছায়ার মতো; যস্য—যাঁর; ভবানানি—ভুবন সমূহকে; বিভর্তি—পোষণ করছেন; দুর্গা—দুর্গাদেবী; ইচ্ছা-অনুরূপম্‌-অপি—ইচ্ছার অনুরূপেই; যস্য—যাঁর; —এবং; চেষ্টতে—আচরণ করে থাকেন; সা—সেই দুর্গাদেবী; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: স্বরূপশক্তি বা চিন্ময়শক্তির ছায়া-স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের (জড় জগতের) সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-সাধিনী মায়া-শক্তিই ভুবন-পূজিতা ‘দূর্গা’, তিনি যাঁহার ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 44

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়া-স্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের (জগৎ-সংসারের; জড় জগতের) সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সাধিনী মায়াশক্তিই ভূবনপূজিতা দুর্গা। তিনি যাঁর ইচ্ছানুরূপ চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি॥

শ্রীব্রহ্মা দেবীধামের অন্তর্ভূক্ত সত্যলোকে থেকে গোলোক ধামের শ্রীগোবিন্দের স্তব করছেন। দেবীধাম চৌদ্দ ভূবন সমন্বিত। এই ধামের অধিষ্ঠাত্রী হলেন দুর্গাদেবী। চিজ্জগতে যে দুর্গাদেবী আছেন–তিনি চিন্ময়ী কৃষ্ণদাসী। সেই দুর্গাদেবীর ছায়ারূপিনী (অর্থাৎ ছায়া-দুর্গা) হচ্ছেন এই জড় জগতে পূজিতা দুর্গাদেবী। পরমেশ্বর ভগবান আদি-পুরুষ গোবিন্দের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গাদেবীশম্ভু (শিব) একসঙ্গে কাজ করেন।

এই শম্ভু ও কৃষ্ণ অভেদ হলেও তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে; তা হচ্ছে শম্ভুর ঈশ্বরতা আদিপুরুষ গোবিন্দের ঈশ্বরতার অধীন। একটি উদাহরণের সাহায্যে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তা তাৎপর্য্য করেছেন, তিনি বলেছেন কৃষ্ণকে যদি দুধের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে শম্ভুকে দধির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই শম্ভু হচ্ছেন পরম বৈষ্ণব; তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে —বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভু।”

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর উল্লেখ করেছেন, দুর্গা দশকর্মরূপ দশভুজা যুক্তা। বীর প্রতাপে অবস্থিত বলে সিংহবাহিনী। পাপ দমনকারিনী মহিষাসুর মর্দিনী। শোভা ও সিদ্ধিরূপ দুই সন্তান যুক্তা বলে কার্তিক ও গণেশের জননী। জড়-ঐশ্বর্য ও জড়বিদ্যা সঙ্গিনী রূপে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মধ্যবর্তিনী। পাপ দমনে বহু রকম বেদোক্ত ধর্ম রূপ বিংশতি অস্ত্র ধারিণী। কাল শোভা বিশিষ্টা বলে সর্পশোভিনী। দুর্গা দুর্গবিশিষ্টা। ‘দুর্গ’ শব্দের অর্থ ‘কারাগার’। যে সমস্ত জীব কৃষ্ণ-বহির্মুখ, তারাই এই কারাগারে বা দুর্গে অবরুদ্ধ হয়। এটাই দুর্গার দুর্গ। এখানে অবরুদ্ধ জীবের দণ্ড হচ্ছে কর্মচক্র। এই সব বহির্মুখ জীবদের প্রতি এরকম শোধন প্রণালী বিশিষ্ট কার্যই গোবিন্দের ইচ্ছা-অনুরূপ কর্ম। দুর্গাদেবী সেই কাৰ্য নিয়ত সম্পাদন করছেন।

সৌভাগ্যক্রমে সাধুসঙ্গে অর্থাৎ কৃষ্ণ-অন্তর্মুখ জনের সঙ্গে জীবদের যখন সেই বহির্মুখতা দূর হয় এবং অন্তর্মুখিতা উদয় হয়, তখন আবার গোবিন্দের ইচ্ছাক্রমে দুর্গাই সেই সেই জীবের মুক্তির কারণ হয়। সুতরাং অন্তর্মুখ ভাব দেখিয়ে কারাকর্ত্রী দুর্গাকে পরিতুষ্ট করে তাঁর নিষ্কপট কৃপালাভ করতে চেষ্টা করা উচিত। সেই দুর্গাই দশ-মহাবিদ্যারূপে প্রাপঞ্চিক জগতে কৃষ্ণবহির্মুখ জীবের জন্য “জড়ীয় আধ্যাত্মিক-লীলা” বিস্তার করেন।

জীব চিৎকণা স্বরূপ। তার কৃষ্ণ-বহির্মুখতা দোষ হলেই মায়িক জগতে মায়ার আকর্ষণ-শক্তিদ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। বিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্র দুর্গা তাকে কয়েদীর পোশাকের মতো পঞ্চভূত (মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ) ও পঞ্চতন্মাত্র (রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ) এবং একাদশ ইন্দ্রিয় (পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়) সংযুক্ত একটি স্থূল দেহে আবদ্ধ করে কর্মচক্রে নিক্ষেপ করেন। জীব তাতে ঘূর্ণায়মান হয়ে সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-নরকাদি ভোগ করে ।

এছাড়া স্থূল দেহের ভেতরে মন, বুদ্ধি অহংকার রূপ একটি লিঙ্গ দেহ যা মায়াদেবী জীবকে দেন। জীব এক স্থূল দেহ ত্যাগ করে সেই সূক্ষ্মবৎ লিঙ্গদেহে অন্য স্থূল দেহকে আশ্রয় করে – মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত জীবের অবিদ্যা, দুর্বাসনাময় (যে ইচ্ছা পূরণ করা যায় না, অত্যুগ্র বাসনা) লিঙ্গদেহ দূর হয় না। লিঙ্গদেহ দূর হলে বিরজা নদীতে স্নান করে জীব হরিধামে গমন করে। এই ধরণের সমস্ত কার্য দুর্গা গোবিন্দের ইচ্ছাক্রমে করে থাকেন।

সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়- সাধনশক্তিঃ একা — সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় সাধনকারিনী হচ্ছেন শ্রীভগবানের মায়াশক্তিই। চিন্ময় জগত নিত্য। অবিনাশী। আনন্দময়। সেই জগতের সৃষ্টি ধ্বংস নেই। জন্ম-মৃত্যু নেই। তা নিত্য নতুন অনুভব যুক্ত। নিত্য স্থিতি সম্পন্ন এবং নিত্য আনন্দময়। সেই জগতের ভগবৎলীলা বিস্তারকারিনী হলেন স্বয়ং  যোগমায়া।

ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা — শ্রীভগবানের স্বরূপশক্তি বা চিন্ময়ী শক্তি বা যোগমায়ার ছায়া স্বরূপিনী দুর্গা হচ্ছেন এই জড় জগতের অধিষ্ঠাত্রী। তিনি সমগ্র জড় ব্রহ্মাণ্ডকে পালন করেন।

ইচ্ছানুরূপম্‌-অপি যস্য চ চেষ্টতে সা — এই দুর্গা বা মহামায়া শ্রীভগবানের ইচ্ছা অনুরূপ আচরণ বা যত্ন করে থাকেন। শ্রীভগবানের ইচ্ছা বলতে বোঝায় সমস্ত জীব স্বতন্ত্রভাবে প্রীতি সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধে যুক্ত থাকবে। তাহলে জীবও আনন্দময় থাকবে। কিন্তু জীব স্বতন্ত্রতার বশে ভোগী হতে চাইলে তাদের জন্য মায়া রচিত এই কারাগাররূপ জড়জগতে জীব বদ্ধভাবে বাস করবে, এটা ভগবানের ব্যবস্থাপনা। শাস্ত্র মতে বাস্তবিকই এই জড়জগতটি হলদুঃখালয়ম্ অশাশ্বতম্দুঃখালয়ম্ = দুঃখময় আলয় এবং অশাশ্বতম্ = অনিত্য অস্থায়ী। এই জগতটা হল জেলখানা স্বরূপ, অর্থাৎ এটি দুঃখময় আলয় এবং সুখ অনিত্য অস্থায়ী। ভগবদবিমুখ হওয়ার জন্য আমরা এই দুঃখময় জগতে অধঃপতিত হয়েছি বলে বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। রাজদ্রোহী প্রজারা জেলখানায় স্থান পায়। জেলখানা শাস্তি, উদ্বেগ ও কষ্ট পাওয়ার জন্যই তৈরী হয়েছে। সরকার জেলখানা তৈরি করেছে বলে সরকার ভালো নয়—এরূপ ভাবাটাই বোকামি। জেলখানা তৈরি করাটা কোনও রাজার দোষরূপে গণ্য করা উচিত নয়।

যেমন কৃত কর্মের দণ্ডভোগের মেয়াদ শেষ হলে জেলখানা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ থাকে, তেমনি পুণরায় অপরাধমূলক কর্ম করলে পুনরায় জেলখানাতেই গতি হয়।

কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি বারে বারে জড়-জাগতিক দুঃখ কষ্ট লাভ করতে চাইবেন না, তাই তাঁরা ভগবদভক্তি অনুশীলন করে এই জেলখানা স্বরূপ দুঃখময় জগৎ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পরমানন্দময় ভগবদ্ধামে উন্নীত হওয়ার জন্য সযত্ন প্রয়াস করেন।

এই বদ্ধ জীব যখন এই দুঃখময় জগতে ভগবানের শরণাগত থাকবে, তখন তার শুদ্ধ মানসিকতা দেখে ভগবান তাকে কৃপা করে তাঁর সমীপে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেন, সেই সময় ভগবানের ইচ্ছা বুঝে মায়াশক্তি সেই জীবের বন্ধন দশা মুক্ত করে দেন ৷ যদি জীব ভগবানের প্রতি বিমুখ মানসিকতা নিয়ে এই জড় জগত ভোগ করতে চায়, আধিপত্য করতে চায়, তখন ভগবানও সেই জীবকে সেই সুযোগ দেওয়ার ইচ্ছা করেন, মায়াদেবী তখন জড়জগতে বিভিন্ন যোনী ভ্রমণ করিয়ে এই দুঃখময় জগতে থাকার মেয়াদ বৃদ্ধি করেন।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহম্ ভজামি — জড় জগতের অধিষ্ঠাত্রী দুর্গা যাঁর ইচ্ছানুরূপ আচরণ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৫ 

❝ক্ষীরং যথা দধি বিকার-বিশেষ-যোগাৎ
সঞ্জায়তে ন হি ততঃ পৃথগস্তি হেতোঃ।
যঃ সম্‌ভুতাম্‌ অপি তথা সমুপৈতি কার্যাৎ-
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

ক্ষীরং যথা (দুধ যেভাবে) বিকারবিশেষযোগাৎ (অম্ল বা অ্যাসিডের সংযোগে বিকারপ্রাপ্তি হওয়া) দধি সঞ্জায়তে (দইতে পরিণত হয়), হি (তবুও) ততঃ হেতোঃ (সেই দুধ থেকে উৎপন্ন হলেও) পৃথক্-ন-অস্তি (পৃথক্ বস্তু নয়), তথা (সেইরূপ) যঃ (যিনি) কার্যাৎ (কার্যবশতঃ) শম্ভুতাম্ অপি (শম্ভু রূপ) উপৈতি (ধারণ করেন), তম্ (সেই) আদিপুরুষং (আদিপুরুষ) গোবিন্দম্ (গোবিন্দকে) অহং (আমি) ভজামি (ভজনা করছি)।

অনুবাদ: দুধ যেভাবে অম্ল বা অ্যাসিডের সংযোগে বিকারপ্রাপ্তি হয়ে দইতে পরিণত হয়, তবুও সেই দুধ থেকে উৎপন্ন হলেও তা দুধ থেকে পৃথক্ বস্তু নয়, সেইরূপ যিনি কার্যবশতঃ শম্ভু রূপ ধারণ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 45

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

(মহেশ-ধামের অধিষ্ঠাতা শম্ভুর (শিবের) স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে।)

শম্ভু—কৃষ্ণ থেকে পৃথক্ অন্য এক ‘ঈশ্বর’ নন। যাদের মধ্যে সেইরকম ভেদ-বুদ্ধি রয়েছে, তারা নিঃসন্দেহে—ভগবানের কাছে অপরাধী। শম্ভুর ঈশ্বরতা গোবিন্দের ঈশ্বরতার অধীন। সুতরাং তাঁরা মূলত অভেদ-তত্ত্ব। অভেদ-তত্ত্বের লক্ষণ এইরকম যে, দুধ যেমন অম্ল বা অ্যাসিডের সংযোগে বিকারপ্রাপ্তি হয়ে দইতে পরিণত হয়, সেইরকম বিকারবিশেষ যোগে ঈশ্বর পৃথক্-স্বরূপ ধারণ করেও ‘পরতন্ত্র’; অর্থাৎ সে স্বরূপের স্বতন্ত্রতা নেই। ভগবানের মুখ্য শক্তিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়—অন্তরঙ্গা (চিৎশক্তি), বহিরঙ্গা (মায়াশক্তি) ও তটস্থা (ভগবানের জীব-সৃষ্টিকারী শক্তি, জীব-শক্তি)

🌸তাঁর অন্তরঙ্গা বা চিৎশক্তির প্রভাবে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত বৈকুণ্ঠলোক প্রকাশ করেন। জড় সৃষ্টির লয় হয়ে গেলেও সেই বৈকুণ্ঠলোকসমূহ চিরকালই বিরাজমান থাকে।

🌸তাঁর তটস্থা বা জীব শক্তির প্রভাবে ভগবান তাঁর বিভিন্ন অংশ জীবরূপে নিজেকে বিস্তার করেন, ঠিক যেভাবে সূর্য তার চতুর্দিকে তার কিরণ বিতরণ করে।

🌸তাঁর বহিরঙ্গা বা মায়া শক্তির প্রভাবে ভগবান এই জড় জগতের প্রকাশ করেন, ঠিক যেভাবে সূর্যরশ্মি কুয়াশা সৃষ্টি করে। এই জড় সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য বৈকুণ্ঠধামের বিকৃত প্রতিফলন।

মায়ার তমোগুণ, তটস্থশক্তির স্বল্পতাগুণ এবং চিন্ময়শক্তির স্বল্প হ্লাদিনীমিশ্রিত সম্বিদ্‌গুণ বিমিশ্রিত হয়ে একটি বিকারবিশেষ রূপ ধারণ করেন, তিনি হলেন ‘সদাশিব’ এবং সদাশিবের কপাল থেকে রুদ্রদেব (সংহার কর্তা) প্রকট হন। সদাশিবের জন্ম-মৃত্যু নেই, তবে রুদ্রদেবের জন্ম-মৃত্যু রয়েছে। 

সৃষ্টিকার্যে দ্রব্যব্যূহময় উপাদান, স্থিতিকার্যে কোন কোন অসুরের নাশ এবং সংহারকার্যে সমস্ত ক্রিয়া-সম্পাদনার্থ স্বাংশভাবাপন্ন বিভিন্নাংশরূপ শম্ভু-স্বরূপে গোবিন্দ ‘গুণাবতার’ হন। “বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভুঃ” — ভাগবতবচনের তাৎপর্য এই যে, সেই শম্ভু স্বীয়-কাল-শক্তিদ্বারা গোবিন্দের ইচ্ছানুরূপ দুর্গাদেবীর সাথে যুক্ত হয়ে কার্যসম্পন্ন করেন। ভগবান তাঁর দৃষ্টিশক্তির দ্বারা প্রকৃতির গর্ভে জীবাত্মাদের প্রেরন করেন এবং জীবাত্মারা তাদের কর্মফল অনুসারে ব্রহ্মার তত্ত্বাবধানে জীবদেহ লাভ করে। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৬৪ গুণ পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে, যেখানে শম্ভুতে অর্থাৎ শিবের মধ্যে মোট ৫৫ গুণ বিদ্যমান যার মধ্যে জীবের পঞ্চাশগুণ প্রভূতরূপে (পর্যাপ্ত পরিমানে) এবং জীবের অপ্রাপ্ত আরও পাঁচটি মহাগুণ আংশিকরূপে আছে। সেই কারণে শম্ভুকে ‘জীব’ বলা যায় না; তিনি—‘ঈশ্বর’ তবুও ‘বিভিন্নাংশগত’। তাই শিব না বিষ্ণুতত্ত্ব, না জীবতত্ত্ব, না কৃষ্ণের স্বাংশতত্ত্ব বরং তিনি বিভিন্নাংশগততত্ত্ব। দুধ রূপান্তরিত দই হয়, কিন্তু দই থেকে দুধ রূপান্তরিত হয় না, সেইরকম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কার্যবশতঃ নিজেকে শিব রূপে রূপান্তরিত (প্রকাশ) করতে পারেন কিন্তু শিব কখনও নিজেকে কৃষ্ণরূপে প্রকাশ করতে পারেন না। 


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৬ 

দীপার্চিরেব হি দশান্তরম্‌ অভ্যুপেত্য
দীপায়তে বিবৃত-হেতু-সমান-ধর্মা ৷
যস্তাদৃগেব হি চ বিষ্ণুতয়া বিভাতি
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

দীপার্চিঃ এব হি—একটি দীপশিখাই যেরকম; দশান্তরম্—দশান্তর অর্থাৎ অন্য একটি প্রদীপকে (সলতেকে); অভ্যুপেত্য—প্রাপ্ত হয়ে; দীপায়তে—অপর একটি প্রদীপ রূপে প্রকাশ পায়; বিবৃত হেতু—বিস্তার কারণে; সমান ধর্মা—সমান ধর্ম হয়; যঃ—যিনি; তাদৃক্ এব হি—সেইরকমই মূল দীপের মতো; —এবং; বিষ্ণুতয়া—অন্য দীপের মতো বিষ্ণুরূপে; বিভাতি—প্রকাশিত হন; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্ – আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহং – আমি; ভজামি—ভজন করি।

অনুবাদ: এক মূল প্রদীপের শিখা যেমন অন্য প্রদীপকে প্রজ্বলিত করলে সেটি মূল দীপের মতোই আলাদা জ্যোতি বিকাশ করে থাকে, সেই রকমই মূল দীপ স্বরূপ যিনি অন্য সব দীপরূপ বিষ্ণুরূপেও প্রকাশিত হন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 46

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

এখানে হরিধামের অধিষ্ঠাতা ‘হরি’, ‘নারায়ণ’, ‘বিষ্ণু’ ইত্যাদি নামে শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ তত্ত্বের বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোকে ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর তত্ত্ব দিয়ে স্বাংশ বিলাস (শ্রীকৃষ্ণের অংশ অবতার) নিরূপিত (আরাধনা) হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিলাস মূর্তি নারায়ণ, তাঁর অংশ মহাবিষ্ণু (কারনোদকশায়ী বিষ্ণু), তাঁর অংশ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু, ও তাঁর অংশ ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু (পরমাত্মা)। সত্ত্ব গুণাবতার বিষ্ণুতত্ত্ব কিন্তু মায়িক গুণাদি মিশ্র শম্ভূতত্ত্ব থেকে আলাদা ৷ গোবিন্দ যেমন শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপ তেমনি তাঁর থেকে প্রকাশিত বিষ্ণুও গোবিন্দের সঙ্গে সমান ধর্ম বিশিষ্ট অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপ। ত্রিগুণময়ী মায়াতে যে স্বত্ত্বগুণ আছে, তা রজো গুণ ও তমো গুণ দিয়ে মিশ্রিত থাকায় অশুদ্ধ-স্বত্ত্ব। ব্রহ্মা–রজোগুণোদিত স্বাংশ প্রভাব বিশিষ্ট বিভিন্নাংশ, শিব—তমোগুণোদিত স্বাংশ প্রভাব বিশিষ্ট বিভিন্নাংশ। মায়াতে সত্ত্বগুণ রজো-তমো মিশ্র হলেও তার মধ্যে যে বিশুদ্ধ-সত্ত্বাংশ আছে, গুণাবতার বিষ্ণু তাতেই আবির্ভূত হন। সুতরাং বিষ্ণু হচ্ছেন পূর্ণ স্বাংশবিলাস ও মহেশ্বর তত্ত্ব। তিনি মায়াযুক্ত নন। তিনি মায়ার প্রভু।

মহাদীপ গোবিন্দের বিলাসমূর্তি থেকেই মহাবিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী, ক্ষীরোদকশায়ী এবং রামচন্দ্র প্রভৃতি স্বাংশ অবতারগণ আলাদা আলাদা বাতি বা দীপ রূপে গোবিন্দের চিৎশক্তি দ্বারা বিরাজমান ।

দীপার্চিরেব হি দশান্তরম্‌ অভ্যুপেত্য — একটি মূল প্রদীপ শিখা যেরকম অপর প্রদীপের সলতেকে উদ্দীপ্ত করে। শ্রীভগবান গোবিন্দ সেই রকম মূল অবতারী একজন হয়েও অন্যান্য অংশ বা অবতার দ্বারা ভগবৎধর্ম প্রকাশ করেন।

দীপায়তে বিবৃত হেতু সমান ধর্মা — প্রজ্বলিত সেই অপর প্রদীপের জ্যোতি (প্রকাশ) কার্যে মূল দীপের মতো পৃথক জ্যোতি বিকাশ করে থাকে। অংশ অবতারগণও শ্রীভগবানের মতো পৃথক ব্যক্তিরূপে ব্যক্ত হন।

যস্তাদৃগেব হি চ বিষ্ণুতয়া বিভাতি — অন্য দীপরূপ বিষ্ণু রূপে বিস্তারিত হয়ে প্রকাশিত হন তবে সেই মূল দীপরূপ অবতারী স্বরূপ ভগবান শ্রীগোবিন্দ ।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহং ভজামি — নানা বিষ্ণু-অবতার রূপে পৃথক পৃথক রূপে সমান ধৰ্ম প্ৰকাশ করে আদি পুরুষ শ্রীগোবিন্দকে আমি ভজন করি ।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৭ 

❝যঃ কারণার্ণব-জলে ভজতি স্ম যোগ-
নিদ্রাম্‌ অনন্ত-জগদণ্ড-সরোমকুপঃ।
আধার-শক্তিম্‌ অবলম্ব্য পরাং স্বমূর্তিং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যঃ—যিনি; কারণ-অর্ণব-জলে—কারণ সমুদ্র জলে; ভজতি স্ম—উপভোগ করেন অর্থাৎ যোগানিদ্রায় শয়ন করেন; যোগনিদ্রাম্—যোগনিদ্রাকে অর্থাৎ স্বরূপশক্তিকে; অনন্ত-জগদণ্ডসরোমকূপঃ—যাঁর রোমকূপ সমূহে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড বিদ্যমান; আধার-শক্তিম্—আধার শক্তি স্বরূপ; অবলম্ব্য—আশ্রয় করে বা অবলম্বন পূর্বক; পরাং—শ্রেষ্ঠ; স্ব-মূর্তিং—অনন্ত নামক নিজের মূর্তি বিশেষকে;  গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্ – আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহং – আমি; ভজামি—ভজন করি।

অনুবাদ: আধার শক্তিময়ী অনন্তশেষ নামক শ্রেষ্ঠ স্বমূর্তি অবলম্বন করে যিনি নিজ রোমকূপে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে কারণ সমুদ্রে শুয়ে যোগনিদ্রা সম্ভোগ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 47

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যঃ কারণার্ণব জলে ভজতি স্ম যোগনিদ্রাম — যিনি কারণ সমুদ্র জলে যোগনিদ্রায় রয়েছেন। এই কারণ সমুদ্র হল ব্রহ্মাণ্ড জগতের বাইরে চিন্ময় জলপূর্ণ সমুদ্র। এই কারণ সমুদ্রে জড় ব্রহ্মাণ্ডগুলি ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। কারণ-সমুদ্রে শায়িত মহাবিষ্ণু কারণোদকশায়ী বিষ্ণু নামেও আখ্যাত ৷ কারণ সমুদ্রের জলে মহাবিষ্ণু যে নিদ্রিত অবস্থায় রয়েছেন, সেই নিদ্রা আমাদের মতো বদ্ধ জীবের আলস্য, ক্লান্তি অপনোদন বা দিক বিদিক্ জ্ঞান শূন্য নিদ্রা নয়। ভগবানের নিদ্রাকে যোগনিদ্রা বলা হয় । ভগবান আনন্দে নিদ্রিত হন যাকে স্বরূপানন্দ সমাধি বলা হয়। আমরা শুয়ে ঘুমিয়ে ঝিমিয়ে থাকলে আমাদের কর্মময় জীবনে অনেক গাফিলতি দেখা যায়। আমাদের অধিক নিদ্রা আমাদের একটা দোষ বা আলসেমি কিংবা তমোগুণের বিষয়। নিদ্রা আমাদের বোধ হরণ করে। কিন্তু শ্রীবিষ্ণু সুন্দরভাবে যখন নিদ্রিত থাকেন তখন তাঁর সৃষ্টি ও পালন কার্য সুন্দরভাবে চলতে থাকে ।

অনন্ত জগদণ্ড সরোমকূপ — অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যাঁর রোমকূপ সমূহে রয়েছে। কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড সূক্ষ্ম সূক্ষ্মভাবে মহাবিষ্ণুর শরীরের লোমকূপগুলিতে বিরাজ করছে। যেমনটি বাষ্পকণা রূপে আমাদের শরীরের লোমকূপ থেকে ঘাম বার হয়। ব্রহ্মাণ্ডগুলি সূক্ষ্ম থেকে ক্রমশ স্থূল রূপ প্রাপ্ত হয়। প্রথমে আকাশ, তারপর বাতাস, তারপর অগ্নি, তারপর জল, তারপর মাটি রূপ প্রাপ্ত হয় ৷

আধারশক্তিম্ অবলম্ব্য পরাং স্বমূর্তিং — আধারশক্তি স্বরূপ অনন্ত শেষ নামক শ্রেষ্ঠ স্বমূর্তিকে অবলম্বন পূর্বক মহাবিষ্ণু অনন্তদেবের কোলে শুয়ে থাকেন। অনন্তদেব হচ্ছেন ভগবানের শয্যারূপ। তিনি ভগবানের সেবক তত্ত্ব।

এই শ্লোকে মহাবিষ্ণুর শয্যারূপ অনন্তের তত্ত্ব বলা হয়েছে। মহাবিষ্ণু যে অনন্ত শয্যায় শয়ন করেন, সেই অনন্ত হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের দাস-তত্ত্ব রূপ ‘শেষ’ নামক অবতার বিশেষ।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহং ভজামি — সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি, যিনি কারণসমুদ্রে মহাবিষ্ণুরূপে শেষশয্যায় শুয়ে যোগ নিদ্রা সম্ভোগ করেন, যাঁর রোমকূপে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড বিদ্যমান ।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৮ 

❝যস্যৈক-নিশ্বসিত-কালম্‌-অথ-অবলম্ব্য
জীবন্তি লোম-বিলোজা জগদণ্ডনাথাঃ।
বিষ্ণূরর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষো
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যস্য—যাঁর; এক—এক; নিশ্বসিত—নিশ্বাসের ; কালম্—কাল; অথ—এইভাবে; অবলম্ব্য—অবলম্বন করে; জীবন্তি—জীবন ধারণ করে; লোম-বিলজাঃ—লোমকূপ থেকে জাত; জগৎ-অণ্ড-নাথাঃ—ব্রহ্মাণ্ডের পতিগণ (ব্রহ্মাগণ); বিষ্ণূরর্মহান্—হা বিষ্ণু; সঃ—সেই ; ইহ—এখানে; যস্য— যাঁর; কলা-বিশেষঃ—অংশের অংশ বিশেষ; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্ – আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহং – আমি; ভজামি—ভজন করি।

অনুবাদ: সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পতিগণ (ব্রহ্মাগণ) মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর এক নিঃশ্বাসকাল পর্যন্ত জীবিত থাকেন, সেই মহাবিষ্ণু যাঁর অংশের অংশ, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 48

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যস্যৈক-নিশ্বসিত-কালম্‌-অথ-অবলম্ব্য — যাঁর (মহাবিষ্ণুর) একটি নিঃশ্বাস কাল পর্যন্ত অবলম্বন করে থাকা (জীবিত থাকা)। মহাবিষ্ণু কারণ সমুদ্রে শায়িত আছেন। ব্রহ্মাণ্ডজগৎ ও বৈকুণ্ঠজগতের মাঝখানে কারণ সমুদ্র। মহাবিষ্ণু একটি শ্বাস ছাড়লেন। তখন ব্রহ্মাণ্ডের চিন্ময় বীজ তাঁর লোমকূপ থেকে নির্গত হলো। তাঁর দেহ নির্গত চিন্ময় পরমাণু থেকে এক একটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হলো। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বর্ণনা আছে —

হঁহো মহৎস্রষ্টা পুরুষ—‘মহাবিষ্ণু’নাম।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর লোমকূপে ধাম॥

মহৎ স্রষ্টা মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড প্রকাশিত হয়।

গবাক্ষে উড়িয়া যৈছে রেণু আসে যায় ।
পুরুষ-নিঃশ্বাস-সহ ব্রহ্মাণ্ড বাহিরায় ॥
পুনরপি নিঃশ্বাস সহ যায় অভ্যন্তর ।
অনন্ত ঐশ্বর্য তাঁর, সব—মায়া-পার ॥

             ━ (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত মধ্য ২০। ২৮০)

জানালার ভেতর দিয়ে যেমন ধূলি উড়ে যাওয়া-আসা করে, তেমনই মহাবিষ্ণুর নিঃশ্বাসের সঙ্গে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড নির্গত হয় এবং পুনরায় তাঁর শ্বাস গ্রহণের সঙ্গে সেই ব্রহ্মাণ্ডগুলোও তাঁর দেহের মধ্যে প্রবেশ করে। মহাবিষ্ণুর অনন্ত ঐশ্বর্য জড় ধারণার অতীত।

জীবন্তি লোম-বিলজা জগদণ্ড-নাথাঃ — মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে জাত ব্ৰহ্মাণ্ডপতিগণ জন্মগ্রহণ করে এবং তাঁর এক নিঃশ্বাস কাল পর্যন্ত জীবিত থাকেন। অর্থাৎ ব্রহ্মা সহ ব্রহ্মাণ্ড সমূহের স্থিতিকাল হচ্ছে মহাবিষ্ণুর একটি শ্বাস ছাড়ার সময়টুকু মাত্র। সৃষ্টি এবং ব্রহ্মাণ্ডপতিগণ মহাবিষ্ণুর একটি শ্বাস পর্যন্ত জীবিত থাকে। মহাবিষ্ণু শ্বাস গ্রহণ করা মাত্রই ব্রহ্মাণ্ডসমূহ মহাবিষ্ণুর শরীরে প্রবিষ্ট হয়।

বিষ্ণূরর্মহান্ স ইহ যস্য কলাবিশেষঃ—সেই মহাবিষ্ণু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের অংশের অংশ। শ্রীকৃষ্ণের অংশ শ্রীবলরাম। শ্রীবলরামের অংশ মহাবিষ্ণু। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে—

অংশের অংশ যেই,‘কলা’তার নাম।
গোবিন্দের প্রতিমূর্তি শ্রীবলরাম॥
তাঁর এক স্বরূপ—শ্রীমহাসঙ্কর্ষণ।
তাঁর অংশ‘পুরুষ’হয় কলাতে গণন॥

             ━ (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত আদি ৫। ৭৪)

শ্রীগোবিন্দের প্রতিমূর্তি বলরাম। তাঁর একটি স্বরূপ মহাসঙ্কর্ষণ। মহাসঙ্কর্ষণের একটি অংশ পুরুষাবতার মহাবিষ্ণু। তাঁকেই কলা বা গোবিন্দের অংশের অংশ বলে গণনা করা হয় ।

গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি — মহাবিষ্ণু যাঁর অংশের অংশ বা কলাবিশেষ, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

৮৬৪ কোটি বছরে ব্রহ্মার ২৪ ঘণ্টা বা একটি দিন (ব্রহ্মার একদিনকে বলা হয় কল্প)। এইরকম ৩০ দিনে ব্রহ্মার একমাস (অর্থাৎ ত্রিশটি কল্প) । এইরকম ১২ মাসে ব্রহ্মার একবছর। এরকমভাবে ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল ১০০ বছর ( ব্রহ্মার আয়ুষ্কালকে বলা হয় বিকল্প)। আমাদের পৃথিবীর মনুষ্যগণের হিসাবে ব্রহ্মার আয়ুষ্কালটি হলো ৩১১,০৪০,০০০,০০০,০০০ বছর (৩১১.০৪ ট্রিলিয়ন বছর)। এতগুলো বছর মহাবিষ্ণুর একটি শ্বাসকাল মাত্র অর্থাৎ মহাবিষ্ণুর নিঃশ্বাসের ফলে একেকটি বিকল্প সম্ভব হয়, তাকে বলা হয় মহাকল্প। অনন্ত কাল প্রবাহের কাছে এভাবে ব্রহ্মা বা ব্রহ্মাণ্ডের আয়ুষ্কাল বুদবুদের মতো অত্যন্ত ক্ষণিক। এইভাবে মহাকল্প, বিকল্প এবং কল্পের এক নিয়মিত এবং ধারাবাহিক চক্র রয়েছে।

শুকদেব গোস্বামী স্কন্দ পুরানের প্রভাস খন্ডে ব্রহ্মার  ত্রিশটি কল্পের বর্ননা করেছেন—— ১) শ্বেতকল্প ২) নীলমোহিত ৩) বামদেব ৪) গাথান্তর ৫) রৌরব ৬) প্রান ৭) বৃহৎকল্প ৮) কন্দর্প ৯) সদ্যোথ ১০) ঈশান ১১) ধ্যান ১২) সারস্বত ১৩) উদান ১৪) গরুড় ১৫) কৌর্ম ১৬) নারসিংহ ১৭)সমাধি ১৮) আগ্নেয় ১৯) বিষ্ণুজ ২০) সৌর ২১) সোমকল্প ২২) ভাবন ২৩) সুপুম ২৪) বৈকুণ্ঠ ২৫) অর্চিষ ২৬) বলীকল্প ২৭) বৈরাজ ২৮) গৌরীকল্প ২৯) মাহেশ্বর ৩০) পৈতৃকল্প

সত্যযুগ=(৪,৩২,০০০ x ৪)=১৭,২৮,০০০ বছর

ত্রেতাযুগ= (৪,৩২,০০০ x ৩)=১২,৯৬,০০০ বছর

দ্বাপরযুগ= (৪,৩২,০০০ x ২)= ৮,৬৪,০০০ বছর

কলিযুগ= ৪,৩২,০০০ বছর

🔘সত্যযুগ + ত্রেতাযুগ + দ্বাপরযুগ + কলিযুগ = চারযুগ মিলে ১ চতুর্যুগ বা ১ মহাযুগ = ৪.৩২ মিলিয়ন বছর

🔘৭১  মহাযুগ = ১ মন্বন্তর = ৩০৬.৭২ মিলিয়ন বছর

🔘১০০০ চতুর্যুগ= ১ “কল্প”= ব্রহ্মার এক দিন (ব্রহ্ম দিবস, ১২ ঘন্টা)= ব্রহ্মার একরাত (ব্রহ্ম রাত্রি, ১২ ঘন্টা)= ৪.৩২ বিলিয়ন বছর [১ কল্প=১৪ জন মনুর সময়কাল। ব্রহ্মার রাতে (ব্রহ্ম রাত্রিতে) মনু আসেন না। সুতরাং শুধু প্রত্যেক দিনের বেলাতেই (ব্রহ্ম দিবসে) ১৪ জন মনুর আগমন ঘটে। প্রথম মনুকে বলা হয় স্বায়ম্ভুব মনু এবং তাঁর স্ত্রী হলেন স্বতরুপা(এই ব্রহ্মান্ডের প্রথম নারী ও পুরুষ)। প্রত্যেক মনুর সময়কালকে বলা হয় মন্বন্তর। এই কল্পের ১৪ জন মনুর নাম হলঃ স্বায়ম্ভুব, স্বরোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুস, বৈবস্বত বা সত্যব্রত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবতাসাবর্ণি ও ইন্দ্রসাবর্ণি] 

🔘 ১ ব্রহ্ম পূর্ণদিবস = ১ ব্রহ্ম দিবস + ১ ব্রহ্ম রাত্রি = ২ কল্প

🔘 ব্রহ্মার ১ মাস = ৩০ ব্রহ্ম পূর্ণদিবস (৩০ ব্রহ্ম দিবস + ৩০ ব্রহ্ম রাত্রি) = ২ x৩০ =৬০ কল্প [যেহেতু শুধু ব্রহ্ম দিবসেই মনুর আগমন ঘটে, ব্রহ্ম রাত্রিতে ঘটে না সেহেতু কেবল ৩০ ব্রহ্ম দিবসেই (অর্থাৎ ৬০ কল্পের মধ্যে কেবল ৩০ কল্পেই) মনু আসবেন সর্বমোট (৩০*১৪)=৪২০ জন ]। 

🔘 ব্রহ্মার ১ বছর= ৩৬০  ব্রহ্ম পূর্ণদিবস = ৩৬০ ব্রহ্ম দিবস + ৩৬০ ব্রহ্ম রাত্রি। [কেবল ৩৬০ ব্রহ্ম দিবসেই মনুর আগমন ঘটে, ব্রহ্ম রাত্রিতে ঘটে না। সুতরাং, ১ বছরে মনু আসবেন ৩৬০*১৪=৫০৪০ জন (মোট)]।

🔘১০০ বছর হল ব্রহ্মার আয়ু= ৩৬০ ব্রহ্ম পূর্ণদিবস= এক ‘বিকল্প’= আমাদের এই ব্রহ্মান্ডের আয়ু= ৩১১.০৪ ট্রিলিয়ন বছর। [ ১০০ বছরে মোট ৫,০৪,০০০ জন মনু আসবেন। (মানুষের হিসেবে) প্রত্যেক মনু অধিকার করেন ৩০,৬৭,২০,০০০ বছর।]

এখনও পর্যন্ত ব্রহ্মার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে ব্রহ্মার বয়স ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে প্রথম পূর্ণদিবস (প্রথম দিবাভাগ) চলছে। প্রত্যেক কল্প/পূর্ণদিবস ধরে ১৪টি মন্বন্তর ঘটে, আবার প্রতি মন্বন্তরে ৭১ চতুর্যুগ আসে।

এটা বৈবস্বত মনুর সময়কাল। তিনি সপ্তম মনু। অর্থাৎ এনার সময়কাল সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র ৭ম  মন্বন্তরটিও শেষ হবে।

অর্থাৎ, ব্রহ্মার প্রথম কল্পের (দিবাভাগের) ৭ম মন্বন্তর এখনও চলছে। এর অন্তর্গত ৭১টি চতুর্যুগের মধ্যে ২৭টি চতুর্যুগও চলে গেছে। ২৭টি চতুর্যুগ যাওয়ার পরেও, আবার পরের “চতুর্যুগ”-এর সত্য,ত্রেতা,দ্বাপরও চলে গেছে, এখন কলি চলছে। অর্থাৎ এইবারের কলিযুগ গেলে ২৮তম “চতুর্যুগ”ও সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।

এখন ভগবত গীতায় ভগবান কি বলেছেন জেনে নিই –

সহস্রযুগপর্যন্তম্‌-অহর্যদ্ ব্রহ্মণো বিদুঃ।
রাত্রিং যুগসহস্রান্তং তে-অহোরাত্রবিদো জনাঃ॥গীতা ৮/১৭॥

অনুবাদ: মানুষের গণনায় সহস্র চতুর্যুগে ব্রহ্মার একদিন হয় এবং সহস্র চতুর্যুগে তাঁর এক রাত্রি হয়। এভাবেই যাঁরা জানেন, তাঁরা দিবা-রাত্রির তত্ত্ববেত্তা (তাঁরাই দিনরাত্রির যথার্থ তত্ত্ব বোঝেন)।

অব্যক্তাদ্ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্তি-অহরাগমে।
রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্র-এব-অব্যক্তসংজ্ঞকে॥গীতা ৮/১৮॥

অনুবাদ: ব্রহ্মার দিন আরম্ভ হলে অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে সমস্ত জীব প্রকাশিত হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রির সমাগমে সমস্ত জীবই পুনরায় অব্যক্তে লয়প্রাপ্ত হয়।

সর্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজামি-অহম্॥গীতা ৯/৭॥

অনুবাদ: হে কৌন্তেয়! কল্পের শেষে (কল্পান্তে) সমস্ত জড় সৃষ্টি আমারই প্রকৃতিতে প্রবেশ করে এবং পুনরায় কল্পের আরম্ভে (কল্পারম্ভে) প্রকৃতির দ্বারা আমি পুনরায় তাদের সৃষ্টি করি।

এই জড় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সম্পূর্ণরূপে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। ব্রহ্মার এক দিনকে (ব্রহ্ম দিবস =১২ ঘণ্টা) এক “কল্প” বলা হয়, আবার ব্রহ্মার এক রাত্রিকেও (ব্রহ্ম রাত্রি =১২ ঘণ্টা) এক “কল্প” বলা হয়। এই  ২ কল্প মিলে হয়  ব্রহ্মার এক পূর্ণদিবস সুতরাং, ১ ব্রহ্ম পূর্ণদিবস = ১ ব্রহ্ম দিবস + ১ ব্রহ্ম রাত্রি ৷ এই রকম ৩০ পূর্ণদিবসে এক মাস হয়। আবার ১২ মাসে তাঁর এক বৎসর হয় । এই ভাবে যখন ব্রহ্মার যখন ১০০ বৎসর অতিক্রান্ত হয় অর্থাৎ শত বৎসর পূর্ণ হয়ে যায় তখন ব্রহ্মার আয়ু শেষ হয়ে যায়। সেই কালের বাচক হল এই “কল্পক্ষয়” পদটি ; সেটিই কল্পের শেষ ৷ ‘কল্পের অবসান’ মানে ব্রহ্মার মৃত্যু— একেই বলা হয় “মহাপ্রলয়”

এর অর্থ হচ্ছে ভগবানের দ্বারা অভিব্যক্ত (প্রকাশিত শক্তি) পুনরায় তাঁরই মধ্যে লয় হয়ে যায়। তার পরে আবার যখন জড় জগতের সৃষ্টির প্রয়োজন হয়, তখন তাঁর ইচ্ছানুসারে তা সম্পন্ন হয় । বহু স্যাম্‌—এক হলেও আমি বহুরূপ ধারণ করব এটি হচ্ছে বৈদিক সূত্র (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/৩) । তিনি নিজেকে এই মায়াশক্তিতে বিস্তার করেন এবং তার ফলে সমস্ত জড় জগৎ পুনরায় প্রকট হয় ।

ময়া-অধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্।
হেতুনা-অনেন কৌন্তেয় জগৎ-বিপরিবর্ততে॥গীতা ৯/১০॥

অনুবাদ: হে কৌন্তেয়! আমার অধ্যক্ষতার দ্বারা (পরিচালনায়) জড়া প্রকৃতি এই চারাচর ‍বিশ্ব সৃষ্টি করে। প্রকৃতির নিয়মে এই জগৎ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি হয় এবং ধ্বংস হয়।

পরমেশ্বরের পরম ইচ্ছা শক্তির প্রভাবে এই জড় জগতের প্রকাশ হয়, কিন্তু তার পরিচালনা করেন জড়া প্রকৃতি। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতাতে বলেছেন যে, বিভিন্ন যোনি থেকে উদ্ভূত সমস্ত জীব-প্রজাতির তিনিই হচ্ছেন পিতা। মাতার গর্ভে বীজ প্রদান করে পিতা সন্তান উৎপাদন করেন, তেমনই পরমেশ্বর ভগবান তাঁর দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জড়া প্রকৃতির গর্ভে সমস্ত জীবকে সঞ্চারিত করেন এবং এই সমস্ত জীব তাদের পূর্ব কর্মবাসনা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও যোনি প্রাপ্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত জীবেরা যদিও ভগবানের দৃষ্টিপাতের ফলে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তাদের পূর্ব কর্মবাসনা অনুসারে তারা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, ভগবান স্বয়ং এই প্রাকৃত সৃষ্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন। শুধুমাত্র তাঁর দৃষ্টিপাতের ফলেই জড়া প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে এবং তার ফলে তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টির অভিব্যক্তি হয়। এর মর্মার্থ হচ্ছে, ভগবানের পরিচালনা ব্যতীত জড়া প্রকৃতি কিছুই করতে পারে না, তবুও সমস্ত জড়-জাগতিক কার্যকলাপ থেকে পরমেশ্বর ভগবান অনাসক্ত।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৪৯ 

❝ভাস্বান্‌ যথাশ্ম-সকলেষু নিজেষু তেজঃ
স্বীয়ং কিয়ৎ প্রকটয়ত্যপি তদ্বৎ অত্র।
ব্রহ্মা য এষ জগদণ্ড-বিধানকর্তা
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

ভাস্বান্—জ্যোতির্ময় সূর্য; যথা—যেমন; অশ্ম সকলেষু—বিভিন্ন প্রকার মণিতে; নিজেষু—তাঁর নিজের; তেজঃ—তেজ; স্বীয়ম্—তাঁর নিজের; কিয়ৎ—কিছু পরিমাণে; প্রকটয়তি—প্রকাশ করে; অপি—ও; তদ্বৎ— সেই রূপে; অত্র—এখানে; ব্রহ্মা—ব্রহ্মা; যঃ—যিনি; এষঃ —প্রভু; জগৎ-অণ্ড-বিধান-কর্তা—ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা; গোবিন্দম্-আদি-পুরুষম্—আদিপুরুষ গোবিন্দকে; তম্—তাঁকে; অহম্—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: সূর্য যেমন বিভিন্ন মণিতে তার তেজ কিছু পরিমাণে প্রকট করে, তেমনই যে আদি পুরুষ গোবিন্দ কোন পুণ্যবান জীবের মধ্যে তাঁর শক্তি সঞ্চার করে ব্রহ্মা রূপে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকার্য সাধন করেন, তাঁকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 49

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

ভাস্বান্ যথাশ্ম-সকলেষু নিজেষু তেজঃ — সূর্যের নিজস্ব তেজ, তাপ, প্রতাপ, প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন মণিতে যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন মণিগুলি সূর্যের মতোই কিছুটা প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়।

স্বীয়ং কিয়ৎ প্রকটয়ত্যপি তদ্বৎ অত্র — সেই রকম এক্ষেত্রে ভগবান নিজের তেজের কিঞ্চিৎ পরিমাণে প্রকাশ করেন। মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হর্তাকর্তা পালয়িতা পরমেশ্বর ভগবান যদি কোন ব্যক্তিকে কৃপাদৃষ্টি দিয়ে থাকেন, তবে সেই ব্যক্তি জ্ঞানে-গুনে প্রকাশিত হয়, তিনি অসম্ভব বা অসাধ্য কর্মও সম্ভব বা সফল করে তোলেন।

ব্রহ্মা য এষ জগদণ্ড-বিধানকর্তা — ব্রহ্মা যাঁর থেকে শক্তি প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের বিধান করেন। ভগবান কোনও পুণ্যবান জীবের মধ্যে তাঁর শক্তি সঞ্চার করে ব্রহ্মারূপে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কার্য-সাধন করেন।

গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি — ব্রহ্মা যাঁর থেকে শক্তি পেয়ে ব্রহ্মাণ্ডের বিধান করেন সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।

ব্রহ্মা দুই প্রকার—১। কোনও কল্পে উপযুক্ত জীবে ভগবৎ-শক্তির আবেশ হলে সেই জীবই ‘ব্রহ্মা ’ হয়ে কার্য বিধান করেন। ২। কোনও কল্পে সেরকম উপযুক্ত জীব না থাকলে শ্রীকৃষ্ণ নিজ শক্তির বিস্তার করে রজোগুণাবতার ব্রহ্মাকে  সৃষ্টি করেন ।

তত্ত্বতঃ, ব্রহ্মা সাধারণ জীব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্ৰহ্মা সাক্ষাৎ ঈশ্বর নন। ব্রহ্মা অপেক্ষা শিবের ঈশ্বরতা অধিক পরিমাণে আছে। ব্রহ্মার মধ্যে জীবের পঞ্চাশগুণ অধিকভাবে আছে এবং তা ছাড়াও আরও পাঁচটি গুণ আংশিক রূপে আছে। শিবের মধ্যে পঞ্চান্ন গুণ অধিকমাত্রায় আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন নারায়ণ, বিষ্ণু রূপে পালন কর্ম করেন তখন তিনি ষাট গুণে অধিষ্ঠিত হন। আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন চৌষট্টি গুণের অধিকারী পরম পুরুষোত্তম, যিনি নিত্য সর্বোচ্চ গোলোকধামে অবস্থান করেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন গোস্বামীকে বললেন —

❝ভক্তিমিশ্র কৃতপুণ্যে কোন জীবোত্তম।
রজোগুণে বিভাবিত করি’তাঁর মন॥
গর্ভোদকশায়ী দ্বারা শক্তি সঞ্চারি।
ব্যষ্টি সৃষ্টি করে কৃষ্ণ ব্রহ্মা-রূপ ধরি॥❞

অনুবাদ: পূর্বকৃত ভক্তিমিশ্রিত পুণ্যকর্মের প্রভাবে পুণ্যবান কোনও উত্তম জীবকে গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু রজোগুণের দ্বারা বিভাবিত করে তার মধ্যে নিজ শক্তি সঞ্চার করেন এবং ব্রহ্মারূপে তার দ্বারা জগতে সৃষ্টিকার্য সাধন করেন। (চৈতন্যচরিতামৃত মধ্য ২০।৩০২-৩০৩)

প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডের ভেতরে গর্ভোদক সমুদ্রে শায়িত গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভি পদ্ম থেকে সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মার জন্ম হয়।

❝কোন কল্পে যদি যোগ্য জীব নাহি পায়।
আপনে ঈশ্বর তবে অংশে ‘ব্রহ্মা’ হয়॥❞

অনুবাদ: কোন কল্পে ভগবান যদি ব্রহ্মা হওয়ার মতো উপযুক্ত জীব না পান, তাহলে তিনি নিজ অংশের দ্বারা ব্রহ্মারূপে প্রকাশিত হন। (চৈতন্যচরিতামৃত মধ্য ২০।৩০৫)

বৃহৎ ভাগবতামৃতে বলা হয়েছে, যে জীব মনুষ্যরূপে একশত জন্ম ধরে বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করেছেন, সেই ব্যক্তি ব্রহ্মা হওয়ার উপযুক্ত পাত্র হন। একশত জন্ম—প্রতি জন্মে চারি বর্ণ যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যশূদ্র—যেরূপে আসবেন তাঁর নিজ নিজ কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করবেন। আর, প্রতি জন্মে চারি আশ্রম যেমন ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থসন্ন্যাসী-যে রূপে আসবেন তাঁর নিজ নিজ কর্তব্য বা দায়িত্ব পালন করবেন। একশত জন্ম এভাবে কর্তব্য পালন করতে পারলে ব্রহ্মার পদে আসীন হতে পারা যাবে। এই চতুর্দশ ভুবনের সর্বোচ্চ লোক সত্যলোকে তিনি নিবাস করতে পারবেন।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫০ 

❝যত্‍-পাদপল্লবযুগং বিনিধায় কুম্ভ-
দ্বন্দ্বে প্রণাম-সময়ে স গণাধিরাজঃ।
বিঘ্নান্ বিহন্তুম্-অলম্‌-অস্য জগত্রয়স্য
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যৎ—যাঁর; পাদ পল্লবযুগং—দুই পাদপদ্ম; বিনিধায়—ধারণ করে; কুম্ভ দ্বন্দ্বে—নিজ মস্তকের কুম্ভ দ্বয়ে, প্ৰণাম সময়ে—প্রণাম করার সময়ে; সঃ গণাধিরাজঃ—সেই প্রসিদ্ধ বিঘ্নবিনাশক গণেশ; বিঘ্নান্—বিঘ্ন সমূহকে ; বিহন্তুম্—বিনাশ করতে; অলং—সমর্থ হন; অস্য—এই; জগত্রয়স্য—ত্রিজগতের; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদি পুরুষং—আদিপুরুষকে; তম্—সেই ; অহং—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: শ্রীগণেশ ত্রিজগতের বিঘ্ন বিনাশ করবার উদ্দেশ্যে তাঁর কার্যকালে শক্তি লাভের জন্য যাঁর পাদপদ্ম নিজ মস্তকের দুই কুম্ভের (হাতীর মাথার দুই পাশের মাংসপিন্ড) উপর নিয়ত ধারণ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 50

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যত্‍-পাদপল্লবযুগং বিনিধায় কুম্ভ-দ্বন্দ্বে — যাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) পাদপদ্ম দ্বয়ে প্রণতি নিবেদন কালে সেই পাদপদ্ম (গণেশ) নিজ মাথায় কুম্ভ দুটিতে ধারণ করেন ।

প্রণাম-সময়ে স গণাধিরাজঃ — লোকগণের উপাস্য দেবতা গণেশ শ্রীগোবিন্দ পাদপদ্মে প্রণতি নিবেদন পূর্বক সমস্ত কার্য সমাধা করেন।

বিঘ্নান্ বিহন্তুম্ অলম্ অস্য জগত্রয়স্য —  ত্রিজগতের বিঘ্নসমূহকে বিনাশ করতে গণেশ সমর্থ হন। গণেশ হলেন ভগবানের শক্তিতে আবিষ্ট একজন আধিকারিক দেবতা। তিনি বিঘ্নবিনাশ কার্যে অধিকার প্রাপ্ত। গোবিন্দের কৃপায়ই তাঁর সমস্ত মহিমা ।

গোবিন্দম্ আদি পুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি — যাঁর পাদপদ্মে প্রণত হয়ে গণেশ ত্রিজগতের বিঘ্ন বিনাশ করবার শক্তি লাভ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবন্দকে আমি ভজনা করি ।

শ্রীনারদপঞ্চরাত্রম্ শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

দ্বারে নিযুক্তং দেবেশং গণেশং গণসংযুক্তম্।
ধ্যানস্থঞ্চ বিভান্তঞ্চ শুদ্ধ স্ফটিকমালয়া॥
জপন্তং পরমং শুদ্ধং ব্রহ্মজ্যোতিঃ সনাতনম্।
নির্লিপ্তং নির্গুনং কৃষ্ণং পরমং প্রকৃতে পরম্॥

অনুবাদ: শুদ্ধ স্ফটিকমালায় শোভিত ধ্যানস্থ সুরসত্তম সগণ গণপতি (গণেশ) মথুরার দ্বার রক্ষণে নিযুক্ত আছেন। তিনি জ্যোতির্ময় শুদ্ধ সনাতন নির্লিপ্ত নির্গুণ প্রকৃতির অতীত পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় মন্ত্র জপ করেন। (নাঃ পঃ রাঃ ৭/১। ৮৩-৮৪)


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫১ 

❝অগ্নিরর্মহী গগনমম্বু মরুৎ-দিশশ্চ
কালস্তথা-আত্ম-মনসীতি জগৎ-ত্রয়াণি।
যস্মাৎ-ভবন্তি বিভবন্তি বিশন্তি যং চ
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

অগ্নিঃ—অগ্নি; মহী—পৃথিবী; গগনম্—আকাশ; অম্বু—জল, মরুৎ–বায়ু; দিশঃ—দিকসমূহ; –ও; কালঃ—কাল; তথা—এবং; আত্ম—আত্মা; মনসী—মন; ইতি—এই নয় পদার্থ সমন্বিত; জগৎ-ত্রয়াণি—ত্রিজগৎ; যস্মাৎ—যাঁর থেকে; ভবন্তি—উৎপন্ন হয়; বিভবন্তি—যাঁতে স্থিতি লাভ করে; বিশন্তি-প্রলয়কালে প্রবেশ করে; যং—যাঁর মধ্যে; চ—এবং; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষং—আদি পুরুষকে; তম্—সেই; অহং—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: অগ্নি, ক্ষিতি, আকাশ, জল, বায়ু, দিক, কাল, আত্মামন এই নয়টি পদার্থে ত্রিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। যাঁর থেকে এসব উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হয়ে যাঁতে অবস্থান করে এবং প্রলয়কালে যাঁর মধ্যে প্রবেশ করে, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 51

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

অগ্নিঃ মহী গগনম্ অম্বু মরুৎ  আগুন, মাটি, আকাশ, জল ও বাতাস। এই পাঁচটিকে বলা হয় পঞ্চ মহাভূত বা পঞ্চভূত। এই পঞ্চভূত শ্রীভগবান থেকেই প্রকাশিত । মাটির গুণ গন্ধ, জলের গুণ রস, বাতাসের গুণ স্পর্শ, আগুনের গুণ রূপ বা তেজ, আকাশের গুণ শব্দ ।

দিশশ্চ কালস্তথা-আত্ম-মনসীতি জগৎ-ত্রয়াণি — তার সাথে দিক, আত্মা, মন এই চার পদার্থে ত্রিজগৎ সৃষ্ট ।

যস্মাৎ-ভবন্তি বিভবন্তি বিশন্তি যঞ্চ — যাঁর থেকে এই নয় পদার্থ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হয়ে যাঁতে অবস্থিতি করে এবং প্রলয়কালে যাঁতে প্রবেশ করে। তিনি হচ্ছে শ্রীগোবিন্দ ।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তম্ অহম্ ভজামি — সবকিছু যাঁর থেকে উৎপত্তি, স্থিতি ও যাঁর মধ্যেই প্রলয় হয় সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ এই পঞ্চভূত এবং দিক, কাল, জীবাত্মা এবং বদ্ধজীবের মন-বুদ্ধি-অহংকার সমন্বিত এই নয়টি মনস্তত্ত্ব ছাড়া আর ত্রিজগতে কিছু নেই। ত্রিজগৎ বলতে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝায়। উপরের লোকসমূহ বা স্বর্গলোক, মাঝখানের লোকসমূহ বা মর্ত্যলোক এবং নিচের লোকসমূহ বা পাতাল লোক। কর্মী, জ্ঞানী, যোগী—সমস্ত রকমের তত্ত্ববাদীর নির্দিষ্ট তত্ত্বই এই নয়টি তত্ত্বের অন্তর্গত। এর অতিরিক্ত তারা কিছু জানতেও চেষ্টা করে না। অথচ এই সকল তত্ত্বের জন্ম, স্থিতি ও প্রলয়ের স্থান যিনি, তিনি হচ্ছেন আদিপুরুষ গোবিন্দ।

নাস্তিক লোকদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন শূন্য থেকেই সবকিছু সৃষ্টি। কেউ বলেন আগে কেবল জল ছিল। জল থেকেই সবকিছু সৃষ্টি । আবার কেউ বলেন আগে সূর্য কেবল ছিল। হঠাৎ বিস্ফোরণ হলো। অমনি অনেক গ্রহমণ্ডল সৃষ্টি হলো। কেউ কেউ বলেন সবকিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে প্রকাশিত হয়েছে। হঠাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ধ্বংস হবে। তারা শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। যেহেতু তারা শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পান না ।

যখন তাদেরকে বলা হয় আপনার পরনের বসনটি হঠাৎ হয়নি, সেটি কেউ বানিয়েছে, যদিও কাপড় তৈরি যিনি করেছেন তাঁকে আপনি দেখেননি। ঘড়িটার তিনটি কাঁটা নিয়ম মতো ঘুরছে। কোনও ব্যক্তি সেটা ঘুরবার ব্যবস্থা করেছেন, যদিও তাঁকে আপনি দেখেননি। কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।

অনুরূপ ভাবেঅহং সর্বস্ব প্রভবঃ আমিই সব কিছুর উৎস (গীতা) এই রূপ উক্তি একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধেই মহাত্মাগণ অঙ্গীকার করেন। অন্য কেউ দাবীদার নেই।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫২ 

❝যচ্চক্ষুরেষ সবিতা সকল-গ্রহাণাং
রাজা সমস্ত-সুর-মূর্তির-অশেষতেজাঃ।
যস্যাজ্ঞয়া ভ্রমতি সংভৃত-কালচক্রো
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যৎ—যে; চক্ষু—চোখ; এষঃ—এই; সবিতা—সূর্য; সকল গ্রহানাং—সমস্ত গ্রহগণের; রাজা—অধিপতি; সমস্ত সুরমূর্তিঃ—সকল দেবগণের অধিষ্ঠান স্বরূপ; অশেষ তেজাঃ—অশেষ তেজো বিশিষ্ট; যস্য—যাঁরা; আজ্ঞয়া—নির্দেশ অনুসারে; ভ্ৰমতি—ভ্ৰমণ করছেন; সংভূত কালচক্রঃ—কালচক্র ধারণ করে; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্‌—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; অহং—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: সকল গ্রহদের রাজা অশেষ-তেজোবিশিষ্ট সুরমূর্তি সবিতা বা সূর্য হচ্ছেন জগতের চক্ষু স্বরূপ। সেই সূর্যদেব যাঁর নির্দেশে কালচক্রে চড়ে ভ্রমণ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 52

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যচ্চক্ষুরেষ সবিতা সকল গ্রহাণাং রাজা — সকল গ্রহদের রাজা সূর্য হলেন জগতের চক্ষু স্বরূপ। চোখ থাকলে রূপ দর্শন করা যায়। সূর্য থাকলে জগৎ দৃশ্যমান হয় ।

সমস্ত-সুর-মূর্তির-অশেষতেজাঃ — সকল দেবগণের মধ্যে অতি তেজস্বী হচ্ছেন সূর্যদেব। সূর্য—জড় তেজঃ সমষ্টি একটি মণ্ডলের অধিষ্ঠাতা। পৃথিবীতে যেমন আমাদের ক্ষিতি বা মাটি, প্রধান শরীর। সূর্যলোকে তেমনই তেজ বা অগ্নিপ্রধান শরীর সমন্বিত প্রাণী বাস করে। একটি জড় বস্তু যেমন জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়, সূর্যলোক সেরকম নয়। প্রদীপের বাতি শেষ হলে কিংবা ঘি বা তেল শেষ হলে নিভে যায়, সূর্য সেরকম নয়, সর্বদা তেজোময়। অশেষ তেজঃ ।

যস্যাজ্ঞয়া ভ্রমতি সংভৃত-কালচক্রো — যাঁর (গোবিন্দের) নির্দেশে কালচক্র ধারণ করে (সূর্য) পরিভ্রমণ করছেন। আমরা কাল গণনা বা দিনরাত মাস বছর ইত্যাদি গণনা করে থাকি সূর্যের উদয় হওয়া ও অস্ত যাওয়া ব্যাপারটাকে ভিত্তি করে। ভ্রমতি সম্ভূত কালচক্রঃ।

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি — সেই সূর্য যাঁর নির্দেশে আলো ও উত্তাপ দিয়ে চলেছেন, জগৎকে প্রকাশ করছেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৫/১২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন —

যৎ-আদিত্যগতম্ তেজো জগৎ ভাসয়তে অখিলম্।
যৎ-চন্দ্রমসি যৎ-চ-অগ্নৌ তৎ-তেজঃ বিদ্ধি মামকম্॥

অনুবাদ: সূর্যের যে জ্যোতি এবং চন্দ্র ও অগ্নিরও যে জ্যোতি যা সমগ্ৰ জগতকে উদ্ভাসিত করে, তা আমারই (কৃষ্ণের) তেজ বলে জানবে।

শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বলছেন, সূর্য, চন্দ্ৰ, অগ্নি, বৈদ্যুতিক শক্তিতে সকলে দেখতে পায়। সূর্যের উজ্জ্বল জ্যোতি, চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণ, বৈদ্যুতিক আলোক ও অগ্নির দীপ্তি সবই আসছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের থেকে। সূর্য সমস্ত সৌর মণ্ডলকে আলোকিত করছে। অনেক অনেক ব্রহ্মাণ্ড আছে এবং সৌরমণ্ডল আছে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সূর্য রয়েছে, চন্দ্র রয়েছে এবং গ্রহ রয়েছে। প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডে একটি করে সূর্য আছে। এই সূর্য, অগ্নি, চন্দ্রকিরণ ইত্যাদির সাহায্য ছাড়া জীব বেঁচে থাকতে পারে না। শ্রীভগবানের কৃপা বিনা সূর্যাদির প্রকাশ হতে পারে না ।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫৩ 

❝ধর্মোথ পাপনিচয়ঃ শ্রুতয়স্তপাংসি
ব্রহ্মাদিকীট-পতগা-অবধয়শ্চ জীবাঃ।
যদ্দত্তমাত্র-বিভব প্রকট-প্রভাবা
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

ধর্মঃ—পুণ্য কর্ম অর্থাৎ বেদোক্ত বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম; অথ—অথবা; পাপনিচয়ঃ—পাপসমূহ; শ্রুতয়ঃ—শ্রুতিগণ অর্থাৎ ঋক, সাম, যজুঃ ও অথর্ব নামক চারি বেদ এবং তাঁদের শিরোভূষণ উপনিষৎ সমূহ; তপাংসি—তপস্যা সমূহ; ব্রহ্মাদি কীট পতগা-অবধয়ঃ—ব্রহ্মা থেকে কীটপতঙ্গ পর্যন্ত;—এবং; জীবাঃ—সমস্ত জীব; যৎ—যাঁর; দত্ত—প্রদত্ত বা দেওয়া; মাত্র—মাত্র; বিভব—বৈভব; প্রকট-প্রভাবাঃ—নিজ নিজ প্রভাব প্রকাশ করে থাকে; গোবিন্দম্—গোবিন্দকে; আদিপুরুষং—আদি পুরুষকে; তম্—সেই; অহং—আমি; ভজামি—ভজনা করি।

অনুবাদ: ধর্ম, অধর্ম (পাপসমূহ), শ্রুতিগণ, তপস্যা সমূহ এবং ব্রহ্মা থেকে কীটপতঙ্গ পর্যন্ত সমস্ত জীব যাঁর দেওয়া বৈভবের (ঐশ্বর্য বা মহিমার) কারণে নিজ নিজ প্রভাব প্রকাশ করে থাকে, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 53

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

ধর্মোহথ পাপনিচয়ঃ শ্রুতয়স্তপাংসি – ধর্ম, অধর্ম (বা পাপসমূহ), শ্রুতিগণ, তপস্যা সমূহ। ধর্ম বলতে বেদ থেকে উদিত বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারি বর্ণের স্বভাবজ ধর্মই বর্ণধর্ম। ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাসী এই চারি আশ্রমীর আশ্রমোচিত ধর্মই আশ্রমধর্ম। এই দুই প্রকার ধর্মে মানুষের সব রকমের জীবনের আচার বা কর্তব্য নির্ণীত আছে। পাপনিচয় অর্থাৎ পাপমূল অবিদ্যা ও পাপবাসনা এবং সবরকমের অবৈধ আচরণ। শ্রুতিগণ অর্থাৎ ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ববেদ এবং তাঁদের শিরোভূষণ রূপ উপনিষদ্গণ। তপঃসমূহ অর্থাৎ ধর্মকে লক্ষ্য করে যতরকমের অভ্যাস শিখতে হয়, তাই তপস্যা। এই সমস্তই বদ্ধজীবের কর্মচক্রের অন্তর্গত বিশেষ অনুশীলন মাত্র ।

ব্রহ্মাদিকীট-পতগা-অবধয়শ্চ জীবাঃ — এবং ব্ৰহ্মা থেকে কীটপতঙ্গ পর্যন্ত জীব সকল। জড়জগতে বদ্ধ জীব চুরাশী (৮৪) লক্ষ যোনিতে ভ্রমণ করছে। এই সমস্ত জীব ব্রহ্মা থেকে ক্ষুদ্র কীট পর্যন্ত অসংখ্য রকমের। তারা দেব, দানব, রাক্ষস, মানব, নাগ, কিন্নর ও গন্ধর্ব ভেদে বিভিন্ন রকমের। 

যদ্দত্তমাত্রবিভব প্রকটপ্রভাবা — যাঁর দেওয়া বৈভবমাত্রের (ঐশ্বর্য বা মহিমার) বলেই নিজ নিজ প্রভাব প্রকাশ করে থাকে। সমস্ত জীব কর্মচক্রের অন্তর্গত। বিশেষ বিশেষ কর্মচক্রের অন্তর্গত। ব্রহ্মা থেকে পতঙ্গ পর্যন্ত সমস্ত বদ্ধজীব। সকলেই এক এক রকমের প্রভাব বিশিষ্ট। সকলেই কোন কোন কাজে ক্ষমতাশালী । কিন্তু সেই সমস্ত প্রভাব তাদের স্বতঃসিদ্ধ নয়। শ্রীগোবিন্দ যাকে যতটুকু বিভব ও পরাক্রম দিয়েছেন, সেই বিভবের প্রকটতা অনুসারেই সেই সেই জীবের প্রভাব মাত্র ।

গোবিন্দমাদিপুরুষম্ তমহং ভজামি — জীবসমূহকে ক্ষমতা প্রদানকারী সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায় বিভূতিযোগের ৮ম শ্লোকে ভগবান শ্রীগোবিন্দ বলছেন —

অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ॥১০/৮॥

অনুবাদ: আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই সত্ত্ব (নিত্য সত্য) অবগত হয়ে পন্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তিসহকারে আমাকে ভজন করে থাকেন।

সুতরাং যারা ভগবানের ভজন করেন না, তারা অপণ্ডিত। মহা ঐশ্বর্যলক্ষণ যুক্ত বিভূতির কথা বলা হচ্ছে। অহং সর্বস্য প্রভবঃ—শ্রীগোবিন্দ এই জড় ও চিন্ময় বস্তু মাত্রেরই উৎপত্তি ও প্রাদুর্ভাবের হেতু। মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে—অন্তর্যামি স্বরূপ গোবিন্দ থেকেই সমগ্র জগৎ কার্যে রত হয়। নারদাদি সমস্ত অবতারের উৎস শ্রীগোবিন্দ থেকেই ভক্তি জ্ঞান তপ কর্মাদি সাধন ও সেই সেই সাধ্য প্রবৃত্ত হয়। ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ—যে সব পণ্ডিত ব্যক্তি এটি অবগত হয়ে শ্রীগোবিন্দকে ভজনা করেন, তাঁরাই শ্রীগোবিন্দে দাস্য-সখ্য প্রভৃতি ভাবযুক্ত হন। যাঁরাই শুদ্ধ ভক্তি সহকারে শ্রীগোবিন্দকে ভজন করেন, তাঁরাই পণ্ডিত। অপর সকলেই অপণ্ডিত। 

এরপর ভগবান পরের শ্লোকে আরও বলছেন, তাদের মধ্যে কোন কোন শুদ্ধ ভক্তরা কেবল অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন। 

মচ্চিত্তা মদগতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ॥১০/৯॥❞

অনুবাদ: যাঁদের চিত্ত ও প্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা পরস্পরের মধ্যে আমার কথা সর্বদাই আলোচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরকে বুঝিয়ে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দ লাভ করেন।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫৪ 

❝যস্ত্বিন্দ্রগোপম্‌ অথবেন্দ্রম্‌ অহো স্বকর্ম-
বন্ধ-অনুরূপ-ফলভাজনম্‌ আতনোতি।
কর্মাণি নির্দহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজাং
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যঃ—যিনি; তু—কিন্তু; ইন্দ্রগোপম্‌—ইন্দ্রগোপ নামক অতি ক্ষুদ্র রক্তবর্ণ কীটবিশেষকে; অথবা—কিংবা; ইন্দ্রং—দেবরাজ ইন্দ্রকে; অহো—আশ্চর্যের বিষয় এই যে; স্বকর্ম-বন্ধ-অনুরূপ—নিজ নিজ কর্মবন্ধের অনুরূপ; ফলভাজনম্—ফলভাজনতা; আতনোতি—প্রকাশ করেন; কর্মানি—কর্ম সমূহ; নির্দহতি–নিঃশেষরূপে অর্থাৎ সর্বতোভাবে দগ্ধ করে থাকেন; কিন্তু—কিন্তু; —এবং; ভক্তিভাজাং—শুদ্ধভক্তিপরায়ণদেরকে; গোবিন্দম্‌—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; ভজামি—ভজনা করি। 

অনুবাদ: ইন্দ্রগোপ নামক ক্ষুদ্র কীটই হোক, কিংবা দেবতাদের রাজা ইন্দ্রই হোক, কর্মমার্গী জীবদের যিনি পক্ষপাতশূণ্য হয়ে তাদের নিজ নিজ কর্মবন্ধানুরূপ ফল ভাজন করছেন অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ভক্তিমানদের সকল কর্ম সমূলে দহন করছেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 54

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যস্তু ইন্দ্রগোপম্ অথবা ইন্দ্রম্ অহো স্বকম ইন্দ্রগোপ কীট হোক কিংবা দেবরাজ ইন্দ্ৰই হোক সব জীবের নিজ নিজ কর্মের অনুরূপ ফল যিনি দিয়ে থাকেন । ইন্দ্রগোপ হলো এক রকমের অতি ক্ষুদ্র পোকা। বর্ষকালে মাটিতে বিবরণকারী অতি ছোট ছোট লালা রঙের পোকা দেখা যায়। ইন্দ্র হলেন স্বর্গের অধিপতি। দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ ছোট বড় সবরকমের জীব এই ব্ৰহ্মাণ্ডে কর্মফলবদ্ধ জীব।

বন্ধ-অনুরূপ-ফলভাজনম্ আতনোতি — নিজ নিজ কর্মবন্ধানুরূপ ফলভাজন করেন। স্বকর্মবন্ধ হচ্ছে, নিজ কর্মের ফল ভোগের জন্য জন্ম প্রভৃতি। অনুরূপ ফল ভাজন বলতে বোঝায়–ব্যবস্থা বিধান করা। নিরপেক্ষভাবে বদ্ধ জীবদেরকে তাদের পূর্ব পূর্ব কর্ম অনুসারে ফল ভোগের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। বদ্ধ জীবদের কর্মফল-দানে পক্ষপাতশূণ্য হয়ে ঈশ্বর পূর্ব-অনুষ্ঠিত কর্ম অনুসারে পরবর্তীকালের কর্মপ্রবৃত্তি প্রদান করেন।

কর্মাণি নির্দহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজাং — কিন্তু ভক্তদের পূর্ব কর্মফল সর্বতোরূপে দগ্ধ করে থাকেন। আহার, নিদ্রা, দেহরক্ষা ও মৈথুনের উদ্দেশ্যে প্রায় সবাই কর্ম করছে। তার কর্মের ফল সে ভোগ করছে। এজন্য তার আচরিত পাপ বা পুণ্য কর্মের অনুষ্ঠানের ফলে সে কর্ম বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার কর্ম যখন শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হয় তখন সেই কর্ম কোনও জড়বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে না। সে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের প্রেমময় রাজ্যে প্রবেশ করে।

গোবিন্দম্ আদিপুরুষম্ তম্ অহম্ ভজামি — আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে ভজনা করি, যিনি নিরপেক্ষ হয়েও তাঁর ভক্তের পক্ষপাতিত্ব করেন এটিই আশ্চর্যের বিষয়।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৯।২৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উল্লেখ করেছেন —

সমঃ-অহম্ সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যঃ-অস্তি ন প্রিয়ঃ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু-চ-অপ্যহম্॥❞

অনুবাদ: আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউই আমার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন (অপ্রিয়) নয় এবং প্রিয়ও নয়। কিন্তু যাঁরা ভক্তিপূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও তাঁদের মধ্যে বাস করি।

মেঘ যেমন জল, স্থল, পাথর কোনও ভেদবুদ্ধি না করে সর্বত্রই সমানভাবে বর্ষণ করে, ভগবানের করুণাও তেমনই সকলের উপর সমভাবে বর্ষিত হয়। কিন্তু তাঁর ভক্তের ক্ষেত্রে তিন বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেন। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৯।২২) বলছেন —

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥❞

অনুবাদ: অন্য চিন্তা না করে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে যারা সর্বদাই পূর্ণ ভক্তি সহকারে আমার সেবা করেন (উপাসনা করেন), তাঁদের সমস্ত অপ্রাপ্ত বস্তু  আমি বহন করি (অর্থাৎ তাঁদের সমস্ত অভাব পূরণ করি) এবং তাদের প্রাপ্ত বস্তুর সংরক্ষণ করি।

যাঁরা কৃষ্ণভাবনা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। যাঁদের একমাত্র অভিলাষ ভগবৎসঙ্গ লাভ করা, তাঁরা নিঃসন্দেহে ভগবৎ সান্নিধ্য লাভ করেন। একে বলে ‘যোগ’। ভগবৎ কৃপার ফলে তাঁদের কখনও জড়জাগতিক বদ্ধ জীবনে ফিরে আসতে হয় না। একে বলে ‘ক্ষেম’ বা ভগবানের কৃপাময় সংরক্ষণ। পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত ভক্তকে ভগবান দুঃখময় বদ্ধ জীবনে পতিত হবার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করেন।

এই জড়জগতে ইন্দ্রিয় তর্পণ লালসায় কেউ ‘ভুক্তি’ বা ভোগ্যবস্তু কামনা করে, কেউ জড়জগতে নাকানি-চুবানি খেয়ে ‘মুক্তি’ বা মোক্ষ কামনা করে, কেউ এই জগতে লোকের কাছে লাভ পূজা প্রতিষ্ঠা লাভের কামনায় ‘সিদ্ধি’ বা লোককে চমক লাগানো বুদ্ধি কামনা করে। এজন্যে তাদের অনেক প্রচেষ্টা, অনেক কর্ম করতে হয়। সেই কর্মগুলি পুণ্য বা পাপ—যা এই কর্মবন্ধ সৃষ্টি করে। কিন্তু ভক্ত ‘শুদ্ধ কৃষ্ণপ্রীতি’ সর্বদা কামনা করে। কৃষ্ণভক্তি কর্মটি পুণ্য বা পাপ নয়। তা চিন্ময়। কৃষ্ণকৃপায় তাঁর ভক্ত কর্মবন্ধন মুক্ত হয়ে চিন্ময় স্তর প্রাপ্ত হয়।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫৫

❝যং ক্রোধ-কাম-সহজ-প্রণয়াদি-ভীতি-
বাৎসল্য-মোহ-গুরু-গৌরব-সেব্যভাবৈঃ।
সঞ্চিন্ত‍্য তস্য সদৃশীং তনুমাপুরেতে
গোবিন্দম্‌ আদি-পুরুষং তমহং ভজামি ॥❞

যং—যাঁকে; ক্রোধ—শত্রুভাব; কাম—মধুরভাব; সহজ প্রণয়াদি—সখ্য ভাব; ভীতি—ভয়ভাব; বাৎসল্য—অভিভাবকের ভাব বা পালক ভাব; মোহ—সর্ব বিস্মরণ ভাব; গুরুগৌরব—শান্তরসের ভাব; সেব্য—সেবা করার জন্য দাস্য ভাব; ভাবৈঃ—এই সমস্ত ভাবের দ্বারা; সঞ্চিন্ত্য—নিরন্তর চিন্তা করে; তস্য—সেই শ্রীভগবানের; সদৃশীং—সদৃশ বা তুল্য; তনুম্—দেহ; আপুঃ—প্রাপ্ত হন; এতে—এঁরা; গোবিন্দম্‌—গোবিন্দকে; আদিপুরুষম্—আদিপুরুষকে; তম্—সেই; ভজামি—ভজনা করি। 

অনুবাদ: ক্রোধ, কাম, সহজ প্রণয়ভাব সখ্যরূপে, ভয়, বাৎসল্য, মোহ, গুরুগৌরবসেব্য ভাবে যাঁকে চিন্তা করে সেই সেই অনুশীলনকারীরা তাঁদের ভাবনার উপযুক্ত রূপ-গুণ শরীর লাভ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করে।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 55

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্য◼️
====================

যং ক্রোধ কাম সহজপ্রণয়াদি ভীতি — যাঁকে ক্রোধ কাম সহজপ্রণয় ভয় ভাবে লোকে ভজনা করে। শিশুপাল, দন্তবক্র প্রভৃতির শত্রুভাব নিবন্ধন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ক্রোধ। শ্রীকৃষ্ণইন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্ছামূলক গোপীগণের প্রেম বা মধুর ভাব। শ্রীদাম সুবল প্রভৃতি সখাগণের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সহজ প্রণয়াদি বা সখ্যভাব। কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত হওয়ার আতঙ্কে কংস প্রভৃতির সর্বক্ষণ ভয় ।

বাৎসল্য মোহ গুরুগৌরব সেব্য ভাবৈঃ — যাঁকে বাৎসল্য মোহ গুরুগৌরব সেব্য ভাবে লোকে ভজনা করে। নন্দ যশোদা প্রভৃতির শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্নেহ বাৎসল্য। মায়াবাদীদের মোহ অর্থাৎ সর্ব বিস্মরণময় ভাব,—নিজেকে ব্রহ্মরূপে সাযুজ্য মুক্তির চিন্তা। শান্তরসের সেবকদের গুরুগৌরব ভাব। দাস্য রসের সেবকগণের সেব্যভাব বা দাস্য ভাব ।

সঞ্চিন্ত্য তস্য সদৃশীং তনুমাপুরেতে — যাঁকে নিরন্তর চিন্তা করে লোকে সেই ভগবানের তুল্য তনু লাভ করে। অর্থাৎ ক্রোধ, ভীতি ও মোহ আবেশযুক্ত ব্যক্তিরা চিন্ময় মাত্রাংশে সাযুজ্য এবং অন্যেরা অর্থাৎ শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের সেবক সেবিকাগণ নিজ নিজ ভাবনার যোগ্য রূপ-গুণ লাভ করবে।

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি — যাঁর নিরন্তর চিন্তা করে চিন্তানুসারী তনু লাভ হয়, সেই আদিপুরুষ শ্রীগোবিন্দের আমি ভজনা করি।

ভক্তি দুই প্রকারের। বৈধী ভক্তিরাগাত্মিকা ভক্তি। কেবল শাস্ত্র ও গুরু-উপদেশক্রমে যে একটু শ্রদ্ধা ভক্তি উদিত হয়, তা শাস্ত্রবিধিযুক্ত হলে কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন ভাবময়ী হয় । ভাব উদিত হলে ভক্ত কৃষ্ণকৃপার পাত্র হতে পারেন। এই অবস্থা পেতে অনেক বিলম্ব ঘটে। একে বৈধীভক্তি বলে। রাগাত্মিকা ভক্তিই শ্রেষ্ঠ, শীঘ্র ফল দানকারী এবং কৃষ্ণাকর্ষণী। (১) গুরুগৌরব শান্তভাব, (২) সেব্যগত দাস্যভাব, (৩) সহজ প্রণয়গত সখ্যভাব, (৪) বাৎসল্য ভাব ও (৫) কামগত মধুরভাব—এই কয়টি ভাবই রাগাত্মিকা ভক্তির অন্তর্গত। ক্রোধ, ভীতিমোহ—এগুলি রাগাত্মিকা হয়েও ভক্তি নয়। কেননা এই তিনটি ভক্তির প্রাতিকূল্য ভাব আছে, আনুকূল্য ভাব নেই অর্থাৎ ভক্তিত্ব নেই ।

আবার শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর—এই পাঁচটির মধ্যে শান্ত ভাবে অনেকটা ঔদাসীন্য যুক্ত। অনুরাগ বা আসক্তি লুপ্ত প্রায়। তবে কিছুটা আনুকূল্য থাকায় তা ভক্তিমধ্যে পরিগণিত হয়। বাকী দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যমধুর—এই চারটি ভাবের মধ্যে প্রভূত রাগ বা আসক্তি আছে ।

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ (গীতা) যে যে ভাবে আমাতে প্রপত্তি স্বীকার করে, আমিও তার যোগ্য অনুরূপ পুরস্কার প্রদান করি। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রতিজ্ঞা ক্রমে (১) ক্রোধ, ভীতি, মোহরূপ রাগের অনুশীলনকারীরা সাযুজ্য মোহ লাভ করে। (২) শান্ত রাগের অনুশীলনকারীরা ব্রহ্ম পরমাত্মপরতারূপ শরীর লাভ করে। (৩) দাস্য ও সখ্যে অধিকার ভেদে যথাযোগ্য পুরুষ-প্রকৃতিময়ী শরীর লাভ হয় । (৪) বাৎসল্যে মাতৃ-পিতৃ ভাবের উপযোগী শরীর লাভ হয় । (৫) মধুর ভাবের ভক্তদের বিশুদ্ধ গোপীতনু লাভ হয়।


ব্রহ্মসংহিতা শ্লোক—৫৬ 

শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরম-পুরুষঃ কল্প-তরবো
দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামণি-গণময়ী তোয়ম্‌ অমৃতম্।
কথা গানং নাট্যং গমনম্‌-অপি বংশী প্রিয়-সখী
চিদানন্দং জ্যোতিঃ পরম্‌-অপি তদাস্বাদ্যম্‌-অপি চ॥ ৫৬ (১)॥

স যত্র ক্ষীরাব্ধিঃ স্রবতি সুরভীভ্যশ্চ সু-মহান্
নিমেষার্ধাখ্যো বা ব্রজতি ন হি যত্রাপি সময়ঃ।
ভজে শ্বেতদ্বীপং তম্‌-অহম্‌-ইহ গোলোকম্‌-ইতি যং
বিদন্তস্তে সন্তঃ ক্ষিতি-বিরল-চারাঃ কতিপয়ে ॥ ৫৬ (২)॥

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্যঃ ৫৬ (১)◼️
=========================

❝শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরম-পুরুষঃ কল্প-তরবো
দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামণি-গণময়ী তোয়ম্‌ অমৃতম্।
কথা গানং নাট্যং গমনম্‌-অপি বংশী প্রিয়-সখী
চিদানন্দং জ্যোতিঃ পরম্‌-অপি তদাস্বাদ্যম্‌-অপি চ॥ ৫৬ (১)॥❞

শ্রিয়ঃ কান্তাঃ—পরম লক্ষ্মীস্বরূপা শ্রীকৃষ্ণপ্রেয়সী শ্রীব্রজসুন্দরীগণই কান্তাবর্গ; কান্তঃ পরমপুরুষঃ—পরমপুরুষ স্বয়ং ভগবান শ্রীগোবিন্দই একমাত্র কান্ত; কল্পতরবঃ—সকলের সমস্ত বস্তু প্রদানে সমর্থ কল্পতরু; দ্রুমা—বৃক্ষসমূহ; ভূমিঃ চিত্তামণিগণময়ী—ভূমি চিন্তামণিময়ী অর্থাৎ তেজোময়ী ও অভীষ্ট প্রদারিনী; তোয়ম্ অমৃতম্—জল অমৃততুল্য স্বাদু; কথা গানং—কথাই গান; নাট্যম্‌ গমনম্ অপি—চলাফেরা নাচের মতো; বংশী প্রিয়সখী—বাঁশী প্রিয়সখীর মতো প্রিয়কার্যসাধিকা; চিদানন্দং জ্যোতিঃ—চিদানন্দরূপ বস্তুই জ্যোতি অর্থাৎ চন্দ্ৰ সূর্যের মতো সর্ব বস্তু প্রকাশক; পরম্ অপি তদ্―সেই সেই প্রকাশ্য বস্তুও চিদানন্দই; আস্বাদম্ অপি চ—এবং সেখানকার সবার আস্বাদ্য বা ভোগ্য।

অনুবাদ: বৃন্দাবনে কৃষ্ণকান্তাগণ সকলেই লক্ষ্মী, কান্ত পরমপুরুষ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, বৃক্ষমাত্রই চিন্ময় কল্পতরু, ভূমিমাত্রই চিন্তামণিতে (অর্থাৎ চিন্ময় মণিবিশেষ) পূর্ণ, জল অমৃত, সহজ কথাই গান, সহজ গমনই নৃত্য, বাঁশি প্রিয়সখী, পরম জ্যোতিস্বরূপ চন্দ্রসূর্য –সেই চিদানন্দময় বৃন্দাবন পরম আস্বাদ্য। ৫৬ (১)।

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 56(1)
 
শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরমপুরুষঃ — সেই বৃন্দাবনে কান্তা-কৃষ্ণশ্রেয়সী হচ্ছেন ব্রজলক্ষ্মী গোপীগণ, এবং কান্ত-পতি হচ্ছেন একজন, পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। লক্ষ্মী স্বরূপা সমস্ত গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণের আশ্রিতা। একমাত্র পুরুষ বা ভোক্তা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ।
 
কল্পতরবো দ্রুমাঃ — সমস্ত বৃক্ষই কৃষ্ণ প্রেম ফল দাতা। এই জগতে সাধারণত বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ বিশেষ বিশেষ ফুল, ফল, পত্রাদি প্রদান করে থাকে কিন্তু কল্প বৃক্ষ অত্যন্ত দুর্লভ কল্পবৃক্ষের কাছে যা কিছু চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। চিন্ময় ধামে চিন্ময় কল্পবৃক্ষলতাকীর্ণ সহজ সিদ্ধ বন নিত্য বিরাজিত । কিন্তু বৃন্দাবনবাসীরা তাদের কাছ থেকে ফুলফল বিনা আর কিছু চান না। শৃঙ্গার পুষ্প তরবস্তরবঃ সুরাণাম্। সেখানকার বৃক্ষরাজি কল্পবৃক্ষ এবং সেই বৃক্ষের ফুল দিয়ে ব্রজগোপিকারা শৃঙ্গার করে।
 
ভূমিশ্চিন্তামণিগণময়ী ভূমি চিন্তামণি দ্বারা রচিত। চিন্তামণি বলতে বোঝায় অভীষ্ট ফল প্রদানকারী রত্ন বিশেষ। চিন্তন মাত্রই সমস্ত অভীষ্ট পূরণ করবে এমন মণি। বৃন্দাবনের ভূমি চিন্তামণি, বৃন্দাবনের গৃহগুলি চিন্তামণি দিয়ে রচিত এবং শ্রীকৃষ্ণের দাসীদের চরণের ভূষণ চিন্তামণির। চিন্তামণিময় ভূমি রত্নের ভাণ্ডার।

চিন্তামণিগণ—দাসী-চরণ-ভূষণ।। (চৈঃচঃমঃ ১৪।২২১)

তোয়মমৃতম্ — সেখানকার জল হচ্ছে অমৃত। শ্রীকৃষ্ণ গীতার বললেন, আমি হচ্ছি জলের স্বাদ। বলা হয় জলই জীবন। কিন্তু পৃথিবীতে জল দূষিত। নানা কলুষিত পদার্থে দূষিত, ক্ষারময়, লবণাক্ত, রোগজীবাণুযুক্ত বিষাক্ত, আয়ুক্ষয়কর। ভীষ্মদেব ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন, কলিযুগের মানুষ জল কিনে খাবে। (মহাভারত) শ্রীবৃন্দাবনে জল হচ্ছে প্রেমামৃত স্বরূপ আস্বাদ্য।
 
কথা গানং নাট্যং গমনম্‌-অপি – সেখানে কথা হচ্ছে গান, চলাফেরা হচ্ছে নৃত্য। শ্রীবৃন্দাবনের লোকেদের স্বাভাবিত কথা দিব্য সঙ্গীতের মতো আর তাদের স্বাভাবিক চলাফেরা নৃত্যের মতো ।

সহজ লোকের কথা—যাহাঁ দিব্যগীত।
সহজ গমন করে, যৈছে নৃত্য প্রতীত॥

        ————(চৈঃচঃম ১৪। ২২৪)

পৃথিবীতে কলিপ্রভাবিত কথাবার্তা হচ্ছে হট্টগোল ও কলহ বিবাদ প্রায়। আর মানুষের চলাফেরা আচার আচরণ প্রায়ই বিরক্তিকর বা উদ্বেগকর। এখানে গান বা নাচ শিখতে হয়। বেশীর ভাগ নাচ বা গানই ভগবৎভক্তিশূন্য। বৃন্দাবনের স্বাভাবিক কথাবার্তা চলাফেরাই শ্রদ্ধা প্রীতি ভক্তিপূর্ণ স্বচ্ছন্দ গীত ও নৃত্য।

বংশী প্রিয় সখী — শ্রীকৃষ্ণের হাতের বাঁশী হচ্ছে তাঁর নিত্য সহচরী। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ নিরন্তর বংশীবাদন করেন, যা হচ্ছে তাঁর প্রিয় সখী।

কৃষ্ণ-বংশী করে যাহা প্রিয়সখী কাজ। (চৈঃ চঃ ম ১৪।২২৬)

বংশী চিন্ময় ব্যক্তিত্ব। জড় বস্তু নয়। প্রিয় সখীর মতো কাজ করে। যিনি ছায়ার মতো সবসময় শ্রীকৃষ্ণকে অনুসরণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা বা মনোভাব বুঝে সেই মতো ক্রিয়াশীল হন। বংশী শুধু বিচিত্র সুর মূর্ছনা তুলে বাদিত হয় তা নয়, শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সাধনের অনুকূল পরিবেশও প্রকাশ করে।

চিদানন্দং জ্যোতিঃ পরম্‌-অপি তদাস্বাদ্যম্‌-অপি চ — সেই স্থান চিদানন্দ জ্যোতির দ্বারা উদ্ভাসিত। শ্রীবৃন্দাবন ধামই কেবল একমাত্র আস্বাদ্য। সর্বত্র চিন্ময় ও আনন্দময় জ্যোতি বা আলো অনুভূত হয়। শ্রীভগবানের অঙ্গজ্যোতিতে জ্যোতিষ্মান। এমন নয় যে পৃথিবীর মতো সূর্য বা চন্দ্রের আলো লাগবে, কিংবা দীপ জ্বালাতে হবে কিংবা বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। জড়জগতের আলো যখন তখন আমাদের বিরক্তিকর ঠেকতেও পারে, কিন্তু সেখানকার দিব্য জ্যোতি চিন্ময় পরমানন্দ প্রদান করে। সুতরাং যেখানে এরকম কান্তা, কান্ত, বৃক্ষলতা, ভূমি, জল, কথা, গমন, বংশীবাদ্য, জ্যোতি, আস্বাদন অর্থাৎ চৌষট্টি কলার অচিন্ত্য চমৎকারিতা, সেই বৃন্দাবনই পরমানন্দময় স্থান।

◼️আধ্যাত্মিক তাৎপর্য্যঃ ৫৬ (২)◼️
=========================

❝স যত্র ক্ষীরাব্ধিঃ স্রবতি সুরভীভ্যশ্চ সু-মহান্
নিমেষার্ধাখ্যো বা ব্রজতি ন হি যত্রাপি সময়ঃ।
ভজে শ্বেতদ্বীপং তম্‌-অহম্‌-ইহ গোলোকম্‌-ইতি যং
বিদন্তস্তে সন্তঃ ক্ষিতি-বিরল-চারাঃ কতিপয়ে ॥ ৫৬ (২)॥❞

সঃ—সেই; যত্র—যে স্থানে; ক্ষীরাব্ধি—ক্ষীরের সমুদ্র; স্রবতি—নিরন্তর স্রাবিত হচ্ছে; সুরভীভ্যঃ—কোটি কোটি সুরভী থেকে;—এবং; সুমহান্—চিন্ময়; নিমেষার্ধক্য—নিমেষার্ধ নামক; বা—অথবা; ব্রজতি—গমন করে; ন হি—কখনই না; যত্র—যে স্থানে; অপি সময়—সময়ও; ভজে—ভজনা করি; শ্বেতদ্বীপম্‌—শ্বেতদ্বীপ নামক ধামকে; তম্—সেই; অহম—আমি; ইহ—এই ব্রহ্মাণ্ডে; গোলোকম্-ইতি—গোলোক বলে; যং—যাকে; বিদন্তঃ—জানেন; তো—সেই; সন্তঃ—ভগবৎ নিষ্ঠ সাধুগণ; ক্ষিতিবিরলচারাঃ—জন জগতে অতি অল্প সংখ্যক; কতিপয়ে—কেউ কেউ ।

অনুবাদ: যে স্থানে কোটি কোটি সুরভী গাভী থেকে চিন্ময় ক্ষীরসমুদ্র নিরন্তর স্রাবিত হচ্ছে। যে স্থানে অতীত ও ভবিষ্যৎ খণ্ডরহিত চিন্ময় কাল—নিত্য বর্তমান। সুতরাং এক নিমেষের জন্যও অতীত ধর্ম প্রাপ্ত হয় না। সেই ধামকে এই জড়জগতে বিরলচর অতি স্বল্প সংখ্যার সাধু ব্যক্তিই গোলোক বলে জানেন। সেই শ্বেতদ্বীপরূপ পরমপীঠকে আমি ভজন করি।॥ ৫৬ (২)॥

ব্রহ্মসংহিতা ✸Brahma Samhita✸Sloka 56(2)

স যত্র ক্ষীরাব্ধিঃ স্রবতি সুরভীভ্যশ্চ সুমহান্ — যেখানে সেই সুমহান্ ক্ষীরের সমুদ্র নিরন্তর স্রাবিত হচ্ছে কোটি কোটি সুরভী গাভী থেকে। গোদুগ্ধ এই জগতে একটি সুষম খাদ্য। যদিও বা লোকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কখনও কখনও মারাত্মক ভেজাল মিশিয়ে দুধ বিক্রি করে। ঊর্ধ্বলোকগুলিতে সুরভী দুধ মনপ্রাণ স্নিগ্ধ সুন্দর করে। গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের গাভীরা কৃষ্ণপ্রেমরসে হৃদয় অভিষিক্ত করে।

নিমেষার্ধাখ্যো বা ব্রজতি ন হি যত্রাপি সময়ঃ — নিমেষ মাত্র সময়ও অতীত হয় না, বা ভবিষ্যতে গমন করে না। ভূত ও ভবিষ্যদ্ রূপ খণ্ডরহিত চিন্ময় কাল নিত্য বর্তমান। জড় ব্রহ্মাণ্ড কালের অধীন। আমরা কালের অধীন। কিন্তু চিন্ময় জগতে কাল শ্রীভগবানের অধীন। জড়জগতে কাল – অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই তিন ভাগে বিচার করা যায়। চিন্ময় জগতে কাল বা সময়কে সেভাবে গণনা করা যায় না। সেখানে অতীত বা ভবিষ্যৎ নেই। যদি কাল বলে কিছু থাকে তবে তা নিত্য বর্তমান বলা হয়। সেখানে জড়জাগতিক কালের কোনও প্রভাব নেই ।

ভজে শ্বেতদ্বীপং তম্‌-অহম্‌-ইহ গোলোকম্‌-ইতি যং — সেই শ্বেতদ্বীপ রূপ পরমপীঠকে আমি ভজন করি। যাকে এই ব্রহ্মাণ্ডের লোক গোলোক বলে। জড় ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে চিন্ময় বৈকুণ্ঠের আকাশের সর্বোচ্চ লোক হচ্ছে শ্রীগোলোক বৃন্দাবন বা শ্রীরাধাকৃষ্ণলোক।

বিদন্তস্তে সন্তঃ ক্ষিতি-বিরল-চারাঃ কতিপয়ে — জড়জগতে অতিঅল্প সংখ্যক কতিপয় ভগবৎনিষ্ঠ সাধুগণই শ্রীগোলোকধাম সম্বন্ধে জানেন ।

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ব্যাখ্যা করছেন, যে স্থান জীবগণের সর্বোৎকৃষ্ট ভজন দ্বারা প্রাপ্য, তা সম্পূর্ণ চিন্ময় হলেও নির্বিশেষ নয়। ক্রোধ, ভয়, ও মোহ দ্বারা নির্বশেষ ব্রহ্ম ধাম লাভ করা যায়। ভক্তগণ রস অনুসারে চিন্ময় জগতের পরব্যোম বৈকুণ্ঠ বা তার উপরে গোলোক লাভ করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে অত্যন্ত বিশুদ্ধ বলে সেই ধামই ‘শ্বেতদ্বীপ’। জড়জগতে যাঁরা চরম রস ভক্তিসিদ্ধি লাভ করেন, তাঁরা এই জগতে বৃন্দাবনে ও নবদ্বীপে সেই শ্বেতদ্বীপ তত্ত্বকে অবলোকন করে ‘গোলোক’ বলে মনে করেন। সেই গোলোকে কান্ত (সুন্দর, মনোরম), বৃক্ষলতা, ভূমি পর্বত, নদী বনাদি, জল, কথা, গমন, বংশীবাদ্য, চন্দ্র সূর্য আস্বাদ্য, চৌষট্টি কলার অচিন্ত্য চমৎকারিতা, গাভী’সকল অমৃতনিঃসৃত ক্ষীর, নিত্য বর্তমান চিন্ময় কাল সর্বদা শোভা পাচ্ছে। এই মায়িক ঝলক যত রকমের বিশেষ বিচিত্রতা দেখা যায়, সেই সমস্তই এবং তার চোখের আরও অনেক বিশেষ চিন্ময় জগতে আছে।

রাধিকার প্রণয়-মহিমা, রাধিকা যে কৃষ্ণরস অনুভব করেন, এবং সেই অনুভবে রাধিকা যে সুখ লাভ করেন—এই তিন ভাব কৃষ্ণের আস্বাদ্য হলে কৃষ্ণ যে গৌরত্ব লাভ করেন, তাই’ই তাঁর প্রদর্শিত রসসেবা সুখ। তা-ও সেই শ্বেতদ্বীপে নিত্য বর্তমান ।

x

Like it? Share with your friends!

221
190 shares, 221 points
daextlwcn_print_scripts(true);

Thanks for your interest joining to Bangla Kobita Club community.

Something went wrong.

Subscribe to Join Our Community List

Community grow with You. [Verify and Confirm your Email]