Join to Our Community
Community Grows With You

চাতুর্মাস্য ব্রত (Chaturmasya Vrata) কি? ✤ কি কি গ্রহণযোগ্য ও বর্জনীয়?

এই অধ্যায়ে বর্ণন করছি চাতুর্মাস্য ব্রত (Chaturmasya vrata) কি? চাতুর্মাস্যে কি কি গ্রহণযোগ্য ও বর্জনীয়? চাতুর্মাস্য ব্রতের নিয়মাবলী কি? প্রভৃতি … 

এই শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত মোট চার মাস হল চাতুর্মাস্যশ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাস

চাতুর্মাস্য ব্রত কি? 

(What is Chaturmasya vrata)

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

শ্রীভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে শ্বেতদ্বীপে অনন্ত শেষনাগের শয্যায় নিদ্রিত হন। বর্ষার চার মাস। বলা হয় যেদিন তিনি শয়নে যান, সেই দিনটি হলো শয়ন একাদশী বা  শয়নী একাদশী (জগন্নাথ রথযাত্রার পর আষাঢ়ী শুক্লা একাদশী)। তারপর যেদিন তিনি পাশ ফিরে শয়ন করেন, সেদিন পার্শ্ব একাদশী (ভাদ্র শুক্লা একাদশী)। যেদিন তিনি নিদ্রা থেকে উত্থিত হন, সেদিন উত্থান একাদশী (কার্তিক শুক্লা একাদশী)।

❝ আষাঢ় শুক্লদ্বাদশ্যাং পৌর্ণমাস্যামথাপি বা।
চাতুর্মাস্য ব্রতারম্ভং কুর্যাৎ কর্কটসংক্ৰমে ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: চাতুর্মাস্য ব্রতকারীরা কেউ শয়ন-একাদশী থেকে উত্থান-একাদশী পর্যন্ত, কেউ আষাঢ় মাসের গুরুপূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের হৈমন্তী রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত, আবার কেউ কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত যথাবিধি ব্রত পালন করে থাকেন। তবে যে দিনটিতেই শুরু করবেন , তার চার মাস পরে ব্রত সমাপন করবেন। ।

জাগ্রত হয়ে তিনি হিসাব নেন চিত্রগুপ্তের কাছে এই চারমাস কে কতবেশি হরিভজন করেছেন।

বছরের এই চারি মাস প্রাকৃতিক কারণে মানুষের দেহ ও মনে রজো ও তমোগুণী প্রভাব অধিক দেখা যায়। ফলে আমাদের সমাজে লক্ষ্য করা যায়, যত রকমের দুর্যোগ, অশান্তি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংসা বছরের সবসময় হলেও এ চার মাসে সর্বাধিক। পশু, পাখি, কীট, পতঙ্গেরাও এ সময়ে বেশি উগ্র প্রকৃতির হয়। শরীর ও মনের উত্তেজনা অধিক থাকে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্যাদি প্রবল হয় । অর্থাৎ যারা লক্ষ্মীমন্ত হতে চায়, তারা অবশ্যই এ সময় ভক্তিযোগ সাধন করবে। সংযত থাকবে। সেজন্য দিনের বেলা ঘুমানো নিষেধ, শ্রীহরির বিগ্রহ অর্চনা করা, স্নান করা ও শুচি থাকা, হরিনাম জপ করা, গীতা-ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত অধ্যয়ন করা, ঘর-দুয়ার পরিষ্কার রাখা, সাত্ত্বিক খাবার গ্রহণ করা, সংযতভাবে কথা বলা, শুভ কাজে যুক্ত থাকা দরকার।

ভক্তগণ কৃষ্ণভক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে চাতুর্মাস্য ব্রত নিয়ম করেন। শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (১৫/১১৩) বলা হয়েছে,

❝চতুর্মাসেষু কর্তব্যং কৃষ্ণভক্তি বিবৃদ্ধয়ে॥❞ ‌

অনুবাদ: কৃষ্ণভক্তি বৃদ্ধির জন্যই চাতুর্মাস্য ব্রত কর্তব্য।

ভবিষ্য পুরাণে বলা হয়েছে,

❝ যো বিনা নিয়মং মর্ত্যো ব্রতং বা জপ্যমেব বা।
চাতুর্মাস্য নয়েন্ মূর্খো জীবন্নপি মৃতো হি সঃ ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: যে ব্যক্তি নিয়ম, ব্রত বা হরিনাম জপ ছাড়া এ চার মাস অতিবাহিত করে, সে ব্যক্তি মূর্খ, সে বেঁচে থেকেও মরার মতো ।

সুতরাং সকলের পক্ষেই চাতুর্মাস্য ব্ৰত করা উচিত। শ্রীব্রহ্মা নারদমুনিকে বলছেন, “হে নারদ, চাতুর্মাস্য ব্রত ভক্তি সহকারে পালন করলে মানুষ পরমাগতি লাভ করার সুযোগ পাবে।


চাতুর্মাস্যে কি কি গ্রহণযোগ্য ও বর্জনীয়?

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

ব্রহ্মচারী চারি মাসশ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিনকার্তিক। 

স্কন্দ পুরাণের নাগরখন্ডে বলা হয়েছে-

❝ শ্রাবণে বর্জয়েৎ শাকং দধি ভাদ্রপদে তথা।
দুগ্ধম্ আশ্বযুজে মাসি কার্তিকে চামিষং ত্যজেৎ ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: শ্রাবণে শাক, ভাদ্রে দই, আশ্বিনে দুধ এবং কার্তিকে মাষকলাই ডাল খাওয়া চলবে না।  কারণ এই সময়ে এই দ্রব্যগুলি রোগ সৃষ্টি করে। মন বিক্ষিপ্ত করে।

শ্রাবণে অসংখ্য পোকামাকড় শাকগুলোতে ডিম পাড়ে। অসংখ্য সূক্ষ্ম জীবাণু চোখেও ধরা পড়ে না, কিন্তু সেগুলো উদরের নানা রোগ সৃষ্টি করে। তাই শাক বর্জনীয়। ভাদ্র মাসে দই এবং আশ্বিন মাসে দুধও হজমের পক্ষে ভালো নয়। তবে, বাচ্চারা মাতৃস্তন পান করলে ভালো নয়। তবে, বাচ্চারা মাতৃস্তন পান করলে কোনো ক্ষতি নেই। দুধ থেকে ছানা, পায়সান্ন প্রভৃতি তৈরি করে আহারে দোষ নেই। কার্তিক মাসে আমাদের বঙ্গদেশে মাষকলাই খেয়ে বহু লোককে অসুস্থ হতেও প্রচুর দেখা যায়। পেট খারাপ হলে মন খারাপ হয়। তখন মানুষের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায় ।

স্কন্দপুরাণ অনুসারে, ভাদ্র মাসে দইয়ের মাঝে বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ মহাজন শিব অধিষ্ঠান করেন, তাই এ মাসে দই ভক্ষণ করলে তাঁর চরণে অপরাধ হয়, যার ফলে ভক্তি নষ্ট হয়ে যায়।


চাতুর্মাস্য ব্রতের মন্ত্র ও সময়সূচী

 

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত আরম্ভ করবার মন্ত্রঃ ◼️
=============================

❝ চতুরো বার্ষিকান মাসান দেবস্য উত্থাপন অবধি।
ইমং করিষ্যে নিয়মং নিৰ্ব্বিঘ্নং কুরু মেহচ্যুত ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: হে অচ্যুত! হে শ্রীকৃষ্ণ ! উত্থান একাদশী তিথি পর্যন্ত বাস চতুষ্টয় এই নিয়মসেবা ব্রত পালন করব। আপনি আমাকে নির্বিঘ্ন করুন।

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত আরম্ভকালীন প্রার্থনা মন্ত্রঃ ◼️
=================================

❝ সুপ্তে ত্বয়ি জগন্নাথ জগৎ শুপ্তং ভবেদিদম্।
বিবুদ্ধে তু বিবুধ্যেত প্রসন্নো যে ভবাচ্যুত ॥ ❞ ‌

শ্রীহরি যে চারিমাস শয়ন করিয়া থাকেন, সেই চারি মাসেই এই ব্রত পালিত হয়। সেই জন্য প্রার্থনা – হে জগন্নাথ ! আপনি শয়ন করলে এই জগৎ সুপ্ত হয় এবং আপনার জাগরণে জগৎ জাগরিত হয়। হে অচ্যুত, আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। উদ্দেশ্য—আপনার প্রশন্নতাক্রমে আপনার অহৈতুক সেবা লাভ করে ধন্য হব।

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত আরম্ভকালীন সঙ্কল্প মন্ত্রঃ ◼️
=================================

❝ ইদং ব্ৰতং ময়া দেব ! গৃহীতং পুরতস্তব।
নির্বিঘ্নাং সিদ্ধিমাপ্নোতু প্রসন্নে ত্বয়ি কেশব॥
গৃহীতেহস্মিন ব্রতে দেব যদ্যপূর্ণে তহংম্রিয়ে।
ত্বন্মে ভবতু সংপূর্ণং ত্বৎপ্রসাদাৎজনাৰ্দ্দন ॥ ❞ ‌

                                         ━┉┈┈( সনৎকুমার )

অনুবাদ: হে কেশব! আমি আপনার সন্মুখে এই ব্রত গ্রহণ করলাম। আপনার অনুগ্রহে তা যেন নির্বিঘ্নে সিদ্ধ হয়। হে দেব! এই গৃহীত ব্রত শেষ হবার পূর্বে যদি মৃত্যু হয়, তবুও, হে জনার্দন যেন আপনার প্রসাদে তা যেন সম্পূর্ণ হয়।

——————————————————————
১ম মাস (শ্রাবণ ) = শ্রীধর মাস = শাক আহার বর্জন
——————————————————————

সময়সূচী          ━ চান্দ্র শ্রাবণ [২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার  – ১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার

বর্জনীয়           ━ সকল প্রকার শাক, লাল ও সবুজ পালং শাক এড়িয়ে চলতে হবে।

গ্রহণযোগ্য     ━ ধনে পাতা, মেথি পাতা, পুদিনা পাতা, কারি পাতা, নিম পাতা, বাঁধাকপি, ফুলকপি শাক না হওয়ায় খাওয়া যেতে পারে।

 ——————————————————————
২য়  মাস (ভাদ্র) = হৃষিকেশ মাস = দই আহার বর্জন
——————————————————————

সময়সূচী          ━ চান্দ্র ভাদ্র [১৯ আগস্ট ২০২৪, সোমবার – ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার]

বর্জনীয়            ━ প্রধানত দই এবং দই দিয়ে তৈরি উপদান যেমন লস্যি, কারি, বাটার মিল্ক প্রভৃতি এড়িয়ে চলতে হবে।     

গ্রহণযোগ্য      ━ চরণামৃতে দই থাকলেও সম্মানের সাথে গ্রহণ করা উচিৎ। 

——————————————————————
৩য়  মাস (আশ্বিন) = পদ্মনাভ মাস = দুধ আহার বর্জন
——————————————————————

সময়সূচী          ━ চান্দ্র আশ্বিন [১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বুধবার – ১৬ অক্টোবর ২০২৪, বুধবার]

বর্জনীয়            ━ প্রধানত দুধ এবং দুধ দিয়ে তৈরি উপদান যেমন দুধ দিয়ে তৈরি পায়েস, মিল্ক শেক, আইসক্রিম, কনডেন্সড মিল্ক প্রভৃতি  এড়িয়ে চলতে হবে।   

গ্রহণযোগ্য      ━ দুধের মিষ্টি যেমন রসগোল্লা, সন্দেশ; দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন ছানা, পনীর যেহেতু দুধ রূপান্তরিত এবং ব্যবহৃত। চরণামৃতে দই থাকলেও সম্মানের সাথে গ্রহণ করা উচিৎ।    

———————————————————————————————
৪র্থ  মাস (কার্তিক) = দামোদর মাস = বিউলি /উরদ/ মাষকলাই ডাল আহার বর্জন
———————————————————————————————

সময়সূচী          ━ চান্দ্র কার্ত্তিক [১৭ অক্টোবর ২০২৪, বৃহস্পতিবার – ১৫ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার]

বর্জনীয়            ━ প্রধানত বিউলির ডাল এবং বিউলির ডাল দিয়ে তৈরি উপদান যেমন ইডলি, ধোসা, বিউলির ডালের বড়ি, অমৃতি প্রভৃতি এড়িয়ে চলতে হবে। তাছাড়া কার্তিক মাসে শিম, বেগুন, পটল, কলমি শাক, বটবটি, দেশী লাউ, মুলো ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।

গ্রহণযোগ্য      ━ বিউলির ডাল বাদে যে কোন ডালই খাওয়া যাবে।

 

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত সমাপ্তির মন্ত্রঃ ◼️
===========================

❝ ইদং ব্ৰতং ময়া দেব ! কৃতং প্রীতৌ তব প্রভো।
ন্যূনং সংপূর্ণতাং যা তু ত্বৎ প্রসাদাৎ জনাৰ্দ্দন ॥ ❞ ‌

অনুবাদ: কাঠক গৃহ্যের মতে যতির পক্ষে এই চারমাস একইস্থানে বাস করা উচিত।  ( তিথিতত্ব )



শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও চাতুর্মাস্য ব্রত

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

গৌড়ীয় বৈষ্ণব জীবনে চাতুর্মাস্য ব্রত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদা বঙ্গদেশের বৈষ্ণবগণ রথযাত্রার পূর্বেই সদলবলে পুরীধাম পৌঁছে যেতেন। সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে সংকীর্তনরঙ্গে তারা রথযাত্রা উদযাপন করতেন। রথযাত্রার পর সেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে থেকে এই চারটি মাস অতিবাহিত করতেন।

❝ চারিমাস রহিলা সবে মহাপ্রভু-সঙ্গে।
    জগন্নাথের নানা যাত্রা দেখে মহারঙ্গে ॥ ❞ ‌

                                                ─━ (চৈতন্য চরিতামৃত, মধ্য, ১৫/১৬)

এ চারটি মাস তারা শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর সঙ্গে জগন্নাথদেবের নানারকম উৎসব, দীপাবলী, উত্থান-দ্বাদশীযাত্রা অংশগ্রহণ করতেন।

❝ এইমত রাসযাত্রা, আর দীপাবলী।
উত্থান-দ্বাদশীযাত্রা দেখিলা সকলি ॥ ❞ ‌

                                                ─━ (চৈতন্য চরিতামৃত, মধ্য ১৫/৩৬)

উত্থান একাদশীর পর রাসপূর্ণিমায় চাতুর্মাস্য সমাপন পূর্বক তারা নিজ নিজ গৃহে ফিরে আসতেন। 

❝ তবে মহাপ্রভু সব ভক্তে বোলাইল।
‘গৌড়দেশে যাহ সবে’ বিদায় করিল ॥ ❞ ‌

                                                ─━ (চৈতন্য চরিতামৃত, মধ্য ১৫/৩৯)

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরমগুরু শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরী মহাশয়ও বৃন্দাবন যাবার পথে রেমুণায় গ্রীষ্মকালে চন্দনযাত্রা উৎসব প্রবর্তন করে নীলাচল প্রত্যাবর্তন করতেন এবং সেখানেই চাতুর্মাস্য পালন করতেন।

❝ গ্রীষ্মকাল অন্তে পুনঃ নীলাচলে গেলা।
নীলাচলে চাতুর্মাস্য আনন্দে রহিলা ॥ ❞

                                                ─━ (চৈতন্য চরিতামৃত, মধ্য ৪/১৬৯)

শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক – বছরের এই চার মাসে বর্ষা লেগেই থাকে। এ সময়টি ভ্রমণের পক্ষে অনুকুল নয়, তাই পরিব্রাজক সন্ন্যাসীরা তাদের প্রচার পরিক্রমার বিশ্রাম দিয়ে একটি স্থানকে কেন্দ্র করেই ভজনে মনোনিবেশ করতেন।


চাতুর্মাস্য ব্রতের নিয়মাবলী

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রতে কি করনীয় ◼️
=========================

চাতুর্মাস্য ব্রতের  নিয়ম ভবিষ্য পুরাণে, স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। নিয়মগুলি হলো :-

১) ভোরে উঠে বিশেষত ব্রহ্মমুহূর্তে প্রাতঃকৃত্য সেরে পবিত্র জলে স্নান করতে হবে। ভক্তগণ তো ভোর চারটায় স্নান সেরে মঙ্গল আরতিতে যোগ দেন।  যত্ন নেন কোনও দিন যেন ফাঁকি না যায়।  মঙ্গলময় শ্রীহরির কৃপাকটাক্ষ লাভের উপযুক্ত ব্রাহ্মমুহূর্তে শুচিশুদ্ধ হয়ে জেগে থাকা বাঞ্ছনীয়।

২) হরিনাম জপ করতে হবে। যাঁরা হরিনাম করেন, তাঁদের আরো বেশি করে হরিনাম জপ করা উচিত।   যারা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন না, তাঁরা অবশ্যই শুরু করবেন। কলিবদ্ধ জীবের সদ্গতি লাভের একমাত্র উপায় হরিনাম। আমাদের মনকে সুরক্ষা দান করে মন্ত্র হরিনাম।

৩) প্রতিদিন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ কিংবা আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভগবানের কথা, ভক্তের কথা আলোচনার মাধ্যমেই আমাদের হৃদয়ের কলুষতা দূর হয়ে আশা ও আনন্দ সঞ্চার হয়ে থাকে। যারা ভগবৎ কথায় সময় দিতে পারে না, তারা আজেবাজে কথায় সময় পেয়ে বসে।

৪) প্রজল্প (তর্ক, গালগল্প, অনর্থক কাজ বা অলস সময়) এড়িয়ে চলতে হবে। কলিযুগের মানুষ আমরা তর্ক করতে, ঝগড়া বাধাতে, গালগল্পে খুবই উন্মুখ হয়ে থাকি।  টিভি দেখা, নভেল পড়াও এর অন্তর্ভুক্ত।  এসব অসৎসঙ্গ দোষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

৫) শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (১৫/১২২) বলা হয়েছে,

❝ জপ হোমাদ্যনুষ্ঠানং নামসংকীর্তনস্তথা ।
স্বীকৃত্য প্রার্থয়েদ্দেব্য গৃহীত নিয়মোবুধঃ ॥ ❞

অনুবাদ: বিজ্ঞব্যাক্তিগণ জপযজ্ঞাদি অনুষ্ঠান ও শ্রীনামসংকীর্তন প্রভৃতি ব্রতনিয়ম স্বীকার করবেন।

৬) শ্রীহরি অর্চন কিংবা শ্রীহরিভক্তিমূলক অন্য কোনও সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে।  সবসময় জানতে হবে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।  আচারে হোক, প্রচারে হোক যেকোনও সেবায় সবসময় সংযুক্ত থাকতে হবে, তাহলেই আমরা ভালো থাকবো।

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রতে কি করনীয় নয় ◼️
============================

 শ্রীল প্রভুপাদ একইভাবে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের মধ্যলীলার ৪/১৬৯ শ্লোকের তাৎপর্যে বলেছেন, “শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্র মাসে দই, আশ্বিন মাসে দুধ ও কার্তিক মাসে সকল প্রকার আমিষ আহার পরিত্যাগ করতে হয়। আমিষ আহার মানে হচ্ছে মাছ-মাংস আহার। তেমনই, মসুর ডাল ও কলাইয়ের ডালকেও আমিষ বলে গণনা করা হয়। এই দুটি ভালে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে এবং অধিক প্রোটিন যুক্ত খাদ্যকে আমিষ বলে বিবেচনা করা হয়। মূল কথা হচ্ছে, বর্ষার এই চার মাসে ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকর আহারাদি পরিত্যাগ করার অনুশীলন করতে হয়।”

সার্বিক ব্রতনিয়ম থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও ব্রতকারী ব্যক্তিগত কিছু কিছু ব্রতসংকল্প করে থাকেন। তবে সেই আচরণগুলিও শাস্ত্রসম্মত।  যেমন-

(১) অনেকে সারাদিনে একবার মাত্র হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন; আবার অনেকে ফলমূল প্রসাদ মাত্র গ্রহণ করেন। বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে এই ব্রত ধারণ করেন । তবে, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যারা তর্ক করে, কথা বাড়ায়, তারা ব্রত ভঙ্গ করছে বলে বুঝতে হবে।

(২) শিম, বরবটি, বেগুন, পটল, আচার প্রভৃতি জিনিসও অনেকে বর্জন করে চলেন;

(৩) অনেকে মাটিতে শয়ন করেন।

(৪) অনেকে ক্ষৌরকর্ম বাদ দেন।

(৫) অনেকে কেবল হরিনাম ছাড়া অন্য কথা বলেন না, তাকে মৌন ভাব বলা হয়।

(৬) অনেকে থালা-বাটি ব্যবহার না করে কলাপাতা বা পদ্মপাতা ব্যবহার করেন।

(৭) আবার অনেকে শরীরে তেল মাখেন না।

(৮) অনেকে এ সময় তীর্থ দর্শনে বের হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বর্ষার চার মাস দক্ষিণ ভারতের তীর্থ পর্যটন এবং হরিনাম প্রচার করেছিলেন।

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত ও নিয়মসেবা:  মাসের ক্ষেত্রে নিয়ম ◼️
===========================================

(১) শ্রাবণে :- শাক ভক্ষণে উদর রোগ। (৩) আশ্বিনে :- দুধ ভক্ষণে আমাশয় ।
(২) ভাদ্রে :- দধি ভক্ষণে উদর রোগ। (৪) কার্তিকে :- আমিষ ভক্ষণে রোগ বৃদ্ধি

শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এই চার মাস লাউ, শিম, পটল, বরবটি, বেগুন পুঁইশাক, মাষকলাই ও আমিষ ভক্ষণ করলে শত জন্মের সুকৃতি নষ্ট হয়।

দুধের সঙ্গে লবণ ভক্ষণ গো-মাংস তুল্য।

রাত্রে টক, তিতা ও শাক ভক্ষণে দরিদ্রতা । – হরিভক্তিবিলাস

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রত ও নিয়মসেবা:  তিথির ক্ষেত্রে নিয়ম ◼️
===========================================

প্রতিপদ :- কুমড়ো ভক্ষণে অর্থহানি।

দ্বিতীয়া :- বেগুন ভক্ষণে হরিভজনে বিঘ্ন।

তৃতীয়া :- পটল ভক্ষণে শত্রু বৃদ্ধি।

চতুর্থী :- মূলা ভক্ষণে ধর্মহানি।

পঞ্চমী :- বেল ভক্ষণে কলঙ্ক ।

ষষ্ঠী :- নিমপাতা ভক্ষণে পক্ষীযোনি প্রাপ্ত।

সপ্তমী :- তাল ভক্ষণে শরীর বিনাশ।

অষ্টমী :- নারিকেল ভক্ষণে মূর্খতা প্রাপ্ত।

নবমী :- লাউ ভক্ষণে গো-মাংস তুল্য।

দশমী :- কলমিশাক ভক্ষণে গো-হত্যা পাপ ।

একাদশী :- শিম ভক্ষণে মহা-পাপ।

দ্বাদশী :- পুঁইশাক ভক্ষণে ব্রহ্মহত্যা পাপ।

ত্রয়োদশী :- বেগুন ভক্ষণে পুত্রহানি।

চতুর্দশী :- মাষকলাই ভক্ষণে চির রোগ।

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা :- মাংস ভক্ষনে মহা-মহা পাপ।

◼️ চাতুর্মাস্য ব্রতের  গুরুত্ব ◼️
========================

এই চাতুর্মাস্য ব্রতের ব্রতকারীরা কেউ শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত, কেউ আষাঢ় মাসের গুরু পূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের হৈমন্তী রাস পূর্ণিমা পর্যন্ত, আবার কেউ কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত- এইভাবে পালন করে থাকেন।  মোটামুটি যে দিন শুরু করবেন তার চার মাস পরে সমাপন করবেন।

এই ব্রত ফলে মন সুন্দর হয়, শরীর ও প্রাণ সুন্দর হয়। কারণ, শ্রীবিষ্ণু শয়ণ করলে লক্ষ্মীদেবী তাঁর পাদপদ্ম সেবা করতে থাকেন, আর সুন্দরভাবে ভগবান নিদ্রিত হন। সেই বিষ্ণু জনার্দন পরমাত্মারূপে জীব-হৃদয়ে বিদ্যমান। বিষ্ণু যখন সুন্দরভাবে নিদ্রা যান, তখন লক্ষ্মীদেবী চিন্তা করেন, পৃথিবীতে মানুষেরা খুব সুন্দরভাবে ধর্ম আচরণ করছে, তাই লক্ষ্মীদেবী তুষ্ট দৃষ্টিপাত করেন। সেই দৃষ্টিপাতে লক্ষ্মীমন্ত হয়। খাদ্য অভাব হয় না। অশান্তি বাড়ে না । আনন্দ বৃদ্ধি হয় । লোকে সুখে- শান্তিতে জীবনযাপন করে। কিন্তু, বিষ্ণুর নিদ্রা যখন ঠিক হয় না, সুন্দরভাবে বিশ্রাম নিতে পারেন না, তখন লক্ষ্মীদেবী চিন্তা করেন, পৃথিবীতে মানুষেরা উদ্ধৃত প্রকৃতির হয়েছে, অশিষ্ট-অনিষ্টাচারী হচ্ছে, অধর্ম আচরণ করছে, তাই লক্ষ্মী রুষ্ট দৃষ্টিপাত করেন। সেই দৃষ্টিপাতে মানুষ লক্ষ্মীছাড়া হয়। খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। অশান্তি বৃদ্ধি পায় । অসুখ বৃদ্ধি পায়। লোকে দুঃখে-কষ্টে জীবন কাটায়।

❝ এবং চ কুর্বতো মাসাংশ্চতুরো যান্তি বৈ সুখম্।
অন্যথা প্রভবেদ্ দুঃখম্ অনাবৃষ্টিশ্চ জায়তে ॥ ❞

অনুবাদ: এভাবে চারি মাস ব্রত পালন করলে সুখে যাপন হবে।  নতুবা দুঃখের প্রভাব বৃদ্ধি হবে, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য দুর্বিপাক লেগে থাকবে।

সীতাদেবী অপহৃত হলেও শ্রীরামচন্দ্র রাবণের লংকারাজ্য আক্রমণ করেননি। তিনি চার মাস পরে লংকা আক্রমণ করবেন মনস্থ করলে লক্ষ্মণ উদ্বিগ্ন হয়ে এ চারমাসে সীতাদেবীর কী দশা হবে জানতে চাইলে রামচন্দ্র বললেন, সীতা ব্রতপরায়ণা, তার ধর্ম তাঁকে সুরক্ষা প্রদান করবে।

মথুরার কংস গোকুলে নন্দপুত্রের অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে অঘ, বক, পূতনা, শকট, তৃণাবর্ত প্রভৃতি ভয়ংকর মায়াবী অসুরদের পাঠিয়েছিল। কিন্তু যাকেই পাঠানো হলো, সেই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। তাদের উৎপাতের ফলে গোকুলবাসীরা অহরহ ভগবৎ-স্মরণ করতে লাগল। এদিকে কংস প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলে। কেননা, তার বিশাল বিশাল মায়াবী অস্ত্র শেষ হয়ে গেল। তার শ্বশুর জরাসন্ধ যখন দেখা করতে আসে, তখন কংস বলল, আমি সর্বস্বান্ত, একটাও অস্ত্র দেখছি না, যাকে বৃন্দাবনে পাঠাব। কংসের অত্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখে জরাসন্ধ বলল, হুটপুটি করে কোনো লাভ নেই। এখানে একটামাত্র অস্ত্র নিয়ে বর্ষার চার মাস অপেক্ষা করতে হবে ━ তা হলো প্রতীক্ষা অস্ত্র। এখন কারো বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই প্রতিকূল পথে পতিত হতে হবে।

“অনেক লোক আছেন যাঁরা উন্নততর জীবন অথবা স্বর্গারোহণ করবার জন্য চান্দ্রায়ণ, চাতুর্মাস্য আদি স্বেচ্ছামূলক তপশ্চর্যার অনুশীলন করেন। এ সমস্ত পন্থায় বিশেষ বিশেষ বিধি-নিষেধের মাধ্যমে জীবনযাত্রাকে পরিচালিত করার জন্য কঠোর ব্রত পালন করতে হয়। যেমন, চাতুর্মাস্য ব্রত পালনকারী চার মাস দাড়ি কামান না, নিষিদ্ধ জিনিস আহার করেন না, দিনে একবারের বেশি দুবার আহার করেন না অথবা কখনও গৃহ পরিত্যাগ করেন না। এভাবেই সাংসারিক সুখ পরিত্যাগ করাকে বলা হয় তপোময় যজ্ঞ।” শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (৪/২৮, তাৎপর্য)

আমাদের দেশে অনেকেই আমিষপ্রিয় ও নেশাপ্রিয় মানুষ রয়েছেন।  সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কেউ চাতুর্মাস্যে মদ ও মাছ-মাংস বর্জন করতে পারে, তবে সে এক সুন্দর যোগী হতে পারবে, ওজস্বী ব্যক্তিত্ব হতে পারবে।

পরিশেষে, উল্লেখ্য এই যে, কর্মী, জ্ঞানী, যোগী ও ভক্ত প্রভৃতি সকলের মঙ্গলের জন্যই চাতুর্মাস্য পালন করা আবশ্যক। শ্রীহরির প্রতি একটু একটু ভক্তি অনুশীলন, একাদশী ব্রত পালন, আমাদের জীবনকে পবিত্র ও মহান করে তোলে। শ্রীব্রহ্মা নারদকে বললেন,” হে নারদ, যে মানুষ ভক্তি সহকারে চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করবে, সে পরমা গতি বৈকুণ্ঠ জগতের বাসিন্দা হতে পারবে।”

আরও পড়ুন: Qualities of Lord Krishna-RadhaRani || শ্রীকৃষ্ণের ৬৪ গুণ ও শ্রীমতি রাধারানীর ২৫ গুণ বর্ণন

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.