এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি বাসনা, কর্ম ও কর্মফল (Desire, Karma and Destiny) কিভাবে একজন ব্যক্তির জীবন প্রভাবিত করে।
সৃষ্টির সমস্ত নিম্ন যোনির (ইতর) প্রাণীদের কর্তব্য-অকর্তব্যের বিচার বিবেচনার ক্ষমতা নেই। তবে তারা প্রকৃতির ক্রমবিবর্তন নীতি অনুযায়ী উন্নত শরীর লাভ করতে থাকে, শেষে মনুষ্য দেহ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের কর্তব্য-অকর্তব্যের বিচার বিবেচনার ক্ষমতা রয়েছে। তার ভাল-মন্দ কর্ম এবং বাসনা তার ভবিষ্যৎ জীবনের সূত্রপাত করে।
মানুষকে বলা হয় বিবেকসম্পন্ন জীব, অর্থাৎ তার মধ্যে ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ভগবান দিয়েছেন। এই সৃষ্টির জগতে বেশীক্ষণ না থেকে ভগবতধাম বৈকুণ্ঠ জগতে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। বৈকুণ্ঠ জগতে যদি যাওয়া যায় তবে সেখানে এই রকম জড়দেহ ধারণ করতে হয় না, সচ্চিদানন্দময় দেহ ধারণ করা হয়।
মূলতঃ আমাদের চেতনা, কামনাবাসনা এবং আমাদের কর্ম আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত করে যে, আমরা কি জীবন লাভ করব? কোনও কোনও ব্যক্তি জাতিস্মর হয়ে তার পূর্ব জীবনের কথা স্মরণ করতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তিই বিস্মৃতিতে বিরাজমান। তাই আমাদের বর্তমান শরীরে থাকার মেয়াদ শেষ হলেই অন্য কোনও জীবনে বিধির নিয়মে উপনীত হতে হবে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ৮ম অধ্যায়ের ৬নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি ──
◼️ অনুবাদ: কৌন্তেয়! মৃত্যুকালে মানুষ যে যে ভাবে চিন্তন করতে করতে দেহত্যাগ করে, সেই সেই ভাবকেই প্রাপ্ত হন।
অর্থাৎ অন্তিমকালে যে যে -বিষয় চিন্তা করে দেহত্যাগ করে, সে সেই ভাব-অনুসারী দেহধারণ করে থাকে। তাহলে তো খুব সোজা আদান-প্রদান, আজীবন আনন্দ করে, মৃত্যুর সময় ভগবানের স্মরণ করে নিলেই হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অনুসারে এরূপ হয় না, ‘সদা তদ্ভাবভাবিতঃ’– সেই ভাবেরই চিন্তন করতে সমর্থ হন, যে ভাবের চিন্তন আজীবন করেছেন। আজীবন ‘যা’ চিন্তন করে এসেছেন, এরই মনের মধ্যে প্রতিফলন হয়। এর অন্যথা হয় না।
বিধির বিধান অনুযায়ী কামনা, বাসনা, কর্ম দ্বারা কিভাবে আমাদের পরবর্তী জীবন নির্ধারিত হয়, সেই বিষয়ে মহাজনেরা (মহর্ষি বেদব্যাস এবং অন্যান্য ঋষিরা) বিস্তারিত বলে গিয়েছেন।
হিন্দুপুরাণ অনুসারে, মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, কর্মফল কখনই বর্তমান জন্মে ভোগ করা যায় না। ভাল-খারাপ দুই ধরনের কাজেরই ফলাফল মেলে পরের জন্মে। শুধু তাই নয়, বর্তমান জন্মও প্রভাবিত হয় পূর্বজন্মের কৃতকর্ম দিয়ে।অর্থাৎ পরবর্তী জন্মে জন্ম নেওয়ার আগেই, পূর্বজন্মের কর্ম ফল অনুযায়ী ঠিক হয়ে যায়, পরের জন্মে কোন অবতারে জন্মগ্রহণ করবে একজন মানুষ। তার মানেটা দাঁড়ায় এই যে, এই জন্মে যদি খারাপের পাশাপাশি ভাল কিছুও ঘটে, তবে তা আগের জন্মের কিছু পুণ্যের ফল।
বহুপ্রাচীন গ্রন্থ মতে,একটি মানব জন্ম পেতে গেলে তার আগে চুরাশি লক্ষ (৮৪,০০০) যোনি অতিক্রান্ত করতে হয়।এক কোষী প্রাণী থেকে শুরুকরে প্রায় পৃথিবীর যাবতীয় জীবজন্তুর রূপে জীবন কাটিয়ে তবেই পাওয়া যায় মানবজীবন।আর একটি মানবজীবনের পরে তার পরের জন্মে সেই আত্মা কী রূপে জন্ম নেবে তা মূলত নির্ভর করে তার মানবজনমের পাপ-পুণ্য এবং কর্মফলের উপর।সেই আত্মা একটি পোকা হয়েও জন্মাতে পারে আবার মানবরূপেও পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে।
► আরও পড়ুন: জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র (Cycle of Birth and Death) ও ৮৪ লক্ষ যোনি
গরুড় পুরাণ অনুযায়ী, যখন কোনও আত্মা মানবজন্ম লাভ করতে যায় তখন মায়ের গর্ভে ৯ মাস সে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য হয়ে থাকে।কিন্তু জন্মানোর পরেই সে ঈশ্বরকে বিস্মৃত হয় এবং নানা ধরনের পাপকর্মে লিপ্ত হয়। চুরি, প্রতারণা, খুন, অকারণে অন্যকে আঘাত করা -এমন হাজারো পাপকাজ মানুষ করে চলে এবং তার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়ে যায় পরের জন্মে ঠিক কী রূপে জন্মগ্রহণ করবে সে। যেমন ──
◉ কেউ যদি উলঙ্গভাবে নিজের চেহারা দেখাতে চেষ্টা করে, তবে পরবর্তীতে বৃক্ষশরীর লাভ হয়।
◉ কেউ যদি অনেক ঘুমাতে চায় তাহলে সে ভাল্লুক-শরীর লাভ করবে।
◉ কেউ যদি আমিষ আহার করে তবে পরবর্তী জন্মে আমিষাশী পশুপাখী রূপে জন্ম লাভ করবে।
এগুলি কামনা বাসনার বিষয়।
◉ কারও অঙ্গহানি করলে নিজের অঙ্গহানি হয়।
◉ কেউ যদি কাউকে অনায়ভাবে হত্যা করে, তবে পরজন্মে তাকে গাধা হয়ে জন্মাতে হয়। দিনরাত মালিকের অত্যাচার এবং অতিরিক্ত বোঝা বহন করাই হয় তার কৃতকর্মের ফল।
◉ কোনো পুরুষ যদি ধর্ষণ করে তবে পরের প্রথম জন্মে তিনি হবেন নেকড়ে, দ্বিতীয় জন্মে শেয়াল, তৃতীয় জন্মে শকুন, চতুর্থ জন্মে সাপ এবং পঞ্চম জন্মে সারস।
◉ পুরাণ মতে সোনা চুরি করা হল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এমন কাজ যে করে তাকে পরের জন্মে পোকা হয়ে জন্মাতে হয়। পাশাপাশি, যদি কেউ রুপা চুরি করে, তাকে পরের জন্মে পায়রা হয়ে জন্মাতে হয়।
◉ কারো পোশাক চুরি করা বা কারো শরীর থেকে পোশাক টেনে নেয়ার মতো ঘৃন্য কাজ করলে সেই ব্যক্তিকে পরের জন্মে টিয়াপাখি হয়ে সারাজীবন খাঁচাবন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়।
◉ যিনি পরিবারের বা পরিবারের বাইরের বায়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং সর্বসমক্ষে অপমান করেন, তাকে পরের জন্মে কাক হয়ে জন্মাতে হয় এবং কাকরূপে তাকে অন্তত ১০ বছর জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
◉ কাউকে প্রতারণা করলে নিজে প্রতারিত হতে হয়।
◉ উপযুক্ত বাক্তিকে বস্তু দান করলে পরবর্তীতে বস্তুর অধিক গুণে প্রাপ্তি হয়।
এগুলি হল কর্মের ফল।
যেহেতু কর্মের কারণ সূত্র আমরা সহজে খুঁজে পাই না বা মনে করতে পারি না, তাই সাধারণেরা একে ‘অদৃষ্ট’ নামে আখ্যায়িত করে। কিন্তু কর্মের কারণ সূত্র স্বীকার করতেই হয়।
✺ উদাহরণ ১:
বিদেশে শ্রীল প্রভুপাদ একটি গাছকে দেখলেন, সেটি সূর্যালোকের দিকে তার শাখাপ্রশাখা বৃদ্ধি না করে তার শাখা প্রশাখাগুলিকে একটি গৃহের অভিমুখে প্রসারিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, সেই গৃহসৌধটি যে নির্মাণ করেছিল সে অতান্ত আশা করেছিল এই সৌধমধ্যে থেকে সুখীজীবন যাপন করবে। কিন্তু অকালেই মানবজীবন হারিয়ে সে বৃক্ষ শরীর পেয়েছে এবং সেই সম্পদ আগলে রেখেছে। ভারতবর্ষের এক প্রধানমন্ত্রী যিনি সুইজারল্যাণ্ডের পোষ্য কুকুর-শরীর লাভ করে দিন যাপন করছেন। শ্রীল প্রভুপাদ ভার ঐশী (ঐশ্বরিয়) দৃষ্টিতে দর্শন করেছিলেন।
✺ উদাহরণ ২:
কোন ব্যক্তি রাজসিংহাসনে নিষ্কণ্টকভাবে সারাজীবন থাকতে চায় কিন্তু রাজপদ বা মন্ত্রীপদ ত্যাগ করতে চায় না। এক্ষেত্রে তার বাসনা যেভাবে একান্ত কিন্তু কর্মটা যদি রাজা বা মন্ত্রীর মতো না হয়ে ইতর প্রাণীর মতো হয়, তবে পরজন্মে সর্ববাঞ্ছাপূরণকারী শ্রীভগবান তাকে অবশ্যই তার মৃত্যুকালীন মনোবাঞ্ছা পূরণ করবে। অর্থাৎ সেই সিংহাসনে সে সারাজীবন নিষ্কণ্টক নিঃশক্ররূপে থাকার সুযোগ পাবে, কিন্তু কর্মফল অনুসারে মনুষ্য-জন্ম না পেয়ে ছারপোকা হয়ে আসনের গদিতে সারাজীবন থাকবে। বাসনা পূর্ণ করতে অচ্যুতানন্দ ভগবান কখনও কার্পণ্য করেন না। বাসনা তার পূর্ণ হবেই। কিন্তু কবে এবং কিভাবে হবে – সেটি সম্পূর্ণ ভগবানের হাতে। এ এক দারুণ রহস্য!
✺ উদাহরণ ৩:
কেউ যদি নারদমুনির মতো সারা দুনিয়ায় যেখানে-খুশি-সেখানে ইচ্ছামতো যাবার বাসনা করে, কিন্তু নারদমুনির মতো তার স্বভাব না হয়ে যদি ইতরতর কোনও প্রাণীর মতো হয়ে থাকে, তবে তার বাসনা অনুসারে হয়ত সে একটি মশার দেহ লাভ করে যেখানে-যখন-খুশি চলে যেতে পারবে আনন্দে, কিন্তু কর্ম অনুসারে সে পরজীবী হয়ে বাঁচবে।
✺ উদাহরণ ৪:
আবার কোনও প্রভাবশালী ধনী ব্যাক্তি যদি অন্য কোনও দরিদ্র নিরীহ ব্যক্তিকে ঠকিয়ে তার সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করে, পরবর্তীকালে দেখা যাবে বঞ্চিত দরিদ্র ব্যক্তিটি দেহত্যাগ করে প্রবঞ্চকের পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করে সিন্দুকে জমানো প্রচুর টাকা উপভোগ করতে লাগল, অন্যদিকে ধনী ব্যক্তিটি সেখানে একটি সিলভার ফিস (বই পোকা) রূপে অবস্থান করতে লাগল।
✺ উদাহরণ ৫:
এক সাধু একজন লোককে বললেন, তুমি মাছ খেও না, তোমার শরীর-মন ভাল থাকবে। কিন্তু সেই লোকটি তার মৎস্যভোজী ঠাকুরদার নির্দেশে সাধুর কথা অগ্রাহ্য করে মাছ ভক্ষন করতে লাগল। ঠাকুরদা মৃত্যুকালে মাছের চিন্তা করতে করতে পরজন্মে মৎস-শরীর প্রাপ্ত হয়ে বাড়ির পাশে পুকুরে জন্ম নিল, লোকটি সেই পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে তার স্ত্রীকে রান্না করতে বলল! এই হল অদৃষ্টের কর্মফল-রহস্য! কে কাকে ধরছে, কে কাকে খাচ্ছে, তা বুঝতে পারা মুশকিল।
✺ উদাহরণ ৬:
কংস তার মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, গোকুলসহ আশেপাশের গ্রামে দশ-পনেরো দিনের কোনও নবজাত শিশুসন্তান থাকলে তাকে অবশ্যই বধ করতে হবে। কেননা দৈববাণীতে কংস শুনেছিল যে, “তাকে বধ করিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।”
তার জন্ম হয়েছে। কংসের সেনারা বহু শিশুকে নৃশংসভাবে বধ করল। কিন্তু বলা হয়েছে, সেই নবজাত শিশুরা পূর্ব জন্মে কংসেরই বিশ্বস্ত অনুগত লোক ছিল, ভগবান কৃষ্ণের অনুগত্য (কৃষ্ণ প্রীতি সম্পন্ন ব্যাক্তি) ছিল না। তাই তারা পূর্ব জন্মের কৃতকর্মের ফলে অভিশপ্ত হয় পরবর্তীজন্মে কংসের দ্বারাই নিহত হবার বিধান পায়। তাদের বাসনা পূরণের কারনে তাদের গোকুলের আশেপাশে শিশুরূপে জন্মগ্রহণ হয়েছিল। সেই দর্শনটি সাধারণের অগোচর।
✺ উদাহরণ ৭:
লোকে দীর্ঘ আয়ু কামনা করল, ফলে পরবর্তী জন্মে সে ব্যাক্তির বাসনা অনুসারে দীর্ঘ আয়ু লাভ করল। কিন্তু কর্মদোষে সে কানা-খোঁড়া-পঙ্গু বা জীনগত কোন ব্যাধি বা বিকৃতি নিয়ে জন্মাল। সেক্ষেত্রে দীর্ঘায়ু পেয়েও কোনও লাভ নেই।
✺ উদাহরণ ৮:
সন্তানহীন পিতামাতা সন্তান কামনা করতে লাগল, ফলে পরবর্তী জন্মে সন্তান লাভ হল। কিন্তু সেই সন্তান এমন বেয়াদব বা নষ্ট প্রকৃতির হল যে, পিতামাত্রা তাকে আর সহ্য করতে না পেরে দূরে সরিয়ে দিল বা তার মুখ দর্শন করতে চাইল না। হতেও পারে অতীতের কর্মদোষের কারনে সেই সন্তানের হাতে তাদের হত্যা হতে হল। সেক্ষেত্রে সন্তান পেয়েও কোনও লাভ হল না।
✺ উদাহরণ ৯:
লোকে লটারী খেলে লাখপতি হতে পারে, তাতে তার আনন্দ হতে পারে। কিন্তু শক্র এসে তার গলা কেটে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এসব কিছুই অদৃষ্ট কর্মফল।
আমাদের সুখ-দুঃখ ভোগ প্রসঙ্গে ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে ─━
─━ (ঈশোপনিষদ্-১)
◼️ অনুবাদ: পরিবর্তনশীল এই জগতে সবকিছুরই ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন পরমেশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ত্যাগ অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মাকে দৃঢ় কর। অপরের ধনে লোভ করো না।
বিধির বিধনি অনুসারে এই চরাচরে আমাদের কর্মফলে যতটুকু বরাদ্দ ততটুকুই ভোগ করতে পারব, তার একটুও কম বা বেশী নয়। যতটুকু সুখ বা দুঃখ পাওয়ার কথা ততটুকুই অবশ্যই পেতে হবে। কখনও তার বেশী কিছু আশা করা যাবে না। সুতরাং পরের সম্পদে লোভ করা বৃথা, পরের সুখে ঈর্ষা করা বোকামি।
সৃষ্টি রহস্যের এরকম কার্যকারণসূত্রে অর্থাৎ এরকম কর্মবাসনা-কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে চাই (বা, জড়াতে না চাই) , তবে আমাদের মনুষ্য জীবনের আয়ুষ্কালের মধ্যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। কৃষ্ণভক্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে হবে।
এ সন্বন্ধে ব্রহ্মার উক্তি ─━
যস্ত্বিন্দ্রগোপমথবেন্দ্রমহো স্বকর্ম-
বন্ধানুরূপফলভাজনমাতনোতি।
কর্মাণি নির্দহতি কিন্তু চ ভক্তিভাজং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।
─━ (ব্রহ্মসংহিতা ৫/৫৪)
◼️ অনুবাদ: ‘ইন্দ্রগোপ’-নামক ক্ষুদ্রকীট হোক, কিংবা দেবতাদের রাজা ‘ইন্দ্র’ হোক, যিনি পক্ষপাতশুন্য হয়ে সমস্ত জীবদের কর্ম অনুসারে ফল প্রদান করান, কিন্তু যিনি তাঁর ভক্তদের সমস্ত কর্মই বিনাশ করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
ভক্তিমান ব্যক্তি (= ভক্ত) এই জড়জগতের কোন কিছু কামনা – বাসনা করে না। যা কিছু সে পায়, তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করার জন্য ব্যাকুল, সেবার জন্য যত্নশীল, নিষ্ঠাপরায়ণ। শ্রীকৃষ্ণ এই ধরনের ভক্তের কর্ম, কর্মবাসনা, অবিদ্যা বন্ধন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মুক্ত করেন।
◎◎✤ কর্মের প্রকারভেদ ✤◎⃝◎
••••••••┈┉━❀❈❈❀━┉┈•••••••••
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ-অধ্যায়ের (জ্ঞানযোগ) ১৭ নং শ্লোকে ভগবান বলছেন,
কর্মণো হি অপিঃ বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যং চ বিকর্মণঃ ।
অকর্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্মণো গতিঃ ॥
─━(গীতা ৪/১৭)
◼️ অনুবাদ: কর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা অত্যন্ত কঠিন। তাই কর্ম, বিকর্ম ও অকর্ম সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানা কর্তব্য।
◼️ তাৎপর্য: কেউ যদি সত্যিই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়, তবে তাকে কর্ম, অকর্ম ও বিকর্মের পার্থক্য জানতে হবে। তাকে জানতে হবে ভগবৎ-তত্ত্ব কি, ভগবানের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক এবং এই জড় জগতের বিভিন্ন গুণের প্রভাবে সে কিভাবে তার কর্তব্যকর্ম করে। এই তত্ত্বের উপলব্ধিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি। এই তত্ত্ব পূর্ণরূপে যে উপলব্ধি করতে পারে, সে-ই বুঝতে পারে যে, জীবের ‘স্বরূপ’ হয়─━ ‘কৃষ্ণের নিত্যদাস’। তাই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা করাই প্রতিটি জীবের পরম কর্তব্য।
সমগ্র ভগবদগীতায় ভগবান আমাদের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষাই দান করেছেন। যে চিন্তাধারা এবং যে কর্ম এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, তাকে বলা হয় বিকর্ম অর্থাৎ নিষিদ্ধ কর্ম। এই তত্ত্বজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে হলে মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তের সঙ্গ করতে হয় – সাধুসঙ্গ করতে হয় এবং তাদের কাছ থেকে এই জ্ঞানের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে হয়। ভগবদ্ভক্তের কাছ থেকে এই জ্ঞান আহরণ করা এবং ভগবানের কাছ থেকে তা আহরণ করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই পরম তত্ত্বজ্ঞান এভাবেই সদগুরুর কাছ থেকে আহরণ না করলে বড় বড় বুদ্ধিমান মানুষেরা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এই জ্ঞানের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে ভগবান তিন প্ৰকার কর্মের বর্ননা করেছেন : কর্ম, অকর্ম, বিকর্ম।
➡️ কর্ম:
যে সমস্ত কর্ম, নিজেকে এবং ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে ছেড়ে, শুধুমাত্র অপরের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কর্ম করা হয়। তাকে কর্ম বলে।
এই কর্ম জীবনে থাকলে পাপ, পূর্ণ দুটোই সঞ্চয় হয়। এই কর্ম করে, মানুষ সম্পূর্ন ভাবে খুশি হতে পারে না।
➡️ অকর্ম:
কর্ম ফলের প্রতি নিরাশক্ত হয়ে কৃষ্ণ ভাবনায় ভাবিত হয়ে কর্ম করাই হল অকর্ম। সুতরাং যিনি শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কর্ম করেন, তাই হল অকর্ম। তিনি প্রতিটি কর্ম করেও নিজেকে অকর্মা বলেন। তিনি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেন, তিনি যতটুকু করছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণই করাচ্ছেন। তিনি নিজে কিছুই করেন না, ভগবানের ইচ্ছায় তা করছেন। স্বার্থ বাসনা ও কর্ম ফলের আসক্তি পরিত্ত্যাগ করে কর্ম করেন বলে তিনি অকর্মা।
তিনি শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে কর্ম করেন। তিনি নিজের জীবনে যা কিছু করেন শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্যই কর্ম করেন। তার নিষ্ঠা ভগবানের প্রতি দৃঢ়। তিনি জানেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলো সমগ্র সৃষ্টির মূল, তাই মূলে জল সিঞ্চন করলে সমগ্র সৃষ্টিই জল পাবে। যেমন, শ্রীকৃষ্ণের ভোগ নিবেদনের পর সকলকে সেই মহাপ্রসাদ বিতরন করা হয়, তাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। যখন এই জগৎ সংসারের ভগবানের সৃষ্ট প্রতিটি জীবকে দয়া, সম্মান ও প্রেম করা হয়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। আর এটিই হল মানুষের প্রকৃত ধর্ম। এই কর্মে না থাকে পাপ, না থাকে পুন্য। এই কর্মে হয় মানুষের জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ ও কর্ম বন্ধন থেকে মুক্তি। এই কর্ম করে মানুষ সম্পূর্ন ভাবে খুশি থাকতে পারেন।
➡️ বিকর্ম:
যে কর্মগুলি শুধুমাত্র নিজের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য করা হয় তাকে বলা হয় বিকর্ম। তিনি কৃষ্ণ ভাবনা বিহীন হয়ে কর্ম ফলের প্রতি আসক্ত হয়ে কর্ম করেন। এটি হলো সম্পূর্ন পাপ কর্ম, শাস্ত্র বিরুদ্ধ কর্ম। এই কর্মে কোনো মানুষ সম্পূর্ন খুশি থাকতে পারে না।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ-অধ্যায়ের (জ্ঞানযোগ) ১৮ নং শ্লোকে ভগবান বলছেন,
কর্মণি অকর্ম যঃ পশ্যেৎ অকর্মণি চ কর্ম যঃ।
সঃ বুদ্ধিমান মনুষ্যেষু সঃ যুক্তঃ কৎস্নকর্মকৃৎ।।
─━(গীতা ৪/১৮)
◼️ অনুবাদ: যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান। তিনি সব রকম কর্ম করেও পরমাত্মার সাথে যুক্ত থাকেন।
◼️ তাৎপর্য: কর্ম হতে পারে আসক্তি যুক্ত বা আসক্তি বিহীন। কিন্তু যার কর্মফলে আসক্তি নেই, তিনি কর্ম করেও আসক্ত বর্জিত থাকেন। কর্মে লিপ্ত হয়েও যিনি সর্বদা নিরাসক্ত থেকে যোগে যুক্ত থাকেন, সেই কর্মই তখন অকর্ম হয়ে পড়ে। আর, সকল প্রকার নিষিদ্ধ ও দূষিত কর্মই বিকর্ম।
যিনি সকল কর্ম করেন ভগবানের উদ্দেশ্যে, ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য (এক্ষেত্রে কর্ম হল অকর্ম ) কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন তিনি নিজে কিছুই করেন নি, সবকিছু ভগবান করেছেন (এক্ষেত্রে অকর্ম হল কর্ম)।
বিকর্ম থেকে কর্ম শ্রেষ্ঠ, আর কর্ম থেকে অকর্ম শ্রেষ্ঠ। যিনি এই কর্ম,অকর্ম ও বিকর্মের স্বরূপকে যথাযথভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছেন। তার জন্য কর্মযোগ সহজ হয়ে যায়। নিরাসক্ত কর্মই হোক জীবের লক্ষ্য।
➡️ নিষ্কাম কর্ম:
কামনা বাসনা ছাড়া শুধুমাত্র কর্ম করার জন্যই যে কর্ম করা হয় তাকে বলে নিষ্কাম কর্ম । নিঃ (নেই) + কাম ( কামনা ) = নিষ্কাম । অর্থাৎ, যে কর্মের পিছনে কোনাে কামনা থাকে না তাকে বলে নিষ্কাম কর্ম । এরূপ কর্মের কোনাে কর্মফল থাকে না এবং সে কারণেই মানুষকে এর জন্য কোনাে কর্মফল ভোগ করতে হয় না।
কর্মফলের আশায় কামনা বাসনা প্রকট হয়, আর কামনা বাসনার কারণে মানুষ অসুন্তুষ্ট হয়, অসোন্তষ থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়, আর ক্রোধ থেকে মোহ জন্ম নেয়। মোহের দরুন ব্যক্তি আচার বিচার ও ব্যবহারের জ্ঞানই ভুলে যায়, জ্ঞান ভুলে গেলে বুদ্ধি চলে যায়, ফলে অনুচিত প্রকারের কার্য অর্থাৎ শাস্ত্র বিরুদ্ধ কর্ম (বিকর্ম) করতেই থাকে, আর সমাজ এরূপ ব্যক্তির শত্রু হয়ে পরে। আর অন্তিমে এরূপ ব্যক্তির পূর্ণতার পতন ঘটে। এই কারণেই সংসারে পাপ আর অধর্ম বৃদ্ধি পায়।
◎◎✤ ভক্তের কি তার কর্তব্য কর্ম ত্যাগ করা উচিত? ✤◎⃝◎
••••••••┈┉━❀❈❈❀━┉┈•••••••••
অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়ন করতে চেয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাকে এই রূপ করতে নিষেধ করেছিলেন। যখন অর্জুন সর্বস্ব ত্যাগ করে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছিলেন তখন কৃষ্ণ বলেছিলেন তোমার স্বধর্ম ত্যাগ করো না। যখন অর্জুন আবেগ তাড়িত হয়ে তার গান্ডীব ধনুক উত্তোলন করতে কম্পিত হয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু সন্তুষ্ট হননি, কেন?
কারণ কৃষ্ণ চেয়েছিলেন অর্জুন নিষ্ঠা এবং সংকল্পের সাথে তার কর্তব্য কর্ম সম্পন্ন করুক।
অর্জুনের মতো অনেক সময় ভক্তরা যারা কৃষ্ণভাবনামূত অনুশীলনে যুক্ত রয়েছে (অথবা ন্যুনতম অনুশীলনের প্রয়াস করছে) তারা এই অনুশীলন ক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করে অমূলক যুক্তি দেখিয়ে যে, এই অনুশীলন তাদেরকে জড়জগতে আবদ্ধ করে রাখবে। কিন্তু তারা কিভাবে নিশ্চিত হল যে, তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাদেরকে এই জড় জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে না? শাস্ত্র কখনোই আমাদের শাস্ত্রানুগ কর্তব্য কর্ম ত্যাগ করতে বলেনি। আমরা যদি মহান আচার্যদের জীবনী অধ্যয়ন করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, তারাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে চরম পরিশ্রম করেছেন এবং পেশাগতভাবে নিপুণও ছিলেন। কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন অথবা গৃহী, স্ত্রী অথবা পুরুষ প্রত্যেককেই কর্ম করতে হবে। জড়বাদীরাও কঠিন পরিশ্রম করে এবং ভক্তরাও কঠিন পরিশ্রম করেন।
তফাৎ হচ্ছে এই যে, জড়বাদীরা তাদের নিজ কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য পরিশ্রম করে যথা, নাম, যশ, অর্থ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি।
কিন্তু একজন ভক্ত কঠিন পরিশ্রম করে কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার জন্য। সে যা কিছু অর্জন করে তা সে কৃষ্ণকে অর্পন করে। একজন ভক্ত সর্বোত্তম প্রয়াসের চেষ্টা করে এবং সফলতা বা বিফলতার চিন্তাই করে না। সে শুধু জানে যে, তার একান্তিক প্রয়াস কৃষ্ণকে সুখী করবে এবং সে ফলের আশাও করে না। অপরপক্ষে জড়বাদীরা যখন তার পরিশ্রমের পরিণাম স্বরূপ কাঙ্ক্ষিত ফল না পায় তখন সে বিষাদপ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আরও বেশি করে এই জড়জগতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
ভক্তিবিনোদ ঠাকুর একজন হাইকোর্ট বিচারক (Judge; জজ) ছিলেন এবং তিনি এত দক্ষ ছিলেন যে, যখন তিনি কর্ম থেকে অবসর নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সরকার সেটি না করতে অনুরোধ করেন। প্রকৃতপক্ষে সরকার যখন দেখলেন তার বাড়ী হাইকোর্ট থেকে দূরে হওয়ার কারণে তার কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়ছে, তখন তার বাড়ী হতে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত একটি রেলওয়ে লাইন পাতা হলো। কারণ সরকার তার মতো একজন সুদক্ষ পেশাদারকে হারাতে চায়নি। তিনি তার সমস্ত কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করেও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের শিক্ষা অনুশীলন এবং প্রচার করেছিলেন। তিনি একটি মানদন্ড তৈরী করেছিলেন, যা আমাদের প্রত্যেকের অনুসরণ করা উচিত।
অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, ভক্তরা ভক্তি জীবন অনুশীলনের সামান্যতম প্রচেষ্টার কারণে তারা তাদের পেশাগত কর্তব্য এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে অসমর্থ (বা নিষ্ক্রিয়) হয়ে পড়ছে। যেহেতু কৃষ্ণ এটা চান না যে ভক্তরা এমন কিছু করুক, যা তাদের ভক্তিজীবনকে প্রভাবিত করে।
তাই একজন ভক্তের নিষ্ঠার সঙ্গে ভক্তিজীবন অনুশীলনের পাশাপাশি এই জাগতিক কর্তব্য কর্মও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করা উচিৎ। এই প্রয়াসের ফলে ভগবান সর্বদা ভক্তদের স্থায়ী ভক্তিজীবন প্রদান করবে এবং যা এক সুখী প্রগতিশীল কৃষ্ণভাবনাময় সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
◎◎✤ কিভাবে সমস্ত কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হওয়া যায়? ✤◎⃝◎
••••••••┈┉━❀❈❈❀━┉┈•••••••••
শৃণ্বতাং স্বকথাঃ কৃষ্ণঃ পূণ্যশ্রবণকীর্তনঃ।
হৃদি অন্তঃস্থো হি অভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎসতাম্॥
─━(শ্রীমদ্ভাগবতম্ – ১/২/১৭)
◼️ তাৎপর্য: “পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি পরমাত্মারূপে সকলেরই হৃদয়ে বাস করেন এবং যিনি হচ্ছেন সাধুবর্গের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ ও কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগ-বাসনা বিনাশ করেন।”
নষ্ট প্রায়েষু অভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া।
ভগবতি উত্তম শ্লোকে ভক্তির্ভবতি নৈষ্ঠিকী॥
─━(শ্রীমদ্ভাগবতম্ – ১/২/১৮)
◼️ তাৎপর্য: “নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করলে এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সেবা করলে হৃদয়ের সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়,এবং তখন উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী ভক্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।”
তদা রজঃ তমঃ ভাবাঃ কাম লোভ আদয়শ্চ যে।
চেতঃ এতৈঃ অনাবিদ্ধং স্থিতং সত্ত্বে প্রসীদতি॥
─━(শ্রীমদ্ভাগবতম্ – ১/২/১৯)
◼️ তাৎপর্য: “যখন হৃদয়ে নৈষ্ঠিকী ভক্তির উদয় হয়, তখন রজ ও তমোগুণের প্রভাবজাত কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপুসমূহ হৃদয় থেকে বিদুরিত হয়ে যায়, তখন ভক্ত স্বত্বগুণে অধিষ্ঠিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রসন্ন হন।”
এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তি যোগতঃ।
ভগবৎ তত্ত্ব বিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে॥
─━(শ্রীমদ্ভাগবতম্ – ১/২/২০)
◼️ তাৎপর্য: “এইভাবে শুদ্ধ-স্বত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে, ভক্তিযোগে যুক্ত হওয়ার ফলে যাঁর চিত্ত প্রসন্ন হয়েছে, তিনি সবরকম জড়-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবত্তত্ত্ব-বিজ্ঞান উপলব্ধি করেন। ”
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চ অস্য কর্মাণি দৃষ্ট এব আত্মনি ঈশ্বরে॥
─━(শ্রীমদ্ভাগবতম্ – ১/২/২১)
◼️ তাৎপর্য: “আত্মার আত্মা পরমাত্মা ভগবানকে দর্শন হলে হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়,সমস্ত সংশয় দূর হয় এবং সমস্ত কর্মফল ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।”
◎◎✤ ভগবদ্ভক্ত ✤◎⃝◎
ভগবদ্ভক্তেরা জড় জগতের বিভিন্ন দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে, নিরন্তর ভগবদ্ভক্তির অমৃতে অবগাহন করেন। তার ফলে ভগবদ্ভক্ত পরম আনন্দ উপভোগ করেন, এবং মুক্তি স্বয়ং তাঁর সেবা করতে আসেন। কিন্তু তাঁরা তাঁর সেবা গ্রহণ করেন না। এমনকি ভগবান স্বয়ং তাঁদের মুক্তি দিতে চাইলেও তাঁরা তা গ্রহণ করতে চান না। ভক্তের কাছে মুক্তি নিতান্তই নগণ্য, কারণ ভগবানের দিব্য প্রেমময়ী সেবা লাভ করার ফলে, তাঁদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়ে যায় এবং তাঁদের আর কোন জড়-জাগতিক বাসনা থাকে না।
ভগবদ্ভক্তেরা জানেন কৃষ্ণভক্তি অত্যন্ত দূর্লভ!
যে ব্যক্তি একটিবার অনুভব করে যে, কৃষ্ণ ভক্তি কতটা চিন্ময় আনন্দের। সে এই জন্মেই তার মনুষ্য জীবনকে স্বার্থক করতে পারে। যে কেউ যেকোনো অবস্থায় মুহুর্তের মধ্যে চাইলেই ভগবানের শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হতে পারে না। ভগবানের ভক্ত হতে হলে আমাদের প্রথমে চারটি বিষয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে। চারটি বিষয় শুধু বিষয়ই নয় চারটি অহংকার –
১) আমি খুব স্মার্ট বা সুন্দরী,
২) আমি খুব শিক্ষিত বা নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি,
৩) আমি খুব উচুঁ জাতের,
৪) আমার অনেক টাকা
… এইসকল বিষয় ভগবানের ভক্ত হওয়ার পথে মারাত্মক বাধাস্বরুপ। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই বিষয়গুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারবো না ততক্ষণ পর্যন্ত কোনোভাবেই ভগবানের চরণের প্রতি আসক্তি লাভ করতে পারবো না।
তাছাড়াও আরো একটি বিশেষ দিক চুম্বকের মত ভগবানের প্রতি আমাদেরকে আকৃষ্ট করে, যেটি হল পূর্ব জন্মের সুকৃতি বা কর্মফল। পূর্ব জন্মের কর্মফলে যদি কিছুটা হলেও ভক্তি সঞ্চিত থাকে, তবেই আমরা ঐ চারটি বিষয় থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে আনতে পারব, সরলভাবে ভগবানের কাছে নিজেকে নিবেদন করতে পারব এবং ঐ মুহুর্ত থেকেই আমরা ভগবানের অত্যন্ত প্রিয় হতে শুরু করবো।
এই দেহের বিনাশ অনিবার্য, আবার উচ্চকুলে জন্ম, পান্ডিত্য সব কিছুরই ক্ষয় আছে, শুধুমাত্র কৃষ্ণভক্তির ক্ষয় নেই। তাই আসুন, যতদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি কৃপা করে কৃষ্ণভক্তি করার চেষ্টা করি। হরে কৃষ্ণ।
◎◎✤ কর্মফল ✤◎⃝◎
একটি মশা এবং ব্রহ্মা উভয়েই এই জড় জগতের জীব; তাঁরা উভয়েই চিৎ স্ফুলিঙ্গ এবং পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অংশ।
──একটি মশার অতি অল্প আয়ু এবং ব্রহ্মার অতি দীর্ঘ আয়ু। ভগবানই তাদের প্রদান করেছেন তাদের কর্মের ফল অনুসারে। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে── “কর্মাণি নির্দহতি“—ভগবান তাঁর ভক্তের কর্মফল ক্ষয় করেন অথবা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করেন। সেই একই তত্ত্ব ভগবদ্গীতায়ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে── “যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র”— কেবল পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত, তা না হলে তা কর্মবন্ধনের কারণ হয়। কর্মের নিয়মে জীব কালের বশবর্তী হয়ে ব্রহ্মাণ্ডে ভ্রমণ করে, কখনও সে একটি মশা হয় এবং কখনও ব্রহ্মা হয়। একজন সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের কাছে এটি কোন লাভজনক ব্যাপার নয়।
ভগবদ্গীতায় (৯/২৫) জীবেদের সতর্কবাণী দেওয়া হয়েছে── “যান্তি দেবব্ৰতা দেবান্” ──যারা দেবতাদের পূজায় আসক্ত, তারা দেবতাদের লোকে যাবে, আর যারা পিতৃদের পূজায় আসক্ত, তারা পিতৃলোকে যাবে। যারা জড়-জাগতিক কার্যকলাপে অনুরক্ত, তারা জড় জগতেই থাকবে। কিন্তু যাঁরা ভগবানের সেবায় যুক্ত, তাঁরা ভগবানের ধামে যাবেন, যেখানে জন্ম- মৃত্যু নেই অথবা কর্মফলের অধীন বিভিন্ন প্রকার জীবন নেই। জীবের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে ভগবদ্ভক্তিতে যুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর উপদেশ দিয়েছেন── “মিছে মায়ার বশে, যাচ্ছ ভেসে, খাচ্ছ হাবুডুবু, ভাই। জীব কৃষ্ণদাস, এই বিশ্বাস করলে ত’ আর দুঃখ নাই।
❀●──❈❈❈❈──●❀
“হরে”কৃষ্ণ”হরে”কৃষ্ণ” “কৃষ্ণ”কৃষ্ণ”হরে”হরে।”
“হরে”রাম”হরে”রাম” “রাম”রাম”হরে”হরে।।”
❀●──❈❈❈❈──●❀
◎◎✤ কর্মফল আপনাকে ভোগ করতেই হবে ✤◎⃝◎
কর্ম অনুযায়ী কর্মফল প্রত্যেককে ভোগ করতেই হবে। জীবনে আপনি যতই ক্ষমতাশালী শক্তিশালী হোন না কেন, কর্মের ফল আপনাকে ভোগ করতেই হবে। প্রকৃতি এখানে কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেন না।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে যখন অর্জুন আর কর্ণের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়, তখন এক পর্যায়ে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেলে তিনি তা মাটি থেকে তোলার জন্যে রথ থেকে নিচে নামেন। সেসময় তিনি নিরস্ত্র ছিলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে, কর্ণের উপর বান নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অর্জুন ভগবানের নির্দেশকে শিরোধার্য করে কর্ণকে লক্ষ্য করে একের পর এক বান নিক্ষেপ করেন। কর্ণ রক্ষা করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয় এবং ভয়ংকরভাবে তির বিদ্ধ হয়। ফলে কর্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মৃত্যু পূর্ববর্তী সময়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া কর্ণ ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কে প্রশ্ন করেন, “এই তুমি ভগবান? এই তুমি করুনাময়? এই তোমার ন্যায্য বিচার ! যে একজন নিরস্ত্র কে হত্যা করার পরামর্শ দাও ? ”
সচ্চিদানন্দময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্মিত হেসে জবাব দেন, “চক্রব্যূহে অর্জুন পুত্র অভিমুন্যও নিরস্ত্র হয়ে পড়েছিল, তখন সকলে মিলে তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিলে… তার মধ্যে তুমিও ছিলে। তাকে হত্যার প্ররোচনা তুমিই দিয়েছিলে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে যে নিয়মশৃঙ্খলাগুলো মানার শপথ নেওয়া হয়েছিল, তা লঙ্ঘন করেছিলে কৌরবরা… তার মধ্যে তুমিও ছিলে। তখন তোমার এই ধর্মজ্ঞান কোথায় ছিলো কর্ণ ? এ জগতে যে যেরূপ কর্ম করে আমিও তাঁকে সেইরূপ কর্মফলই প্রদান করি। ইহাই আমার বিচার।”
অতএব… কর্ম করুন ভেবেচিন্তে। আপনি আজ কাউকে কষ্ট দিলে, যন্ত্রনা দিলে, অবজ্ঞা করলে, কারো দুর্বলতার সুযোগ নিলে…. আগামী দিনে আপনার জন্যেও সেই একই কর্মফল অপেক্ষা করে থাকবে এবং স্বয়ং তিনিই আপনাকে তা প্রদান করবেন। আমরা অনেকেই হয় তো শরীরে বল প্রয়োগ করে মানুষের উপর অত্যাচার করি কিংবা মানুষকে ছোট করে কথা বলি। মনে রাখবেন সময় সবার এক রকম ভাবে কাটে না। আপনার কর্ম অনুসারে ফল আপনার কাছে যথা সময়েই ফিরে আসবে। তখন অন্যের উপর প্রয়োগ করা কর্মের ফল ভোগ করতে পারবেন তো? একটি বার ভেবে দেখুন। সুতরাং জীবনে ধর্মের পথে চলুন, ধর্মকে ধারন করে মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। ধর্মই আপনার কাছে সুখ শান্তি হয়ে ফিরে আসবে।