◉ গোবর্ধন পূজা (Govardhan Puja):- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাত্র সাত বছর বয়সে ব্রজবাসীদের ইন্দ্রের ক্রোধ থেকে রক্ষা করার জন্য গোবর্ধন পর্বতকে কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ধারন করেছিলেন। সেই সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের অহঙ্কার চূর্ণ করে তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের বিপক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষামূলক লীলা স্মরণে “গোবর্ধন পূজা” উদযাপিত হয়।
◉ গোবর্ধন পূজা সাধারণত দীপান্বিতা/ দিওয়ালি / দীপাবলির পরের দিন পালিত হয়।
দীপাবলি, আলোর উত্সব টানা পাঁচ দিন ধরে চলতে থাকে – ধনতেরাস, নরকা চতুর্দশী, লক্ষ্মী পূজা, গোবর্ধন পূজা এবং ভাই ফোঁটা (ভাই দুজ) নীচের ক্যালেন্ডার অনুসারে: –
✦ দীপাবলি (দিওয়ালি) দিবস ১ : 30-অক্টোবর-2024 (বুধবার) ত্রয়োদশী – ধনতেরাস।
✦ দীপাবলি (দিওয়ালি) দিবস ২ : 31-অক্টোবর-2024 (বৃহস্পতিবার) চতুর্দশী – ছোট দিওয়ালি।
✦ দীপাবলি (দিওয়ালি) দিবস ৩ : 01-নভেম্বর-2024 (শুক্রবার) অমাবস্যা – দীপাবলি, শ্রীকালীপূজা।
✦ দীপাবলি (দিওয়ালি) দিবস ৪ : 02-নভেম্বর-2024 (শনিবার) প্রতিপদ – অন্নকূট মহোৎসব, গোবর্ধনপূজা।
✦ দীপাবলি (দিওয়ালি) দিবস ৫ : 03-নভেম্বর-2024 (রবিবার) দ্বিতীয়া – ভাই ফোঁটা (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া; ভাই দুজ)।
◉পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজবাসীদের ইন্দ্রযজ্ঞের জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখে তাদের ইন্দ্রের পূজার পরিবর্তে গোবর্ধন পর্বতের পূজা করতে অনুরোধ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে সমগ্র বৃন্দাবনে প্রলয়কালীন বৃষ্টিপাত শুরু করেন। কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে সাত দিন ধরে ছাতার মতো গোবর্ধন পর্বত ধারন করে বৃন্দাবনের সমস্ত বাসিন্দাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পরে ইন্দ্র ভুল বুঝতে পেরে, শ্রীকৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এভাবে পরমেশ্বর ভগবান প্রমাণ করেছিলেন যে ভক্তিপূর্ণ সেবায় নিযুক্ত আত্মসমর্পণকারী ভক্ত, সমস্ত বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত এবং বস্তুগত অনুগ্রহের জন্য কোনও দেবদেবীর উপাসনা করার প্রয়োজন নেই। এই লীলা “গোবর্ধন লীলা” হিসাবে পরিচিত এবং শ্রীমদ্ভাগবতমের দশম স্কন্ধে বর্ণিত আছে।
◉ গোবর্ধন পূজাটিকে ‘অন্নকূট’ বলেও উল্লেখ করা হয়। অন্নকূট কি?
“অন্ন” শব্দের অর্থ খাদ্য এবং “কূট” অর্থ পর্বত। সুতরাং “অন্নকূট” উৎসবে অন্নের ও নানাবিধ ব্যঞ্জনের পর্বত তৈরি করা হয়। এককথায়, অন্নকূট অর্থ “খাদ্যের পাহাড়”।
◉ শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে, ব্রজবাসীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, প্রতি বছর কার্তিক মাসে দীপাবলীর পরের দিন এই উৎসব পালিত হয়। ভক্তরা একটি অন্নকূট (“অন্নের একটি ছোট পাহাড়”) প্রস্তুত করেন এবং মিষ্টি, কেক, সবজি এবং বিভিন্ন রঙিন অন্ন দিয়ে সজ্জিত করেন। গোবর্ধন এবং আশেপাশের হ্রদগুলির একটি ক্ষুদ্র রূপ ভক্তরা তৈরি করেন।
◉ ভক্তরা গোবর্ধন পুজার দিন গোমাতার পূজাও করেন। কৃষ্ণ “গোপাল” নামে পরিচিত ━ “গোমাতার রক্ষক”। এই উৎসব চলাকালীন গোমাতাকে সজ্জিত করা হয় এবং খাওয়ানো হয়। এদিন গোমাতাকে সামনে রেখে ভক্তগণ গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমা করেন। গোবিন্দের প্রণাম মন্ত্রে তাই উল্লেখ রয়েছে:-
❝ॐ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো-ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ॥ ❞
◼️ গোবর্ধন পূজা কি? ◼️
গোবর্ধন পূজা ও পরিক্রমার মাধ্যমে ভগবৎধাম প্রাপ্তি হয়। এছাড়াও এদিন গোপূজা কর্তব্য। গোবর্ধন ও গোপূজাকে গোবর্ধন যজ্ঞ বলে। এটি শ্রীকৃষ্ণকে অপরিসীম সন্তুষ্ট করে এবং এর ফলে ধন, ঐশ্বর্য, গাভী এবং সমৃদ্ধি বর্ধিত হয়।
গোবর্ধন = গো (ইন্দ্রিয়) + বর্ধন (বৃদ্ধি)
সুতরাং গােবর্ধন অর্থে ইন্দ্রিয়ের আনন্দ বৃদ্ধি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের সর্বদা আনন্দ বিধান করে থাকেন।
গোবর্ধন = গো (গরু) + বর্ধন (পুষ্টি)
আক্ষরিক অর্থ হল যিনি গরুর পুষ্টি বিধানকারক ও রক্ষক। গােবর্ধন পর্বতে সৃষ্ট পাতা, লতা, গুল্ম খেয়ে লক্ষাধিক গাভী পুষ্টি লাভ করত ও বেঁচে থাকত। মাধবীলতা, পুষ্প শোভিত, ফল-ফুলে সমাকীর্ণ, রত্নময় ঝর্ণা ও গুহাবৃত, শতশৃঙ্গ, মনোহর বিচিত্র ঋতুরাগরঞ্জিত সশব্দ পক্ষি পরিবৃত হরিণ বানরাদি পশু পরিব্যাপ্ত, ময়ুরধ্বনি মণ্ডিত লতাগুল্ম তৃণাচ্ছাদিত এই গোবর্ধন সকলের মনোরঞ্জনকারী।
✸ আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ ✸
===================
দেবরাজ ইন্দ্রের মতো, মনুষ্যগণও যতদিন হিংসাদ্বেষাদির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে, ততদিন সে নিজ শক্তির পরিচয় পাবে না। আত্মশক্তি সকলের মধ্যে থাকলেও অজ্ঞানতা থেকে উৎপন্ন কাম-ক্রোধ, হিংসা-দ্বেষাদির অর্থাৎ ষড়রিপুর দ্বারা তা মানুষের হৃদয়ে সুপ্ত (লুক্কায়িত) থাকে। ভক্তি সাধনার মাধ্যমে হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হলে অর্থাৎ আত্ম জ্ঞানের বিকাশ হতে থাকলে ঐ সব অশুভ মনোবৃত্তিসমূহ ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে। তখন ভক্ত বুঝতে পারেন যে, তার মধ্যে যে শুদ্ধ চৈতন্য (আত্মা) আছে, বিকারী মন সেখান থেকেই সৃষ্ট হয়েছে। নিজের শুদ্ধ স্বরূপের তুলনায় পার্থিব সকল বস্তুই যে তুচ্ছ, তখন শুদ্ধ মন তা বুঝতে পেরে কেবল আত্মাতেই সমাহিত হয়ে থাকতে ভালোবাসে। আত্মাতে পরমাত্মার (ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু) বাস। পরমাত্মার জাগরণে কলুষিত আত্মা বিশুদ্ধ হয়। নিরন্তর আত্মার মধ্যে পরমাত্মাতে সমাহিত থাকার ফলে ভক্তের মানসিক শক্তি অতিসয় প্রবল হতে থাকে এবং নিজের স্বরূপকে জানতে পেরে তিনি আর মৃত্যুকেও ভয় করেন না। বিশুদ্ধ আত্মশক্তি লাভকেই “গােবর্ধন ধারন” রূপে প্রকাশ করেছেন।
যার দ্বারা ইন্দ্রিয়গণ জীবিত রয়েছে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে যে মন, সেই মনকেও যিনি ধারণ করে রয়েছেন তিনিই গােবর্ধনধারী অর্থাৎ আত্মা। আত্মা ও আত্মার মধ্যে পরমাত্মাকে যিনি উপলব্ধি করিতে পারেন, তিনিও গােবর্ধনধারী। কারণ “ব্রহ্মবিত ব্রম্মৈব ভবতি” ━ অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞানী নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায়। মানুষ ব্ৰহ্মজ্ঞানী হলে কি হয়? মানুষ ব্রহ্মজ্ঞানী হলে সে জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পায়। মানুষ ভোগের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারেনা, ত্যাগের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। ত্যাগ, তিতিক্ষা (ধৈর্য; সহিষ্ণুতা; ক্ষমা) ও নিরন্তর সাধনার দ্বারাই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
শ্রীকৃষ্ণ যেমন গােবর্ধন পর্বতকে তুলে ধরে সকল গোপগণকে আশ্রয় দান করেছিলেন, সেইরূপ শোক-তাপ , মৃত্যুভয় প্রভৃতির দ্বারা তাপিত হয়ে যারা আত্মজ্ঞানী পুরুষের আশ্রয় গ্রহণ করে, তাদেরকেও তিনি আশ্রয় দানে তাদের সকল বিপদ থেকে ত্রান (রক্ষা, মুক্তি, উদ্ধার) করেন।
◼️ গিরিরাজ গোবর্ধন কে? ◼️
🌸 জীবের প্রকৃত বন্ধু বা সুহৃদ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, ‘সুহৃদং সর্বভূতানাম্’। তিনি সচ্চিদানন্দময়। তিনি ‘রস বৈ স’ অর্থাৎ সমস্ত রস বা আনন্দের আধার বা উৎসস্থল। তাঁর গুণ ও মহিমার অন্ত নেই। জীবের মঙ্গল বিধান এবং ভক্তদের আনন্দ ও প্রেম বর্ধনের জন্য নানা রূপে তিনি লীলাবিলাস করেন।
❝ রামাদিমূর্তিষু কলা নিয়মেন তিষ্ঠান্
নানাবতারমকরোদ্ভুবনেষু কিন্তু।
কৃষ্ণ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি॥ ❞
━┉┈┈(শ্রীশ্রী ব্রহ্মসংহিতা, শ্লোক ১২)
অনুবাদ: “যে পরম পুরুষ স্বাংশ কলাদি নিয়মে রামাদি মূর্তিতে স্থিত হয়ে ভুবনে নানাবতার প্রকাশ করেছিলেন এবং স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হয়েছিলেন, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
ভগবানের এই সমস্ত বহুবিধ লীলার মধ্যে নররূপে তাঁর যে লীলাবিলাস তা হচ্ছে সর্বোত্তম, কেননা এইরূপে তিনি যেমন পরম করুণাময়, তেমনি তিনি হচ্ছেন রসিক শেখর। এইজন্য তাঁকে প্রণাম করে বলা হয়েছে-
❝ হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে।
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমস্তুতে॥ ❞
🌸 ঈর্ষাপরায়ণ এবং নাস্তিকেরা ভগবান সম্পর্কে নানা কথা বলে থাকে। ভগবান বলে কেউ নেই, ভগবান মরে গেছে, ভগবান নিরাকার, আমরাই ভগবান, আবার কেউ কেউ বলে আমি, তুমি গরু, ছাগল, ভেড়া সবাই ভগবান। এসবই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
অথচ আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরের কিছু পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রূপে এই মর্ত্যধামে ভৌম বৃন্দাবনে লীলাবিলাস করেছেন। যা কোনও কল্পিত গল্পকথা বা আজগুবি ইতিহাস নয়; পক্ষান্তরে তা বাস্তব সত্য। কিন্তু কাল্পনিক মিথ্যা, অবাস্তব কাহিনী পড়ে দেখেশুনে আমাদের দশা এমনই শোচনীয় হয়ে গেছে যে, যথার্থ বাস্তবকেও গল্প বলে মনে হয়। এটি নিতান্তই অল্পবুদ্ধি ও অজ্ঞভারই পরিচায়ক। আজও ভগবানের লীলাক্ষেত্রগুলি রয়েছে। উত্তর প্রদেশের মথুরা জেলার শ্রীধাম বৃন্দাবনে তার পরম সাক্ষীরূপে বিরাজমান যমুনা নদীসহ সকল লীলাস্থলী। আর রয়েছে সাক্ষাৎ ভগবরূপী শ্রীগোবর্ধন। কালের প্রভাবে স্থানগুলির নাম ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা কিছুটা হ্রাস পেলেও এখনও বহু স্থান ভগবানের লীলার স্মৃতি বহন করে চলেছে। তার মধ্যে গিরিগোবর্ধন বহু লীলার সাক্ষী হয়ে এখন বিরাজমান।
🌸 এই গোবর্ধনকে বলা হয় ‘গিরিরাজ’। সমস্ত গিরি অর্থাৎ পর্বতের রাজা। অভিন্ন ভগবৎ শরীর হয়েও গিরিরাজ ভক্তদের সতত আনন্দ ও ভক্তি বর্ধন করেন। রাধাভাবে ভাবিত গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তাই কখনও গোবর্ধন পদস্পর্শ করেননি। তাঁর অনুগামী ষড় গোস্বামীরা সেই নিয়ম পালন করে প্রতিদিন গোবর্ধন পরিক্রমা করতেন। কখনও গোবর্ধনের ওপরে বিচরণ করতেন না। শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদ এমনকি বৃদ্ধাবস্থায়ও রোজ গোবর্ধন পরিক্রমা করতেন। তাঁর কষ্ট দেখে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর পদচিহ্নযুক্ত একটি শিলাখণ্ড অর্পণ করে সনাতন গোস্বামীকে তা পরিক্রমা করতে বলেন। বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরাধা দামোদর মন্দিরে এখনও সেটি সংরক্ষিত আছে।
🌸 গোবর্ধন কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল গাভী ও গোবৎসদের (বাছুরদের) সুষ্ঠুরূপে পালন পোষণকারী। মাধবীলতা, পুষ্প শোভিত, ফল-ফুলে সমাকীর্ণ, রত্নময় ঝর্ণা ও গুহাবৃত, শতশৃঙ্গ, মনোহর বিচিত্র ঋতুরাগরঞ্জিত সশব্দ পক্ষি পরিবৃত হরিণ বানরাদি পশু পরিব্যাপ্ত, ময়ুরধ্বনি মণ্ডিত লতাগুল্ম তৃণাচ্ছাদিত এই গোবর্ধন সকলের মনোরঞ্জনকারী।
🌸 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয়তমা রাধিকার মনোরথ পূরণের জন্য নিত্য গোলোকে তাঁর হৃদয় থেকে গোবর্ধনকে প্রকট করেন। ভগবান যমুনার তীরে নিকুঞ্জ পার্শ্বে রাসভূমিতে তাঁকে স্থাপন করেন। ক্ষণকালের মধ্যে গোবর্ধন পবর্তাকারে উর্ধ্বে, নিম্নে, পার্শ্বে নানাভাবে অপুর্ব শোভাসহ বিস্তার লাভ করে।
🌸 এই ভৌমলীলায় (জড়জাগতিক লীলায়) অংশগ্রহণের জন্য গোবর্ধন ভারতের পশ্চিম প্রদেশ শাল্মলীদ্বীপে দ্রোণাচলের পুত্ররূপে আবির্ভূত হন। গোবর্ধনের জন্মকালে দেবতারা পুষ্পবর্ষণ করেন। একবার মহামুনি পুলস্ত্য তীর্থ করতে করতে দ্রোণাচলের আতিথ্য স্বীকার করেন। সেখানে শান্ত সৌম্য অপূর্ব সুন্দর গোবর্ধনকে দর্শন করে তিনি মুগ্ধ হন। তিনি গোবর্ধনকে কাশীতে নিয়ে যেতে মনস্থ করে দ্রোণাচলের কাছে তার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। মুনি বাক্য শ্রবণে পুত্রস্নেহে বিহ্বল দ্রোণাচল অত্যন্ত মর্মাহত হন। অবশেষে মুনির মন রক্ষার্থে ও মুনির অভিশাপ থেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য তাঁর প্রিয়তম পুত্র গোবর্ধনকে অর্পণ করতে রাজি হন। গোবর্ধন পিতাকে ছেড়ে মুনির সাথে যেতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিল না।
🌸 তখন গোবর্ধন বলল, “হে মুনিবর! অষ্ট যোজন দীর্ঘ (৮ x ১২.৩ = ৯৮.৪ কিমি), পঞ্চক্রোশ প্রসারিত (৫ x ৩.২৪ = ১৬.২ কিমি) ও দুই যোজন উচ্চ (২ x ১২.৩ = ২৪.৬ কিমি) আমাকে কিভাবে আপনি নিয়ে যাবেন ! ”
(১ যোজন = ৯.০৯ মাইল =১২.৩ কিলোমিটার)
(১ ক্রোশ= ২.২৭২ মাইল = ৩.২৪ কিলোমিটার)
মহামুনি পুলস্ত্য বললেন, “তুমি আমার হস্তে অবস্থান করে গমন কর, আমি যোগবলে তোমাকে নিয়ে যাব। ”
গোবর্ধন বুঝল তাকে এই মুনিবর নিয়ে যাবেই, পিতার থেকে আলাদা হতে হবে ভেবেই মন ব্যাথিত হয়ে গেল। গোবর্ধনও জেদের বশে কঠিন শর্ত রাখল – “হে মুনে! আমি আপনার সাথে যেতে রাজি তবে আমারও একটি শর্ত আছে ━ পথিমধ্যে কোথাও আমাকে স্থাপন করবেন না, যদি করেন তবে আমি আর সে স্থান ত্যাগ করব না। ”
পুলস্ত্য মুনিও প্রতিজ্ঞা করলেন “ঠিক আছে তাই হবে। তোমাকে পথিমধ্যে নামাবো না। ” অশ্রুপূর্ণ চোখে মহাবল গোবর্ধন পিতা দ্রোণকে প্রণাম করে মুনির করতলে আরোহন করে যাত্রা শুরু করলেন। এইভাবে চলতে চলতে তারা ব্রজমণ্ডল পর্যন্ত গমন করেন।
🌸 ব্রজমণ্ডলের শোভা দর্শন করে গোবর্ধন চিন্তা করলেন যে, অখিল ব্রহ্মাণ্ডপতি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ব্রজে অবতীর্ণ হবেন। এখানে তিনি গোপ-গোপী সখাসহ বাল্য ও কৈশোর আদি বহু লীলাবিলাস করেন। অতএব পবিত্র যমুনাতীরে অবস্থিত এই ব্রজভূমি পরিত্যাগ করে আমি কোথাও যাব না। এইরূপ চিন্তাকরে গোবর্ধন এত ভারি হতে লাগল যে, মুনির পক্ষে তাকে বহন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। পূর্ব প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হয়ে মহামুনি পুলস্ত্য শৌচাদি কর্মের জন্য গোবর্ধনকে তাঁর হাত থেকে নামিয়ে রাখল শৌচান্তে স্নান সেরে এসে পুনরায় গোবর্ধনকে যেতে বললে গোবর্ধন তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। মুনি স্বীয় তেজবলে অনেক চেষ্টা করেও গোবর্ধনকে নিয়ে যেতে সমর্থ না হয়ে অভিশাপ দিয়ে বললেন━ “হে গোবর্ধন, তুমি ধৃষ্টতা করে আমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করলে না। অতএব, এখন থেকে তুমি প্রতিদিন এক তিল করে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। ” এই বলে পুলস্ত্য মুনি কাশী চলে গেলেন।
গিরিগোবর্ধন প্রতিদিন এক তিল করে ক্ষীণ হতে লাগল। বর্তমানে গোবর্ধন পরিক্রমাকালে দেখা যায় কোথাও গোবর্ধন অতি ক্ষীণরূপে অবস্থান করছে।
🌸 তবে যতদিন ভগীরথী গঙ্গা ও গোবর্ধন ভূতলে বিদ্যমান থাকবে ততদিন বদ্ধজীব কলির প্রভাব মুক্ত হয়ে ভগবদ্ভক্তি লাভের সুযোগ পাবে।
🌸 গোবর্ধনের উৎপত্তি তথা মহিমা শ্রবণ মাত্রই জীব হৃদয়ে ভগবদ্ভক্তির সঞ্চার হয় এবং গোবর্ধন পরিক্রমার ফলে ভগবতধাম ও কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্তি হয়।
◼️ গিরিগোবর্ধন মহিমা ◼️
✸ ব্রাহ্মণ ও রাক্ষসের কাহিনী ✸
======================
গিরিরাজের মহিমা ব্যক্ত করে নারদমুনি একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা শ্রবণমাত্রই মহাপাপ বিনষ্ট হয়।
✦ গোমতী নদী তীরে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। একসময় তিনি ঋণ গ্রহণের জন্য মথুরায় আসেন। কার্য সমাপনান্তে তিনি গৃহে ফিরবার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ক্রমে তিনি গোবর্ধন গিরিতটে এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে বর্তুলাকার এক খণ্ড শিলা গ্রহণ করে বনপথে ব্রজমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসবার পথে হঠাৎ তাঁর সম্মুখে তিনি ভয়ঙ্কর-দর্শন রাক্ষসকে দেখতে পান। বিশালাকায় রাক্ষসটি তাঁকে খাবার জন্য এগিয়ে আসছে দেখে সেই ব্রাহ্মণ অত্যন্ত ভয় পেয়ে গেলেন। অগত্যা প্রাণ রক্ষার্থে সেই শিলাখণ্ডটি রাক্ষসটির গায়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন। গিরিরাজ শিলার আঘাতে রাক্ষসটির প্রাণান্ত হলো এবং তৎক্ষণাৎ এক দিব্য দেহ ধারণ করল। হে ব্রাহ্মণ। আপনি যে শিলা দ্বারা আমাকে আঘাত করেছেন তা হচ্ছে গিরিরাজ গোবর্ধন শিলা যা ভগবানের অভিন্ন প্রকাশ। এই শিলা দর্শন মাত্র মানব জীবন ধন্য হয়। বহু তীর্থবাস, যজ্ঞ, দান, তপস্যা পবিত্র নদীতে স্নানে যে ফল লাভ হয় তা কেবল গিরিরাজ দর্শনে অনায়াসে লাভ হয়। গিরিরাজের মতো পবিত্র তীর্থস্থান আর নেই। তাই হে ব্রাহ্মণ, আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান কেননা, আপনি গোবর্ধনের দর্শন ও স্পর্শ পেয়েছেন। আর আমি সেই শিলার স্পর্শে কৃষ্ণ সারূপ্য লাভ করেছি।
✸ গোবর্ধন মহিমা ✸
===============
✦ গিরিরাজের মহিমার অন্ত নেই। শ্রীমতী রাধারাণী গিরিরাজকে ‘হরিদাস বর্ষ্য’ বলে বর্ণনা করেছেন। হরিদাস বর্ষ্য অর্থ হলো যিনি শ্রীহরির শ্রেষ্ঠ ভক্ত। শ্রী গোবর্ধন পুষ্টিকর তৃণ, বিচিত্র গুহা ও নানাবিধ কন্দমূলাদির মাধ্যমে গোপবালক ও ধেনু পাল পরিবেষ্টিত শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের নানাবিধ সেবায় যুক্ত, তাই শ্রীমতি তাঁর শ্রীমুখে তাকে ‘হরিদাস বর্ষ্য’ আখ্যা দান করেছেন।
✦ শ্রীকৃষ্ণ-বলরামের অতি প্রিয় গাভীদের সেবার জন্য একদিকে গোবর্ধন স্বচ্ছ শীতল পানীয়, ফল-মূল, বিশ্রামের জন্য সুশীতল বৃক্ষছায়া এবং কোমল স্নিগ্ধ শীতল বিশ্রামস্থান নিজ অঙ্গ সাজিয়ে রেখেছেন, তেমনি অপরদিকে শ্রীরাম-কৃষ্ণের চরণ স্পর্শ করে প্রেমে মোহিত হয়ে তৃণরাশির কম্পনের মাধ্যমে পুলক, আর্দ্রতার মাধ্যমে স্বেদ (ঘাম) ও ঝর্ণার মাধ্যমে অশ্রু প্রকাশ করে পরমানন্দে আত্মহারা হয়েছেন। তাই শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীপাদ শ্রীগিরিরাজের সান্নিধ্যে বসবাসই চরম কাম্য বলে শ্রীগিরিরাজের চরণে প্রার্থনা নিবেদন করছেন।
✦ আজও বহু ভক্ত প্রতিনিয়ত গোবর্ধনকে দর্শন, প্রণাম, পূজো, পরিক্রমা করে চলেছেন। এই পরিক্রমা চলছে রাতদিন। কেউ দণ্ডবৎ পরিক্রমা করছেন, কেউ আবার একস্থানে ১০৮ বার দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করে পরিক্রমা করছেন। অপারগ ব্যক্তিরা রিকশা বা গাড়িতে চড়েও পরিক্রমা করে থাকেন। স্ত্রী-পুরুষ, বালক-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পরম উৎসাহে গোবর্ধন পরিক্রমায় অংশগ্রহণে পরম আনন্দে মগ্ন হন। বর্তমানে বিশেষ করে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসে গোবর্ধন পরিক্রমা করছেন। আর প্রতিবছর কার্তিক মাসে এই গোবর্ধন পূজায় বিশ্বের সকল ইসকন কেন্দ্রে মহা-ধুমধামে মন্দির পরিক্রমা করে থাকেন। ব্রজবাসীদের আজ্ঞা নিয়ে গোবর্ধন শিলা এনে পূজো করা যায়। গোবর্ধন যে সাধারণ কোন পর্বত নয়, তা ভক্তিমান জন মাত্রই বুঝতে পারেন।
✦ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সাতদিন এই গোবর্ধন ধারণ করে ইন্দ্রের প্রকোপ থেকে ব্রজবাসীদের রক্ষা করেছিলেন। গোবর্ধন পরিক্রমাকালে শ্রীরাধাকুণ্ড, শ্যামকুণ্ড, কুসুম সরোবর, মানসি গঙ্গা, চাক্রেশ্বর মহাদেব, শ্রীহরিদেব মন্দির, শ্রীগোবিন্দ কুণ্ড, অপ্সরা কুণ্ড, লোঠাবাবার মন্দির, দান ঘাটি, উদ্ধবকুণ্ড ইত্যাদি বহু শ্রীহরি লীলা মনোরম স্থান দর্শনে ভক্তরা যারপর নাই আনন্দ সাগরে অবগাহন করেন। পরিশেষে, শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর রচিত শ্রীশ্রীগোবর্ধন বাস প্রার্থনা করে বলেছেন –
❝ হরিদয়িতমপূর্বং রাধিকা কুণ্ডমাত্ম
প্রিয়সখমিহ কণ্ঠে নর্মনালিঙ্গ গুপ্তঃ।
নবযুবযুগ খেলাস্ত্র পশ্যন্ রহো মে
নিজনিটক নিবাস দেহি গোবর্ধন ত্বম্ ॥❞
অনুবাদ: “হে গোবর্ধন! তুমি তোমার অত্যন্ত প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ দয়িত অপূর্ব শ্রীরাধাকুণ্ডকে কৌতুকবশতঃ কণ্ঠে আলিঙ্গনপূর্বক নবযুগ যুগল শ্রীশ্রীরাধা মাধবের কৃষ্ণলীলা নিভৃতে দর্শন করছ। অহো! তুমি সেই স্থানের নিকটে আমায় নিবাস প্রদান কর।”
◼️ গিরিরাজ গোবর্ধন লীলা ◼️
🌸 গিরিরাজ গোবর্ধন লীলা থেকে আমরা কৃষ্ণভাবনামৃতের কি শিক্ষা পাই, তার বর্ণন শ্রীমদ্ভাগবতম্ গ্রন্থের দশম স্কন্ধ চতুর্বিংশতি অধ্যায়ে রয়েছে।
❝ সচ্চিদানন্দরূপায় কৃষ্ণায়াক্লিষ্ট কারিনে।
নমো বেদান্তবেদ্যায় গুরবে বুদ্ধি সাক্ষিনে॥ ❞
━┉┈┈(গোপালতাপনী উপনিষদ – ১/১)
অনুবাদ: “আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জ্ঞাপন করছি। যাঁর অপ্রাকৃত রূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কারণ তাঁকে জানার অর্থ হলো সমগ্র বেদকে জানা এবং সেই কারণেই তিনি হচ্ছেন পরমগুরু।”
🌸 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তিনিই অনন্ত কোটি বিশ্ব সংসারে একমাত্র আরাধ্য বিষয়। এই তত্ত্ব উপলব্ধি করাকেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনামৃত।
❝ অহো পশ্যত নারীণামপি কৃষ্ণে জগদ্গুরৌ।
দুরন্তভাবং যোহবিধ্যন্মৃত্যুপাশান্ গৃহাভিধান্॥ ❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ১০/২৩/৪২)
অনুবাদ: “দেখ এই রমণীগণ সমগ্র জগতের গুরু শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের অসীম প্রেম বিকশিত করেছেন। এই প্রেম তাদের সেই মৃত্যু বন্ধন—পারিবারিক জীবনের প্রতি তাদের আসক্তি ছিন্ন করেছে।”
ব্রাহ্মণ পত্নীগণের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মে এই প্রেমময়ী ভক্তির দ্বারা আত্মসমর্পণে ভগবান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং তিনি বললেন তোমরা আমার প্রতি তোমাদের মন নিবিষ্ট কর তাহলে অতি শীঘ্রই তোমরা আমাকে লাভ করবে।
🌸 বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান সম্পাদনকারী ব্রাহ্মণ-পত্নীগণকে এইরূপে কৃপা করার পর কৃষ্ণ ও বলরাম একদিন দেখলেন যে, গোপেরা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে অনুরূপ এক যজ্ঞের আয়োজন করছেন। সর্বজ্ঞ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত বিষয় নিয়ে পূর্ণরূপে অবগত আছেন তবুও তিনি তাঁর পিতা নন্দমহারাজ এবং অন্যান্য প্রবীণ গোপেদের কাছে যজ্ঞ সম্বন্ধে অবগতির জন্য প্রশ্ন করলেন যে কেন তারা এই যজ্ঞের আয়োজন করছেন? এর ফল কি? এতে কি কি দ্রব্য লাগে? ইত্যাদি। ভগবান যখন গোবর্ধন লীলা করেছিলেন তখন কৃষ্ণের বয়স ছিল ছয় বা সাত বছর।
🌸 প্রত্যুত্তরে নন্দ মহারাজ বললেন, “বৃষ্টির নিয়ন্তা দেবরাজ ইন্দ্র, মেঘ সকল তার প্রতিনিধি এবং তারা প্রত্যক্ষভাবে জল সরবরাহ করে এবং তার দ্বারা শষ্য সমূহ উৎপাদন হয়, নদী, সরোবর ইত্যাদি পুষ্ট হয় এবং জীব তা গ্রহণ করে জীবনধারণ করে তাই তাকে যজ্ঞের মাধ্যমে এই সমস্ত অর্ঘ এবং পূজা সামগ্রী নিবেদন করা হয়।”
🌸 চৈতন্য চরিতামৃতে মধ্যলীলা ২২/৬২তে বৰ্ণনা করা হয়েছে ━
❝ ‘শ্রদ্ধা’ শব্দে-বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয়।
কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্বধর্ম কৃত হয় ॥ ❞
দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কৃষ্ণভক্তি করলে বা ভক্তি সহকারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলে আর কোন কর্তব্য কর্ম সম্পাদনের প্রয়োজন থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্তের কোন রকম বৈদিক শাস্ত্র বিধান অনুসারে কোন আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি কোন দেবদেবীর আরাধনা করারও প্রয়োজন নেই। বেদের অনুশাসন অনুযায়ী বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে অথবা দেবদেবীর পূজা করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিলাভ হয় না। পক্ষান্তরে কেউ যখন সর্বোতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হন তখন আপনা থেকেই সকল বৈদিক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের এই প্রকার বৈদিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের অনুমোদন প্রদান করেন নি। তিনি তাঁর বৃন্দাবন প্রকটলীলাতে তাঁর প্রতি অনন্য ভক্তির পন্থাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে মনস্থ করেছিলেন।
🌸 তাই পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রশ্নের উত্তরে নন্দমহারাজের বক্তব্য শ্রবণ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে ক্রুদ্ধ করার মানসে বৃন্দাবনের সমস্ত গোপেদের বললেন যে, এই প্রকার যজ্ঞের কোন প্রয়োজন নেই। দেবরাজ ইন্দ্রের প্রীতি সাধনের জন্য এই যজ্ঞ না করার তিনি দুটি সিদ্ধান্ত দিলেন, —
(১) প্রথমতঃ পার্থিব উন্নতি সাধনের জন্য কোন দেবদেবীর পূজা করার প্রয়োজন নেই। দেবদেবীর পূজা করে যে ফললাভ হয় তা ক্ষণস্থায়ী এবং অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরাই কেবল এই ধরনের ক্ষণস্থায়ী ফল লাভে উৎসাহী।
❝ অন্তবৎ তু ফলম্ তেষাম্ তদ্ ভবতি অল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মাম্ অপি॥ ❞
━┉┈┈(গীতা-৭/২৩)
অনুবাদ: “অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনালব্ধ সেই ফল অনিত্য ও অস্থায়ী। কারণ দেবতাদের উপাসকেরা তাঁদের আরাধ্য দেবতাদের লোক প্রাপ্ত হন কিন্তু আমার ভক্তরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।”
(২) দ্বিতীয়তঃ যে সমস্ত অনিত্য ফল এই সমস্ত দেবদেবীর আরাধনা করে লাভ হয়। তা পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ অনুসারেই তারা তা দেবার সক্ষমতা লাভ করেন বা শক্তিপ্রাপ্ত হন।
❝ স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তঃ-তস্য-আরাধনম্-ঈহতে।
লভতে চ-ততঃ কামান্-ময়া-এব বিহিতান্ হি তান্॥ ❞
━┉┈┈(গীতা-৭/২২)
অনুবাদ: “সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার কাছ থেকে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।”
পরমেশ্বর ভগবানের অনুমোদন ব্যতীত কেউ কোন কিছু দিতে পারেন না। কিন্তু কখনো কখনো জড়া প্রকৃতির গুণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেবতারা নিজেদের সর্বশক্তিমান মনে করে এবং গর্বান্বিত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের পরম ভগবত্তার কথা বিস্মৃত হন।
🌸 শ্রীমদ্ভাগবতমে বর্ণনা করা হয়েছে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কেবল একজন দেবতাকে অপমান করার উদ্দেশ্য ছিল না বরং ভগবানের এক ক্ষুদ্র ভৃত্য ইন্দ্ররূপে যার প্রতিনিধিত্ব করার কথা, তার হৃদয়ের জাগরুক অহঙ্কারের বিশাল পর্বতটিকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইন্দ্র একটি ‘পদ’ (position) যেখানে ভগবানের এক ক্ষুদ্র ভৃত্য ভগবানের ইচ্ছায় অধিষ্ঠিত হন এই মনোভিলাষ নিয়ে তিনি ভগবানের সেবায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত থাকবেন। কিন্তু ইন্দ্রলোকে বৈভব, বিলাসিতা ও আড়ম্বরের ঘেরাটোপে কখনও কখনও ইন্দ্রদেব নিজের কর্তব্য ভুলে যান, অহংকারের কারণে নিজেকে সর্বশক্তিমান ভগবান মনে করে। গোবর্ধন লীলার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রদেবের অহঙ্কারের বিশাল পর্বতটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।
🌸 তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে বৃন্দাবনের গোপেদের আয়োজিত ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে তার ক্রোধের উদ্রেক করেছিলেন। ইন্দ্রের গর্ব চূর্ণ করবার জন্য পিতা শ্রীনন্দ মহারাজকে বললেন, ━ “হে পিতঃ! এই জগতে জীবগণ তার নিজ কর্মফলের কারণে জন্ম-মৃত্যু, জরা ,ও সুখ, দুঃখ, ভয় প্রভৃতি ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করেন। কর্মফলেই ৮৪ লক্ষ যোনি দেহ প্রাপ্তি হয় এবং কর্ম বশেই পুনরায় দেহ ত্যাগ করে। সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমোগুণের দ্বারা যথাক্রমে বিশ্বের স্থিতি, সৃষ্টি ও বিনাশ হয়ে থাকে। মেঘসকল রজঃ গুণে চালিত হয়ে বারি বর্ষণ করে, এতে ইন্দ্রের কিছু কাজ নেই। আমরা বৈশ্য জাতি, কৃষি-বাণিজ্য-পশুপালন প্রভৃতির মধ্যে গো-রক্ষাকেই আমরা প্রধান জীবিকা রূপে বরণ করে থাকি। এই পর্বতের মধ্যে তৃণ-লতা ভক্ষণ করে গাভীগুলো বেঁচে থাকে। আমরা এই পর্বতেই বনবাসীর ন্যায় বসবাস করি। অতএব এই গো, ব্রাহ্মণ ও এই পর্বতের উদ্দেশ্যে আমাদের যজ্ঞ-পূজা করা একান্ত দরকার। ইন্দ্রের পূজার জন্য দ্রব্যগুলিকে এই অনুষ্ঠানে নিযুক্ত করলে আমাদের নিশ্চয়ই মঙ্গল হবে।” শ্রীকৃষ্ণের এমন মধুর কথা শ্রবণ করে শ্রীনন্দ মহারাজ ও গোপগণ সমস্ত দ্রব্যাদি নিয়ে গােবর্ধন পর্বতের পূজা-যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।
✸ আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ ✸
===================
সুতরাং, এই জগতে জীবেরা তাদের নিজ নিজ প্রারব্ধ কর্মফল ভোগ করতে বাধ্য হয়। যেহেতু মানুষের স্বভাবজাত ভাগ্য ইন্দ্র কোন ভাবেই পরিবর্তন করতে পারেন না, তাহলে মানুষ কেন তার পূজা করবে? প্রত্যেকেই তার নিজ স্বভাবের নিয়ন্ত্রণের অধীন। সমস্ত দেবতা, দানব ও মানুষ সহ এই নিখিল ব্রহ্মাণ্ড স্বভাবেই অবস্থিত। যেহেতু কর্মই বদ্ধজীবের বিভিন্ন উচ্চ ও নীচ শ্রেণীর জড়দেহ সমূহ গ্রহণ ও ত্যাগের কারণ, তাই এই কর্ম তার শত্রু, মিত্র, উদাসীন সাক্ষী, তার গুরু ও নিয়ন্ত্রকারী ঈশ্বর, সুতরাং আন্তরিকভাবে কর্মেরই পূজা করা উচিত। মানুষের উচিত তার স্বভাবগত অবস্থায় অবস্থান করে তার নিজের কর্তব্য অনুষ্ঠান করা। বাস্তবিক যার দ্বারা আমরা ভালভাবে জীবন ধারণ করতে পারি সেটিই আমাদের আরাধ্য বিগ্রহ। যদি কোন বস্তু প্রকৃতই আমাদের জীবন পালন করে থাকে কিন্তু আমরা যদি অন্য বস্তুর আশ্রয় গ্রহণ করি তাহলে আমরা কিরূপে প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে সমর্থ হব।
সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রকৃতির এই তিন গুণ সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ বিশেষত, রজঃগুণ এই জগত সৃষ্টি করে এবং রজোগুনের দ্বারা চালিত হয়ে মেঘরাশি সর্বত্র তাদের বারি বর্ষণ করে এবং এই বৃষ্টির দ্বারা সমস্ত জীব তাদের জীবনধারণ করে। এই ব্যবস্থাপনাতে ইন্দ্রের করণীয় কিছুই নেই। শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন, যেহেতু ব্রজবাসীগণের বাসস্থান বন ও পাহাড় তাই গো, ব্রাহ্মণ ও গিরিগোবর্ধনের সন্তোষ বিধানের জন্য একটি যজ্ঞ সম্পাদন করা উচিত। ইন্দ্রপূজার জন্য একত্রিত সমস্ত উপকরণ এই যজ্ঞে ব্যবহার করা হোক ৷ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞাগ্নিতে আবাহন করুন। তারপর সেই ব্রাহ্মণগণকে উত্তমরূপে পাক করা ভোজন সামগ্রী ভোজন করানো হোক এবং সমাপনান্তে তাদের গাভী ও অন্যান্য উপযুক্ত দানসামগ্রী দেওয়া হোক। প্রত্যেকের দ্বারা এই ভাবে ভোজন গ্রহণ করে যথাযথ বসন অলঙ্কার ও দেহকে চন্দন দ্বারা ভূষিত করে যজ্ঞাগ্নি ও গিরিগোবর্ধনকে পরিক্রমা করা হোক। শ্রীকৃষ্ণের অভিলাষ ছিল যে, সমস্ত মানুষ এমন কি পশুরা পর্যন্ত ভগবানকে নিবেদিত ভোজন সামগ্রী গ্রহণ করুক। সকলকে উৎসাহিত করার জন্য স্বয়ং ভগবান তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ ব্রাহ্মণ, গাভী এবং স্বয়ং ভগবানের প্রীতিবিধানের জন্য যা কিছুই সম্পাদিত হয় তা সমগ্র জগতের পক্ষে মঙ্গলকারক।
বৃন্দাবনবাসীরা কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রতিই আসক্ত ছিলেন। সেটিই ছিল তাদের জীবন ধারণের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভগবানের শুদ্ধভক্ত হওয়ার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের বা তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তারা কোন দর্শনেও আগ্রহী ছিলেন না তারা শুধু এইটুকু জানতেন কৃষ্ণ তাদের বলেছেন। যেহেতু তারা কেবলমাত্র কৃষ্ণকে ভালবাসেন এবং গভীর প্রীতিবশত কৃষ্ণ যা অনুরোধ করেছেন তারা কোন কিছুর বিবেচনা না করে কৃষ্ণের জন্য তৎক্ষণাৎ তাই করেছিলেন। যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে তাঁর মধ্যে ধারণ করেন সেই পরম তত্ত্বের প্রতি যেহেতু তারা আসক্ত ছিলেন তাই তাদের মানসিকতা ছিল মাৎসর্যহীন। ব্রজবাসীগণ সকল তত্ত্বের পরম কারণ শ্রীকৃষ্ণকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন তাই তাদের কৃষ্ণ ব্যতীত অন্য কোন কারণ প্রভাবিত করতে সক্ষম হতো না।
🌸 যজ্ঞের জন্য গিরিগোবর্ধন পর্বতের সামনে পায়সান্নের পুকুর তৈরি করা হল, বিভিন্ন সবজি নির্মিত বিভিন্ন ধরনের ভক্ষ্য সামগ্ৰীর পাহাড় নির্মিত করা হল! নানা রকমের ভাজা ও সেকা দুই ধরনের শৌখিন পিঠার স্তূপ তৈরি করা হল। আর প্রাপ্য দুগ্ধজাত সমস্ত দ্রব্যাদি এই যজ্ঞের জন্য ব্যবহার করা হল। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যথাযথভাবে যজ্ঞাগ্নিতে আবাহন করতে শুরু করলেন। এরপর সমস্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে শ্রীকৃষ্ণ একটি বিরাট দিব্যরূপ ধারণ করে বৃন্দাবনের অধিবাসীদের কাছে ঘোষণা করলেন যে স্বয়ং তিনিই গোবর্ধন পর্বত যাতে তাঁর ভক্তদের কোন সংশয় না থাকে যে, গোবর্ধন পর্বত ও শ্রীকৃষ্ণ অভিন্ন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ সেখানে নিবেদিত সমস্ত ভোজন সামগ্রী ভোজন করতে লাগলেন। ভগবানের সমস্ত লীলাই দিব্য, সুতরাং ভগবানের সেই ভোজন ছিল দিব্য। কিছু সময়ের মধ্যে ভোগ্য দ্রব্য কম পরে গেল, গোবর্ধন পর্বত আরও ভোজনের জন্য আবদার করতে লাগলেন। গোকুল বাসী জোগান দিতে দিতে হিমশিম খেতে লাগল। অবশেষে গোবর্ধন পর্বতের সামনে গোকুলবাসীরা হার স্বীকার করে তাঁর শরণাপন্ন হলেন। তুষ্ট হয়ে ভগবান বিধান দিলেন ভোগে তুলসী পাতা অর্পণ করতে। এতে ভগবান অতি তুষ্ট হয়ে ভোজন সমাপ্ত করলেন। এই লীলার পিছনে ভগবানের উদ্দেশ্য ছিল ━
১) শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, ইন্দ্র বা অন্য দেবগণ নয়।
২) গোবর্ধন পর্বত ও শ্রীকৃষ্ণ অভিন্ন।
৩) বিশ্বাস ভক্তি সহকারে ভগবানের শরণাপন্ন হলে ভগবান সর্বদা তার সহায় হন, তাকে রক্ষা করেন সর্বদা।
৪) ভগবানের নিবেদিত ভোগে তুলসী পাতা দিলে ভগবান অতীব তুষ্ট হন।
ভোগে অন্নের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে সেই অন্ন পাহাড়ের মত দেখতে হয়ে যায়। তাই এটাকে অন্নকূট বলা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় সেই থেকে ‘শ্রীশ্রীঅন্নকূট মহোৎসব’ -এর প্রচলন শুরু হয়। অন্নকূট উৎসবে উপবাসের বিধান নেই। তবে দুপুরবেলা ভগবানকে ভোগ অর্পণ করে প্রসাদ পাওয়া যাবে। কৃষ্ণ এবং গোবর্ধন পর্বত যে অভিন্ন তা ভক্তরা আজও শ্রদ্ধা সহকারে মেনে চলেন। গোবর্ধন শিলাকে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের অভিন্ন রূপে আরাধনা করা হয় এবং তারপর গিরি-গোবর্ধনকে প্রদক্ষিণ করা হয়।
🌸 তো এইভাবে কৃষ্ণ সমস্ত ব্রজবাসীদের সমাবেশ করে গোবর্ধনের নিকটে আনলেন এবং এই মহোৎসব করলেন। এই অনুষ্ঠানের পর তারা গৃহে ফিরে গেলেন, ইন্দ্রদেব নিজেকে ঈশ্বর মনে করে ক্রোধান্বিত হয়ে ঔদ্ধত্যের সাথে বললেন যে, “এই কৃষ্ণ কে? ব্রজবাসীগণ এক ছোট্ট বালকের কথা শুনছে! সে এক সাধারণ বালক মাত্র কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনছে এবং আমার যজ্ঞ-পূজা বন্ধ করে অবমাননা করার সাহস করছে। আমি ব্রজ-গোপগণকে এর উচিত শিক্ষা দেব।” এইরূপ ভেবে ইন্দ্রদেব প্রলয়কারী সাম্বর্তক- মেঘগণকে আহ্বান করে শিলা বৃষ্টির দ্বারা ব্রজবাসীগণকে উৎপীড়নের আদেশ দিলেন। যেন বৃন্দাবনের উপর প্রবলভাবে বারিবর্ষণ করে সেই অঞ্চলকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করে দেয়। জড় সৃষ্টি যখন ধ্বংস করার প্রয়ােজন হয়, তখন এই মেঘকে ডাকা হয়।
🌸 আসুরিক ভাবাপন্ন হয়ে ইন্দ্র মনে করেছিলেন যে, তিনিই হচ্ছেন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর। অসুরেরা যখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানকে অস্বীকার করে। ইন্দ্র যদিও অসুর ছিলেন না কিন্তু তাঁর উচ্চ পদের গৌরবে গর্বান্বিত হয়ে তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনিই শ্রীকৃষ্ণের মতাে পরম নিয়ন্তা, সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছেন।
বৃন্দাবনে খুব বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া সৃষ্টি হল। সাম্বর্তক- মেঘগণেরা বড় বড় স্তম্ভের আয়তনে বা বিশাল বিশাল হাতির মতো আয়তনে স্থুল বৃষ্টির ফোঁটা ব্রজবাসীগণের উপর বর্ষণ করাতে লাগল। ব্রজভূমি জলে মহাসমুদ্রের মতো হয়ে উঠল। শুধু বৃষ্টিই নয়, পাথরের মত বিশালাকৃতির শিলাখন্ডও নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ইন্দ্রদেব ঐরাবত হাতির পীঠে উঠে তাঁর বজ্র শক্তি প্রয়োগ করে বৃন্দাবনে মহা দুর্যোগ উৎপন্ন করলেন। মুষলধারায় বৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হল। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বায়ু বইছিল এবং ভীষণ শীতে বৃন্দাবনের প্রতিটি প্রাণী থরথর করে কাঁপতে লাগল। তাদের আর কোন আশ্রয় ছিল না, তাই ব্রজবাসীগণ গােবিন্দের কাছে গিয়ে তার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল। গাভীরা এই প্রচণ্ড বর্ষণে অত্যন্ত উৎপীড়িত হয়ে তাদের দেহের দ্বারা মস্তক এবং বৎসদের আচ্ছাদিত করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল।
🌸 সেই সময় বৃন্দাবনের সমস্ত অধিবাসীরা মহাভয়ভীত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন,
❝কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহাভাগ ত্বনানথং গোকুলং প্রভো।
ত্রাতুমর্হসি দেবান্নঃ কুপিতাৎ ভক্তবৎসলঃ॥ ❞
━━┉┈┈(শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২৫.১৩)
অনুবাদ: “হে কৃষ্ণ, হে মহাভাগ, হে ভক্তবৎসল, হে সর্বশক্তিমান, আমাদের প্রতি কোপান্বিত ইন্দ্রের হাত থেকে তোমারই প্রতিপাল্য গোকুলকে রক্ষা কর।”
🌸 এই প্রার্থনা শুনে শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, ━ “ইন্দ্র তাঁর যজ্ঞের সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে এই অসময়ে প্রলয়কালীন শিলা-বৃষ্টি বর্ষণ করছে। এসবই ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের বলপ্রকাশ। তাই তিনি ঠিক করলেন, এই ইন্দ্রদেব নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করে তার শক্তি প্রদর্শন করছে কিন্তু এখন তার পদমর্যাদার গর্ব ও তার শক্তির দর্প চূর্ণ করা দরকার।
দেবতারা আমার ভক্ত, তাদের সীমিত শক্তি অনুযায়ী উপযুক্ত পদ প্রদান করেছি আমারই তত্ত্বাবধানে, আমারই শক্তিতে আবেশিত হয়ে এই অখিল বিশ্বজগত পরিচালনার সেবা (সহায়তা) করবার জন্য। তাই তাদের পক্ষে আমার পরম পদ ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়! কিন্তু পদমর্যাদার গর্বে সে এতই গর্বিত হয়ে উঠেছে যে, সে সেই শক্তির দুর্ব্যবহার করেছে! আমি এখন তাকে এই মিথ্যা অহঙ্কার থেকে মুক্ত করব।
বৃন্দাবনের শুদ্ধ ভক্তরা এখন সর্বতােভাবে আমার কৃপার ওপর নির্ভর করে আছে এবং আমিও সম্পূর্ণভাবে তাদেরকে আমার আশ্রয়ে গ্রহণ করেছি। এখন আমি তাদের রক্ষা করব। আমার যােগমায়ার প্রভাবে আমি তাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করব।”
🌸 মনে মনে এইভাবে চিন্তা করে শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বাম হাতের কনিষ্ঠ (কড়ে) আঙ্গুলের উপর গােবর্ধন পর্বত তুলে ধরলেন—ঠিক যেভাবে একটি শিশু মাটি থেকে একটা ব্যাঙের ছাতা তােলে। এইভাবে তিনি ‘গিরি গােবর্ধন ধারণ লীলা’ প্রদর্শন করলেন। তাঁর বাম হাতের কনিষ্ঠ (কড়ে) আঙ্গুলের উপর শ্রীকৃষ্ণকে সেই বিরাট পর্বতকে ছাতার মতাে ধারণ করতে দেখে ব্রজবাসীরা অবাক হয়ে গেলেন, ভগবানের লীলা দেখে ধন্য হলেন। পর্বতের নিচে জীবজন্তু, গাভী সহ ব্রজবাসীরা আশ্রয়গ্রহণ করে ভগবানের গুন কীর্তন করতে থাকলেন। একটানা একভাবে শ্রীকৃষ্ণ সাতদিন ত্রিভঙ্গ মুরলীধর হয়ে এই পর্বত ধারণ করেছিলেন। অপর দিকে ইন্দ্র দুর্যোগ চালিয়ে গেলেন। ইন্দ্রের প্রচণ্ড বজ্রাঘাত গােবর্ধন পর্বত রূপে স্বয়ং ভগবান নিজের উপর নিলেন।
তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং নিজের সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করে সেই এক সপ্তাহ ধরে একটা ছাতার মতো গােবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে রইলেন। এই হল ভক্তদের প্রতি ভগবানের সেবা। ভক্তের সামান্য ভক্তি, সম্পূর্ণ শরনাগতির নিষ্কাম কর্মকে ভগবান বৃহৎ ফলস্বরূপ এইভাবে বারেবারে ফিরিয়ে দেন। ‘গিরি গােবর্ধন ধারণ লীলা’ তারই এক উদাহরণ। ভক্তের জীবনে পর্বত সমান বেদনা দুঃখ কষ্টকে তিনি এইভাবে সরিয়ে পরিত্রাণ করেন।
🌸 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গলায় ঝুলন্ত কৌস্তভ মণি দিব্যভাবে প্রজ্বলিত করে সূর্যালোকের থেকেও বেশী উজ্জ্বল কিরণ ও তাপ প্রদান করে প্রলয়কালীন প্রচণ্ড শীতলতা, আর্দ্রতা দূর করে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত সেবক, ভগবানের বাহ্যিক প্রাণ শ্রীমান বলরাম অনন্ত শেষনাগ রূপে গােবর্ধনকে বেষ্টন করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শান্ত রইলেন, যাতে প্রলয়কালীন বন্যার জল সেই স্থানে প্রবেশ করে কোনরূপ বিড়ম্বনা করতে না পারে। তখন ইন্দ্র কুপিত হয়ে বজ্র নিক্ষেপ করলে শ্রীকৃষ্ণের শক্তির প্রভাবে বজ্রসহ ইন্দ্রের পুরো হাতটিই অসাড় হয়ে গেল। (শ্রীগর্গসংহিতা গিরিরাজ খণ্ড ৩।২০-২৫)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ডান হাতে বাঁশি বাজাতে লাগলেন, তাতে ব্রজবাসীদের মন থেকে ভয় বিচ্যুত হয়ে তাঁর দিকে আকৃষ্ট হল। এরপর তাদের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা শুরু হল এবং সকলের এই সমাগমকে উৎসব হিসাবে পালন করতে শুরু করল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা সব বাহ্যিক চেতনা তাদের লোপ পেল, কেবল কৃষ্ণতে মন একাগ্র হল। প্রিয় কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার একান্ত ইচ্ছে, একসাথে সময় কাটানোর ইচ্ছা পূরণ হল। গোপিকাদের হৃদয় আরও প্রফুল্ল, এখন কৃষ্ণ সঙ্গ করতে কোনও অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই, বাধা দেবার কেউ নেই। প্রিয় কৃষ্ণকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হবে না, সামনাসামনি বিনা দ্বিধায় সকলের সম্মুখে দেখতে পাবে। রাধা (শক্তি) ও কৃষ্ণ (শক্তিমান) উভয়ের মিলিত রূপ মিলে সম্পূর্ণ ভগবানকে দর্শন করলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল চক্রাকারে ঘিরে রাখা ব্রজবাসীরা সকলেই কৃষ্ণকে সামনে থেকেই দর্শন করছিল, যারা পাশে বা পিছনে ছিল সকলেই কৃষ্ণকে সামনাসামনি দেখছিল।
✸ আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ ✸
===================
এই লীলার মাধ্যমে ভগবান বোঝালেন, যেখানে একজন বদ্ধজীব নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার ছায়াকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে অসাধ্য, সেখানে নিজেকে নিজে উত্তোলন করা অসম্ভব। মানুষের চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার সীমাবদ্ধতা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। ভগবান তাই করে দেখালেন এই লীলার মাধ্যমে। নিজেকে নিজেই উত্তোলন করলেন, প্রত্যেকের কৃষ্ণকে কাছে পাবার অভিলাষ একসাথে পূর্ণ করেছিলেন, প্রত্যেককে সামনে থেকে দর্শন দিয়েছিলেন, প্রত্যেকের হৃদয়কে প্রেমানন্দে ভরিয়ে তৃপ্ত করেছিলেন। তিনি আবার দেখালেন তিনি কত কৃপাময়! যতই বিপদ আসুক না কেন তিনি তাঁর শরণাগতদের উদ্ধার করবেনই করবেন।
🌸 এক সময় সাম্বর্তক-মেঘ সমূহের জল শেষ হয়ে গেলো, আর বর্ষণ করার শক্তি থাকলো না। ইন্দ্রের শক্তিও ফুরিয়ে গেলো। ইন্দ্র বুঝতে পারলেন তার ও সহচরদের শক্তি শেষ করার ক্ষমতা আছে কেবলমাত্র একজনেরই, তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তার অর্থ হল এই ছোট্ট বালকটি আর কেউ নন, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এত শক্তি প্রয়োগ করে যখন কিছুই ক্ষতি করতে পারি নি, এর অর্থ আগেই বোঝা উচিত ছিল, অহংকারে অন্ধ হয়ে কেবল শক্তিই প্রয়োগ করে গেছি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তির কাছে তিনি কিছুই না। ভগবানের ইচ্ছাতেই সব। তিনি প্রভু। হরি যাকে রক্ষা করেন তাঁকে মারবার ক্ষমতা কারোর নেই।
শ্রীকৃষ্ণের এই অলৌকিক শক্তি দেখে দেবরাজ ইন্দ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সংকল্পচ্যুত হলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করে শরনাগতি নিলেন। ইন্দ্রদেব অপকর্ম করলেও তার কারনেই ব্রজবাসীরা একসাথে টানা ৭দিন একসাথে সময় কাটাতে পেরেছেন, তাদের আনন্দ বৃদ্ধি করেছেন এই ভেবে ইন্দ্রকে ক্ষমা করে দিলেন।
🌸 ইন্দ্র এরপর স্বর্গে ফিরে গেলে দেবগুরু বৃহস্পতি তাকে এসে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। এরপর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে তার অপকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্তমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দেন। ইন্দ্র আবারও গাভীমাতা সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে গোবর্ধন পর্বতের কাছে পৌঁছে ভগবানের সম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং প্রায়শ্চিত্তমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার অনুমতি চাইলেন। তার অশ্রুজলে শক্রকু-নামক সরোবর সৃষ্টি হলো। সর্বশক্তিমান ভগবান মৃদু হেসে ইন্দ্রকে অনুমতি প্রদান করলেন। তদনুসারে, ইন্দ্রদেব স্বর্গীয় দিব্য সুরভী গাভীর দুধ দিয়ে এবং ঐরাবত আকাশগঙ্গার জল দিয়ে ভগবানের মহাঅভিষেক সম্পন্ন করলেন। সেইসাথে ভগবানকে দুর্মূল্য হীরা খচিত মুকুট পরিয়ে দিলেন এবং তাঁকে অনুরোধ করলেন “দেবাধি দেব” (“Devadhi Deva”; দেবগণের প্রভু) উপাধি গ্রহণের জন্য। একেই “গোবিন্দ পট্টাভিষেকম” (“Govinda Pattabhishekam”) বলা হয়।
🌸 এরপর আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত হল, তখন আবার সূর্যোদয় হল এবং প্রচণ্ড বায়ু ও বৃষ্টি নিবৃত্ত হল।
সেই সময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, এখন যাঁর আরেক নাম হল গিরিধারী, বললেন, “হে গােপগণ তােমরা, এখন তােমাদের স্ত্রী-পুত্র, গাভী এবং ধনসম্পদ সহ ফিরে যেতে পার। এখন আর কোন ভয় নেই। বায়ু ও বৃষ্টি এখন নিবৃত্ত হয়েছে এবং নদীর প্লাবন প্রশমিত হয়েছে।”
তখন সমস্ত গােপেরা তাঁদের উপকরণসমূহ গাড়িতে (শকটে) পূর্ণ করে তাদের গাভী এবং অন্যান্য পশুদের নিয়ে ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁরা সকলে বেরিয়ে এলে শ্রীকৃষ্ণ সকলের সামনে অনায়াসে গােবর্ধন পর্বতকে আগের মতাে স্বস্থানে স্থাপন করলেন। সকলেই অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের মায়ার প্রভাবে সবই বিষ্ণুর ইচ্ছা বলে মেনে নিয়ে প্রেমের আবেগে পরিপূর্ণ চিত্তে বৃন্দাবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে তাকে আলিঙ্গন করলেন এবং ভক্তিভরে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলেন।
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্বভাবত স্নেহশীলা গােপীরা তাদের অশ্রুমিশ্রিত দধি তাকে দিলেন এবং তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। মা যশােদা, মা রােহিলী, নন্দ মহারাজ এবং মহাবলীয়ান বলরামও তখন স্নেহবিহুল হয়ে একে একে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন।
তখন স্বর্গের দেবতা, সিদ্ধ, গন্ধর্ব এবং চারণেরা তুষ্ট হয়ে স্তুতি এবং পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন স্বর্গের দেবতারা শঙ্খ, দুন্দুভি, ডম্বরু প্রভৃতি বাজনা বাজাচ্ছিলেন এবং গন্ধর্বপতিরা গান করছিলেন।
তারপর পরমেশ্বর ভগবান তার সখা এবং পশু-পরিবৃত হয়ে তার গৃহে ফিরে গেলেন। গােপিকারা হৃদয়স্পর্শী শ্রীকৃষ্ণের সেই বিস্ময়জনক কার্যের বিষয়ে হৃষ্টচিত্তে গান করতে লাগলেন।
🌸 ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রের গর্ব চূর্ণ করবার জন্য এক হস্তে গােবর্ধন পর্বতকে উঠিয়ে পর্বতের নিচে গোপগণকে আশ্রয়দান করলেন। শ্রীকৃষ্ণ সাতদিন এই পর্বত ধারণ করেছিলেন এবং এই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ-পূজাকে “শ্রীশ্রীঅন্নকূট মহোৎসব” হিসাবে জগৎবাসীগণ পালন করে থাকেন।
✤✸ ছাপ্পান্ন ভোগ (৫৬ ভোগ/ Chappan Bhog) ✸✤
মাতা যশোদা বালক কৃষ্ণকে একদিনে অষ্টপ্রহর ভোজন করাতেন। গােবর্ধন পর্বতকে টানা ৭ দিন কৃষ্ণ ধারণ করার কারনে তিনি অন্ন-জল গ্রহণ করেননি। তিনি কর্তব্যে অবিচল থেকে গ্রামবাসীদের প্রাণরক্ষায় অভুক্ত থাকেন।
দিনে আট বার করে খাদ্য গ্রহণ ধরে সাত দিনের হিসেবে তাঁর জন্য (৮x৭ =৫৬) ছাপ্পান্ন রকম পদ তৈরি করেন গোকূলবাসী। এই ৫৬ রকমের পদই ছাপ্পান্ন ভোগ (৫৬ ভোগ; Chappan Bhog) নামে পরিচিত হয়।
৫৬ ভোগে থাকে ২০ ধরনের মিষ্টি, ১৬ রকমের নোনতা খাবার এবং ২০ রকমের শুকনো ফল। মাখন মিছরি, ঘোল, মোহনভোগ, জিরে লাড্ডু, জিলিপি, রসগোল্লা, রাবড়ি, মালপোয়া, মুগডাল হালুয়া, মাতির, চাটনি, মোরব্বা, দই, শাক, ভাত, খিচুড়ি, বেগুন সবজি, লাউ সবজি, পুরি, ভাজা, পাপড়, পকোড়া, টিকিয়া এবং পান নিবেদন করা হয়।
প্রথমে দুধের উপাচার, তারপর নোনতা এবং তারপর মিষ্টি জাতীয় খাবার নিবেদন করা হয়।
✤✸ গোবর্ধন লীলা থেকে কৃষ্ণভাবনামৃতের শিক্ষণীয় বিষয় ✸✤
কৃষ্ণভক্তেরা গোবর্ধন শিলাকে অভিন্ন কৃষ্ণজ্ঞানে পূজা করে থাকেন, কেননা এই পূজা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীবিগ্রহের পূজারই মতো। শ্রীকৃষ্ণ যখন গোবর্ধন লীলা করছিলেন তখন তাঁর বয়স কেবলমাত্র সাত বছর। সাত বছরের একটি ছোট্ট শিশু কিভাবে এতো বড় গোবর্ধন পর্বত হাঁতের কনিষ্ট আঙ্গুলে টানা ৭ দিন, ৭ রাত ধারণ করে ছিলেন?
কৃষ্ণভক্ত কিংবা শ্রদ্ধাবান ছাড়া অনেকেই এমন সংশয় প্রকাশ করে থাকেন। সামান্য বুদ্ধি দিয়ে ভগবানের ক্রিয়াকলাপ বিচার করা, লীলাদর্শন করা, তাতে সংশয় প্রকাশ করা উচিৎ নয়, কারণ আমাদের বোঝা উচিত এই ছোট্ট শিশুটিই হলেন বিশ্বব্রহ্মান্ডের অধিশ্বর পরমপুরুষ ভগবান। তাই জড়জাগতিক বিচারে বয়সে সাত বছর হলেও তিনি ছিলেন ষড় ঐশ্বর্যপূর্ণ সকলের প্রভু। তাই তার কাছে কোনকিছুই অসম্ভব নয়। ঠিক যেমন, সামান্য একটা পিঁপড়ের কাছে পদ্মফুলকে তোলা নিতান্তপক্ষে খুব কঠিন কিন্তু একটা হাতির পক্ষে একটি পদ্মফুল তোলা অতি তুচ্ছ একটি ব্যাপার। ঠিক তেমনি আমরা হলাম এই পিঁপীলিকা তুল্য আর কৃষ্ণ স্বয়ং ঐরাবত, একমাত্র তাঁর নির্দেশেই অখিল ব্রহ্মান্ডের সবকিছুই সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
✍🏾(০১) বৃন্দাবনবাসীরা কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রতিই আসক্ত ছিলেন। সেটিই ছিল তাদের জীবন ধারণের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভগবানের শুদ্ধভক্ত হওয়ার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের বা তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সংক্রান্ত যজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
✍🏾(০২) শ্রীকৃষ্ণ এই গোবর্ধন পূজার মাধ্যমে একটি মহামূল্যবান শিক্ষা আমাদের প্রদান করেছেন যে এই জড় জগতের একজন শক্তিশালী প্রশাসকের পূজা উপেক্ষা করে তার বিনিময়ে শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ গোবর্ধন নামক এক পর্বতের পূজা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে হবে। অর্থাৎ জড় জাগতিক কোন কিছুই যত শক্তিশালী হোক না কেন তা আমাদেরকে এই জন্ম মৃত্যুর করাল বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে না। তা পারেন একমাত্র পরমেশ্বর মুকুন্দ। যেহেতু ব্রজবাসীগণ স্বতঃই মুকুন্দশরণাগত ছিলেন তাই তাদের নিকট নদী, পর্বত বা অন্য কোন বস্তু লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ এবং সেটি পালনের মাধ্যমে তারা পরমেশ্বর ভগবানকে তাদের হৃদয়ে আবদ্ধ করেছিলেন। এই গোবর্ধন পূজা উৎসব তাই আমাদের কাছে জড় জাগতিক ধ্যানধারণা বশতঃ দেব পূজা আরাধনার পদ্ধতি পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হওয়ার উৎসব এবং এটিই হলো কৃষ্ণভাবনামৃতের শিক্ষা।
✍🏾(০৩) শ্রীকৃষ্ণের চরণাশ্রয়ের তিনটি বিশেষ সুফল হল ━
শ্রীকৃষ্ণের চরণের মহিমা অপার। তন্মধ্যে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তিনটি বিশেষ মহিমার কথা উল্লেখ করেছেন। যথা: ১. অশোক, ২. অভয় ও ৩. অমৃতপূর্ণ।
❝এখন বুঝিনু প্রভু তোমার চরণ,
অশোক অভয়-অমৃতপূর্ণ সর্বক্ষণ। ❞
অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে যিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন, তিনি কখনো শোকবিহ্বল হন না। তিনি সমস্ত ভয় থেকে মুক্ত হন এবং নিরন্তর কৃষ্ণচরণামৃত আস্বাদন করে আনন্দসমুদ্রে ডুবে থাকেন।
✍🏾(০৪) এই লীলার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান প্রমাণ করেছিলেন যে, ভক্তিপূর্ণ সেবায় নিযুক্ত আত্মসমর্পণকারী ভক্ত, সমস্ত বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত এবং বস্তুগত অনুগ্রহের জন্য কোনও দেবদেবীর উপাসনা করার প্রয়োজন নেই।
✍🏾(০৫) এই লীলার মাধ্যমে ভগবান বোঝালেন, যেখানে একজন বদ্ধজীব নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার ছায়াকে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে অসাধ্য, সেখানে নিজেকে নিজে উত্তোলন করা অসম্ভব। মানুষের চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার সীমাবদ্ধতা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। ভগবান তাই করে দেখালেন এই লীলার মাধ্যমে। নিজেকে নিজেই উত্তোলন করলেন, প্রত্যেকের কৃষ্ণকে কাছে পাবার অভিলাষ একসাথে পূর্ণ করেছিলেন, প্রত্যেককে সামনে থেকে দর্শন দিয়েছিলেন, প্রত্যেকের হৃদয়কে প্রেমানন্দে ভরিয়ে তৃপ্ত করেছিলেন। তিনি আবার দেখালেন তিনি কত কৃপাময়! যতই বিপদ আসুক না কেন তিনি তাঁর শরণাগতদের উদ্ধার করবেনই করবেন।
✍🏾(০৬) শ্রীমদ্ভাগবতমে বর্ণনা করা হয়েছে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কেবল একজন দেবতাকে অপমান করার উদ্দেশ্য ছিল না বরং ভগবানের এক ক্ষুদ্র ভৃত্য ইন্দ্ররূপে যার প্রতিনিধিত্ব করার কথা, তার হৃদয়ের জাগরুক অহঙ্কারের বিশাল পর্বতটিকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইন্দ্র একটি ‘পদ’ (position) যেখানে ভগবানের এক ক্ষুদ্র ভৃত্য ভগবানের ইচ্ছায় অধিষ্ঠিত হন এই মনোভিলাষ নিয়ে তিনি ভগবানের সেবায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত থাকবেন। কিন্তু ইন্দ্রলোকে বৈভব, বিলাসিতা ও আড়ম্বরের ঘেরাটোপে কখনও কখনও ইন্দ্রদেব নিজের কর্তব্য ভুলে যান, অহংকারের কারণে নিজেকে সর্বশক্তিমান ভগবান মনে করে। গোবর্ধন লীলার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রদেবের অহঙ্কারের বিশাল পর্বতটিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।
✍🏾(০৭) তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং নিজের সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করে সেই এক সপ্তাহ ধরে একটা ছাতার মতো গােবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে রইলেন। এই হল ভক্তদের প্রতি ভগবানের সেবা। ভক্তের সামান্য ভক্তি, সম্পূর্ণ শরনাগতির নিষ্কাম কর্মকে ভগবান বৃহৎ ফলস্বরূপ এইভাবে বারেবারে ফিরিয়ে দেন। ‘গিরি গােবর্ধন ধারণ লীলা’ তারই এক উদাহরণ। ভক্তের জীবনে পর্বত সমান বেদনা দুঃখ কষ্টকে তিনি এইভাবে সরিয়ে পরিত্রাণ করেন।
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
◼️ গােবর্ধনের বৈশিষ্ট্য ◼️
১। গােবর্ধন হলেন শ্রীমতি রাধিকার প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণের হৃদয় হইতে জাত অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়েরই প্রকাশ বিগ্রহ। সুতরাং এটি প্রাকৃত নয়। অন্যদিকে বিষ্ণুই স্বয়ং কৃষ্ণসেবার্থে গােবর্ধনরূপে বিরাজমান।
২। গােবর্ধন পর্বতরাজ। অন্য পর্বতদের পূজ্য মান্য গােবর্ধনের আবির্ভাবকালে সমস্ত পর্বত উপস্থিত হয়ে তাঁকে ‘গিরিরাজ’ উপাধি প্রদান করেন।
৩। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গােবর্ধনের পূজাদি প্রবর্তন করেন। এ সৌভাগ্য অন্য পর্ব্বতের নেই।
৪। গােবর্ধন লীলাপুরুষোত্তমের বিচিত্র বিলাস কেন্দ্র।
৫।গােবর্ধন শালগ্রামের ন্যায় নিত্যপূজ্য, কিন্তু অন্য পর্ব্বতের তেমন নিত্যপূজ্যত্ব নেই।
৬। গােবর্ধন হরিদাসবর্য্য অর্থাৎ কৃষ্ণদাসগণের মধ্যে অন্যতম, ধন্যতম, বরেণ্য ও শরণ্যতম।
৭। গােবর্ধন ব্রজরক্ষা কল্পে শ্রীকৃষ্ণের ছত্র স্বরূপ। তাঁর তলদেশ মহোযোগপীঠ স্বরূপ।
৮। গােবর্ধন বিনা প্রতিষ্ঠায় স্বতঃসিদ্ধ পূজ্য। ইনি কৃষ্ণের বিলাসবিগ্রহ স্বরূপও বটে।
৯। গােবর্ধন অনন্যসিদ্ধ দ্রুত পাপীদের ত্রাণকর্তা (আশু পতিতপাবন) মাহাত্ম্য মণ্ডিত।
১০। শালগ্রাম অপেক্ষা গােবর্ধন শিলার সমর্চ্চন শ্রীকৃষ্ণের অতি অভিপ্রেত ও প্রীতিপ্রদ।
১১। উচ্চতায় সুমেরু শ্রেষ্ঠ হইলেও মহত্বের উচ্চতায় গােবর্ধন সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ।
১২। গােবর্ধন অবতারী, কৃষ্ণের অনন্য বিলাস চিত্রকূট পর্বত তাঁর অবতার স্বরূপ।
১৩। গােবর্ধনতট ভজনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। অন্য পর্বতের এই সৌভাগ্য নেই।
১৪। গােবর্ধনতট মানসীগঙ্গাদি বহুতীর্থের সমাশ্রয়, অন্য পর্বত তা নয়। বিন্দুসরোবর মহত্বে রাধাকুণ্ডের কোট্যাংশের এক অংশও নয়।
১৫। নিজ স্বভাব সেবা সৌজন্যাদি দ্বারা স্বয়ং ভগবানের পঞ্চেন্দ্রিয়ের আনন্দ বর্দ্ধন হেতু গিরিরাজের গােবর্ধন নাম সার্থক। এরূপ মহত্ব অন্য পর্বতের নেই।
► আরও পড়ুন: দামোদর কে?✸দামোদর লীলা (দামবন্ধন লীলা✤Damodar Lila)মাহাত্ম্য✸
► আরও পড়ুন: Gopashtami❖গোপাষ্টমী (গোপ অষ্টমী বা গোষ্ঠাষ্টমী) মাহাত্ম্য