আমাদের অবশ্যই জানা দরকার ◆ গুরুপূর্ণিমা (Guru Purnima) বা ব্যাসপূর্ণিমা (Vyasa Purnima) মাহাত্ম্য কি? ◆ কেন পালন করা হয়? ◆ “কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস”- নামের অর্থ কি? ◆ বাড়িতে কিভাবে পালন করবেন? ◆ প্রকৃত গুরু চিহ্নিতকরন করবেন কিভাবে?
꧁❀ গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসপূর্ণিমা কি? ❀ ꧂
পূর্ণিমা হলো সংস্কৃত শব্দ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ full moon। পূর্ণিমার দিনটি হল প্রতি মাসে সেই দিনটি (তিথি) যখন full moon (পূর্ণিমা) ঘটে। ব্রহ্মসূত্র, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত এবং ১৮টি পুরাণের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষে পূর্ণিমা তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেইজন্য আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিকেই স্মরণ সারা পালিত হয় গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসপূর্ণিমা। মহর্ষি বেদব্যাস হলেন আদি গুরু তথা জগৎ গুরু। গুরুর কৃপাশীর্বাদ ছাড়া জীবন পথে চলা যায় না। গুরুর আশীর্বাদে জীবন হয় শ্রীবৃদ্ধি, গুরুর কৃপাতে ধুয়ে যায় সমস্ত পাপ। সেইজন্য গুরুপূর্ণিমা তিথিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বেদব্যাসকে গুরু রূপে স্মরণ পূর্বক পালন করেন। গুরুপূর্ণিমা একটি বৈদিক প্রথা, যার মধ্য দিয়ে শিষ্য তার গুরুকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।
যেন ত্বয়া ভারততৈলপূর্ণ প্রজ্বালিতো জ্ঞানময় প্রদীপঃ॥ ❞
꧁◼️ গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসপূর্ণিমা পালন সময় ◼️꧂
এবছর ২১শে জুলাই, ২০২৪ রবিবার গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসপূর্ণিমা পালিত হবে।
꧁◼️ গুরু শব্দের অর্থ কি? ◼️꧂
“প্রসঙ্গত এই গুরু শব্দেরও কিন্তু একটা অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে। ‘গূ’-কথার অর্থ ‘অন্ধকার’ বা ‘অজ্ঞতা‘ এবং ‘রু’ অর্থ তেজ বা আলো। তাহলে গুরু শব্দের মূল অর্থ হলো মানুষের অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত করে মানবকূলকে আলোর পথে নিয়ে চলেন যে ব্রহ্মময় পুরুষ, তিনিই গুরু। আর সেই কারণেই একজন মানুষের জীবনে গুরুর অবদান সবথেকে বেশি। একজন গুরুই পারেন তাঁর শিষ্যের জীবন থেকে ভগবত জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে যাবতীয় অন্ধকার দূর করে দিতে।”
꧁◼️ জীবনে গুরুর ভূমিকা ◼️꧂
প্রাচীনকাল থেকেই এই দেশে গুরুদের সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছে। গুরুর দেখানো পথে চললে, কোনও ব্যক্তি শান্তি, আনন্দ ও মোক্ষ প্রাপ্ত করতে পারেন। তাই গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকেই গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে।
সন্ত তুলসীদাস তাঁর লিখিত গ্রন্থ রামচরিতমানসে উল্লেখ করেছেন, ━ “গুরু বিন ভব তরহু না কো-ই ” অর্থাৎ গুরু ছাড়া উদ্ধার নেই। কারণ ভগবৎ ভজনের মূল কৃপাশ্রয় যে তিনিই, অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত করে তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা ও মন্ত্র সাধনেই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তত্ত্ব, বিস্তার তত্ত্ব, লীলা মহিমা, ভগবানের প্রতিটি লীলার পেছনে রয়েছে গূঢ় শিক্ষণীয় তত্ত্ব যা গুরুর বিশ্লেষণের মাধ্যমেই রসাস্বাদন করা সম্ভব। ফলে গুরুর কৃপায় প্রথমে আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা বিকশিত হয়, দ্বিতীয়ত ভগবানের সাথে আমাদের নিত্যকালের জন্য সম্বন্ধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। জড়জগতের অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্যোতির্ময়ের পথে চালিত করেন গুরুদেব। তাই গুরুপ্রনাম মন্ত্রে বলা হয়েছে, ━
❝ ওঁ অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥ ১॥❞
অনুবাদ: “অজ্ঞতার গভীরতম অন্ধকারে আমার জন্ম হয়েছিল এবং আমার গুরুদেব জ্ঞানের আলোকবর্তিকা দিয়ে আমার চক্ষু উন্মীলিত করেছেন। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”
❝ অখন্ড মন্ডলা কারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম।
তদপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ॥ ২॥❞
অনুবাদ: “যাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) দ্বারা অখন্ড-মন্ডলাকার এই চরাচর বিশ্ব (অসংখ্য ব্রম্ভান্ড) পরিব্যাপ্ত রয়েছে, তাঁর শ্রীপাদপদ্ম যিনি দর্শন করিয়ে দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ প্রণতি নিবেদন করি।”
❝গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে, গুরুরূপে কৃষ্ণ কৃপা করেন ভক্তগণে।❞ ┈ (চৈ.চ)। শ্রীগুরুদেব সাক্ষাৎ ভগবানের কৃপার প্রতিমূর্তি। তিনি পারমার্থিক পিতা। তাঁর কাছে শিষ্যের ঋণ কখনও শোধ হবার নয়। দীক্ষা গুরু, শিক্ষা গুরু -উভয়েরই গুরুত্ব শিষ্যের জীবনে অসীম। বলা হয় শ্রীগুরুদেবের সেবা সমস্ত সেবার থেকে শ্রেষ্ঠ। কারণ “সর্ব দেবময় গুরৌ” -গুরুদেব সর্ব দেবের স্বরূপ, তিনি ভগবানের কৃপার প্রকাশ।
❝ গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরুর্দেবো মহেশ্বর।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥ ৩॥❞
অনুবাদ: “জীবনে গুরুই হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সম। কারন, তিনিই আমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জ্ঞান বা পরম ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। সেই গুরুর উদ্দেশ্যে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”
꧁◼️ গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাসপূর্ণিমার মাহাত্ম্য কি? ◼️꧂
🌸(১) হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ছিলেন পরাশর ঋষি ও সত্যবতীর পুত্র। তিনি ছিলেন তিন জগতের (ত্রিলোকের) জ্ঞানী।
শ্রীসূত গোস্বামী বললেন, একসময়ে ব্যাসদেব সূর্যোদয়ের সময় সরস্বতী নদীর জলে প্রাতঃস্নান করে একাকী উপবিষ্ট হয়ে ধ্যানস্থ হলেন। মহর্ষি বেদব্যাস এই যুগের ধর্ম বিপর্যয় দর্শন করলেন। তিনি তাঁর দিব্যদর্শন থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, কলিযুগে মানুষ ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে, যার ফলে মানুষ নাস্তিক হয়ে যাবে, কর্তব্যহীন এবং স্বল্পস্থায়ী হবে, সত্ত্বগুণের অভাবে তারা ধৈর্যহীন হয়ে পড়বে। এইভাবে পূর্ণ জ্ঞান সম্পন্ন মহর্ষি তার দিব্য দৃষ্টির দ্বারা এই যুগের প্রভাবে জড় জগতের অধঃপতন দর্শন করলেন।
তাই মহর্ষি বেদব্যাস তাই তিনি সমস্ত বর্ণ এবং আশ্রমের মানুষের কি ভাবে মঙ্গলসাধন করা যায় সেই চিন্তা করলেন। তিনি দেখলেন যে, বেদে নির্দেশিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের বৃত্তি অনুসারে তার কার্যকলাপকে পবিত্র করা। এই প্রক্রিয়াকে সরলীকৃত করার উদ্দেশ্যে তিনি এক বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন, যাতে যারা বুদ্ধিমত্তা দুর্বল বা যাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল তারাও বেদ অধ্যয়ন করে উপকৃত হতে পারেন। স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজোচিত গুণাবলীবিহীন ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত মানুষদের বেদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা নেই, তাই তাদের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত রচনা করলেন, যাতে তারা তাদের জীবনের পরম উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে। (শ্রীমদ্ভাগবত, ১/৪/১৪-২০, ২৪-২৫)
বেদ আলাদা করার পর ব্যাস সেগুলোর নাম দেন যথাক্রমে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ। এইভাবে বেদের বিভক্তির কারণে তিনি বেদব্যাস নামে প্রসিদ্ধ হন। এরপর তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য পাইলা, বৈশম্পায়ন, জৈমিনী এবং সুমন্তুকে এই চারটি বেদের জ্ঞান দেন।
বেদে উপস্থিত জ্ঞান অত্যন্ত রহস্যময় এবং কঠিন ছিল, তাই বেদব্যাস পঞ্চম বেদের আকারে পুরাণগুলি রচনা করেছিলেন, যেখানে বেদের জ্ঞান আকর্ষণীয় গল্পের আকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি তাঁর শিষ্য রোমহর্ষণকে পুরাণের জ্ঞান দান করেন। এরপর বেদব্যাসের শিষ্যরা তাদের বুদ্ধিমত্তার জোরে বেদকে বহু শাখা-উপ-শাখায় বিভক্ত করেন। বেদব্যাস আমাদের আদি-গুরু হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাই গুরুপূর্ণিমার দিনটিকে ‘ব্যাসপূর্ণিমা‘-ও বলা হয়।
✸“কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস”- নামের অর্থ কি? ✸
=================================
বেদব্যাসের নামের প্রতিটি শব্দই অর্থময়। যমুনা নদীর একটি দ্বীপে জন্মেছিলেন বলে দ্বৈপায়ন, গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ তাই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আর অখন্ড বেদশাস্ত্রকে গুণানুযায়ী বিভক্ত করেছিলেন বলে বেদব্যাস। তিনি হলেন অষ্ট চিরঞ্জীবির মধ্যে একজন ।
🌸 (২) শৈব মতে এই তিথি তে শিবদক্ষিণামূর্তিরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার চারজন মানসপুত্রকে বেদের গুহ্য পরম জ্ঞান প্রদান করেছিলেন, দক্ষিণামূর্তি সকলের আদি গুরু, তাই শৈব বিশ্বাস অনুযায়ী এই তিথিটি দেবাদিদেব শিবের প্রতি সমর্পিত।
সপ্তর্ষির সাতজন ঋষি হলেন তাঁর প্রথম শিষ্য – অত্রি, বশিষ্ঠ, পুলহ, অঙ্গীরা, পুলস্থ্য, মরীচি এবং কেতু (নাম নিয়ে মতভেদ আছে)। শিব এই তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হন এবং এই সাত ঋষিকে মহাজ্ঞান প্রদান করেন।
🌸 (৩) বৌদ্ধ ধর্ম মতে, বোধিজ্ঞান লাভের পরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় সারনাথে প্রথম শিষ্যদের উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ।
꧁◼️ গুরুপূর্ণিমার পূজন তিথি ◼️꧂
১) অন্যান্য দিনের মতো গুরু পূর্ণিমাতে ব্রম্ভমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে, আপনার ঘর পরিষ্কার করার পরে, স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরিধান করবেন।
২) তারপর একটি পরিষ্কার স্থান বা উপাসনালয়ে একটি সাদা কাপড় বিছিয়ে একটি ব্যাস পীঠ বা নিজ ইষ্ট গুরুদবের আসন তৈরি করুন এবং বেদব্যাসর মূর্তি বা গুরুদেব এর ছবি (চিত্রপট) স্থাপন করবেন।
৩) সাধ্যমত ভগবান, গুরুদেব ও পঞ্চতত্ত্বকে ফুল, চন্দন দিয়ে সজ্জিত করবেন।
৪) ভোগের সময় ভগবানকে প্রথম ভোগ নিবেদন করার পর তারপর সেই মহাপ্রসাদ বেদব্যাস বা শ্রীগুরুদেবকে নিবেদন করবেন।
৫) আরতির সময় ভগবানকে আরতির পাশাপাশি বেদব্যাস বা শ্রীগুরুদেবকে সেই উপকরন দিয়ে নিবেদন করবেন (যেমন, ধূপ , দীপ, পঞ্চপ্রদীপ, চামর, পাখা প্রভৃতি)।
৬) কমপক্ষে ১৬ মালা হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করবেন। শেষে ভগবানের চরনে, তারপর গুরুদেবের চরনে দণ্ডবৎ (প্রভুরা) বা পঞ্চাঙ্গ (মাতাজিরা) প্রনাম নিবেদন করবেন।
─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─
꧁❀ প্রকৃত গুরু চিহ্নিতকরন করবেন কিভাবে? ❀ ꧂
বৈদিক শাস্ত্র অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে যে, ভগবান সর্বদাই ভগবান এবং অন্য কেউই কখনো ভগবান হতে পারে না। শ্রীল প্রভুপাদ সর্বদাই দৃঢ়তার সঙ্গে মায়াবাদীদের এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন যেখানে তারা প্রচার করেছে যে, যে কেউ এবং প্রত্যেকেই পরিশেষে ভগবান হতে পারে।
হ্যাঁ, এটি সত্য যে, একজন গুরুর প্রতি সেই সম্মান এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত যেমন ভাবে একজন শ্রীহরির প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করে। কিন্তু গুরু ভগবান নন।
আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে তাঁর শিষ্যের সম্পর্ক পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মতো। একজন আধ্যাত্মিক গুরু সর্বদাই নিজেকে পরমেশ্বর ভগবানের দীন সেবক হিসাবে উপস্থাপন করেন।
꧁◼️ প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরু ◼️꧂
একজন শুধুমাত্র গৈরিক বসন অথবা বৈষ্ণব পোশাক পরিধান করে, সর্বাঙ্গ তিলক ভূষিত করে এবং শুধুমাত্র বৈদিক শ্লোক আবৃত্তি করেই গুরু হতে পারেন না। আধ্যাত্মিক গুরুর স্তর প্রাপ্তির জন্য একজনকে তিনটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়।
(১) ভক্তি জীবনের নির্ধারিত নিয়মাবলী পালন করা। একে বলে সাধন সিদ্ধ।
(২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর ভক্তদের কৃপা লাভ করা। একে বলে কৃপা সিদ্ধ।
(৩) এ ছাড়াও নিত্য সিদ্ধগণেরা সমগ্র জীবনে মুহূর্তকালের জন্যও কৃষ্ণকে বিস্মৃত হন না। একে বলে ভগবান বিস্মৃতি।
একজন প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরু কোন সাধারণ ব্যক্তি নন, তিনি নিত্য মুক্ত। আধ্যাত্মিক গুরু তার শিষ্যদের আধ্যাত্মিক পিতা। তাঁর বাণী এবং কার্যের দ্বারা তিনি তাঁর শিষ্যদের পরম পিতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি যা ভাবেন বা অনুভব করেন সে কথা তিনি বলেন না কিন্তু তিনি সর্বদা তাঁর পূর্ববর্তী আচার্যদের বাণী পুনরাবৃত্তি করেন এবং প্রত্যেককে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন। তিনি একজন আচার্য, আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের চিন্ময় শিক্ষক এবং সেই কারণেই তিনি তাঁর শিষ্যদের বৈদিক শাস্ত্রের জটিল তত্ত্বগুলির শিক্ষা দিয়ে তাদের দ্বিতীয় জন্ম প্রদান করেন।
পরম সত্যকে জানতে যারা ব্যাকুল এবং আন্তরিক তিনি তাদের আশ্রয় দান করেন। একজন আধ্যাত্মিক গুরু কখনো জাতি, পূর্বজন্ম, লিঙ্গ এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তার শিষ্যদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেন না। তাঁর কাছে তাঁর শিষ্য কে ব্রাহ্মণপুত্র, কে শূদ্রপুত্র তা নিরর্থক।
꧁◼️ গুরু শিষ্য সম্বন্ধ ◼️꧂
চৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে যে, ‘আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে তাঁর শিষ্যের সম্পর্ক পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মতো। একজন আধ্যাত্মিক গুরু সর্বদাই নিজেকে পরমেশ্বর ভগবানের দীন সেবক হিসাবে উপস্থাপন করেন কিন্তু শিষ্যের তাঁকে পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিভূরূপে দেখা উচিত।‘ (চৈতন্য চরিতামৃত আদি, ১/৪৫)
একজন স্বীকৃত শিষ্য অনুধাবন করেন যে, আধ্যাত্মিক গুরু হলেন কৃষ্ণের প্রতিভূ কিন্তু তিনি এও উপলব্ধি করেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় লীলা বিলাস অনুকরণ করার অধিকার আধ্যাত্মিক গুরুর নেই। কখনো কখনো কিছু আধ্যাত্মিক গুরু পরমেশ্বর ভগবানের কার্যাবলীকে অনুকরণ করে তার শিষ্যদের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। তারা তাদের শিষ্যদের বিভ্রান্ত করে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে বিনষ্ট করে। একজন আধ্যাত্মিক গুরুর যে যে নূন্যতম গুণাবলী থাকা দরকার, তা হল ━
(১) একজন আধ্যাত্মিক গুরুর নাম-যশের প্রতি কোন মোহ থাকা উচিত নয়।
(২) তিনি কখনোই নাম এবং যশ বৃদ্ধি করার জন্য সমসাময়িক আধ্যাত্মিক গুরুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন না।
(৩) তিনি কখনোই অন্যান্য আধ্যাত্মিক গুরুদের সমালোচনা করেন না, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন না এবং তাঁর অনুগামী সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য কোন অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন না।
(৪) ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষাষ্টকমে্ যে নির্দেশাবলী দিয়েছেন তাকে তিনি সর্বদা অনুসরণ করেন, ‘হে জগদীশ ! আমি ধন, জন বা সুন্দরী রমনী কামনা করি না ; আমি কেবল এই কামনা করি যে, জন্মে জন্মে তোমাতেই আমার অহৈতুকী ভক্তি হোক।‘
(৫) প্রকৃত গুরু প্রকৃতি অর্থেই বিনয়ী, এবং সর্বদা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে তিনি নিজেকে তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুর দাসরূপে চিন্তা করেন। ভারতের বৃন্দাবনে একবার একজন শ্রীল প্রভুপাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি সমগ্র পৃথিবীর গুরু?‘ শ্রীল প্রভুপাদ কয়েক মুহূর্ত মাটির দিকে তাকিয়ে মৌন ছিলেন এবং তারপর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন, “না, আমি সকলের দাস। সেটাই সব।”
꧁◼️ গুরু – সাধু – শাস্ত্র ◼️꧂
শ্রীমদ্ভাগবতে (৫-৫-১৮) ব্যাখ্যা আছে, “যিনি তার শিষ্যদের জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত করতে পারেন না তিনি কখনোই একজন আধ্যাত্মিক গুরু, একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন মাতা অথবা একজন পূজ্য দেবতা হতে পারেন না।”
ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত হলেই তবে একজন তাঁর শিষ্যদের মুক্ত করে ভগবদ্ধামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। যদি আধ্যাত্মিক গুরু পূর্ববর্তী আচার্যদের রীতিনীতি অনুসরণ না করেন তাহলে তাকে পরিত্যাগ করা যেতে পারে।
যখন ভগবান বামনদেব একজন ব্রাহ্মণ রূপে বলি মহারাজের যজ্ঞস্থলে আবির্ভূত হয়ে ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা চেয়েছিলেন তখন শুক্রাচার্য বলি মহারাজকে তাঁর এই আধ্যাত্মিক কর্ম থেকে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। শুক্রাচার্য ব্রাহ্মণকে ভগবান বিষ্ণুরূপে চিনতে পেরেছিলেন এবং তিনি যে বলি মহারাজের কাছ থেকে সমগ্র রাজত্ব হরণ করবেন তাও বুঝতে পেরেছিলেন। যদি ভগবান বলি মহারাজের কাছ থেকে সমস্ত কিছু হরণ করেন তাহলে তিনিও ভিখারী হয়ে যাবেন এই ভয়ে ভীত হয়েছিলেন। শুক্রাচার্য একজন শুদ্ধ ভক্ত ছিলেন না, তিনি কমবেশী সকাম কর্মের প্রতি আসক্ত ছিলেন। শাস্ত্র নির্দেশ দেয় যে, আমাদের যা কিছু আছে তা সমস্তই পরমেশ্বর ভগবানের এবং সেই জন্য পরমেশ্বর ভগবানের কাছে সমস্ত কিছু নিবেদন করার জন্য আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত (গীতা ৯-২৭)। ভগবানের এক মহান ভক্তরূপে বলি মহারাজ বেদের সকল রীতিনীতি সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়ায় তিনি শুক্রাচার্যের নির্দেশ পালন করেননি, তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁকে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং ভগবান বামনদেবের নিকট তাঁর সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন।
বেদ গুরু-সাধু-শাস্ত্র রূপে পরখ এবং তুল্য পদ্ধতি দিয়েছে যার দ্বারা আমরা একজন গুরুকে তিনি প্রকৃত অথবা ভন্ড কিনা যাচাই করতে পারি। গুরুর প্রদত্ত শিক্ষা অবশ্যই সাধুগণের শিক্ষার অনুসারী হতে হবে (গুরু পরম্পরা ধারা অনুসারে) যা সরাসরি শাস্ত্রানুগ (শাস্ত্রসম্মত)। শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেন, “প্রামাণিক শাস্ত্র অনুসারে একজন আধ্যাত্মিক গুরু যদি নিজেকে গুরুপদের যোগ্য রূপে প্রমাণ করতে না পারেন তাহলে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা চলে। একজন গুরুকে আচার্যও বলা হয় যিনি সমগ্র শাস্ত্রের সার এবং তিনি তাঁর শিষ্যদের সেই সমস্ত পন্থা অবলম্বন করতে সহায়তা করেন।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১-৭-৪৩ তাৎপর্য)
꧁◼️ গুরু, ভগবানের দাস ◼️꧂
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “একজন আচার্যকে আমার স্বরূপ বলে দেখা উচিত এবং কোনভাবেই তাঁকে অশ্রদ্ধা করা উচিত নয়। তাঁকে সাধারণ ব্যক্তি ভেবে কখনোই ঈর্ষা করা উচিত নয় কারণ গুরু সর্ব দেবময়।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১১-১৭-২৭)
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর, শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী এবং অন্যান্য আচার্যগণ পুষ্টিকরণ করেছেন যে, প্রামাণিক শাস্ত্র সকল আধ্যাত্মিক গুরুকে পরমেশ্বর ভগবানের স্বরূপ রূপে গ্রহণ করেছে কারণ তিনি ভগবানের অন্তরঙ্গ এবং প্রিয় সেবক।
শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছেন, “গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ সেই জন্য গুরুদেবকে পরমেশ্বর ভগবানের সেবক রূপে অৰ্চনা করেন। ভক্তিযোগের সকল প্রাচীন শাস্ত্রে এবং শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এবং অন্যান্য শুদ্ধ বৈষ্ণবদের কীর্তনে আধ্যাত্মিক গুরুকে সর্বদা হয় শ্রীমতি রাধারাণীর অন্তরঙ্গ সাথীরূপে অথবা শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর প্রতিভূরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১১-১৭-২৭)।
(সন্দর্ভ : শ্রীল প্রভুপাদ-লীলামৃত)
► আরও পড়ুন: Qualities of Lord Krishna-RadhaRani || শ্রীকৃষ্ণের ৬৪ গুণ ও শ্রীমতি রাধারানীর ২৫ গুণ বর্ণন