বিষ্ণুতত্ব বা কৃষ্ণতত্বকে উপলব্ধি করতে হয় ব্রহ্মতত্বকে অতিক্রম করে, এবং তখন তিনি বৈষ্ণব পদবাচ্য হন। ‘অসুর’ শব্দের দুইটি অর্থ আছে — ★একটি হচ্ছে যারা ভগবৎ (ভগবান) বিদ্বেষী। ★দ্বিতীয়টি হল দেবতা বিরোধী কিন্তু ভগবৎ বিদ্বেষী নয়।
বৃত্রাসুর একজন অসুর হলেও তিনি ছিলেন এক মহান বৈষ্ণব। অসুরও যদি বৈষ্ণব হয় তাহলে তিনি আমাদের প্রনম্য। বৃত্রাসুর ভগবৎ বিদ্বেষী নন কিন্তু দেবতাদের বিরোধী বলে তিনি একজন অসুর।
꧁✸ দেবরাজ ইন্দ্রের দ্বারা দেবগুরু বৃহস্পতিকে অপমান ✸꧂
🌸 এক সময় দেবরাজ ইন্দ্র ও তাঁর পত্নী শচীদেবী সহ স্বর্গসভায় সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন এবং সিদ্ধ, চারণ ও গন্ধর্বগণেরা বন্দিত করছিলেন, সেই সময় দেবগুরু বৃহস্পতি সেই সভায় এসে উপস্থিত হলেন। ইন্দ্র তাঁর গুরুদেবকে দর্শন করা সত্ত্বেও তাঁকে কোনরূপ সম্মান প্রদর্শন করলেন না, তার ফলে বৃহস্পতি অপমানিত বোধ করে তখনই সেই সভা থেকে অদৃশ্য হলেন।
🌸 গুরুদেবের প্রতি অসম্মানজনক আচরণের ফলে ইন্দ্র তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলেন এবং এক ভয়ংঙ্কর যুদ্ধে দৈত্যদের দ্বারা পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হলেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের শিক্ষা লাভ করা উচিত— “শ্রীগুরুদেবের কৃপার ফলে ভগবানের কৃপা লাভ করা যায়। গুরুদেব যদি অপ্রসন্ন হন তাহলে তাঁর কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকে না।” (গুরুষ্টকম—শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী) তাই গুরুদেবের সঙ্গে আচরণের সময় অত্যন্ত সাবধান থাকা উচিত।
🌸 ইন্দ্র তখন অন্যান্য দেবগণ সহ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা তাদের অপরাধের জন্য দেবতাদের তিরস্কার করেন এবং ত্বষ্টার পুত্র দ্বিজবর বিশ্বরূপকে পৌরোহিত্যে বরণ করতে উপদেশ দিলেন। তখন দেবতারা বিশ্বরূপের পৌরোহিত্যে এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন এবং দৈত্যদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।
ত্বষ্টা হলেন একজন বৈদিক দেবতা এবং আদিত্যদের একজন। পিতা হলেন কশ্যপ ও মাতা হলেন অদিতি। তিনি দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা নামে পরিচিত। ত্বষ্টা ছিলেন একজন দক্ষ কারিগর, যিনি ইন্দ্রের বজ্র, বৃহস্পতির কুঠার এবং ঐশ্বরিক খাদ্য ও পানীয়ের জন্য কাপ সহ অনেক সরঞ্জাম তৈরি করেছিলেন।
ত্বষ্টার পত্নী ছিলেন দনু, যিনি অসুরদের দানব বংশের মাও ছিলেন।
🌸 বিশ্বরূপ তাঁর পিতার দিক থেকে দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন এবং তাই তিনি প্রকাশ্যভাবে বিনয়ের সঙ্গে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞভাগ প্রদান করতেন। কিন্তু তাঁর মাতৃ সম্বন্ধে তিনি অসুরদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, তাই তিনি দেবতাদের অজ্ঞাতসারে অসুরদেরও যজ্ঞভাগ নিবেদন করতেন। একসময় দেবরাজ ইন্দ্র এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বিশ্বরূপের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বরূপের মস্তক ছেদন করেন।
কিন্তু একজন ব্রাহ্মণকে হত্যা করেছেন বলে পরে দেবরাজ ইন্দ্র অনুতাপ করেন। ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ স্খালন করতে সমর্থ হলেও দেবরাজ ইন্দ্র তা করেননি। পক্ষান্তরে, তিনি সেই পাপের ফল গ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি তা ভূমি, জল, বৃক্ষ এবং স্ত্রী-সাধারণের মধ্যে তা বিতরণ করেন। যেহেতু ভূমি সেই পাপের এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করেছিল, তাই ভূমির এক অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বৃক্ষ যে এক- চতুর্থাংশ গ্রহণ করেছিল, তার ফলে বৃক্ষের নির্যাসরূপে তা দৃষ্ট হয়, যা পান করা নিষিদ্ধ। স্ত্রীদের মধ্যে সেই পাপ রজোরূপে দৃষ্ট হয় এবং সেই জন্য রজস্বলা স্ত্রী অস্পৃশ্য। জলে সেই পাপ বুদ্বুদ ফেনারূপে দৃষ্ট হয় বলে, ফেনাযুক্ত জল অব্যবহার্য।
꧁✸ বৃত্রাসুরের জন্ম ✸꧂
🌸 বিশ্বরূপের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর পিতা ত্বষ্টা ইন্দ্রকে হত্যা করার জন্য এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই যজ্ঞ থেকে বৃত্রাসুর নামক ভয়ঙ্কর দর্শন এক অসুর উৎপন্ন হয়েছিল, তখন তার ভয়ঙ্কর মূর্তি দর্শন করে ত্রিভুবন কম্পিত হয়েছিল এবং তার দেহের জ্যোতির প্রভাবে দেবতারা নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। ইন্দ্র প্রমুখ দেবতারা সসৈন্যে তার প্রতি ধাবিত হয়ে তাদের দিব্য অস্ত্রের দ্বারা তাকে আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু বৃত্রাসুর তাঁদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গ্রাস করেছিল। দেবতারা তখন ভয়ে ভীত হয়ে পরমেশ্বর ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন এবং তাঁর স্তবস্তুতি করতে লাগলেন। দেবতাদের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে ভগবান তাঁদের নির্দেশ দিলেন—“ঋষিশ্রেষ্ঠ দধিচীর কাছে গিয়ে তাঁর শরীর প্রার্থনা কর। তাঁর অস্থি দিয়ে বিশ্বকর্মা বজ্র নির্মাণ করবে এবং সেই বজ্রের দ্বারা বৃত্রাসুরকে বধ করা সম্ভব হবে। কারণ আমার শক্তির দ্বারা বজ্রের তেজ বর্ধিত হবে। সেও আমার ভক্ত, তাই তোমাদের প্রতি সে কখনও হিংসা করবে না।”
꧁✸ বৃত্রাসুরের পূর্বজন্ম ✸꧂
Vritrasura Previous Birth
🌸 বৃত্রাসুরের মতো একজন অসুর কিভাবে ভগবানের মহান ভক্ত হয়েছিলেন, এ ব্যাপারে পরীক্ষিৎ মহারাজ প্রশ্ন করলে শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন—“আসলে বৃত্রাসুর পূর্ব জন্মে ছিলেন গন্ধর্বদের রাজা চিত্রকেতু এবং তিনি পরমেশ্বর ভগবানের একজন মহান ভক্ত ছিলেন। দেবী পার্বতীর অভিশাপে তাঁকে অসুরকূলে জন্মাতে হয়েছিল।”
🌸 চিত্রকেতুর লক্ষ লক্ষ মহিষী থাকা স্বত্বেও সবাই ছিল বন্ধ্যা। পুত্রহীন হওয়ায় তিনি দুঃখে অত্যন্ত মুহ্যমান ছিলেন। এমতাবস্থায় একদিন অঙ্গিরা ঋষিকে তিনি তার দুঃখের কথা জানান। সব শুনে ঋষি তাকে একটা যজ্ঞ করতে নির্দেশ দিয়ে বললেন, — “সেই যজ্ঞের ফলে একটি পুত্র সন্তান হবে কিন্তু সেই পুত্র তার সুখ এবং দুঃখ দুইয়েরই কারণ হবে।” এরপর যথাসময়ে তার মহিষী কৃতদ্যুতির গর্ভে এক পুত্র সন্তান হলো। তার ফলে রাজা সর্বক্ষণ তার মহিষী কৃতদ্যুতি ও পুত্রকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এতে তাঁর অন্য মহিষীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে সেই সন্তানকে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেললেন।
꧁✸ বৃত্রাসুর বধ✸꧂
❝ যে যথা মাম্ প্রপদ্যন্তে তান্ তথা এব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্ম অনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥ ❞
━┉┈┈(গীতা-৪/১১)
অনুবাদ:“যারা যেভাবে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে, আমি তাকে সেই ভাবেই পুরষ্কৃত করি। হে পার্থ, সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।”
◉ইন্দ্র এবং বৃত্রাসুর উভয়েই ছিলেন ভগবানের ভক্ত, তাই ভগবান তাঁদের ইচ্ছা অনুসারে তাঁদের বাসনা পূর্ণ করেছিলেন। ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে পরাজিত করে স্বর্গসুখ ভোগ করতে চেয়েছিলেন এবং ভগবানের কাছে সেই প্রার্থনাই করেছিলেন। তাই ভগবানও তাঁর জন্য সেই ব্যবস্থাই করেই দিয়েছিলেন। বজ্র নিক্ষেপের ফলে ইন্দ্রের জয় হবে এবং তিনি জন্ম-মৃত্যুময় এই জড়জগতের সংসার চক্রে থেকে স্বর্গসুখ ভোগ করবেন। এটা হল কর্মমিশ্রা ভক্তের দৃষ্টান্ত। কর্মমিশ্রা ভক্তরা নিজেদের সুখভোগের জন্য সবকিছু করতে পারে। তাদের চিন্তাধারা হল, ঠিক আছে দধীচি মুনি দিয়ে দিক জীবনটা, কিন্তু আমি তো সুখভোগ করব।
◉ অন্যদিকে বৃত্রাসুর কখনোই জড় সম্পদ কামনা করেননি, কারণ এর পরিণতি সম্বন্ধে তিনি ভালভাবেই অবগত ছিলেন। যদিও ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে বধ করার জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু প্রকৃত বিজয় বৃত্রাসুরের জন্য নির্ধারিত ছিল, ইন্দ্রের জন্য নয়। ভগবান প্রকৃতপক্ষে বৃত্রাসুরের প্রতি অধিক কৃপাপরবশ ছিলেন; কারণ ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে মৃত্যুর পর বৃত্রাসুর ভগবদ্ধামে তাঁর কাছে ফিরে আসবেন, কিন্তু বিজয়ী ইন্দ্রকে এই জড়জগতে দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা হল শুদ্ধভক্তের দৃষ্টান্ত। শুদ্ধভক্ত সর্বদা গুরুত্ব দেন কৃষ্ণের ইচ্ছার উপর। শুদ্ধভক্ত সর্বদা সেটাকে ভগবানের কৃপা এবং আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। বৃত্রাসুর অসুর হলেও দেহের প্রতি তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি ভাবলেন যদি আমি অসুর যোনিও লাভ করি তাতে তো ক্ষতি নেই, কিন্তু যেন কৃষ্ণকে কখনও না ভুলে যাই। এটাই হচ্ছে বৃত্রাসুরের মাহাত্ম্য, এমনটাই হল শুদ্ধ ভক্তের একমাত্র কামনা।
✸বৃত্রাসুর স্তুতি (Vritrasura Stuti) ✸
===========================
মৃত্যুর পূর্বে বৃত্রাসুর পরমেশ্বর ভগবানের কাছে স্তুতি (মহিমা-কীর্তন) করছেন ━
❝ অহম্ হরে তব পাদ-এক-মূল-
দাসানুদাসো ভবিতাস্মী ভূয়ঃ।
মনঃ স্মরেত অসুপতেঃ গুণান্ তে
গৃণীত বাক্ কর্ম করোতু কায়ঃ ॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১১/২৪)
অনুবাদ:“হে ভগবান, যাঁরা আপনার পাদমূল আশ্রয় করেছেন, আমি কি আবার আপনার সেই দাসদের দাস হতে পারব? হে প্রাণপতি, আমি যেন পুনরায় তাঁদের দাস হতে পারি যাতে আমার মন সর্বদা আপনার দিব্য গুণাবলী স্মরণ করে, আমার বাণী যেন সর্বদা আপনার মহিমা কীর্তন করে এবং দেহ যেন সর্বদা আপনার সেবাকার্য সম্পাদন করতে পারে।”
❝ ন নাকপৃষ্ঠং ন চ পারমেষ্ঠ্যং
ন সার্বভৌমং ন রসাধিপত্যম।
ন যোগসিদ্ধীঃ অপুনঃ-ভবম্ বা
সমঞ্জস ত্বা বিরহয্য কাঙ্খে ॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১১/২৫)
অনুবাদ:“হে সর্ব সৌভাগ্যের উৎস, আমি আপনার শ্রীপাদপদ্ম ত্যাগ করে ধ্রুবলোক, ব্রহ্মপদ, পৃথিবীর আধিপত্য, অষ্ট যোগসিদ্ধি, এমন কি মোক্ষও লাভ করতে চাই না। ”
❝ অজাতপক্ষা ইব মাতরং খগাঃ
স্তন্যং যথা বৎসতরাঃ ক্ষুধার্তাঃ।
প্রিয়ং প্রিয়া ইব ব্যুষিতং বিষণ্ণা
মনোহরবিন্দাক্ষ দিদৃক্ষতে ত্বাম্॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১১/২৬)
অনুবাদ:“হে অরবিন্দাক্ষ, অজাতপক্ষ পক্ষীশাবক যেমন মাতার আগমনের প্রতীক্ষা করে, রজ্জুবদ্ধ গোবৎস যেমন ক্ষুধায় পীড়িত হয়ে কখন স্তন পান করবে তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, বিষন্ন পতিব্রতা পত্নী যেভাবে প্রবাসী পতির দর্শনের অভিলাষ করে, আমার মনও সর্বদা সেইভাবে আপনার সেবা করার জন্য আকাঙ্ক্ষা করছে।”
❝ মম উত্তম-শ্লোক-জনেষু সখ্যং
সংসারচক্রে ভ্রমতঃ স্বকর্মভিঃ।
ত্বৎ-মায়য়া আত্ম আত্মজ দারগেহেষু
আসক্ত চিত্তস্য ন নাথ ভূয়াৎ॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১১/২৭)
অনুবাদ:“হে নাথ, আমি আমার কর্মের ফলে সংসারচক্রে ভ্রমন করছি। তাই আমি যেন আপনার পুন্যকীর্তি ভক্তগনের সঙ্গে সখ্য লাভ করতে পারি। আপনার মায়ার প্রভাবে আমার চিত্ত যে দেহ, পুত্র, কলত্র, গৃহ প্রভৃতির প্রতি আসক্ত হয়েছে, তাতে যেন আর আসক্তি না থাকে। আমার মন, প্রাণ, সব কিছুই যেন আপনাতেই আসক্ত হয়।”
✸বৃত্রাসুরের জীবনীর আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ✸
==================================
পরীক্ষিৎ মহারাজ শুকদেব গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন –
❝ দেবানাং শুদ্ধ-সত্ত্বানাম্ ঋষীণাম্ চ অমল-আত্মনাম্।
ভক্তিঃ মুকুন্দ-চরণে ন প্রায়েণ উপজায়তে ॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১৪/২)
অনুবাদ: “শুদ্ধ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত দেবতারা এবং ভোগবাসনার কলুষ থেকে মুক্ত ঋষিরাও প্রায়ই মুকুন্দের শ্রীপাদপদ্মে ভক্তি লাভ করেন না। (অতএব বৃত্রাসুর কিভাবে এই প্রকার মহান ভক্ত হলেন ?)”
শুকদেব গোস্বামীকে আরও বলেছিলেন –
❝ মুক্তানাম্ অপি সিদ্ধানাং নারায়ণপরায়ণঃ।
সুদুর্লভঃ প্রশান্তাত্মা কোটিষু-অপি মহামুনে ॥❞
━┉┈┈(ভাগবতম্ ৬/১৪/৫)
অনুবাদ:“হে মহর্ষে, এই প্রকার কোটি কোটি মুক্ত ও সিদ্ধদের মধ্যেও প্রশান্তাত্মা নারায়ণ-পরায়ণ ভক্ত অত্যন্ত দূর্লভ।”
অর্থাৎ শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১৭) উল্লেখ করা হয়েছে–
❝ শৃণ্বতাং স্বকথাঃ কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ।
হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎসতাম্ ॥❞
“পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়েই বিরাজ করেন এবং যিনি হচ্ছেন সাধুবর্গের সুহৃদ, তিনি তাঁর পবিত্র কথা শ্রবণ এবং কীর্তনে রতিযুক্ত ভক্তদের হৃদয়ের সমস্ত ভোগবাসনা বিনাশ করেন।” যতক্ষণ পর্যন্ত না হৃদয়ের কলুষ বিধৌত হয়, ততক্ষণ শুদ্ধ ভক্ত হওয়া যায় না। তাই এই শ্লোকে সুদুলর্ভঃ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কেবল শতসহস্রের মধ্যে নয়, কোটি কোটি মুক্তদের মধ্যে একজন শুদ্ধ ভক্ত খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। এই শুদ্ধ ভক্তরা হলেন নারায়ণপরায়ণ (ভগবানের ভক্ত)। তাই এখানে কোটিষু-অপি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
সিদ্ধ এবং নারায়ণপরায়ণ— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের ভক্ত, তাঁদের বলা হয় নারায়ণপরায়ণ, কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন প্রকার যোগসাধন করেন, তাঁদের বলা হয় সিদ্ধ৷
ভাগবতম্-এর ১০/২/৩২ শ্লোকে বলা হয়েছে “হে ভগবান, যারা নিজেদের মুক্ত বলে মনে করে কিন্তু ভক্তিপরায়ণ নয়, তাদের বুদ্ধি অবিশুদ্ধ। যদিও তারা কঠোর তপস্যার প্রভাবে মুক্তির পরম স্তরে উন্নীত হয়, তবু পুনরায় এই জড় জগতে তাদের অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী, কারণ তারা আপনার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেনি।”
মৃত্যুর সময় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে মনকে একাগ্র করা। কেউ যদি তাঁর মনকে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে স্থির করতে পারেন, তাহলে তিনি সার্থক হবেন। ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে চিত্ত স্থির করে মৃত্যুবরণ করার জন্য বৃত্রাসুর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করেছিলেন, তাই তিনি ইন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রতি বজ্র নিক্ষেপ করার জন্য।
তারপর বৃত্রাসুর বললেন, – “ভগবান এতই কৃপাময় যে তিনি তাঁর ভক্তদের ধর্ম, অর্থ এবং কামের প্রয়াস করতে নিষেধ করেন। যাঁরা ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের সম্পূর্ণ শরণাগত এবং সর্বদা ঐকান্তিকভাবে তাঁর শ্রীপাদপদ্মের চিন্তায় মগ্ন, তাঁদের ভগবান তাঁর নিজ সেবকরূপে স্বীকার করেন। স্বর্গ-মর্ত্য এবং পাতালের যে সম্পদ আছে, তা তিনি তাঁদের প্রদান করেন না। কারণ এই ত্রিভুবনের ঐশ্বর্যের ফলে শত্রুতা, উদ্বেগ, মনস্তাপ, গর্ব এবং কলহের সৃষ্টি হয়। তখন সেই সম্পদ বৃদ্ধির জন্য এবং সংরক্ষণের জন্য তাঁকে অধিক প্রয়াস করতে হয় এবং সেই সম্পদ হারালে তখন তার গভীর দুঃখ হয়। তাই একান্ত ভক্তদের জন্য শ্রীকৃষ্ণ কখনও জড় সম্পদ প্রদান করেন না। প্রচারের জন্য ভক্তের কখনও কখনও ধনসম্পদের প্রয়োজন হয় কিন্তু ইন্দ্রিয় তর্পণের জন্য ধনসম্পদের অপব্যবহার করেন না। অবশ্য ভক্ত যদি ধর্ম-অর্থ-কাম চান তাহলে ভগবান নিশ্চয়ই সেগুলো তাদের প্রদান করেন—যেমন এক্ষেত্রে ইন্দ্রের জন্য স্বর্গসুখের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বৃত্রাসুরের ক্ষেত্রে ইন্দ্রের দ্বারা তাঁর দেহের বন্ধন বিনষ্ট করে, তাঁকে তাঁর নিজধামে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
এরপর বৃত্রাসুর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যেন তিনি তাঁর দাসের অনুদাসের দাস হতে পারেন। এটাই ভগবদ্ভক্তির সারাতিসার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এটাই উপদেশ দিয়েছেন এবং নিজে আচরণ করে এই শিক্ষা দিয়েছেন। অর্থাৎ গুরুপরম্পরা ধারায় যিনি ভগবানের দাসের অনুদাস, তাঁকে গুরুরূপে বরণ করা উচিত এবং শরীর, মন, বাণী—এই তিনটি সম্পদ গুরুদেবকে সমর্পণ করা উচিত। শ্রীগুরুদেবের আজ্ঞা অনুসারে দেহকে ভগবদ্ সেবামূলক কাজে নিযুক্ত করতে হবে, মন দিয়ে নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করতে হবে এবং বাণী দ্বারা সর্বদা ভগবানের মহিমা কীর্তন করতে হবে, তাহলে তাঁর মনুষ্য জীবন সার্থক হয়। শুদ্ধভক্ত কেবল ভগবান এবং তাঁর পার্ষদদের নিত্য সান্নিধ্য লাভ করে ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকতে চান—তাই নরোত্তম দাস ঠাকুর গেয়েছেন- “তাঁদের চরণ সেবি ভক্ত সনে বাস, জনমে জনমে হয় এই অভিলাষ।”
বৃত্রাসুর এখানে ভগবানের কাছে সেই প্রার্থনাই জানাচ্ছেন—“হে ভগবান! আমি আপনার শ্রীপাদপদ্ম ত্যাগ করে ধ্রুবলোক, ব্রহ্মপদ, পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য, অষ্টযোগসিদ্ধি, এমন কি মোক্ষও লাভ করতে চাই না। পক্ষীশাবক যেমন যতক্ষণ না মা ফিরে এসে তাকে খেতে দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে সন্তুষ্ট হতে পারে না, বাছুর মায়ের স্তন্য দুধ পান করতে না পারা পর্যন্ত সন্তুষ্ট হয় না এবং প্রবাসী পতি ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত পতিব্রতা পত্নী যেমন সন্তুষ্ট হতে পারে না, সেরকম শুদ্ধ ভক্তের একমাত্র বাসনা ভক্তসঙ্গে ভগবান এবং তাঁর দাসের অনুদাসের সেবা করা।”
বৃত্রাসুর তাঁর কথা শেষ করে ইন্দ্রের সঙ্গে ঘোরতর সংগ্রামে রত হলেন। ইন্দ্র বজ্রের দ্বারা বৃত্রাসুরের একটা বাহু ছিন্ন করলে বৃত্রাসুর তার অন্য হাত দিয়ে গদা দিয়ে ইন্দ্রকে আঘাত করলে ইন্দ্রের হাত থেকে বজ্র পড়ে যায় । ইন্দ্র মাটি থেকে বজ্র তুলতে চাননি, কিন্তু বৃত্রাসুর তাঁকে বজ্র তুলে নিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে অনুপ্রাণিত করেন। বৃত্রাসুর ইন্দ্রকে বললেন—“হে ইন্দ্ৰ ! যখন দু’পক্ষ যুদ্ধ করে তখন সেই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মা ভগবানের নিদের্শনায় সংঘটিত হয় (ভগবত গীতা ১৫।১৫)। জীব মূর্খতাবশতঃ নিজেকে কর্তা বলে মনে করলেও সে স্বতন্ত্র নয় । পরতন্ত্র জীবেরা ভগবানের ব্যবস্থাপনায় যুদ্ধ করে। জয় এবং পরাজয় প্রকৃতপক্ষে তাদের হয় না, জড়া প্রকৃতির মাধ্যমে সেটি ভগবানেরই আয়োজন। বিজয় সর্বদা ভগবানেরই হয়। জয়ে গর্ব অথবা পরাজয়ে বিপদ তাই অর্থহীন। আমাদের ইন্দ্রিয়ের শক্তি, মনের শক্তি, দেহের শক্তি, প্রাণ, অমরত্ব এবং মৃত্যু সবই ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। “শ্রীকৃষ্ণই কেবল পরম ঈশ্বর এবং অন্য সকলে তাঁর ভৃত্য । তিনি যেভাবে তাঁদের নাচান, সেইভাবে তাঁরা নৃত্য করেন। (চৈতন্য চরিতামৃত আদিলীলা ৫।১৪২)। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর আদি, তাঁর কোন আদি নেই, কারণ তিনি সর্বকারণের পরম কারণ (ব্রহ্মসংহিতা ৫।১)।”
দেবরাজ ইন্দ্র বৃত্রাসুরের মুখে এরূপ জ্ঞানগর্ভ বাণী শ্রবণ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন। তখন তাঁর প্রহ্লাদ মহারাজ এবং বলী মহারাজ আদি দৈত্যকুলের মহান ভক্তদের কথা মনে পড়েছিল এবং বৃত্রাসুরকে মহান ভগবদ্ভক্ত হিসাবে সম্মতি জানিয়ে ছিলেন। তারপর তাঁরা পুনরায় যুদ্ধ করতে শুরু করেন। বৃত্রাসুর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ইন্দ্রকে গ্রাস করেন, কিন্তু ইন্দ্র বৃত্রাসুরের উদর থেকে নির্গত হয়ে বজ্রের দ্বারা তাঁর মস্তক ছিন্ন করেছিলেন তখন বৃত্রের দেহ থেকে জ্যোতির্ময় আত্মা নিষ্ক্রান্ত হয়ে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করলেন। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর বিশ্লেষণ করেছেন যে, —“প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্র বৃত্রাসুরের পরিত্যক্ত দেহটি কেটেছিলেন, বৃত্রাসুর নিহত হননি। তাঁর প্রকৃত চেতনায় বৃত্রাসুর ভগবান সঙ্কর্ষণের পার্ষদত্ব লাভ করে ভগবদ্ধামে ফিরে গিয়েছিলেন।”