daextlwcn_print_scripts(false);
✤পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব✸Panihati Chida Dahi Utsava✤1

✤পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব✸Panihati Chida Dahi Utsava✤

1 min


190
159 shares, 190 points

‘পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব’ (Panihati Chida Dahi Utsava) বা দণ্ড মহোৎসব হল বৈষ্ণব সেবার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এবং সেই সাথে শ্রীকৃষ্ণের লীলা স্মরণের উপযোগী এমন পারমার্থিক তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব আজও হয়ে থাকে, এবং প্রতি বৎসর মহাসমারোহে উদযাপিত হয়ে থাকে, এবং সকলেই উপলব্ধি করে থাকেন যে, এই উৎসবের মাধুর্য উপভোগের অভিলাষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুসহ তাঁদের সমস্ত পার্ষদবর্গ আজও দণ্ড মহোৎসবের দিনক্ষণে চিন্ময় রূপে অবশ্যই উপস্থিত থাকেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইস্কন) প্রতিষ্ঠাতা- আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে পবিত্র পানিহাটি ধামে এই চিঁড়া-দধি মহোৎসবের আয়োজন করতে তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেই নির্দেশ অনুসারে ইস্কনের ভক্তবৃন্দ প্রতি বছরেই কলকাতা মহানগরীর উত্তর উপকন্ঠে গঙ্গাতীরে পানিহাটি নামে জায়গাটিতে বিপুল উৎসাহে এই মহোৎসবটি পালন করে থাকেন। 

এই উৎসবের তাৎপর্য মাহাত্ম্য সম্পর্ক কেবল পানিহাটিতেই নয়, আজ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইস্কনের কৃষ্ণভক্তদের মাঝেও এই উৎসবের আকর্ষণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ইস্কনের আয়োজিত এবং প্রবর্তিত বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানাদি, বিশেষ করে পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব’টির সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পারমার্থিক তাৎপর্য ক্রমশই সমগ্র পৃথিবীর জনগণের কাছে তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছেও প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। সকলেই এই সমাজ সংহতিমূলক “পারমার্থিক উৎসব” টির শুভ প্রতিক্রিয়া নিজ নিজ দেশে ফলপ্রসূ করতেই চাইছেন।

আজকের বিচ্ছিন্নতার যুগে মানুষকে পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব ব্রতে উদ্বুদ্ধ করে সংহতিসূত্রে আবদ্ধ রাখার মানসে এই মহোৎসবটিকে এমনভাবে মাতিয়ে তুলতে হবে।

─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

 পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব সময়সূচী 

পানিহাটিতে ৫১০ তম  ঐতিহ্যবাহী ‘পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব’ বা ‘দণ্ড মহোৎসব’ পালিত হবে ━

ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 20-জুন-2024 (বৃহস্পতিবার)
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৫ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব মহিমা ❀ 

 

❝ কৃপাগুণৈর্যঃ কুগৃহান্ধকূপা দুদ্‌ধৃত্য ভঙ্গ্যা রঘুনাথদাসম্।
ন্যস্যস্বরূপে বিদধেহন্তরঙ্গং শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যমমুং প্রপদ্যে॥ ❞

━┉┈┈(চৈতন্য চরিতামৃত অন্তলীলা, ৬/১)

অনুবাদ: যিনি কৃপারূপ রজ্জুর দ্বারা গৃহান্ধকূপ থেকে কৌশলে রঘুনাথ দাসকে উদ্ধার করে স্বরূপ দামোদরের কাছে অর্পণ করে তাকে অন্তরঙ্গ ভক্ত করেছিলেন। সেই শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর চরণে আমি প্রপন্ন হই।

◼️ শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর আবির্ভাব ◼️

১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী বাংলার কথা অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫৭৫ বছর আগের কথা। বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে ছিল অবিভক্ত বাংলা। সেই সময় যশোরের ভৈরব নদ থেকে শুরু করে রূপনারায়ণ নদ পর্যন্ত এক বিশাল ভূখণ্ডের নাম ছিল সপ্তগ্রাম সে সময় এই সপ্তগ্রাম ছিল মূলতঃ বন্দর ও নগর। তদানীন্তনকালে সপ্তগ্রাম ছিল প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র এবং এক ঐশ্বর্যমণ্ডিত ক্ষেত্র। এই নগরেই শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর পিতা গোবর্ধন দাস এবং জ্যাঠা হিরণ্য দাস প্রভূত সম্পদের অধীশ্বর রূপে বসবাস করতেন। এই সপ্তগ্রামেরই জমিদার ছিলেন শ্রী গোবর্ধন দাস। তিনি কায়স্থ কুলোদ্ভূত সম্ভ্রান্ত পরিবারভূক্ত ধনাঢ্য জমিদার ছিলেন। তাদের রাজপ্রদত্ত উপাধি ছিল মজুমদার তার বাৎসরিক আয় ছিল কুড়ি লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। আজ থেকে ৫০৮ বছর আগের এই কুড়ি লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়। তখনকার দিনের কুড়ি লক্ষ টাকা এখনকার দিনের প্রায় ২০০ কোটির সমান। হিরণ্য ও গোবর্ধন দাস উদার ছিলেন ও ধনবান ছিলেন। তারা ব্রাহ্মণদের ধন সম্পদ ইত্যাদি দান করতেন এবং ব্রাহ্মণেরা অনেকাংশেই তাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই দুই ভাইকে খুব ভালভাবে জানতেন ।

এ রকম এক বিশাল ধনী পিতার পুত্ররূপে ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণপুর গ্রামে, বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের অন্যতম বৈষ্ণব কুল চূড়ামণি শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী আবির্ভূত হন। জমিদার পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাল্যকাল থেকেই এইসব ঐশ্বর্য ও বিষয় এর প্রতি উদাসীন ছিলেন। শ্রীরঘুনাথ শৈশবে পুরোহিত আচার্য শ্রীবলরাম দাসের নিকট অধ্যয়ন করতেন। শ্রীবলরাম দাস শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কৃপার পাত্র ছিলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুরও মাঝে মধ্যে শ্রীরঘুনাথদের গৃহে আগমন করতেন। সেই কারণেই শ্রীরঘুনাথ, শ্রীহরি দাস ঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে কৃষ্ণের কৃপা প্রাপ্তি ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তত্ত্ব উপদেশ শ্রবণ করার সৌভাগ্যলাভ করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ কৃষ্ণভক্তি এবং মহাপ্রভুর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। শ্রীহরিদাস ঠাকুরের মতো শুদ্ধ ভক্তের সঙ্গ প্রভাবে বাল্যকাল থেকেই তিনি সংসারের অনিত্যতা সম্বন্ধে উপলব্ধি লাভ করেন। ক্রমে বিভিন্ন শুদ্ধ ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রীশ্রীগৌর নিত্যানন্দের মহিমান্বিত কথা শ্রবণের কারণে তাঁদের শ্রীপাদপদ্ম দর্শনের নিমিত্ত অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।

✤পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব✸Panihati Chida Dahi Utsava✤3

◼️ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সাক্ষাৎ ◼️

ঘটনাক্রমে তাই রঘুনাথ দাস গোস্বামী যখন অবগত হলেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর শান্তিপুরে আসবেন তখন রঘুনাথ দাস মহাপ্রভুর সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ করেন। মহাপ্রভুর সাক্ষাতে তিনি প্রেমাবিষ্ট হয়ে পড়েন এবং মহাপ্রভুর শ্রীচরণে পতিত হন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাকে কৃপা পূর্বক তাঁর পাদস্পর্শ প্রদান করেন। রঘুনাথ দাসের পিতা শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভুর অত্যন্ত প্রিয় পাত্র ছিলেন এবং সেই কারণেই রঘুনাথ দাস সেই সময় শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের গৃহেই অবস্থান করেছিলেন এবং আচার্যের কৃপাতে রঘুনাথ দাস মহাপ্রভুর উচ্ছিষ্ট পেতেন। এইভাবে কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর মহাপ্রভু যথা সময়ে শ্রীক্ষেত্র নীলাচলে গমন করলেন এবং রঘুনাথ দাস তার গৃহে ফিরে গেলেন। কিন্তু গৃহে ফিরে যাবার পর রঘুনাথ দাস গৌরাঙ্গপ্রেমে উন্মাদ হয়ে পড়লেন। যেহেতু তিনি জানতেন মহাপ্রভু নীলাচলে অবস্থান করছেন, তাই তিনি বারংবার নীলাচল গমনের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করতে লাগলেন। প্রতিবারই তার পিতা পাইকদের দিয়ে তাকে পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন। অবশেষে রঘুনাথকে গৃহবন্দী করে রাখা হলো। নীলাচলে না যেতে পারার কারণে রঘুনাথ সর্বদাই অত্যন্ত দুঃখিত থাকতেন। এই রকম অবস্থা চলতে থাকার মধ্যে তিনি পুনরায় অবগত হলেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শান্তিপুরে এসেছেন।

মহাপ্রভুর আগমন বার্তা পেয়ে রঘুনাথ এত বিচলিত হয়ে পড়লেন যে তিনি আকুল হয়ে তার পিতার কাছে  প্রার্থনা করলেন যে, তিনি যেন শ্রীমহাপ্রভু শ্রীপাদপদ্ম দর্শনের অনুমতি তাকে দেন নচেৎ তার পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব নয়। পুত্রের এই আকুল প্রার্থনায় স্নেহশীল পিতা গোবর্ধন দাস সম্মত হলেন এবং বহু লোকজন ও নানা দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে রঘুনাথকে মহাপ্রভুর দর্শনে প্রেরণ করলেন। রঘুনাথ দাস শান্তিপুরে সাতদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে ছিলেন। মহাপ্রভুর সঙ্গে অবস্থানকালে তিনি সর্বদাই চিন্তা করতেন কিভাবে তিনি এই পাইকদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে মহাপ্রভুর সঙ্গে নীলাচলে যাবেন। অন্তর্যামী সর্বজ্ঞ ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রঘুনাথ দাসের অভিলাষের কথা জানতে পারলেন এবং এখানেই গৃহস্থ ভক্তদের শিক্ষার নিমিত্ত এক মহামূল্যবান উপদেশ প্রদান করলেন । তিনি বললেন—

❝ স্থির হইয়া ঘরে যাও, না হও বাতুল।
ক্রমে ক্রমে পায় লোক ভবসিন্ধু কুল॥ 

মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাঞা।
যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্ত হঞা॥

অন্তরে নিষ্ঠা কর, বাহ্যে লোক ব্যবহার।
অচিরাৎ কৃষ্ণ তোমায় করিবেন উদ্ধার॥ ❞

                           ━┉┈┈( চৈতন্য চরিতামৃত মধ্য, ৬।২৩৭ – ২৩৯)

 শ্রীল প্রভুপাদ এই শ্লোক সমূহের তাৎপর্যে ব্যাখ্যা করছেন যে এই জড় জগত এক বিশাল সমুদ্রের ন্যায়। ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে অবগত না হওয়ার ফলে বদ্ধজীব সাঁতার না জানা মানুষের মতো এই সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই সমুদ্র একলাফে পার হওয়া যায় না। এটিকে উন্মাদের ন্যায় আচরণ দ্বারাও অতিক্রম করা যায় না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বা তাঁর প্রতিনিধির নির্দেশ অনুসারে চেষ্টার দ্বারাই তা কেবলমাত্র অতিক্রম করা সম্ভব। তাই কপট বৈরাগ্য কখনই অবলম্বন করা উচিত নয় । ভগবানের সেবার নিমিত্ত অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয় ভোগ স্বীকার করে সেই বিষয়ে আসক্তি পরিত্যাগ করে জীবন যাপন করলে তার জন্য কর্মকালের অধীন হতে হয় না। তাই যুক্ত বৈরাগ্য অনুমোদন যোগ্য এবং তা অবলম্বন করে অন্তরে নিষ্ঠার সঙ্গে ভগবানের সেবা এবং একজন সাধারণ বিষয়ীর মতো আচরণ করলে একদিন শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হয়ে মায়ার বন্ধন থেকে উদ্ধার করবেন।

রঘুনাথ দাসের প্রতি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই উপদেশটি হলো গৃহস্থ ভক্তদের ভগবদ্ভক্তির অভ্যাস যোগ অবলম্বন করে ক্রমে তার থেকে উন্নতি লাভ করে এক সময় কাঙ্ক্ষিত স্তর অর্থাৎ প্রেমভক্তি লাভ এবং জড়জগত থেকে মুক্তির এক সরল ও প্রকৃষ্ট পন্থা।

◼️ শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর মধ্যে বৈরাগ্যের প্রকাশ ◼️

এই উপদেশ শ্রবণ করার পর শ্রীরঘুনাথ দাস ঘরে ফিরে গিয়ে তাঁর নির্দেশমতো আচরণ করতে লাগলেন। বৈষয়িক দায়িত্ব পালন করতে দেখে তার পিতা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তার প্রহরা কিছু শিথিল করলেন। রঘুনাথের বৈরাগ্য দূর করে তাঁকে সংসারমুখী করার উদ্দেশ্যে তাঁর পিতামাতা অবশেষে এক পরমা সুন্দরী কন্যার সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও রঘুনাথের সংসারের প্রতি উদাসীনভাব গেল না। এইরূপে রঘুনাথ দাস প্রায় এক বৎসরকাল অভিজ্ঞ বিষয়ীর মতো আচরণ করে কালতিপাত করলেন এবং তারপর থেকে পুনরায় তার পলায়ন ইচ্ছা প্রবল হলো। রাত্রিকালে পলায়ন করলেন এবং যথারীতি তার পিতা তাকে ধরে আনলেন। বারবার তার পলায়নের ঘটনাতে রঘুনাথ দাসের মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে তাঁর পিতাকে বললেন তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে। রঘুনাথের বিষণ্ণ পিতা তাতে ব্যক্ত করলেন যে, ━

ইন্দ্রের মতো ঐশ্বর্য ও অপ্সরার মতো সুন্দরী স্ত্রী যাকে বাঁধতে অক্ষম তাকে দড়ির বন্ধনে কিরূপে বেঁধে রাখা যাবে? চৈতন্যচন্দ্রের প্রেমে যে পাগল তাকে কে রাঁধতে পারে?

এইমত পন্থায় শ্রীচৈতন্যচন্দ্রের কৃপালাভ সম্ভব নয় দেখে রঘুনাথ দাস মনে কিছু বিবেচনা করলেন, তার মনে হলো দয়াল নিত্যানন্দ প্রভুর অপার করুণা ব্যতীত শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কৃপা প্রাপ্তি সম্ভব নয়। কারণ,

❝ নিত্যানন্দের অধিক চৈতন্যের প্রিয় নাহি আর।
নিরবধি সেই দেহে তিনি করেন বিহার॥ ❞

◼️ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সাক্ষাৎ ◼️

তখন ১৫১৩-১৪ খ্রিষ্টাব্দের বাংলার কথা অর্থাৎ আজ থেকে ৫১০ বছর আগের কথা। বর্তমানে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় সোদপুর স্টেশন থেকে অনতিদূরে গঙ্গাতীরে পানিহাটি গ্রামে শ্রীল রাঘব পন্ডিত গোস্বামীর বাড়ীতে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু এসেছেন। সপ্তগ্রামের জমিদার গোবর্ধন রায়ের একমাত্র সন্তান রঘুনাথ দাস এখবর পেয়ে নিত্যানন্দ প্রভুকে দর্শন করতে আকুল হয়ে পড়েন এবং নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য পানিহাটি আসেন।

তিনি দেখলেন গঙ্গার ধারে এক বটবৃক্ষের নিচে বেদীর উপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন। তাঁর চিন্ময় দেহ কোটি কোটি সূর্যের মতো জ্যোতির্ময়। বহু ভক্ত, বহু কীর্তনীয়া, সেবক এবং অনুগামী তাঁকে ঘিরে বসে আছেন। দূর থেকে রঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে দন্ডবৎ করে পড়ে রইলেন। কোনও ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন, রঘুনাথ আপনাকে প্রণতি নিবেদন করছে। তা শুনে নিত্যানন্দ প্রভু স্নেহ বিগলিতভাবে রঘুনাথ দাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

❝ চোরা, দিলি দরশন।
আয়, আয়, আজি তোর করিমু দণ্ডন॥ ❞

অর্থাৎরঘুনাথ, তুই এতদিন চোরের মতো পালিয়ে থেকে আজ আমাকে দর্শন দিলি, দাঁড়া আজ তোকে আমি দণ্ড দেব। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাকে কাছে ডাকলেও রঘুনাথ দাস তাঁর কাছে যাচ্ছিলেন না। তখন নিত্যানন্দ প্রভু জোর করে ধরে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিয়ে এলেন। শ্রীচরণে পতিত হলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাঁর অভয়চরণ (শ্রীচরণপদ্ম) কৃপা করে রঘুনাথের মস্তকে স্থাপন করলেন। কৌতুক প্রিয় করুণার সাগর নিত্যানন্দ প্রভু অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে বললেন, 

❝ নিকটে না আইস, চোরা, ভাগ’ দূরে দূরে।
আজি লাগ্‌ পাঞাছি, দণ্ডিমু তোমারে॥ ❞

অর্থাৎ আমার কাছে না এসে তুই চোরের মতো দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াস। আজ তোর নাগাল পেয়েছি, তোকে দন্ড দেব। সেই শ্রীপাদপদ্মের স্পর্শ মাত্রই রঘুনাথের সব বন্ধন যেন কেটে গেল, দ্বিধাদ্বন্ধ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে গেলেন। তখন হাসিমুখে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীরঘুনাথ দাসকে বললেন, 

❝ দধি চিড়া ভক্ষণ করাহ মোর গণে।
শুনি’ আনন্দিত হৈল রঘুনাথ মনে॥ ❞

অর্থাৎ আমার লোকদেরকে এখন চিড়াদধি খাওয়াতে হবে। সেই নির্দেশ লাভ করা মাত্রই রঘুনাথ দাসের মনে আনন্দের সীমা রইল না। রঘুনাথ বৈষ্ণব-সেবার অধিকার অর্জনের পরমানন্দে তৎক্ষণাৎ গ্রামে গ্রামে লোকজন পাঠিয়ে দিলেন চিঁড়া, দই, দুধ, সন্দেশ, চিনি, কলা ইত্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে (কিনে আনতে)। এক মহামহোৎসবের সূচনা হয়েছিল সেই দিন যা আজও পালিত হয় ‘পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব’ হিসাবে। তাছাড়া এই মহামহোৎসবটি দণ্ড মহোৎসব (Danda Mahotsava = the Festival of Punishment) নামেও পরিচিত। দিনটি ছিল আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথি। সেই চিড়াদধি মহোৎসব স্মৃতি অনুসারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে এই পানিহাটিতে সেই বটবৃক্ষতলে চিড়াদধি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

✤পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব✸Panihati Chida Dahi Utsava✤2

পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব পালন
=============================

🌸 মহোৎসবের সংবাদ পেয়ে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ভক্ত, ব্রাহ্মণ এবং সজ্জন ব্যক্তিরা সেখানে আসতে লাগলেন। বড় বড় মৃৎকুণ্ডিকার (মাটির জালা) মধ্যে পাঁচসাত জন ব্রাহ্মণ চিড়া ভেজাতে লাগলেন। কোনো পাত্রে গরম দুধের মধ্যে চিড়া ভিজিয়ে সেখান থেকে অর্ধেক অন্য পাত্রে নিয়ে দধি, চিনি ও কলা দিয়ে মেশানো হল আর অর্ধেক অন্য পাত্রে নিয়ে ঘন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে চাঁপাকলা, চিনি, ঘি এবং কর্পূর মিশিয়ে মাখা হলো।

🌸 শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তখন নতুন ধুতি পরে বৃক্ষমূলে পিণ্ডার (পিঁড়ির) উপর উপবেশন করলেন।  এভাবে তখন তাঁর সম্মুখে সাতটি দধি-চিড়া পূর্ণ মৃৎকুণ্ডিকা রাখা হলো। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর চারি পাশে রামদাস, সুন্দরানন্দ দাস, গদাধর, শ্রীমুরারী, কমলাকর, শ্রীপুরন্দর, ধনঞ্জয়, সদাশিব, শ্রীজগদীশ, পরমেশ্বর দাস, মহেশ পণ্ডিত, শ্রীগৌরীদাস, হোড়কৃষ্ণ দাস ও উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর প্রভৃতি নিত্যানন্দ প্রভুর সমস্ত নিজ জনেরা উপরে বসলেন। অভ্যাগত পণ্ডিত ভট্টাচার্যগণকেও সম্মানের সঙ্গে উপরে বসানো হল। সকলকে দুটি করে মৃৎ পাত্রে দুগ্ধ চিড়া ও দধি-চিড়া সমেত দেওয়া হয়েছিল। সবাইকে চিড়াদধি দেওয়া হলেও কেউই ভোজন করছিলেন না। কারণ সেই সমস্ত ভক্তের মনোভিলাষ এই ছিল যে, নিত্যানন্দ প্রভু আগে ভোজন শুরু করবেন, তারপর তাঁর নির্দেশক্রমে ভক্তেরা ভোজন শুরু করবেন। কেউ কেউ উপরে স্থান না পেয়ে গঙ্গাতটে গিয়ে ভোজন করছিলেন। আবার কেউ কেউ তটে স্থান না পেয়ে গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে দধি চিড়া ভক্ষণ করছিলেন।

🌸 সেদিন রাঘব পণ্ডিতের গৃহে নিত্যানন্দ প্রভুর নিমন্ত্রণ ছিল কিন্তু তাঁর আগমনে বিলম্ব দেখে, রাঘব পণ্ডিত গোস্বামী সেই স্থানে আগমন করলে সেখানে মহোৎসবের আয়োজন দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে হাসতে লাগলেন। তিনিও নানা রকমের প্রসাদ নিয়ে এসে নিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন, আপনার জন্য আমি গৃহে ভোগ নিবেদন করেছি, আর এখানে উৎসব! এদিকে আমার ঘরে প্রসাদ রয়েছে। নিত্যানন্দ প্ৰভু বললেন, “জাতিতে আমি গোপ, তাই গোপেদের নিয়ে এইভাবে নদীর তীরে পুলিন ভোজন করতে আমার খুব আনন্দ হয়।” অতঃপর রাঘবকে “তোমার ঘরে রাতে প্রসাদ গ্রহণ করব” বলে আশ্বস্ত করলেন এবং এই দুটি মৃৎ পাত্র নিয়ে তুমি আমাদের সাথে প্রসাদ পাও।

🌸 এইভাবে সকলকে দধিচিড়া পরিবেশন করার পর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু মহাপ্রভুর ধ্যানে বসলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সন্ন্যাসীবেশে পুরীধানে অবস্থান করলেও নিত্যানন্দ প্রভু ধ্যানের মাধ্যমে আহ্বান জানালে তিনি এই অপ্রাকৃত মহোৎসবে তাঁর দিব্য স্বরূপে পানিহাটিতে যোগদান করেছিলেন। অন্তর্যামী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এলে নিত্যানন্দ প্রভু হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং সকল মণ্ডলে আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। নিত্যানন্দ প্রভুর এই ভ্রমণ রঙ্গ অনেকেরই বোধগম্যের বাইরে ছিল। এভাবে নিত্যানন্দ প্রভু সব মন্ডলে বেড়াতে লাগলেন এবং সমস্ত বৈষ্ণবগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই লীলা দর্শন করতে লাগলেন। কোন কোন ভাগ্যবান সেই ব্যাপার লক্ষ্য করছিলেন। অনেকেই বুঝতেই পারছিলেন না নিত্যানন্দ প্রভু কি করছেন? কারণ অনেকেই চৈতন্য মহাপ্রভুকেই দেখতে পাচ্ছেন না।

🌸 সকলের হাতে রাখা চিড়াদধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। প্রতিটি পাত্র থেকে এক এক গ্রাস করে চিড়া তুলে নিয়ে তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে দিতে লাগলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও মৃদু মৃদু হেসে এক এক গ্রাস চিড়া তুলে নিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মুখে দিলেন। তারপর নিত্যানন্দ প্রভু নিজে আসনে বসলেন এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে আসনে বসিয়ে দুই ভাই একত্রে হাসতে হাসতে পরস্পর পরস্পরকে খাওয়াতে লাগলেন। কয়েকজন পার্ষদ ছাড়া উপস্থিত অন্য কেউ সেদিন মহাপ্রভুর এই দিব্যলীলা দর্শন করতে পারেননি।  তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ভাবাবেগে সকলকে হরিধ্বনি দিতে বললেন,

❝ হরি হরি বলি বৈষ্ণব করয়ে ভোজন।
পুলিন-ভোজন সবার হইল স্মরণ॥ ❞

                                                 ━┉┈┈(চৈতন্য চরিতামৃত অন্ত ৬/৮৭)

🌸 নিত্যানন্দ প্রভুর নির্দেশে বৈষ্ণবেরা হরিনাম উচ্চারণ করতে শুরু করলেন। তখন হরি হরি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হলো। নিত্যানন্দ প্রভু আগে মুখে গ্রাস তুললেন, তখন অন্যরা ভোজন করতে শুরু করলেন। সেই সময় ভোজনকারী বৈষ্ণবগণের প্রত্যেকের মনে পানিহাটি কিংবা গঙ্গাতটের কথা মনে হলো না, মনে হলো বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সাথে তারা সব গোপসখা যমুনার তীরে পুলিনভোজন করছেন।

🌸 এদিকে পানিহাটিতে মহোৎসব হচ্ছে এই কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এবং কথাটি শোনামাত্রই দূরের, আশেপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে অনেক ভক্ত অনেক অনেক  পরিমাণে চিড়া, দই, সন্দেশ, প্রভূতি নিয়ে এসে পৌঁছাল। যে যা নিয়ে এল, রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাদের সমস্ত মূল্য দিয়ে সেগুলি কিনে নিলেন এবং তাদেরই সেগুলি খাওয়ালেন। অসংখ্য ভক্ত সেখানে আসতে লাগল মজা দেখতে, তাদেরকেও চিড়া দধি কলা খাওয়ানো হলো।

🌸 নিত্যানন্দ প্রভু আচমন করলেন। তাঁর কাছে চারটি কুন্ডিতে অবশেষ প্রসাদ ছিল। একটি কুন্ডি রঘুনাথ গোস্বামীকে নিত্যানন্দ প্রভু দিয়েছিলেন, বাকী তিনটি কুন্ডি থেকে অবশেষ প্রসাদ এক ব্রাহ্মণ একটু একটু করে নিয়ে অন্য সমস্ত ভক্তকে বিতরণ করতে লাগলেন। পাশাপাশি রঘুনাথ দাস গোস্বামীও প্রভুর দেওয়া অবশেষ প্রসাদ তাঁর ভক্তদের বিতরণ করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আশীর্বাদে নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপায় ভক্তদের হৃদয়ে আনন্দের মধ্য দিয়ে ভক্তি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই ভক্তিরসে স্নাত ভক্তগণ সে দিন ভক্তির সমুদ্রে ডুব দিয়ে আনন্দময় উন্মাদনা উপলব্ধি করছিল।

🌸 তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যাকালে শুরু হলো শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মহা হরিনাম সংকীর্তন। ভগবৎ প্রেমে যেন জগত প্লাবিত করছেন। অনেকেই সেখানে নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নাচতে দেখলেন, আবার অনেকে মহাপ্রভুকে দেখেননি। তাঁরা জানেন, মহাপ্রভু তো জগন্নাথপুরী ধামে রয়েছেন। যাই হোক, সেই চিড়া দধি মহোৎসবে রঘুনাথ দাস গোস্বামী সহ সমস্ত ভক্ত পরম আনন্দে বিহ্বল হলো। এইভাবে রঘুনাথ দাসের শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা প্রাপ্তি স্বরূপ দধি-চিড়া মহোৎসব সমাপন হলো। নিত্যানন্দ প্রভু রঘুনাথ দাসকে আশীর্বাদ করলেন যে তিনি অচিরেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্ম লাভ করবেন।সেই চিড়াদধি মহোৎসব স্মৃতি অনুসারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে এই পানিহাটিতে সেই বটবৃক্ষতলে চিড়াদধি মহোৎসব হয়। 

🌸 শ্রীরঘুনাথ দাস গৃহে ফিরে গেলেন এবং চিরকালের জন্য নীলাচলে গমনের উপায় চিন্তা করতে থাকলেন। একদিন দৈবক্রমে তার কুলগুরু ও কুলপুরোহিত যদুনন্দন আচার্য ভোররাত্রে তাদের গৃহে উপস্থিত হলেন। যদুনন্দন আচার্য এক বিশেষ কার্যের কারণে রঘুনাথকে নিয়ে গেলেন আর শেষ রাত্রে রক্ষকেরা সকলে ঘুমিয়ে পড়ল। পথের মধ্যে ছলপূর্বক যদুনন্দনের আদেশ নিয়ে নীলাচল অভিমুখে পলায়ন করলেন। ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে কায়-মন-বাক্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মের কথা চিন্তা করতে করতে নীলাচল ক্ষেত্রে পৌঁছালেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর পার্ষদবর্গসহ যখন বসেছিলেন তখন রঘুনাথ দাস সেখানে এলে মুকুন্দ দত্ত বললেন, “রঘুনাথ এসেছে।” শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাকে আসতে বললেন এবং রঘুনাথ এসেই তাঁর শ্রীপাদপদ্মে পতিত হলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তখন তাঁর আসন থেকে উঠে কৃপাবশতঃ তাকে আলিঙ্গন করলেন। রঘুনাথের ওপর মহাপ্রভুর এই বিশেষ কৃপা দর্শন করে তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদগণও রঘুনাথকে আলিঙ্গন করলেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, শ্রীকৃষ্ণের কৃপা সব চাইতে বলিষ্ঠ, তাই তিনি তোমাকে বিষয় বিষ্ঠার গর্ত হতে উদ্ধার করলেন। (চৈ.চ. অন্ত ৬/১৯৩ শ্লোকার্থ)।

❝ রঘুনাথ মনে কহে কৃষ্ণ নাহি জানি।
তব কৃপা কাড়িল আমা—এই আমি মানি॥ ❞

                                                 ━┉┈┈(চৈতন্য চরিতামৃত অন্ত ৬/১৯৪)

অর্থাৎ, রঘুনাথ মনে মনে বললেন, কৃষ্ণ কে তা আমি জানি না, আপনার কৃপাই আমাকে ভব সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে—এই আমি মানি।” 

অতঃপর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বরূপ দামোদরকে বললেন, এই রঘুনাথকে আমি তোমার কাছে সমর্পণ করলাম। একে তোমার পুত্র ও ভৃত্যরূপে তুমি অঙ্গীকার কর। আমার পার্ষদদের মধ্যে তিনজন রঘুনাথ রয়েছে তাই আজ থেকে এর নাম হলো ‘স্বরূপের রঘু’ এবং এই ভাবেই শ্রীরঘুনাথ দাস শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা লাভ করে বৈরাগ্য ও ভক্তিযোগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ 
===================

শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কেন দিয়েছিলেন রঘুনাথকে শাস্তি? কি ছিল তাঁর অপরাধ?

কারণ, মহাপ্রভু হচ্ছেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর আরাধ্য। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হলেন স্বয়ং বলরামদেব, স্বয়ং অনন্ত শেষনাগ। তিনি ভগবানের সেবায় সর্বদা নিযুক্ত, ভগবানের খুশির জন্য তিনি সর্বদা তৎপর। যদি কোন ভক্ত নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা লাভ করেন, তাকে ভগবান দূরে ঠেলে দিতে পারেন না, ভগবানের আশীর্বাদ তিনি নিশ্চিত পাবেনই। কিন্তু রঘুনাথ দাস গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুর অনুমোদন ব্যতীতই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেবা অনুরাগী হতে হয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু তা জানতেন, তাই তিনি রঘুনাথ দাসকে ফিরিয়ে দিলেন এই বলে এখনও উপযুক্ত সময় হয় নি রঘুনাথ। এই সংসারে এখনও তোমার প্রয়োজন রয়েছে। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হলেন আদি গুরু, তাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পেতে হলে তাঁর প্রতিনিধি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাধ্যমে পেতে হবে। যখন শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে নত স্বীকার করলেন, গুরুর মর্যাদা দিলেন, তখন নিত্যানন্দ প্রভু তাকে দণ্ড (শাস্তি) প্রদান করলেন। তাঁর শাস্তি ছিল- নিত্যানন্দ-গৌরাঙ্গের সমস্ত ভক্তদের চিড়া-দধি খাওয়াতে হবে। যদিও তৎকালীন হুগলি জেলার শ্রীকৃষ্ণপুরের জমিদার গোবর্ধন মজুমদারের একমাত্র পুত্র রঘুনাথ দাস এই দন্ড মাথা পেতে নিয়েছিলেন। জানা যায় সেই জমিদারের মাসিক আয় ছিল বিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। তার ছেলে রঘুনাথ দাস সেসময় হাজার হাজার ভক্তদের নিজের হাতে চিড়া-দধি প্রসাদ বিতরণ করেছিলেন।

নিত্যানন্দ প্রভু জানতেন তার আর্থিক সচ্ছলতার কথা, তবু তিনি সমস্ত ভক্তদের চিড়া-দধি খাওয়ানোর দণ্ড দিলেন কেন? এটা সহজ দণ্ডই বা তাকে দিলেন কেন?  কারণ, এতে শ্রীরঘুনাথ দাসকে ভুলের শাস্তি দেওয়া হল, যাতে এই ভুল তিনি যেন দ্বিতীয়বার আর না করেন। তার ভুলের মাধ্যমে বাকি ভক্তদের এই শিক্ষা প্রদান করলেন ভগবানকে প্রাপ্ত করতে হলে গুরুর চরণে আশ্রয় নিতে হবে, গুরুর কৃপায় ভক্তের ভগবান প্রাপ্তি সম্ভব। শাস্তি এমন দেওয়া উচিত যাতে ভক্তের ভক্তি মনোভাবের কোন পরিবর্তন না হয়, অথচ সে তার ভুল বুঝে শুধরে নিতে পারবে। যেমন মা তার শিশুকে ভালোবেসে বোকাঝোকা করে ভুল শুধরে দেয়। ভক্তদের খাওয়ানোর ফলে ভক্তের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়, পাশাপাশি ভক্তিভাব আরও বৃদ্ধি পায়। এই হল ভক্তের প্রতি গুরুর কৃপা। সুতরাং জড় জাগতিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে এটা শাস্তি মনে হলেও তা ছিল শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর প্রতি  শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর অসীম কৃপা।

যদি ভক্ত অহংকারী ও ত্রিগুণের দাস হয়, সে গুরুর কথা শুনতে চাইবে না; আবার গুরু এর মাধ্যমে সহজেই বুঝতে পারবেন সেই ভক্ত আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হতে পারবে কিনা, ভক্ত জীবনে টিকতে পারবে কিনা, জ্ঞান লাভ করে সেই পথ অনুসরণ করতে পারবে কিনা। এটা ভক্তের মানসিক অবস্থা বোঝার একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষা যখন শ্রীরঘুনাথ আনন্দের সাথে গ্রহণ করলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই গুরু শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর অসীম কৃপা বর্ষণ হতে লাগল। 

Read-More_4

আরও পড়ুন: শ্রীকৃষ্ণের ৬৪ গুণ (64 Qualities of Krishna)✸রাধারানীর ২৫ গুণ (25 Qualities of RadhaRani)

x


Like it? Share with your friends!

190
159 shares, 190 points
daextlwcn_print_scripts(true);

Thanks for your interest joining to Bangla Kobita Club community.

Something went wrong.

Subscribe to Join Our Community List

Community grow with You. [Verify and Confirm your Email]