Join to Our Community
Community Grows With You

Radhastami 2023 || রাধাষ্টমী তিথি ও রাধাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম্য

রাধা অষ্টমী হল শ্রীমতি রাধারানীর আবির্ভাব তিথি। শ্রীমতি রাধারানী হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী (আনন্দদায়িনী) শক্তি। তিনি নিত্যকাল ধরে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধান করেন। তিনি ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রে, দিনের অর্দ্ধভাগে অভিজিৎ মূহুর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন বার্ষনার রাভেল গ্রামে। তাই এই ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী মহাপবিত্র তিথিকে রাধাষ্টমী তিথি বলা হয়।  ━━ (পদ্মপুরাণ)

ভগবান সর্বশক্তিমান আর রাধারানী হলেন ভগবানের শক্তি। রাধারানী এবং কৃষ্ণ অভিন্ন, কিন্তু তারা মাধূর্য্য ভক্তি আস্বাদনের জন্য দুই দেহ ধারণ করেছেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে আনন্দ প্রদানের জন্য শরীরের বাম অংশ থেকে শ্রীমতি রাধারানীকে সৃষ্টি করেছেন এবং আরও অধিকভাবে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধানের জন্য রাধারাণী নিজের অঙ্গ থেকে অসংখ্য গোপিকাদের প্রকাশ করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে সমস্ত গোপীদের, দ্বারকার রাণীদের এবং বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীগণের উৎস।  

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বশক্তিমান এবং সর্বাকর্ষক কিন্তু রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণকেও আকর্ষিত করে।

শ্রীকৃষ্ণ কামদেবকে আকর্ষন করে বলে তার নাম মদনমোহন, তেমনিভাবে রাধারানী শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষন করে বলে তার নাম মদনমোহনমোহিনী

রাধা শব্দের অর্থ কি?

➡️ সংস্কৃত শব্দ রাধা (সংস্কৃত: राधा) অর্থ “সমৃদ্ধি, সাফল্য, পরিপূর্ণতা ও সম্পদ”।

➡️ যেহেতু রাধারানী দিব্যলীলাপীঠ গোলোক বৃন্দাবন ধামে রাসমন্ডল নামে একটি অপ্রাকৃত স্থানে আবির্ভূত হন এবং তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হয়েই শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা ও পুষ্পচয়ন করবেন বলে উদ্যানের দিকে ধাবমান হলেন। তাই তাঁর নাম হল “রাধা”। কারণ, ‘রা’ অর্থে ‘আরাধিকা’ আর ‘ধা’ অর্থে ‘ধাবমানা’।

➡️ রাধা নামের আরেকটি অর্থ হল:  ‘রা — শব্দটা রমন শব্দ থেকে এসেছে। রমন শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ বর্ধনকারী। ‘ধা’ — শব্দটা ধারন থেকে। রাধার অর্থ আনন্দকে ধারন করা। যিনি আনন্দকে ধারন করে থাকেন তিনিই “রাধা”

 এখানে আনন্দ টা কে  ?

এখানে আনন্দ টা হল শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম সচ্চিদানন্দ। সৎ, চিৎ, আনন্দ। আনন্দ স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকে যিনি মনের মধ্যে ধারন করে আছেন তিনিই “রাধা”।।

শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন যে, ভক্তি শ্রীকৃষ্ণকে পর্যন্ত আকর্ষণ করে। (পূর্ব ১/৪১) শ্রীকৃষ্ণ সকলকে আকর্ষণ করেন, কিন্তু ভক্তি শ্রীকৃষ্ণকেও আকর্ষণ করে। ভক্তির চরম প্রতীক হচ্ছে শ্রীমতী রাধারাণী। শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় মদনমোহন, অর্থাৎ তাঁর রূপ এতই মনোহর যে, তা কোটি কোটি কন্দর্পকেও মোহিত করে। কিন্তু শ্রীমতী রাধারাণীর রূপ এতই চিত্তাকর্ষক যে, তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পর্যন্ত আকর্ষণ করেন। তাই ভক্তরা তাঁকে মদনমোহনমোহিনী বলে সম্বোধন করেন।

ভগবদ্ভক্তি আচরণ করার অর্থ হচ্ছে শ্রীমতী রাধারাণীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভগবানের সেবা করা। তাই বৃন্দাবনের ভক্তরা শ্রীমতী রাধারাণীর আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাতে তাঁদের ভক্তি স্বার্থক হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভক্তি কোন জড়-জাগতিক কর্ম নয়: তা সরাসরিভাবে রাধারাণীর পরিচালনাধীন। ভগবদ্‌গীতায় প্রতিপন্ন হয়ছে যে, যাঁরা মহাত্মা তাঁরা সরাসরিভাবে দৈবী প্রকৃতি অর্থাৎ ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি শ্রীমতী রাধারাণীর আশ্রিত। সুতরাং সরাসরিভাবে ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তির পরিচালনাধীন হওয়ার ফলে, ভগবদ্ভক্তি শ্রীকৃষ্ণকে পর্যন্ত আকর্ষণ করে।

হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে, রাধারানীর জন্মদিন কৃষ্ণের জন্মের ১৫ দিন পরে পালিত হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, রাধা ছাড়া কৃষ্ণের পূজা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এমতাবস্থায়, কোন ভক্ত যদি কৃষ্ণের জন্মদিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করে থাকেন, তবে সেই ভক্তকে অবশ্যই রাধা অষ্টমীর দিন রাধারাণীর পূজা করতে হবে, কারণ রাধারাণীর আরাধনা করলে কৃষ্ণ প্রসন্ন হন এবং তাঁর ভক্তদের ভগবদ্ভক্তি লাভ হয়।

রাধাকে বৃষভানু নন্দিনী বলা হয় । বৃষভানু শব্দের অর্থ কি?

“বৃষ” অর্থ বিষাদ কে বুঝানো হয়েছে। “ভানু” অর্থ ভঙ্গ কে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং “বৃষভানু” অর্থ যার মন থেকে বিষাদ ভঙ্গ হয়েছে। মানুষের মধ্যে মনের বিষাদ ভঙ্গ হওয়ার পরেই ত মনে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তার সেই আনন্দটাকে মনে ধারন করাটাই হচ্ছে “রাধা”। অর্থাৎ বিষাদ ভঙ্গ হওয়ার পরে সে বিষাদের জায়গায় মনে যে আনন্দের আগমন হয় সে আনন্দটাকে ধারন করাটাই হচ্ছে “রাধা”।


রাধাষ্টমী তিথি ✤

(Radhastami Tithi)

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

ভাদ্রে মাসি সিতে পক্ষে অষ্টমীসংজ্ঞিকে তিথৌ।
বৃষভানোর্যজ্ঞভুমৌ জাতা সা রাধিকা দিবা॥

◼️ অনুবাদ: ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে, মহারাজ বৃষভানুর গৃহে শ্রীমতি রাধারানী নিজেকে প্রকাশিতা করেছিলেন। তাই এই ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী মহাপবিত্র তিথিকে শ্রীরাধাষ্টমী তিথি বলা হয়।  ━━ (পদ্মপুরাণ)

শ্রীমতি রাধারানী ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রে, দিনের অর্দ্ধভাগে অভিজিৎ মূহুর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন বার্ষনার রাভেল গ্রামে।

রাধাষ্টমী মুহূর্ত শুরু                – শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দুপুর ১:৩০ টায়

রাধাষ্টমী মুহূর্ত শেষ               – শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দুপুর ১২:২০ টায়

রাধাষ্টমী ব্রত                           – শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ (৫ই আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ)

 

রাধাষ্টমী সংকল্প মন্ত্র              

❝ভাদ্র মাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমা তিথৌ ________ গোত্র  
_________ দেবশর্ম্মা রাধাষ্টমী  ব্রতং অহম করিস্যে। ❞

‌বিঃ দ্রঃউপরের দুটি শূন্যস্থানের প্রথমটিতে নিজের গোত্র ও দ্বিতীয়টিতে নিজের নাম বলতে হবে। 

 

রাধাষ্টমী পারণ           – পরদিন সকাল অর্থাৎ রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

🌏 পশ্চিমবঙ্গ:- ৫:২৯মিঃ-৫:৫২মিঃ

🌏 বাংলাদেশ:– ৫:৫৯মিঃ-৬:২২মিঃ

🌏 মথুরা:– ৬:১২মিঃ-৯:৩০মিঃ

রাধাষ্টমী পারণ মন্ত্র                                   

✦ পারণ আরম্ভের মন্ত্র ✦

❝সর্বায় সর্বেশ্বরায় সর্বপতয়ে সর্বসম্ভবায়
গোবিন্দায় রাধেজীকো নমো নমঃ। ❞ ‌

পারণ শেষে মন্ত্র

❝ভূতায় ভূতেশ্বরায় ভূতপতয়ে ভূতসম্ভবায়
গোবিন্দায় রাধেজীকো নমো নমঃ। ❞ ‌

 

শ্রীরাধারাণীর গায়ত্রী মন্ত্র                                

❝ওঁ বৃষভানুজায়ৈ বিদ্মহে কৃষ্ণপ্রিয়ায়ৈ
ধীমহি তন্নো রাধা প্রচোদয়াৎ। ❞ ‌

 

শ্রীকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র             

প্রণাম মন্ত্র – ১                   

❝হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে।
গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমহস্তুতে ॥❞ ‌

প্রণাম মন্ত্র – ২ ✦      

❝ওঁ নম ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমঃ নমঃ ॥ ❞ ‌

 

শ্রীরাধারাণীর প্রণাম মন্ত্র                                

প্রণাম মন্ত্র – ১

❝তপ্তকাঞ্চন গৌরাঙ্গি রাধে বৃন্দাবনেশ্বরী।
বৃষভানুসুতে দেবী প্রণমামি হরিপ্রিয়ে॥ ❞ ‌

প্রণাম মন্ত্র – ২

❝রাধাং রাসেশ্বরীং রম্যাং গোবিন্দ-মোহিনীং পরাং।
বৃষভানু-সুতাং দেবীং নমামি শ্রীহরি-প্রিয়াং॥
মহাভাব-স্বরূপা ত্বাং কৃষ্ণপ্রিয়া-বরীয়সী।
প্রেমভক্তি-প্রদে! দেবী! রাধিকে! ত্বাং নমাম্যহং ॥ ❞ ‌

প্রণাম মন্ত্র – ৩

❝রাধাং রাসেশ্বরীং রম্যাং স্বর্ণ-কুণ্ডল-মণ্ডিতাম্ ।
বৃষভানুসুতাং দেবীং তাং নমামি হরিপ্রিয়াম্॥ ❞ ‌

প্রণাম মন্ত্র – ৪

❝নবীনাং হেমগৌরাঙ্গীং পূর্ণানন্দবতিং সতীম্।
বৃষভানুসুতাং দেবীং বন্দে রাধাং জগৎপ্রসূম্॥ ❞ ‌

 

শ্রীরাধারাণীর ধ্যান মন্ত্র                                      

❝ওঁ অমল কমল কান্তিং নীলবস্ত্রাং সুকেশীং।
শশধর সমবক্তাং খঞ্জনাক্ষিং মনোজ্ঞাং ॥
স্তনযুগ গজমুক্তাদাম দীপ্তাং কিশোরীং।
ব্রজপতি সুতকাত্তাং রাধিকামাশ্রয়েহহম্ ॥ ❞ ‌

 

শ্রীরাধারাণীর  বন্দনা                                      

❝নমস্ত্রৈলোক্যজননি প্রসীদ করুণার্ণবে।
ব্রহ্মবিষ্ণবাদিভির্দেবৈর্বন্ধমান পদম্বুজে॥ ❞ ‌

অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি দেবতা দ্বারা বন্দিত চরণকমলের হে ত্রৈলোক্যজননী! আপনাকে প্রনাম। হে করুণার্ণবে! আপনি আমার ওপর প্রসন্ন হন।

 

শ্রীরাধারাণীর স্তুতি                                       

❝নমস্তে পরমেশানি রাসমণ্ডলবাসিনী ।
রাসেশ্বরি নমস্তেস্তু কৃষ্ণ প্রাণাধিকপ্রিয়ে॥ ❞ ‌

অর্থাৎ রাসমণ্ডলে বসবাসকারী পরমেশ্বরী, আপনাকে প্রনাম। শ্রী কৃষ্ণের প্রাণাধিক প্রয় হে রাসেশ্বরী, আপনাকে প্রনাম।


✤ রাধাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম্য

(Significance of Radhastami Vrat)

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

————————————————–
❖❖  রাধাষ্টমী ব্রতের ফল ❖❖
————————————————–

রাধাষ্টমী ব্রত প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক।রাধাষ্টমীর বিশেষ মাহাত্ম্য সম্পর্কে পদ্মপুরাণের ব্রহ্মকান্ডের ৭ম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে:

➡️ ১। কোটিজন্মাৰ্জ্জিতং পাপং ব্রহ্মহত্যাদিকং মহৎ।
            কুৰ্ব্বন্তি যে সকৃদ্ভক্ত্যা তেষাং নশ্যতি তৎক্ষনাৎ

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড, ৭/৭)

◼️অনুবাদ: যে সকল মানুষ ভক্তিভরে একবার মাত্র এই মহাপবিত্র শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত পালন করে থাকেন, সেই সকল মানুষের কোটি জন্মের ব্রহ্মহত্যাদি সমস্ত মহাপাপ তৎক্ষনাৎ বিনাশ হয়ে যায়।

➡️ ২। ❝একাদশ্যাঃ সহস্রেন যৎ ফলং লভতে নরঃ।
            রাধাজন্মাষ্টমী পুণ্যং তস্মাং শত গুণাধিকম্ ॥ ❞

     ━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড, ৭/৮)

◼️অনুবাদ: ১ হাজার একাদশী ব্রত পালন করলে যে ফল লাভ করে থাকেন, রাধাষ্টমী ব্রত পালনে তার ১০০ গুণ অধিক ফল লাভ হয়ে থাকে।

➡️ ৩।   ❝মেরুতুল্যসুবর্ণানি দত্বা যৎ ফলমাপ্যতে ।
              সকৃদাধাষ্টমী’ ক্বত্বা তস্মাচ্ছতগুণাধিকম্ ॥ ❞

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড, ৭/৯)

◼️অনুবাদ: পর্বত সমান (মেরুপ্রমাণ) সোনা দান করলে যে ফল লাভ হয়, তার ১০০ গুণ অধিক ফল লাভ হয়, রাধাষ্টমী ব্রত পালনে।

➡️ ৪। ❝কন্যাদানসহস্রেণ যৎপুণ্যং প্রাপ্যতে জনৈঃ ।
          বৃষভানুসুতাষ্টম্যা তৎফলং প্রাপ্যতে জনৈঃ ॥ ❞ 

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড, ৭/১০)

◼️অনুবাদ: একবার রাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে সহস্র (অর্থাৎ এক হাজার) কন্যাদানের ফল লাভ হয়।

➡️ ৫। ❝গঙ্গাদিষু চ তীর্থেষু স্নাত্বা তু যৎফলং লভেৎ
           কৃষ্ণপ্রাণপ্রিয়াষ্টম্যাঃ ফলং প্রাপ্নোতি মানবঃ ॥ ❞

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড, ৭/১১)

◼️অনুবাদ: একবার রাধাষ্টমী ব্রত পালনে গঙ্গা আদি সকল তীর্থের ফল লাভ হয়।

➡️ ৬। ❝এতদ্‌ব্রতন্ত যঃ পাপী হেলয়াশ্রদ্ধায়াপি বা ।
            করোতি বিষ্ণুসদনং গচ্ছৈৎ কোটিকুলান্নিতঃ ॥ ❞

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখন্ড,৭/১২)

◼️অনুবাদ: যদি কোন পাপী ব্যক্তি অশ্রদ্ধায় বা অবহেলাতেও রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে তাহলে সে ও তার কোটি কূলসহ বিষ্ণুলোকে (বৈকুণ্ঠলোকে) নিত্যকাল বিরাজ করে।

পদ্মপুরাণের স্বর্গখন্ডের চল্লিশতম অধ্যায়ে এমনই এক কাহিনী বর্ণিত রয়েছে ।

অতীতে সত্যযুগে লীলাবতী নামে এক পতিতা বাস করতেন । একদিন সকালে নগর ভ্রমনকালে এক সুসজ্জিত মন্দিরে রাধারানীর পূজা উদযাপন দেখতে পেয়ে ব্রতীদের কাছে ঐ পতিতা ছুটে গেলেন। আগ্রহের সাথে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে সকল পূণ্যাত্মা! তোমরা এত সকাল সকাল অতি যত্ন সহকারে কোন ব্রত উদযাপন করছ ?”

প্রত্যুত্তরে রাধাব্রতীগণ বললেন “যেহেতু ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীমতি রাধিকা আবির্ভূত হয়েছিলেন, আমরা সেই রাধাষ্টমী ব্রত পালন করছি। এই অষ্টমীব্রত গোহত্যা জনিত পাপ, ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ অথবা স্ত্রী হত্যা জনিত পাপ সহ সকল পাপই নাশ করতে সক্ষম।”

তাদের কাছ থেকে রাধাষ্টমীর মহিমা শ্রবণ করে সেই পতিতাও স্বেচ্ছায় ব্রত পালনে সংকল্প বদ্ধ হলেন এবং ভক্তগণের সহিত যথাযথভাবে ব্রত পালন করলেন। পরদিন সর্পদংশনে সেই পতিতার মৃত্যু হল। ক্রোধে রাগান্বিত যমদূতেরা তাকে বেঁধে সাথে নিয়ে যমালয়ের দিকে যাত্রা শুরু করলেন ।

পথিমধ্যে শঙ্খ, চক্র, গদ, পদ্মধারী ভগবান বিষ্ণুর দূতগণ উপস্থিত হয়ে লীলাবতীর সকল বাঁধন ছিন্ন করে দিলেন এবং তাকে সঙ্গে করে রাজহংসযুক্ত দিব্য বিমানে বৈকুণ্ঠলোকে গমন করলেন। এই ভাবে অধঃপতিত বেশ্যাও কেবল মাত্র রাধাষ্টমী পালন করার ফলে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি বৈকুণ্ঠ ধামে গমন করলেন।

➡️ ৭।  রাধাব্রতিন উঁচুঃ
           ভাদ্রে মাসি সিতাষ্টম্যাং জাতা শ্রীরাধিকা যতঃ
          অষ্টমী সাদ্য সম্প্রাপ্তা তাং কুর্ব্বাম প্রযত্নতঃ ।
          গোঘাতজনিত‍ পাপং স্তেয়জং ব্ৰহ্মঘাতজন
          পরস্ত্রীহরণাচ্চৈব তথা চ গুরুতল্পজম্ ।
           বিশ্বাসঘাতঞ্জঞ্চৈব স্ত্রীহত্যাজনিতং তথা ।
           এতানি নাশয়ত্যাশু কৃতা যা চাষ্টমী নৃণাম্।। 

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখন্ড, ৭/২২-২৪)

◼️অনুবাদ: রাধাব্রতিগণ কহিলেন, “ভাদ্র মাসে শুক্লাষ্টমীতে শ্রীরাধিকা জন্মগ্রহণ করেন। অদ্য সেই অষ্টমী তিথি উপস্থিত। তাই সাদরে আমরা সেই অষ্টমীব্রতের অনুষ্ঠান করিতেছি। এই অষ্টমীব্রত করিলে নরগণের গোহত্যা, ব্রহ্মহত্যা, স্তেয় (চুরী), পরস্ত্রী হরণ, গুরুস্ত্রীগমন, বিশ্বাসঘাতকতা ও স্ত্রীহত্যা জনিত পাপ বিনষ্ট হইয়া থাকে।”

————————————————–
❖❖ রাধাষ্টমী ব্রত পালন না করার শাস্তি ❖❖
————————————————–

➡️ ৮। রাধাষ্টমীব্রতং তাত যো ন কুৰ্য্যাচ্চমুঢ়ধীঃ।
            নরকান্নিস্কৃতির্নাস্তি কোটিকল্পশতৈরপি॥ ❞

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখন্ড,৭/৩১)

◼️অনুবাদ: হে তাত (পিতৃতুল্য ব্যক্তি)! যে সকল মুঢ়বুদ্ধি মানুষ রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে না, শতকোটি কল্পেও সেই সকল মানুষের নিষ্কৃতি ঘটবে না। ১০০ কোটি কল্প মানে (৮৬৪ কোটি বছর  x ১০০ কোটি)

➡️ ৯। স্ত্রিয়শ্চ যা ন কুৰ্ব্বন্তি ব্রতমেতচ্ছুভপ্রদম।
           রাধাবিষ্ণোঃ প্রীতিকরং সর্ব্বপাপপ্রণাশনম॥
           অন্তে যমপুরীং গত্বা পতন্তি নরকে চিরম্ ।
           কদাচিজ্জন্ম চাসাদ্য পৃথিব্যাং বিধবা ধ্রুবম ॥ ❞

━━┉┈┈(পদ্মপুরান, ব্রহ্মখন্ড,৭/৩২-৩৩)

◼️অনুবাদ: যে সকল নারী রাধাকৃষ্ণের প্রীতিকর, সর্বপাপহরনকারী, এই রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে না, তারা নরকে গমন করে এবং পৃথিবীতে জন্মের পরে বিধবা হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়।


✤ রাধাষ্টমী ব্রত পালনের নিয়ম

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─
শ্রীরাধার জন্ম মধ্যাহ্ন সময়ে হয়েছিল তাই উপবাস সময় দুপুর ১২ টা পর্যন্ত । রাধাষ্টমী এর আগের দিন সংযম বলা হয় । এবং সংযমের দিন সন্ধ্যায় সংকল্প ও রাধারানীর অধিবাস দিতে হয়, অধিবাসে বিভিন্ন মাঙ্গলিক দ্রব্য রাধারাণীকে দর্শন করাতে হয় (মাঙ্গলিক দ্রব্য যেমন পান, সুপারি, কলা পাতা, কলা, ঘট, ধান দূর্বা, আম পাতা, শাড়ি, গামছা, সুগন্ধি ফুল, ডাব ইত্যাদি)। 
তারপর ঘুমানোর আগে অবশ্যই ব্রাশ করে নিতে হবে যাতে করে, খাবারের কুচি মুখে লেগে না থাকে । এরপর রাধাষ্টমীর দিন ভোর ভোর শয্যা ত্যাগ করতে হয় । তারপর রাধারানী কে ভোগ দেওয়ার জন্য প্রসাদ নিবেদন করুন ।

✤ রাধাষ্টমী পুজো বিধি

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─
সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে ধোয়া পরিষ্কার পোশাক পরিহিত করবেন। এবার একটি চৌকিতে লাল বা হলুদ কাপড় পেতে তার উপরে শ্রী কৃষ্ণ এবং রাধার মূর্তিটি স্থাপন করবেন। সেই সঙ্গে পুজোর ঘটও স্থাপন করবেন।
পঞ্চামৃত দিয়ে রাধা ও কৃষ্ণকে অভিষেক করাবেন । এরপর দুজনকেই নতুন বস্ত্র পরিয়ে সাজিয়ে দেবেন। শ্রীরাধার পঞ্চ উপাচারের পুজা মন্ত্রের দ্বারা পূজা করতে হয়, যদি মন্ত্র না জানা থাকে তবে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র বলে সকল দ্রব্য নিবেদন করবেন।

🌸🌸 হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ,  কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।     

          হরে রাম হরে রাম,  রাম রাম হরে হরে।। 🌸🌸

পুজো করার সঙ্গে সঙ্গেই রাধা ও কৃষ্ণের পুজো করবেন। পদ্ম ফুল দিলে রাধারাণী অধিক প্রসন্ন হন। তারপর ফুল-ফল নৈবেদ্য, মিষ্টি সাজিয়ে নিবেদন করুন। অন্ন ভোগও দিতে পারেন । রাধারাণী প্রিয় ভোগ “দই আরবি” কচুর মুখী দিয়ে তৈরি করা হয় ।
শ্রীরাধারাণীর পঞ্চ উপচারে পূজা
◼️ গন্ধ            ━ এষ গন্ধ ওঁ রাধিকায়ৈ নমঃ
◼️ পুষ্প           ━ ইদং পুষ্পম্ ওঁ রাধিকায়ৈ নমঃ
◼️ ধূপ            ━ এষ ধূপঃ ওঁ রাধিকায়ৈ নমঃ
◼️ দীপ             ━ এষ দীপঃ ওঁ রাধিকায়ৈ নমঃ
◼️ নৈবেদ্য     ━ ইদং নৈবেদ্যং মিষ্টান্ন পানীয়াদীকং সবম ওঁ রাধিকায়ৈ নমঃ
রাধারাণী দুধের তৈরি দ্রব্যও অতি প্রিয়। বিভিন্ন রকমের দুধ দিয়ে তৈরি করে ভোগ নিবেদন করতে পারেন, এর পরে রাধারানীর উপরে শ্লোক ভজন গীত গেয়ে রাধারাণী কে সন্তুষ্ট করা হয়। প্রসাদ হিসাবে দুধের উপাদান দিলে ভালো হয় । প্রসাদ দেওয়ার পরে প্রসাদ এর উপরে অবশ্যই তুলসীপাতা রাখবেন ।
এরপর রাধা কৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র ৩ বার জপ করুন , তারপর রাধা কৃষ্ণের সুন্দর করে আরতি করুন ।
পুষ্পাঞ্জলি দেবেন রাধাকৃষ্ণর প্রণাম মন্ত্র ৩ বার বলতে বলতে।
পূজার শেষে অবশ্যই ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র বলে পূজা সমাপন করবেন। কারন পূজা করার সময় আমাদের দ্বারা অজান্তেই অনেক রকম ভুল ত্রুটি হয়ে যায় ।

 শ্রীকৃষ্ণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র                                    

❝নমো যদক্ষরং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্‌ ভবেৎ।
পূর্ণং ভবতু ত্বং সর্বং ত্বং প্রসাদাৎ জনার্দ্দন ॥
মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং ভক্তিহীনং জনার্দ্দন ।
যৎ পূজিতং ময়াদেব পরিপূর্ণং তদস্তুমে ॥❞ ‌


✤ রাধারাণীর কাছে  ভক্তের প্রার্থনা কেমন হওয়া উচিত?

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

ভাদ্র মাসি সিতে পক্ষে অষ্টমী যা তিথির্ভবেৎ।
তস্যাং বিশাখানক্ষত্রে দিনার্দ্ধেহভিজিতে ক্ষণে।।
ইত্থং শ্রীরাধিকাদেবী আবির্ভুতা ধরাতলে।
অস্যামেব তিথৌ রাধাং পূজয়িত্বা ময়া সহ।।
নানোপহারৈর্নৈ বেদ্যৈর্ব্বস্ত্রালঙ্কার-ভূষণৈঃ।
পরেহহ্নি পারণং কুর্য্যুর্ব্বৈষ্ণবৈঃ সহ বৈষ্ণবা।।
ইত্থং তে কথিতং বিপ্র পুণ্যং রাধাষ্টমীব্রতম্।
রাধিকা-প্রীতিজননং মৎপ্রসাদস্য কারণম্।।
রাধিকায়াং প্রসন্নায়াৎ সুতরাং মৎপ্রসন্নতা।।

     ━━┉┈┈(নারদং প্রতি শ্রীকৃষ্ণবাক্যম্)।

◼️অনুবাদ: ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষীয় অষ্টমী তিথিতে বিশাখানক্ষত্রে, দিবসের অর্দ্ধভাগে অভিজিৎক্ষণে শ্রীরাধিকাদেবী ধরাতলে আবির্ভুত হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারদকে বলেন, “ঐ দিনে বৈষ্ণবগণ বৈষ্ণবগণের সহিত বিবিধ উপহার, নৈবেদ্য ও বস্ত্রালঙ্কারাদি দ্বারা রাধিকার পূজা করিবে। তাহাতে রাধিকা অত্যন্ত প্রীত হন। রাধাকা প্রসন্ন হইলে আমিও অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া থাকি।”  –  ইতি ভবিষ্যপুরাণে নারদ প্রতি শ্রীকৃষ্ণ বাক্য। 

রাধাষ্টমীর দিন উপবাস থাকিয়া মধ্যাহ্নে পূজা উৎসবাদি পালন এবং পরের দিন পারণ করতে হয়। দুপুর পর্যন্ত উপবাস শাস্ত্র সম্মত নহে। তবে অসমর্থের জন্য দুপুর ১২ টায় অভিষেকের পর অনুকল্প প্রসাদ পাওয়া যাবে কিন্তু নিরাহার ব্রতই শ্রেষ্ঠ। যারা নিরাহার থাকতে পারবেন না, তাঁরা পঞ্চরবিশষ্য বর্জন করে একাদশীর ন্যায় ব্রত করতে পারবেন।

শ্রীরাধার জন্মজয়ন্তী রাধাষ্টমী  তিথিতে, রাধা এবং কৃষ্ণ উভয়ের পূজা করা হয়। বৃষভানুর কন্যা শ্রীরাধিকা, মাতা লক্ষীর রূপ। দ্বাপর যুগে শ্রীলক্ষী, রাধারানী রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাই শ্রীরাধা কৃষ্ণবল্লভা, তিনি হরিপ্রিয়া। যেমন লক্ষী–নারায়ণ তেমনই রাধা–কৃষ্ণ। রাধাষ্টমীতে ষোড়শোপচারে শ্রীরাধার পূজা করিলে ধন, সম্পদ, ঐশ্বর্য, বৈভব এবং সর্ব্ব সুখ প্রাপ্তি হয়। পূজান্তে জপ, ধ্যান, গায়ত্রী ও প্রণাম মন্ত্রে প্রণাম।

রাধাষ্টমীর ব্রত রেখে ভক্তরা রাধারাণীর কাছে প্রার্থনা করবেন ─ “শ্রীলক্ষ্মীদেবী বিশ্বের বন্দনীয় যুবতীগণ দ্বারা পূজিতা হলেও রূপ, নব যৌবনাদি সম্পত্তি, সৎ-স্বভাব ও মনােজ্ঞ লীলা বিষয়ে যে  শ্রীরাধিকার সমান নন এবং যে শ্রীরাধিকা অপেক্ষা জগতে অধিক গুণসম্পন্না কেউ নেই , সেই শ্রীরাধিকা আমাকে তাঁর শ্রীপাদপদ্মের দাস্য দান করুন।”

শ্রী রাধারানীর দাসত্ব গ্রহণ করার অর্থ হল শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ। তাই শ্রীকৃষ্ণের কৃপা পেতে হলে আপনাকে আগে রাধারাণীর কৃপা-আশির্বাদ লাভ করতে হবে। রাধারাণী পরম করুণাময়ী, কৃপামময়ী। তিনি সহজেই ভক্তকে কৃপা করেন, তিনি যাকে কৃপা করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দ্বিধায় তাকে কৃপা করেন, এর কোনও দ্বিমত নেই। ফলত সে ভগবদ্ধাম প্রাপ্তি  করেন।

বিশেষত এই কলিযুগে গোলকের প্রেমধন কিংবা কৃষ্ণকৃপা পেতে হলে আপনাকে অতি অবশ্যই শ্রীমতি রাধা ঠাকুরাণীর কৃপা লাভ করতে হবে, গুরুশ্রেষ্ঠ প্রভু বলরামদেব বা নিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা লাভ করতে হবে। রাধারাণীকে ডিঙিয়ে বা উপেক্ষা করে কৃষ্ণকে লাভ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ আপনার হাতে নেই, যা শাস্ত্রেও প্রতিপন্ন করা হয়েছে। আগে রাধারাণীর কৃপা, তারপর কৃষ্ণকৃপা, এটাই সিম্পল প্রসেসিং।

তাই সকলে রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে  ভগবানের অশেষ কৃপা লাভ করুন এবং আপনার প্রকৃত আলয় গোলকধামে ফিরে যান।


✤ রাধাষ্টমী

(Radhastami)

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

রাধাষ্টমী হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম সুখময় দিন। 

ভগবতমে্‌ বর্ণিত আছে যদি আমরা বৃক্ষের শিকড়ে জল সিঞ্চন করি তাহলে তা পূর্ণ বৃক্ষের ডাল, পাতা, পল্লব, ফুল সমস্তই পুষ্টি প্রাপ্ত হয়। তেমনই, শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত অস্তিত্বের — পার্থিব এবং অপার্থিব জগতের সমস্ত কিছুর উৎস। তিনি সর্ব কারণের কারণ এবং প্রত্যেকে ও সমস্ত কিছু তাঁর থেকেই আসছে। তাই যখন শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হন, আমরা তখন পরমার্থিক সন্তুষ্টির পরম পুষ্টি দেখতে পাই ৷

তাই কৃষ্ণকে সন্তুষ্টিকরণের মাধ্যমে আমরা শুধু নিজেরাই তৃপ্ত হই না, আমরা সমস্ত জগত সংসারকে সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারি এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে কোন্ পরমানন্দ নিয়ে আসে? তার প্রিয় রাধারাণীর আনন্দ। তাই আমাদের প্রেমভক্তি, সকৃতজ্ঞ চিত্ত এবং পূর্ণ আনন্দে শ্রীমতী রাধারাণীর পূজা করা উচিত বিশেষ করে রাধাষ্টমীর দিন।

শ্রীমতী রাধারাণীর আবির্ভাব

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীমতি রাধারাণীর জন্মলীলা সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাসের ইচ্ছার কারণে তাঁর বাম অঙ্গ থেকে হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারানী প্রকটিত হন।

◎◎ ❛রাধা কে?❜ ◎ ◎

দিব্যলীলাপীঠ গোলোক বৃন্দাবন ধামে রাসমন্ডল নামে একটি অপ্রাকৃত স্থান রয়েছে। রাসমন্ডলের এক দিকে শতশৃঙ্গ নামক একটি পর্বত বিরাজমান। এই শতশৃগ পর্বতই ভূলোকে গিরি গোবর্ধনরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বৃন্দাবনে মালতী ও মল্লিকা ফুলের একটি অত্যন্ত মনোহর পুষ্পোদ্যান বিদ্যমান । যার ইচ্ছামাত্রে সব কিছু সংঘটিত হয়, সেই জগৎপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পুষ্পোদ্যানে অতীব সুন্দর রত্ন-সিংহাসনে একা বসে আছেন। তখন তাঁর হৃদয়ে লীলাবিলাস উপভোগের অভিলাষ উদিত হওয়া মাত্রই তাঁর বাম অঙ্গ থেকে হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারানী প্রকটিত হন। লীলা কাকে বলে? ভগবানের আনন্দময় উচ্ছ্বাসের নাম লীলা। ভক্ত ও ভগবানের মিলন বৈচিত্রের নাম লীলা।

শ্রীমতি রাধিকাই হচ্ছে আদি শক্তি। কোটি চন্দ্রের স্নিগ্ধতা তাঁর সর্বাঙ্গে। তাঁর গাত্রবর্ণ তপ্ত গলিত স্বর্ণের থেকেও অধিক উজ্জ্বল। শরতের শত পদ্মের সুষমাকেও পরাজিত করে এমন মুখসৌষ্ঠব, অতুলনীয়া অঙ্গসৌন্দর্য তাঁর। তাঁর সমগ্র অঙ্গসৌষ্ঠব নানা রকম রত্ন অলংকারে বিভূষিতা। তাঁর স্মিতহাস্য বিভাসিত মুখে মুক্তাধবল মনোহর দাঁতের শোভা বিকশিত।

পীতবর্ণা রত্ন ঘটা, জিনিয়া জানুর ছটা,

যেই হরে তাঁর গর্ব মান।

শরতের পদ্ম যিনি, শ্রীচরণ দুইখানি,

নূপুরের ধ্বনি যার গান ॥

কোটি পূর্ণিমার চান্দ, জিনিয়া নখের ছান্দ,

ঝলমল কিরণ যাহার।

সাত্ত্বিকাদি ভাবগণ, আকুল তাহার মন,

তাতে হয় বিগ্রহ যাহার ॥

যার কটাক্ষ কামশরে, কৃষ্ণে উন্মাদিত করে,

মনাব্ধির তরঙ্গ বাঢ়ায়।

হেন বৃন্দাবনেশ্বরী, তাঁরে বঁন্দো কর যুড়ি,

কৃষ্ণ প্রিয়াগণানন্দ তায় ॥

মহাভাব মাধুরী, যাঁহাতে উদয় করি,

বিহ্বল করয়ে অতিশয়।

অশেষ নায়িকার গুণ, তাঁতে হয় প্রকটন,

অপরূপ চরিত্র আশয় ॥

                               ━━┉┈┈ (শ্রীভাষাচাটু পুষ্পাঞ্জলি)

যেহেতু রাধারানী  রাসমন্ডলে আবির্ভূত হন এবং তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হয়েই শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা ও পুষ্পচয়ন করবেন বলে উদ্যানের দিকে ধাবমান হলেন। তাই তাঁর নাম হল “রাধা”। কারণ, ‘রা’ অর্থে ‘আরাধিকা’ আর ‘ধা’ অর্থে ‘ধাবমানা’।

রাধা নামের আরেকটি অর্থ হল — রা — শব্দটা রমন শব্দ থেকে এসেছে। রমন শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ বর্ধনকারী। ধা — শব্দটা ধারন থেকে। রাধার অর্থ আনন্দকে ধারন করা। যিনি আনন্দকে ধারন করে থাকেন তিনিই “রাধা”

সংস্কৃত শব্দ রাধা (राधा) অর্থ “সমৃদ্ধি, সাফল্য, পরিপূর্ণতা ও সম্পদ”।

আরও অধিকভাবে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধানের জন্য রাধারাণী নিজের অঙ্গ থেকে অসংখ্য গোপিকাদের প্রকাশ করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে সমস্ত গোপীদের, দ্বারকার রাণীদের এবং বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীগণের উৎস।  

এই যে ভগবান এক দেহ থেকে দুই দেহ হলেন, শ্রীল জীব গোস্বামীপাদ এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করলেন ‘চাণক্যবৎ’ বলে। অর্থাৎ মটরের মত। যেমন একটি মটরদানাকে ভিজিয়ে রাখলে সেটি ফুলে যায়। তারপর হাতের সামান্য চাপে তা থেকে দুটি অর্ধাংশ বেড়িয়ে আসে। দুটি অংশই কিন্তু সমান। অথচ শুকনো অবস্থায় বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে ভিতরে দুটি সমান অর্ধাংশ আছে। ঠিক তেমন “রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব”। কোনো ভেদ নেই তাঁদের মধ্যে। এক আত্মা, দুই দেহ তাঁরা।

❝রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা, দুই দেহ ধরি’।
অন্যোন্যে বিলসে রস আস্বাদন করি ॥ ❞ ‌

                  ━━┉┈┈(চৈ. চ. আদি ৪/৫৬)

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিশক্তি হলেন শ্রীমতী রাধারাণী। শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কিছু পার্থক্য নেই, তাঁরা এক এবং অভিন্ন। কিন্তু তাঁরা দুটি পৃথক দেহ ধারণ করে পরস্পরের প্রেম রস (লীলারস) আস্বাদন করেন। এই চিন্ময়, শাশ্বত এবং অপ্রাকৃতি মূর্তি সাধারণ মানুষের নিকট বোধগম্যের অতীত। এই পরম তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে হলে অবশ্য করেই একনিষ্ঠ পারমার্থিক উপলব্ধি প্রয়োজন। অভিন্ন পরমেশ্বর ভগবান দুইরূপে আনন্দ রস আস্বাদন করেন।

পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিমান পুরুষ। যেহেতু কৃষ্ণ শক্তিমান পুরুষ , তাই তাঁর থেকে অনন্ত শক্তি প্রকাশিত হয়েছে, যেমন – সৃষ্টিশক্তি, লীলাশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জীবশক্তি, মায়াশক্তি, বৈকুণ্ঠে ভূ, শ্রী যোগমায়া আদি ষোড়শ শক্তি, তা ছাড়া অন্তরঙ্গা শক্তি ইত্যাদি। চিন্ময় জগত গোলোকের সমস্ত কার্যকলাপ শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়।

এই অন্তরঙ্গা শক্তি তিন ভাগে বিভক্ত — সন্ধিনী, সম্বিৎ ও হ্লাদিনী।

সন্ধিনী শক্তির সাহায্যে সমস্ত চিৎ-জগৎ প্রকাশিত হয়েছে।

সম্বিৎ শক্তি বা জ্ঞান শক্তির দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে জানতে পারেন কৃষ্ণভক্তেরা এই শক্তির সাহায্যে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন।

আর হ্লাদিনী শক্তির দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ দিব্য আনন্দ আস্বাদন করেন এবং ভক্তরা এই হ্লাদিনী শক্তির কৃপায় কৃষ্ণপ্রেমের সমুদ্রে অবগাহন করেন। এই হ্লাদিনী শক্তির প্রতিমূর্তি হচ্ছেন শ্রীমতি রাধারানী।  তিনি নিত্যকাল ধরে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধান করেন।

এই সমস্ত ব্রজাঙ্গনারা রূপে-গুণে সর্বোত্তমা ছিলেন। সুতরাং শ্রীমতি রাধারাণী ও তাঁর কায়ব্যুহ (কায়=শরীর; ব্যুহ=বিভক্ত করা) গোপিকাদের মায়াবদ্ধ জীবদের মতো জন্মগ্রহণ করতে হয়নি। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ। তাঁরা গোলোকে শাশ্বতকাল ধরে অবস্থান করছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীলা বিলাস করে কৃষ্ণপ্রেম আস্বাধন করছেন। ব্রহ্মার দিবসের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন ভৌম বৃন্দাবনে বা এই জড় জগতের মধ্যে প্রকাশিত বৃন্দাবনে অবতরণ করেন, তখন তাঁর লীলায় অংশ গ্রহণ করবার জন্য তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারানী ও তাঁর কায়ব্যুহ সখীরা যদিও তাঁদের শাশ্বত চিন্ময় রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন, তবুও আমাদের দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা যেন জন্মলীলা প্রকট করেছেন।

যেহেতু আমরা মায়াবদ্ধ জীব, তাই আমাদের কৃপা করবার জন্য তাঁরা আমাদের মতো জন্মলীলা পরিগ্রহ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের জন্ম ও কর্ম সবই দিব্য বা অপ্রাকৃত। তবে সাধারণ মানুষেরা এ তত্ত্ব না জেনে শ্রীমতী রাধারাণীকে একজন সাধারণ নারী বলে জ্ঞান করেন। কারণ কামে বশবর্তী হয়ে তারা এ জগতে সমস্ত বস্তুকে কামময় দৃষ্টিতে দর্শন করেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধারাণীর সমস্ত লীলা হচ্ছে প্রেমময়। এ জগতে প্রেমের লেশমাত্র গন্ধ নেই। এটি কামময় জগত। কাম ও প্রেমের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ।

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-বাঞ্ছা —-তারে বলি, ‘কাম’।

কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা ধরে ‘প্রেম’ নাম।।

        ━━┉┈┈ ( চৈ. চ. আ. ৪/১৬৫)

অর্থাৎ “নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনাকে বলা হয় কাম, আর শ্রীকৃষ্ণের ইন্দ্রিয়ের প্রীতিসাধনের ইচ্ছাকে বলা হয় প্রেম।” শ্রীমতী রাধারাণীর অন্য একটি নাম ‘ক্যাচিৎ’, অর্থাৎ যিনি শ্রীকৃষ্ণকে অখণ্ড সুখ প্রদান করেন। ‘সর্বত্যাগ করি’ করে কৃষ্ণের ভজন।’ দেহ ধৰ্ম, বেদধর্ম, লোকধর্ম সব ত্যাগ করে কৃষ্ণের সেবা করেছিলেন। তবে এ তত্ত্ব সম্বন্ধে সকলে অবগত নন।

বিভিন্ন শাস্ত্র হতে শ্রীমতী রাধারাণীর বিভিন্ন জন্মলীলা

পৃথিবীতে শ্রীমতী রাধারাণীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে বিভিন্ন শান্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দেখা যায়। এর একটি কারণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কল্পে বিভিন্ন রকমের আবির্ভাব ঘটেছে।

১) গর্গ মুনির কন্যা গার্গীকে পৌর্ণমাসী দেবী শ্রীমতী রাধারাণীর যে আবির্ভাব-তত্ব বলেছিলেন, শ্রীল রূপ গোস্বামী নারদ তার ‘ললিত মাধব’ গ্রন্থে তা বর্ণনা করেছেন। এই আবির্ভাব সম্বন্ধে পৌর্ণমাসী বিশদভাবে অবগত ছিলেন, কেননা তিনি ভগবানের সকল লীলাবিলাসের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করেন। তিনি এই তথ্য কেবল যশোদা মাতা ও রোহিণী দেবীকে জানিয়েছিলেন ।

প্রথমটি হলো বিন্ধ্য পর্বত এবং হিমালয় পর্বতের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা এবং বিন্ধ পর্বতের কঠোর তপস্যা এবং ফল স্বরূপ রাধারানীকে কন্যা রূপে লাভ করেন।

 ❛রাধাষ্টমী ইতিহাস -১❜ 

━━━━━━◆❃◆━━━━━━

বিন্ধ্য পর্বত বিশালায়াতন হিমালয় পর্বতকে ঈর্ষা করত কারণ হিমালয় পার্বতীকে তার কন্যা হিসাবে পাওয়ায় জন্যই মহাদেব শিবকে জামাতা হিসাবে লাভ করার সুযোগ পেয়েছিল । তাই বিন্ধ্য পর্বত এমন একজন সৌভাগ্যবতী কন্যাকে লাভ করতে চেয়েছিল, যার স্বামী মহাদেবকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবে, যার ফলে তিনি রাজেন্দ্র রোজাধিরাজ) পদ লাভ করতে পারবে।

এরপর তিনি তার অভিলাষ পূরণের সংকল্প নিয়ে ব্রহ্মাকে সন্তষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। কিছু কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর ব্রহ্মা তার কাছে আবির্ভূত হয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন। বর হিসাবে তিনি তার অভিলাষ প্রার্থনা করেন এবং ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে বর প্রদান করেন। কিন্তু বরদানের পর ব্রহ্মা চিন্তা করতে লাগলেন, “এমন কোন ব্যক্তি আছেন যিনি মহাদেবকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেন? এটি অসম্ভব …।” কিন্ত বর তিনি ইতিমধ্যেই অনুমোদন করেছেন, সেজন্য তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

তারপর তিনি উপলদ্ধি করলেন যে ভূলোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা সংঘটিত করার সময় হয়ে এসেছে, কেবল তিনিই মহাদেবকে রণে পরাভূত করতে পারেন। ব্রহ্মা ভাবলেন, “কৃষ্ণের নিত্য লীলাসঙ্গিনী হচ্ছেন শ্রীমতী রাধারাণী। যদি বিন্ধ্যপর্বত রাধারাণীকে তার কন্যা হিসেবে লাভ করতে পারে, তাহলেই কেবল আমার বর ফলপ্রসূ হতে পারে । কিন্ত কেমন করে সেটা সম্ভব?

তার বর কিভাবে ফলপ্রসূ করা যায়, তা নিয়ে চিন্তান্তিত হয়ে ব্রহ্মাজী শ্রীমতী রাধারাণীকে পরিতুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। যখন রাধারাণী তার প্রতি প্রীত হলেন, তখন ব্রহ্মা তাঁকে অনুরোধ করেন বিন্ধ্য পর্বতের কন্যারপে আবির্ভূত হওয়ার জন্য। রাধারাণী সম্মত হলেন, এবং তখন যোগমায়া দেবী ইতিমধ্যেই রাজা বৃষভানুচন্দ্রভানুর স্ত্রী-দ্বয়ের গর্ভে থাকা রাধারাণী চন্দ্রাবলীকে আকর্ষণ করে বিন্ধ্য পর্বতের স্ত্রীর গর্ভে স্থানান্তরিত করলেন। এর ফলে বিন্ধ্যের দুই স্ত্রী দুটি পরমা সুন্দরী কন্যার জন্মাদান করলেন।

ইতিমধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভগবানের আদেশে বসুদেব শিশুপুত্র কৃষ্ণকে গোকুলে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে যশোদার কাছে রাখলেন, যিনি ইতিমধ্যেই একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দান করেছিলেন। বসুদেব কৃষ্ণকে সেখানে রেখে পরিবর্তে ভগবৎ আজ্ঞানুসারে যশোদার কন্যাটিকে নিলেন এবং তাঁকে নিয়ে মথুরার কারাগারে ফিরে এলেন, যেখানে তাকে ও দেবকীকে কংস বন্দী করে রেখেছিল।

বিন্ধ্য পর্বতের স্ত্রী দুই কন্যা সন্তানের জন্মদান করলে বিন্ধ্য পর্বত শিশুকন্যা দুটির জন্য সংস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। দুই কন্যাকে যজ্ঞস্থলে রেখে একজন ব্রাহ্মণ যজ্ঞানুষ্ঠান করছিলেন। গগনচারী পূতনা যজ্ঞস্থলে দুই রূপবতী কন্যাকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁদেরকে ভূীম থেকে তুলে নিয়ে আকাশ মার্গে উড়ে পালাতে লাগল। রাক্ষসী পূতনাই রাধাকে গােকুলে নিয়ে এসেছিল। বৃন্দাবনে যে-সমস্ত অসাধারণ কুমারীরা জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদেরকে অপহরণ করে নিয়ে আসার জন্য কংস পূতনাকে নিযুক্ত করেছিল, কারণ সে তাদের হত্যা করতে চেয়েছিল।

অসুর কংসের এই প্রবৃত্তি তীব্রভাবে জাগ্রত হয়েছিল কারণ দেবকীর কন্যা অষ্টভুজা মহামায়া কংসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, তাঁর থেকেও উত্তম মাধুর্যমণ্ডিতা অষ্ট মহাশক্তি— রাধা, চন্দ্রাবলী, ললিতা, বিশাখা, পদ্ম, শৈব্যা, শ্যামলা ভদ্রা যথা সময়ে পৃথিবীতে আবির্ভূতা হবেন। আবার এই অষ্ট মহাশক্তির মধ্যে দুটি ভগিনী বিশেষ গুণবতী বলে খ্যাতিলাভ করবেন এবং তাঁরা যুথেশ্বরী হবেন। এই দুই ভগিনীকে যিনি বিবাহ করবেন, তিনি রাজশ্রেষ্ঠা হবেন এবং যুদ্ধে মহাদেবকে পরাস্ত করতে পারবেন।

এতে বিন্ধ্যারাজ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রাহ্মণকে ঐ রাক্ষসীকে মন্ত্রোচারণ দ্বারা হত্যা করতে বললেন। রাজার আদেশে ব্রাহ্মণ মন্ত্রপাঠ করতে লাগলেন, যার ফলে আকাশচারী পুতনা ক্রমশঃ দুর্বলহয়ে পড়তে লাগল। দুই শিশুকন্যাকে ধরে রাখা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ল, এবং তাঁদের একজনকে সে নীচে নদীতে ফেলে দিল। ঐ নদী বিদর্ভ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিদর্ভরাজ ভীষ্মক এই কন্যাকে পেয়ে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে নিজের কাছে রাখলেন । সে সময় জাম্ববান বিন্ধ্য ও গোবর্দ্ধন পর্বতে বাস করছিলেন । বিন্ধ্যরাজের আদেশে জাম্ববান বিদর্ভে গিয়ে সেই কন্যাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। তিনি চন্দ্রাবলী নামে সুবিদিতা হলেন।

পুতনা যখন অপর কন্যাটিকে তাঁর বাহুলগ্না করে নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, মন্ত্র প্রভাবে সে ক্রমশঃ আর শক্তিহীন হয়ে পড়তে লাগল । ব্রজে পৌঁছানোর পর পুতনা আর চলতে না পেরে ভূমিতে পতিত হল। সেই সময় পৌর্ণমাসী দেবী পুতনার কাছ থেকে ঐ শিশু কন্যাকে নিয়ে মুখরার কাছে অর্পণ করে তাঁকে বললেন, “এই কন্যা তোমার জামাতা বৃষ্ণভানুর সন্তান, সুতরাং তুমি এঁর লালন-পালন করো।” এইভাবে সেইদিন হতে ঐ কন্যা বৃষভানু -কন্যা রাধা নামে সুবিদিতা হলেন ।

পৌর্ণমাসী পুতনার কাছ থেকে আরও পাঁচটি শিশু কন্যাকে উদ্ধার করেন। তাঁরা হচ্ছেন ললিতা, পদ্মা, ভদ্রা, শৈব্যা এবং শ্যামা । এইভাবে শ্রীমতী রাধারাণী ও চন্দ্রাবলী তাঁদেরনিত্যসহচরী সখীগণ সহ ভুলোকে আবির্ভূতা হলেন। নারদ মুনি এই সংবাদ পৌর্ণমাসীকে প্রদান করেছিলেন ।

 

২) দ্বিতীয়টি হলো সূর্যদেবের শ্রীমতি রাধারানীকে কন্যা রূপে লাভ করার জন্য ভগবান শ্রীহরির আরাধনা । ভগবান সূর্যদেবের প্রতি প্রসন্ন হয়ে তার অভিলাষ পুরণে সম্মত হন এবং ফলস্বরূপ রাধারানীকে কন্যা রূপে লাভ করেন।

 ❛রাধাষ্টমী ইতিহাস -২❜ 

━━━━━━◆❃◆━━━━━━

পদ্ম পুরানে রাধাষ্টমীর পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, বহু বহু কাল আগে সূর্যদেবকে পৃথিবী ভ্রমণ করতে এসে পৃথিবীর রূপ, সৌন্দর্য এবং অনাবিল আনন্দ দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং মন্দার পর্বতের গুহায় গভীর তপস্যায় মগ্ন হন।

এইভাবে অনেকদিন চলে যায়, সূর্যের অনুপস্থিতিতে পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পৃথিবীবাসী হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ।

সূর্যের আলো ছাড়া পৃথিবী কোনো ভাবেই বাঁচতে পারে না। তখন বাধ্য হয়ে ভীত – সন্ত্রস্ত স্বর্গের দেবতারা শ্রী হরির শরণাপন্ন হন সাহায্যের জন্য। শ্রী হরি অর্থাৎ শ্রীবিষ্ণু তাদের সকলকে আশা দিয়ে ফিরে যেতে বলেন। তারপর মন্দার পর্বতের গুহায় তপস্যারত সূর্যের সামনে গিয়ে তিনি উপস্থিত হন।

সূর্যদেব খুবই আনন্দিত হয়ে বলেন যে, শ্রী হরির দর্শন পেয়ে তার এতদিনের তপস্যা সার্থক হয়েছে। সূর্যদেবের সাধনায় তুষ্ট হয়ে শ্রী হরি তাকে বর দিতে চাইলে সূর্যদেব বলেন যে, আমাকে এমন একটি গুণবতী কন্যার বর প্রদান করুন, যার কাছে আপনি চিরকাল বশীভূত থাকবেন।

শ্রী হরি সূর্যদেবকে সেই বর প্রদান করেছিলেন এবং বলেছিলেন পৃথিবীর ভার কমানোর জন্য আমি বৃন্দাবনের নন্দালয়ে কৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করব। তুমি সেখানে বৃষ ভানু রাজা হয়ে জন্মাবে। আর তোমার কন্যা রুপে জন্মগ্রহণ করবে রাধা।

এই ত্রিলোকে আমি একমাত্র শ্রীরাধিকারই বশীভূত থাকবো। রাধা এবং কৃষ্ণের মধ্যে কোন প্রভেদ থাকবে না। সকলকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু এই জগত সংসারে একমাত্র রাধিকাই আমাকে আকর্ষণ করতে পারবে। সেইমতো প্রতিশ্রুতি অনুসারে মর্ত্যের নন্দালয়ে জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণ। সূর্যদেব বৈশ্য কুলে জন্মগ্রহণ করেন বৃষভানু রাজা হয়ে।

তারপর সময় মতো ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষে অষ্টমী তিথিতে পৃথিবীর বুক পবিত্র করে রাধারাণী আবির্ভাব গ্রহণ করেন। শ্রীরাধার এই আবির্ভাব তিথিকেই রাধা অষ্টমী বলা হয়। যেটা তার জন্মদিন হিসেবেও পালন করা হয়ে থাকে।

৩) তৃতীয়টি হলো বৃষভানু এবং তাঁর পত্নী কীর্তিদা তাঁদের পূর্ব জন্মে হাজার হাজার বছর তপস্যা করেছিলেন পরমেশ্বরী সৌভাগ্যের ভগবতীকে তাঁদের কন্যারূপে পাবার জন্য। পূর্বে তাঁদের নাম ছিল সুচন্দ্র এবং কলাবতী। তাঁরা গোকুল মহাবনের নিকট রাভেল নামক গ্রামে বাস করতেন।

 ❛রাধাষ্টমী ইতিহাস -৩❜ 

━━━━━━◆❃◆━━━━━━

পুরাকালে ধর্মপ্রাণ মৃগ রাজার পুত্র সুচন্দ্র ও পুত্রবধূ কলাবতী গোমতী নদীর তীরে এক অরণ্যের মধ্যে বারো হাজার বছর ব্রহ্মার স্তব করতে থাকেন। উই ঢিবিতে তাদের শরীর ঢাকা পড়ে গেলো। তারপর একদিন ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে বললেন, বর গ্রহণ করো। ব্রহ্মার বাক্য শুনে দিব্য রূপ ধারণ করে সুচন্দ্র ব্রহ্মাকে বললেন, “প্রভু, আমার সর্বোত্তম মোক্ষ হোক”। ব্রহ্মা বললেন, “তথাস্তু”

সেই সময় কলাবতী দুঃখিত হয়ে ব্রহ্মাকে বললেন, যদি আমার পতি মোক্ষ লাভ করেন, তবে আমার গতি কি হবে? আমি পতি ব্যতীত বাঁচবো না, তখন বিহ্বল হয়ে আমি আপনাকে অভিশাপ দেবো।

ব্রহ্মা বললেন, “বৎস, আমি সাযুজ্য মুক্তির কথা বলিনি। তুমি তোমার পতির সঙ্গে সম্প্রতি স্বর্গে যাও। সেখানে সুখে থাকো। তারপর যথাকালে তোমরা দুই জনে এই পৃথিবীতে আসবে। দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভারতে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী প্রদেশে তোমাদের কন্যা রূপে আবির্ভূতা হবেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা রাধা। তখন তোমাদের পরমধাম প্রাপ্তি হবে।”

ব্রহ্মার অমোঘ দিব্য বরে সুচন্দ্র ও কলাবতী স্বর্গ ভোগের পর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। কলাবতী কান্যকুব্জবাসী ভলন্দন রাজার যজ্ঞকুণ্ড থেকে আবির্ভূত হলেন। তিনি জাতিস্মরা। রাজার কন্যা রূপে পালিতা হলেন। সুচন্দ্র ধর্মনিষ্ঠ । সুরভানুর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর নাম হলো বৃষভানু। তিনিও জাতিস্মর ছিলেন। রূপে গুণে অতুলনীয় । শ্রীনন্দ মহারাজই তাদের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধের যোজনাকারী ছিলেন। ব্রজের গোকুল মহাবনের অন্তর্গত রাবেল নামক গ্রামে যমুনার পূর্বতীরে মনোরম স্থানে বৃষভানুর আবাস।

সেখানে ভাদ্র মাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে সোমবারে মধ্যাহ্নকালে গোলোকেশ্বরী রাধার জন্ম হলো।

বৃষভানু ও তাঁর পত্নী কীর্তিদার রাধারানী প্রাপ্তি 

একদা যখন বৃষভানু যমুনার জলে নিমজ্জিত হয়ে ভগবানের ধ্যান করছিলেন।  সে সময় একটি সহস্রদল পদ্মফুল জলপ্রবাহে ভাসতে ভাসতে তার দিকে এসে তার শরীরে স্পর্শ করল। তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে অতি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, একটি সহস্রদল পদ্মফুলের মধ্যে এক অপরূপ মাধুর্যময় শিশু কন্যা শায়িত রয়েছে এবং হাত-পা সঞ্চালন করছে। তাঁর স্বর্ণাভ অঙ্গকান্তি চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র প্রকটিত হয়ে সেই ক্ষুদ্র বালিকা শিশুটিকে বৃষভানুর হস্তে অর্পন করলেন।

যেহেতু রাজার কোনো সন্তান ছিল না, সেজন্য এই কন্যাকে পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশী হলেন। তিনি সেই শিশু কন্যাটিকে তাঁর গৃহে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে তাঁর প্রিয়পত্নী কীর্তিদার হাতে তুলে দিলেন।  এইভাবে শ্রীমতী রাধারাণী তার নিত্য মাতা-পিতা কীর্তিদা সুন্দরী ও মহারাজ বৃষভানুর ভুলোকের গৃহে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। তাঁদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেল কিন্তু এর সঙ্গে দুঃখও মিশ্রিত ছিল। কারণ শিশুটি তার চক্ষু খুলল না, তবে সে কি অন্ধ? সে কোন শব্দও করছে না, তবে সে কি মূক? সে কোন শব্দেরও প্রতিক্রিয়া করছে না। সে কি বধির? তারা বিভ্ৰান্ত হয়ে গেলেন। হয়তো সময় মতো সত্য প্রকাশিত হবে।

সেই সময়ে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিলো। দেবতারা নন্দনকাননজাত পুষ্প বর্ষণ করতে লাগলেন। নদী সমূহে নির্মল জল প্রবাহিত হয়েছিলো। পদ্মফুলের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। মৃদুমন্দ সুস্নিগ্ধ বাতাস বইতে লাগলো ।

বৃষভানু পত্নী কলাবতী শরৎকালের শতচন্দ্রকান্তি পরম মনোরমা কন্যাকে দর্শন করে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। প্রীতমনে সত্ত্বর অত বিধান পূর্বক দুই লক্ষ গাভী ব্রাহ্মণদেরকে দান করলেন। উজ্জ্বল রত্নখচিত চন্দন লিপ্ত সোনার দোলনায় শিশুকন্যা রাধা অন্যান্য গোপীদের দ্বারা আন্দোলিত হয়ে দিনে দিনে শশীকলার মতো বাড়তে লাগলো।

ব্রহ্মা শিব প্রমুখ মহান দেবতারা সহজে যাঁর দর্শন পান না, কোটি কোটি যুগ ধরে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেও যার দর্শন লাভ হয় না, ব্রজের লোকেরা সেই তাকেই আজ বৃষভানু ভবনে ছোট্ট শিশুরূপে দর্শন করতে লাগলেন ।

বৃষভানুকুমারীকে দর্শনের জন্য অন্তরীক্ষে সমাগত হলেন ব্রহ্মা, শিব, বিশ্বদেব, অশ্বিনীকুমার, গ্রহ-নক্ষত্র, মরুতগণ, পিতৃগণ। আকাশে সমাগত হলেন দেব দানব গন্ধর্ব রাক্ষস প্রভৃতি। বিদ্যাধর, সিদ্ধ, সাধ্য, ভৈরব, কিন্নর এমনকি পক্ষী পিশাচ দৈত্য নাগ প্রভৃতি হিংস্র জীবেরাও সমাগত হলো। সমস্ত ঋষি, সমস্ত মনু, চারি বেদ, সবাই দিব্য রথে আরোহণ করে আকাশ মণ্ডলে উপস্থিত হলেন।

সূর্যের শুভ উদয়ে গন্ধবগণ মধুর বাদ্য বাজাতে লাগলেন। অপ্সরাগণ গান ও নৃত্য করতে লাগলেন। মুনি ঋষিগণ শ্রীরাধা-কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। সাধুগণের মন প্রসন্ন হলো ।

শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি রক্তবর্ণ বিদ্যুতের মতো অর্থাৎ তপ্তকাঞ্চনবর্ণী, ময়ূর হার, মুকুট প্রভৃতি অলংকারে সুদীপ্তা । সর্ব সৌভাগ্য বর্ধিনী রাধা জননীর কোলে বিরাজ করতে লাগলেন। কোটি সূর্যের মতো অঙ্গ প্রভা সবার মন ও নয়নের আনন্দ বর্ধন করে।

মাতা কলাবতী অর্থাৎ কীর্তিদা অনুমান করলেন, এই কন্যা সাধারণ নয়। এ বহু তপস্যার ফল। সর্ব জগতের প্রণম্য। যাঁর পাদপদ্ম সবাই বন্দনা করে থাকেন।

শিশু কন্যার দর্শন উদ্দেশ্যে জানা অজানা অসংখ্য নরনারীর ভীড় হলো। সেই দর্শনার্থীদের সকলে বসন ভূষণে সুন্দরভাবে সজ্জিত ছিলেন। বৃদ্ধগণ, বৃদ্ধাগণ, যুবকগণ, যুবতীগণ, বাচ্চারা নিজ নিজ বহু দল করে মহানন্দে নৃত্য গীত করতে লাগলো। বাড়ীর থেকে, উঠোনে, বাইরে, পথে ঘাটে লোক দুধ দুই ননী ঘি, দুর্বা, হলুদগুঁড়ো, নানা রঙের আবীর প্রভৃতি ছড়িয়ে পরস্পরকে নিক্ষেপ করে এক পরমানন্দময় পরিবেশ গড়ে তুললো ।

বৃষভানু মহারাজ সমস্ত সমাগত ব্যক্তিদের আদর আপ্যায়ণ করে ভোজন করালেন, সবাইকে বসনভূষণ দান করলেন। শিশুকন্যা রাধা ও তাঁর মা বাবা সহ সকলের মঙ্গলসূচক বন্দনা এবং আশীর্বাদ উচ্চারণ করতে করতে লোকেরা সানন্দে প্রস্থান করলো।

ইতিমধ্যে নারদমুনি বুঝতে পারলেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই পরমেশ্বরী, সৌভাগ্যের ভগবতী শ্রীমতী রাধারানী হয়তো আবির্ভূতা হয়েছেন। তিনি ব্রজভূমিতে শ্রীমতী রাধারানীর অন্বেষণ করছিলেন এবং তাঁর পরমজ্ঞানের দ্বারা তিনি বৃষভানু মহারাজের গৃহে আগমন করলেন। তিনি প্রবল আগ্রহের সঙ্গে শিশুটিকে দর্শন করতে চাইলেন।

বৃষভানু মহারাজ ভাবলেন যে, মহামুনি নারদ যদি শিশুটিকে আশীর্বাদ প্রদান করলে  হয়তো সে তাঁর চোখ খুলবে এবং দেখবে। যখন নারদমুনি এই অপরূপ শিশুটিকে দর্শন করলেন, তাঁর হৃদয় প্রেমভক্তিতে বিগলিত হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন যে, সমস্ত প্রেমভক্তির পরম আধার সেই শিশু। তিনি সেই শিশুটির সহিত একান্তে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। যখন তিনি একান্তে সেই বালিকা শিশুর কাছে ছিলেন, তিনি তাঁর পূজা করলেন, তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং প্রার্থনা করলেন যে, তিনি যেন তাঁর পারমার্থিক জগতের চিন্ময়রূপ দর্শন করতে পারেন। শ্রীমতী রাধারানী তখন তাঁর সেই পরম দিব্য প্রায় চৌদ্দ বর্ষীয়া কন্যার অপরূপ রূপে প্রকাশিত হলেন। তিনি সমগ্র সৌন্দর্য, পরমকৃপা এবং পরম প্রেমভক্তির উৎস। নারদমুনি মূর্ছিত হলেন। যখন তিনি চেতনা ফিরে পেলেন তিনি শুধুমাত্র নৃত্যগীত সহযোগে শ্রীমতী রাধারানীর রূপ গুণ কীর্তন করতে লাগলেন। এটি ছিল নারদমুনির বহু বছরের শুদ্ধ তপস্যার ফলস্বরুপ প্রাপ্তি  এবং তিনি তাঁর কৃপা প্রার্থনা করলেন । তারপর শ্রীমতী রাধারাণী পুনরায় সেই শিশুর আকার ধারণ করলেন। নারদমুনির চক্ষু পুলকাশ্রুতে পূর্ণ ছিল, তাঁর ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হচ্ছিল। তিনি ধ্বনি দিচ্ছিলেন: জয় রাধে! জয় রাধে! জয় রাধে !

বৃষভানু মহারাজ এবং কীর্তিদা কক্ষে প্রবেশ করলেন। কিন্তু নারদমুনি তাদের কাছে সত্য প্রকাশ করলেন না কারণ এটিই ছিল তার কাছে তাঁর পরমারাধ্যা শ্রীমতী রাধারানীর নির্দেশ। তাঁদের সৌভাগ্যের প্রশংসা করে নারদমুনি তাঁদের গৃহ থেকে প্রস্থান করলেন।

বৃষভানু নন্দ মহারাজের এক প্রিয় সখা ছিলেন এবং কীর্তিদাও মাতা যশোদার প্রিয় সখী ছিলেন। নন্দ মহারাজ এবং মাতা যশোদা সেই শিশু বালিকার সংবাদ শ্রবণ করে এত আনন্দিত হয়েছিলেন যে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ তাঁর সখীর সেই সদ্যজাত শিশুটিকে দর্শন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

শীঘ্রই মাতা যশোদা শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে সেখানে আসলেন, যিনি কিছুদিন পূর্বেই আবির্ভূত হয়েছেন। যখন কীর্তিদা এবং যশোদা ঐ অপরূপ বালিকার রূপ বর্ণনায় রত তখন ছোট্ট কৃষ্ণ হামাগুড়ি দিয়ে দোলনার দিকে গেলেন যেখানে শ্রীমতী রাধারানী ছোট্ট শিশু বালিকা রূপে শায়িত ছিলেন।

ছোট্ট কৃষ্ণ সেই ছোট্ট বালিকাকে স্পর্শ করলেন। যখন কৃষ্ণের মুখমন্ডল তাঁর সম্মুখে আসল, শ্রীমতী রাধারানী তৎক্ষণাৎ তাঁর চক্ষু উন্মিলিত করলেন এবং কৃষ্ণের জন্য কান্না করলেন। তিনি কৃষ্ণ ছাড়া আর কিছু দেখতে চাইলেন না। তিনি কৃষ্ণের গুণকীর্তন ছাড়া আর কোন কথা বলতে চাইলেন না। এটিই পরমেশ্বর ভগবানের আহ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতী রাধারানীর চিন্ময় প্রকৃতি। এই জড় জগতে আবির্ভূত হয়েছেন এক ও একমাত্র ভগবানের আনন্দ বিধানের জন্য, তিনি  প্রথম দর্শনের ইচ্ছা ভগবানের রাখবেন সেটা ত স্বাভাবিক! ভগবান যাঁকে শুধু হৃদয়ে নয় মস্তকে ধারণ করেন তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেন না তা আবার হয় নাকি!  

ইত্যবসরে বৃষভানু রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দেখলেন, রাধিকা চোখ উন্মীলিত করে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন তিনি আনন্দের আতিশয্যে উভয়কে কোলে তুলে নিলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, কৃষ্ণই রাধাকে চক্ষুদান করেছেন। রাধার চক্ষু উন্মীলনের খবর পাওয়া মাত্রই সমগ্র ব্রজবাসীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন।

🌿 রাধারানীর চোখ মুদ্রিত হয়ে থাকার কারণঃ

একদিন গােলােকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধারানীকে জ্ঞাপন করলেন যে, তিনি অতি শীঘ্রই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। সুতরাং রাধারানী যেন সেখানে অবতরণ করেন, কেন না সেখানে উভয়ের মধ্যে বিচিত্র মাধুর্য লীলাবিলাস হবে।

কৃষ্ণের কথা শুনে রাধারানী বললেন যে, যদি তাঁকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে হয়, তা হলে তাঁকে পর পুরুষের মুখ দর্শন করতে হবে। কিন্তু রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের রূপমাধুরী ছাড়া অন্য কিছুই দর্শন করেন না। তাই তাঁর পক্ষে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা কি করে সম্ভব?

রাধারানীর যুক্তিসঙ্গত কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন যে, সেই জন্য তাঁর চিন্তার কোনও কারণ নেই। রাধারানী সব সময় কৃষ্ণকেই দেখতে পাবেন।এভাবেই আশ্বস্ত হয়ে, তবেই হরিপ্রিয়া রাধারানী মর্ত্যলােকে অবতীর্ণ হতে রাজি হয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে ভৌম জগতের বৃন্দাবন-ধাম আর চিন্ময় জগতের সর্বোচ্চলােক গােলােক বৃন্দাবনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতেই চিন্ময় গােলােক বৃন্দাবন এই জড় জগতে প্রকাশিত হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জড় জগতে অবতরণ করতে চান, তখন তিনি তাঁর নিত্য পার্ষদবৃন্দ ও চিন্ময় ধামসহ অবতরণ করেন।

মায়াবদ্ধ জীবেরা এই জড় জগতের অন্তর্গত বৃন্দাবন, নবদ্বীপ আদি ধামগুলি যে চিন্ময় তা উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের কাছে এই চিন্ময় ধামণ্ডলি জড় রাজ্যেরই অন্তর্গত এক-একটি অঞ্চল বলে মনে হয়। ধাম যেহেতু ভগবানের চিন্ময় রাজ্য, তাই বদ্ধ জীব ধামকে কলুষিত করতে পারে না। যারা ধামে এসে পাপকর্ম চরিতার্থ করে, প্রকৃতপক্ষে তাদের কার্যকলা ধামের উপরে মায়া রচিত আবরণের জালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সদ্গুরুর কৃপায় মায়ার আবরণ উন্মােচন হলে, তবেই ধামের চিন্ময় স্বরূপের দর্শন ও উপলব্ধি সম্ভব হয়।

কেন রাধাষ্টমী হলো শ্রীকৃষ্ণের পরমানন্দের দিন ?

চৈতন্য চরিতামৃতে বর্ণিত আছে শ্রীমতী রাধারানী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আহ্লাদিনী শক্তি এবং তাঁর থেকে তিনি অভিন্ন ।

তিনি বৈকুন্ঠে নারায়ণপত্নী সমস্ত লক্ষ্মীদেবীর উৎস। তিনি শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী সীতামাতার উৎস। তিনি পার্বতী এবং দুর্গার উৎস যাঁরা জড় জগতের লালন পালনের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। শ্রীরাধা, শ্রীসীতা, শ্রীলক্ষ্মী অভিন্ন ঠিকই কিন্তু শ্রীমতী রাধারানী তাঁর প্রকৃতরূপ, পূর্ণ ঐশ্বর্য, তাঁর চরম প্রেমভক্তিভাব ইত্যাদি নিয়ে বৃন্দাবনের চিন্ময় ভূমিতে নিজেকে প্রকাশিত করেছিলেন।

শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে তাঁদের চিন্ময় মধুর লীলা প্রদর্শন করেছিলেন।

কৃষ্ণ সর্বজ্ঞ। তিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জানেন। কিন্তু এই অনন্ত কোটি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে তাঁর একটি বস্তু অজানা আছে, আর তা হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীমতী রাধারানীর শুদ্ধ নির্মল এবং প্রগাঢ় প্রেমভক্তি।

রাধারানীর প্রেমভক্তির প্রশংসা করে কৃষ্ণ উদ্ধবকে বলেছেন, যখন রাধারানী যমুনাতে যেতেন লোকে তাঁর সমালোচনা করত। কিন্তু রাধারানী বলতেন, ‘প্রত্যেকেই যমুনাতে যায় কিন্তু আমি যখন যমুনাতে যাই লোকে তখন আমাকে অসতী বলে কারণ আমি কৃষ্ণের অন্বেষণে যাই । যদি কৃষ্ণসেবায় গিয়ে অকথা কুকথায় আমার চরিত্র হননও হয়, তাহলেও আমি কৃষ্ণের আনন্দের জন্য সেই অকথা ও কুকথাকে অতি সুবাসিত পুষ্পের মালার মতো আমার কন্ঠে অতি আনন্দের সহিত ধারণ করব।’

‘আমার কি এমন বিশেষ গুণ রয়েছে যা তাঁকে পরম সুখ প্রদান করে? আমার প্রেমের মাধুর্য আস্বাদন করে সে কি আনন্দ পায়? তার প্রেমের প্রকৃতিই বা কি? আমাকে ভালবেসে সে কি সুখ অনুভব করে?’ কৃষ্ণ নিরন্তর এই চিন্তা গভীরভাবে করতে থাকেন। কিন্তু একটি বিষয় তিনি উপলব্ধি করেন, তিনি পরিপূর্ণভাবে শ্রীমতী রাধারানীর ভক্তির অধীন।

শ্রীমতী রাধারানী ভক্তির সর্বোচ্চ রস —- পবিত্র, নির্মল ভক্তিকে প্রকাশ করার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি হলেন কৃষ্ণভক্তির সর্বোচ্চ আধার। তাঁর কৃপা বিনা কেউই ভক্তি লাভ করতে পারে না ।

শ্রীচৈতন্য রূপে তিনি সমগ্র পৃথিবীতে পবিত্র নাম জপের মাধ্যমে তাঁর প্রেম বিতরণ করেছেন —- হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।

হরিনাম সংকীর্তন আন্দোলনের মাধ্যমে, শ্রীমতী রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর লীলাবিলাসকে ঐকান্তিকভাবে অনুভব করার আমন্ত্রণ জানাতে স্বয়ং এই পৃথিবীতে এসেছেন। জলদূতে শ্রীল প্রভুপাদ একটি সুন্দর প্রার্থনা লিখেছিলেন: ‘হে আমার সমস্ত ভ্রাতাগণ, শ্রীমতী রাধারানী তোমাদের উপর তাঁর কৃপা বর্ষণ করলে তবেই সৌভাগ্য প্রাপ্ত হবে ।’

কৃষ্ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান কিন্তু শ্রীরাধিকার প্রেম হলো সর্বোচ্চ, কারণ এটি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেও পরাজিত করেছেন। সেই জন্যই রাধাষ্টমী হলো শ্রীকৃষ্ণের পরমানন্দের দিন।

শ্রীরাধারানী কি জয়। মহারানী কি জয়।

✤  শ্রীরাধারাণীর অষ্টোত্তর (১০৮) নাম

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

শ্রীরাধা নমো নমঃ। ১

শ্রী বৃষভানুজা নমো নমঃ।। ২

শ্রী কীর্তিদাকন্যাকা নমো নমঃ। ৩

শ্রী রাসেশ্বরী নমো নমঃ।। ৪

স্ত্রী রাস-বাসিনী নমো নমঃ। ৫

শ্রী রশিক-ঈশ্বরী নমো নমঃ।। ৬

শ্রীকৃষ্ণ প্রাণাধিক নমো নমঃ। ৭

শ্রী কৃষ্ণ প্রিয়া নমো নমঃ।। ৮

 

শ্রী কৃষ্ণ স্বরূপিনী নমো নমঃ। ৯

শ্রী কৃষ্ণবামঙ্গসম্ভুতা নমঃ।। ১০

শ্রী পরমানন্দরুপিনি নমঃ। ১১

শ্রী কৃষ্ণা নমো নমঃ।। ১২

শ্রী বৃন্দাবনী নমো নমঃ। ১৩

শ্রী বৃন্দাবন বিনোদিনী নমঃ।। ১৪

শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্ৰ নমো নমঃ। ১৫

শ্রী চন্দ্ৰকান্তা নমো নমঃ।। ১৬

 

শ্রী শতচন্দ্ৰনি ভনান নমো নমঃ। ১৭

শ্রী গান্ধারবিকা নমো নমঃ।। ১৮

শ্রী গান্ধাব্ধারাধিকা নামো নামঃ। ১৯

শ্রী মাধব সঙ্গিনী নমো নমঃ।। ২০

শ্রী দামোদরদ্বৈত সখি নমঃ। ২১

শ্রী সূর্যপাসিকা নামো নামঃ।। ২২

শ্রী আনন্দমঞ্জুরিজৈষ্ঠায় নমঃ। ২৩

শ্রী দামাবরজো নমো নমঃ।। ২৪

 

শ্রী উত্তমা নমো নমঃ। ২৫

শ্রী বিশাখা সয়া নমো নমঃ।। ২৬

শ্রী বৃন্দাবনেশ্বরী নমো নমঃ। ২৭

শ্রী জীবন স্বরূপা নমো নমঃ।। ২৮

শ্রী রাস বিলাসিনী নমঃ। ২৯

শ্রী নিত্য বিহারিনী নমঃ।। ৩০

শ্রী নিত্য কেশরী নমঃ। ৩১

শ্রী শ্যামপ্ৰণধণ নমো নমঃ।। ৩২

 

শ্রী প্রেমস্বরূপিনী নমো নমঃ। ৩৩

শ্রী নব কিশোরী নমো নমঃ।। ৩৪

শ্রী রাসবিহারী নমো নমঃ। ৩৫

শ্রীগৌরাঙ্গী নমো নমঃ।। ৩৬

শ্রী শ্যামা নমো নমঃ। ৩৭

শ্রী কুলবতী নমো নমঃ।। ৩৮

শ্রী শ্রীজি নমো নমঃ। ৩৯

শ্রী মথেশ্বরী নমো নমঃ।। ৪০

 

শ্রী ক্রিয়েশ্বরীর নমো নমঃ। ৪১

শ্রী স্বধেশ্বরি নমো নমঃ।। ৪২

শ্রী ত্রিবেদভারতীশ্বরী নমঃ। ৪৩

শ্রী সুরেশ্বরি নমো নমঃ।। ৪৪

শ্রী ব্রজাধিপে নমো নমঃ। ৪৫

শ্রী ব্রজেশ্বরী নমো নমঃ।। ৪৬

শ্রী আদ্যা শক্তি নমো নমঃ। ৪৭

শ্রী ক্ষমেশ্বরি নমো নমঃ।। ৪৮

 

শ্রী কলাবতী নমো নমঃ। ৪৯

শ্রী কৃপাবতি নমো নমঃ।। ৫০

সী ইন্দুমুখি নমো নমঃ। ৫১

শ্রী অনুপমা নমো নমঃ।। ৫২

স্ত্রী অবনী ধারণী নমো নমঃ। ৫৩

শ্রী ইষ্ঠভক্তি প্রদায়িনী নমো নমঃ।। ৫৪

শ্রী অপদুন্ধারিণী নমো নমঃ। ৫৫

শ্রীকৃষ্ণ প্রাণেশ্বরী নমো নমঃ।। ৫৬

শ্রী গোপেশ্বরী নমো নমঃ। ৫৭

শ্রী গোকুল ঈশ্বরী নমো নমঃ।। ৫৮

শ্রী দয়াময়ী নমো নমঃ। ৫৯

শ্রী করুণাময়ী নমো নমঃ।। ৬০

শ্রী কুঞ্জনিবাসিনী নমো নমঃ। ৬১

শ্রী নলিনাক্ষী নমো নমঃ।। ৬২

শ্রী কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী নমঃ। ৬৩

শ্রী কল্যাণী নমো নমঃ।। ৬৪

 

শ্রী কৌমারী নমো নমঃ। ৬৫

শ্রী বল্লভী নমো নমঃ।। ৬৬

শ্রী প্রধানা প্রকৃতি নমো নমঃ। ৬৭

শ্রী হরি প্রিয়া নমো নমঃ।। ৬৮

শ্রী শ্রীশিবা নমো নমঃ। ৬৯

শ্রী বৈজয়ন্তী নমো নমঃ।। ৭০

শ্রী ধাত্রী নমো নমঃ। ৭১

শ্রী মনোরোমা নমো নমঃ।। ৭২

 

শ্রী ক্ষমাবতী নমো নমঃ। ৭৩

শ্রী ত্রৈলোক্য মঙ্গলময় নমঃ।। ৭৪

শ্রী যোগেশ্বরী নমো নমঃ। ৭৫

শ্রী যোগগক্ষ্যা নমো নমঃ।। ৭৬

শ্রী শান্তা নমো নমঃ। ৭৭

শ্রী সুগতি দায়িনী নমো নমঃ।। ৭৮

শ্রী প্রেমাঙ্গী নমো নমঃ। ৭৯

শ্রী পূর্ণানন্দময়ী নমো নমঃ।। ৮০

 

শ্রী নরাঙ্গানা নমো নমঃ। ৮১

শ্রী পরমার্থ প্রদায়িনী নমো নমঃ।। ৮২

শ্রী নিধুবন নিবাসিনী নমো নমঃ। ৮৩

শ্রী বংশীবট বিহারিনী নমো নমঃ।। ৮৪

শ্রী নারী শিরোমনি নমো নমঃ। ৮৫

শ্রী রমা নমো নমঃ।। ৮৬

শ্রী রত্মা নমো নমঃ। ৮৭

শ্রী পূর্ণা নমো নমঃ।। ৮৮

 

শ্রী শ্যামমোহিনী নমো নমঃ। ৮৯

শ্রী হরিণ নয়না নমো নমঃ।। ৯০

শ্রী মদন মোহন মোহিনী নমো নমঃ। ৯১

শ্রী সুধামুখী নমো নমঃ।। ৯২

শ্রী ভবসাগর তরণী নমো নমঃ। ৯৩

শ্রী সিন্ধু কন্যা নমো নমঃ।। ৯৪

শ্রী কৃষ্ণাত্মা নমো নমঃ। ৯৫

শ্রী মহাভাব স্বরূপিনী নমো নমঃ।। ৯৬

 

শ্রী সম্মোহিনী নমো নমঃ। ৯৭

শ্রী মহাভাব শিরোমনি নমো নমঃ।। ৯৮

শ্রী বৃন্দাবন বিহারী নমো নমঃ। ৯৯

শ্রী বৃন্দাবন বিলাসিনী নমো নমঃ।। ১০০

শ্রী কৃষ্ণানন্দ প্রদায়িনী নমো নমঃ। ১০১

শ্রী বিষ্ণু প্রিয়া নমো নমঃ।। ১০২

শ্রী কাঞ্চনাভ্য নমো নমঃ। ১০৩

শ্রী হেমগাত্ৰা নমো নমঃ।। ১০৪

 

শ্রী বেদপ্রিয়া নমো নমঃ। ১০৫

শ্রী বেদ গঙ্গা নমো নমঃ।। ১০৬

শ্রী বেনু বাদ্য নমো নমঃ। ১০৭

শ্রী বেনুরীতি নমো নমঃ।। ১০৮

 

|| ইতি সমাপ্ত রাধা রানীর অষ্টোত্তর শতনাম ||


✤  শ্রীরাধারাণীর অষ্টসখীর নাম

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

রাধার অষ্টসখী বা গোপী কারা? রাধা কৃষ্ণের রাসলীলা নৃত্যের সময় যে আটজন সখীর দর্শন পাওয়া যায়, সেই আট সখিকে রাধার অষ্টসখী বলা হয়। এছাড়াও রাধাকৃষ্ণের ডান পাশে চারজন সখিকে দেখতে পাওয়া যায় এবং বাম পাশে চারজন সখিকে দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই অষ্টসখীর নাম হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। এই অষ্টসখীরা হলেন – ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, ইন্দুরেখা, চম্পকলতা, রঙ্গদেবী, সুদেবী ও তুঙ্গবিদ্যা।

অষ্টসখী বৃন্দের পরিচয়  

️১) ললিতা_সখী

জন্ম – বর্ষণা হতে দু-তিন কিলোমিটার দূরে পূর্ব দিকে উঁচা গ্রামে, ললিতা গ্রাম নামে বিখ্যাত। পিতা – বিশোক, মাতা – সারোদা, পতি – ভৈরব, স্বভাব  – বামা প্রখরা, বর্ণ – গো রচনা, বস্ত্র – ময়ূর পুচ্ছ, সেবা – তাম্বুল, ভাব – খণ্ডিতা, কুঞ্জ – বিদ্যুৎ বর্ণললিতানন্দন, বয়স – ১৪/৩/১২ দিন। গৌর লীলায় – স্বরুপ দামোদর।

️২) বিশাখা_সখী

জন্ম – কামাই গ্রামে। পিতা – পাবন, মাতা – দক্ষিণা, পতি – বাহিক, স্বভাব – অধিক মধ্যা, বর্ণ – বিদ্যুৎ, বস্ত্র – তারা বলি, সেবা – কর্পূর এবং বস্ত্রালংকার, ভাব – স্বাধীন ভত্তৃকা, কুঞ্জ – মেঘবর্ণ মদন সুখোদা, বয়স – ১৪/২ মাস। গৌর লীলায় – রায় রামানন্দ।

৩) চিত্রা_সখী

জন্ম – চিক্ সৌলী গ্রাম। পিতা – চতুর, মাতা – চব্বিকা, পতি – পিঠর, স্বভাব – অধিক মৃদ্ধি, বর্ণ – কাস্মির, বস্ত্র – কাঁচ প্রভা, সেবা – মালা এবং বস্ত্রালঙ্কার, ভাব – দিবাভিসারিকা, কুঞ্জ – কিঞ্জঙ্ক চিত্রানন্দ, বয়স – ১৪/২/১৬ দিন। গৌর লীলায় – গোবিন্দ নন্দ ঘোষ।

৪) ইন্দুরেখা_সখী

জন্ম – আঁ জনক গ্রাম। পিতা – সাগর, মাতা – বেলা, পতি – দূর্ব্বল, স্বভাব – বামা প্রখরা, বর্ণ – চম্পক, বস্ত্র – চাষ পক্ষী অথবা দারিম্ব কুসুম, সেবা – চামর এবং নৃত্য, ভাব – বাসকসজ্জা, কুঞ্জ – তপ্তকাঞ্চন সুখদ, বয়স – ১৪/২/১২ দিন। গৌর লীলায় – শ্রীবসুরামানন্দ।

৫) চম্পকলতা_সখী

জন্ম – সুন্হেরা গ্রাম। পিতা – আরাম, মাতা – বাটিকা, পতি – চান্ডাক্ষ, স্বভাব – বামা মধ্যা, বর্ণ – হরিতাল, বস্ত্র – দাড়িম্ব কুসুম, ভাব – প্রষিতভত্তিকা, সেবা – নৃত্য, কুঞ্জ – স্বর্ণবর্ণ নন্দদ কমলকুঞ্জ, বয়স – ১৪/২/১৯ দিন। গৌরলীলায় – শ্রী সেন শিবানন্দ।

৬) রঙ্গদেবী_সখী

জন্ম – বঝেরা গ্রাম। পিতা – রঙ্গ সার, মাতা – করুণা, পতি – বক্রে ক্ষণ, রঙ্গদেবী ও সুদেবী যমজ বোন, স্বভাব – বামামধ্যা, বর্ণ – পদ্মকিঞ্জক, বস্ত্র – জবাকুসুম, ভাব – উৎকণ্ঠা, সেবা – অলক্ত, কুঞ্জ – শ্যাম বর্ণ সুখদ শ্যাম কুঞ্জ, বয়স – ১৪/২/৮ দিন। গৌরলীলায় – শ্রী গোবিন্দ ঘোষ।

️৭) সুদেবী_সখী

জন্ম – বঝেরা গ্রাম। পিতা – রঙ্গ সার, মাতা – করুণা, পতি – বক্রেক্ষণের ছোট ভাই রক্তেক্ষণ, সুদেবী ও রঙ্গদেবী যমজ বোন, স্বভাব – বামা প্রখরা, বর্ণ – সুবর্ণ, বস্ত্র – প্রবাল বর্ণ, সেবা -জল, ভাব – কলহান্তরিকা, কুঞ্জ – হরিদ্রা বর্ণ সুখদ কুঞ্জ, বয়স – ১৪/২/৮ দিন। গৌর লীলায় – শ্রী বাসুদেব ঘোষ।

️৮) তুঙ্গবিদ্যা_সখী

জন্ম – ডাভারা গ্রাম। পিতা – পৌস্কর, মাতা – মেধা, পতি – বালিশ, স্বভাব -দক্ষিণ প্রখরা, বর্ণ – চন্দ্র কুসুম, ভাব – বিপ্রলব্ধা, বস্ত্র – পাণ্ডরবর্ণ, সেবা – গীতবাদ্য, কুঞ্জ – অরুন বর্ণ নন্দন কুঞ্জ, বয়স – ১৪/২/১৩ দিন। গৌরলীলায় – শ্রী বক্রেশ্বর পন্ডিত।


✤  শ্রীমতী রাধারাণীকে কেন “মা’ বলা হয় না?

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

একজন ভক্ত রাধারানীকে কিরূপে গ্রহন করবেন, সেটা ভক্তের ভাবের ওপর নির্ভর করে। সেই ভক্তের ভাবের উপর নির্ভর করে রাধারানীকে তিনি কি ভাবে সম্বোধন করবেন।

বিশেষত ব্রজধাম বৃন্দাবনে, উচ্চ শ্রেণীর ভক্তরা রাগানুগা বা মাধুর্য রসে ভক্তি করেন। যা ভক্তি রাজ্যের সর্বোচ্চ রস। আর এই রস অনুযায়ী রাধা রানী হলেন নিত্য কিশোরী। সেখানে তিনি কৃষ্ণের নিত্য প্রেমিকা।

আর ভক্তরা নিজেকে সেই রাধারানীর দাসানুদাস ভাবে সেবা করেন। তারা কৃষ্ণকে রসিক সৎচিৎআনন্দ প্রেমিক রূপে সেবা করেন আর রাধারানীকে সেই কৃষ্ণের প্রেম প্রদানকারী প্রেমিকা রূপে সেবা করেন। সুতরাং ভক্তরা কৃষ্ণের প্রেমভক্তি প্রাপ্ত করার জন্য রাধারানীকে অধীশ্বরীরূপে তার আনুগত্যে সেবা করেন ।

তাই তারা রাধা রাণীকে মা রূপে দেখেন না, তারা তাকে নিত্য কিশোরী রূপে সেবা করেন।

আর এটাই জগতে প্রচলিত যে রাধা রানী নিত্য কিশোরী এবং কৃষ্ণের প্রেম প্রদানকারী তার প্রধান প্রিয় সখি।

 তাই বলে এমন নয় যে রাধা রানিকে মা বলা যায় না।আগেই বলেছি এটা ভক্তের ভাবের ওপর নির্ভর করে । কে কি ভাব নিয়ে তার সেবা করবেন  এটা তার নিজের ভাব ভক্তির উপর নির্ভর করে। শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে পরম পিতা বলা হয়। অতএব রাধারাণীকে পরম মাতা বলেও সম্বোধন করা যায়।

যার যা ভাব যে যেভাবে তাকে ভক্তি করে সেই ভাবেই তিনি ভক্তের কাছে প্রকট হন “যে যথা মাম প্রপদন্তে”

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধা রাণীকে ‘ব্রহ্মান্ড জননী ‘ বলা হয়েছে।

পদ্ম পুরাণে স্বয়ং শিবের উক্তি হল,  “কৃষ্ণঃ জগতাং তাতঃ জগন্মাতা চ রাধীকা।” অর্থাৎ জগৎপিতা হলেন কৃষ্ণ এবং রাধারানী হলেন ‘জগন্মাতা’।

শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে, “সর্ব পালিকা, সর্ব জগতের মাতা।”

বেদশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাধারাণী সমগ্র ব্রহ্মান্ডের মা।

পার্বতীর কাছে মহাদেব রাধারণীর সহস্র নাম বলতে গিয়ে বললেন, ‘জননী জন্মশূন্যা  চ জন্মমৃত্যুজরাপহা। ‘

অর্থাৎ, রাধারাণী সবার মাতা, প্রকৃত পক্ষে তাঁর কোনও মা নেই। তিনি ‘জন্মশূন্যা’। আমাদের জন্ম মৃত্যু জরাব্যাধির দুঃখক্লেশময় চক্র থেকে তিনিমুক্ত করেন। ‘জন্মমৃত্যুজরাপহা’।

মহাদেব বলেছেন, শ্রীরাধা ‘নীতির্গতির্মতিরভীষ্ঠদা ‘। অর্থাৎ তিনি নীতি, আমাদের পরমগতি,আমাদের পরম অভীষ্ট প্রদান করেন। কিন্তু যার মস্তিস্কে রাধারানীর প্রতি মাতৃভক্তি থাকে না, যারা ‘মা’ বলে ভাবতে পারল না, সে মূঢ়। সেই মূঢ়দের নীতি, গতি ও অভীষ্ট কি ধরনের?

রাধারানী পরম কৃপাময়ী, তাঁর কৃপা ছাড়া কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্ত হয় না।


✤  শ্রীমতী রাধারাণী কি কাল্পনিক ?

─•━━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

কখনও কখনও কেউ যুক্তি দেখান শ্রীমতী রাধারাণীর নাম শ্রীমদ্ভাগবতে নেই। কিন্তু এটি জানা উচিত শ্রীমতী রাধারাণীর নাম ও মহিমা শ্রীমদ্ভাগবত ছাড়া শ্রীব্যাসদেবের রচিত বহু প্রামাণিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।           

এখন প্রশ্ন হল, শ্রীমদ্ভাগবতে রাধারাণীর নাম নেই কেন?

উত্তরঃ শ্রীপরীক্ষিৎ মহারাজের দেহত্যাগ অবধি তাঁকে শ্রীল শুকদেব গোস্বামী অনর্গলভাবে সাতদিন ধরে মধুর ভাগবত-অমৃত দানের সংকল্প করেছিলেন। ভক্তচূড়ামণি শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর মুখে যদি অতি উচ্চ ও গুহ্য সেই রাধাতত্ত্ব প্রকাশিত হত, তবে তিনি আর শ্রীমদ্ভাগবত ব্যাখ্যা করতে সম্পূর্ণ বিকল হতেন। কারণ, রাধা নাম ও রাধাভাবের কথাতে তাঁর মধ্যে অষ্টসাত্ত্বিক বিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে তিনি সযত্নে সেই রাধাতত্ত্বকথা এড়িয়ে গেছেন।

শ্রীবৃহৎ-ভাগবতামৃতে শ্রীপরীক্ষিত মহারাজের উক্তি হল —-

গোপীনাং বিততাদ্ভুতস্ফুটতর প্রেমানলার্চিশ্ছটাদগ্ধানাং
কিল নামকীর্তনকৃতাত্তাসাং বিশেষাৎ স্মৃতেঃ।
তত্তীক্ষনজ্বলনোচ্ছিখাগ্রকণিকাস্পর্শেন সদ্যো মহা-
বৈকল্যং স ভজন্ কদাপি ন মুখে নামানি কর্তুং প্রভুঃ ।।

━━┉┈┈(বৃহদ্ভাগবতামৃতম্ – ১/৭/১৩৪)

অর্থাৎ —- মহারাজ পরীক্ষিত নিজ জননী উত্তরাকে বললেন, “হে মাতা! আমার গুরুদেব শুকমুনি ভাগবত কথা কীর্তন করার সময় গোপীদের কারোর নাম উচ্চারণ করতে সমর্থ হননি। তা’র কারণ গোপীদের নাম উচ্চারণ করলে তাঁর বিশেষ স্মৃতিতে চিত্ত অতি বিস্মৃত জ্বালাময় প্রেমাবলে মহাবিহ্বল হয়ে পড়তেন, যারফলে আর ভাগবত কথা বলতে পারতেন না।”

বহু প্রামণিক শাস্ত্রে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণন –

তবে বহু প্রামণিক শাস্ত্রে শ্রীমতী রাধারাণীর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে । যেমন,

➡️ নারদপুরাণে উল্লেখ রয়েছে —- 

❝সত্যম্ সত্যম্ পুনঃ সত্যম্ সত্যমেব পুনঃপুনঃ।
বিনা রাধা প্রসাদেন মৎপ্রসাদো ন বিদ্যতে॥ ❞ ‌

অর্থাৎ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘হে নারদ! আমি বার বার সত্য কথা বলছি পুনরায় সত্য করে বলছি — শ্রীরাধারানীর কৃপা ব্যতীত আমার কৃপা কেউ লাভ করতে পারবে না ।’

শ্রীমতি রাধারানীর কৃপা ব্যতীত শ্রীকৃষ্ণপ্রেম লাভ করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই ভক্তের সর্বদা মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য যে রাধাকৃষ্ণ ভিন্ন নয়, তাঁরা যুগলে এক ।

➡️  ‘শ্রীগোপাল তাপিনী’তে বলা হয়েছে —

❝তস্যাদ্যো প্রকৃতি রাধিকা নিত্য নির্গুণা ।
যস্যাংশে লক্ষ্মী দুর্গাদিকা শক্তয়ঃ ॥ ❞ ‌

অর্থাৎ”শ্রীকৃষ্ণের নিত্য শক্তি, আদিশক্তি শ্রীরাধা নিত্য নির্গুণা; এবং লক্ষ্মী, দুর্গাদি সব ভগবৎ শক্তিবর্গ যাঁর অংশ।”

➡️ ‘শ্রীবৃহৎগৌতমীয় তন্ত্রে’ শ্রীকৃষ্ণের উক্তি —

❝সত্ত্বং তত্ত্বং পরত্বঞ্চ তত্ত্বত্ৰয়মহং কিল।
ত্রিতত্ত্বরূপিণী সাপি রাধিকা মম বল্লভা॥ ❞ ‌

অর্থাৎ “আমি যেমন নিত্য আনন্দময় হয়ে বিশ্বের কার্য, কারণ ও ত্রিতত্ত্ব-স্বরূপ, তেমনই শ্রীরাধা নিত্য আনন্দময়ী হয়ে কার্য, কারণ স্বভাবস্থিতা।”

➡️ শ্রীপদ্মপুরাণে পাতালখণ্ডে শ্রীশিবজী নারদকে বললেন —

দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা ।

সর্বলক্ষ্মী স্বরূপা সা কৃষ্ণাহ্লাদ স্বরূপিণী।।

তৎ সো প্রোচ্যতে বিপ্র হ্লাদিনীতি মনীষিভিঃ।

তৎকলাকোটিকোট্যাংশা দুর্গাদ্যাস্ত্রীগুণাত্মিকাঃ।।

অর্থাৎ “ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমপুরুষ দেবাদিদেব, এবং শ্রীমতী রাধিকা হচ্ছেন নিত্য শক্তি। রাধিকা সর্বলক্ষ্মী তাঁর অংশ স্বরূপা। হে নারদ, দুর্গাদি দেবীগণ শ্রীমতী রাধিকার কোটি কোটি অংশের এক কলা।”

 

➡️ শ্রীপদ্মপুরাণে পাতালখণ্ডে

বহুনা কিং মুনিশ্রেষ্ঠ বিনাতাভ্যাং ন কিঞ্চন।

চিদ্ তিল্লক্ষণং সর্ব রাধাকৃষ্ণ ময়ং জগত।।

ইত্থং সর্ব তয়োরের বিভূতি বিধি নারদ।

নশ্যক্যতে মায়াবক্তুং বর্ষ কোটি শতৈরপি।।

অর্থাৎ “শ্রী শিবজী নারদ মুনিকে বললেন, হে মুনিবর! আমি তোমাকে আর কি বলব? শ্রীরাধাকৃষ্ণ ছাড়া জগতে আর কিছু নেই। এইভাবে সবই তাদের বিভূতি বলে জানবে। আমি শত কোটি বছর ধরে বললেও শ্রীরাধাকৃষ্ণের মহিমা বর্ণনা করতে সক্ষম হব না।”

 

➡️ শ্রীগৌতমীয়-তন্ত্রে’ বর্ণিত আছে —-

দেবী কৃষ্ণময়ী প্রোক্তা রাধিকা পরদেবতা।

সর্বলক্ষ্মীময়ী সর্বকান্তিঃ সম্মোহিণী পরা।।

অর্থাৎ “শ্রীমতী রাধারাণী হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের আদিশক্তি এবং আদি লক্ষ্মী। সর্বগুণ বিভূষিতা এবং সমস্তকে আকর্ষণ করেন।”

 

➡️ শ্রীনারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে-

সৃষ্টিকালে চ সাদেবী মূলপ্রকৃতিরীশ্বরা।

মাতা ভাবেন্মহাবিষ্ণোঃ স এব চ মহান্ বিরাট্।।

অর্থাৎ “শ্রীরাধাই মূল প্রকৃতি এবং ঈশ্বরী। জগত সৃষ্টির সময় যে মহাবিষ্ণু হ’তে জগত সৃষ্টি হয়, সেই বিরাট পুরুষের মাতা শ্রীরাধা। মহাবিষ্ণু হতে জগত সৃষ্টি এবং শ্রীরাধা হতে মহাবিষ্ণু উদ্ভব বলে শ্রীরাধাকে তত্ত্বতঃ জগন্মাতা বলা হয়।”

 

➡️  ‘শ্রীনারদপঞ্চরাত্রে’ আবার বলা হয়েছে-

রাধা বাম শসম্ভূতা মহালক্ষ্মী প্রকীৰ্ত্তিতা।

ঐশ্বর্য্যাধিষ্ঠাত্রী দেবীশ্বরস্যৈব নারদ।।

অর্থাৎ “যে মহালক্ষ্মী ঈশ্বরের ঐশ্বর্য্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনি শ্রীরাধার বামসম্ভূতা অর্থাৎ তিনি শ্রীরাধার অংশ। সুতরাং শ্রীরাধা হচ্ছেন সর্ববিধ ঐশ্বর্য্যের মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী।”

 

➡️ ‘শ্রীঋগ্বেদে’ উল্লেখিত রয়েছে —

“স্তোত্রং রাধানাং পতে গির্বাহোবীর যস্যতে”

       —–শ্রীঋগ্বেদ (১/৩০/৫)

অর্থাৎ “হে বীর রাধানাথ স্তুতি ভাজন তোমার এই রূপ স্তুতি, তোমার বিভূতি সত্য ও প্রিয় হোক্”।

 

➡️ এই রকম শাস্ত্রে বহু প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় যে শ্রীমতী রাধারাণী শ্রীকৃষ্ণের আদিশক্তি। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/১৪/২০) এই সত্যকে স্বীকার করে বলেছেন, “হে উদ্ধব, ভক্তের প্রবল ভক্তি যেভাবে আমাকে আকর্ষণ করে, যোগ, সাংখ্য, ধর্ম, বেদ অধ্যয়ন, তপ, ত্যাগ, দান, আদি পুণ্যকর্ম তা করতে পারে না।”

 

➡️ ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে’ বলা হয়েছে —

রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি।

অন্যোন্যে বিলসে রস আস্বাদন করি।।

শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ এক তত্ত্ব হয়েও অনাদি কাল থেকে দুই দেহ ধারণ করে আছেন। তা’র কারণ শ্রীকৃষ্ণ রসময়। রস আস্বাদন করাই তাঁর স্বরূপধর্ম । বিলাসের মধ্যে রস আস্বাদিত হয়। এই বিলাস করার জন্য দুই দেহ ধারণ করে রস আস্বাদন করেন। রাধাকৃষ্ণ অভিন্ন হলেও চিরকাল ভিন্ন হয়ে আছেন। ভিন্ন ও অভিন্ন দু’টিই নিত্যসত্য। কেবল অভিন্ন অপেক্ষা ভিন্নতায় উৎকর্ষতা বা প্রাধান্য অধিক রয়েছে। কারণ অভিন্ন তত্ত্বে কেবল স্বরূপ আনন্দময় থাকে। কিন্তু ভিন্ন তত্ত্বের   মধ্যে স্বরূপ আনন্দের উপর স্বরূপ-শক্তির আনন্দ বিলাস করে। ভগবান স্বরূপানন্দ অপেক্ষা স্বরূপ শক্তির দ্বারা অধিক আনন্দিত হন। ভগবান হলেন শক্তি, রাধারানী হলেন শক্তিমান, শক্তি ও শক্তিমানকে পৃথক করা সম্ভব নয়। ঠিক যেমন, সূর্য (শক্তি) থেকে সূর্যকিরণ (শক্তিমান) আলাদা করা সম্ভব নয়; চিনি (শক্তি) থেকে মিষ্টতা (শক্তিমান) আলাদা করা সম্ভব নয়। সেইজন্য শক্তি ও শক্তিমান্ অভিন্ন হলেও ভিন্নতায় প্রাধান্য অধিক, কারণ তাতে বিলাস রয়েছে, বিলাসের মধ্যে রস আস্বাদন হয়। শ্রীকৃষ্ণ রস-স্বরূপ, রস আস্বাদন করা এবং রস আস্বাদন করানো তাঁর স্বভাব। প্রিয়জনের বশ্যতা স্বীকার করে শ্রীকৃষ্ণ রসিকশেখর, নাগর শেখর হয়েছেন।

যিনি ভগবৎ-স্বরূপ প্রীতিতে বশ্যতা স্বীকার করেছেন, সেই ভগবৎ-স্বরূপে অধিক রূপগুণ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, অর্থাৎ মাধুর্য প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য স্বরূপে ভগবান্ সকলকে নিজের বশে রেখে লীলা করেছেন, কারোর বশীভূত হন নি। কিন্তু স্বয়ং-রূপের লীলায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ স্বকীয় ঐশ্বর্য ভুলে অপূর্বভক্ত বাৎসল্যের ফলে ভক্তের বশীভূত হয়েছেন। সেই অধিনতা শ্রীভগবানের পরম প্রিয়তম। শ্রীভগবান্ আত্মারামতা, পূর্ণকামতা, মহাযোগেশ্বরতা আদি গুণসমূহ অর্থাৎ স্বরূপানন্দ গুণ পরিত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ভক্তবশ্যতা অর্থাৎ স্বরূপ শক্তি দ্বারা বিলাস পরিত্যাগ করতে পারেন না। অধিকন্তু আদরের সঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করে থাকেন। এই স্বভাব যে শক্তি দ্বারা তিনি লাভ করেছেন তাই হ্লাদিনী শক্তি। এই হ্লাদিনী শক্তির ঘনীভূত বিলাসের নাম ‘প্রেম’। আবার প্রেমের ঘনীভূততম অবস্থায় প্রেমকে ‘মহাভাব’ বলা হয়। এই মহাভাবই শ্রীরাধার স্বরূপ। মহাভাব কৃষ্ণপ্রেমের ঘনীভূত অবস্থা। তাই মহাভাবকে কৃষ্ণপ্রেমের বিকার বলে অভিহিত করা হয়েছে।

 

➡️ ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে’ বলা হয়েছে-

রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয়-বিকার।

স্বরূপশক্তি —‘হ্লাদিনী’ নাম যাঁহার ।।

হ্লাদিনী করায় কৃষ্ণে আনন্দাস্বাদন।

হ্লাদিনীর দ্বারা করে ভক্তের পোষণ।।

   —– (চৈ. চ. আদি ৪/৫৯,৬০)

“হ্লাদিনী শক্তি স্বরূপা শ্রীরাধারাণী শ্রীকৃষ্ণকে আনন্দ আস্বাদন করান এবং ভক্তদেরকে ভজনানন্দ দান করে পোষণ করেন। হ্লাদিনী ভক্তদেরকে ভজনানন্দ দেন বলে ভক্তরা ভগবানের সেবা না করে থাকতে পারেন না। সুতরাং ভক্তদেরকে আনন্দ দেওয়া কৃষ্ণ-সুখে পর্যবেশিত হয়েছে। কৃষ্ণসুখ চিন্তা ছাড়া হ্লাদিনী স্বরূপা রাধারাণীর কোন সত্তা নেই। শ্রীরাধারাণীর কাছে কৃষ্ণ পরিপূর্ণ রূপে বশীভূত হয়েছেন। সমস্ত ভগবৎ স্বরূপের যত প্রকার কান্তাগণ আছেন, তাদেরকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়, যথা লক্ষ্মীগণ, মহিষীগণ এবং ব্রজাঙ্গনাগণ

—পরব্যোমে দ্বারকা, মথুরা এবং বৃন্দাবন লোকে যে সমস্ত কান্তাগণ আছেন, তাদের মধ্যে ব্রজঙ্গনাগণই শ্রেষ্ঠ। ব্রজে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও মাধুর্য পূর্ণতমরূপে অভিব্যক্ত হলেও ঐশ্বর্য মাধুর্যের অনুগত। মাধুর্যের অধিনে ঐশ্বর্য রয়েছে। সুতরাং ব্রজে মাধুর্যেরই পূর্ণ প্রাধান্য। সেইজন্য ব্রজে কান্তাপ্রীতি।

—-পরব্যোমে (বিষ্ণুলোক, বৈকুণ্ঠ) লক্ষ্মীগণ শ্রীরাধার বৈভব বিলাস। লক্ষ্মীগণ স্বরূপে শ্রীরাধা থেকে অভিন্ন হলেও শ্রীরাধা দ্বিভুজা, কিন্তু লক্ষ্মীগণ চতুর্ভুজা। সুতরাং আকার গতিভেদ আছে। শ্রীরাধা সর্বশক্তি গরীয়সী, লক্ষ্মীগণ সেরূপ নন। এই সমস্ত কারণে লক্ষ্মীগণ শ্রীরাধার বৈভব-বিলাসাংশ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

—দ্বারকায় মহিষীগণ হচ্ছেন শ্রীরাধার বৈভব প্রকাশ, মূল স্বরূপের মতো আবির্ভাব সমূহকে প্রকাশ বলা হয়। শ্রীরাধা দ্বিভুজা, মহিষীগণও দ্বিভুজা। এইজন্য শ্রীমহিষীদেরকে শ্রীরাধার প্রকাশ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু মহিষীদের মধ্যে শ্রীরাধা অপেক্ষা কম শক্তি অর্থাৎ সৌন্দর্য-মাধুৰ্যাদি কম প্রকাশিত হয়েছে বলে মহিষীগণ শ্রীরাধার বৈভব প্রকাশ।

আকার স্বভাব-ভেদে ব্রজদেবীগণ।

কায়ব্যূহরূপ তাঁর রসের কারণ।।

                                         —–(চৈ. চ. আ. ৪/৭৯)

ব্রজদেবীরা শ্রীরাধার কায়ব্যূহ রূপ অথবা আবির্ভাব-বিশেষ রূপে এবং স্বভাবে প্রত্যেকেরই মুখ্যাদি অঙ্গের গঠন ভিন্ন ভিন্ন, স্বভাবও ভিন্ন ভিন্ন, কেউ ধীরা, কেউ প্রখরা, কেউ স্বরূপা, কেউ বিপক্ষা, কেউ সুহৃদপেক্ষা, কেউ নিরপেক্ষা ইত্যাদি। বিভিন্ন গোপীতে বিভিন্ন কান্তাপ্রেম বৈচিত্র্য। রসসৃষ্টির জন্য শ্রীরাধাই এইরূপ বিচিত্র স্বভাব ও বিচিত্র রূপ বিশিষ্ট বহু গোপসুন্দরী রূপে আত্ম প্রকট করেছেন। সুতরাং বহু গোপ সুন্দরীর সঙ্গে বিলাস করা মানেই শ্রীরাধার সঙ্গে বিলাস করা।

পদ্ম পুরাণে ‘পাতালখণ্ডে’ বলা হয়েছে, “গোপ্যৈকয়া বস্তেত্র পরিচিত্রিত সর্বদা।” অর্থাৎ “বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ একজন মাত্র গোপীর সঙ্গে ক্রীড়া করেন।” এই উক্তি দ্বারা শ্রীরাধার সর্বোৎকর্ষতা সূচিত হয়েছে এবং এটিও সূচিত হয়েছে যে, অসংখ্য গোপীর সঙ্গে ক্রীড়াও একা রাধার সঙ্গে ক্রীড়া। যেহেতু শ্রীরাধাই অনন্ত গোপীরূপে আত্মপ্রকট করে শ্রীকৃষ্ণকে লীলারস আস্বাদন করান। বহুকান্তা ব্যতীত শৃঙ্গার রসের পুষ্টি সাধিত হয় না, বিশেষতঃ রাসলীলা সম্পাদিত হতে পারে না; অর্থাৎ বহুকান্তাদ্বারা সম্পাদিত নৃত্য, গীত ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান হতে পারে না। এটাই হচ্ছে রাসলীলা এবং এই রাসলীলাতেই শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত ইচ্ছার সমাপ্তি। এই রাস-লীলা শ্রীরাধাই করিয়ে থাকেন। শ্রীরাধাই হচ্ছেন রাসলীলার শৃঙ্খল। রাসলীলা সম্পাদনের জন্যই শ্রীরাধা বহু গোপসুন্দরী রূপে আত্ম প্রকট করেছিলেন।

বহু কান্তা বিনা নহে রসের উল্লাস।

লীলার সহায় লাগি’ বহুত প্রকাশ।।

তার মধ্যে ব্রজে নানা ভাব-রস-ভেদে।

কৃষ্ণকে করায় রাসাদিক-লীলাস্বাদে।।

—–(চৈ. চ. আদি ৪ / ৮০, ৮১)

অতএব শ্রীরাধারাণীই হচ্ছেন সর্বলক্ষ্মীময়ী, সর্ব-ঐশ্বর্য্যময়ী, আদিশক্তি। যেহেতু শ্রীজগন্নাথ রাধা-বিরহ-বিধুর, তাই এই অধ্যায়ে শ্রীমতী রাধারাণীর স্বরূপ বর্ণনা করা হল।

 

রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতির্হ্লাদিনীশক্তিরস্মা-

দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।

চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং

রাধাভাবদ্যুতি সুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।।

রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ভগবানের হ্লাদিনী শক্তির বিকার শ্রীমতি রাধারানী ও কৃষ্ণ একাত্মা হলেও তাঁরা অনাদিকাল থেকে গোলোকে পৃথক দেহ ধারণ করে আছেন। এখন সেই দুই চিন্ময় দেহ পুনরায় একত্রে যুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে প্রকট হয়েছেন। শ্রীমতী রাধারানীর এই ভাব ও কান্তিযুক্ত শ্রীকৃষ্ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যকে আমি প্রণতি নিবেদন করি। (চৈ.চ.আদি ৪।৫০)

(হরেকৃষ্ণ)

আরও পড়ুন: Desire, Karma and Destiny || বাসনা, কর্ম ও কর্মফল

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.