Join to Our Community
Community Grows With You

সরস্বতী দেবী (Saraswati Devi) কে?✸সরস্বতী পূজা (Saraswati Puja)

সরস্বতী পূজা (Saraswati Puja) পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে আমরা উচ্চারণ করি — বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।” অর্থাৎ, দেবী সরস্বতী বেদ, বেদান্ত, বেদাঙ্গের জ্ঞান দান করেন; জাগতিক অনিত্য বিদ্যা দান করা দেবীর প্রকৃত কার্য নয়, যদিও অধিকাংশ মানুষ মায়াকবলিত জাগতিক বিদ্যা কামনা করেন। কিন্তু পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরা দেবীর কাছে কৃষ্ণভক্তিরূপ জ্ঞান প্রার্থনা করেন এবং কৃষ্ণভক্তি প্রতিকূল জাগতিক মোহরূপ অজ্ঞানতা হতে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করেন, আর এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বা শ্রীমদ্ভাগবতাদি শাস্ত্র পাঠের পূর্বে আমরা একটি স্তুতি সরস্বতী দেবীর রূপ করি — 

❝ নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ॥ ❞

সংসার বিজয়ী বৈদিক শাস্ত্র উচ্চারণ করার পূর্বে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নর-নারায়ণ ঋষি নামক ভগবদবতার, বিদ্যাদেবী সরস্বতী এবং শাস্ত্রসমূহের প্রণেতা মহর্ষি ব্যাসদেবকে প্রণতি নিবেদন করে তারপর পাঠ শুরু করা হয়। বিদ্যা, জ্ঞান, মেধা, কলা এবং শুদ্ধতার অধিষ্ঠাত্রী বেদমাতা সরস্বতীর কৃপা প্রার্থনা করে তারপর ভগবত্তত্ত্বস্বরূপ অমৃত সমুদ্রে অবগাহন করা যায়। প্রচলিত রীতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবনে বা শিল্পীরা তাদের শিল্পের ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের জন্য সরস্বতী পূজা করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে, দেবী সরস্বতীর তার চেয়েও মহত্বপূর্ণ স্থান আছে বৈদিক ধর্মে। 

◼️ সরস্বতী দেবী কে? ◼️

🌸 সরস্বতী দেবী জ্ঞান, সঙ্গীত, কলা এবং বিদ্যার দেবী। সরস্বতী শব্দটিসার এবংস্ব দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ যিনি কারো মধ্যে সার জ্ঞান প্রকাশ করেন। আবার সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত সুরস-বতি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে জলের আধার। দেবী সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবীমূর্তি এবং নদী দুই রূপেই প্রকটিত। ঠিক যেমন গঙ্গাদেবী নদী এবং দেবী উভয় রূপেই নিজেকে প্রকাশিত করেন। ঋগবেদে (২/৪১/১৬) বর্ণনা করা হয়েছে—

❝ অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী।
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি॥ ❞

অনুবাদ: মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করুন।

🌸 ঋগবেদে (১/৩/১১-১২) আরও বর্ণনা করা হয়েছে—

❝ চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী॥ 

মহো অর্নঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি॥ ❞

অনুবাদ: সত্য ও প্রিয়বাণীর (মঙ্গলজনক বা মানব হিতকর কথা) প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞান সমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং ধারণাবতী বুদ্ধি সমূহকে দীপ্তি দান করেন।

🌸 ঋগবেদে (৭/৩৫/১১) সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে—

❝ শংনো দেবা বিশ্বদেবা ভবন্তু শং সরস্বতী সহধীভিরস্তু। ❞

অনুবাদ: জ্ঞান জ্যোতির রক্ষক বিদ্বানেরা আমাদের কল্যাণ সাধন করুন। বিদ্যাদেবী সরস্বতী নানা প্রকারে বুদ্ধির সাথে কল্যাণদায়িনী হোক।

🌸 দেবী সরস্বতী দুই রূপেই জগজ্জীবের কল্যাণ সাধন করেন। বৈদিক শাস্ত্রে সরস্বতী দেবীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় — ব্রাহ্মণী (জ্ঞান-বিজ্ঞানের দেবী), বাণী এবং বাচী (বাদ্যগীত এবং বচন), বর্ণেশ্বরী (বর্ণের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বায় অবস্থান করেন), বীণাপাণি, সারদা, ভারতী, মেধা, বাগেশ্বরী, বাক্, জ্ঞানদা এছাড়াও আরো বিভিন্ন নামে দেবীকে অভিহিত করা হয়।

◼️ সরস্বতী দেবীর রূপ ◼️

পদ্মপুরাণে উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্এ বর্ণিত হয়েছে ━

❝ শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বর ধরা নিত্যং শ্বেতগন্ধানুলেপনা॥ 

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥

বন্দিতা সিদ্ধগন্ধবৈচিতা সুরদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈ ঋষিভিঃ ভূয়তে সদা॥ ❞

অনুবাদ: দেবী সরস্বতী সাদা পদ্মফুলের আসনে উপবিষ্টা, সাদা ফুলের দ্বারা সজ্জিতা, মুক্তা বা স্ফটিকের সাদা জপমালাধারিণী, সাদা চন্দন যুক্তা, সাদা রঙের বীণা যন্ত্র ধারণ করে আছেন, যিনি শুভ্রকান্তি এবং সাদা অলংকার ভূষিতা, তিনি সিদ্ধ, গন্ধর্ব, দেবতা, অসুর সকলের দ্বারা বন্দিতা, সমস্ত মুনি-ঋষি তাঁর পূজা ও স্তুতি করেন।

সরস্বতীর একাধিক রূপভেদ আছে। বঙ্গদেশে তাঁর দ্বিভুজা বীণাপাণি রূপের পূজার প্রচলন আছে, অন্যান্য স্থানে তিনি চতুর্ভুজা। পুষ্পমাল্য শোভিত চতুর্ভুজা দেবী সরস্বতীর পরনে শুভ্র বস্ত্র, হংসবাহিনী, এক হাতে পুস্তক যা জ্ঞানের প্রতীক, এক হাতে জপমালা এবং অপর দুই হাতে বীণা বাজিয়ে ভগবানের মহিমা কীর্তনে রত। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই মূর্তিতে গভীর তত্ত্ব নিহিত রয়েছে ━

✸তাঁর এক হাতে পুস্তক বিদ্যা তথা জ্ঞানের প্রতীক, এক হাতে জপমালা সাধনা তথা ভক্তির প্রতীক, অপর দুই হাতে বীণা শিল্পকলার প্রতীক।

✸তিনি শ্বেতপদ্মের উপর বসে আছেন। পদ্ম গভীর কাদায় তথা পঙ্কে জন্মায়, কিন্তু কাদা তাকে স্পর্শ করে না। কাদা ভেদ করে সে সূর্যালোকের দিকে ধাবিত হয়। তেমনি সরস্বতীর কৃপায় যার অজ্ঞানতা দূর হয়ে জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হয়েছে, তিনি জড়জগতের পাপপঙ্কিলতা ভেদ করে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আকাঙ্ক্ষায় ধাবিত হন

✸দেবীর বাহন রাজহংস। হংস জলে সাঁতার কাটলেও জল তাকে স্পর্শ তথা সিক্ত করতে পারে না। তেমনি যার ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান আছে, তিনি জাগতিক পরিবেশে বিচরণ করলেও জাগতিক মোহমায়া তাকে স্পর্শ করে না

✸মাতা সরস্বতীর মধ্যে আমরা শ্বেত বর্ণের প্রাধান্য পাই। শ্বেত তথা সাদা রংটি সত্ত্বগুণ, শুদ্ধতা, নির্মলতা এবং জ্যোতির্ময়তার প্রতীক

◼️ সরস্বতী পূজা ◼️

মাঘমাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা (Saraswati Puja) অনুষ্ঠিত হয়। এদিন দেবী সরস্বতী চিন্ময় জগতে গোলোকধামে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় শরীর থেকে আবির্ভূত হন এবং এই তিথিতে তিনি জগতে সকল যুগে সমাদরে পূজিত হবেন বলে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আশীর্বাদ করেন। এই তিথিকে শ্রীপঞ্চমীও বলা হয়। কারণ, এদিন সরস্বতীর সাথে শ্রীদেবী তথা লক্ষ্মীদেবীও পূজিত হন। সরস্বতী পূজার সংকল্পের মন্ত্রেই সরস্বতীর সহিত লক্ষ্মী ও নারায়ণের পূজা করার কথা বলা আছে।

সরস্বতী পূজায় বিশেষত লেখনী-মস্যাধার (দোয়াত-কলম) ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমরা দেখি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহাসমরোহে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন পুস্তক, কলম, বাদ্যযন্ত্র দেবীর চরণে সমর্পণ করে পূজা করা হয়, শিশুদের হাতেখড়ি বা বিদ্যারম্ভ করা হয়, দেবী সরস্বতীর প্রিয় পলাশ ফুল নিবেদন করা হয়। এছাড়া কুল বা বড়ই, আমের মুকুল, যবের শীষ এবং হলুদ ফুল দেবারও রীতি আছে। প্রচলিত রীতি অনুসারে, সরস্বতী পূজার আগে বিদ্যার্থীরা কুল খান না। এর পেছনে এক ইতিহাস রয়েছে। সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদরিকাশ্রমে তপস্যা করেছিলেন। তপস্যা শুরুর পূর্বে তাঁর তপস্যাস্থলের সন্নিকটে একটি কুল বা বরইবীজ রেখে শর্ত দেয়া হলো, এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হবে।

সরস্বতী পূজা পালিত হবে  ━

ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 14-ফেব্রুয়ারি-2024 (বুধবার)
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ লা ফাল্গুন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

◼️ সরস্বতী দেবীর মন্ত্রসমূহ ◼️

সরস্বতী দেবীর প্রণাম মন্ত্র

=========================

❝ ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিদ্যারূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমহস্তুতে॥ 

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে॥ ❞

অনুবাদ: হে বিদ্যাদেবী সরস্বতী, পদ্মফুলের মতো তোমার চক্ষু, তুমি বিশ্বরূপা। হে বিশাল (দিব্য) চক্ষুদানকারী দেবী, আমাকে বিদ্যা প্রদান করুন। তোমাকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার (দু হাতে প্রণাম নিবেদন করি) করি। সমগ্র বিশ্বচরাচরে দেবীর জয় জয়াকার হোক। যাঁর মুক্তাহার দিয়ে কুচযুগ শোভিতা অর্থাৎ যাঁর অঙ্গুলীর অগ্রাংশ দীপ্তিময় মুক্তোমালা দ্বারা শোভিত (কুচ = বৃদ্ধা ও মধ্য অঙ্গুলীর অগ্রাংশ,  যুগ = দীপ্তিময় , শোভিত = শোভা পাওয়া), বীনা দ্বারা রঞ্জিতা এবং যিনি হস্তে পুস্তক ধারন করে থাকেন সেই ভগবতী (নারী রূপী পরমাত্মা/ঈশ্বর) ভারতী (বাণী) দেবীকে দু হাতে প্রণাম নিবেদন করি।

সরস্বতী দেবীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র

============================

❝ ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে॥ 

এষ সচন্দন গন্ধপুষ্পাঞ্জলি ওঁম্‌ শ্রীশ্রীসরস্বতীদেব্যৈ নমঃ॥ ❞

 

❝ ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিদ্যারূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমহস্তুতে॥

এষ সচন্দন গন্ধপুষ্পাঞ্জলি ওঁম্‌ শ্রীশ্রীসরস্বতীদেব্যৈ নমঃ॥ ❞

❝ ওঁ সা মে ভবতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী।
মুরারীবল্লভাং দেবী সর্ব শুক্লা সরস্বতী॥

এষ সচন্দন গন্ধপুষ্পাঞ্জলি ওঁম্‌ শ্রীশ্রীসরস্বতীদেব্যৈ নমঃ॥ ❞

❝ ওঁ সরস্বত্যৈ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ॥

এষ সচন্দন গন্ধপুষ্পাঞ্জলি ওঁম্‌ শ্রীশ্রীসরস্বতীদেব্যৈ নমঃ॥ ❞

সরস্বতী দেবীর প্রার্থনা মন্ত্র

============================

❝ ওঁ যথা ন দেবো ভগবান ব্রহ্মা লোকপিতমহঃ।
ত্বং পরিত্যজ্য সংতিষ্ঠেৎ তথাভব বরপ্রদ॥ 

ওঁ বেদা শাস্ত্রাণি সর্ব্বাণি নৃত্যগীতাদিকঞ্চযৎ।
না বিহীনা ত্বয়া দেবীর তথা মে সন্তু সিদ্ধয়ঃ॥

ওঁ লক্ষীর্মেধা ধারা তুষ্টি গৌরি পুষ্টিঃ প্রভা ধৃতি।
এতাভিঃ পাহি তনুভিরষ্টাভির্মাং সরস্বতী॥ ❞

সরস্বতী দেবীর বন্দনা

============================

নমঃ নমঃ সরস্বতী তুমি বীণাপাণি ।
বাকদেবী শ্বেতকায়া কত রূপে জানি ॥
হংস-বাহিনী মাতা কত শুনি নাম ।
তোমার চরণে মাগো করি যে প্রণাম ॥
বীণা-পুস্তক-ধারিনি , সুমতি দায়িনি ।
স্মরণ করি যে মাগো চরণ দু’খানি ॥
অজ্ঞান-আঁধারে তুমি আলো করো দান ।
তোমার কৃপায় মাগো হই জ্ঞানবান ॥
তুমি বিনা ত্রিভুবনে সবে জ্ঞান হীন ।
মানব-দানব-দেব তোমার অধীন ॥
সুর-লয়-তাল বোধ তোমার কৃপায় ।
স্বর্গ-মর্ত সুরাসুরে তব গুণ গায় ॥
সর্বভূতে জ্ঞান রূপে তুমি সংস্হিতা ।
আমার হৃদয়ে থাকো সদা বিরাজিতা ॥
তোমার আশীষ পেয়ে ধন্য হবো মাগো ।
জ্ঞানদায়ী মাতা তুমি হৃদয়েতে জাগো ॥

◼️ সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব ◼️

চিন্ময় জগতে সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব
===============================

দেবী সরস্বতী সৃষ্টির আদিতে চিন্ময় জগতে পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জিহ্বা থেকে আবির্ভূত হয়েছেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (প্রকৃতিখণ্ড— ২.৫৪-৫৫) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে ━

❝ এতস্মিন্নন্তরে দেবীজিহ্বাগ্রাৎ সহসা ততঃ।
আবির্ভূব কন্যৈকা শুক্লবর্ণা মনোহরা॥ 

পীতবস্ত্রপরীধানা বীণাপুস্তকধারিণী।
রত্নভূষণভূষাঢ্যা সর্ব্বশাস্ত্রাধিদেবতা॥ ❞

ব্রহ্মসংহিতায় (৫.২৪-৫.২৫) বলা হয়েছে, যখন ব্রহ্মা ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে সৃষ্টি হলেন, তখন তিনি তাঁর চারপাশে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। বহু চেষ্টা করেও তিনি তার উৎপত্তির কারণ জানতে পারলেন না। তখন বৈকুণ্ঠনিবাসিনী দিব্যা সরস্বতী তাঁকে দৈববাণী করেন তপস্যা করার এবং তাঁকে পরমপবিত্র কৃষ্ণমন্ত্র দান করেন।

এজন্য পদ্মপুরাণে সরস্বতী স্তোত্রে বলা হয়েছে ━

❝ সা মে বসতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী।
মুরারিবল্লভা দেবী সর্বশুক্লা সরস্বতী॥ ❞

এখানে মুরারিবল্লভা শব্দে তাঁকে ভগবৎপ্রিয়া রূপেই বর্ণনা করা হচ্ছে (মুরারি ভগবান শ্রীহরির অপর নাম)। তবে পরবর্তীকালে লীলা বিস্তারের উদ্দেশ্যে জড়জগতে ভগবানের গুণাবতার ব্রহ্মার পত্নী তথা সৃষ্টিকারিণী জ্ঞানশক্তি রূপে আবির্ভূত হন।

জড়জগতে সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব
=============================

এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিত, চিন্তা করছেন। এমন সময় তাঁর শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হয়। দেবী ব্রহ্মাকে বলেন, হে বিধাতা, আমি আপনার থেকেই প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আপনি আমার স্থান এবং আমার কী কর্ম তা নির্দেশ করুন।

ব্রহ্মা বললেন, তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করো সকলের জিহ্বাতে। বিশেষভাবে বিদ্বান (সুশিক্ষিত) ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করো। পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হও।

দেবী সরস্বতী প্রশ্ন করলেন, হে বিধাতা, আপনি বললেন, আমি সবার জিহ্বাতে অবস্থান করব, আবার বললেন, বিদ্বান ব্যক্তিদের জিহ্বাতে নৃত্য করব; আবার বললেন, নদীরূপে থাকব। এর ব্যাখ্যা কী?

তখন ব্রহ্মা বললেন, হে সরস্বতী, তুমি যখন লোকের জিহ্বাতে অবস্থান করবে, তখন লোকের জিহ্বা থেকে বাকশক্তি হবে। তাই তোমার নাম বাক্‌দেবী। তুমি আমার মুখ থেকেই প্রকাশিত। তুমি পবিত্রবতী। জগৎসংসারে বহু অপবিত্র মানসিকতাসম্পন্ন জীব থাকবে, অপবিত্র মানুষদের জিহ্বায় কদর্য বাক্য নির্গত হবে, সেসব জিহ্বায় তুমি সুখী হতে পারবে না, সেজন্য সুশিক্ষিত ব্যক্তির জিহ্বাতে তুমি অবস্থান করে সুখী হতে পারবে। হে সরস্বতী, তুমি সাক্ষাৎ বুদ্ধিস্বরূপিনী। তুমি বলো, কোথায় তুমি আনন্দ লাভ করবে?

সরস্বতী বললেন, যে সমস্ত ব্যক্তি পরমসুন্দর পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেন, তাঁদের জিহ্বায় সর্বদা পরম প্রভুর নাম কীর্তিত হবে। আমি তাঁদের পবিত্র জিহ্বায় অধিষ্ঠান করব। যে সমস্ত ব্যক্তি ভগবদ্বিমুখ মানসিকতা নিয়ে থাকবে, তাদের জিহ্বায় আমি নিছক ছায়ারূপে বিরাজ করব। আর আমি হিমালয়ে নদীরূপে প্রবাহিত হলে, ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত আমার তটে বসে ভাগবত কথা কীর্তন করবে, লিপিবদ্ধ করবে। আর আমার তটে ভগবানের নামকীর্তন হলে আমি আনন্দিত হবো। আমিও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের নাম গান করেই আনন্দিত থাকবো।

◼️ সরস্বতী দেবীর পরিচয় ◼️

দেবী সরস্বতীর দুটি স্বরূপ। 

(১) পরা সরস্বতী চিজ্জগতে অধিষ্ঠান করে জীবকে পরমতত্ত্বজ্ঞান তথা ভগবদ্ভক্তি প্রদান করেন;

(২) আবার, অপরা সরস্বতী জড়জাগতিক ব্যক্তিদের জাগতিক বিদ্যা, নৃত্য, কলা, সংগীত তথা জাগতিক অনিত্য জ্ঞান দান করেন তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে। দেবী সরস্বতী ভগদ্ভক্তদের প্রকৃত কৃপা করে তাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলন করেন এবং তাদের প্রতি স্নেহশীলা। কিন্তু তিনি জাগতিক ভোগাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিদের কপট কৃপা করেন। তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখি রামায়ণে।

রাম লীলায় অংশগ্রহন
===================

যখন কুম্ভকর্ণ কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর চাইবে, তখন ব্রহ্মা চিন্তা করলেন, এর মতো মহাবলশালী পাষাণপ্রাণ রাক্ষস নিশ্চয়ই এমন কোনো বর চাইবে, যা জগতের জন্য ক্ষতিকর। তখন তিনি সরস্বতীর শরণাপন্ন হলেন। বাগ্‌যন্ত্রের অধীশ্বরী দেবী সরস্বতী তখন কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় আবির্ভূত হন। তখন কুম্ভকর্ণ ‘ইন্দ্ৰাসন’ বলতে গিয়ে ‘নিদ্রাসন’ চেয়ে বসলো। ফলে, কুম্ভকর্ণ স্বর্গের ইন্দ্রের আসনের পরিবর্তে বছরে ছয় মাস মহানিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকতো। আর এভাবে সরস্বতী দেবী দেবরাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করেন এবং ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের রাবণ বধের অংশস্বরূপ কুম্ভকর্ণকে বিনাশে সমর্থ হয়। 

কৃষ্ণ লীলায় অংশগ্রহন
===================

একদা গোকুলে বৃষভানু নামে এক মহান রাজা বাস করতেন। পরমেশ্বর শ্রীহরির প্রীতিসাধনের উদ্দেশ্যে বৃষভানু রাজা রাজসূয় প্রভৃতি শত শত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন। অবশেষে যথাবিধানে তিনি প্রজেয় বাসিন্দা বিষ্ণুভক্ত বিন্দুগোপের কনিষ্ঠা কন্যা গুণবতী কীর্তিদার পাণিগ্রহণ করেন। বহুদিন অতিবাহিত হলো। তাদের কোনও সন্তান জন্মাল না।

সন্তান লাভের নিমিত্তে বহু রকমের যজ্ঞ, দান, পূজা-অর্চনা, তীর্থ সেবা প্রভৃতি করেও ফল হলো না। বৃষভানু নিজেকে অত্যন্ত পাপী বলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। সাধ্বী পত্নী কীর্তিদা তাকে সুস্থ করিয়ে বললেন, চলো যাই, আমরা দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা করি। তখন তারা দু’জনই কাত্যায়নী দেবীর আরাধনা করতে আরম্ভ করলেন। সহসা একদিন বিদ্যাবুদ্ধিদাত্রী সরস্বতী দেবী আকাশ মার্গে আবির্ভূত হয়ে বলতে লাগলেন—

❝ হরিনাম বিনা বৎস কর্ণমুদ্ধিঃ ন জায়তে।
তস্মাৎ শ্রেয়স্করং রাজন্ হরিনামানুকীর্তনম্॥ 

গৃহান্ হরিনামানি যথাক্রমমনিন্দিত॥ ❞

অনুবাদ: হে বৎস! হরিনাম বিনা কারও কর্ণশুদ্ধি হয় না। সেইজন্য হে বৃষভানু! শ্রেয়স্কর কোন বিষয় যদি পেতে চাও তবে যথাবিধি হরিনাম গ্রহণ করো। হে বৃষভানু, তুমি যাও, মহামুনি ক্রতুর আশ্রমে গিয়ে তাঁর কাছে হরিনাম গ্রহণ করো। এভাবে তিনি হরিনামকে জগতের কাছে মহিমান্বিত করলেন।

দেবী সরস্বতী জ্ঞান, বিদ্যা, মেধা, স্মৃতি, কলা, বাণীরূপে আছেন। আবার, তাঁর নদী স্বরূপের উল্লেখ বিভিন্ন শাস্ত্রে আছে। তাঁর সরস্বতী নামের মধ্যে জলের সম্পর্ক আছে (সরস অর্থ জল)। ঋগ্বেদে ( ২/৪১/১৬) তাঁকে নদীতমা বলা হয়েছে।

❝ অশ্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি।
অপ্রশস্তা ইব স্মসিপ্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি॥ ❞

অনুবাদ: মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করুন।”

আমরা আজও জলশুদ্ধির মন্ত্রে যে সাতটি পবিত্র নদীকে আহ্বান করি, তার একটি সরস্বতী নদী-

গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধো কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু॥ ❞

প্রয়াগধামে তিন পবিত্র নদী-গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটেছে, যেখানে স্নান করতে অসংখ্য লোক সমাগম হয়। সরস্বতী নদীর তীরেই ব্যাসদেব শ্রীমদ্ভাগবতাদি শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন।

◼️ ভগবদ্ভক্তদের কাছে দেবী সরস্বতীর গুরুত্ব ◼️

🌸 দেবী সরস্বতী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী, তাঁর শক্তি এবং তাঁর ভক্তরূপে পরমা বৈষ্ণবী। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় স্তোত্র জগন্নাথ অষ্টকমে চতুর্থ শ্লোকে বলা আছে – রমাবাণী রামঃ স্ফুরদমলপদ্মেক্ষণমুখৈঃ অর্থাৎ, লক্ষ্মী (রমা) এবং সরস্বতী (বাণী) পত্নীরূপে ভগবান শ্রীজগন্নাথের সঙ্গে সর্বদা আছেন।

🌸 আমরা দেখি মাতা সরস্বতীর হাতে বীণা যন্ত্র রয়েছে। এই বীণা বাজিয়ে তিনি কোনো জড়জাগতিক গান করছেন না, তিনি নিত্য শ্রীহরিনাম সংকীর্তনে রত আছেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর রচিত শিক্ষাষ্টকমে প্রথম শ্লোকে বলেছেন – চেতোদর্পণমার্জনং ভবমহাদাবাগ্নিনির্বাপণং, শ্রেয়ঃকৈরবচন্দ্রিকাবিতরণং বিদ্যাবধূজীবনম্। অর্থাৎ, এই শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন হল বিদ্যাবধূর জীবনস্বরূপ, আর সরস্বতী মাতা স্বয়ং বিদ্যাবধূ।

🌸 আবার, রায় রামানন্দকে মহাপ্রভু প্রশ্ন করেছিলেন ━

প্রভু কহে, কোন বিদ্যা বিদ্যা মধ্যে সার।
রায় কহে, কৃষ্ণভক্তি বিনা বিদ্যা নাহি আর॥ ❞

অর্থাৎ, কৃষ্ণভক্তি ছাড়া সকল বিদ্যাই প্রকৃতপক্ষে অবিদ্যা। তাই বিদ্যারূপিণী সরস্বতী তাঁর শুদ্ধ স্বরূপে মায়াবদ্ধ জীবকে ভগবভক্তির জ্ঞান দিয়ে তাদের অবিদ্যা নাশ করেন। দেবী সরস্বতী সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের অধীশ্বরী, আর বৈদিক শাস্ত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শ্রীমন্মহাপ্রভুর উক্তি ━

❝ গৌণ মুখ্য বৃত্তি বা অন্বয় ব্যতিরেকে।
বেদের প্রতিজ্ঞা কেবল কহয় কৃষ্ণকে॥ ❞

🌸 একইভাবে, মহাভারতের শেষেও বলা হয়েছে বেদ, বেদান্ত, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ আদি শাস্ত্রগ্রন্থসমূহের মূল উদ্দেশ্য পরমেশ্বর শ্রীহরির মহিমা প্রকাশ করা তাহলে আমরা বুঝতে পারি, বৈদিক শাস্ত্রের মাধ্যমে ভগবানের মহিমাকে বাণীবাক্যে প্রকাশ করছেন বাণীর মূর্তরূপ দেবী সরস্বতী। তাই সরস্বতী পূজার পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার মন্ত্রে আমরা উচ্চারণ করি—বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ। অর্থাৎ, দেবী সরস্বতী বেদ, বেদান্ত, বেদাঙ্গের জ্ঞান দান করেন; জাগতিক অনিত্য বিদ্যা দান করা দেবীর প্রকৃত কার্য নয়, যদিও অধিকাংশ মানুষ মায়াকবলিত জাগতিক বিদ্যা কামনা করেন। কিন্তু পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের ভক্তরা দেবীর কাছে কৃষ্ণভক্তিরূপ জ্ঞান প্রার্থনা করেন এবং কৃষ্ণভক্তি প্রতিকূল জাগতিক মোহরূপ অজ্ঞানতা হতে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করেন, আর এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

🌸 দেবী সরস্বতী যে ভগবদ্ভক্তদের ওপর বিশেষভাবে কৃপালু, তার একটি নিদর্শন আমরা দেখতে পাই চারটি স্বীকৃত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি শ্রীসম্প্রদায়ের মূল আচার্য, শ্রী রামানুজাচার্যের জীবনে। সেসময় শঙ্করাচার্যের মায়াবাদী দর্শনের অনুকূলে ব্রহ্মসূত্রের টীকা সর্বত্র জনপ্রিয় হয়েছিল, যেখানে পরমেশ্বর ভগবানের সচ্চিদানন্দ রূপকে অস্বীকার করা হয়েছিল। সমস্ত ভারতে পণ্ডিত সমাজে যখন এই শঙ্কর ভাষ্য ছড়িয়ে পড়েছে, তখন রামানুজাচার্য এই ভক্তিবিরোধী মায়াবাদকে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মসূত্রের বৈষ্ণব ভাষ্য লেখার সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় বৈদিক গ্রন্থাবলি এত সুলভ ছিল না। তাই তিনি ব্রহ্মসূত্রের লিখিত রূপ পাবার উদ্দেশ্যে সুদূর কাশ্মীরের সারদাপীঠে (বর্তমানে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর) গমন করেন। সারদাপীঠ (সারদা সরস্বতীর অপর নাম) দেবী সরস্বতীর তীর্থ এবং তৎকালীন বৈদিক জ্ঞান অর্জনের জন্য পণ্ডিতদের সমাগমস্থল ছিল। কিন্তু সেখানকার পণ্ডিতেরা রামানুজ আচার্যকে ব্রহ্মসূত্রের লিপি দেখাতে অস্বীকার করে। বিফলমনোরথ হয়ে রামানুজ যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখন পীঠের অধীশ্বরী দেবী সরস্বতী স্বয়ং তাঁর হাতে ব্রহ্মসূত্রের লিপি তুলে দেন। সেই লিপি পেয়ে রামানুজ ব্রহ্মসূত্রের বৈষ্ণব ভাষ্য লিখে মায়াবাদ খণ্ডন করেন।

◼️ আমরা কোন বিদ্যা চাইব? ◼️

🌸 শুদ্ধভক্তগণও সরস্বতী পূজা করেন। কিন্তু মায়াবদ্ধ ও মায়ামুক্ত জীবের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে তাদের পূজায়ও পার্থক্য আছে। মায়াগ্রস্ত জীবের মায়িক বস্তুতে আসক্তি থাকে। যখন জীব মায়ার সেবায় প্রবৃত্ত হন, তখন তিনি কর্মী; আবার যখন মায়ার বিদ্যাবৃত্তির সেবায় রত হন, তখন তিনি জ্ঞানী। ঈশোপনিষদে ( শ্লোক-৯) বলা হয়েছে—

❝ অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহবিদ্যামুপাসতে।
ততো ভূয় ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ॥ ❞

অর্থাৎ, যারা অবিদ্যা অনুশীলন করে, তারা অজ্ঞানের ঘোর অন্ধকারময় লোকে প্রবেশ করে, যারা তথাকথিত বিদ্যা অনুশীলনে রত, তারা আরো ঘোরতর অন্ধকারময় স্থানে গতি লাভ করে।

অর্থাৎ অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক, তবে বিপথচালিত বা ভ্রান্ত বিদ্যা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। গণশিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতা যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পারমার্থিক বিদ্যা বা পরা বিদ্যা। সেখান থেকে বিমুখ হয়ে জড়-জাগতিক উন্নতিতে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায়, মানুষ পূর্বাপেক্ষা আরো অধিক অসুখী হয়ে পড়ছে।

🌸 বিদ্যাবৃত্তি জড় আসক্তিকে বিনাশ করে, আর অবিদ্যাবৃত্তি জড় বিষয়ে আসক্তি বৃদ্ধি করে। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ জীবগণ অবিদ্যায় অবস্থিত। অবিদ্যার আবরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ আচ্ছাদিত। যারা মায়ামুক্ত, তাঁরা বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ের স্বরূপ সম্যক প্রকারে অবগত আছেন। তারা নিজেদের ভগবানের দাস জ্ঞান করে ভগবানের সেবায় প্রবৃত্ত হন। মায়াবশীভূত জীবগণ সত্ত্ব, রজতমো গুণে আবদ্ধ হয়ে দেবতাদের ভজনা করেন। অর্থাৎ, মায়ার ব্রহ্মাণ্ডের আবরণে স্থিত দেবতাদের উপাসনা করেন। বিভিন্ন গুণসম্পন্ন জীবগণ তাদের নিজ নিজ রুচি অনুসারে শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য বা বৈষ্ণব নামে অভিহিত হন। তারা ভোগবাসনা চরিতার্থ করার জন্য ধন কামনায় দেবী লক্ষ্মী এবং বিদ্যালাভ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লৌকিক প্রথা অনুসারে দেবী সরস্বতীর পূজা করেন।

তারা যে বিষয় কামনায় পূজা করেন তা সবই নশ্বর। আমি ধনী হবো, পণ্ডিত হবো, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবো, সমগ্র জগতে আমার যশ কীর্তিত হবে। এসমস্ত বাসনা সবই নশ্বর।

🌸 চারবেদ ষড় দর্শন অধ্যয়ন করেও যদি ভগবানের প্রতি অহৈতুকী ভক্তির উদয় না হয় তবে সবই বৃথা। শাস্ত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে—

আচারহীনং ন পুনন্তি বেদা.. যে বস্তু দেহত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্যাগ করে সেসমস্ত বিষয় নিয়ে নিত্য আত্মার কতটুকু স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে? তাই যারা উন্নত বিচারবোধসম্পন্ন, তারা কখনো নশ্বর বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের সুযোগটুকু হেলায় হারাতে ইচ্ছা করেন না। ঐকান্তিকী ভক্তগণ সরস্বতী দেবীকে চিৎ-শক্তিরূপে পূজা করেন

🌸 ভাগবত কীর্তনের প্রারম্ভে শ্রীল সূত গোস্বামী মঙ্গলাচরণের মধ্যে পরাবিদ্যাস্বরূপিনী সরস্বতীর প্রণাম করছেন যে, দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদীরয়েৎ । আদিগুরু শ্রীব্রহ্মার হৃদয়ে জড় জাগতিক সৃষ্টি বিষয়ক স্মৃতি প্রকাশের জন্য যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিতা হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন।

❝ পূর্বে জন্মিলেন নাভিপদ্ম হৈতে।
তথাপিও শক্তি নাই কিছুই দেখিতে॥ 

তবে যবে সর্বভাবে লইলা শরণ।
তবে প্রভু কৃপায় দিলেন দরশন॥

তবে কৃষ্ণকৃপায় স্ফুরিল সরস্বতী। ❞

এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যারা শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পণ করেন, কৃষ্ণের কৃপায়ই তাদের সরস্বতীদেবীর কৃপা লাভ হয়। সরস্বতী নামরূপে তাদের জিহ্বায় নৃত্য করে থাকেন। বিদ্যা দুই প্রকার— পরা বিদ্যা (নশ্বর জড় বিদ্যা) এবং অপরা বিদ্যা (ভগবদ্ সম্বন্ধীয় বিদ্যা)। দুই প্রকার বিদ্যা লাভের তারতম্য হেতু সরস্বতী দেবীর আরাধনা দুই প্রকার। একটি পরাবিদ্যা লাভ করার জন্য, আরেকটি অপরা বিদ্যা লাভের জন্য। এক স্বরূপে দেবী অপরা সরস্বতী, অন্য স্বরূপে দেবী পরা সরস্বতী বা শুদ্ধা-সরস্বতী

🌸 অপরা সরস্বতী আমাদের কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য বিষয় অর্থাৎ মায়িক বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেন। আর শুদ্ধা-সরস্বতী কৃষ্ণভজনের অনুকূল পথ প্রদর্শনপূর্বক শরণাগত ভক্তের জিহ্বায় নৃত্য-কীর্তন করেন। দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরী, কবি কালিদাস অপরা সরস্বতীর কপট কৃপা লাভ করেছিলেন। সরস্বতীর কপট কৃপায় মহাপ্রভুর প্রকটকালীন নবদ্বীপের সকলেই যথেষ্ট পাণ্ডিত্য প্রতিভা লাভ করেছিলেন। শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর বলেন— সরস্বতী প্রসাদে সবাই মহাদক্ষ কিন্তু পরাবিদ্যাস্বরূপিনী শ্রীসরস্বতীর প্রভু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিকট সকলেরই প্রতিভা পরাভূত হয়েছিল। শ্রীমন্মহাপ্রভুর দিগ্বিজয়ীর দর্প-দমন-লীলায় দেখতে পাওয়া যায়, মহাপ্রভুর কাছে পরাভূত হওয়ার পর সরস্বতী দেবী স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে কেশব কাশ্মিরীকে বললেন—

❝ সরস্বতী বলেন, শুনহ বিপ্রবর।
যাঁর ঠাঞি তোমার হইল পরাজয়॥ 

অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড-নাথ সেই সুনিশ্চয়॥
আমি যাঁর পাদপদ্মে নিরন্তর দাসী।

সম্মুখ হইতে আপনারে লজ্জা বাসী॥ ❞

অনুবাদ: সরস্বতী বললেন, তুমি এতদিন আমার যে মন্ত্ৰ উচ্চারণ করেছ, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হওয়া তার ফল নয়। তুমি যে সাক্ষাৎ পরমেশ্বরের দর্শন লাভ করলে, এটাই তার চরম ফল। তুমি শীঘ্র গিয়ে তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করো। এরপর দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত সরস্বতীর নির্দেশে মহাপ্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

এখন নির্ণয় আমাদের হাতে, আমরা সরস্বতীর কপট কৃপা লাভ করব, নাকি অকপট কৃপা লাভ করে কৃষ্ণভক্তিবিজ্ঞান লাভে প্রয়াসী হবো। যদি কৃষ্ণভক্তি লাভ হয়, তবে সরস্বতী দেবীর কৃপা আমাদের এমনিতেই লাভ হবে।  — হরেকৃষ্ণ

◼️ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে দেবী সরস্বতী ◼️

দেবী সরস্বতী কেবল হিন্দুদের নয়, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মেও পূজিত হন। বিশেষ করে বজ্রযান বৌদ্ধগণ দেবী সরস্বতীর আরাধনা ব্যাপকভাবে করে থাকেন। এছাড়া, জাপানে সরস্বতী বেঞ্জাতেন নামে পরিচিত, যিনি দ্বিভুজা এবং বীণাপাণিরূপে অধিক পূজিতা। ক্ষেত্র বিশেষে তান্ত্রিক সরস্বতীর মতো অষ্টভুজা রূপও দেখা যায়, সেখানে বড় বড় সরস্বতী মন্দির আছে। কোথাও কোথাও এসব মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই, তবে মন্দিরগুলো জলের মধ্যে, যেহেতু সরস্বতীর সাথে নদী বা জলের সম্পর্ক আছে (সরস্বতীর নদী স্বরূপ আছে) তাই জল রূপেও তিনি পূজিত হন।

ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দেশেও রাস্তা ঘাটে বহু জায়গায় সরস্বতীর মূর্তি তারা তাদের আদি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্থাপন করেছে। গ্রিক এবং মধ্যপ্রাচ্যেও সরস্বতী সদৃশ দেবীমূর্তি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে। এতে বোঝা যায়, সরস্বতী ভারতের বাইরেও ব্যাপকভাবে পূজিতা ছিলেন । মহাভারত বা ভাগবতাদি শাস্ত্রে যে বলা হয়েছে, পূর্বে সারা পৃথিবী বৈদিক সংস্কৃতির অধীনে শাসিত হতো, বেদমাতা সরস্বতীর বিভিন্ন দেশে এই প্রভাব সেই হারিয়ে যাওয়া সত্যের ইঙ্গিত করছে।

আরও পড়ুন: দামোদর কে?✸দামোদর লীলা (দামবন্ধন লীলা✤Damodar Lila)মাহাত্ম্য✸

আরও পড়ুন: Gopashtami❖গোপাষ্টমী (গোপ অষ্টমী বা গোষ্ঠাষ্টমী) মাহাত্ম্য

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.