Join to Our Community
Community Grows With You

বৈষ্ণব সঙ্গের গুরুত্ব✤Significance of Vaishnava association?✤

একথা সত্য যে, পূর্ব জন্মের সুকৃতি ছাড়া কৃষ্ণভক্তি ও বৈষ্ণব সঙ্গ (Vaishnava association) হয় না। সুতরাং, সাধু গুরু বৈষ্ণব পদধূলি হচ্ছে পূর্ব জন্মের সুকৃতি স্বরূপ যা সাধনভজন না করলে এবং সাধুসঙ্গ বৈষ্ণবসঙ্গ না করলে পাওয়া যায় না। 

যার যে কুলেই জন্ম হোক না কেন, যার যেমন গুণই থাক না কেন, সে যদি শ্রীভগবানের শুদ্ধভক্তের কৃপা লাভ করে তখন তার আর এই জাগতিক মায়াবদ্ধতা থাকে না। সে তখন শুদ্ধভক্তির দ্বারা শ্রীভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করে চিন্ময় পরিবেশে বিরাজ করে। শ্রীভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সবকিছুই হচ্ছে চিন্ময়। 

রাস্তার ধুলিকণা যখন বায়ুর সঙ্গ লাভ করে, তখন সে বায়ুর সাথে উর্ধ্বগামী হয়। আবার যখন সে বৃষ্টির জলের সঙ্গ পায়, তখন সে নর্দমার কাদায় পরিণত হয়। সুতরাং সঙ্গ খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষকে তার সঙ্গের মাধ্যমেই চেনা যায়, সে কোন প্রকৃতির। যদি আমাদের ভগবানে প্রতি ভক্তিভাব ও ভালোবাসা জাগ্রত করতে হয়, তাহলে অবশ্যই ভক্ত সঙ্গ (বৈষ্ণব সঙ্গ) করতে হবে। কারণ শাস্ত্রে আছে, ভক্তি প্রজায়তে সাধু সঙ্গে, ━ অর্থাৎ ভক্তির জন্ম হয় সাধু সঙ্গের ফলেই। কথায় আছে, ━

❝সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস
অসৎ সঙ্গে নরগে বাস
সাধু ও বৈষ্ণব সঙ্গে হয় সিদ্ধি লাভ।❞

꧁✸ বৈষ্ণব সঙ্গে দস্যু রত্নাকর হলেন বাল্মিকী মুনি ✸꧂

মৃগারী ব্যাধ অরণ্যে শিকার করে বেড়াত, জীব হত্যা করত। কিন্তু সেই ব্যাধও অবশেষে শ্রীভগবানের শুদ্ধভক্ত নারদ মুনির সংস্পর্শে এসে, তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে একজন শুদ্ধভক্তে পরিণত হয়েছিল। বাল্মিকী মুনি প্রথম জীবনে একজন দস্যু ছিলেন। সে সময় তিনি দস্যু রত্নাকর নামে পরিচিত ছিলেন। তার পেশা ছিল ডাকাতি করা। মানুষকে হত্যা করে তাদের ধন দ্রব্যাদি অপহরণ করতেন। এইসব দুষ্কর্ম নিয়েই তিনি থাকতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দস্যু রত্নাকর নারদ মুনির সান্নিধ্য লাভ করে, তাঁর কৃপা প্রাপ্ত হয়ে মহর্ষি বাল্মিকীতে পরিণত হলেন। তিনি রামায়ণ রচনা করলেন এবং শুদ্ধ রামভক্তির দ্বারা তিনি ভগবদ্ধামে প্রবেশের অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

꧁✸ বৈষ্ণব শ্রীনিবাস আচার্যের কৃপায় দস্যু রাজা বীরহাম্বী হলেন ভক্ত ✸꧂

🌸 আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বৎসর আগে এই বাঙলার বনবিষ্ণুপুর রাজ্যে বীরহাম্বীর বলে এক রাজা ছিলেন। তিনি বাইরে নিজেকে খুব ভালো বলে জাহির করতেন, কিন্তু গোপনে গোপনে দুষ্কর্ম করতেন। তাঁর অধীনে কিছু গোয়েন্দা কর্মচারী ছিল, যাদের কাজ হল, রাত্রিবেলা ঐ রাজ্যের মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী যাত্রীদের ধন-রত্নের খোঁজ রাখা এবং পরে সেসব ধন-রত্ন চুরি করে, ডাকাতি করে সরাসরি রাজাকে প্রদান করা। এরপর নিঃস্ব লুণ্ঠিত যাত্রীরা যখন রাজার কাছে গিয়ে অভিযোগ করত, হে রাজা, দেখুন, আমরা আপনার রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আর আমাদের সবকিছু লুঠেরারা লুঠ করে নিয়েছে, সবকিছু ডাকাতি হয়ে গেছে অভিযোগ শুনে রাজা অত্যন্ত সহানুভূতির সুরে বলতেন, খুবই দুঃখের কথা। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি যখনই ঐ ডাকাতদের, চোরদের ধরতে পারব তখন তাদের কঠিন শাস্তি দেব। আচ্ছা, আপনারা এই অল্প কিছু টাকা নিয়ে যান এবং আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। রাজার কথা শুনে যাত্রীরা ভাবতো, ও এই রাজা কত ভালো। রাজা আমাদের সাহায্য করেছে।

🌸 এই রাজাই আবার রাজসভায় পণ্ডিতদের নিয়ে এসে ভাগবত পাঠ শুনতেন আর এদিকে মনে মনে কুকর্মের চিন্তা করতেন। বহিরঙ্গে ভক্ত, অন্তরঙ্গে চোর অবশেষে একদিন হল কি, রাজা রাজ-জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলেন দেখুন তো বিচার করে, শীঘ্রই কোন ভাল যাত্রী মূল্যবান কিছু নিয়ে আমার রাজ্যের মধ্য দিয়ে যাবে কি না। এরপর জ্যোতিষী গণনা করে বলল মহারাজ আপনার রাজ্যে মহাধন আসছে। যে সম্পদ আসছে তার মূলোর কোন সীমা পরিসীমা নেই। এত মূল্যবান ধন আপনার রাজ্যে কোনদিন আসেনি। এবং যার কাছে এই সম্পদ থাকে তার সর্বমঙ্গল হয়। এই কথা শুনে রাজা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ভাবলেন, আজ আমার ভাল দিন এসেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ তার গোপন লুঠেরা কর্মচারীদের ডেকে বললেন, দেখ, এই ধরনের সব লোক আসছে এবং তাদের কাছে এমন সম্পদ আছে যা মহামূল্যবান। তোমরা যদি এই জিনিসটি হরণ করে আমার কাছে নিয়ে আসতে পার, আমি তবে তোমাদের প্রত্যেককে এক হাজার রৌপ্য মুদ্রা পুরস্কার দেব।

🌸 সেদিন রাত্রে রাজার লুঠেরারা খোঁজ করে দেখল, গরুর গাড়ি করে কিছু যাত্রী এসেছে এবং তারা সব সাধু। যাত্রীরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের কাছে রয়েছে একটা বড় বাক্স। সেই সময় লুঠেরারা সেই বাক্সটি লুঠ করে রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজা তাদের প্রত্যেককে একহাজার রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার দিয়ে বিদায় করে দিয়ে, নিজেই বাক্সটি নিয়ে সিন্দুক গৃহে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এত মহামূল্য সম্পদ দেখে কেউ যদি পাগল হয়ে যায়। সে যদি রাজাকে হত্যা করে। তাই রাজা কাউকেই এসব দেখাতে চান না। অবশেষে রাজা বাক্সটি খুলে দেখলেন। কিন্তু একি! কোথায় হীরে-মণি-মাণিক্য মহামূল্যবান ধন সম্পদ? বাক্সটি যে গ্রন্থে পরিপূর্ণ। রাজা গ্রন্থগুলি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন। সংস্কৃত ও বাংলায় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ। কয়েকটি গ্রন্থ পড়ে দেখলেন। লেখা আছে —

❝ যারে দেখ তারে কহ ‘কৃষ্ণ’-উপদেশ।
আমার আজ্ঞায় শুরু হঞা তার এই দেশ ॥

রাজা ঠিক বুঝতে পারলেন না এগুলি কি ধরনের গ্রন্থ!

🌸 পরে তিনি রাজপণ্ডিতবর্গকে আহ্বান করে গ্রন্থগুলি দেখালেন। তারা বললেন, মহারাজ, এতো দেখছি ধর্মগ্রন্থ। রাজা বললেন, সে তো আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা কি ধরনের শাস্ত্রগ্রন্থ? পণ্ডিতেরা বললেন, সেটা আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এটা কৃষ্ণ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। রাজা এরপর পণ্ডিতদের চলে যেতে বলে ভাবতে লাগলেন, আমি নিশ্চয়ই কোন সাধু মহাত্মার গ্রন্থ চুরি করেছি। সাধুদের গ্রন্থ চুরি করার ফলে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। হায়! আমি মহাপাপ করেছি। এতদিন আমি বিষয়ী লোকেদের ধন-সম্পদ অপহরণ করে পাপ করেছি। আজ সাধুর গ্রন্থ চুরি করে মহাপাপ করলাম।

রাজা ঠিক করলেন তিনি ভাগবত পাঠ শ্রবণ করে পাপ মোচন করবেন। তিনি মনে করলেন ভাগবত শ্রবণ করে তাঁর এই পাপ মোচন হয়ে যাবে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধু পাপই নয়, পাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর মহাপরাধ করেছেন। তিনি বৈষ্ণব অপরাধ করেছেন তিনি বৈষ্ণবের গ্রন্থ চুরি করে বৈষ্ণব অপরাধ করেছেন। আর বৈষ্ণব অপরাধীকে ভগবান বাঁচাতে পারে না, কেউ তাকে বাঁচাবে না, এমন কি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করবেন না। একমাত্র যে বৈষ্ণবের চরণে অপরাধ হয়েছে, তিনি যদি ক্ষমা করেন তবেই অপরাধীর উদ্ধার হবে। এই ভেবে রাজা তার সেই গোপন লুঠেরাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার কাছ থেকে লুঠ করেছ? এই বাক্সের মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল।

লুঠেরারা জবাব দিল — হ্যাঁ, তাঁরা সাধু ছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁদের সঙ্গে লড়াই করি নি।

রাজা বললেন,— আগে কেন এ কথা আমাকে বল নি? তাহলে এগুলো ফেরত দিতে পারতাম।

লুঠেরারা বলল — আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।

রাজা তাদের নির্দেশ দিলেন,—তোমরা যেখান থেকে পার এ গ্রন্থ যাঁর, তাকে খুঁজে বের কর।” কিন্তু তারা অনেক খুঁজে খুঁজেও সাধুদের আর সন্ধান পেল না।

🌸 একদিন এক ব্রাহ্মণ এলেন রাজার সঙ্গে দেখা করতে। সে সময় রাজা ভাগবত পাঠ শ্রবণ করছিলেন। কিন্তু যিনি ভাগবত পাঠ করছিলেন, তিনি মায়াবাদীভাষ্য ব্যাখ্যা করছিলেন। সেই ভাষ্য শুনতে শুনতে ব্রাহ্মণের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। রাজা সেটি লক্ষ্য করে বললেন—এ কি! মহা পণ্ডিতের ভাগবত পাঠ শ্রবণ করে এরকম মুখভঙ্গি করছেন কেন? আপনার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?

ব্রাহ্মণ জবাব দিলেন—হ্যাঁ, উনি ভাগবত যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তা শুনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

রাজা বললেন – আপনি কি এর চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন? তাহলে আসন গ্রহণ করে আপনি তা ব্যাখ্যা করুন। আর এর চেয়ে যদি ভাল ব্যাখ্যা না হয়, তাহলে এভাবে পণ্ডিতকে অপমান করার ফলে আমি আপনাকে প্রাণদণ্ড দেব।

তখন সেই ব্রাহ্মণ আসন গ্রহণ করে ভাগবত খুলে শ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ ও বৈষ্ণববৃন্দের উদ্দেশ্যে প্রণতি নিবেদন করে ভাগবত ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। ব্রাহ্মণের ব্যাখ্যা শ্রবণে সমবেত ভক্তবৃন্দ সেখানে মুগ্ধ হয়ে গেল। রাজাও অদ্ভূত মুগ্ধতা অনুভব করলেন। রাজা নিজে বুঝতে পারলেন, এই ব্রাহ্মণ কোন সাধারণ ব্যক্তি নন, তিনি একজন মহান বৈষ্ণব। রাজার মনে সন্দেহ হল হয়ত আমি এরই গ্রন্থ চুরি করেছি। পাঠ শেষ হওয়ার পর রাজা বিনীতভাবে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত কথা আছে। আপনি যদি দয়া করে আমার সঙ্গে ভেতরে আসেন!

যে ঘরে গ্রন্থগুলি রয়েছে, রাজা ব্রাহ্মণকে সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন।

🌸 ব্রাহ্মণ বললেন, আমার নাম শ্রীনিবাস দাস। আমি শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামীর শিষ্য এবং শ্রীল জীব গোস্বামীর কাছে শিক্ষা প্রাপ্ত হয়েছি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে আবির্ভূত হয়েছেন এই জগতে কৃষ্ণভক্তি প্রচারের জন্য। তাঁর আশীর্বাদধন্য অন্তরঙ্গ পার্ষদগণ শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভু, শ্রীল সনাতন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু আচার্য বাণী গোস্বামী প্রভু বৃন্দাবনে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন চরিত চৈতন্য চরিতামৃত রচনা করলেন। আমি তাঁদের আদেশ প্রাপ্ত হয়ে শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর এবং শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভুর সঙ্গে সেই সমস্ত গ্রন্থ নিয়ে আসছিলাম। পথিমধ্যে আপনার রাজ্যে একরাত্রিতে সেইসব গ্রন্থগুলি চুরি হয়ে গেল। এখন আমার অস্থির অবস্থা। সেইসব মহান বৈষ্ণব আচার্যগণের সমগ্র জীবনের কাজ সেইসব গ্রন্থের মধ্যে ছিল। কিন্তু সেই গ্রন্থ এখন নিখোঁজ, আমরা তা খুঁজে পাচ্ছি না।

🌸 এই কথা শুনে, রাজা শ্রীনিবাস আচার্যের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলতে লাগলেন, আমাকে ক্ষমা করুন । আমাকে ক্ষমা করুন। আমি মহা-অপরাধ করেছি। আপনার গ্রন্থগুলি আমিই চুরি করেছি। এখন এই মহা অপরাধ থেকে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আজ আমি আপনাকে গুরুরূপে বরণ করলাম।

🌸 শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু তখন সব বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ওহে! আগে আমাকে সেই গ্রন্থগুলি দেখান, আমি দেখি সেই গ্রন্থগুলি আমার কিনা। আগেই কেন ও কথা বলছেন?

রাজা তখন সিন্দুক থেকে সেই ট্রাঙ্কটি বের করে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুকে দেখালেন। শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু বললেন–হ্যাঁ, এগুলি আমারই গ্রন্থ।

রাজা বললেন, এ গ্রন্থ আমার রাজ্যের মহা পণ্ডিতগণও বুঝতে পারেনি। দয়া করে তা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করুন । এই গ্রন্থের তত্ত্ব আমরা জানতে চাই।

শ্রীনিবাস আচার্য বললেন—না, এই গ্রন্থ আমি নবদ্বীপে নিয়ে যাবো। সেখানে পণ্ডিতেরা এই গ্রন্থগুলির প্রতিলিপি তৈরি করার পর আমরা তা সমস্ত বৈষ্ণবদের কাছে পৌঁছে দেব। এইভাবে তা প্রচারিত হবে।

রাজা বললেন, না, না, নবদ্বীপে যেতে হবে না, আমি পণ্ডিত নিয়ে এসে এখানে তা প্রতিলিপি তৈরি করাবো। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। এইভাবে সেই দস্যু রাজা, বৈষ্ণবের সঙ্গ প্রভাবে একজন ভক্তে পরিণত হল। অবশেষে এই রাজা বীরহাম্বীর শ্রীনিবাস আচার্যের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন ৷ এই হচ্ছে সাধু সঙ্গ বা বৈষ্ণব সঙ্গের ফল যার যে কুলেই জন্ম হোক না কেন, যার যে রকম গুণই থাক না কেন, সাধু বৈষ্ণবের সঙ্গ প্রভাবে সেও পরম ভগবদ্ভক্তে পরিণত হয়। বৈষ্ণবের সৎসঙ্গের দ্বারা বৈষ্ণবের গুণ অবৈষ্ণবের মধ্যে আপনা থেকেই রোপণ হয়ে যায়। 

বৈষ্ণব সঙ্গের ফল

===================

🌸 এই জড় জগতে মায়ার অজ্ঞানতা দূর হলেই জীবের ভগবানের প্রতি আসক্তি জন্মায়, তখনই সে আত্মিক স্তরে অর্থাৎ আমি শরীর নয়, আমি আত্মা,আমি পরমাত্মা গোবিন্দের অংশ – এই ভাবে জীব উন্নীত হয় – মুক্তির নিকট আসে, কিন্তু এই অজ্ঞানতা দূর হওয়া কোনো সহজ কথা নয়, তার জন্য সাধু গুরু বৈষ্ণব সঙ্গ ও কৃপার প্রয়োজন আছে ! গীতা ভাগবত উপলব্ধি করতে হবে।

❝ অপাকরোতি দুরিতং শ্রেয়ঃ সংযোজয়তাপি।
যশে বিস্তারয়ত্যাশু নৃণাং বৈষ্ণবসঙ্গমঃ॥❞
                         ━┉┈┈(বৃহন্নারদীয় পুরাণম্)
অর্থাৎ,
বৈষ্ণবের সঙ্গ পেলে পাপমুক্তি ঘটে।
ইহাতেই সর্ব্ব ইষ্টি জীবভাগ্যে বটে।।
🌸 “কেউ যদি বৈষ্ণবও হন, কিন্তু তার চরিত্র ভালো না হয়, তবে আমরা তাকে বৈষ্ণব হিসাবে সম্মান করবো, কিন্তু তার সঙ্গ করতে পারি না… ~শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (জয়পতাকা স্বামীকে পত্র, লস অ্যাঞ্জেলস, ৩০/০৪/১৯৭০)।
🌸 “আগুনের কাছে লোহা রাখলে যেমন ধীরে ধীরে সেটা গরম হয়, তেমনি বৈষ্ণব সঙ্গ করলে বৈষ্ণবদের মধ্যে যে চিন্ময় গুণাবলী আছে সেগুলি আমাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হয়। ~শ্রীমৎ ভক্তিপ্রেম স্বামী মহারাজ, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ক্লাস! ১ লা ডিসেম্বর, ২০২১।
🌸বৈষ্ণব সঙ্গের প্রভাবে এবং ভগবানের দিব্য নাম জপের ফলে ব্যক্তির মধ্যে বৈষ্ণবের ২৬টি গুণ সমূহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়৷ শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলায় (২২/৭৮-৮০) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন গোস্বামীকে বৈষ্ণবের ২৬ টি গুণ বর্ণনা করেছিলেন, তা হলো
১। কৃপালু
২। বিনীত
৩। সত্যবাদী
৪। সমদর্শী
৫। নির্দোষ
৬। বদান্য
৭। নম্র
৮। শুচি
৯। অকিঞ্চন
১০। সর্বোপকারক
১১। শান্ত
১২। সর্বদা কৃষ্ণের প্রতি শরণাগত
১৩। জড় বাসনা থেকে মুক্ত
১৪। জাগতিক বিষয়ে অনীহ
১৫। স্থির প্রজ্ঞাযুক্ত
১৬। ষড়রিপু-জয়ী
১৭। মিত আহারী
১৮। অপ্রমত্ত
১৯। সবাইকে সম্মান দেয়
২০। নিজে সম্মান চায় না
২১। গম্ভীর
২২। করুণাপরায়ণ
২৩। বন্ধুত্বপূর্ণ
২৪। কবি সুলভ
২৫। দক্ষ
২৬। মৌনী

꧁✸  শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর জীবনী ✸꧂

নদীয়া জেলায় অগ্রদ্বীপের উত্তরে চাখন্দি গ্রামে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু আবির্ভূত হন। তাঁহার পিতার নাম শ্রীগঙ্গাধর ভট্টাচার্য ও মাতার নাম লক্ষীপ্রিয়া। শ্রীনিবাস মাতৃগর্ভে থেকেই সমস্ত গ্রামে নামের বন্যায় ভাসিয়ে ছিলেন। সেসময় জমিদার দুর্গাদাস ঢেড়া দিয়ে আদেশ জারী করার নির্দেশ দিলেন, দেবীদুর্গার নাম ছাড়া যেন আর কেউ অন্য নাম না নেয়। এরপর ঢুলিয়ারা ঢোলে বাড়ি দিতেই ‘রাধাকৃষ্ণ’ নাম উচ্চারিত হতে লাগলো, সব লোক রাধাকৃষ্ণের নামে উন্মত্ত হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। এভাবেই শ্রীনিবাস মাতৃগর্ভে থেকেই নাম প্রেমে সকলকে মাতিয়েছিলেন।
তিনি শিশুকাল থেকেই পিতা ও মাতার মুখে স্ব-পার্ষদ ভগবান শ্রীগৌর হরির গুণ-কীর্তন শ্রবণ করতেন। তিনি বাল্যকালেই গৌর-পার্ষদ শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ও অন্যান্য বৈষ্ণবগণের কৃপা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর মাতাকে নিয়ে চাখন্দি গ্রাম থেকে মাতামহের আলয় (দাদুর বাড়ি) যাজি গ্রামে চলে আসেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর হৃদয়ে ভক্তি- প্রেম উদয় হতে থাকে। জগতের কোন বস্তুর প্রতি লালায়িত না হয়ে সর্বদা শ্রীগৌর হরির চরণ দর্শনের জন্য চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতেন। তাঁর নীলাচলে যাবার ইচ্ছা হলে শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর প্রভৃতি, গৌড়ীয় ভক্তগণের সাথে যাবার নির্দেশ দিলেন। নীলাচলে কিছুদিন অবস্থানের পর আবার তিনি গৌড় দেশে ফিরে এলেন। নবদ্বীপে যেতেই নিত্যানন্দ প্রভুঅদ্বৈত আচার্যের সংগোপন (অতিশয় গোপন কথা) শুনে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। চেতনা পেয়ে অগ্নি জ্বেলে মরবার জন্য প্রস্তুত হলেন। শ্রীনিবাসের কৃষ্ণপ্রেম বিহ্বল অবস্থা দেখে দুই প্রভু স্বপ্নে এসে দর্শন দিয়ে সান্ত্বনা প্রদান করলেন ও বৃন্দাবনে যাওয়ার আজ্ঞা দিলেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে তিনি বৃন্দাবন যাত্রা করলেন এবং শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর কাছে মন্ত্র-দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
শ্রীনিবাস আচার্য, শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু ও শ্রীনরোত্তম ঠাকুর-এই তিনজনেই শ্রীল জীব গোস্বামীর নিকট ভক্তি-শাস্ত্র অনুশীলন করতেন। ব্রজের গোস্বামীগণ এই তিনজনের দ্বারা গৌড়দেশে ভক্তি-গ্রন্থ প্রচারের সিদ্ধান্ত করলেন ও আদেশ দিলেন। তাঁরা গ্রন্থ নিয়ে গৌড় দেশের পথে এগোতে লাগলেন, তাঁরা বহু পথ অতিক্রম করিয়া হিন্দু রাজ্য বনবিষ্ণুপুরে আসলে রাজা বীর হাম্বী, গ্রন্থের সিন্ধুক দেখে, বহু ধনরত্ন আছে এমন ভেবে দস্যুগণকে অপহরণের নির্দেশ দিলেন। দস্যুগণ রাত্রিতে গ্রন্থের সিন্ধুক নিয়ে রাজার কাছে গেলে, রাজা সিন্ধুকে মূল্যবান গ্রন্থ সমূহ দর্শন করে অনুতপ্ত ও ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। শ্রীনিবাস আচার্য জনৈক ব্যক্তির কাছে অনুসন্ধান করে বনবিষ্ণুপুরের রাজার কাছে গ্রন্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা অবগত হয়ে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুকে উৎকলে ও শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে খেতুরীতে পাঠালেন এবং তিনি নিজে আমন্ত্রিত হয়ে রাজসভায় রাজা ও পারিষদ গণের কাছে ভাগবত পাঠ করলেন, পাঠ শুনে সবার চিত্ত বিগলিত হল। রাজা আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে নির্জনে শ্রীনিবাস আচার্যের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, রাণীর হৃদ্য়ও অত্যন্ত ব্যকুলিত হল। শ্রীনিবাস আচার্য তাঁদের কৃপা করলেন। গ্রন্থ প্রাপ্তি সন্দেশ ও রাজার কৃপা লাভ সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রীবৃন্দাবনে, শ্রীনরোত্তম ঠাকুর ও শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুকে সংবাদ দিলেন। শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু বনবিষ্ণুপুর হইতে যাজিগ্রাম, কাটোয়া ও নবদ্বীপ ভ্রমণ করেন।
পরবর্তীতে শ্রীখন্ড নিবাসী শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং নাম-প্রেম প্রচার ও জীব উদ্ধার করতে থাকেন। অগণিত দুঃখী পতিত জীব চরণে আশ্রয় গ্রহণ করেন। একদিন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু ভাব সমাধিস্থ হলে তিন দিন কেটে যায়। অনিষ্ট চিন্তা করে সকলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। ইতিমধ্যে সেখানে শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ এসে সব দেখে বললেন, আপনারা কেউ ক্রন্দন করবেন না। দেখি গুরুদেব কোন আনন্দে ডুবে আছেন। বলে পাশে বসে উনিও সমাধিস্থ হলেন। সমাধিতে দেখলেন রাধামাধবের যমুনায় জলবিহার চলছে। হঠাৎ রাধারানীর নাকের বেসর হারিয়ে যাওয়ায় সকলেই তন্নতন্ন করে খুঁজছেন। এইদিকে রামচন্দ্রও গুরু আনুগত্যে খুঁজতে লাগলেন। শ্রীগুরুর কৃপায় অল্প সময়ে পদ্মপত্র তলে খুঁজে পেলেন। এনে শ্রীগুরুদেবের হাতে দিলেন। উনি গুনমঞ্জরীকে দিলেন। গুনমঞ্জরী সমস্ত মঞ্জরীগনের প্রধান রূপমঞ্জরীকে দিলেন। রূপমঞ্জরী নিয়ে রাধারানীর নাসায় পরিয়ে দিলেন। রাধারানী জিজ্ঞাসা করলেন- কে পেয়েছে ?
এই নবদাসী বলে ইঙ্গিত করে জানালেন। রাধারানী কাছে ডেকে আদর করে নিজের চর্বিত তাম্বুল অধরামৃত প্রদান করলেন। ধ্যান ভঙ্গ হলে নিজহাতে চর্বিত তাম্বুল দেখে সকলে বিস্ময়ান্বিত হলেন। তাম্বুলের সুগন্ধে চারিদিক আমোদিত হল। গুরুদেব কে সমর্পন করলে সকলে সেই দিব্য অধরামৃত পেয়ে ধন্য হলেন।
Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.