Join to Our Community
Community Grows With You

ত্রিতাপ ক্লেশ / ত্রিতাপ দুঃখ কি? (What is Tritaap Kleshas)

শ্রীমদ্‌ভগবতগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “দুঃখালয়ম্‌”। এই জড়জগত দুঃখ (ক্লেশ) দিয়ে তৈরী। বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত আছে, জগতে তিন রকমের দুঃখ বিদ্যমান, যা ‘ত্রিতাপ ক্লেশ’ বা ‘ত্রিতাপ দুঃখ’ নামে পরিচিত — আধ্যাত্মিক দুঃখ, আধিদৈবিক দুঃখআধিভৌতিক দুঃখ। 

০১. আধ্যাত্মিক দুঃখ (Adhyatmik Klesha)

আধ্যাত্মিক দুঃখ হল দেহ (শরীর) ও মনের কারনে প্রাপ্ত দুঃখ। সুতরাং আমরা এই পৃথিবীতে নিজের দ্বারা যে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করি সেটাই আধ্যাতিক ক্লেশ। তাই আধ্যাত্মিক দুঃখ হল দুই রকমের– শারীরিক দুঃখ ও মানসিক দুঃখ।

—- শারীরিক দুঃখ: আমরা যে জড় দেহটি ধারণ করে রয়েছি সেই দেহটি নানা ব্যাধি, ব্যাথা, বেদনার আকর। যার কারনে আমরা দুঃখ পাই। শারীরিক দুঃখ বহু রকমের। যেমন শিরোরোগ (মাথা ব্যাথা, মাথার সমস্যা প্রভৃতি), জ্বর, শূল (পেটের যন্ত্রণা, শারীরিক ব্যাথা বেদনা), অস্থিরোগ (হাড়ের সমস্যা), কিডনি রোগ, রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া), ভগন্দর (ফিস্টুলা), অর্শ (পাইলস), শ্বাসকষ্ট, শোথ (এডিমা, edima – জলসঞ্চয়ের ফলে দেহের বিশেষত হাত -পা ফোলা রোগ), সর্দি-কাশি, অক্ষিরোগ (চোখের রোগ), অতিসার (ডায়রিয়া), কুষ্ঠ  প্রভৃতি বহু রকমের।

—– মানসিক দুঃখ: আবার মানসিক দুঃখ প্রধানত ষড়রিপু থেকে উৎপন্ন দুঃখ। রিপু অর্থ – শত্রু; পাপ প্রবৃত্তি। ষড় রিপু অর্থ – ছয়টি শত্রু বা পাপ প্রবণতা। মানুষের আত্মোন্নতি পথে, এই ষড়রিপু গুলিই প্রধান বাঁধা।

১। কাম (lust) – ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা

২। ক্রোধ (anger) – রাগ

৩। লোভ (greed) – লালসা, অন্যের জিনিস পাবার প্রবল বাসনা

৪। মদ (arrogance / vanity)  – অহংকার, দর্প ও,

৪। মোহ  (attachment)  – আসক্তি, টান

৬। মাৎসর্য (envy / jealousy) হিংসা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অন্যের ভালো দেখতে না পারা।

এই ষড়রিপুর কারনে মানুষ অপমানিত, অসম্মানিত, শোকগ্রস্ত, বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে মানসিক দুঃখ পায়। যেমন, আত্মীয় স্বজনের বিচ্ছেদ, মৃত্যুর কারণে দুঃখ, প্রিয় বস্তু হারানোর দুঃখ, অপ্রিয় বস্তুর সংযোগও দুঃখ।   

০২. আধিভৌতিক দুঃখ (Adhibhautik Klesha)

আধিভৌতিক দুঃখ হল অন্য জীবের দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখ। যেমন বিষাক্ত পোকামাকড়, জীব জন্তুর দংশন, চোর -ডাকাত-গুন্ডার উৎপাত, পকেটমার – প্রতারকের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি আমাদের দুঃখ প্রদান করে।

০৩. আধিদৈবিক দুঃখ (Adhidaivik Klesha)

আধিদৈবিক দুঃখ হল দেবতাদের দ্বারা সংঘটিত যে দুঃখ। ভূমিকম্প, ঝড়, প্রবল বৃষ্টি, বন্যা, সুনামি, প্রচণ্ড গরম, কনকনে ঠাণ্ডা, অগ্নিকাণ্ড, তুষারপাত ইত্যাদি দৈব-দুর্বিপাক থেকে উৎপাদিত দুঃখ। প্রত্যেকেই কমবেশী এ সমস্ত দুঃখে মর্মাহত হয়।

এই সমস্ত দুঃখ ছাড়া গর্ভবাস, জন্ম, জরা, অজ্ঞানতা, মৃত্যু, ভূত-পিশাচ থেকে দুঃখ এবং নরকাদিতে উৎপন্ন দুঃখও হাজার হাজার রকমের হয়।

গর্ভবাস ও জন্ম জনিত দুঃখ (Birth Klesha)

জীব যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন সে গর্ভচর্ম দ্বারা বেষ্টিত হয়ে তার পিঠ, ঘাড়, অস্থিসমূহ কুণ্ডলিত হয়ে মুচড়ানো অবস্থায় থাকে। মা যখন অতিশয় তীক্ষ্ণ টক, ঝাল, উষ্ণ, ঠাণ্ডা বা লবণাক্ত যুক্ত খাবার ভোজন করে তার ফলে জঠরস্থ জীবের কষ্ট ভীষণ বাড়তে থাকে। সে হাত-পা নড়াচড়া করতে পারে না। মলমূত্রসমেত অন্ধকারাচ্ছন্ন তরলের মধ্যে শায়িত থাকে এবং সবসময় কষ্ট অনুভব করে। সেই সময় সে সচেতন ভাবে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে থাকে এবং নিজের কর্মদোষে এমন কষ্ট পাচ্ছে বলে অনুশোচনা করে। তখন সে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে ভগবানকে এবং প্রতিজ্ঞা করে বাকি জীবন আপনার নাম কীর্তন স্মরণ করে এই জড় জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গোলক ধামে ফিরে যাব, জড় বন্ধনে আটকে পড়া জীবেদের আপনার মহিমা শ্রবণ করিয়ে তাদেরকেও মুক্ত করব।

এরপর জন্মগ্রহণ কালে তার সমস্ত শরীর মলমূত্র, রক্ত মিশ্রিত বিশেষ তরলে (অ্যামনিওটিক তরল; amniotic fluid) মাখামাখি থাকে এবং অত্যন্ত প্রবল সুতি নামক বায়ু তাঁর মুখমন্ডল নিচের দিকে করে দেয়। এরপর গর্ভসংকোচক পেশির অত্যধিক চাপে জীব মাতৃগর্ভ থেকে জরায়ুর মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে ভূমিষ্ঠ হয়, ফলে তার অস্থিবন্ধন (হাড়-কার্টিলেজ নির্মিত শরীরে) প্রচণ্ড চাপে পীড়া প্রাপ্ত হয়।

জীব জন্মগ্রহণ করার পর প্রথমে সে চাপ শূন্য অনুভূত করে, অন্ধকার মাতৃ গর্ভ থেকে বাইরের আলো দেখে ভিত হয়, খোলা মেলা হাওয়ার ছোঁয়ায় শিউরে উঠে ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে, এ এক অন্য জগত অনুভূত করে মুর্ছিত যায় এবং ধীরে ধীরে তাঁর পূর্ব জন্মের কথা, প্রতিজ্ঞার কথা সে ভুলে যায়। সে একটি কৃমির মতো মাটিতে পড়ে থাকে। নিজের দেহ নড়াচড়া করার কিংবা এদিক-ওদিক পাশ ফেরার  শক্তিটুকুও তার থাকে না। একটু দুধ পান করবার জন্য সে পরের উপর নির্ভরশীল থাকে । মল মূত্র ত্যাগ করে তাতে শুয়ে থাকতে হয় যতক্ষণ না অন্য কেউ এসে পরিষ্কার করে দেয়। মশা, মাছি, কীটপতঙ্গ কামড়ালেও তা নিবারণ করতে পারে না, আবার বিড়াল, কুকুর বা অন্য কোন হিংস্র জন্তুর কামড়ের ভয় পেলেও দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারে না।

তারপর সে তাঁর বাল্যকালে (childhood) নানা প্রকার আধিভৌতিক দুঃখ-কষ্ট পেয়ে থাকে। সে এক অচেনা, অজানা, অজ্ঞানতার ঘোরে আচ্ছন্ন থাকে। সে   কিছুতেই জানতে পারে না যে, আমি কে, আমি এলাম কোথা থেকে, এখন আমি কোথায় এসেছি , আমি কোথায় যাব, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি, আমার স্বরুপটা কি রকম, কোন বন্ধনে আমি এখানে আবদ্ধ আছি, এর পিছনে কোন কারণ আছে, অথবা এই দুঃখ ভোগ করার কারণ কি, আমার কি কর্তব্য, কি অকর্তব্য, কি বলা উচিত, কি বলা উচিত নয়, কি ভাবে চলা উচিত, কোন কাজে দোষ আছে, কোন কাজে গুণ আছে? এরকম বহু ভাবনা তাঁর মধ্যে আসে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এই সমস্ত কর্তব্য-অকর্তব্য বহুবিধ ভাবনা তাঁর থাকলেও কেবলমাত্র উদরপরায়ণ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে সে পশুর মতো জীবনযাপন করতে থাকে এবং অজ্ঞানজনিত কারনে নানভাবে নানাপ্রকার দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে থাকে।

অজ্ঞানতা হল তমোগুণের বা জড়তার স্বভাব। জড়তার আধিক্যতার কারনে ক্রমশঃ জীবের প্রবৃত্তি বা কর্ম লোপ পেতে  থাকে। অজ্ঞ ব্যক্তিরা ইহকাল বা পরকালে কেবল দুঃখই ভোগ করে থাকে। কিন্তু সুভাগ্য ক্রমে শ্রীগুরুদেবের কৃপায় সে আবার জ্ঞানালোকে ফিরে আসতে পারে।

মৃত্যু জনিত দুঃখ (Death Klesha)

জীব যখন জরাতে জর্জরিত হয় অর্থাৎ বৃদ্ধ হলে তার শরীর ক্লান্ত ও শিথিল হয়ে পড়ে, দাঁতগুলো একে একে পড়ে যায়, চোখ কোটরের মধ্যে ঢুকে যায়, চোখে ছানি পড়ে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, শরীর কাঁপতে থাকে, শরীরের অস্থিসমূহ প্রায় প্রকাশ পায়, দেহ সামনের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে ক্রমশঃ কুঁজো হয়ে যায়। সেই সময় রক্তের তেজ কমে আসে, ক্ষুধার অগ্নি প্রায় নিভে যাওয়ায় আহারে অনীহা আসে। উঠাবসা, চলাফেরা, শোওয়াবসা একলা করতে পারে না, অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। তার ইন্দ্রিয়গুলো তার আয়ন্তে থাকে না। স্মৃতি বিভ্রম ঘটে, সদ্য ঘটনাও মনে করতে পারে না। ঠাণ্ডা গরমের অনুভূতিও অনুভব করতে পারে না। সামান্য কথা বললেই হাঁফিয়ে পড়ে। শ্বাস কষ্ট ও কাশির জ্বালায় ঘুমোতে পারে না। তার শৌচক্রিয়া শয্যাতেই হয়। সেই সময় ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী, আপনজন কিংবা আত্মীয় স্বজন সকলের কাছেই অবমানের পাত্র হতে হয়। এর মধ্যে যদি তিনি আহার-বিহারে হঠাৎ বেশি ইচ্ছা প্রকাশ করলে পরিজনগণের কাছে হাসির কারণ হন। তার জন্যও অনেকে ব্যতিব্যস্ত হয়। যৌবনের মধুর স্মৃতিগুলি কখনও কখনও সে স্মরণ করে আনন্দিত হয় এবং বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে নিতান্ত দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানি নিজের কানে শুনে ভয়ে তার শরীর কাঁপতে থাকে।

এভাবে বৃদ্ধকালে মানসিক, শারীরিক নানপ্রকার দুঃখ কষ্ট পেতে পেতে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। প্রায়ই সে মূর্ছিত হয়ে যায় এবং থেকে থেকে অল্পসল্প জ্ঞানে ফিরে আসে। কিন্তু  সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, সেই সময়ও সে মায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে সাংসারিক মমতায় আকুল হয়ে চিন্তা করতে থাকে “আমার এই ঐশ্বর্য, আমার বাড়ি গাড়ি, আমার জমানো অর্থ – সোনা গহনা, আমার স্বামী-স্ত্রী ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে, আমাকে ছাড়া তাদের কিভাবে চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।” ভাবনায় কেবল আমার আমার। সত্যি বলতে কি এইসময় সে নিজেকে সংসারে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, বিচক্ষন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে মনে করে।

নিদারুণ মারাত্মক মৃত্যু যন্ত্রণায় পীড়িত হয়ে তার দেহের সমস্ত অস্থিবন্ধন (হাড়-কার্টিলেজ নির্মিত শরীর) বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তার দুটি চোখ ঘুরতে থাকে, তালু, ঠোঁট, গলা শুকিয়ে যায়। শ্লেষ্মা বা কফে কণ্ঠরোধ হয়ে যায়। কানে সোঁ সোঁ তীব্র শব্দে তালা ধরে যেতে থাকে। নার্ভের যন্ত্রণায় সে অস্থির হয়ে পড়ে, সাথে অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাত-পা কাঁপতে থাকে, সময়ের সাথে তার তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। সে কিছু দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু মূহ্যমান শরীরে সে বিস্ফোরিত চোখে কিছু দেখতে পায় না, সবই ঝাপসা হয়ে যায়। অন্তর ফাটিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু হয় সে বলতে পারে না বা পারলেও সব জড়িয়ে মুড়িয়ে ক্ষীণ শব্দ বেরিয়ে আসে।  কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সে বোঝাতে পারে না। কেউ কিছু বললেও সে শুনতে পায় না।

আমাদের শরীরের নয়টি দ্বার আছে – দুটি চক্ষু, দুটি কর্ন, দুটি নাসিকা, মুখগহ্বর, লিঙ্গপায়ু

আত্মার বহিরাগমনের প্রক্রিয়া অনুসারে বোঝা যায়,আত্মাটি ঊর্ধ্বগামী অর্থাৎ স্বর্গলোকগামী হবে নাকি অধোগামী অর্থাৎ নরকগামী হবে। আত্মা যদি শরীরের উপরিভাগ (অর্থাৎ দুটি চক্ষু, দুটি কর্ন, দুটি নাসিকা,বা মুখগহ্বর) থেকে নির্গত হয় তবে জীবাত্মা স্বর্গলোকগামী হয়।  বিপরীতক্রমে জীবাত্মা শরীরের নিম্নভাগ (অর্থাৎ লিঙ্গ বা পায়ু) থেকে নির্গত হওয়ার ফলে মানুষটির মলমূত্র সহযোগে মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে আত্মা অতি অবশ্যই অধোগামী অর্থাৎ নরকগামী হয়। উর্দ্ধগামী হলে দেবতারা যাত্রাপথের সহযোগী হয়,তেমনই নরকগামী হলে যমদূতেরা তত্ত্বাবধায়ক হয়।

গীতায় স্পষ্টতঃ ভগবান উল্লেখ করেছেন – মৃত্যুর সময় মানুষ যেমন চিন্তায় মগ্ন থাকে,পরবর্তী দেহ সেই হিসাবে গঠিত হয়। মৃত্যুর পর আত্মা দেহের উপরিভাগ থেকে বের হবার পর কর্মের পুণ্যফল অনুযায়ী আত্মা স্বর্গে সুখ ভোগ করে। স্বর্গে দেবদূতরা ফুলের মালা পরিয়ে স্বর্গলোকে আমন্ত্রণ জানায়। পুণ্যফল যত শেষ হতে থাকে একে একে মালার ফুলগুলি শুকিয়ে যেতে থাকে, সম্পূর্ণ পুণ্যফল শেষ হয়ে গেলে মালা শুকিয়ে যায়। তারপর পাপ কর্মফল অনুযায়ী আত্মাকে নরকে পাঠানো হয় এবং পাপের শাস্তি ভোগ করে। মৃত্যুর পর আত্মা দেহের নিম্নভাগ থেকে বের হবার পর প্রথমে নরকে যন্ত্রণা দেওয়া হয়, যদি তার কিছু পুণ্যফল থাকে তবে স্বর্গে পাঠানো হয়। পাপ ও পুণ্যফল ভোগের শেষে পূর্বজন্মের কর্মফল অনুযায়ী পুনরায় নতুন দেহ ধারণের জন্য সে প্রস্তুত।

যে সমস্ত মানুষ কৃষ্ণস্মরণ ভুলে শুধুমাত্র ষড়রিপু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন,তাদের সঙ্গে যমদূতেরা কিভাবে আচরন করে,তা ভাগবতে উল্লেখ রয়েছে। গরুড় পুরাণ অনুযায়ী মৃত্যুর প্রাক্কালে ভয়ঙ্কর বিকট চেহারার দুই যমদূত আসে। মৃত্যুর পরে আত্মাকে নিতে আসা সেই রাগান্বিত, ভয়ঙ্কর, বিস্ফোরিত চোখ যুক্ত যমদূতদের দেখেই সেই ব্যক্তি ভয়ে মলমূত্র ত্যাগ করে মৃত্যু হয়। তখন সে যমদূতদেরকে দেখলেও অন্য কেউ তাদেরকে  দেখতে পায় না। সম্পূর্ণ একাকী অসহায় অবস্থায় নিপীড়িত হয়ে যমদূতদের সঙ্গে যমলোকে নিয়ে গিয়ে সেখানে প্রথম ২৪ ঘণ্টার জন্য রাখা হয় এবং সেই ব্যক্তিকে নিজের চোখের সামনে জীবনে কত পাপ এবং কত পুণ্য করেছে সমস্ত ঘটনা দেখানো হয়। এরপর আত্মাকে আবার সেই ঘরে বা স্থানে রেখে দেওয়া হয় যেখানে সে দেহ ছেড়েছিল। এর পরে, তাকে ১৩ দিন মৃত্যু পরবর্তী পিণ্ড ও শ্রাদ্ধ কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। পিণ্ড দান করার সময় চারটি অংশে ভাগ করা হয় – এর মধ্যে দুটি অংশ মৃতব্যাক্তি গ্রহণ করে, তৃতীয় অংশ যমদূত গ্রহণ করে এবং চতুর্থ অংশটি পাপী আত্মার রূপে ভূত গ্রাস করে।  ১৩ দিন পর তাকে আবার যমলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। 

দেশের সংবিধান লঙ্ঘনকারীকে যেমন প্রশাসনের তরফ থেকে পুলিশ দন্ড দেবার জন্য গ্রেপ্তার করে, তেমনই শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তি জ্ঞানত ও অজ্ঞানত কোনভাবে যদি ভগবানের তৈরি আইন (ভাগবতগীতা, ভাগবতম্‌ এ উল্লেখিত) লঙ্ঘন করে, সেক্ষেত্রে যমরাজের তরফ থেকে যমদূতেরা শাস্তি দেবার জন্য তাকে যমলোকে নিয়ে যায়। তাই কৃষ্ণবিস্মৃত ও শাস্ত্রলঙ্ঘনকারী, অপরাধজনক ইন্দ্রিয়তৃপ্তির কাজে যুক্ত এরূপ ব্যক্তিদের যমদূতেরা তাদের সূক্ষদেহকে (মন,বুদ্ধি ও অহঙ্কার দ্বারা আত্মার আবরণ) আচ্ছাদিত করে,গলায় দড়ি বেঁধে যমালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে শতসহস্র নরক থাকলেও ব্যাসদেবের পুত্র শ্রীল শুকদেব গোস্বামী শ্রীপরীক্ষিৎ মহারাজের কাছে মাত্র ২৮ প্রকারের নরকের বর্ণনা করেছেন। নরকে নানা দুদ্ধর্মের ফলস্বরূপ প্রচণ্ড যাতনা ভোগ করবার জন্য যাতনা শরীর প্রাপ্ত হয়। শাস্তির প্রকারভেদ অনুযায়ী তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন নরকে যাতনা দিয়ে তাকে পরবর্তী যোনির জন্য তৈরি করা হয়। যেমন, কোন জীবাত্মা তার কর্মফলের কারনে শূকর যোনি প্রাপ্ত হল, তখন তাকে নরকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মলমূত্র, নোংরা ভক্ষণ করিয়ে করিয়ে প্রস্তুত করান হয়, কর্মফলের শাস্তি শেষে তাকে এই বদ্ধ জড় জগতে নিক্ষেপ করা হয়।

সুতরাং কেবল নরকে যে দুঃখ আছে তা নয়। ঘদি তার পুণ্য কর্ম ফলে স্বর্গ সুখ লাভ করে থাকেও সেখানেও পতন ভয় আছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন —

তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি।

এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৯/২১)

অনুবাদঃ তাঁরা সেই বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করে পুণ্য ক্ষয় হলে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন। এভাবেই ত্রিবেতোক্ত ধর্মের অনুষ্ঠান করে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আকাঙ্ক্ষী মানুষেরা সংসারে কেবলমাত্র বারংবার জন্ম-মৃত্যু লাভ করে থাকেন।

‘ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি’ – অর্থাৎ সঞ্চিত পুণ্যের  ফলে বহুবিধ স্বর্গীয় সুখ ভোগ করার পর পুণ্য ক্ষীণ হয়ে এলে পুনরায় পৃথিবীতে পতিত হয়ে আবার জন্ম নিতে হয়। আবার নরকে কষ্ট যন্ত্রণা ভোগের পর পাপীর পাপ ক্ষীণ হয়ে এলে পুনরায় তাকে পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয়।

পাপের মাত্রা (বেশি বা কম), হিংস্রতা ও তীব্রতার (খুনি, আত্মঘাতী, চোর, ছিনতাইবাজ, পকেটমার, লোভী, অহংকারী, পাপাচারী প্রভৃতি) উপর পাপের কর্মফল নির্ধারিত হয়। সেই পাপ কর্মফলের উপর ভিত্তি করে কেউ মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে, কেউ সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর, কেউ বাল্যকালে, কেউ যৌবনে, কেউ প্রৌঢ় বয়সে, কেউ বা বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। মৃত্যু হল জীবের অন্তিম পরীক্ষা এবং তা আসবেই এটাও নিশ্চিত, তবে এই পরীক্ষায় উতরে আপনি ভগবতধামে যাবেন, নাকি স্বর্গ বা নরকে আটকে জড় জগতে বারবার যোনি চক্রে আবর্তিত হবেন সবই নির্ভর করছে আপনার কর্মফলের উপর।     

সংসারে জীব সুখ-সম্পদ লাভের জন্য নানা ভাবে বহু রকমের চেষ্টা-চরিত্র করে থাকে। কিন্তু অর্থের নাশে, অর্জনে এবং পালনে নানা রকমের দুঃখ উৎপন্ন হয়ে থাকে। যে যে পদার্থ মানুষের আনন্দজনক বলে মনে হয় সেই সমস্তই পরিণামে দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। স্ত্রী, সন্তান, চাকর বাকর, ঘর বাড়ি, জায়গা জমি এবং বিষয় সম্পদ ইত্যাদি দ্বারা মানুষের যত পরিমাণে ক্লেশ উৎপন্ন হয়, তার অপেক্ষা সুখের ভাগ অত্যন্ত অল্প।

অনবরত এই গর্ভ, জন্ম, জরা ইত্যাদি অবস্থাতে আধ্যাত্মিক প্রভৃতি ত্রিবিধ দুঃখের একমাত্র সনাতন ঔষধ হল পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীচরণপদ্ম আশ্রয় করা। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, তস্মাৎ তৎ প্রাপ্তয়ে যত্নঃ কর্তব্যঃ পন্ডিতৈর্নরৈঃ – পণ্ডিত ব্যক্তিরা সর্বদা ভগবৎ প্রাপ্তির নিমিত্ত যত্ন করবেন।

 

আরও পড়ুন: জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র (Cycle of Birth and Death) ও ৮৪ লক্ষ যোনি

আরও পড়ুন: ত্রিতাপ ক্লেশ / ত্রিতাপ দুঃখ কি? (What is Tritaap Kleshas)

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.