এই মনুষ্য জীবনে, এই ভক্তি জীবনে তুলসী মাহাত্ম্য (Tulasi Mahatyam) কি অবশ্যই প্রত্যেকের জানা দরকার। সেই সঙ্গে জানা দরকার তুলসী পূজা পদ্ধতি, তুলসী প্রনাম মন্ত্র, তুলসী প্রদক্ষিণ মন্ত্র, তুলসী জলদান মন্ত্র, তুলসী চয়ন মন্ত্র, তুলসী ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র তুলসী স্তব এবং বিধি-নিষেধ কি ইত্যাদি।
❝ বৃন্দায়ৈ তুলসী দেব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ।
বিষ্ণুভক্তি প্রদে দেবী সত্যবত্যৈ নমো নমঃ॥ ❞
শ্রীমতী তুলসীদেবী হলেন শ্রীকৃষ্ণ ভক্তিদায়িনী, শ্রীকৃষ্ণপ্রেম প্রদায়িনী, সর্বদুঃখহারিণী এবং শ্রীকৃষ্ণের সাথে মায়াবদ্ধ জীবের মিলনকারিণী। গোলকবাসিনী শ্রীমতী তুলসীদেবী শ্রীকৃষ্ণের প্রাণপ্রেয়সী। শ্রীমতী তুলসীদেবী হলেন পুষ্পসারা (সমস্ত ফুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠা), পূজ্যা ও মনোহরা। তিনি প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শিখার মত সমস্ত পাপ দহনকারিনী। সমস্ত দেবীগনের মধ্যে যিনি পবিত্র রূপা এবং যাঁর তুলনা নেই, তিনি ‘তুলসী’ নামে কীর্তিতা হন। তিনি সকলের প্রার্থনীয়া, শিরোধার্যা, বিশ্বপাবনী নামে প্রসিদ্ধা, এবং মুক্তি ও হরি ভক্তিদায়িনী।
বৃহৎ ধর্ম পুরাণে বলা হয়েছে – শ্রীমতী তুলসী দেবী দ্বিভুজা, শ্যামাঙ্গী, চারুবদনী, শ্বেতবসনা, শঙ্খ-পদ্ম হস্তযুক্তা এবং নানা প্রকার অলঙ্কারে বিভূষিতা। তিনি ভক্তের সর্বার্থ সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন।
বৃক্ষরূপে অবস্থিতা তুলসীদেবী বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকেন। যেমন- হরিৎ বর্ণ, কৃষ্ণ বর্ণ, সবুজ বর্ণের এবং কখনো মিশ্রিত বর্ণের হয়েও থাকে। বৃক্ষরূপে অবস্থিতা তুলসীদেবীর প্রতি পাতায় দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র বিরাজমান। আবার প্রতি বর্ণে বা অক্ষরে ভগবান বিষ্ণুর সহস্র নাম বিরাজমান। এই পৃথিবীতে তুলসীদেবী কখনো শঙ্খচূড়ের পত্নীরূপে, কখনো জলন্ধরের পত্নীরূপে, কখনো ধর্মদেবের পত্নীরূপে, কখনো বা ভগবান বিষ্ণুর নয়নাশ্রু থেকে আবির্ভূতা হয়েছেন। তিনি যখন যেভাবেই আবির্ভূতা হোন না কেন, সর্বাবস্থায় তিনি শ্রীকৃষ্ণপরায়ণা ছিলেন। এই জগতে তাঁর কোন তুলনা নেই। তাই ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে বলা হয়েছে ━
❝ পুষ্পেষু তুলনাপ্যস্যা নাসীদ্ দেবীষু বা মুনে।
পবিত্র রূপা সর্বসু তুলসী সা চ কীৰ্ত্তিতা॥ ❞
অনুবাদ: “হে মুনে! সমস্ত পুষ্পসমূহের মধ্যে এবং সমস্ত দেবীগণের মধ্যে যাঁর কোন তুলনা নেই, সেই কারণে সমস্ত পুষ্প ও দেবীগণের মধ্যে এই দেবী তুলসী পবিত্ররূপা বলে অভিহিত করা হয়েছে।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই তুলসী ব্যতীত কোন ভোগ্যবস্তুই গ্রহণ করেন না। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে ━❝ছাপান্ন ভোগ ছত্রিশ ব্যঞ্জন, বিনা তুলসী প্ৰভু একোনাহি মানি।❞ এইভাবে দেখা যায়, শ্রীমতী তুলসী দেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রাণপ্রিয়া অন্তরঙ্গা শক্তি।
বৈদিক শাস্ত্ৰসমূহে ভক্তিজননীর বিভিন্ন লীলা মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়েছে এবং আমাদের পূবর্তন আচার্যরাও বভিন্ন সময়ে ভক্তিদেবীর নিকট শরণাগতি প্রার্থনা করে মহিমা কীর্তন করেছিলেন। নিম্নে কয়েকটি লীলা মাহাত্ম্য আলোচনা করা হলো ━ ─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─ একাদশী মাহাত্ম্যে ও শ্রীশ্রী হরিভক্তিবিলাসে তুলসী বন পূজা মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হরিভক্তিবিলাস ধৃত অগস্ত্য সংহিতায় বলা হয়েছে ━ তুলসী রোপণ, সেবন, দর্শন ও স্পর্শ দ্বারা পবিত্রতা লাভ হয় এবং সযত্নে উপাসনা করলে যাবতীয় অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। প্রতিদিন তুলসী প্রদক্ষিণ করে প্রণাম করলে সকল পাপ ধ্বংস হয়। যে গৃহে প্রতিদিন তুলসী পূজা হয় সেখানে যাবতীয় মঙ্গল পরিবর্ধিত হয় । কলিকালে শ্রীহরি তীর্থক্ষেত্র ও নিখিল ভুধর ত্যাগ করে একমাত্র তুলসী বনেই নিত্য অবস্থান করেন। যিনি যথাবিধি তুলসীবন রোপণ করেন, তিনি পরম পদ লাভ করেন। বিশেষতঃ শ্রবণা নক্ষত্র যোগে তুলসী রোপণ করা কর্তব্য, শ্রবণায় তুলসী রোপণ করলে রোপণকারীর সহস্র অপরাধ ক্ষমা করেন। যে সমস্ত দেব মন্দির বা পুণ্যভূমিতে তুলসী বৃক্ষ রোপণ করা হয় সে সমস্ত স্থান শ্রীহরির তীর্থস্বরূপ। চৈত্র সংক্রান্তি হতে বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত তুলসীতে জলধারা দান ও ছায়া দান করলে পরম গতি লাভ হয়। একাদশী মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে —- ১) যিনি যথাবিধি তুলসী বন রোপণ করেন, তার বংশে যারা মৃত হয়েছেন, যারা বর্তমান আছেন এবং যারা ভবিষ্যতে জন্মগ্রহণ করবেন তারা সকলেই কল্পান্ত কাল পর্যন্ত শ্রীহরির গৃহে বাস করেন। ২) যে স্থানে বায়ু তুলসী গন্ধ বহন করে প্রবাহিত হয় তার চতুর্দিকের সমস্ত জীবই শুদ্ধ হয়ে যায়। ৩) যে তুলসী বনে তুলসী বীজ পতিত হয় সেখানে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলে সে পিণ্ড অক্ষয় হয়ে থাকে। ৪) প্রতিদিন তুলসী (১) দর্শন, (২) স্পর্শ, (৩) চিন্তন, (৪) কীর্তন, (৫) প্রণাম, (৬) গুণ শ্রবণ, (৭) রোপণ, (৮) অর্চন ও (৯) সেবা করলে সকল পাপ ভস্মীভূত হয় এবং অন্তে শ্রীহরির ধামে বসতি লাভ করে। ৫) বৈশাখ মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, পুষ্করাদি তীর্থ, গঙ্গাদি নদী এবং ভগবান বিষ্ণু তুলসীদলে অবস্থান করে থাকেন। ৬) যে গৃহে তুলসী জলদ্বারা সকলে অভিষিক্ত হয়, যমদূতেরা সেই গৃহে প্রবেশ করতে পারে না। ৭) হরিতকী ফল যেরূপ রোগ দূরীভূত করে সেইরূপ তুলসী বহু দারিদ্র্য দুঃখহারিণী। ৮) তুলসী সন্নিকটে দেহ ত্যাগ করলে তার হরিধাম (বিষ্ণুলোক) প্রাপ্ত হয়। ৯) ভোরে ঘুম থেকে উঠে অপর দ্রব্য দর্শন না করে প্রথমেই তুলসী দর্শন করলে তৎক্ষণাৎ তার দিবারাত্র কৃতপাপ বিনষ্ট হয়। ১০) যিনি তুলসী বৃক্ষ রোপণ করেন, তার পিতৃ-মাতৃকুলের সপ্তকোটি পুরুষ হরিসন্নিধানে অবস্থান করে। ১১) তুলসী বৃক্ষে গন্ডূষ পরিমাণে জল (হাতের তালুতে ধারণ করা কিছু পরিমাণ জল) প্রতিদিন সেচন (সিঞ্চন) করলে হরিসন্নিধানে বসতি লাভ হয়। ১২) তুলসী বনের চারদিকে কাঠের বেড়া দিয়ে বেষ্টন করলে সেই বেড়া-প্রদানকারীর ত্রিকুল সহ ভগবৎ ধামে অবস্থান করেন। ১৩) প্রলয়কালীন আগুন যেমন নিখিল (সমগ্র, সম্পূর্ণ) দ্রব্য ভষ্মীভূত করে তদ্রুপ তুলসী মহিমা শ্রবণ, দর্শন, রোপণ, জল সেচন, প্রণাম দ্বারা অখিল (সমগ্র, সম্পূর্ণ) পাপ দগ্ধ হয়। ১৪) বুধবার ও শ্রবণা নক্ষত্রযুক্ত শুক্লা তৃতীয়াতে তুলসী রোপণ করলে তুলসীদেবী অতি পুণ্যদায়িনী হন। ─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─✤✸ তুলসীবন পূজা মাহাত্ম্য ✸✤
✤✸ তুলসী কথা কীর্তন পাপ বিনাশিনী ✸✤
◉ অতি প্রাচীনকালে কাশ্মীর দেশে হরিমেধা ও সুমেধা নামে দুইজন ব্রাহ্মণ বাস করতেন। এক সময় ঐ দুই ব্রাহ্মণ তীর্থ যাত্রায় গমন করলে পথে এক তুলসী বন দেখতে পান। ব্রাহ্মণ সুমেধা তুলসী বন দর্শন করে প্রণাম সেরে প্রদক্ষিণ করলেন।
◉এই দেখে হরিমেধা বললেন━ আপনি এত শ্রেষ্ঠদের, তীর্থ ও ব্রাহ্মণ থাকতে কেন তুলসী বনকে প্রদক্ষিণ করলেন। তখন সুমেধা বললেন━ঐ বট বৃক্ষের ছায়ায় চলুন, আমি আপনার কাছে তুলসীর কথা কীর্তন করব। বট বৃক্ষ ছায়ায় বসে সুমেধা তুলসী মাহাত্ম্য বলতে লাগলেন।
◉প্রাচীনকালে দুর্বাসার অভিশাপে ইন্দ্র হতশ্রী হলে দেব-দানবগণ ক্ষীর সাগর মন্থন করেন। মথিত সাগর হতে কল্পবৃক্ষ, চন্দ্র কমলাদেবী, ধন্বন্তরী উৎপন্ন হন। অনন্তর অমৃত কলস উৎপন্ন হলে বিষ্ণু তা হস্তদ্বারা গ্রহণ পূর্বক দর্শন করে আনন্দিত হন। তাঁর আনন্দাশ্রুবিন্দু সকল অমৃত কলসে পতিত হয় এবং মণ্ডলাকারে তুলসী বৃক্ষ উৎপন্ন হয়। তখন ব্রহ্মাদি দেবগণ সর্বসুলক্ষণ সম্পন্ন সর্বাভরণে ভূষিতা তুলসীদেবীকে শ্রীবিষ্ণুর হাতে অর্পণ করেন। ভগবান বিষ্ণুও তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। সেই থেকে তুলসীদেবী বিষ্ণুসদৃশ পূজিতা হন। ভগবান বিষ্ণু জগতের মঙ্গলকর্তা এবং তুলসী তাঁরই প্রিয়া। এজন্যে আমি তাকে প্রণাম-প্রদক্ষিণ করেছি।
◉ ব্রাহ্মণ সুমেধা এভাবে তুলসী মাহাত্ম্য কীর্তন করলে অদূরে এক দিব্য বিমান এলো এবং বটবৃক্ষও পতিত হলো। সেই পতিত বটবৃক্ষ হতে দু’জন দিব্যপুরুষ এসে সুমেধা ও হরিমেধাকে প্রণাম করলেন । সুমেধা ও হরিমেধা দিব্য পুরুষদ্বয়কে প্রশ্ন করলেন, আপনারা দু’জন কে? আপনাদের এরূপ অবস্থার কারণ কি?
◉পুরুষদ্বয়ের মধ্যে একজন বলল, আমার নাম আস্তিক, আমার বাসস্থান দেবলোকে। আমি এক সময় নন্দন বনে অপ্সরার সঙ্গে বিচরণ করছিলাম। তাঁর পাশেই লোমশ মুনি তপস্যা করছিলেন। তিনি আমার ব্যবহারে ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দেন ━ ❝তুমি ব্ৰহ্মরাক্ষস হয়ে বটবৃক্ষে বিচরণ কর।” আমি তখন বিভিন্ন প্রার্থনা দ্বারা ঋষিকে প্রসন্ন করলে তিনি আমার প্রতি শাপমোচন বাণী প্রয়োগ করে বললেন━ ❝তুমি যখন দ্বিজ (ব্রাহ্মণ) মুখে তুলসী মাহাত্ম্য ও বিষ্ণুর নাম শ্রবণ করবে তখন অভিশাপ মুক্ত হবে। এরূপে আমি মুনি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে দীর্ঘকাল এই বটবৃক্ষে বাস করছিলাম। দৈবাৎ আপনাদের মুখে তুলসী মাহাত্ম্য শ্রবণ করে শাপ মুক্ত হলাম। আমার সঙ্গী এই দ্বিতীয় পুরুষটিও গুরু আদেশ অনাদর করে ব্রহ্মরাক্ষস হয়েছে, ইনিও আপনাদের অনুগ্রহে শাপ মুক্ত হলেন। আপনাদের তীর্থযাত্রার ফল এই স্থানেই সম্পন্ন হলো। তবে আপনাদের ভক্তি অনুদিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে।” তারপর সেই দিব্য পুরুষদ্বয় হরিমেধা ও সুমেধাকে প্রণাম করে নিজ ধামে গমন করলেন।
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
✤✸ ঐকান্তিক সেবা নিষ্ঠায় শ্রীবৃন্দা দেবীর কৃপা ✸✤
◉কাম্যবনে মদন মোহনের সেবা করতেন জয় কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজ। এক সময় তরুণ বয়স্ক এক কনিষ্ঠ ভক্ত তাঁর কাছে ভজন শিক্ষার জন্য আসেন। কিছুদিন অতীত হলে কনিষ্ঠ ভক্তের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে রাগানুগা ভজন শিক্ষা দিতে জয় কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজ মনস্থ করলেন। বাবাজী কনিষ্ঠ ভক্তের কাছে তার গুরু প্রণালী জানাতে চাইলেন । কনিষ্ঠ ভক্ত বললেন গুরু প্রণালী কি তা আমি জানি না এবং গুরুদেবের কাছে এবিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। মহারাজ বললেন━ তুমি বাংলায় গিয়ে তোমার গুরুদেবের কাছ থেকে গুরু প্রণালী নিয়ে এসো। বাবাজী মহারাজের স্নিগ্ধ ব্যবহার ও আদর এবং মদন মোহনের সেবা ছেড়ে গৌড়দেশে যেতে হবে বলে কনিষ্ঠ ভক্ত কেঁদে আকুল। কিন্তু একপ্রকার বাধ্য হয়েই কনিষ্ঠ ভক্ত দেশে যাত্রা করলেন।
◉কনিষ্ঠ ভক্ত কাতর হয়ে শ্রীমতী বৃন্দাদেবী ও রাধারাণীর নিকট প্রার্থনা করলে যে, গাড়িতে ওঠার আগেই যেন ব্রজভূমে তার প্রাণবিয়োগ হয়। শ্রীমতি বৃন্দাদেবী ও রাধারাণী তার প্রার্থনা শুনলেন। কনিষ্ঠ ভক্ত গাড়ির নিকট যাওয়ার আগেই গাড়ি স্টেশন ছেড়ে চলে গেল। কনিষ্ঠ ভক্ত তখন আর কি করবেন। তিনি পুনরায় ভজন কুটিরে ফিরে আসার সঙ্কল্প করলেন।
◉এদিকে শ্রীবৃন্দাদেবী ঐ রাত্রে স্বপ্নে বাবাজী মহারাজকে ধমক দিয়ে বলছেন━ ❝তুই কেন নবীন ভক্তকে বাইরে পাঠালি? তার গুরু প্রণালী তো তোর ঠাকুরের সিংহাসনেই রয়েছে।” জয় কৃষ্ণদাস বাবাজী মহারাজ চমকে জেগে উঠলেন। শ্রীবৃন্দাদেবীর পুনঃদর্শন না পেয়ে কেঁদে কেঁদে আকুল হলেন এবং বৃন্দাদেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
◉সকালে স্নান সেরে তিনি শ্রীমদনমোহনের মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মদনমোহনের সিংহাসনে শ্রীগুরু প্রণালী পেয়ে বক্ষে ধারণ করলেন। শ্রীমতী বৃন্দাদেবীর কৃপা স্মরণপূর্বক শ্রীগোবিন্দ মন্দিরে গিয়ে বৃন্দাদেবীর স্মরণ করে অনেক কান্নাকাটি করলেন এবং নবীন ভক্তকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন।
◉ঐদিন সন্ধ্যাকালে নবীন ভক্ত ভজন কুটিরে ফিরে আসেন। বাবাজী মহারাজ নবীন ভক্তকে জিজ্ঞাসা করলেন━ ❝কেন এবং কিভাবে ফিরে এলে?” নবীন ভক্ত গাড়ি না পাওয়ার কথা খুলে বলল। বাবাজী মহারাজ নবীন ভক্তকে শ্রীবৃন্দাদেবীর কৃপার কথা স্মরণ করে তাকে আলিঙ্গন করে নয়ন জলে অভিষিক্ত করলেন। তারপর বৃন্দাদেবীর স্বপ্নের কাহিনী বিস্তারিত বললেন এবং গুরু প্রণালীও যে প্রাপ্ত হয়েছে তাও জানালেন।
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
✤✸ তুলসীর গুণ তত্ত্ব ✸✤
ভগবান শ্রীহরি তুলসীকে বরদান পূর্বক অঙ্গীকার করে বলেছেন-
🕉️ ১। তুলসী ছাড়া পূজা, পূজার মধ্যে গণ্য নয়। তুলসী ছাড়া ভোজন, ভোজন নয়। তুলসী ছাড়া পানীয়, পানীয় হিসাবে গণ্য হয় না।
🕉️ ২। স্বর্গ-মর্ত্য, পাতাল, বৈকুণ্ঠ ও হরি সন্নিধানে তুলসীবৃক্ষ সকল পুষ্প থেকে শ্রেষ্ঠ হবে।
🕉️ ৩। পুন্যপ্রদ তুলসীবৃদ্ধ গোলকের বিরজা তীরে, রাসমন্ডলে, বৃন্দাবন ভূমিতে, ভান্ডীর বনে, রমনীয় চম্পকবনে, চন্দন কাননে, মাধবী, কেতকী, কুন্দ, মল্লিকা ও মালতী বনে এবং অন্যান্য যাবতীয় পুন্যস্থানে উৎপন্ন হবে।
🕉️ ৪। পুন্যপ্রদ তুলসী বৃক্ষমূলে সকল তীর্থের অধিষ্ঠান হবে। সেই স্থানে সমস্ত দেবগন পতিত তুলসী পত্রের প্রত্যাশায় অধিষ্ঠান করবেন।
🕉️ ৫। যে ব্যক্তি তুলসীপত্র জলে অভিষিক্ত হবেন, তিনি সকল তীর্থস্থান ও সর্ব্বযজ্ঞে দীক্ষার ফল লাভ করবেন।
🕉️ ৬। সুধাপূর্ণ সহস্র ঘঠদানে হরির যে প্রীতি না হয়, মানবগণ এক তুলসীপত্র প্রদানে সেই প্রীতি সম্পাদন করবে।
🕉️ ৭। মনুষ্যগণ অযুত গোদান করে যে ফল লাভ হয়, এক তুলসীপত্র দান করে সেই ফল লাভ করবে, মৃত্যুকালে যিনি তুলসীপত্রের জল প্রাপ্ত হবেন, তিনি সমস্ত পাপ হতে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করবেন।
🕉️ ৮। যে মনুষ্য নিত্য তুলসী পত্রের জল পান করবেন, তিনি জীবন্মুক্ত হয়ে গঙ্গাস্নানের ফল ভাগী হবেন।
🕉️ ৯। যে মানব নিত্য তুলসী পত্র দ্বারা শ্রীহরির পূজা করেন, নিশ্চয় তাঁর লক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞের পূণ্য হবে।
🕉️ ১০। মনুষ্যগণ দেহে তুলসী ধারণ করে দেহত্যাগ করলে বিষ্ণুলোকে গতি হবে।
🕉️ ১১। যে মানুষ তুলসী কাষ্ঠ নির্মিত মালা ধারণ করবে, তার পদে পদে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল হবে। যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে তুলসীজলের কনামাত্র প্রাপ্ত হবে সে বৈকুন্ঠে গমন করবে। তুলসী মালা ধারণকারীকে কখনও যমদূত স্পর্শ করতে পারে না। তুলসী ধারণ/স্পর্শ করে মিথ্যা শপথ বা অঙ্গীকার করা মহাঅপরাধ ।
🕉️ ১২। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, দ্বাদশী ও সংক্রান্তি দিবসে, তৈলযুক্ত হয়ে স্নানের সময়, মধ্যাহ্নে, রাত্রিকালে, উভয় সন্ধ্যাকালে, রাত্রিবাস (বাসী কাপড়) পরিধান করে তুলসী চয়ন করলে শ্রীহরির শিরচ্ছেদ করার অপরাধে অপরাধী হতে হবে।
🕉️ ১৩। তুলসীপত্র ত্রিরাত্রি পর্যুষিত (বাসি) হলেও, তা-শ্রাদ্ধ, ব্রত, দান, প্রতিষ্ঠা ও দেব পূজাদি এবং অন্যান্য কার্যে শুদ্ধ হবে। ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তুলসীপত্র মৃত্তিকা বা জলে পতিত হলেও তা প্রক্ষালন করলে অন্যান্য কার্যে শুদ্ধ হবে।
🕉️ ১৪। শালগ্রাম শিলা, নারায়ণ শিলা, তুলসী ও শঙ্খকে যিনি একস্থানে রাখেন তিনি মহাজ্ঞানী ও শ্রীহরির অতি প্রিয় হবেন।
🕉️ ১৫। তুলসী কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনী, চক্তিদেবী। নিত্য নববিধা তুলসী সেবা প্রত্যেকেরই কর্তব্য, কল্যাণ লাভ হয়ে থাকে। নববিধা তুলসী ভজনা হল- (১)দর্শন, (২) স্পর্শন, (৩) ধ্যান, (৪) গুণ-কীৰ্ত্তন, (৫) প্রণাম, (৬) গুণ-শ্রবণ, (৭) রোপণ, (৮) জল সিঞ্চন দ্বারা সেবন ও (৯) তাঁর পূজা। তুলসীর নিত্য ভজনা-কর্তার সহস্ৰকোটী যুগ বিষ্ণুলোকে বসতি লাভ হয়।
তুলসী গুণকীর্তন ও মাহাত্বের বর্ণনার কোন শেষ হয় না, তবুও সংক্ষিপ্ত ভাবে বর্ণন করার প্রয়াস হল মাত্র।
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
◼️ তুলসী পূজা কীর্তন ◼️
প্রাতঃকালে মঙ্গলারতির পরে এবং বিশেষ করে সন্ধ্যাকালেও সন্ধ্যারতির আগে সমবেত সকল ভক্তমণ্ডলী অবশ্যই প্রথমে ৩বার তুলসী প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে তুলসীদেবীকে প্রণতি নিবেদন করবেন। — তারপরে তুলসী আরতি কীর্তন করবেন। আরতি নিবেদনকালে ভক্ত ধূপ, ঘৃতপ্রদীপ ও পুষ্পার্ঘ্য সহকারে তুলসীদেবীর উদ্দেশ্যে আরতি নিবেদন করেন। এই উপকরণাদি নিবেদনের সময়ে, তুলসী আরতি করতে হলে ভক্তকে একটি আসনের উপর (উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে) দাঁড়াতে হবে এবং তিনি বাঁহাতে ঘণ্টা বাজাতে থাকবেন।
তুলসীদেবীকে নিবেদনের পরে প্রতিটি উপকরণকে সমবেত ভক্তবৃন্দের উদ্দেশ্যে চক্রাকারে ৩বার ঘুরিয়ে বিতরণ করবেন। তুলসীপূজা কীর্তন গান শেষ হয়ে গেলে, সমবেত বৈষ্ণবমণ্ডলী অন্তত ৪বার তুলসীদেবীকে প্রদক্ষিণ করবেন এবং তুলসী জলদান অর্থাৎ কয়েক ফোঁটা জল তুলসীর মূলদেশে (কেবলমাত্র প্রাতঃকালীন পূজার সময়ে সন্ধ্যায় নয়) নিবেদন করবেন।
আরতি করার নিয়ম –
🕉️ উপকরণ: আচমন পাত্র, ধুপকাঠি, প্রদীপ, পুষ্প, ঘন্টা
🕉️ নিবেদন নিয়ম: ধুপকাঠি, প্রদীপ, পুষ্প সবগুলি উপকরণই সর্বাঙ্গে ৭বার করে ঘুরিয়ে (ঘরির কাটার দিকে বাম দিক থেকে ডান দিকে) দেখাবেন। প্রত্যেকটা উপকরণ দেখানোর আগে-পরে আচমন করে নেবেন।
🕉️ আরতির সময়: ভক্তরা দুই বেলা তুলসী আরতি করে থাকেন।
◉ সকালে(ভোরে)- মঙ্গল আরতির পর।
◉ রাতে- গৌর আরতি বা সন্ধ্যা আরতির আগে।
✤✸ তুলসী প্রনাম মন্ত্র ✸✤
❝ (ওঁ) বৃন্দায়ৈ তুলসী দেব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ।
কৃষ্ণভক্তিপ্রদে দেবি সত্যবত্যৈ নমো নমঃ॥ ❞
━━┉┈┈(৩ বার)
অনুবাদ: “ভগবান শ্রীকেশবের অতি প্রিয় বৃন্দা, শ্রীমতী তুলসীদেবীর উদ্দেশ্যে আমার পুনঃ পুনঃ প্রণতি নিবেদন করি। হে দেবী সত্যবতী, শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে আপনি আমাদের ভক্তি প্রদান করুন।”
✤✸ তুলসী আরতি কীর্তন ✸✤
নমো নমঃ তুলসী! কৃষ্ণপ্রেয়সী !
রাধাকৃষ্ণ-সেবা পাব এই অভিলাষী ॥
যে তোমার শরণ লয়, তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়,
কৃপা করি কর তারে বৃন্দাবন বাসী।
মোর এই অভিলাষ, বিলাস-কুঞ্জে দিও বাস,
নয়নে হেরিব সদা যুগলরূপরাশি ॥
এই নিবেদন ধর, সখীর অনুগত কর,
সেবা-অধিকার দিয়ে কর নিজ দাসী।
দীন কৃষ্ণদাসে কয়, এই যেন মোর হয়,
শ্রীরাধাগোবিন্দ-প্রেমে সদা যেন ভাসি ॥
অনুবাদ: “(১) হে তুলসী, কৃষ্ণপ্রেয়সী, আমি বার বার তোমাকে প্রণাম করি, শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের সেবার আমি অভিলাষী।
(২) যে তোমার শরণ গ্রহণ করে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। কৃপা করে তুমি তাকে বৃন্দাবনবাসী কর।
(৩) বৃন্দাবনধামে বিলাসকুঞ্জে বাস করার আমার যে অভিলাষ তুমি পূর্ণ কর, যাতে নয়নভরে সব সময় আমি শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের সুন্দর লীলা দর্শন করতে পারি।
(৪) আমার প্রার্থনা এই যে, তুমি আমাকে ব্রজের সখীদের অনুগত কর। সেবার অধিকার দিয়ে আমাকে তোমার দাসী কর।
(৫) শ্রীকৃষ্ণের এক একান্ত পতিত ও দীন সেবক বিনতি নিবেদন করছে যে, “আমি যেন সব সময় শ্রীরাধাগোবিন্দ প্রেমে ভাসতে পারি।”
✤✸ তুলসী প্রদক্ষিণ মন্ত্র ✸✤
❝ যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।
তানি তানি প্রণশ্যন্তি প্রদক্ষিণ পদে পদে॥ ❞
━━┉┈┈(৪ বার)
অনুবাদ: “যখন মানুষ শ্রীমতী তুলসীদেবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন প্রতি পদক্ষেপে তার কৃত সকল পাপকর্ম, এমন কি ব্রহ্মহত্যার পাপও বিনষ্ট হয়ে যায়।”
✤✸ তুলসী জলদান মন্ত্র ✸✤
❝ (ওঁ) গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিণীম্।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তিপ্রদায়িনীম্॥ ❞
অনুবাদ: “শ্রীগোবিন্দের প্রিয়তমা, জগজ্জননী, সকল ভক্তবৃন্দের চেতনা প্রদায়িনী এবং শ্রীকৃষ্ণে ভক্তিপ্রদায়িনী শ্রীমতী তুলসীদেবী, আপনাকে আমি স্নানসেবা নিবেদন করছি।”
✤✸ তুলসী চয়ন মন্ত্র ✸✤
❝ (ওঁ) তুলস্যমৃতজন্মাসি সদা ত্বং কেশবপ্রিয়া।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে॥ ❞
অনুবাদ: “হে তুলসী, অমৃত থেকে আপনার জন্ম। আপনি নিয়ত ভগবান শ্রীকেশবের অতীব প্রিয়। এখন শ্রীকেশবের পূজার উদ্দেশ্যে আপনার পত্র ও মঞ্জরী আমি সংগ্রহ করছি কৃপা করে আমাকে বরদান করুন।”
✸ তুলসীচয়ণ বিধি✸
================
প্রাতঃকালে স্নানের পর শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে পুষ্প চয়ন ও তুলসী চয়নের নিয়ম ৷ মধ্যাহ্ন স্নানের পর পুষ্প ও তুলসী চয়ন নিষিদ্ধ ৷ ভগবানকে প্রণাম করে এবং তার আদেশ নিয়ে তুলসী ও পুষ্প চয়ন করতে হয় ৷ অছিদ্র হরিৎপত্র তুলসীই শ্রীকৃষ্ণার্চ্চনের যোগ্য অর্থাৎ ছেঁড়া তুলসী পাতা অর্পণ করবেন না। তিনবার করতালি দিয়ে তুলসীর শাখা-প্রশাখা কম্পন না হয় এমনভাবে বামহাত দিয়ে এক একটি শাখা ধরে ডানহাত দিয়ে মঞ্জুরীবৃন্ত সহ তুলসী পত্র চয়ন করতে হয় ৷ তুলসীর পত্র চয়ন কালে যদি শাখা-প্রশাখা ভেঙ্গে যায়, তবে শ্রীহরির হৃদয়ে ব্যথা প্রদান করা হয় ৷
✸ তুলসীচয়ণ নিষেধাঞ্জা ✸
====================
পূর্ণিমা, অমবাস্যা, দ্বাদশী ও সংক্রান্তিতে তুলসীপত্র চয়ন করতে নেই। তেল মেখে, মধ্যাহ্নে স্নান না করে, সকালে সূর্যোদয়ের আগে কিংবা সন্ধায় সূর্যাস্তের পরে, ও রাত্রিবাস (রাতে যে পোশাক পরিধান করে ঘুমানো হয়) পরিধান করে যে তুলসী চয়ন করে, তাঁহার হরির মস্তক ছেদন করে।
✤✸ তুলসী ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র ✸✤
❝ চয়নোদ্ভবদুঃখং চ যদ্ হৃদি তব বর্ততে।
তৎ ক্ষমস্ব জগন্মাতঃ বৃন্দাদেবি নমোঽস্তুতে॥ ❞
অনুবাদ: “হে তুলসী দেবী, আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই। হে জগন্মাতা, আপনার পত্র ও মঞ্জরী চয়নকালে যদি আপনার হৃদয়ে দুঃখের উদ্ভব করে থাকি, তবে কৃপা করে আমাকে ক্ষমা করবেন।”
✤✸ তুলসী স্তব ✸✤
❝ বৃন্দাং বৃন্দাবনীং বিশ্বপূজিতাং বিশ্বপাবনীং।
পুষ্পসারাং নন্দিনীর্ষভ তুলসীং কৃষ্ণজীবনীং ॥
এতন্নামাষ্টকঞ্চৈতৎ স্তোত্রং জ্ঞতার্থ সংযুতং ।
যঃ পঠেত্তাঞ্চ সম্পূজ্য সোহশ্বমেধ ফলং লভেৎ॥ ❞
━━┉┈┈(ব্রহ্মাবৈবর্ত্ত পুরাণ)
অনুবাদ: “যারা এই স্তব প্রতিদিন পাঠ করেন, তারা অশ্বমেধ ফল লাভ করেন।”
❝ হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে॥ ❞
🌸 শ্রী শ্রী রাধামাধব কি জয় 🌸
🌸 জয় শ্রীশ্রী-বৃন্দাদেবী-তুলসী-মহারানী কি জয় 🌸
🌸 শ্রীল প্রভুপাদ কি জয় 🌸
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
◼️ তুলসী সম্পর্কে বিধি-নিষেধ ◼️
✸ কি করনীয় ✸
=============
১৷ প্রতিদিন তুলসী বৃক্ষে জল দান করতে হয় এবং গ্রীষ্মকালে ছায়ার মধ্যে রাখতে হয় ৷
সা দেবী কৃষ্ণশক্তিহি শ্রীকৃষ্ণবল্লভা মতা ॥
অতস্তাং বৈষ্ণবীং দেবীং নান্যপদে সমর্পয়েৎ ।
অর্পণে তত্ত্বহানিংঃ স্যাৎ সেবাপরাধ এব চ॥
অতত্ত্বজ্ঞস্ত পাষণ্ডো গুরুব্রুবস্য পাদয়োঃ।
অর্পয়ন্ তুলসীং দেবীমর্জয়েন্নরকং পদম্॥ ❞
ব্রহ্মহা স হি গোঘ্নশ্চ স এব গুরুতল্পগঃ॥ ❞
=============
১। পূর্ণিমা, অমবাস্যা, দ্বাদশী ও সংক্রান্তিতে তুলসীপত্র চয়ন করতে নেই। তেল মেখে, মধ্যাহ্নে স্নান না করে, সকালে সূর্যোদয়ের আগে কিংবা সন্ধায় সূর্যাস্তের পরে, ও রাত্রিবাস (রাতে যে পোশাক পরিধান করে ঘুমানো হয়) পরিধান করে যে তুলসী চয়ন করে, তাঁহার হরির মস্তক ছেদন করে। আগের কিংবা সকালে তোলা তুলসীপত্র শুখিয়ে গেলেও, তা শ্রীবিগ্রহ অর্চ্চনায় ব্যবহার করা চলে।
─•━━⊱♦️✥♦️⊰•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱⊱♦️✥♦️⊰•━━•─
◼️তুলসী মাহাত্ম্য ◼️
১। পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখন্ডে (৬০/১০৫ শ্লোকে) বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শ্রীমহাদেব পুত্র কার্তিককে বললেন,
❝ সর্বেভ্যঃ পত্রপুষ্পেভ্যঃ সত্তমা তুলসী শিবা।
সর্বকামপ্রদা শুদ্ধা বৈষ্ণবী বিষ্ণুসুপ্রিয়া॥ ❞
অনুবাদ:“সমস্ত পত্র ও পুষ্পের মধ্যে তুলসী হলেন শ্রেষ্ঠা। তুলসী সর্বকামপ্রদা, মঙ্গলময়ী, শুদ্ধা, মুখ্যা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুর প্রেয়সী এবং সর্বলোকে পরম শুভা।”
সমগ্র পুষ্পের মধ্যে তুলসী শ্রেষ্ঠ এবং শ্রীহরি, দেব-দেবী সকল, ব্রাহ্মণ এবং বৈষ্ণবগণের আনন্দবর্ধনকারিণী। তিনি অতুলনীয়া এবং কৃষ্ণের জীবনস্বরূপিনী।
২। পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখন্ডে (৬০/১১৭-১১৮ শ্লোকে) বৈষ্ণব শিরোমণি শ্রীমহাদেব পুত্র কার্তিককে আরও বললেন,
❝ যো মঞ্জরীদলৈরেব তুলস্যা বিষ্ণুমর্চয়েঃ ।
তস্য পুণ্যফলং স্কন্দ কথিতুং নৈব শক্যতে॥
তত্র কেশবসান্নিধ্যং যত্রাস্তি তুলসীবনম্।
তত্র ব্রহ্মা চ কমলা সর্বদেবগণৈঃ সহ॥ ❞
অনুবাদ: “হে কার্তিক! যে মনুষ্য ভক্তিসহকারে প্রতিদিন তুলসীমঞ্জরি দিয়ে শ্রীহরির আরাধনা করেন, এমনকি আমিও তার পুণ্য বর্ণনা করতে অক্ষম। যেখানে শ্রীতুলসীর বন আছে, শ্রীগোবিন্দ সেখানেই বাস করেন। আর গোবিন্দের সেবার উদ্দেশ্যে লক্ষ্মী, ব্রহ্মা প্রভৃতি সমস্ত দেবতা সেখানেই বাস করেন।”
যেখানে একটি মাত্র তুলসীবৃক্ষ আছে, সেইস্থানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব সকলে অবস্থান করেন। পত্রমধ্যে কেশব, পত্রাগ্রে প্রজাপতি, পত্রবৃত্তে শিব সর্বদাই ভাবামৃত আছেন। এর পুষ্পে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গায়ত্রী, চন্দ্রিকা ও শচী প্রভৃতি দেবীগণ নিত্য বিরাজিত আছেন। ইন্দ্র, অগ্নি, শমন, বরুণ, পবন ও কুবের প্রভৃতি দেবগণ এর শাখাতে বাস করেন। ইন্দ্র আদিত্যাদি গ্রহ, বসু, মনু ও দেবর্ষি, বিদ্যাধর, গন্ধর্ব্ব প্রভৃতি সকল দেবগণ তুলসীপত্র আশ্রয় করে আছেন।
৩। সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রের রচয়িতা শ্রীব্যাসদেব তুলসীদেবীর গুণ মহিমা পদ্মপুরাণের সৃষ্টিখণ্ডে (৬০/১২৭-২৮) অতি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন ━
❝ পূজনে কীর্তনে ধ্যানে রোপণে ধারণে কলৌ ।
তুলসী দহতে পাপং স্বর্গং মোক্ষং দদাতি॥
উপদেশং দিশেদস্যাঃ স্বয়মাচরতে পুনঃ।
স যাতি পরমং স্থানং মাধবস্য নিকেতনম্॥ ❞
অনুবাদ: “শ্রীতুলসীদেবীর পূজা, কীর্তন, ধ্যান, রোপণ ও ধারণে সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং পরমগতি লাভ হয়। যে ব্যক্তি অন্যকে তুলসী দ্বারা শ্রীহরির অর্চনার উপদেশ দেন, এবং নিজেও অর্চনা করেন, তিনি শ্রীমাধবের আলয়ে গমন করেন। শুধু শ্রীমতী তুলসীদেবীর নাম উচ্চারণ করলেই শ্রীহরি প্রসন্ন হন। ফলে পাপসমূহ নাশ হয় এবং অক্ষয় পুণ্যার্জিত হয়।”
৪। পদ্মপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে (৬/২২) বলা হয়েছে ━
দেবৈস্তীর্থৈঃ পুষ্করাদ্যৈস্তিষ্ঠান্ত তুলসীদলে॥ ❞
বাসুদেবাদয়ো দেবা বসন্তি তুলসীদলে॥ ❞
তদগৃহং যমদূতাশ্চ দূরতো বৰ্জ্জয়ন্তি হি॥ ❞
তদ্গৃহং তীৰ্থীভূতং হি নো যান্তি যম-কিঙ্করাঃ॥ ❞
কুৰ্ব্বন্তি তেষাং পিতরস্তৃপ্তা বর্ষাযুতং জলৈঃ॥ ❞
শুশ্রূষিতো হরিস্তৈস্তু নাত্র কার্য্যা বিচারণা ॥ ❞
যথাহি বাসুদেবস্য বৈকুণ্ঠে ভোগ-বিগ্রহঃ ॥ ❞
৬। তুলসীদেবীর অনন্তমহিমা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে (২২/৪২-৪৪) বর্ণিত রয়েছে ━
❝ শিরোধার্যাঞ্চ সর্বেসামীপ্সিতাং বিশ্বপাবনীম্।
জীবন্মুক্তাং মুক্তিদাঞ্চ ভজে তাম্ হরিভক্তিদাম্॥ ❞
অনুবাদ: “যিনি সকলের শিরোধার্যা, উপাস্যা, জীবন্মুক্তা, মুক্তিদায়িনী এবং শ্রীহরিভক্তি প্রদায়িনী, সেই সমগ্র বিশ্বকে পবিত্রকারিণী বিশ্বপাবনী তুলসীদেবীকে সতত প্রণাম করি।”
লক্ষাশ্বমেধজং পুণ্যং লভতে নাত্র সংশয়ঃ॥ ❞
তুলসী-কাননে নিত্যং কলৌ তিষ্ঠতি কেশবঃ॥ ❞
রোপিতা যৈশ্চ বিধিনা সংপ্রাপ্তং পরমং পদং॥ ❞
রোপিতা সেবিতা নিত্যং পূজিতা তুলসী শুভা॥ ❞
যুগ-কোটিসহস্রাণি তে বসন্তি হরেগৃহে॥ ❞
❝ যস্মিন্ গৃহে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! তুলসীমূল-মৃত্তিকা ।
সৰ্ব্বদা তিষ্ঠতে দেহে দেবতা ন স মানুষঃ॥ ❞
অনুবাদ: “হে দ্বিজরাজ! যার গৃহে ও দেহে সর্ব্বদা তুলসী মূলমৃত্তিকা থাকে, তিনি মনুষ্য নয় ━ তিনি দেবতা।”
❝ তুলসী-মৃত্তিকা যত্র কাষ্ঠং পত্রঞ্চ বেশ্মনি ।
তিষ্ঠতে মুনি-শার্দূল! নিশ্চলং বৈষ্ণবং পদং॥ ❞
অনুবাদ: “হে মুনিবর! যে গৃহে তুলসী-মৃত্তিকা, তুলসী-কাষ্ঠ ও তুলসী-পত্র থাকে, সেই গৃহ নিশ্চয় বিষ্ণুর স্থান হয়।”
❝ যস্য নাভিস্থিতং পত্রং মুখে শিরসি কর্ণয়োঃ ।
তুলসী-সম্ভবং নিত্যং তীর্থৈস্তস্য মখৈশ্চ কিং॥ ❞
অনুবাদ: “সর্বদা যার নাভিতে, মুখে, মস্তকে ও কর্ণদ্বয়ে তুলসীপত্র অবস্থিত থাকে, তার আর তীর্থে গমন বা যজ্ঞ করার কি প্রয়োজন আছে? ”
❝ যদা ভক্তিরতো নিত্য নরো দহতি পাতকং ।
তুলসী ভক্ষণাৎ তদ্বৎ দতহতে পাপ-সঞ্চয়ং॥ ❞
অনুবাদ: “ভক্তিমান ব্যক্তি যেমন প্রত্যহ ভক্তির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাপ দাহ করেন, সেইরকম তুলসীপত্র ভক্ষণ করলেও সঞ্চিত পাপ দগ্ধ হয়ে যায়। ”
❝ যুক্তো যদি মহাপাপৈ সুকৃতং নাৰ্জ্জিতং ক্বচিৎ ।
তথাপি গীয়তে মোক্ষস্তুলসী ভক্ষিতা যদি॥ ❞
অনুবাদ: “যদি কোন ব্যক্তি সমস্ত মহাপাপযুক্তও হয় এবং কখনও পুণ্য কাৰ্য্য নাও করে থাকে, তবুও সে যদি তুলসীপত্র ভক্ষণ করে, তাহলে তার পরিত্রাণ লাভ হয়ে থাকে।”
৮। অগস্ত্যসংহিতায় বর্ণিত রয়েছে ━
ক্রোশমাত্রং ভবত্যেব গাঙ্গেয়স্যৈব পাথসঃ॥ ❞
ন তেষাং নরক-ক্লেশ প্রয়ান্তি পরমং পদং॥ ❞
অহোরাত্র-কৃতং পাপং তৎক্ষণাৎ প্রহরন্তি তে॥ ❞
জন্মকোটি-কৃতাৎ পাপান্মচ্যুতি নাত্র সংশয়॥ ❞
ভবতে নৈব পাপং তদ্গৃহে সংক্ৰমতে কলৌ॥ ❞
বিশিষ্যতে কায়শুদ্ধিশ্চান্দ্রায়ণ-শতং বিনা॥ ❞
❝ নিত্যং সন্নিহিতো বিষ্ণুঃ সংস্পৃহস্-তুলসী-বনে ।
অপি মেহক্ষত-পত্ৰৈকং কশ্চিৎ-বন্যোঽপয়েদিতি॥ ❞
অনুবাদ:“শ্রীবিষ্ণু সৰ্ব্বদা তুলসী-বনের কাছে এই অভিলাষ নিয়ে বাস করেন, যদি কোন ধন্য ব্যক্তি আমাকে একটি অখণ্ড তুলসীপত্র অর্পণ করে।”
পুরাণ-পঠনং যত্র তত্র সন্নিহিতো হরিঃ॥ ❞
ক্ষীরোদাশায়িনা সার্দ্ধং বসেদাচন্দ্র তারকং॥ ❞
দুৰ্ল্লভা হরিভক্তিশ্চ সংসারার্ণব-পাতিনাং॥ ❞
লভতে চাক্ষয়ং স্থানং পিতৃভিঃ সহ বৈষ্ণবঃ॥ ❞
গয়া-শ্রাদ্ধং কৃতং তেন ভাষিতং বিষ্ণুনা পুরা॥ ❞
করোতি ধৰ্ম্মকার্যাণি ফলমাপ্নোতি চাক্ষয়ং॥ ❞
তথাপি বৈষ্ণবৈস্তন্ন গ্রাহ্যং কৃষ্ণাৰ্পণ বিনা॥ ❞
তুলসী-সম্ভবং মূলং পাবনং মৃত্তিকাদ্যপি॥ ❞
ন তেষাং পুনরাবৃত্তির্বিষ্ণুলোকাৎ কথঞ্চন॥ ❞
মৃতঃ শুধ্যতি দাহেন তুলসী কাষ্ঠ-বহ্নিনা॥ ❞
তুলসীকাষ্ঠ-দগ্ধস্য মৃতস্য ন পুনর্ভবঃ ॥ ❞
দাহকালে ভবেন্মুক্তিঃ পাপকোটি-যুতস্য চ ॥ ❞
১৪। বায়ু তুলসীর গন্ধ নিয়ে যে যে দিকে গমন করে, সেই সেই দিক পবিত্র হয়।
১৫। “তুলসীর দর্শনে পাপ ও রোগ নাশ হয়, স্পর্শের ফলে শরীর শুদ্ধ হয়, জল সিঞ্চনের ফলে ভয় দূর হয়, রোপণ করার ফলে ভগবদ্ভক্তি লাভ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্পণ করার ফলে পূর্ণ ভগবৎ-প্রেম লাভ করা যায়, সেই তুলসীদেবীর চরণে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।” ━━ (স্কন্দ পুরাণ)
১৬। তুলসীকে বলা হয় “কৃষ্ণ প্রেয়সী” অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পরম প্রিয়। তাই তুলসী ছাড়া শ্রীনারায়ণ পূজো বা শ্রীকৃষ্ণের পূজো হয় না।
১৭। ‘স্কন্দ পুরাণ’ আর ‘পদ্ম পুরাণে’ বলা হয়েছে ━━ “যে মনুষ্যের গৃহে তুলসীবন রয়েছে, সেই গৃহ তীর্থ-স্বরূপ।”
১৮। ‘গড়ুর পুরাণে’ বলা হয়েছে – “তুলসী গাছ রোপন, দান ও তুলসী গাছের যত্ন নিলে মানুষের পূর্ব জন্মের পাপ ক্ষয় হয়।”
১৯। তুলসীবনে পিতৃশ্রাদ্ধ করলে তাহা পিতৃগণের অতিশয় প্রীতিপ্রদ হয়।
২০। যার গৃহে তুলসীতলার মাটি থাকে, তার গৃহে যমকিঙ্করগণ (যমরাজের আজ্ঞাবহ ভৃত্য) যেতে পারে না। তুলসী মাটি মেখে যদি কেউ প্রাণ ত্যাগ করে এবং সেই ব্যক্তি যদি ঘোরতর পাপী হয় তা হলেও যমকিঙ্করগণ তাকে দেখতেও সমর্থ হয় না।
২১। যিনি তুলসীমূলে দীপ দান করেন, তিনি বৈষ্ণবপদ লাভ করেন।
২২। নর্ম্মদা ও গোদাবরী নদীতে স্নান করলে যে পুণ্য হয়, একমাত্র তুলসীবন সংসর্গে সেই ফল লাভ হয়।
২৩। যিনি নিত্য তুলসী সেবা করেন তিনি সমসত ক্লেশ হতে মুক্ত গয়ে অভীষ্ঠ সিদ্ধি লাভ করেন। যে মনুষ্য তুলসী মঞ্জরী দিয়ে শ্রীহরির পূজা করেন, তাকে পুনরায় গর্ভবাস যন্ত্রনা ভোগ অর্থাৎ পুনর্জন্ম করতে হয় না। অর্থাৎ তার মোক্ষ লাভ হয়।