একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী

একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলীএকাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলীসেই সঙ্গে আলোচনা করব একাদশীতে কি কি খাবারে নিষেধাজ্ঞা আছে, একাদশী সঙ্কল্প মন্ত্র কি, একাদশী পারন মন্ত্র কি, একাদশী পারনের নিয়ম কি, একাদশীতে কোন কোন নিয়ম পালন করতেই হবে, এবং একাদশী না থাকলে কি করতে হবে

আপনি নিজের ভালোর জন্য একাদশী ব্রত পালন করুন ও অন্যের ভালোর জন্য একাদশী ব্রত পালনে উৎসাহিত করুন।

সাধারণত ১২ মাসে চব্বিশটি একাদশী। এইগুলি হচ্ছে –
১. উৎপন্না একাদশী, ২. মোক্ষদা একাদশী, ৩. সফলা একাদশী, ৪. পুত্রদা একাদশী, ৫. ষট্তি‌লা একাদশী, ৬. জয়া/ ভৌমী একাদশী, ৭. বিজয়া একাদশী, ৮. আমলকী একাদশী, ৯. পাপমোচনী একাদশী, ১০. কামদা একাদশী, ১১. বরুথিনী একাদশী, ১২. মোহিনী একাদশী, ১৩. অপরা একাদশী, ১৪. নির্জলা একাদশী, ১৫. যোগিনী একাদশী, ১৬. শয়ন একাদশী, ১৭. কামিকা একাদশী, ১৮. পবিত্রা একাদশী, ১৯. অন্নদা একাদশী, ২০. পরিবর্তিনী বা পার্শ্ব একাদশী, ২১. ইন্দিরা একাদশী, ২২. পাশাঙ্কুশা একাদশী, ২৩. রমা একাদশী, ২৪. উত্থান একাদশী।

কিন্তু যে বছর পুরুষোত্তমাস, অধিমাস বা মলমাস থাকে, সেই বৎসর ২৫.পদ্মিনী একাদশী ও ২৬.পরমা একাদশী নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়। সেক্ষেত্রে দাঁড়ায় ছাব্বিশটি একাদশী।

যারা যথাবিধি একাদশী উপবাসে অসমর্থ অথবা ব্রতদিনে সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণে অসমর্থ, তারা নিজেরা এই একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণ করলে অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হন।

একাদশী কি? 

একাদশী হল চন্দ্র পক্ষের একটা তিথি। চাঁদের দুটি পক্ষ – শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদের পূণির্মা পর্য্যন্ত সময়কে শুক্লপক্ষ এবং অমাবস্যা পর্য্যন্ত সময়কে কৃষ্ণপক্ষ বলা হয়। পনের দিনে এক পক্ষ সমাপ্ত হয়। এই এক পক্ষের এক একটা দিনকে এক একটা তিথি বলা হয়। তিথিগুলোর নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী এবং পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যা ।

হিন্দু শাস্ত্রানুসারে একাদশীকে পুণ্যতিথি হিসেবে গ্রাহ্য করে একাদশী ব্রত পালন করা হয়। এদিন পূণ্য লাভের আশায় যে কেউ একাদশী ব্রত পালন করতে পারেন। এসময় সাধারণত ফলমূল ও বিভিন্ন সবজি এবং দুধ খাওয়া যায়, তবে একাদশীতে পঞ্চরবি শস্য বর্জন করতে হয়। বিষ্ণুর শয়ন, পার্শ্ব পরিবর্তনউত্থান উপলক্ষে যথাক্রমে আষাঢ়, ভাদ্র ও কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশী বিশেষ শুভপ্রদ গণ্য করা হয়। ভৈমী একাদশী ও মাঘের শুক্লা একাদশীকেও বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তবে প্রত্যেক একাদশী ব্রত পালনে শুভফল লাভ হয়। নিয়মিত একাদশী ব্রত পালন শরীরের পক্ষেও উপকারী। তাই স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে প্রতি মাসে দুটি একাদশী ব্রত পালন করেন।

একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

বৈদিক শাস্ত্র সিদ্ধান্ত মতে একাদশী ব্রত বা উপবাস কেনো করা হয়?

”কৃষ্ণ ভুলি যেই জীব অনাদি বহির্মুখ ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার দুঃখ।।”

—- চৈতন্যচরিতামৃত( মধ্য ২০/১১৭)

অনুবাদ :  শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড় প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট রয়েছে। তাই মায়া তাকে এ জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে।

পরম করুণাময় ভগবান, কৃষ্ণস্মৃতি জাগরিত করতে মায়াগ্রস্ত জীবের কল্যাণে বেদপুরাণে আদি শাস্ত্রগ্রন্থাবলী দান করেছেন। ভক্তি হচ্ছে ভগবানকে জানার ও ভগবৎ প্রীতি সাধনের একমাত্র সহজ উপায়।

শাস্ত্রে যে চৌষট্টি প্রকার ভক্ত্যাঙ্গের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একাদশী ব্রত সর্বত্তোম। শ্রবণ, কীর্ত্তন, স্মরণ আদি নবধা ভক্তির পরই দশম ভক্ত্যাঙ্গরূপে একাদশীর স্থান। এই তিথিকে হরিবাসর বলা হয়। তাই ভক্তি লাভে ইচ্ছুক সকলেরই একাদশী ব্রত পালনের পরম উপযোগিতার কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। একাদশী তিথি সকলের অভীষ্ট প্রদানকারী। এই ব্রত পালনে সমস্ত প্রকার পাপ বিনষ্ট, সর্বসৌভাগ্য ও শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধান হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আট থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত যে কোন ব্যক্তিরই ভক্তিসহকারে পবিত্র একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য।

➢ হিন্দু বা বৌদ্ধরা উপবাসকে (না খাবার গ্রহণ করে থাকলে) বলে “উপবাস”

➢ খ্রিস্টানরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলে ‘’ফাস্টিং”

 মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলে “সিয়াম”

➢ বিপ্লবীরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলে ‘’অনশন”

➢ আর, মেডিক্যাল সাইন্সে উপবাস করলে, তাকে বলা হয় “অটোফাজি”

কাদশী প্রতি ১৫ দিনে একবার পড়ে (পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার পরের দিন), এবং বছরের ৩৬৫ দিনে মাত্র ২৪ বার একাদশী পড়ে। তবে প্রতি তৃতীয় বছরে অধীকামাসের কারণে ২টি একাদশী যোগ করে মোট ২৬টি একাদশ করা হয়। একাদশীতে শরীর একটি বিশেষ চক্রের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় শরীরে খাবারের বিশেষ কোনো প্রয়োজন হয় না বা বাকি দিনের তুলনায় কম থাকে।

শাস্ত্র মতে একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য —

গীতার মাহাত্ম্যে উল্লেখ আছে –

‘’যোহধীতে বিষ্ণুপর্বাহে গীতাং শ্রীহরিবাসরে।
স্বপন জাগ্রৎ চলন তিষ্ঠন শত্রুভির্ন স হীয়তে।।‘’

অনুবাদ  :   অর্থাৎ, শ্রীবিষ্ণুর উৎসবের দিনে, একাদশী ও জন্মাষ্টমীতে যিনি গীতা পাঠ করেন, তিনি চলতে থাকুন বা দাঁড়িয়েই থাকুন, ঘুমিয়ে বা জেগে থাকুন (যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন), শত্রু কখনো তার কোন ক্ষতি করতে পারেনা।

🌿 একাদশী করলে কোন ব্যাক্তির কেবল মাত্র নিজের জীবনের সদগতি হয় তা নয়, একাদশী ব্যক্তির প্রয়াত পিতা ও মাতা নিজ কর্ম দোষে নরকবাসী হন, তবে সেই পুত্রের একাদশীর কর্মফলে পিতা-মাতা নরকের যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার হন।

🌿 একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে যেমন নরকবাসী হবে, তেমনই অন্যকে অন্নভোজন করালেও নরকবাসী হবে। কাজেই একাদশী ব্রত পালন করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

মেডিক্যাল সাইন্স অনুসারে উপবাসের মাহাত্ম্য —

কোষ একটি প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার নিজের ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত বিকৃত প্রোটিন কণা, ক্ষতিগ্রস্থ অর্গানেল এবং প্যাথোজেনগুলিকে সরিয়ে দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অটোফাজি। ২০১৬ সালে নোবেল কমিটি জাপানী ডাক্তার ‘ওশিনরি ওসুমি’ (Yoshinori Ohsumi)-কে অটোফাজি নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোকে শনাক্ত করার জন্যে নোবেল পুরষ্কার দেন।

এখন প্রশ্ন হল, ‘Autophagy‘ কি ?

Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে এবং Phagy অর্থ খাওয়া। সুতরাং, অটোফাজি মানে “আত্মভক্ষণ” অর্থাৎ “নিজে নিজেকে খাওয়া।”

মেডিক্যাল সাইন্স থেকে জানা যায়, শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার (পুষ্টি) না পেলে, তখন সুস্থ কোষগুলি নিজেই নিজের অসুস্থ কোষগুলোকে খেতে শুরু করে, তাকেই মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় অটোফাজি বলে। এর ফলে আবার নতুন স্বাস্থ্যকর কোষ পুনরুৎপাদন হয়।

অটোফ্যাজি কোষের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পারে বা উপাদানগুলিকে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে কোষ মেরামতের (cellular repair) জন্য ব্যবহার করে। অর্থাৎ, অটোফাজি একদিকে প্রোগ্রামড সেল ডেথ (অ্যাপোপ্টোসিস; apoptosis) কে নিয়ন্ত্রন করে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর কোষ পুনরুৎপাদন করে। কোষ বা কোষের উপদানগুলির সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে কোষীয় ভারসাম্য বা সেল হোমিওস্ট্যাসিস (cell homeostasis) বজায় রাখে।

ওশিনরি ওসুমি আবিষ্কার করেন যে ১২-২৪ ঘন্টা উপবাস রাখলে মানুষের দেহে অটোফেজি চালু হয়। তিনি প্রমান করেন যে, উপবাস থাকার মাধ্যমে মানুষের নিম্নলিখিত উপকার গুলো হয়-

১| দেহের সেল বা কোষগুলি পরিস্কার হয়।
২| ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়। ঠিকমত অটোফাজি না হলে বিকৃত, ক্ষতিগ্রস্ত জিনের কারনে ক‌্যান্সার বা পারকিনসনস্‌ ডিজিজের মত জটিল রোগ হয়।  
৩| পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়।
৪| ব্রেইনের কার্যকরীতা বাড়ে। ঠিকমত অটোফাজি না হলে বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিভ্রংশের মত রোগ দেখা দেয়।
৫| শরীর নিজে নিজেই সেরে যায় (Autophazy)।
৬| ডায়াবেটিস ভালো হয়।
৭| বার্ধক্য রোধ হয়।
৮| স্থুলতা (Obesity) নিয়ন্ত্রন হয়। 
৯| সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।

শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী

একাদশী ব্রত পালনের একমাত্র প্রকৃত উদ্দেশ্যে কেবল উপবাস করা নয়। নিরন্তর ভগবান এর নাম স্মরণ, মনন, ও শ্রবন কীর্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করতে হয়। এই দিন যতোটুকু সম্ভব উচিত একাদশী পালনে পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্য ভাষণ, ক্রোধ, দুরাচারী, স্ত্রী সহবাস, সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে তা পালন করতে হবে।

১) সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার, একাদশীতে নিরাহার, ও দ্বাদশীতে একাহার করতে হবে।

২) তা পালন করতে অসমর্থ হলে, শুধু মাত্র একাদশীতে অনাহার করতে হবে।

৩) যদি তাও পালনে অসমর্থ হলে, একাদশীতে অবশ্যই পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করবে। ফলমূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রয়েছে।

একাদশী ব্রতের আগের দিন রাত ১২ টার আগেই অন্ন ভোজন শেষ করে নিতে হয়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করে নিতে হবে যাতে দাঁতে বা মুখে একটুকরো অন্ন লেগে না থাকে।

ব্রম্ভমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করে (ভোর ৪-৪ঃ৩০) শুচিশুদ্ধ হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে প্রার্থনা করতে হয়, “হে শ্রীকৃষ্ণ, আজ যেন এই মঙ্গলময়ী পবিত্র একাদশী সুন্দরভাবে পালন করতে পারি, আপনি আমাকে কৃপা করুন।”

একাদশীতে শরীর ও মাথাতে প্রসাধনীর ব্যবহার নিষিদ্ধ, যেমন – সুগন্ধী সাবান, তেল, শ্যাম্পু ইত্যাদি। এছাড়া একাদশীতে পরনিন্দা-পরচর্চা, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, দিবানিদ্রা, সাংসারিক ঝামেলা বর্জনীয়। এই দিন গঙ্গা আদি তীর্থে স্নান করতে হয়। মন্দির মার্জন, শ্রীহরির পূজার্চনা, স্তবস্তুতি, গীতা-ভাগবত পাঠ আলোচনায় বেশি করে সময় অতিবাহিত করতে হয়।

এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের লীলা স্মরণ এবং তাঁর দিব্য নাম শ্রবণ করাই হচ্ছে সর্বোত্তম। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের একাদশীতে ২৫ মালা বা যথেষ্ট সময় পেলে আরো বেশি জপ করার নির্দেশ দিয়েছেন, তবেই আপনি চিণ্ময় আনন্দ অনুভব করবেন।

(১ মালা = ১০৮ বার)।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।

একাদশীর দিন সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম যেমন – দাড়ি-গোঁফ কাটা (শেভিং), চুল, নখ ইত্যাদি কাটা নিষিদ্ধ।

একাদশীর সময়কালে সব্জি কাটার থেকে সতর্ক থাকতে হবে। যেনো কোথাও কেটে না যায়। একাদশীতে রক্ত ক্ষরণ বর্জনীয়।

একাদশী ব্রত পালনে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ আদি বহু অনিত্য ফলের উল্লেখ শাস্ত্রে থাকলেও শ্রীহরিভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেম লাভই এই ব্রত পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভক্তগণ শ্রীহরির সন্তোষ বিধানের জন্যই এই ব্রত পালন করেন। পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বৈষ্ণবস্মৃতিরাজ শ্রীহরিভক্তিবিলাস আদি গ্রন্থে এ সকল কথা বর্ণিত আছে।

হরিবাসরে (একাদশীতে) রাত্রি জাগরণের বিধি আছে। মহান গোস্বামীগন ও আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত তালিকা বা পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) ব্রত পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেগুলি সেই মতো পালন করলে সর্বোত্তম হয়।

একাদশীর মাহাত্ম্য ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবণ করতে হয় অথবা সম্ভব না হলে নিজেই ভক্তি সহকারে পাঠ করতে হয়। কৃষ্ণ ভজন, কৃষ্ণ কথা, শ্রীমদ্ভাগবতম, শ্রীমদ্ভাগবত কথা, চৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাকথা, জগন্নাথদেবের লীলাকথা প্রভৃতি পাঠ করতে হবে। সম্ভব হলে শুদ্ধ ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবণ করতে হবে। 

 নির্জলা ও নিরাহার থেকে একাদশী পালন করতে একান্ত অপারগ হলে জল সহ কিছু সবজি, ফলমূল গ্রহণ করতে পারবে। নির্জলা উপবাস শুষ্ক উপবাস নামে পরিচিত। যেমন, আলু, মিষ্টি আলু, কুমড়ো, চালকুমড়ো, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি সবজি, ঘি, সূর্যমুখী তেল অথবা বাদাম তেলে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে, আহার করতে পারবেন। কাঁচা হলুদ অথবা ঘরে বানানো গুঁড়ো হলুদ, মরিচ, সৈন্ধব লবণ (Rock salt) ব্যবহার করবেন।

 আবার অন্যান্য আহার্য যেমন, দুধ, দই, কলা, আপেল, আঙুর, আনারস, আঁখ, আমড়া, তরমুজ, বেল, নারিকেল, আলু, বাদাম, লেবুর শরবত ইত্যাদি ফলমূল খাওয়া যায়।

 একাদশীতে সাবু খাওয়া যায় তবে অনেকক্ষেত্রে সাবু দানার উপর ময়দার কোটিং দেওয়া হয় ভারি করার জন্য, নিশ্চিত না হলে সাবু না খাওয়াই ভালো।

একাদশীতে পাঁচ প্রকার রবিশস্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে —

১) ধান জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন, চাল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি ,চালের পিঠা, খৈ, ইত্যাদি।

২) গম জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন, আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির বিস্কুট, বা সকল প্রকার বিস্কুট, বেকারির রুটি, হরলিক্স জাতীয় ইত্যাদি।

৩) যব বা ভূট্টা জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন, ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি।

৪) ডাল জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন, মুগ, মসুরী, মাসকলাই, খেসারী, ছোলা, অড়হর, বিউরি, মটরশুঁটি, বরবটি, সিম ইত্যাদি।

৫) সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিল তেল, ইত্যাদি।

একাদশীতে রান্নার সময় পাঁচ ফোড়ন ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত। কারন, পাঁচ ফোঁড়নে অনেক সময় সরিষার তেল ও তিল থাকে, যা বর্জনীয়।

উপরোক্ত পঞ্চ রবি শস্য যে কোনো একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয় ও পাপ ভক্ষণ করা হয়। কারন, মাত্র ১টি খাদ্য শস্যের মধ্যে চার ধরনের পাপ থাকে। পাপ গুলো হল —

১। মাতৃ হত্যার পাপ।
২। পিতৃ হত্যার পাপ।
৩। ব্রহ্ম হত্যার পাপ।
৪। গুরু হত্যার পাপ।

সুতরাং, আমরা ভোজনে মাত্র একটি দানা নয়, হাজার হাজার রবিশস্য দানা ভক্ষণ করি। ভাববার বিষয় হল, যে পাপকর্ম আমি করিনি সেই পাপকর্মের ভাগীদার আমাকে নিতে হবে।

একাদশীতে খাদ্যশস্য গ্রহণ করলে যে পাপ হবে অন্যকে খাওয়ালেও সেই একই পাপ হয়।

একাদশীতে চা, বিড়ি, সিগারেট, পান, কফি, মদ, আফিম, গাঁজা, বা অন্য কোনও জাতীয় নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করবেন না।

একাদশী সংকল্প মন্ত্র

একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –

একাদশ্যাম্‌ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।

ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্‌ মে ভবাচ্যুত।।

অনুবাদ :  হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।

একাদশী পারন মন্ত্র

একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে। 

একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —

অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।

প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥

—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)

অনুবাদ :  হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।

একাদশী ব্রত কেন করা উচিত?

আমরা কেন একাদশী করব এবং বিভিন্ন পুরানে একাদশী মহাব্রত সম্পর্কে কি বলা হয়েছে?

ভক্তি সহকারে একাদশী ব্রত পালন করলে সকল ধরনের যজ্ঞের ফল ও সকল প্রকার ব্রত পালনের ফল লাভ হয়। এই তিথিতে খাদ্যশস্য গ্রহণকারীকে পশুর থেকে নিকৃষ্ট বলে শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে।

১) একাদশী নিয়ে বিভিন্নপুরাণে লিখিত মুনিদের এক নিশ্চিত মত যে, একাদশীতে উপবাস করলে সব পাপ থেকে মুক্ত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। (ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ)

২) শ্রী যমরাজ ব্রাহ্মনকে বলেছেন, হে ব্রাহ্মণ! যাদের পুত্র ও পৌত্র একাদশী ব্রত পালন করে আমি শাসন কর্তা, মৃত্যুর দূত যম হয়েও বিশেষরূপে তাদের কাছে যেতে ভীত হই। যারা একাদশী ব্রত পালন করে সেই মহাত্মারা বলপূর্বক নিজের শত পুরুষ উদ্ধার করেন। (পদ্মপুরাণ)

৩) একাদশীতে যে উপবাস, ইহাই সার, ইহাই তত্ত, ইহাই সত্য, ইহাই ব্রত, ইহাই সম্যক প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ। (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ)

৪) যে মানুষ একাদশীর দিন শস্যদানা (পাঁচ প্রকার রবিশস্য) গ্রহণ করে সে তার পিতা, মাতা, ভাই এবং গুরু হত্যাকারী এবং সে যদি বৈকুন্ঠ লোকে উন্নীত হয় তবুও তার অধঃপতন হয়। (স্কন্দপুরাণ)

৫) শুধু বিধবাদের জন্য নয়, শাস্ত্র অনুসারে সকল মানুষের মঙ্গলার্থে একাদশী ব্রত পালন করার প্রথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তন করে ছিলেন। (শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত আদিলীলা (১৫/৮-১০)

৬) হে রাজন! যতদিন আয়ু থাকবে ততদিন একাদশী উপবাস থাকবে। (অগ্নিপুরাণ)

৭) বিধবা রমণী একাদশীতে আহার গ্রহণ করলে, তার সর্বপ্রকার সুকৃতি নষ্ট হয় এবং দিনদিন তার ভ্রূণহত্যাসম পাপের অপরাধ হয়। (কাত্যায়ন সংহিতা)

৮) যিনি একাদশী ব্রত পরিত্যাগ করে অন্য ব্রতের উপাসনা করেন, তার হাতের মহা মূল্যবান রত্ন পরিত্যাগ হয়, তার বদলে লোহার দ্রব্য প্রাপ্ত হয়। (তত্ত্বসাগর)

৯) দেবাদিদেব শিব দূর্গাদেবীকে বলেছেন হে মহাদেবী! যারা হরি বাসরে (একাদশীতে) ভোজন করে যমদূতগণ যমালয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের অগ্নিবর্ন তীক্ষ লৌহ অস্ত্র তাদের মুখে নিক্ষেপ করে। (স্কন্দপুরাণ)

তবে কেন আমরা জেনে শুনে পাপ কর্ম করব?

আমাদের মধ্যে যেসকল ভক্তবৃন্দরা একাদশী মহাব্রত পালন না করে যে পাপ করছেন, আসুন তারা সহ সকল ভক্তবৃন্দরাই একসাথে প্রতিজ্ঞাসহ একাদশী মহাব্রত পালন করি এবং আমাদের এই দুর্লভ মানব জীবনকে স্বার্থক করি।

একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল?

পদ্মপুরাণের চতুর্দশ অধ্যায়ের ‘ক্রিয়া সাগর সার’ অংশে একাদশী প্রসঙ্গে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। একসময় জৈমিনি ঋষি তাঁর গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব! একাদশীর জন্ম কখন হয়েছিল এবং তার জন্মের উৎসই বা কি? একাদশীর দিন উপবাস পালনের বিধি বা কি? দয়া করে এই ব্রত পালনের কি লাভ এবং কখন এই ব্রত উদযাপন করতে হবে তার বর্ণনা করুন। শ্রী একাদশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা কে? একাদশীর নিয়ম পালন না করার অপরাধ কি? এ সব বিষয়ে আপনি কৃপা করে বলুন।”মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে শুরু করলেন — সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণই পঞ্চমহাভূত দ্বারা এই জড় সংসারে স্থাবর-অস্থাবর বস্তুর সৃষ্টি করলেন। সেই সঙ্গে মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একজন পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হল।

মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে শুরু করলেন — সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণই পঞ্চমহাভূত দ্বারা এই জড় সংসারে স্থাবর-অস্থাবর বস্তুর সৃষ্টি করলেন। সেই সঙ্গে মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একজন পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হল।

পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চোখ দুটি-মদ্যপান বা নেশায় আসক্তি জনিত পাপ, মুখ-স্বর্ণ অপহরণ জনিত পাপ, দুই কর্ণ-গুরুপত্নীর প্রতি আসক্তি জনিত পাপ, দুই নাসিকা-স্ত্রীহত্যা জনিত পাপ, দুই বাহু-গোহত্যা জনিত পাপ, গ্রীবা-ধন অপহরণ জনিত পাপ, গলদেশ-ভ্রূণহত্যা জনিত পাপ, বক্ষ-পরস্ত্রীর সাথে আসক্তি জনিত পাপ, উদর-আত্মীয়স্বজন হত্যা জনিত পাপ, নাভি-শরণাগত হত্যা জনিত পাপ, কোমর-আত্মশ্লাঘা (নিজের প্রশংসা বা আত্মতুষ্টি) জনিত পাপ, দুই উরু-গুরুনিন্দা বা গুরুর প্রতি অপরাধ জনিত পাপ, শিশ্ন (যৌনাঙ্গ)-কন্যা বিক্রি জনিত পাপ, মলদ্বার-গুপ্তকথা প্রকাশ জনিত পাপ, দুই পা-পিতৃহত্যা জনিত পাপ, শরীরের রোম-অন্যান্য পাপ কর্মাদি। এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হল। শরীর ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, চোখ দুটি পীতবর্ণ, সে পাপীদের অতীব দুর্দশা দান করে।

এই সময় যমরাজও নানা প্রকার নরক সৃষ্টি করলেন। মৃত্যুর পর পাপীদের যমরাজের কাছে পাঠান হবে এবং তিনি তাদের পাপ অনুসারে বিভিন্ন নরকে যন্ত্রণা ভোগের জন্য পাঠাবেন।

একদিন গরুড়ের পিঠে চড়ে ভগবান পৌঁছালেন যমরাজের মন্দিরে। যমরাজ ভগবানকে স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পা ধুয়িয়ে দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন। যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জীবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি।  উচ্চ চিৎকার শুনতে পেলেন। আশ্চর্য হয়ে তিনি যমরাজকে প্রশ্ন করলেন, “কারা এ আর্তক্রন্দন করছে? কেনই বা করছে?” 

যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্ত্যের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে আর সেই যন্ত্রণার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান বিষ্ণুর হৃদয় করুনাতে গলে গেল। তিনি চিন্তা করলেন-আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্মদোষে দুষ্ট হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদগতির ব্যবস্থা করব। ভগবান শ্রীবিষ্ণু সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশীরূপে এক দেবীমূর্তিতে প্রকাশিত হলেন। মা যেমন তার সন্তানের ভুলভ্রান্তি, অন্যায় ক্ষমা মার্জনা করে দেন, তেমনই পাপাচারীদের পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য ভগবান বিষ্ণু মাতৃস্বরুপা একাদশীরূপে দেবীমূর্তি ধারন করেছিলেন। তিনি সেই পাপীদেরকে নিষ্ঠার সাথে একাদশী ব্রত পালন করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুন্ঠ ধামে গমন করল।

শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! একাদশী, পরমেশ্বর বিষ্ণু ও পরমাত্মার বিগ্রহে প্রভেদ নাই। শ্রীএকাদশী পালন সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ম ও সকল ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত।

শ্রীএকাদশী আবির্ভাবের সাথে সাথে ভগবানের সৃষ্ট পাপপুরুষ একাদশীর প্রতিকূল প্রভাব অনুভব করতে লাগল। সে বিষ্ণুর স্তব, মহিমা-কীর্তন করতে লাগল। বিষ্ণু প্রসন্ন হয়ে তাকে বর দিতে চাইলেন।

পাপপুরুষ তখন শ্রীবিষ্ণুর কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থনা করতে লাগল-“হে ভগবান! আমি আপনার থেকে সৃষ্ট। পাপীদের শাস্তি আমার মাধ্যমে আপনি দিতে চেয়েছিলেন। পাপীদের কর্ম অনুযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল। কিন্তু এখন একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি। এই একাদশী ব্রত পালনের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকুন্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। যে একাদশী ব্রত পালন করবে তারাও বৈকুন্ঠধাম লাভ করবে। হে ভগবান, এখন আমার কি হবে? আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব? সবাই যদি বৈকুন্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কি হবে? আপনিই বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে লীলা করবেন? পাপপুরুষ আকুল প্রার্থনা করতে লাগল- হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে লীলা করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দুর করুন। একাদশী তিথির ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন! আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি। মানুষ, পশুপাখী, কীট-পতঙ্গ, জল-স্থল, বন-প্রান্তর, পর্বত-সমুদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয়ে স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। হে ভগবান! এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় নিতে পারছি না। আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্থান প্রদান করুন।”

এরপর ব্যাসদেব জৈমিনীকে বললেন, – “এইরূপ প্রার্থনা করে পাপপুরুষ পরমেশ্বর বিষ্ণুর পাদপদ্মে নিপতিত হয়ে কাঁদতে লাগল।”

পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বলতে লাগলেন- “হে পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করো না। যখন একাদশী এই ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে একাদশী তিথিতে আবির্ভুত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্যের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। তা হলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না।”

এরপর ভগবান শ্রীবিষ্ণু অন্তর্ধান হলেন এবং পাপপুরুষ নিজের কাজে লিপ্ত হল।

“সূতরাং সেই থেকে পরম লাভে চেষ্টাবান ব্যক্তিরা একাদশীর দিন খাদ্যশস্য গ্রহণ করেন না। বিষ্ণুর আদেশে জড়-জগতে সকল প্রকার পাপকর্ম একাদশীর দিন খাদ্যশস্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। একাদশী পালন করলে সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় এবং কখনো নরকগামী হতে হয় না। একমুঠো শস্য খেলে কোটি ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ হয়। একাদশী যারা পালন না করে তারা তো পাপীর অধম। সেই কারণে শাস্ত্রে বারবার বলা হয়েছে যে একাদশীতে কখনও খাদ্যশস্য ভক্ষণ করো না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র নির্বিশেষে একাদশী পালন করা অবশ্য করণীয়। ইহাই বর্ণাশ্রমের ভিত্তি। একাদশী পালন করলেই সর্বপাপ নাশ হয় ও অবশ্যই বৈকুণ্ঠধাম লাভ করা যায়।

একাদশী ব্রত-পারণ কালে মহাপ্রসাদ-সম্মান-বিচার

একদিন গৌরহরি,         শ্রীগুণ্ডিচা পরিহরি,

‘জগন্নাথবল্লভে’ বসিলা।

শুদ্ধা একাদশী-দিনে,         কৃষ্ণনাম-সুকীৰ্ত্তনে,

দিবস রজনী কাটাইলা।।

সঙ্গে স্বরূপদামোদর,         রামানন্দ, বক্রেশ্বর,

আর যত ক্ষেত্রবাসিগণ।

প্রভু বলে, “একমনে,         কৃষ্ণনাম-সঙ্কীৰ্ত্তনে,

নিদ্রাহার করিয়ে বর্জ্জন।।

কেহ কর সংখ্যানাম,         কেহ দণ্ডপরণাম,

কেহ বল রামকৃষ্ণ-কথা।”

যথা তথা পড়ি’ সবে,         ‘গোবিন্দ’ ‘গোবিন্দ’ রবে,

মহাপ্রেমে প্রমত্ত সৰ্ব্বথা।।

হেনকালে গোপীনাথ,         পড়িছা সাৰ্ব্বভৌম-সাথ,

গুণ্ডিচা-প্ৰসাদ লঞা আইল ৷

অন্নব্যঞ্জন, পিঠা, পানা,         পরমান্ন, দধি, ছানা,

মহাপ্রভু-অগ্রেতে ধরিল।।

প্রভুর আজ্ঞায় সবে,          দণ্ডবৎ পড়ি’ তবে,

মহাপ্রসাদ বন্দিয়া বন্দিয়া ।

ত্রিযামা রজনী সবে         মহাপ্রেমে মগ্নভাবে,

অকৈতবে নামে কাটাইয়া।।

প্রভু-আজ্ঞা শিরে ধরি’,          প্রাতঃস্নান সবে করি’,

মহাপ্রসাদ সেবায় পারণ।

করি’ হৃষ্ট চিত্ত সবে,          প্রভুর চরণে তবে,

করযোড়ে করে নিবেদন।।

“সর্ব্বব্রত-শিরোমণি,         শ্রীহরিবাসরে জানি,

নিরাহারে করি জাগরণ।

জগন্নাথ-প্রসাদান্ন,          ক্ষেত্রে সৰ্ব্বকালে মান্য,

পাইলেই করিয়ে ভক্ষণ।।

এ সঙ্কটে ক্ষেত্রবাসে,          মনে হয় বড় ত্রাসে,

স্পষ্ট আজ্ঞা করিয়ে প্রার্থনা।

সৰ্ব্ববেদ আজ্ঞা তব,          যাহা মানে ব্রহ্মা-শিব,

তাহা দিয়া ঘুচাও যাতনা।।”

প্রভু বলে,—“ভক্তি-অঙ্গে,          একাদশী-মান-ভঙ্গে,

সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত হয়।

প্রসাদ-পূজন করি,          পরদিনে পাইলে তরি,

তিথি পরদিন নাহি রয়।।

শ্রীহরিবাসর-দিনে,           কৃষ্ণনাম-রসপানে,

তৃপ্ত হয় বৈষ্ণব সুজন।।

অন্য রস নাহি লয়,           অন্য কথা নাহি কয়,

সর্ব্বভোগ করয়ে বৰ্জ্জন।।

প্রসাদ- ভোজন নিত্য,          শুদ্ধ বৈষ্ণবের কৃত্য,

অপ্রসাদ না করে ভক্ষণ।

শুদ্ধা-একাদশী যবে,          নিরাহার থাকে তবে,

পারণেতে প্রসাদ-ভোজন।।

অনুকল্প-স্থানমাত্র,           নিরন্ন প্রসাদপাত্র,

বৈষ্ণবকে জানিহ নিশ্চিত।

অবৈষ্ণব জন যা’রা,          প্রসাদ-ছলেতে তা’রা,

ভোগে হয় দিবানিশি রত।

পাপ-পুরুষের সঙ্গে,          অনাহার করে রঙ্গে,

নাহি মানে হরিবাসর-ব্রত।।

ভক্তি-অঙ্গ-সদাচার,           ভক্তির সম্মান কর,

ভক্তিদেবী-কৃপা-লাভ হবে।

অবৈষ্ণব-সঙ্গ ছাড়,           একাদশী-ব্রত ধর,

নাম-ব্রতে একাদশী তবে।।

প্রসাদসেবন আর শ্রীহরিবাসরে।

বিরোধ না কর কভু বুঝহ অন্তরে।।

এক অঙ্গ মানে, আর অন্য অঙ্গে দ্বেষ।

যে করে, নির্ব্বোধ সেই জানহ বিশেষ।।

যে অঙ্গের যেই দেশ-কাল-বিধি -ব্রত।

তাহাতে একান্তভাবে হও ভক্তিরত।।

সর্ব্ব অঙ্গের অধিপতি ব্রজেন্দ্রনন্দন।

যাহে তেঁহ তুষ্ট তাহা করহ পালন।।

একাদশী-দিনে নিদ্রাহার-বিসর্জ্জন।

অন্য দিনে প্রাসাদ-নিৰ্ম্মাল্য সুসেবন।।

শ্রীনামভজন আর একাদশী-ব্রত।

একতত্ত্ব নিত্য জানি’ হও তাহে রত।।”

—-(শ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত)

Join to Our Community
Community Grows With You
whatsapp
x