এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির মাহাত্ম্য ও পায়ের নুপুরের মাহাত্ম্য কী?
► আরও পড়ুন : দেবতারা কেন স্বর্গে থাকেন আর দানবরা কেন পাতালে থাকেন ?
► আরও পড়ুন : হিন্দু ধর্মের যুগ বিভাগ ~ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ
► আরও পড়ুন : মঙ্গলাচরণ ইসকন ( Iskcon Mangalacharan in Bengali)
► আরও পড়ুন : Shri Narasimha Kavacham Iskcon -শ্রীনৃসিংহ কবচম্, স্তব, নাম
► আরও পড়ুন : সনাতন ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্ম-এর মধ্যে সম্পর্ক কী?
–:- শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির মাহাত্ম্য কী ? –:-
কথিত আছে, কৃষ্ণের মুখে সর্বদা বাঁশিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গোপীরা বাঁশির উপরে ভীষণ রুষ্ট হন । কারণ, ও বাঁশির জন্যই তো কৃষ্ণ তাঁদের দিকে মন দেন না! সেজন্য সকলে মিলে একদিন মনস্থির করলেন, বাঁশিটিকে কোনও ভাবে চুরি করতে হবে এবং সেটিকে ভেঙে ফেলতে হবে যাতে কৃষ্ণ আর কোনদিন বাঁশিটি ব্যবহার করতে না পারেন। কিন্তু চুরি করবেন কি ভাবে? কৃষ্ণ যে সব সময় বাঁশিটিকে তাঁর সঙ্গেই রাখেন! শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরে বাঁশিটিকে নিজের থেকে দূরে রেখে অন্যদিকে মনোনিবেশ করলেন। তাঁরা ভাবল কৃষ্ণ বুঝি অসতর্ক, বাঁশির প্রতি কোনও ধ্যানই নেই! সেই সুযোগে চুপি চুপি বাঁশিটিকে তাঁরা চুরি করলেন। গোপীদের মনের উৎফুল্লতা দেখে শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করল, তার বহিঃপ্রকাশ ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল। ভগবান এমনই করুনাময়! এমনই ভক্তপ্রেমী! ভক্তের আনন্দে যেমন প্রসন্ন হন, ভক্তের কষ্টে উদ্বেলিত হন! ভক্তের মনবাঞ্ছা ঠিক পূরণ করেন। গোপীরা আনন্দে গদগদ হরে বলাবলি করতে লাগল প্রথম কাজটি সফল হয়েছে, দ্বিতীয় কাজটি এক্ষুনি সেরে ফেলতে হবে! যেই না বাঁশিটিকে ভাঙতে যাবে বাঁশি আর্তনাদ করে উঠল : “এভাবে আমাকে আপনারা কৃষ্ণের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলেন কেন ?” গোপীরা হতবাক হয়ে বললেন : “তুমিই আমাদের কষ্টের কারন, তুমিই আমাদের হতাশার কারন। তোমার এমন কি গুণ আছে যে, তুমি সর্বদা কৃষ্ণের হাতে হাতে ফের আর তাঁর অধর স্পর্শ, তাঁর সান্নিধ্য উপভোগ করে থাকো?” বাঁশি গোপীদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল : “গুণের কথা ছেড়ে দিন, আমার তো কোন অস্তিত্ব নেই । কারণ , আমার ভেতরে যে শাঁস ছিল তা বের করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমার নিজস্ব কোন সত্তাই এখন আর নেই। আমার গোটা শরীরটাই ফোঁপরা- ফাঁপা । সুতরাং আমার আমিত্ব বলে আর কিছু নেই । আমার যা- কিছু সব তাঁর । আমার নিজের কোন সুরও নেই, তানও নেই । কৃষ্ণের সুর, কৃষ্ণের তানই আমার সুর…আমার তান। তিনি যে ভাবে আমাকে বাজান, আমি সে ভাবেই বাজি। শরণাগতকে তিনি কখনো পরিত্যাগ করেন না । আমার সর্বস্ব তাঁকে অর্পণ করে আমি তাঁর আশ্রয় নিয়েছি। তাই তিনি আমাকে তাঁর অধরে রাখেন। আমি শুধু তাঁর হাতের যন্ত্র মাত্র। আমি যে অহংশূন্য।” গোপীরা বুঝলেন বাঁশির মাহাত্ম্য, যখন কেউ বাঁশির মতো নিজের সর্বস্ব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সমর্পন করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অহংশূন্য করতে পারে, তিনি সে কৃষ্ণের হাতের বাঁশির মতো ভগবানের সান্নিধ্য পাবার যোগ্য হয়। বাঁশির ভেতরের সার পদার্থ যখন বের করে দেওয়া হয় তখন নিশ্চয় তার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। অহংকার-অভিমান ত্যাগ করা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু যদি নির্মম ভাবে নিজেকে অহংশূন্য করা যায় তখনি আমরা তাঁর হাতের যন্ত্র হতে পারি, অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তির পথে একধাপ এগিয়ে ভগবানের করুনা লাভ করতে পারি। তিনি অবশ্যই কৃপা করে বাঁশির মতো আমাদেরকেও তাঁর অধরে স্থান দেবেন। আমাদেরকে তাঁর যন্ত্র করবেন। 🙏 হরে কৃষ্ণ 🙏
–:- শ্রীকৃষ্ণের পায়ের নুপুর ছোট বড় কেন? নুপুরের মাহাত্ম্য কী? –:-
শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে হারানোর পর রামধনুকটি মাটিতে রেখে কাঁদছেন।
হঠাৎ ভ্রাতা লক্ষণ দেখতে পেলেন রামচন্দ্রের চোখের জলের ধারা মাটিতে পড়ছে। কিন্তু সেখানে চোখের জল নয় সেটা রক্তের ধারা! লক্ষণ বিনীত স্বরে ভ্রাতা রামচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রাতা একি, আপনি কাঁদছেন অথচ মাটি রক্তে ভেসে যাচ্ছে কেন? তখন রামচন্দ্র ধনুক সরিয়ে দেখলেন একটি আহত রক্তাক্ত ব্যাঙ ধনুকের নিচে আর তারই রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি।
রামচন্দ্র এমন অবস্থা দেখে ব্যাথিত হলেন এবং ব্যাঙটিকে অতি সযত্নে হাতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন – “ওরে ব্যাঙ! সাপে যখন তোকে আহার ভেবে খেতে যায়, তখন তো চিৎকার করিস। তাহলে এখন কেন চুপ করে রইলি?”
তখন ব্যাঙ সবিনয়ে প্রত্যুতরে জানালো – “প্রভু বারবার আহারের জন্য যখন আক্রান্ত হই, তখন নিজের ভাগ্যের উপর আক্ষেপ হয় আর আমি চিৎকার করে প্রভুর (ভগবানের) কাছে নালিশ জানাই। আর এই মুহূর্তে আমি দুর্ভাগ্যবশত স্বয়ং প্রভুর দ্বারা আক্রান্ত, তাহলে প্রভু আমি কার কাছে নালিশ জানাব?”
তখন রামচন্দ্র জানতে চাইলেন – “তুমি পুর্ব জন্মে কি ছিলে?”
তখন ব্যাঙ উত্তরে বললো – “আমি ছিলাম কর্ণব আর আমার গুরুদেব ছিলেন বিশ্বাবসু। গুরুর চরণ সেবা করতে গিয়ে একদিন নখের আঁচর লেগেছিল। তাতে গুরুদেব ক্ষুন্ন হয়ে আমায় অভিশাপ দিয়েছিলেন যে আমি পরজন্মে ব্যাঙ কুলে জন্ম নেব।”
আমার অজান্তে এমন ভুল হয়েছে স্বীকার করে গুরুদেবের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে প্রার্থনা করেছিলাম “গুরুদেব! এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় কি আছে সেই আশীর্বাদটুকু দিন। তখন আশীর্বাদ দিয়েছিলেন আমার মৃত্যু প্রভু রামচন্দ্রের হাতেই হবে তবে সবকিছুই হবে অজান্তে।”
সব কিছু শোনার পর রামচন্দ্র ব্যাথিত হৃদয়ে ব্যাঙের কাছে জানতে চাইলো “আমাকে তোমার শেষ ইচ্ছে জানাও ?”
মৃত্যুকষ্টে থেকেও প্রভুর মুখের অমৃতময় কথা শুনে ব্যাঙের হৃদয় বিগলিত হল এবং করুণস্বরে বললো – “আমার শেষ ইচ্ছা আমার গুরুদেব যেন অন্তিমকালে আপনার শ্রীচরণে ঠাঁই পান।”
তখন রামচন্দ্র ব্যাঙটিকে আশ্বস্ত করে বললেন, “তবে শোনো, আমি যখন পরের যুগে অর্থাৎ দ্বাপর যুগে আবার আসব শ্রীকৃষ্ণ হয়ে তখন তুমি থাকবে আমার ডান পায়ের নুপুর হয়ে আর তোমার গুরুদেব বিশ্বাবসু থাকবেন আমার বাম পায়ের নুপুর হয়ে। তবে দুজন ছোট বড় হয়ে আমার পায়ের নুপুর হয়ে থাকবে।”
নুপুরের মাধ্যমে ভগবানের কৃপা ও ভক্তের প্রতি অপার করুনা বিকশিত হয়েছে –
১। গুরুদেব বিশ্বাবসু ও তাঁর শিষ্য কর্ণব দুজনেই ভগবানের ভক্ত। বিশ্বাবসুর অভিশাপ যেমন কার্যকর করেছেন, তেমনি তাঁর শিষ্যকে দেওয়া আশীর্বাদও ভগবান সাগ্রহে গ্রহণ করে তাঁকে সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। এ থেকেই পরিষ্কার, ভগবানের কাছে ভক্তের গুরুত্ব কতখানি!
২। বিশ্বাবসুকে আঁচর লেগেছিল অজান্তেই তাঁর শিষ্য কর্ণবের দ্বারা, তেমনি অজান্তেই তাঁর মৃত্যু কামনা করে অভিশাপ ছুঁড়ে দিয়েছিল কর্ণবের দিকে। ভগবান সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপন্ন করেছেন।এ থেকে আরও পরিষ্কার, ভগবান ভক্তের মনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না।
৩। শুদ্ধ ভক্তকে ভগবান নিজের থেকে দূরে রাখেন না, তাঁর অধরে স্থান দেন কখনও বাঁশির মতো বা কখনও নুপুরের মতো। তাই আমাদের অতি অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে শুদ্ধ ভক্ত হবার।
🙏 হরে কৃষ্ণ 🙏