এই অধ্যায়ে আমরা নারদ মুনির মনে উদিত হওয়া একটি প্রশ্নের “দেবতারা কেন স্বর্গে থাকেন আর দানবরা কেন পাতালে থাকেন ?” যথাযথ পর্যালোচনা করার প্রয়াস করছি।
দেবর্ষি নারদ একবার ব্রহ্মলোকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাজীর কাছে পৌঁছালেন এবং প্রশ্ন করলেন “দেবতারা কেন স্বর্গে থাকেন আর দানবরা কেন পাতালে থাকেন ?”
ব্রহ্মাজী বললেন, “হে দেবর্ষি নারদ! দেবতারাও আমার সন্তান আর দানবরাও আমারই সন্তান, তাই এই প্রশ্নের উত্তর যদিও আমার দেওয়া উচিৎ নয় , তবে আমি তোমাকে আগামীকাল একটা উদাহরন দেখিয়ে বুঝিয়ে দেবো !! যাও তুমি আজ সকল দেবতা ও দানবদের কাছে গিয়ে নিমন্ত্রন করে এসো ,আগামীকাল তারা যেন আমার এখানে দ্বিপ্রহরে ভোজন সেবা গ্রহণ করতে আসেন।”
দেবর্ষি নারদও খুশি মনে পিতার আদেশ পালন করলেন। তিনি স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের আর পাতালে গিয়ে দানবদের নিমন্ত্রন করে ফিরে এলেন।
পরদিন দুপুরবেলা প্রথমে দানবরা এসে হাজির হলেন। বসানো হল ভোজনের জন্য। দানবেরা ভোজন শুরু করতে যাবেন, ঠিক সেইসময় ব্রহ্মাজী একজন দানবের হাত ধরে ফেললেন এবং বললেন, তোমরা ভোজন শুরু করার আগে আমার একটি শর্ত মানতে হবে ! যদিও শর্তটি খুবই সামান্য! দানবরা একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ব্রহ্মাজীর দিকে। শর্তটি হলো আমি তোমাদের সবার হাতে একটুকরো কাঠ বেঁধে দেবো তারপর তোমরা ভোজন করতে পারবে !
দানবদের শক্তি বেশি হলেও বুদ্ধিতে বেশ খাটো। সামান্য কাঠের টুকরো তাদের শক্তির কাছে সে আবার এমন কি! শেষমেশ রাজী হল।
এরপর সকল দানবদের হাতে একটুকরো লাঠি বেঁধে দেওয়া হলো এমন ভাবে তারা যেন হাত কিছুতেই বাঁকা করে খেতে না পারে ! দানবরা তো হাত বাঁকা করতে না পেরে কেউ কেউ মাটিতে শুয়ে ভোজন শুরু করে দিলেন, আবার কেউ কেউ পা দিয়ে কোনোমতে ভোজনের থালাটা উপরে তুলে অতিকষ্টে ভোজন করতে লাগলেন। অবশেষে তারা ভালো করে, তৃপ্তিজনকভাবে ভোজন করতে না পেরে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন এবং ব্রহ্মাজীকে ভীষণভাবে বকাবকি তিরস্কার করতে শুরু করলেন! যদি এভাবেই দুই হাতে কাঠের টুকরো বেঁধে আমাদের ভোজন করতে দেওয়া হয় তাহলে কেন আমাদেরকে নিমন্ত্রন করে এখানে আনা হয়েছে? তবে কি আমাদের এখানে অপমান করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে ?
ঠিক সেইসময় দেবতারা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং তারাও ভোজন করতে বসলেন। ব্রহ্মাজী বললেন, তোমরা ভোজন শুরু করার আগে আমার একটি শর্ত মানতে হবে ! যদিও শর্তটি খুবই সামান্য! শর্তটি হলো আমি তোমাদের সবার হাতে একটুকরো কাঠ বেঁধে দেবো তারপর তোমরা ভোজন করতে পারবে !
শর্ত শুনে দেবতারাও রাজী হল। পরমপিতা ব্রহ্মাজী তাদেরও হাত ঐ একইভাবে কাঠের টুকরো বেঁধে দিলেন। ততক্ষনে দেবতারা বেশ বুঝে গেছেন যে হাত সোজা করে তো ভোজন করা যাবে না বরং অন্যকে খাওয়ানো যেতে পারে। সেইমতো হাত সোজা রেখেই দেবতারা খুবই আনন্দ সহকারে একে অপরকে ভোজন করাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর দেবতাদের ভোজন শেষ হয়ে গেল। এবার দেবতারা একে অপরকে হাত ধোয়ালেন।
এই দৃশ্য দেখে দানবরা খুবই লজ্জিত হয়ে গেলেন এবং তারা আফসোস করতে লাগলো যে, দেবতাদের এই চিন্তাভাবনাটা আগে কেন আমাদের মাথায় আসে নি !
দূর থেকে দেবর্ষি নারদ এই দৃশ্য দেখে ওঁনার এতদিনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন এবং ব্রহ্মাজীকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও প্রনাম জানালেন।
এখন প্রশ্ন হলো ব্রহ্মাজীর দেওয়া শিক্ষা থেকে নারদ মুনি কি এমন উত্তর খুঁজে পেলেন?
নারদ মুনি বুঝলেন বুদ্ধি ও যোগ্যতার দ্বারা দেবতারা স্বর্গলোকে অবস্থান করেন আর দানবরা থাকেন পাতালে। শুধু তাই নয়, দেবতারা দেখালেন অন্যের প্রতি সৌহার্দ্যতা, ভালোবাসা এবং পরোপকারিতা। তিনি আরও লক্ষ্য করলেন, কেমনভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে প্রয়োজন হয় সহিষ্ণুতার। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধর্মের সারটুকু। যেমন – নিজের জন্য নয় অন্যের জন্য বাঁচো ও বাঁচতে শেখাও। পরোপকার করার মানসিকতা রাখো। ধর্মের পথে অনেক প্রতিকূলতা আসবে, সে সাংসারিক জীবনেই হোক বা ভক্তিপথেই হোক, সহিষ্ণুতার সাথে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে, নচেৎ ভক্তিপথ থেকে দূরে সরে যেতে হবে। ভক্তিপথে থাকলে কত লোকে কত কথা বলবে, মনে আঘাত দেবে, আপনদের কাছে পীড়িত হবে …তবু ভক্তিপথে টিকে থাকতে হবে সহিষ্ণুতার সাথে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই-এর সাথে। এতে ভগবান ও ভক্তের মধ্যে দূরত্ব কমে, ভগবানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস জন্মাবে। বিশ্বাস আপনাকে করতেই হবে, এমন ভক্তগনকে ভগবান সর্বদা আগলে রাখে।