এই অধ্যায়ে আমরা জানব হিন্দুধর্মে পঞ্চতত্ত্ব (Pancha Tattva) কারা? পঞ্চতত্ত্বের গুরুত্ব ইসকন তা শাস্ত্রীয় মতে কিভাবে ব্যাখা করেছেন জেনে নিই।
প্রত্যেক জীবের প্রত্যহ মঙ্গলাচরণ পাঠ করা উচিত, ভগবানের জন্য নয় নিজের স্বার্থে, নিজের মুক্তির জন্য।
► Read More: মঙ্গলাচরণ ইসকন ( Iskcon Mangalacharan in Bengali) ► Read More: Shri Narasimha Kavacham Iskcon -শ্রীনৃসিংহ কবচম্, স্তব, নাম ► Read More: ব্রাহ্মন ও পুরোহিতের মধ্যে পার্থক্য কী? সুখ ও দুঃখের মধ্যে সম্পর্ক কী? ► Read More: সনাতন ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্ম-এর মধ্যে সম্পর্ক কী? ► Read More: হিন্দু ধর্মের যুগ বিভাগ ~ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ
-: পঞ্চতত্ত্ব প্রণাম :-
পঞ্চতত্ত্বাত্মকম্ কৃষ্ণম্ ভক্তরূপ স্বরূপকম্।
ভক্ত-অবতারম্ ভক্তাখ্যম্ নমামি ভক্তশক্তিকম্ ॥
অনুবাদঃ ভক্তরূপ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ভক্তস্বরূপ শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, ভক্তাবতার শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু, ভক্তশক্তি গদাধর পন্ডিত, এবং ভক্ত শ্রীবাস ঠাকুর — এই পঞ্চতত্ত্বাত্মক শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে প্রণাম নিবেদন করি।
-: পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্র :-
(জয়) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ।
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ ||
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা তাঁর পূর্ণ সম্প্রসারণ শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, তাঁর অবতার শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু, তাঁর অন্তরাঙ্গা শক্তি শ্রী গদাধর পণ্ডিত প্রভু, এবং তাঁর বাহ্যিক শক্তি শ্রীবাস ঠাকুর প্রভুর সাথে থাকেন। তিনি তাদের মাঝে আছেন পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা এই অন্যান্য তত্ত্বগুলির সাথে থাকেন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি আমাদের প্রণাম সম্পূর্ণ হয় যখন আমরা বলি,
শ্রী-কৃষ্ণ-চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ
শ্রী-অদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি-গৌর-ভক্ত-বৃন্দা।
শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ এই পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে। শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বিস্তার করতে পারেন। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণই নন, সিদ্ধ যোগীমাত্রই নিজেকে বিস্তার করতে পারেন। তবে শ্রীকৃষ্ণের মতো এত বেশি নয়।
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলা আছে —’যত্র যোগেশ্বরঃ হরিঃ’। তিনি যোগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে বিরাজমান। যৌগিক বিদ্যার চরমে তিনি। তাই এই যে পঞ্চতত্ত্বের বিস্তার —শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর পণ্ডিত, শ্রীবাস ঠাকুর —এই পাঁচটি রূপে অভিব্যক্ত হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ।
পঞ্চতত্ত্বাত্মকম্ কৃষ্ণম্ ভক্তরূপ স্বরূপকম্।
ভক্ত-অবতারম্ ভক্তাখ্যম্ নমামি ভক্তশক্তিকম্ ॥
পরম শক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পঞ্চ শক্তিতে প্রকাশ করেন পাঁচটি পারমার্থিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। ভগবানের এই পঞ্চতত্ত্বে কোন পারমার্থিক ভেদ নেই। তাঁরা পঞ্চতত্ত্ব হলেও এক ও অদ্বিতীয় তত্ত্ব। তাঁদের ভক্তরূপ, ভক্তস্বরূপ, ভক্ত-অবতার, শুদ্ধভক্ত ও ভক্তশক্তি বলে।
অদ্বয়তত্ত্বের এই বিবিধ পঞ্চ শক্তির মধ্যে—
● ভক্তরূপ — শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন আদি অবতারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।
● ভক্তস্বরূপ — শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের প্রথম স্বাংশ প্রকাশ, তিনি শ্রীবলরামের প্রকাশ।
● ভক্ত-অবতার — মহাবিষ্ণুর অংশ প্রকাশ অদ্বৈতাচার্য প্রভু । শ্রীঅদ্বৈত প্রভু প্রত্যক্ষ প্রকাশ নন বলে তাঁকে বলা হয় ভক্ত-অবতার।
● ভক্তশক্তি — গদাধর হলেন ভগবানের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারানীর প্রকাশ আর
● শুদ্ধভক্ত — শ্রীবাস হলেন ভগবানের তটস্থ শক্তির প্রতীক।
অদ্বৈত প্রভু প্রত্যক্ষ প্রকাশ না হলেও চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত, এই তিন তত্ত্ব হলেন পরমব্রহ্ম বা বিষ্ণুতত্ত্ব— তাঁরা সকলের আরাধ্য। চতুর্থ ভক্তশক্তি— শ্রীগদাধর প্রভু তাঁদের উপাসক, আর পঞ্চম শ্রীবাস আদি যত ভক্তবৃন্দ আছেন, তাঁরা হচ্ছেন জীবতত্ত্ব অর্থাৎ ভগবানের শুদ্ধভক্ত।
পঞ্চতত্ত্ব বিগ্রহের মধ্যে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য প্রভু বিষ্ণুতত্ব বলে তাঁদের চরণে তুলসী পত্র নিবেদন করা যায়।
স্বাংশ প্রকাশ হলো প্রত্যক্ষ আর অবতার হলো পরোক্ষ। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু হলেন মহাবিষ্ণুর অংশ প্রকাশ অর্থাৎ অংশের অংশ প্রকাশ। শ্রীঅদ্বৈত প্রভু প্রত্যক্ষ প্রকাশ নন বলে তাঁকে বলা হয় ভক্ত-অবতার।.
ভগবানের একটি বিস্তার রূপ থেকে অন্য একটি বিস্তার রূপে শক্তি যে কম থাকে তা ঠিক নয়। যেমন প্রথমে একটি মোমবাতি থেকে অন্য একটি বাতি জ্বালানো হল, আবার দ্বিতীয়টা থেকে আর একটা বাতি জ্বালানো যাবে। তৃতীয়টা থেকে আবার একটা। ঠিক তেমনি, ভগবানের অংশ প্রকাশ কিংবা অবতার যাই হোক, সবই হল ঐ বাতির মতো । আদি বাতিটা হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বাতির আলো সব কটিতেই সমান থাকে।
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর ক্ষমতা মর্যাদা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর থেকে কম কিছু নয়। যে কোনও অবতারের কিংবা অংশ প্রকাশের সমান শক্তি থাকে। শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন। ঠিক যেমন, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্র, উভয়ই হলেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তবে একজন হলেন আদি পুরুষ। শ্রীকৃষ্ণ সেই আদি পরম পুরুষ এবং রামচন্দ্র হলেন তাঁর বিস্তার। কেন ? কারন শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের গুণগুলি পরিপূর্ণ ভাবে ব্যক্ত করেছেন আর রামচন্দ্র আংশিকভাবে ।
শ্রীরামচন্দ্র নিজেকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান রূপে প্রকাশ না করে আদর্শ রাজারূপে অভিব্যক্ত করেন এবং এই জগতের নীতিবোধ নিয়েই ব্যাপৃত ছিলেন। আর শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে জড় জগতের সব নীতির ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রকটিত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরিপূর্ণ স্বয়ং ভগবান।
অপ্রাকৃত রস আস্বাদনের উদ্দেশ্যে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। উপাস্য ও উপাসকের মধ্যে অপ্রাকৃত রস বিনিময় নিয়েই সমগ্র ভক্তিতত্ব। এই চিন্ময় দিব্য রসাস্বাদনহীন ভগবদ্ভজন সম্পুর্ন অর্থহীন।
বিশুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে স্বয়ং লীলা পুরুষোত্তম ভগবান উপলব্ধি করা দুরূহ। স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান হওয়া সত্ত্বেও মহাপ্রভু কখনও নিজেকে কৃষ্ণরূপে প্রকাশ করেন নি। বরং জীবকুলকে কৃষ্ণ ভজন শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে তিনি মহান ভক্তরূপে পার্ষদসহ আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পঞ্চতত্ত্বের মর্ম বুঝতে হলে এগুলো উপলব্ধি করতে হবে। সবই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন রূপে। তাই পরমেশ্বরের অভিব্যক্তি বলে তাঁদের সবাইকে অভিন্ন রূপে প্রণতি জানাতে হবে।
পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্রের শেষে আমরা হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ বা কীর্তন করব –
-: হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র :-
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
(রেফারেন্স : কৃষ্ণভক্তি সর্বোত্তম বিজ্ঞান, পৃ. ১৭২-১৭৫,ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট)