এই অধ্যায়ে আমরা মঙ্গলাচরণ ইসকনের অনুপ্রেরণায় সম্পূর্ণ শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে আপনাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস করছি এবং এই মঙ্গলাচরণের গুরুত্ব প্রত্যেক জীবের কাছে কতখানি অপরিসীম তা প্রতিনিয়ত পাঠ করলে বুঝতে পারবেন।
❖ মঙ্গলাচরণ ❖
বন্দেহহম্ শ্রীগুরোঃ শ্রীযুতপদকমলম্ শ্রীগুরুন্ বৈষ্ণবাংশ্চ
শ্রীরূপম্ সাগ্রজাতম্ সহগণরঘুনাথান্বিতম্ তম্ সজীবম্॥
সাদ্বৈত সাবধূতম্ পরিজনসহিতম্ কৃষ্ণচৈতন্যদেবম্
শ্রীরাধাকৃষ্ণপাদান্ সহগণললিতা-শ্রীবিশাখান্বিতাংশ্চ ||
অনুবাদঃ আমি আমার আধ্যাত্মিক গুরুদেবের পাদপদ্মে এবং ভক্তিমূলক সেবার পথে অন্যান্য সমস্ত গুরুর শ্রীচরনে শ্রদ্ধাশীল প্রণাম জানাই। আমি সমস্ত বৈষ্ণববৃন্দের এবং শ্রীল রূপ গোস্বামী, তাঁর অগ্রজ শ্রীল সনাতন গোস্বামী, শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী, শ্রীরঘুনাথ ভট্র গোস্বামী, শ্রীগোপাল ভট্র গোস্বামী, শ্রীল জীব গোস্বামী সহ ছয় গোস্বামীকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
আমি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু, শ্রীগদাধর পণ্ডিত এবং শ্রীবাস ঠাকুরের নেতৃত্বে তাঁর সমস্ত ভক্তদের (পার্ষদবৃন্দের) পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি। আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতি রাধারাণী এবং শ্রীমতী ললিতা ও বিশাখার নেতৃত্বে থাকা সমস্ত গোপীদের পদ্মচরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।
❖ শ্রীগুরু প্রনাম ❖
ওঁ অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতম্ যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥
শ্রী চৈতন্যমনোহভীষ্টম্ স্থাপিতম্ যেন ভূতলে।
স্বয়ম্ রূপঃ কদা মহ্যং দদাতি স্ব-পদান্তিকম্॥
অনুবাদঃ আমি আমার আধ্যাত্মিক গুরুকে আমার শ্রদ্ধার সাথে প্রণাম জানাই, যিনি জ্ঞানের আলোয় আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, যা অজ্ঞতার গভীরতম অন্ধকারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুপাদ, যিনি এই জড় জগতের মধ্যে ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাসনা পূরণের জন্য এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, কবে আমি তাঁর শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ করতে পারব?
❖ শ্রীল প্রভুপাদ প্ৰণতি ❖
নমো ওঁবিষ্ণুপাদায় কৃষ্ণপ্ৰেষ্ঠায়া ভূতলে।
শ্রীমতে ভক্তিবেদান্ত স্বামীনিতি নামিনে ॥
নমস্তে সারস্বতে দেবে গৌরবাণী প্রচারিণে ।
নির্বিশেষ-শূন্যবাদী পাশ্চাত্যদেশ তারিণে ॥
অনুবাদঃ আমি আমার শ্রদ্ধাশীল প্রণাম জানাই ঐশ্বরিক করুণাপ্রাপ্ত (দিব্য অনুগ্রহ সম্পন্ন) কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের চরণে, যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় এবং তাঁর পদ্মের চরণে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
হে আধ্যাত্মিক গুরু, হে প্রভুপাদ, হে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের প্রিয়শিষ্য ও সেবক, আপনি কৃপাপূর্বক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচারের দ্বারা নির্বিশেষবাদ, শূন্যবাদপূর্ণ পাশ্চাত্যদেশ উদ্ধারকার্য করেছেন, আপনার চরণে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।
❖ শ্রীবৈষ্ণব প্রণাম ❖
বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।
পতিতানাম্ পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ ॥
অনুবাদঃ
আমি ভগবানের সমস্ত বৈষ্ণব ভক্তবৃন্দদের চরণ-কমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি, যাঁরা বাঞ্ছাকল্পতরুর মতো সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ (মনোবাঞ্ছাপূর্ণ) করতে পারেন এবং আমাদের মতো অধোগতিসম্পন্ন আত্মাদের প্রতি অতল সমুদ্রের ন্যায় কৃপা প্রদান করে উদ্ধার করতে পারেন।
❖ শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রণাম ❖
নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায়তে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ॥
অনুবাদঃ আমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, যিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যান্য অবতার অপেক্ষা উদার, যিনি শ্রীমতি রাধারাণীর সোনালী রঙ ধারণ করেছেন, এবং যিনি শ্রীকৃষ্ণের অতিদুর্লভ বিশুদ্ধ প্রেম এই জড় জগতে ব্যাপকভাবে বিতরণ করছেন।
❖ শ্ৰীকৃষ্ণ প্রণাম ❖
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে ।
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তু তে॥
অনুবাদঃ হে আমার প্রিয় শ্রীকৃষ্ণ! তুমি করুণার সাগর, তুমি দুঃস্থের (দীনের) বন্ধু, তুমি সৃষ্টির উৎস এবং সমস্ত জগতের পতি। তুমি গোপালকদের গুরু (ঈশ্বর) এবং গোপীদের প্রেমিকা, বিশেষত শ্রীমতি রাধারাণীর প্রেমাস্পদ। আমি তোমার পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গো-ব্রাহ্মণ্য হিতায় চ।
জগতদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।।
অনুবাদঃ হে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তুমি সকল গাভী ও ব্রাহ্মণদের কল্যাণকামী এবং তুমি সমগ্র মানবসমাজ ও জগতের কল্যাণকামী। আমি তোমার পাদপদ্মে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।
গাভী থেকে প্রাপ্ত বিশুদ্ধ ঘি হোম যজ্ঞে ব্যবহৃত হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করতে। মন্ত্রচারন ও হোম-যজ্ঞের কাজ সম্পন্ন করে ব্রাহ্মণগণ। ভগবানের করুনায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী মেঘে পরিনত হয় এবং সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির রসে মাটি সিক্ত হয় এবং বীজ মাটি থেকে সেই রস গ্রহণ করে অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে প্রথমে চারা গাছ, পরবর্তীতে বৃক্ষে পরিনত হয় । সেই বৃক্ষ অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ করে জগতকে পুষ্ট করে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ভগবান কতো করুনাময়! তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মানবসমাজ ও জগতের কল্যাণ প্রতিনিয়ত করে চলেছেন।
❖ শ্রীমতি রাধারাণী প্রণাম ❖
তপ্ত-কাঞ্চন-গৌরাঙ্গী রাধে বৃন্দাবনেশ্বরী৷
বৃষভানুসুতে দেবী প্রণমামি হরিপ্রিয়ে॥
অনুবাদঃ আমি শ্রীমতি রাধারাণীর চরণকমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি, যাঁর দেহের শোভা গলিত সোনার (তপ্তকাঞ্চনের) মতো, যিনি বৃন্দাবনের রাণী (ঈশ্বরী), যিনি মহারাজ বৃষভানুর কন্যা, এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয় (প্রেয়সী)।
❖ তুলসী প্রণাম ❖
ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসী-দেব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ।
বিষ্ণুভক্তিপ্রদে দেবী! সত্যবত্যৈ নমো নমঃ ॥
অনুবাদঃ হে কেশবপ্রিয়া (শ্রীকৃষ্ণ প্রিয়া) বৃন্দাদেবী (শ্রীমতি তুলসী মহারাণী) যিনি বিষ্ণু-ভক্তি প্রদান করেন সেই সত্যবতী তুলসী দেবীকে বারবার আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
❖ তুলসী নাম ❖
বৃন্দা, বৃন্দাবনী, বিশ্ব-পাবনী,
বিশ্ব-পূজিতা, নন্দিনী,
পুষ্পসারা, তুলসী, কৃষ্ণ-জীবনী ॥
❖ পঞ্চতত্ত্ব প্রণাম ❖
পঞ্চতত্ত্বাত্মকম্ কৃষ্ণম্ ভক্তরূপ স্বরূপকম্।
ভক্ত-অবতারম্ ভক্তাখ্যম্ নমামি ভক্তশক্তিকম্ ॥
অনুবাদঃ ভক্তরূপ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ভক্তস্বরূপ শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, ভক্তাবতার শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু, ভক্তশক্তি গদাধর পন্ডিত, এবং ভক্ত শ্রীবাস ঠাকুর — এই পঞ্চতত্ত্বাত্মক শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে প্রণাম নিবেদন করি।
❖ পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্র ❖
(জয়) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ।
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ ||
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর পণ্ডিত ও শ্রীবাস ঠাকুর আদি গৌরভক্তবৃন্দের চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা তাঁর পূর্ণ সম্প্রসারণ শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, তাঁর অবতার শ্রী অদ্বৈত আচার্য প্রভু, তাঁর অন্তরাঙ্গা শক্তি শ্রী গদাধর পণ্ডিত প্রভু, এবং তাঁর বাহ্যিক শক্তি শ্রীবাস ঠাকুর প্রভুর সাথে থাকেন। তিনি তাদের মাঝে বিরাজ করেন পরমেশ্বর ভগবান হিসেবে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু সর্বদা এই অন্যান্য তত্ত্বগুলির সাথে থাকেন। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি আমাদের প্রণাম সম্পূর্ণ হয় যখন আমরা পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্র কীর্তন করি।
কৃষ্ণ চেতনা প্রচারক হিসাবে আমরা প্রথমে এই পঞ্চ-তত্ত্ব মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে প্রণাম জানাই; এরপর, আমরা মহামন্ত্র জপ করি
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু মহা-বদন্যাবতার নামে পরিচিত, সবচেয়ে মহৎ অবতার, কারণ তিনি পতিত আত্মার অপরাধ বিবেচনা করেন না। এইভাবে মহামন্ত্র জপের পূর্ণ উপকার লাভ করা যায়।
আমাদের প্রথমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আশ্রয় নিতে হবে, পঞ্চ-তত্ত্ব মন্ত্র শিখতে হবে, এবং তারপর হরে কৃষ্ণ মহা-মন্ত্র জপ করতে হবে। এটি অত্যন্ত কার্যকর হবে।
❖ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র ❖
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
● “হরে কৃষ্ণ” মহামন্ত্রের প্রকৃত অর্থ কি ?
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি ৩টি শব্দ দ্বারা গঠিত । শব্দ ৩টি হচ্ছে যথাক্রমে (১) হরে , (২) কৃষ্ণ ও (৩) রাম । এবার জেনে নেয়া যাক শব্দ তিনটি আসলে কি নির্দেশ করেঃ
১. হরে শব্দটি সংস্কৃত “হরা” শব্দ থেকে এসেছে যা দ্বারা শ্রীমতি রাধারাণীকে সম্বোধন করা হয় । রাধারাণী ভগবানের পরম আনন্দময়ী শক্তি । সৃষ্টির আদিতে পরমেশ্বর ভগবান তার নিজের সেবা ও ভক্তসঙ্গ লাভের জন্য শ্রীমতি রাধারাণীকে তার হৃদয়ের বামপাশ থেকে সৃষ্টি করেছেন । কাজেই রাধারাণীর অনুমতি ব্যাতীত কোন মানুষ এমনকি দেবতারাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারে না ।
২. কৃষ্ণ শব্দ দ্বারা সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণকে অর্থাৎ পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বুঝায় । তিনিই সর্বপ্রথম এবং সর্বাদিরূপ । তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেনি ।
৩. রাম শব্দ দ্বারা সর্ব আনন্দদায়ক শ্রীমান “বলরামকে” বুঝায় । বলরাম বৃন্দাবনে সবার অন্তরে আনন্দ সঞ্চার করেন । বলরামকে আমরা ভগবানের লীলা অবতাররূপেও দেখতে পাই ।
অতএব, হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের সঠিক অর্থ হচ্ছেঃ
হে পরম আনন্দময়ী শ্রীমতি রাধারাণী, হে সর্বানন্দদায়ক ভগবান শ্রীবলরাম, হে সর্বাকর্ষক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, আপনারা আমাকে কৃপাপূর্বক আপনাদের চিন্ময় জগতের (Chinmoy Plannet) প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত করুন ।
কলি যুগে কৃষ্ণনাম ব্যাতীত জীব কখনোই ভগবত ধাম (Chinmoy Pannet) লাভ করতে পারে না । শিশু মাতৃক্রোড়ের জন্য যেভাবে ব্যাকুল সুরে কান্না করে ,তেমনি আমরাও যদি ব্যাকুল চিত্তে ভগবানের কীর্তন করি তাহলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরকে অবশ্যই কৃপা করবেন। আর যে আকুল-ব্যাকুল-আন্তরিকভাবে এই মহামন্ত্র কীর্তন করে, সেই ভক্তের কাছে ভগবান স্বয়ং আত্মপ্রকাশ করেন। এই মহামন্ত্র কীর্তন ব্যতীত জীবের মুক্তির অন্য কোনও পন্থা নেই।
● “হরে কৃষ্ণ” মহামন্ত্র জপ করব কেন ?
এই “হরে কৃষ্ণ” মহামন্ত্রই হল আমাদের অপ্রাকৃত চেতনাশক্তি পুনর্জাগরণের একমাত্র দিব্য উপায়। মূলতঃ স্বরূপে আমরা সকল জীবই কৃষ্ণচেতনাময়, কিন্তু অনাদিকাল থেকে জড় বস্তুর সংস্পর্শে থাকার জন্যই আমাদের চেতনা কলুষিত ও অপবিত্র হয়েছে। যে জড় পরিবেশের মধ্যে বর্তমানে আমরা বাস করছি, তাহাকে ‘মায়া’ বা ‘মোহ’ বলে।
‘মায়া’ শব্দের অর্থ হইল যাহা নহে…..। ভৃত্য কৃত্রিম উপায়ে সর্ব-শক্তিমান প্রভুর অনুকরণ করলে তাকে মায়া বলে। আমরা যতই জড়া-প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করার চেষ্টা করছি, প্রকৃত সম্পদ আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছি, ততই প্রকৃতির কঠোর নিয়মশৃঙ্খলে-মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছি। প্রকৃতিকে জয় করতে গিয়ে প্রকৃতির অধীনস্থ হয়ে পড়ছি, এটাই হল ‘মায়া’। কিন্তু আমাদের শাশ্বত কৃষ্ণভাবনা পুনর্জাগরণের ফলে এখনই জড়া-প্রকৃতির সাথে এই মায়িক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো যায়। তাই মহামন্ত্র কীর্তন করুন বারবার আর কমপক্ষে ১৬ মালা (১ মালা = ১০৮ বার) সারাদিনে জপ করার চেষ্টা করুন। জপ করার সময় মনকে সংযত করে এমনভাবে উচ্চারন করতে হবে যেন প্রতিটি শব্দ আপনি শ্রবণ করতে পারেন এবং কানের মধ্য দিয়ে সেই অপ্রাকৃত ধ্বনি তরঙ্গ আপনার হৃদয়কে উদ্বেলিত করে ভক্তি ভাব সঞ্চার করতে পারে।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
এই মহামন্ত্রই হলো আমাদের চিন্ময় শুদ্ধ চেতনাশক্তির পুনর্জাগরণের অপ্রাকৃত পথ। জপ-কীর্ত্তনের ফলে সৃষ্ট অপ্রাকৃত ধ্বনি তরঙ্গের দ্বারা আমাদের হৃদয়ের সমস্ত সংশয়, অবিশ্বাস দূর হয়ে যায়। ঐসব সংশয় ও অবিশ্বাসের জন্ম নেয় ভ্রান্ত ধারণা থেকে, যেমন—যাহা কিছু দৃশ্যমান, আমি তারই ‘প্রভু’। কৃষ্ণভাবনা হল জীবের আদি শক্তি। যখন আমরা এই মহামন্ত্র শ্রবণ করি, তখন আমাদের এই চেতনার পুনর্জাগরণ হয়। ভগবত উপলব্ধির এই সহজতম পথটিই হল এ যুগের ধৰ্ম্ম।
বাস্তব অভিজ্ঞতা (Practical Experience) থেকেও বোঝা যায় যে, এই মহামন্ত্র কীর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এক অপ্রাকৃত পরিবেশ অনুভব করা যায়।
● প্রথম শ্রেণীর মানুষ যারা জড় জগতেই আটকে থাকে ভক্তির অভাবে, তারা সুখ বলতে ইন্দ্রিয় সুখভোগকেই বোঝে, যা হল নিম্ন পশুর স্তরভুক্ত। এরা নাস্তিক।
●এই স্তর অপেক্ষা সামান্য উন্নত জীব মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য মানসিক যুক্তি ব্যবহার করে থাকে, যেমন – এখন ভগবান ভক্তির সময় নয়, তারা মনে করে কর্মই ধর্ম আর কর্ম হল রোজগার করা, উদরপূর্তি করা, সুখভোগ করা। ভগবান ভক্তি করব আজ নয় কাল, এখন নয় বয়সকালে যখন সময় থাকবে অগাধ। বাস্তবে তাদের কাছে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, ভক্তি আর করা হয়ে ওঠে না।
●এই স্তর অপেক্ষা উন্নত যথেষ্ট বুদ্ধি সম্পন্ন জীব সকল কারণের পরম কারণ ভগবানকে মনে করেন, মনে করেন তারা শ্রীকৃষ্ণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ ও অংশাংশ। কৃষ্ণভাবনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত দিব্য গুনাবলী বর্ধিত ও প্রকাশিত হবে।
এইরূপ কৃষ্ণভাবনা উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ উপায় পরম পবিত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করা।
এই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্ত্তন আধ্যাত্মিক স্তর হইতে কার্য করে এবং এই ভাবে এই ধ্বনি তরঙ্গ চেতনার সকল নিম্নস্তর (ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি) অতিক্রম করে। এই মহামন্ত্র কীর্তনের জন্য মন্ত্রের ভাষা বুঝিবার প্রয়োজন নাই, কোন যুক্তি তর্কের প্রয়োজন নাই অথবা বুদ্ধির সহিত ঐক্যসাধন (Intellectual Adjustment)- এর কোন প্রয়োজন নাই, ইহা স্বতঃস্ফূর্ত আধ্যাত্মিক স্তর হইতে আসে, তাই কোন রকম পূর্বযোগ্যতা ছাড়াই যে কেহ ‘অপ্রাকৃত ধ্বনি’ কীর্ত্তনে অংশগ্রহণ করিতে পারে।
এই বিষয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হইল, এই মহামন্ত্র কীর্ত্তন যতদূর সম্ভব শুদ্ধ ভক্তের শ্রীমুখ হইতেই শ্রবণীয়। দুগ্ধ পরম উপাদেয় বস্তু হলেও সর্পোচ্ছিষ্ট দুগ্ধ যেমন বিষবৎ পরিত্যাজ্য, অভক্তের মুখ থেকে নাম শ্রবণও সেরকম বিষবৎ। শুদ্ধ ভক্তের মুখ-নিঃসৃত নাম শ্রবণে দ্রুত ফল লাভ হয়।
❏❖❏ বিবিধ বিশেষ মন্ত্রাবলী ❏❖❏
❖ শ্ৰীগৌরাঙ্গমহাপ্রভু প্রণামমন্ত্র ❖
আনন্দ-লীলাময়-বিগ্রহায়
হেমাভ-দিব্যচ্ছবি-সুন্দরায়।
তস্মৈ মহাপ্রেমরস-প্রদায়
চৈতন্যচন্দ্রায় নমো নমস্তে।।
❖ শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু প্রণামমন্ত্র ❖
নিত্যানন্দ ! নমস্তুভ্যম্ প্রেমানন্দ-প্রদায়িনে।
কলৌ কল্মষঃ-নাশায় জাহ্নবা-পতয়ে নমঃ।।
❖ শ্ৰীঅদ্বৈতপ্ৰভু প্রণামমন্ত্র ❖
শ্রীঅদ্বৈত ! নমস্তুভ্যম্ কলিজন-কৃপানিধে !
গৌরপ্রেম-প্রদানায় শ্রীসীতাপতয়ে নমঃ ।।
❖ শ্ৰীগদাধর-প্রণামমন্ত্র ❖
গদাধরমহম্ বন্দে মাধবাচাৰ্য্য-নন্দনম্।
মহাভাব-স্বরূপম্ শ্রীচৈতন্যাভিন্ন-রূপিণম্।।
❖ শ্ৰীবাস-প্রণামমন্ত্র ❖
শ্রীবাস-পণ্ডিতম্ নৌমি গৌরাঙ্গ-প্রিয়পার্ষদম্।
যস্য কৃপা-লবেনাপি গৌরাঙ্গে জায়তে রতিঃ।।
❖ শ্রীকৃষ্ণ-প্রণামমন্ত্র ❖
নমো নলিন-নেত্রায় বেণুবাদ্য-বিনোদিনে।
রাধাধর-সুধাপান শালিনে বনমালিনে।।
❖ শ্রীরাধিকা-প্রণামমন্ত্র ❖
রাধাম্ রাসেশ্বরীম্ রম্যাং গোবিন্দ-মোহিনীম্ পরাম্।
বৃষভানু-সুতাম্ দেবীম্ নমামি শ্রীহরি-প্রিয়াম্।।
মহাভাব-স্বরূপা ত্বাম্ কৃষ্ণপ্রিয়া-বরীয়সী।
প্রেমভক্তি-প্রদে! দেবী! রাধিকে! ত্বাম্ নমাম্যহম্।।
❖ শ্রীশ্ৰীযুগল-প্রণামমন্ত্র ❖
বন্দে বৃন্দাবন-গুরু কৃষ্ণং কমল-লোচনম্।
বল্লবী-বল্লভম্ দেবং রাধালিঙ্গিত-বিগ্রহম্।।
❖ শ্রীবলরাম-প্রণামমন্ত্র ❖
নমস্তে তু হলগ্রাম! নমস্তে মুষলায়ুধ!
নমস্তে রেবতীকান্ত! নমস্তে ভক্ত-বৎসল!
নমস্তে বলিনাম্ শ্রেষ্ঠ! নমস্তে ধরণীধর!
প্রলম্বারে! নমস্তে তু ত্রাহি মাম্ কৃষ্ণ-পূর্বজ।।
❖ শ্রীশ্রীঅষ্টসখী-প্রণামমন্ত্র ❖
ললিতা চ বিশাখা চ চিত্রা চম্পবল্লীকা।
রঙ্গদেবী সুদেবী চ তুঙ্গবিদ্যেন্দুরেখিকা ৷৷
এতাভ্যোইষ্টসখীভ্যশ্চ সততঞ্চ নমো নমঃ।
তথাপি মম সর্বস্বা ললিতা সৰ্ববন্দিতা ।।
❖ শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রা-প্রণামমন্ত্র ❖
নীলাচল-নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
বলভদ্র-সুভদ্রাভ্যাম্ জগন্নাথায় তে নমঃ।।
অনুবাদঃ– পরমাত্মা স্বরূপ যারা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবকে প্রণতি নিবেদন করি।
❖ শ্রীশ্রীসীতা রাম-প্রণামমন্ত্র ❖
রামায় রাম-ভদ্রায় রামচন্দ্রায় মেধষে।
রঘুনাথায় নাথায় সীতায়ৈ পতয়ে নমঃ।।
❖ শ্রীভগবদ্চরণামৃত-গ্রহণমন্ত্র ❖
অকালমৃত্যু-হরণম্ সর্বব্যাধি-বিনাশনম্।
বিষ্ণুপাদোদকম্ পীত্বা শিরসা ধারয়াম্যহম্।।
❖ অপরাধ-শোধন-মন্ত্র ❖
মন্ত্রহীনম্ ক্রিয়াহীনম্ ভক্তিহীনম্ জনার্দন।
যৎ পূজিতম্ ময়া দেব পরিপূরণম্ তদস্তু মে।।
❖ শ্রীমদ্ভাগবত-বন্দনা ❖
তমাদিদেবম্ করুণানিধানম্ তমালবর্ণম্ সুহিতাবতারম্।
অপার সংসার-সমুদ্র-সেতুম্ ভজামহে ভাগবত-স্বরূপম্।।
❖ বিষ্ণুমন্ত্র ❖
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়
ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় ।।
অনুবাদঃ হে বসুদেব-তনয়, সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান। আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
❖ ব্যাসদেব প্রণাম মন্ত্র ❖
নারায়ণম্ নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্।
দেবীম্ সরস্বতীম্ ব্যাসম্ ততো জয়মুদীরয়েৎ ॥
অনুবাদঃ সংসার বিজয়ী সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত উচ্চারণ করার পূর্বে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণকে, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তথা ভগবৎ অবতার নর-নারায়ণ ঋষিকে, বিদ্যাদেবী সরস্বতী এবং ব্যাসদেবকে।
নষ্টপ্রায়েম্বভদ্ৰেষু নিত্যম্ ভাগবতসেবয়া ৷
ভগবত্ উত্তমশ্লোকে ভক্তিরৰ্ভবতি নৈষ্ঠিকী॥
অনুবাদঃ নিয়মিতভাবে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ (কীর্তন) করলে এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তের সেবা করলে হৃদয়ের সমস্ত কলুষ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়, এবং তখন উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমময়ী ভক্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
► Read More: Shri Narasimha Kavacham Iskcon -শ্রীনৃসিংহ কবচম্, স্তব, নাম
► Read More: হিন্দুধর্মে পঞ্চতত্ত্ব (Pancha Tattva) কারা? || ইসকন ||
► Read More: ব্রাহ্মন ও পুরোহিতের মধ্যে পার্থক্য কী? সুখ ও দুঃখের মধ্যে সম্পর্ক কী?