Join to Our Community
Community Grows With You

৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী ||ইসকন

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব ৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী যা জানলে আপনিও অবাক হবেন।

TABLE OF CONTENTS

Toggle

:- মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য? :-

মহাভারত পঞ্চম বেদ ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত। মহর্ষি বেদব্যাস দ্বারা রচিত এবং হিন্দু সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ । ভগবদ গীতাও এই মহাকাব্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল যার মোট এক লক্ষ শ্লোক রয়েছে তাই ইহাকে শাটাহস্ত্রি সংহিতা বলা হয় ।

পান্ডুর পাঁচ পুত্র এবং মহাভারতে ঘটে যাওয়া ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের মধ্যে শত্রুতা সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। তাদের মধ্যে এই বিদ্বেষ পাশার খেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং ফলস্বরূপ, পাণ্ডবরা তাদের জমি এবং তাদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে কৌরবদের কাছে হেরে যান এবং ১৩ বছরের নির্বাসনের পরে, যখন পাণ্ডবরা ফিরে এসেছিলেন, দুর্যোধন তাদের অর্ধেক জমি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এরপর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় পাঁচ গ্রাম ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যেখানে পাণ্ডবরা কৃষিকাজ করে জীবন প্রতিপালন করতে পারেন । সেই প্রস্তাবও দুর্যোধন অহঙ্কারবশত প্রত্যাখ্যান করেন এবং কৃষ্ণকে তীব্র আক্রমনাত্নক ভঙ্গিতে জানিয়ে দেন সুঁচের অগ্রভাগ সমান জমি সে পাণ্ডবের দেবেন না। পিতা ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়া স্বত্বেও অন্যায় হতে দেখেও চুপ করে রইলেন। অধর্মকে ধ্বংস করে ধর্ম স্থাপনের উদ্দেশ্যে  কুরুক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধ সম্পন্ন হয়, যা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নামে খ্যাত। কৌরবদের পিতা রাজা ধৃতরাষ্ট্র চাননি যে, পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে কোন আপস মীমাংসা হোক। তিনি আশা করেছিলেন যে, যুদ্ধে তাঁর পুত্রদের ভাগ্য সুনিশ্চিত হোক।

যেখানে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর নৈতিক, আধ্যাত্মিক জ্ঞান দিয়েছিলেন যা শ্রীমদ্ভাগবতগীতা নামে পরিচিত। মনে রাখা দরকার, অর্জুন শ্রী কৃষ্ণের প্রিয় সখা হওয়া সত্বেও ভগবান এই জ্ঞান অযাচিতভাবে দেন নি, যতক্ষন না তিনি ভগবানের চরনে সম্পূর্ণরুপে নিজেকে সমর্পণ করেছেন, মন থেকে গুরুরুপে স্বীকার করেছেন। 

এই যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরে, পাণ্ডবরা তাদের আত্মীয়দের হত্যা করার অপরাধে পোলার পর্বতমালায় স্বর্গে যাবার যাত্রা করেছিলেন। যেখানে যুধিষ্ঠির, যিনি স্বর্গের দ্বার পেয়েছিলেন, পথে তাঁর চার ভাই ও স্ত্রী দ্রৌপদি মারা গিয়েছিলেন।

নীচে মহাভারত সম্পর্কে কিছু আশ্চর্যজনক তথ্য রয়েছে যার সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশই অজানা

১ :- কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস কে ছিলেন ?

বেদব্যাস নাম নয়, যাদের বেদ জ্ঞান ছিল তাদের দেওয়া একটি পদ। কৃষ্ণদ্বীপায়নের আগে ২৭ জন বেদব্যাস ছিলেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হলেন ২৮ তম বেদবিদ। তাঁর শ্রীকৃষ্ণের মতো গায়ের বর্ণ ছিল এবং তিনি একটি দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন নামকরন করা হয়। তাই তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস নামে পরিচিত। তাঁর পিতা ছিলেন পরাশর মুনি, মহান বশিষ্ঠের নাতি, সপ্তঋষির একজন যিনি প্রথম বেদ শুনেছিলেন। কুরুক্ষেত্রে চক্রান্তকারী দুর্যোধন ছিলেন সম্পর্কে তাঁরই নাতি। 

ব্যাসদেবের বংশপরম্পরা – 

ব্যাসদেব বেদের স্তোত্রগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করে চারটি সংকলন তৈরি করেছিলেন – ঋক, সাম, যজুর এবং অথর্ব। এই কাজ সম্পন্ন করে ৬০ টি খণ্ডে ‘জয়া’ রচনা করেন যার মধ্যে বৈদিক সত্যের সত্যতা প্রকাশিত। ‘জয়া’ কথাটির অর্থ ‘বিজয়ের গল্প’। এর মধ্যে শুধুমাত্র একটি খণ্ড ব্যাসদেবের ছাত্র বৈশম্পায়নের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। সুতরাং ব্যাসদেব যা বর্ণনা করেছেন এবং দেবতা গণেশ যা লিখেছেন তার সম্পূর্ণ খণ্ড কেউ সত্যিই জানে না। 

২ :- মহাভারত কে লিখেছেন এবং কীভাবে তা লেখা হয়েছিল?

মহাভারত মহর্ষি বেদব্যাস দ্বারা রচিত। তিনি ব্রহ্মার কাছে একজন দক্ষ লিপিকার জন্য জানালেন এবং গণেশকে সেই কাজে নিয়োগ করা হল। যেখানে তিনি শ্লোকগুলি বলবেন এবং ভগবান গণেশ শুনে সেটি লিখবেন। একটি শর্তে ভগবান গণেশ লিখতে রাজি হলেন, মহর্ষি বেদব্যাসকে একবারও না থামিয়ে শ্লোকগুলি ধারাবাহিকভাবে বলতে হবে। তখন বেদব্যাসও একটি শর্ত গনেশকে দিয়েছিলেন যে তিনি যা শ্লোক বলবেন তার অর্থ বুঝে গণেশকে এগুলি ব্যাখ্যা করতে হবে। সুতরাং, এইভাবে পুরো মহাকাব্যগুলিতে বেদব্যাস শক্ত শ্লোকে ব্যক্ত বলেছিলেন যা গণেশ অর্থ বোঝার জন্য সময় নিয়েছিল এবং ইতিমধ্যে বেদব্যাস ও বিশ্রাম নিয়েছিলেন।

ব্যাসদেব তার পুত্র শুকদেবকে বর্ণনা করেছিলেন, যিনি এটি বর্ণনা করেছিলেন জনমেজয়ের পিতা পরীক্ষিতের কাছে।

মহাকাব্য বক্তা মহাকাব্য শ্রোতা
ব্যাসদেব গণেশ, জৈমিনী, বৈশম্পায়ন, শুকদেব
শুকদেব পরীক্ষিত মহারাজ (জনমেজয়ের পিতা)
বৈশম্পায়ন জনমেজয়, রোমহর্ষণ
রোমহর্ষণ উগ্রশ্রবা (সৌতি)
উগ্রশ্রবা (সৌতি) শোনক
চার পাখি জৈমিনী

৩ :- গীতা এক না অনেক!

আশ্চর্যজনক হলেও একদম সত্য যে আরও ১০ টি গীতা রয়েছে ,যেমন বৈদ্য গীতা, অষ্টাভাকর গীতা, পরাশর গীতা ইত্যাদি। যদিও শ্রীমদ্ভাগবদ গীতা শুদ্ধ ও সম্পূর্ণ গীতা যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তথ্য ধারণ করে।

৪ :- রাজা জনমেজয় কেন বৈশম্পায়নকে দিয়ে সর্পিয়াজ্ঞ করেছিলেন ?

বৈশম্পায়ন বেদব্যাসের শিষ্য। তিনি প্রথমবার রাজা জনমেজয়ের বাড়িতে মহাভারত পাঠ করেছিলেন। জনমেজয় ছিলেন অর্জুনের পুতী, অভিমন্যুর নাতি এবং পরিক্ষীতের পুত্র। তাঁর বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বৈশম্পায়ন দ্বারা অনেক সর্পিয়াজ্ঞ করেছিলেন।

৫ :- কেন কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধের আয়োজন হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে ?

কারন কুরুক্ষেত্র হল ধর্মক্ষেত্র (যে স্থানে ধর্মীয় আচারসমূহ অনুষ্ঠিত হয়) শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যাকে বেদে আরাধনার ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এমনকি দেবতাদের জন্যও। কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের (পাণ্ডবদের) পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন।  তাই ধৃতরাষ্ট্র এই যুদ্ধের ফলাফলের উপর এই পবিত্র স্থানের প্রভাব সম্বন্ধে শঙ্কাকুল হয়েছিলেন। তিনি খুব ভালভাবে জানতেন যে, অর্জুন তথা অন্যান্য পাণ্ডবদের উপর এই পবিত্র স্থানের মঙ্গলময় প্রভাব পড়বে, কারণ তাঁরা সকলেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ।

৬ :- সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টি বর্তমানকালে টেলিভিশনের ধরনা দিয়েছিল

সঞ্জয় ছিলেন ব্যাসদেবের শিষ্য, তাই ব্যাসদেবের আশীর্বাদে তিনি দিব্যদৃষ্টির প্রভাবে ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে বসেও কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গন দেখতে পেতেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে বর্ণনা করতেন। আর তাই শুনে ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ অবগত থাকতেন।

৭ :- কেন শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের পরিবর্তে পাণ্ডবদের সমর্থন করেছিলেন ?

আসন্ন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৃষ্ণের সহায়তা পাওয়ার জন্য দুর্যোধন সবার আগে দ্বারকা পৌঁছান। অর্জুন তখনও পৌঁছননি। কৃষ্ণের কক্ষে প্রবেশ করে দুর্যোধন তাঁকে ঘুমন্ত দেখেন এবং ভগবানের মাথার কাছে রাখা একটি সিংহাসনে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে অর্জুন সেখানে প্রবেশ করে কৃষ্ণের পায়ের কাছে আসন গ্রহণ করেন। জেগে উঠে কৃষ্ণ অর্জুনকেই প্রথম দেখেন। কারন ভগবান তার চরনে থাকা ভক্তকে আগে উদ্ধার করেন। তিনি অর্জুনকে ২ টি শর্ত দিয়ে বলেন একটি বাছাই করতেঃ 

— একদিকে থাকবে একা স্বয়ং কৃষ্ণ, তবে তিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবেন না, থাকবেন সারথী হয়ে। 

—অন্যদিকে থাকবে বিশাল নারায়নী সেনা। 

 অর্জুন প্রথম শর্ততে রাজি হলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পক্ষে থাকার প্রতিশ্র ুতি দেন। দুর্যোধন আগে এলেও তাকে বাছাইয়ের প্রথম সুযোগ না দেওয়ায় অত্যন্ত ক্ষুন্ন হন, যদিও তার ইচ্ছা ছিল বিশাল নারায়নী সেনা সেটা পাওয়াতে প্রসন্ন হয়ে যান। কৃষ্ণ তাঁকে আশ্বাস দেন তাঁর অধীনস্থ নারায়ণী সেনা কৌরব পক্ষেই ষুদ্ধ করবে।

৮ :-ভীষ্মের জন্ম বহুচর্চিত ‘পূর্বজন্ম’-এর সত্যতা প্রমান করে

ভীষ্ম পিতামহের পিতা ছিলেন শান্তনু এবং মাতা ছিলেন গঙ্গা। পূর্বজন্মে শান্তনু ছিলেন ইক্ষবাকুবংশীয় রাজা মহাবিশ যিনি বহু যজ্ঞ করে স্বর্গে গিয়েছিলেন, তিনি ব্রহ্মার সেবা করতে ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত হলেন। সেখানে অন্যান্য দেবতারাও উপস্থিত ছিলেন।  যেখানে তিনি গঙ্গাকে দেখে তাঁর দিকে আকৃষ্ট হন। ইতোমধ্যে ব্রহ্মা তা লক্ষ্য করেন এবং মহাবিশকে জানিয়ে দেন তিনি স্বর্গে থাকার যোগ্য নন ও অভিশাপ দেন ওঁকে আবার মর্ত্যলোকে জন্মাতে হবে। তাই পরবর্তী জন্মে তিনি রাজা প্রদীপ পুত্র শান্তনুরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং গঙ্গার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু তিনি শান্তনুকে একটি শর্ত দেন তিনি কখনই তাঁর কাছ থেকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না। শান্তনু এতে সম্মতি দিয়েছিলেন।

তিনি দেখলেন স্ত্রী গঙ্গা একে একে প্রথম ৭ পুত্রকে জন্মের পরেই গঙ্গানদীতে ডুবিয়ে দেন, তিনি কখনই কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেননি। তবে যখন গঙ্গা তার অষ্টম সন্তানকে ডুবোতে যাচ্ছিল তখন তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন এবং তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তখন গঙ্গা তাকে তাঁর পূর্বের জন্ম এবং ভগবান ব্রহ্মার অভিশাপ সম্পর্কে বলেন। তিনি এও বলেন এই আট পুত্র বাস্তবে অষ্টাবসু। এই অষ্টাবসুরা একদিন সস্ত্রীক বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে গেছিলেন। অষ্টাবসুদের মধ্যে এক স্ত্রী বশিষ্ঠ মুনির গাভী নন্দিনী-র মোহে পড়ে যায় এবং তাঁর স্বামী প্রভাসকে গাভীটিকে চুরি করার প্রলোভন দেন। প্রভাস বাকি সাত বসুদের সাহায্য নিয়ে গাভীটিকে চুরি করে স্ত্রীকে উপহার দেন। বশিষ্ঠ মুনি ধ্যান যোগে সবকিছু জানতে পারেন এবং অষ্টবসুদেরকে অভিশাপ দেন মর্ত্যলোকে মানবরূপে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু‌ অষ্টবসুদের মিনতিতে বশিষ্ঠ মুনি আশ্বস্ত করেন তাঁদের স্বল্প সময়ের জন্য মানব জন্ম গ্রহণ করতে হবে কেবলমাত্র প্রভাস ছাড়া।  প্রভাসের আয়ুষ্কাল হবে দীর্ঘ, পত্নী বা পুত্র সুখ থাকবে না। তবে তিনি হবেন পুণ্যবান, পিতার বাধ্য, সমস্ত শাস্ত্রে পণ্ডিত। গঙ্গা শান্তনুকে আশ্বস্ত করেন তাঁদের অষ্টম সন্তানকে রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার জন্য তিনি তাকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন। কথা শেষে গঙ্গা শিশুটিকে নিয়ে অদৃশ্য হলেন। 

পরবর্তীতে এই অষ্টম পুত্র দেবব্রত বা ভীষ্ম নামে পরিচিত হন।

৯ :- মহাভারতকালে শিক্ষা মুখস্থ বিদ্যার উপর নির্ভরশীল ছিল না, ছিল শিক্ষার্থীর কঠিন সাধনা ও অধ্যাবসায়ের ফল

মাতা গঙ্গার সাথে থাকাকালীন ভীষ্ম বশিষ্ঠ মুনির কাছে বেদ ও বেদাঙ্গ, দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, এবং পরশুরাম মুনির কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা নিয়ে একজন আদর্শ রাজা হয়ে ওঠেন। এমনকি তিনি গুরু পরশুরামকে ২৩ দিন ব্যাপী যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন।

১০ :- ভীষ্ম কীভাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর পেলেন এবং কার থেকে ?

একদিন হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনু মৃগয়া করতে যমুনার তীরে গিয়েছিলেন। এমন সময় মৃগনাভির সুগন্ধিতে তিনি বিমোহিত হন। গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে এক কুটিরে সত্যবতীকে দেখতে পান এবং তার পিতা ধীবরনেতা দাশরাজের কাছে বিবাহের প্রস্তাব রাখলে তিনি শান্তনুকে এক শর্ত দেন যেন তার কন্যার গর্ভজাত পুত্রেরাই পরবর্তীতে রাজা হবেন। দেবব্রত যেহেতু শান্তনুর প্রথম পুত্র তাই সত্যবতীর সন্তানদের কোনদিন রাজা হওয়ার সুযোগ আসবে না। যদি তিনি এই শর্তে রাজি থাকেন তবেই তার কন্যার বিয়ে দেবেন তাঁর সাথে। 

শান্তনু ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল একদিকে দাশরাজের শর্ত অন্যদিকে তাঁর একমাত্র পুত্র দেবব্রতের (ভীষ্মের) রাজ্যাভিষেক নিয়ে।  পিতার কষ্ট দেখে দেবব্রতও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। পিতা তাকে কিছু না জানালেও তিনি এক মন্ত্রীর কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা জানলেন। এরপর কালবিলম্ব না করে দাশরাজের কাছে পৌঁছান এবং পিতার জন্য সত্যবতীকে প্রার্থনা করেন। দাশরাজ পুনরায় তার শর্তের কথা জানান। প্রত্যুত্তরে রাজকুমার দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি কোনদিন রাজা হবেন না, এমনকি তিনি কোনদিন বিয়েই করবেন না ব্রহ্মচারী জীবন কাটাবেন। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তার নাম হলো ভীষ্ম। ধীবর রাজ এই দুই শর্তে রাজি হয়ে রাজা শান্তনুর হাতে কন্যাদান করেন। রাজা শান্তনু খুশি হয়ে ভীষ্মকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন

কুলগুরু প্রশ্ন তোলেন সেক্ষেত্রে যদি রাজকুমার সিংহাসনের অযোগ্য হয় তাহলে কি হবে? সেক্ষেত্রে ভীষ্ম আবার প্রতিজ্ঞা নিলেন, রাজা যেই হোক না কেন, তিনি সবসময় রাজ্যের কল্যাণে রাজার প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করবেন এবং রাজা শান্তনুর বংশের কোনো অপমান হতে দেবেন না। 

১১ :- ভীষ্মের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী ছিল – অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, নাকি তাঁর করা প্রতিজ্ঞা ?

শান্তনুর দ্বিতীয় বিবাহ ধীবর (জেলে) রাজকন্যা সত্যবতীর সাথে হয়েছিল এবং চিত্রাঙ্গাদ ও বিচিত্রবীর্য নামে তাঁর দুটি সন্তান ছিল। চিত্রাঙ্গাদ যুদ্ধে মারা যান এবং তারপরে বিচিত্রবীর্য রাজা হন। বিচিত্রবীর্যের জন্য ভীষ্ম কাশী রাজার আয়োজিত স্বয়ম্ভর সভা থেকে তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা-কে তুলে নিয়ে আসেন। পথে সৌবলের রাজা শল্ব বাঁধা দিলে তাকে পরাস্ত করেন। আসলে শল্ব ছিল বড় রাজকন্যা অম্বার প্রনয়ী। হস্তিনাপুরে পৌঁছে অম্বা সেকথা ভীষ্মকে জানালে শল্বর কাছে তাঁকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরাস্ত শল্ব জানিয়ে দেন অম্বা যেহেতু অন্য একজন পুরুষের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, সুতরাং অম্বাকে বিয়ে করা তার পক্ষে অপমানজনক। 

বিচিত্রবীর্যের সাথে অম্বিকা এবং অম্বালিকার বিবাহ হয়। 

এই অবস্থায় অম্বা ভীষ্মকে জানান তিনি যেহেতু তাকে স্বয়ম্ভর সভা থেকে তুলে এনে বিয়ে ভেঙ্গেছেন তাই তাকে পত্নীরূপে স্বীকার করা উচিত। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়ে অম্বার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভীষণ অপমানিত ও নিরুপায় হয়ে অম্বা তখন ভীষ্মের বিনাশের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও পাগলপ্রায় হয়ে ওঠে।

এই অবস্থায় অম্বা ভীষ্মের গুরুদেব পরশুরামের কাছে বিহিত চাইলেন এবং তিনি তার শিষ্য ভীষ্মকে অম্বাকে বিবাহের আদেশ দিলেন। ভীষ্ম গুরুদেবকে প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে দিয়ে আদেশ মানতে অস্বীকার করেন। আকুতি করে জানান, প্রয়োজন হলে তিনি গুরুদেবের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত আছেন, তবু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারবেন না।  তিনি গুরু পরশুরামের কাছে ধর্মের জয় চেয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা চাইলেন এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।  ২৩ দিন ব্যাপী সেই যুদ্ধ চলেছিল এবং তিনি পরশুরামকে পরাস্ত করেছিলেন।

অনেক তপস্যার পর অবশেষে অম্বা শিবের থেকে বর পান যে পরজন্মে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। এই অম্বাই পরজন্মে শিখন্ডি হয়ে জন্মেছিলেন, যাকে দেখে ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১০ম দিনে অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি শিখন্ডিকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন এবং কোনো মহিলার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ভীষ্ম পিতামহের নীতিবিরুদ্ধ ছিল। শিখন্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন অজস্র তীরে ভীষ্মকে এমনভাবে বিদ্ধ করেন যাতে ভীষ্মের দেহ মাটি স্পর্শ না করে। ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করে রইলেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা মৃত্যু ছিল বলে তাঁর সেদিন মৃত্যু হয় নি।

১২ :- ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের রহস্যময় জন্মকথা

বিচিত্রবীর্যের সাথে অম্বিকা এবং অম্বালিকার বিবাহ হলেও নিঃসন্তান ছিলেন। বংশ নির্বংশ হতে বসেছে। মাতা সত্যবতী ভীষ্মকে আকুতি করেন অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভসঞ্চার করার জন্য। কিন্তু বিনা দ্বিধায় সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। 

উপায় না দেখে তিনি তার প্রথম পক্ষের সন্তান ব্যাসদেবকে স্মরন করলে তিনি হাজির হন। ব্যাসদেব রাজি না হলেও মাতৃ আজ্ঞা ফেলতে পারেন নি।

● অম্বিকা ব্যাসদেবের বীভৎস চেহারা দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেন, তাই অম্বিকার গর্ভে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হয়। 

● একইভাবে অম্বালিকা ব্যাসদেবের বীভৎস চেহারা দেখে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যান কিন্তু ভুলেও তিনি চোখ বন্ধ করেন নি, কারন তিনি জানতেন চোখ বন্ধ করার পরিনাম কি হয়েছে অম্বিকার সাথে! অম্বালিকার গর্ভে জন্ম নেন দুর্বল পাণ্ডু। 

● দুই সন্তানই সিংহাসনে বসার উপযুক্ত হবে না এই ভেবে বিচলিত সত্যবতী ফের অম্বিকাকে সহবাসের জন্য রাজি করান। পূর্বের বীভৎসতার কথা মনে পড়ে গেলে অম্বিকা আর ব্যাসদেবের সম্মুখে যেতে রাজি হননি বরং চুপিচুপি শূদ্রা দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন। সেই শূদ্রা দাসীর গর্ভে জন্ম নেয় ধর্মজ্ঞ জ্ঞানী বিদুর।   

১৩ :-বিদুরের জন্ম প্রমান করে ভগবান যখন মর্ত্যে আসেন তখন তিনি তাঁর পার্ষদদেরকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন

মহাভারতে, বিদুর ছিলেন যমরাজের অবতার এবং ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্রের এক মহান পন্ডিত। মহর্ষি মন্ডভ্য ঋষির অভিশাপে তাঁকে মানব হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল।

ভীষ্ম বিদুরকে সন্তানের মতো পালন করেন এবং তিনি তাকে ধনুর্বেদ, গজশিক্ষা, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতিতে শিক্ষিত করে তোলেন। যেহেতু তিনি শূদ্রা জননীর গর্ভে জন্মেছিলেন তাই তাকে রাজার অধিকার দেওয়া হয় নি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বিভিন্নভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যাতে সংঘটিত না হয় তার পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু তাতে তিনি রাজি হন নি।

১৪ :- কর্ণের জন্ম প্রমান করে সেকালে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের থেকেও উন্নত প্রযুক্তি ছিল

সহজ ভাষায়, ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন (wireless transmission) হল তার বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিক পরিবাহকের সাহায্য ছাড়াই দূরে থাকা ব্যাক্তির সাথে তথ্য আদান-প্রদান করা। যেমন, কুন্তি শৈশবে মহর্ষি দুর্বাসার যত্নসহকারে সেবা করেছিলেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বর দিয়েছিলেন, কুন্তী যে কোনও দেবতাকে স্মরণ করলে সেই দেবতা এসে কুন্তীকে পুত্রসন্তান দান করবে। বর পেয়ে কৌতূহলী কুন্তী কুমারী অবস্থাতেই সূর্যদেবকে প্রার্থনা করে বসেন এবং সূর্যদেব সেখানে হাজির হন। তবে এক্ষেত্রে শুধু তথ্য আদান প্রদানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এমন কিছু প্রযুক্তি ছিল যার মাধ্যমে দেবতারা অনায়াসে মুহূর্তের মধ্যে বিভিন্ন লোকে যাতায়াত করতে পারতেন।

সূর্যদেব তার নাভি স্পর্শ করলে তিনি গর্ভবতী হয়ে যান এবং এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সুতরাং, বিয়ের আগে তিনি সন্তান প্রসব করায় লোকলজ্জার ভয়ে সন্তানটিকে যমুনার জলে ভাসিয়ে দেন। এভাবেই কর্ণের জন্ম হয়েছিল। এর দ্বারা বোঝা যায় মহাভারতকালে ভ্রূণতত্ববিদ্যা কোটি কোটি গুন উন্নত ছিল, যেখানে বাচ্চার জন্ম একনিমেষে হতে পারত তাও আবার মাতৃগর্ভ ছাড়া  ভ্রূণের পরিস্ফ ুরণ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। যেসব ঘটনা আমাদের ভাবনার উপরে তাকে আমরা কল্পকথা বলে উড়িয়ে দিই, তাতে অবশ্য সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।  

১৫ :- পাণ্ডবদের জন্ম রহস্য বর্তমান বিজ্ঞানীদের ভাবনার নাগালের বাইরে

মহর্ষি কিন্দমের অভিশাপের কারণে পান্ডু তাঁর রাজ্য ত্যাগ করেছিলেন এবং সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। কুন্তি ও মাদ্রিও তাঁদের সাথে এক বনে বাস করতে শুরু করেছিলেন। যেখানে কুন্তি ধর্মরাজকে স্মরন করে যুধিষ্ঠিরের জন্ম দেন। এরপর, বায়ুকে স্মরন করে পুত্র ভীম এবং ইন্দ্রকে স্মরন করে পুত্র অর্জুনের জন্ম দেন। কুন্তি সেই মন্ত্র মাদ্রিকে দিয়েছিলেন এবং তিনি অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে স্মরণ করে নকুল ও সহদেবকে জন্ম দিয়েছিলেন। এরাই হলেন পঞ্চপান্ডব। 

১৬ :- কৌরবদের জন্ম হয়েছিল বর্তমান টেস্টটিউব পদ্ধতির থেকেও উন্নত প্রযুক্তিতে

গান্ধারী তার শ্বশুর ব্যাসদেবের সেবা করেছিলেন এবং সেই সেবায় খুশি হয়ে তিনি বর দিয়েছিলেন গান্ধারী শতপুত্রের জননী হবেন। যথাসময়ে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন কিন্তু কুড়ি মাস অতিক্রান্ত হলেও তার প্রসব হল না। এদিকে কুন্তীর পুত্রলাভের খবর পেয়ে গান্ধারী অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে লোহার মুগুর দিয়ে নিজের গর্ভপাত করেন। এর ফলে তার গর্ভ হতে এক লৌহকঠিন মাংসপিণ্ড নির্গত হল। গান্ধারী দাসীদের তা নষ্ট করার হুকুম দিলেন কিন্তু এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাদের এমন কাজ করতে বারণ করলেন। তিনি মাংসপিণ্ডটিকে শীতল জলে ভিজিয়ে একশ ভাগে ভাগ করে তা ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখেন। একবছর পর দুর্যোধন এবং একবছর এক মাসের মধ্যে দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকর্ণ প্রভৃতি শতপুত্র ও দুঃশলা নামক কন্যার জন্ম হল। দুঃশাসন তার ভাই দুর্যোধনের অন্ধ অনুগত ও পাণ্ডবদের হত্যার নানা ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন।

১৭ :- দুর্যোধনের জন্মকালে কি কি অশুভ ইঙ্গিত দেখা গিয়েছিল ?

দুর্যোধন জন্মানোর পরে গাধার মতো উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করেন, এর ফলে কাক, শকুন, শিয়াল, হায়েনা  প্রভৃতি পশুপাখি অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে চিৎকার শুরু করে দেয়। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেন তিনি যেন অশুভ গুণসম্পন্ন সন্তানকে মেরে ফেলেন। কারণ সে তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করবেন কিন্তু তিনি তার সন্তানের প্রেম মোহে তা করতে পারেননি। দুর্যোধনের আসল নাম ছিল স্যোধন

১৮ :- মহাভারতকালে স্ত্রীকে পুরুষের বাম উরুতে ও কন্যাদেরকে ডান উরুতে বসানো হত কেন ?

শকুনি মামার চাতুরীতে মহাভারতে দুর্যোধন পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরকে হারিয়ে প্রথমে তার রাজপাট থেকে সর্বস্বান্ত করেন, পরে নিজের ভাইদের পন রেখে হেরে যান, এমনকি শেষে নিজেকে পণ রেখেও হেরে যান। এরপর তিনি দ্রৌপদীকে পণ রেখে তাকেও হারান।  

পাশা খেলায় জিতে যুধিষ্ঠিরকে আদেশ দেন স্ত্রী দ্রৌপদীকে তাঁর বাম উরুতে এনে বসাতে, বারবার বাম ঊরুতে বাম হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে দিতে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করতে থাকেন। এ কারণে তিনি খলনায়ক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সেই সময়গুলিতে স্ত্রীকে পুরুষের বাম উরুতে বা বাম দিকে স্থান দেওয়া হত এবং কন্যাদের জন্য ডান উরু বা ডানদিকে রাখা হত।

১৯ :- দ্রৌপদীর বস্ত্রহরনের সময় কৃষ্ণের কৃপা এবং ভীমের নেওয়া প্রতিজ্ঞা কি সত্যি হয়েছিল ?

দুঃশাসন দ্রৌপদীকে তার অন্তঃপুর থেকে চুল ধরে সভায় টেনে আনেন এবং কর্ণের প্ররোচনায় তাকে বিবস্ত্রা করার চেষ্টা করে। তখন দ্রৌপদী শ্রীকৃষ্ণকে হাত জোড়ে আহ্বান করতে থাকেন, কৃষ্ণ বস্ত্রের যোগান দিতেই থাকেন। অনেক চেষ্টার পর ক্লান্ত দুঃশাসন হাল ছেড়ে দেন।

সভায় ভীষ্ম পিতামহ, দ্রোনাচার্য, কৃপাচার্য প্রমুখ উপস্থিত থাকলেও কেউ বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেননি, একমাত্র বিদুর ছাড়া। যদিও তাতে কৌরবরা ক্ষান্ত হননি। শেষমেশ ভীম ক্ষোভে হুঙ্কার দিয়ে প্রতিজ্ঞা করে বসে দুর্যোধন তুই যে হাত ঊরুতে থাপ্পড় দিতে দিতে এই ভরা সভায় দ্রৌপদীর অপমান করেছিস তোর ওই ঊরু ভেঙ্গে তোর প্রান নেব। আর দুঃশাসন তোর বুক চিরে তোর প্রান নেব তবেই আমার বুকের জ্বালা মিটবে। ভীম যা বলে সে তাই করে এটা দুর্যোধন জানে, ভয়ে দুর্যোধন শান্ত হয়ে যায়। 

২০ :- ভীম কি সত্যিই দুঃশাসনের রক্ত পান করেছিলেন ?

কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের ১৭ তম দিনে ভীম দুঃশাসনের বক্ষ খড়গ দিয়ে বিদীর্ণ করেন এবং হাত দিয়ে চিড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। অনেকের মতে  ভীম দুঃশাসনের রক্তপান করেছিলেন – একথা মোটেও সত্য নয়। ভীম তার দাদা শ্রী হনুমানের থেকে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন যখন ভীম ক্রোধে গর্জন করবে তার মধ্য থেকে হনুমানজীর গর্জন যুক্ত হয়ে প্রচণ্ড শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করবে। এই শব্দতরঙ্গের কারনে কুরুক্ষেত্রে বহু প্রান যায়, বহুজন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালায়। তেমনি ক্ষুব্ধ ভীমের তীব্র গর্জনের শব্দতরঙ্গে দুঃশাসনের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছিল। 

২১ :- শকুনি কি সত্যিই পাণ্ডবদের শত্রু এবং কৌরবদের মিত্র ছিল ?

শকুনি ছিলেন গান্ধার রাজ্যের রাজকুমার, রাজা সুবলের ১০০ তম তথা কনিষ্ঠতম সন্তান (তাই তাকে সৌবালা বলা হত), তিনি ছিলেন গান্ধারীর ভাই এবং কৌরবদের মামা। (গান্ধাররাজ যা বর্তমান আফগানিস্তান অবস্থিত)। সুতরাং, ভাইদের মধ্যে শকুনি সবার ছোট এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান।

শকুনির রাগ বা বিদ্বেষ কোনটাই পান্ডবদের প্রতি ছিল না, ছিল ভীষ্ম পিতামহের প্রতি এবং তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র কুরু বংশ ধ্বংস করে দিতে। এই শত্রুতার বীজ লুকিয়ে ছিলো গান্ধারীর বিয়েতে।

রাজা সুবল কন্যা গান্ধারীর জ্যোতিষী ছকবিচার করে জেনেছিলেন, “গান্ধারীর প্রথম স্বামীর আয়ু সীমিত, কিন্তু দ্বিতীয় স্বামীর আয়ু হবে দীর্ঘায়ু।” তাই সুবল রাজ সতর্কতার সঙ্গে গান্ধারীর বিয়ে দেন এক ছাগলের সঙ্গে। এরপর সেই ছাগটিকে বলি দেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন পরেই স্বয়ং ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে গান্ধার রাজ্যে পৌঁছান। আর সুবল দেরি না করে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তিনি ভেবেছিলেন এই বিয়ের প্রস্তাবটি আসবে সুদর্শন রাজকুমার পাণ্ডুর পক্ষ থেকে, যিনিই কৌরবদের রাজা হতে চলেছেন। ধৃতরাষ্ট্র বয়সে বড় হলেও অন্ধত্বের কারণে রাজ সিংহাসনের অধিকার পান নি। যাই হোক, সুবল রাজের আদশে রাগে-অভিমানে গান্ধারী মেনে নেয় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে স্বামী হিসাবে এবং নিজের চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করলেন একটুকরো কাপড় বেঁধে।এই বঞ্চনার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন শকুনি কিন্তু ভীষ্মের ব্যক্তিত্বের সামনে তা ছিল নিষ্ফল।

ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ের সময় গান্ধারীর প্রথম বিবাহের ঘটনা গোপন রাখা হয়। পরে কুরু বংশে প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে গান্ধারী বিধবা হওয়া সত্ত্বেও ছলনার করে বিয়ে দেওয়া হয় ধৃতরাষ্টের সঙ্গে। ভীষ্মের মতো বিচক্ষণ ব্যাক্তি কিনা প্রতারণার স্বীকার হয়েছে, যা শুনে সকলে হাসবে। তাই রাগে ক্ষোভে সত্যকে গোপন রাখা ও কুরু বংশকে বঞ্চনার অভিযোগে গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করেন ভীষ্মের বিশাল বাহিনী। যুদ্ধে পরাস্ত হন রাজা সুবল ও বন্দি করা হয় শকুনিসহ তাঁর শতপুত্রকে। তাঁদের প্রাণে হত্যা না করে কারাগারে আটক করে অভুক্ত রাখা হয় কিন্তু খাবার দেওয়া হতো এক জনের। এইভাবে তিলে তিলে তাঁদের হত্যার পরিকল্পনা নেয় হস্তিনাপুর রাজপুরুষরা।

গান্ধার রাজ সুবল তখন তাঁর পুত্রদের বললেন, এভাবে লড়াই করে সকলের একসাথে বেঁচে থাকে কঠিন, তার থেকে বাঁচিয়ে রাখা হবে চতুরতম বংশধর শকুনিকে, যে ভবিষ্যতে প্রতিশোধস্বরূপ কুরু বংশ নির্বংশ করবে। তাই সবাই অনাহারে থেকেও ওই সামান্য খাদ্য শকুনিকে খাওয়াত। এইভাবে বন্দিদশায় একে একে মারা যান শকুনির সব ভাই। মৃত্যু মুখে গান্ধাররাজ সুবল একদিন একটা মোটা লাঠি দিয়ে শকুনির পায়ে আঘাত করে গোড়ালি ভেঙে দেন এবং মনে করিয়ে দেন ‘সৌবালা, এখন থেকে তুমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবে আর প্রত্যেকবার খুঁড়িয়ে হাঁটার সময় তোমাকে মনে করিয়ে দেবে কৌরবরা ও ভীষ্ম আমাদের প্রতি কী ভীষণ অন্যায় করেছে, যার কোনও ক্ষমা নেই। তারা যেভাবে গান্ধার বংশ শেষ করেছে, কৌরবদের বিনাশেই আমার আত্মা শান্তি পাবে, সে কথা কখনও ভুলে যেও না।’ শুধু প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে জীবিত থাকেন শকুনি।

শেষ শয্যায় শুয়ে সুবল রাজ শকুনিকে কাছে ডেকে কানে কানে বললেন, “পুত্র সৌবালা, তুমিই এখন ভাইদের মধ্যে একমাত্র জীবিত। আমার মৃত্যু আসন্ন। একটা গোপন কথা শোনো। আমার মৃত্যুর পর আমার উরুর হাড় দিয়ে তোমার পাশার ঘুঁটি তৈরি করবে।  আমার সমস্ত ক্রোধ ও প্রতিহিংসা এই অস্থি অবশেষের মাধ্যমে পাশার ঘুঁটির মধ্যে বেঁচে থাকবে। পাশার খেলায় যে দান তুমি চাইবে, তোমার ইচ্ছা অনুসারেই জয়ের ফল তুমি পাবে। লোকে একে কপট উপায় বলবে কিন্তু তাতে কান দিও না, কারণ এই গুপ্ত কথা কেউ জানবে না। তুমি এখান থেকে মুক্তি পেলে তোমার ভাগ্নে সুযোধনের (দুর্যোধনের অপর নাম) সঙ্গে যোগাযোগ করে কৌরবদের পক্ষে মিলিত হবে! ভবিষ্যতে এই পাশাখেলার সাহায্যেই তুমি কুরু বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তুমি এই লক্ষ্য থেকে  কখনও বিচ্যুত হও না “

এরপর ইতিহাসই সাক্ষি! শকুনি হয়ে উঠলেন মহাভারতের প্রধান খলনায়ক। প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকা শকুনি এসে উঠলেন দিদি গান্ধারীর কাছে। ধূর্ত শকুনি বুঝলেন দুর্যোধন মূর্খ এবং গোঁয়ার। তাঁকেই তিনি ব্যবহার করলেন নিজের চালের দান স্বরূপ। শকুনির লক্ষ্য ছিলো কৌরব-পাণ্ডবদের লড়িয়ে দিয়ে পুরো বংশ ধ্বংস করে দেওয়া। দুর্যোধনকে তিনি নানান কুটবুদ্ধি দিতেন যেমন, কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে শৈশবে হত্যার চেষ্টা, জতুগৃহে কুন্তি সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা, ইত্যাদি ষড়যন্ত্রে শকুনির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দুর্যোধনের মাধ্যমে পাশা খেলায় পাণ্ডবদের আমন্ত্রন জানায় এবং যুধিষ্ঠির এই খেলায় প্রথমে রাজ্যপাট, পরে স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরে যান। শুধুমাত্র পাশার চাল চেলে একটা বড় সাম্রাজ্যকে নিজের কুক্ষিগত করা মুখের কথা নয়! এই পাশা খেলার আসরই হল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূত্রপাত। পাশার খেলায় হেরে যাওয়ার ফলে শর্তসাপেক্ষে তিনি পান্ডবদের ১২ বছরের নির্বাসন ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছিলেন ।

গান্ধার সিংহাসন শূন্য পড়ে থাকলেও সেখানে তিনি রাজত্ব করতে জাননি।  শকুনির দুই পুত্র – উলুক এবং বৃকাসুর। 

যুদ্ধ শুরু হবার আগে শকুনির পুত্র উলুক দুর্যোধনের দূত হিসেবে দুর্যোধনের শিখিয়ে দেওয়া অভদ্র অশ্লীল নোংরা কথা পাণ্ডবদের গিয়ে শোনালেন। সহদেব সেই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ নিলেন যে, শকুনি তাঁদের পরিনতির সব নষ্টের মূল তাই তার সামনে প্রথমে উলুককে হত্যা করবে, তারপর তার পিতা শকুনিকে বধ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিন তথা ১৮ তম দিনে সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলুক ও শকুনির মৃত্যু হয়।

ভারতের ইতিহাসেও শকুনির উল্লেখ আছে। গান্ধারের রাজা অম্ভি কুমার ছিলেন রামায়ণের ভরত এবং মহাভারতের শকুনির বংশধর। তক্ষশীলায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সহপাঠী ছিলেন অম্ভি। আলেকজান্ডার যখন ভারত অভিযানে আসেন, তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন অম্ভি। পরে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাতে নিহত হন তাঁর একদা সহপাঠী এবং শকুনির উত্তরসূরী অম্ভি কুমার। 

২২ :- কীভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুভ সন্ধিক্ষণ পাল্টে দিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ?

সহদেব ছিলেন ভাল জ্যোতিষী। শকুনির পরামর্শে দুর্যোধন সহদেবের কাছে এসেছিলেন এই কথা জানতে যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু করলে কৌরবরা যুদ্ধে জয়ী হবেন? সহদেব সৎ ছিলেন। তাই কৌরবরা তার শত্রু জেনেও তিনি সঠিক সময়টি বলে দেন। কৃষ্ণ তা বুঝতে পেরে যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই একটি গ্রহণের পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণের চিন্তায় ভীত হয়ে সূর্য ও চন্দ্র তার কাছে এসে বলেন যে এর ফলে মহাবিশ্বে সময়ের একটি বড়ো অসঙ্গতি দেখা দেবে। তখন কৃষ্ণ ঘোষণা করেন যেহেতু পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য একযোগে একসাথে এসেছে, সেহেতু এটিই একটি গ্রহণ। এভাবেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুভ সন্ধিক্ষণ পাল্টে দিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। 

২৩ :- মহাভারতের যুদ্ধে বিদেশীরাও অংশগ্রহণ করেছিল

আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বিদেশীরাও মহাভারতের লড়াইয়ে জড়িত ছিল। লড়াই কেবল পান্ডব এবং কৌরবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, রোমের গ্রীস থেকে আসা বাহিনীও এর অংশ ছিল।

২৪ :- চক্রব্যূহে অভিমন্যুকে হত্যার চক্রান্তে কারা জড়িত ছিল ?

যদিও এটি বিশ্বাস করা হয় যে চক্রব্যুয়ের সাতটি মহারাথি অভিমন্যুর মৃত্যুর কারণ ছিল, তবে এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। 

অর্জুনের বারো বছরের ব্রহ্মচর্য ও বনবাস জীবন সম্পূর্ণ হওয়ার পর অভিমন্যুর জন্ম হয়। অভিমন্যু যখন সুভদ্রার গর্ভে, একদিন সুভদ্রা অর্জুনের কাছ থেকে চক্রব্যূহে প্রবেশের পন্থা শুনতে চায় এবং তা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। তাই অভিমন্যু কেবল চক্রব্যূহে প্রবেশের পন্থা জানতেন, বাহির হওয়ার পন্থা জানতেন না।

যুদ্ধের ১৩ তম দিনে অভিমন্যু যখন চক্রব্যূহ ভেদ করে এগোতে থাকে তার তীরবর্ষণে মদ্ররাজ শল্ব ও দুঃশাসন মূর্ছিত হন। কর্ণের এক ভাই ও শল্বের  ভ্রাতা নিহত হয় এবং পরে শল্ব রণভূমি ছেড়ে পালিয়ে যান। কৌরবসৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং যোদ্ধারা পালাতে থাকে। অভিমন্যুর পরাক্রমে শল্বপুত্র রুক্মরথ, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষণ কুমার ও কোশলরাজ বৃহদবল তার বাণে হত হন।

এইদিকে সাহায্যের জন্য যুধিষ্ঠির, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখন্ডী, সাত্যকী, বিরাটদ্রুপদ চক্রব্যূহে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে চাইলে ধৃতরাষ্ট্রের জামাই সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ শিবের বরে বলীয়ান হয়ে তাদের পরাস্ত করেন ও ব্যূহের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়।

অভিমন্যুকে পরাস্ত করার কোনও উপায় না দেখে দ্রোণাচার্য কর্ণকে পেছন থেকে আক্রমণ করে তাকে রথচ্যূত ও ধনুর্হীন করার পরামর্শ দেন। সেই মতো কাজ হলে দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধনশকুনি নির্দয়ভাবে তার ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন। অভিমন্যু খড়গ, গদা এমনকি রথের চাকা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এইসময় দুঃশাসনের পুত্র তার মাথায় নির্মমভাবে গদা দিয়ে আঘাত করলে নিরস্ত্র অভিমন্যুর মৃত্যু হয়। অভিমুন্যের বধের জন্য দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, শকুনি ছাড়াও শল্ব, কৃতবর্মা, বৃহদ্বল, ভূরি, ভুরিশ্রবা, শল, পৌরববৃষসেনকে দায়ি করা হয়।

২৫ :- জয়দ্রথকে হত্যার পেছনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কী অবদান ছিল ?

অর্জুন অভিমন্যু হত্যার প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নেন যে মূল দোষীকে পরদিন সূর্যাস্তের আগেই হত্যা করবেন অথবা অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করবেন। পুত্র হত্যার মূল চক্রান্তকারী হিসাবে জয়দ্রথকে চিহ্নিত করেন।  এই প্রতিজ্ঞার বিষয় জেনে জয়দ্রথ পালানোর চেষ্টা করলে দুর্যোধন ও দ্রোণ তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

পরদিন অর্থাৎ যুদ্ধের ১৪ তম দিনে জয়দ্রথকে রক্ষার জন্য দ্রোণ প্রথমে একটি শকটব্যূহ রচনা করেন। এই ব্যূহের ভিতরে গর্ভব্যূহ এবং গর্ভব্যূহের মধ্যে সুচীব্যূহ রচনা করেন। সেই সুচীব্যূহের মধ্যে বিশাল সেনাবাহিনির ঘেরাটোপে জয়দ্রথকে লুকিয়ে রাখেন। 

ভীম ও অর্জুন বহু চেষ্টা করেও জয়দ্রথের কাছে পৌঁছাতে পারছিলেন না। তখন শ্রীকৃষ্ণ যোগবলে সুদর্শনচক্র দ্বারা সূর্যকে ঢেকে দেন ফলে দিন থাকতেই সন্ধ্যা নেমে আসে।এর থেকে আমরা বুঝতে পারি, আমরা সময়ের অধীনস্থ হলেও ভগবান নন, তিনি হলেন সমগ্র ব্রহ্মান্ডের, সমস্ত ব্রহ্মান্ডের মধ্যে সমস্ত সৃষ্টির, সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সমস্ত জড় জগতের নিয়ন্ত্রতা। তিনি আদি পুরুষ ও সব কিছুর উর্দ্ধে। 

কৌরবরা ইতিমধ্যে বিজয়াচ্ছাস শুরু করে দেয়, জয়দ্রথও খুশি খুশি আত্মপ্রকাশ করে নির্ভয়ে সূর্যাস্ত দেখতে থাকে। তখন কৃষ্ণ অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন যে জয়দ্রথের পিতা বৃদ্ধক্ষত্র জয়দ্রথের জন্মকালে দৈববাণী পেয়েছিলেন যে রণস্থলে তার পুত্র জয়দ্রথের মস্তকচ্ছেদন হবে, তখন তিনি পাল্টা এই অভিসম্পাত করেন, যে তার পুত্রের মস্তক মাটিতে ভুপাতিত করবে তার মস্তক শতভাগে টুকরো-টুকরো হবে। সুতরাং, মস্তকচ্ছেদন করার পর তা মাটিতে ফেলা যাবে না।

যুদ্ধকালে বৃদ্ধক্ষত্র স্যমন্তপঞ্চক দেশের বহির্ভাগে তপস্যা করছিলেন। এই কারণে কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন কৌতূহলী ও অসতর্ক জয়দ্রথের মাথা এক তীরের দ্বারা কেটে ফেলেন এবং তা মাটিতে পড়ার আগেই আরও কয়েকটি বাণ নিক্ষেপ করে মাথাটিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে উলপাহাড়ীতে সন্ধ্যাবন্দনারত রাজা বৃদ্ধক্ষত্রের কোলে ফেলেন। রাজা বৃদ্ধক্ষত্র আচমকা কিছু না বুঝে উঠে দাঁড়ান। ফলে পুত্রের কাটা মাথাটি মাটিতে পড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তার নিজের মাথাও শত ভাগে টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। 

২৬ :- বিকর্ণ কে ছিল এবং তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল ?

যুদ্ধের এই ১৪ তম দিনে ভীম ও অর্জুন জয়দ্রথ বধে উদ্যোদী হন। এমন সময়ে দুর্যোধন তাঁর ভাই বিকর্ণকে পাঠান ভীমের উপরে নজরদারি করার জন্য। তিনিই ছিলেন কৌরব ভাইদের ভেতর ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ। বিকর্ণ ধর্মপথ ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। তা ছাড়া তিনি জানতেন, যথা কৃষ্ণ তথা জয়। তিনি পাণ্ডবদের সমর্থন করলেও কৌরব পক্ষ ত্যাগ করে পারেননি। ভীম বিকর্ণকে দেখতে পান। তিনি দেখেছিলেন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো নিন্দনীয় অপমানের সময়ে বিকর্ণই একমাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু বিকর্ণের অনুরোধেই তিনি তাঁর সঙ্গে গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভীম বিকর্ণকে বধ করেন। কারণ তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিশ্চিহ্ন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। 

২৭ :- মহাভারতে অর্জুনকে কেন বৃহন্নলা হতে হয়েছিল ?

আপনি কি জানেন যে অর্জুন তাঁর ‘মা’ সম্বোধন করতে গিয়ে ইন্দ্রলোকের অপ্সরা উর্বশীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি নপুংসক হয়ে উঠবেন। এই অর্থে ভগবান ইন্দ্র অর্জুনকে বলেছিলেন যে এই অভিশাপ তাকে এক বছর লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করবে এবং এই সময় ব্যয় করার পরে তিনি আবার তার পুরুষতন্ত্র ফিরে পাবেন এই বরদান দেয় এবং মহাভারতে ১২ বছর বনে কাটানোর পরে, পাণ্ডবরা রাজা বিরাটের দরবারে ১৩ তম বছরটি অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছিলেন। অর্জুন এই অভিশাপটি ব্যবহার করেছিলেন এবং বৃহন্নলা নামে নপুংসক হিসাবে বসবাস করেছিলেন।

২৮ :- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে ভীষ্ম পিতামহের হাত থেকে পাণ্ডবদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর অপ্র্রাপ্ত বরের পাওনাটা মনে করে দেন – অর্জুন তুমি একবার দুর্যোধনের জীবন বাঁচিয়েছিলে এবং বলেছিলে যে উপযুক্ত সময়ে তিনি এটি চাইবেন। যাও অর্জুন! দুর্যোধনের কাছ থেকে ভীষ্মের দ্বারা মন্ত্রপূত পাঁচটি সোনার তীর চেয়ে নিয়ে এসো। কৃষ্ণ জানতেন এই তীরগুলি ভীষ্ম পিতামহ পাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য আগামীকাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করবেন। দুর্যোধন ভীষ্ম পিতামহের থেকে তিরগুলো নিয়ে এসেছিলেন কারন সে জানত পাণ্ডবদের প্রতি পিতামহের দুর্বলতা রয়েছে, শেষ মুহূর্তে তিনি  পাণ্ডবদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারেন। 

একই সাথে দুর্যোধন হতবাক হয়েছিলেন যখন অর্জুন তার থেকে ৫ টি সোনার তীর চায় যেহেতু তিনি অর্জুনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাই তাকে তীরগুলো ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। পরের দিন সকালে ভীষ্ম যখন সব শুনলেন তখন তিনি হেসে বললেন পাণ্ডবদের হত্যা করা সম্ভব নয়, কারন তাঁদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন এবং আগামীকাল মহাভারতের যুদ্ধে যা কিছু ঘটবে তা অনেক আগেই লেখা হয়ে গেছে এবং কোনও কিছুই তা পরিবর্তন করতে পারবে না।

২৯ :- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কি প্রতিশ্র ুতি ভঙ্গ করেছিলেন এবং কেন ?

মহাভারতের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রতিশ্র ুতি ভঙ্গ করেছিলেন যে তিনি কোনও অস্ত্র গ্রহণ করবেন না। কিন্তু যুদ্ধের তৃতীয় দিনে যখন তিনি দেখলেন যে অর্জুন ভীষ্মের  প্রচন্ড সংহারমূর্তি শক্তির সাথে মেলে ধরতে পারছেন না, তখন সে অসহায় হয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে রথের লাগামটি থামিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন, রথের একটি চাকা তুলে ভীষ্মের দিকে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। অর্জুন কৃষ্ণকে থামানোর ভীষণ চেষ্টা করেন। অন্যদিকে ভীষ্ম ভগবানের হাতে মৃত্যু ইচ্ছায় অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করে নিরস্ত্র হয়ে যান। 

৩০ :- ইরাবান কে এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর অবদান কি ?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইরাবানের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি ছিলেন অর্জুন এবং নাগ রাজকন্যা উলুপীর পুত্র। ইরাবান তাঁর পিতা অর্জুনের বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে নিজেকে মা কালীর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, তিনি বিবাহ করবেন। মৃত্যু পথযাত্রী স্বামীর জন্য কন্যা পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে এক সুন্দরী নারীতে পরিণত করেন এবং ইরাবানকে বিবাহ করেন। শুধু তাই নয়, ইরাবানের মৃত্যুর পরে তিনি বৈধব্য পালনও করেছিলেন।

৩১ :- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে কৌরব পক্ষে একজন যোদ্ধাই জীবিত ছিলেন, কে তিনি ?

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষে কেউই জীবিত ছিলেন না শুধুমাত্র ধৃতরাষ্ট্রের এক কানীন পুত্র (অর্থাৎ, অবিবাহিত কন্যার সন্তান) যুযুৎসু ছাড়া। কারণ তাঁর সৎ ভাইরা তাঁরা জন্মবৃত্তান্ত তুলে তাঁকে অপমান করতেন। তিনি সদ্ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কৌরবদের ত্যাগ করে পাণ্ডব শিবিরে চলে আসেন। ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যুদ্ধে মারা যাননি। পরে তিনিই পরিক্ষিতের অভিভাবক হন।

৩২ :- গন্ধর্বদের সাথে পাণ্ডবদের সুসম্পর্ক

রাক্ষতো গন্ধর্বরাও বনে বসবাসকারী প্রাণী ছিল। তবে তারা আরও বেশি অত্যাধুনিক ছিল যেমন উড়ন্ত রথে ভ্রমণ এবং ধনুক ব্যবহার করত। সম্ভবত তারা অ-বৈদিক উপজাতি ছিল। যখন তারা প্রশংসনীয় কাজ করত তাদেরকে দেবতা বা দেবী হিসাবে গন্য  করা হত এবং যদি তারা ঘৃণ্য কাজ করত তাদেরকে দানব হিসাবে চিহ্নিত করা হত। 

ঘোড়া ভারতীয় উপমহাদেশীয় প্রাণী নয়। যেসব গন্ধর্ব পাণ্ডবদের ঘোড়া সরবরাহ করত তাদেরকে উত্তর পশ্চিম সীমান্তে আশ্রয় দিয়েছিল যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা মধ্য এশিয়া ও আরবের স্টলনকে ভারতে নিয়ে আসত।

৩৩ :জতুগৃহে পাণ্ডবদের হত্যার চক্রান্তের পিছনে কার হাত ছিল ?

মহাভারতে পাণ্ডবদের সাথে মাতা কুন্তীকে হত্যা করার বারণাবত নগরীতে দুর্যোধন তার মন্ত্রী পুরোচনকে দিয়ে এক মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করিয়েছিলেন যা লাক্ষা (বা, জতু ) দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। তাছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছিল সহজ দাহ্য পদার্থ যেমন বাঁশ, মোম, ঘি, শণ ইত্যাদি। এই গৃহই জতুগৃহ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন – ধৃতরাষ্ট্র, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি প্রমুখ। দুর্যোধনের মন্ত্রী পুরোচনকে এই গৃহে অগ্নি সংযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। চক্রান্তের আঁচ বিদূর বুঝতে পেরে যুধিষ্ঠিরকে এই বিষয়টি জানান। পাণ্ডবদের রক্ষা করার জন্য বিদূর একজন লোককে সেই ঘরে একটি সুড়ঙ্গ খোড়ার জন্য পাঠান। লোকটি সেই ঘর থেকে নিকটবর্তী নদীতীর পর্যন্ত একটি গোপন সুড়ঙ্গ খোঁড়েন, যাতে সে পথ দিয়ে পাণ্ডবরা সহজেই পালিয়ে যেতে পারেন।

একদিন কুন্তী একটি ভোজসভার ব্যবস্থা করেন। ভোজ শেষে কুন্তির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলে সেইসময় ক্ষুধার্ত এক নিষাদী তার পাঁচ পুত্রের সাথে সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। কুন্তি তাদের ভালোভাবে পানভোজন করালেন। নিষাদী ও তার পুত্রেরা অতিরিক্ত মদ্যপান করায় অজ্ঞান ও মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকেন। গভীর রাতে যখন জোরে জোরে বাতাস বইতে থাকে, তখন উপযুক্ত সময় বুঝতে পেরে ভীম প্রথমে পুরোচনের ঘরে, তারপরে জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে দেন। এরপর বিদুরের পাঠানো নৌকায় নদী পার করে জঙ্গলে প্রবেশ করেন। এই সময় ক্লান্ত হয়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ভীম একা সকলকে পাহাড়া দিতে থাকেন এবং রাগে উত্তেজনায় তাঁদের এই দুর্দশার জন্য দুর্যোধনকে মনে মনে দোষারোপ করতে থাকেন।

আগুনের উত্তাপে ও শব্দে গ্রামবাসীরা ছুটে এলো এবং জল নিয়ে সকলে অগুন নেভানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার জন্য জতুগৃহের কাছে কেউ যেতে সাহস পেল না। চারদিকে লোকজন হাহাকার করে ঘুরতে লাগল। গালা(জৌ), ঘি, তেলের গন্ধ চারদিকে ছড়াতে লাগলো। এই অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নিষাদী সহ তার পাঁচ পুত্র সন্তান। ছাইভস্ম থেকে ছয় জনের মৃতদেহ দেখতে পেয়ে সকলে ক্রন্দন করতে লাগল আর বলতে লাগল দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিতেই এই জতুগৃহ নির্মাণ ও তার দুর্বুদ্ধিতেই পান্ডুপুত্রদের ছলনা করে দগ্ধ করা হল। 

৩৪ :- হিড়িম্বার সাথে ভীমের বিবাহ অর্থাৎ রাক্ষসীর সাথে মানবের বিবাহ

কুন্তী সহ পাণ্ডবরা যে বনে আশ্রয় নিয়েছিল তা ছিল হিড়িম্ব নামক এক নরভোগী রাক্ষসের দখলে। সেখানে সে তার বোন হিড়িম্বার সাথে বাস করত। মানুষের আগমনে হিড়িম্ব-এর মধ্যে খাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হল এবং তার বোন হিড়িম্বাকে বললো মানুষগুলোকে মেরে নিয়ে আসতে। সে এসে সবাইকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখল একমাত্র ভীম ছাড়া। ভীমের পেশীবহুল দৈত্যাকার চেহারা দেখে মোহিত হয়ে ভীমের প্রেমে পড়ে গেলো। হিড়িম্বা ভাবতে লাগল মেরে খাওয়ার সুখ ক্ষনিক, তার থেকে বিয়ে করে সারাজীবন সুখভোগে থাকতে পারব, স্বামীর ভালোবাসা অনেক সুখের। এরপর সে রাক্ষসরূপ ত্যাগ করে এক সুন্দরী মানবীর রূপ ধরে ভীমের কাছে এসে জানায় তার ভাই এক রাক্ষস ও এই বনের রাজা এবং সেইসঙ্গে সে ভীমের কাছে প্রেম নিবেদন করে ও সকলের মঙ্গলের জন্য সবাইকে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বলে। ঘুমন্ত মা ও ভাইদের ছেড়ে যেতে তিনি যেতে রাজি হলেন না। 

এইদিকে বোনের আসতে দেরি দেখে হিড়িম্ব নিজেই হাজির হয়। পরে ভীমের সাথে যুদ্ধ হলে হিড়িম্ব নিহত হয়।  

ভীম-হিড়ম্বের যুদ্ধের আওয়াজে কুন্তীসহ অন্য পাণ্ডবরা ঘুম থেকে জেগে যান। হিড়িম্বকে হত্যা করার পর, ভীম হিড়িম্বাকে হত্যা করতে এগিয়ে যান, হিড়িম্বা ততক্ষণে কুন্তীকে প্রণাম করে শরণাপন্ন হয়। সে বিনতির সাথে জানায় সে একজন রাক্ষসী এবং ভীমের প্রতি যে অনুরক্তা। এরপর যুধিষ্ঠির ও কুন্তীর অনুগ্রহে ভীম ক্ষান্ত হয় এবং হিড়িম্বা রক্ষা পায়। তখন কুন্তীর আদেশে ভীম হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন। যুধিষ্ঠির হিড়ম্বার সাথে শর্ত সাপেক্ষে মিলিত হওয়ার অনুমতি দেন। শর্তটি ছিল, স্নান-আহ্নিক শেষে ভীম সারাদিন হিড়িম্বার সাথে থাকবেন, তবে সূর্যাস্তের পূর্বে তিনি আবার পাণ্ডবদের সাথে মিলিত হবেন। তখন ভীমও প্রতিজ্ঞা করেন যে, যতদিন না হিড়িম্বার গর্ভে তাঁর পুত্র জন্মাবে ততদিন তিনি হিড়িম্বার সাথে থাকবেন। পরে ভীমের ঔরসে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয় এবং পরবর্তীতে সে একজন ধার্মিক, বিদ্বান ও বীর যোদ্ধায় পরিনত হয়। এরপর হিড়িম্বা রাক্ষস ধর্ম ত্যাগ করে এবং পুত্রকে লালন করতে থাকে। কথা মতো ভীমকে বিদায় দেয় এবং তিনি ফিরে যান পাণ্ডবদের কাছে।

৩৫ :- মহাভারতের মহাযুদ্ধের পর কেন অর্জুনের রথ পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল?

মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল ধর্মের জন্য। কৌরবদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন চরমে পৌঁছেছিল এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র আসক্তিতে এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে তার ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান ছিল না। যদিও তাদের সঙ্গে ছিল বিদুরের মতো পণ্ডিত। যখন দ্রৌপদীকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হচ্ছিল এবং দরবারে উপস্থিত সবাই মাথা নিচু করে সেই লজ্জাজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিল, তখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বিকর্ণ এর বিরোধিতা করেন। মহাভারতে, বিদুর এবং বিকর্ণ এমন দুটি চরিত্র যারা মহাভারতের যুদ্ধকে ধ্বংসাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন। এর পরেও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র আসক্তিতে আটকা পড়ে মহাভারতের যুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠেন।

পাণ্ডবদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন, কৌরবরা তাঁকে গোয়ালা বলে সর্বদা তুচ্ছ করে নিজেদের মৃত্যু ফাঁদ নিজেরাই তৈরি করেছিল। ভগবানের মহিমা ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার না করা হল মুর্খামি, তাঁর স্মরনাপন্ন না হওয়া আরও বড় মুর্খামি। শকুনি মামা, ভীষ্ম পিতামহ  প্রতিপদে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভুমিকা এই যুদ্ধে, সবকিছু জেনেও না জানার অহঙ্কারিতা তাদের জীবনের কাল হল। পিতামহ এও বলেছিলেন, যদি এই যুদ্ধে একদিকে পাণ্ডব ও কৌরবের মিলিত শক্তি থাকে অন্যদিকে একা শ্রীকৃষ্ণ থাকেন তবু শ্রীকৃষ্ণই জিতবেন।

মহাভারতের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের গাণ্ডিব রথের সারথি হয়েছিলেন এবং সমগ্র যুদ্ধে তাঁর রথে চড়ে যুদ্ধপরিচালনা করেছিলেন। অর্জুন যে রথে চড়েছিলেন, সেটি সাধারণ রথ ছিল না। যে রথে ভগবান স্বয়ং চড়েন সেই রথ সাধারন হবে কী করে? অর্জুনের রথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ছিলেন হনুমান ও শেষনাগ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যুদ্ধ হবে ভয়াবহ। এই কারণেই তিনি প্রথম দিকে অর্জুনকে হনুমানজির কাছে রথের উপরে পতাকা নিয়ে বসার জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিলেন। অর্জুন হনুমানজিকে অনুরোধ করলেন এবং তিনি রাজি হলেন। এইভাবে হনুমান অর্জুনের রথে চড়েছিলেন। 

অন্যদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় অনন্ত শেষনাগ রথের চাকা ধরে ছিলেন এবং এইভাবে রথের উপরের ও নীচের অংশ সুরক্ষিত করেছিলেন। রথের মধ্যভাগ সুরক্ষিত করেছিলেন ভগবান স্বয়ং যাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের কোনও প্রভাব না পড়ে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন এই যুদ্ধে একের পর এক ভয়ানক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হলে, অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেছিলেন যে ভগবানকে প্রথমে রথ থেকে নামতে। কারন সেটাই ছিল নিয়ম, আগে নামবেন সারথি তারপর নামবেন আরোহী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা ভালোভাবেই জানতেন তবু তিনি বললেন, না অর্জুন, তুমি আগে নেমে যাও। ভগবানের কথা অনুসরন করে প্রথমে নামলেন অর্জুন এবং তাকে দূরে, আরও দূরে, আরও দূরে সরে যেতে বললেন। অর্জুন বহু দূরে সরে গেলে, নেমে দাঁড়ালেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। হনুমানজি এবং শেষনাগও অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। নামার সঙ্গে সঙ্গে রথে আগুন ধরে যায় ও কিছুক্ষণের মধ্যেই গাণ্ডিব রথ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

:- মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণী :-

১. “সমুদ্র হোক বা সংসার, যে ধর্মের নৌকা প্রস্তুত করে সে ঠিকই পার হয়ে যায়”- শ্রীকৃষ্ণ

২. “যে কেবল নিজের দুঃখকে আপন করে জীবন কাটায় সে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ব্যক্তি সমগ্র
সমাজের দুঃখ আপন করে জীবন কাটায় সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে”-শ্রীকৃষ্ণ।

৩.”অরন্যের লতা বৃক্ষের স্মরণ নেয়, তারপর সেই বৃক্ষকেই গ্রাস করে ফেলে।” -শ্রীকৃষ্ণ।

৪. “যে বস্তু সহজেই লাভ করা যায়, সে বস্তুর প্রতি মানুষের মূল্যবোধ থাকে না“-বিদূর

৫. “চরিত্রের পরীক্ষা তখনই হয়, যখন অপরিচিত কারো সংস্পর্শে আসা হয়”-ভীষ্ম

৬. “জয়ের জন্য বলের চেয়ে অধিক ছলের প্রয়োজন”-শকুনি

৭. “সুগন্ধ, দুর্গন্ধ ও মানুষের স্বভাব কখনো গোপন থাকে না”-শকুনি

৮. “যেভাবে বৃক্ষের মূল বৃক্ষকে খাদ্য যোগায়, সেভাবে মানুষের গর্ব মানুষকে শক্তি যোগায়”-শকুনি

৯. “পরিস্থিতিকে যদি নিজের অনূকুলে না আনতে পার,তবে তাকে শত্রুর প্রতিকুল বানিয়ে ফেলো”-শকুনি

১১. “যারা শত্রুর শত্রু হয়, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হয়”-শকুনি

১২. “যেখানে বল কাজ করে না সেখানে ছল কাজ করে”-শকুনি

 🙏 জয় শ্রীকৃষ্ণ 🙏

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.