এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব মহাভারতে অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা কখনও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কখনও বা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতপক্ষে অর্জুনের মাধ্যমে আমাদের মতো অধম, মূর্খ মানুষদের শিক্ষা দিয়েছেন।
► আরও পড়ুন: ৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী ||ইসকন
► আরও পড়ুন: শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির মাহাত্ম্য ও পায়ের নুপুরের মাহাত্ম্য কী?
► আরও পড়ুন: দেবতারা কেন স্বর্গে থাকেন আর দানবরা কেন পাতালে থাকেন ?
► আরও পড়ুন: মঙ্গলাচরণ ইসকন ( Iskcon Mangalacharan in Bengali)
► আরও পড়ুন: Shri Narasimha Kavacham Iskcon -শ্রীনৃসিংহ কবচম্, স্তব, নাম
–:- মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা –:-
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করে তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন তার সুন্দর বর্ণনা শ্রীমদ্ভগবতগীতার একাদশ অধ্যায় ‘বিশ্বরূপদর্শনযোগ’-এ বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং ভগবানের বিশ্বরূপ সাধারন মানুষের পক্ষে দর্শন করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না ভগবান দিব্যশক্তি প্রদান না করেন।
সেই বিশ্বরূপ দর্শন করে অর্জুন ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। অর্জুনের আর্তিতে ভগবান তাকে দর্শন করালেন চতুর্ভুজ রূপ, অবশেষে দ্বিভুজ শ্যামসুন্দর রূপে প্রকাশিত হলেন। ভগবান জানতেন, অন্যদের হৃদয়ে বিশ্বাস তৈরির জন্যই অর্জুন তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করতে চেয়েছিলেন। ভগবান আরও জানতেন, বিশ্বরূপ দর্শনের মাধ্যমে তিনি আমাদের মতো মূর্খদের প্রকৃত ভগবান কে অর্জুন তা চেনাবার চেষ্টা কলেন, কারন পরবর্তীকালে বহু ভণ্ড নিজেদের ভগবান বা ভগবানের অবতার বলে দাবী করবে।
এখন প্রশ্ন হল, ভগবান কেন অর্জুনকে এই বিশ্বরূপ দর্শন করালেন? কারন, অর্জুন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ সখা এবং বিশেষ জ্ঞানী পুরুষ। তিনি কুরুক্ষেত্রে ভগবানের চরনে নিজেকে সমর্পণ করেছেন, নিজেকে শুদ্ধ ভক্ত হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন তারপর ভগবান তাকে বিশ্বরূপ দর্শনের শক্তি দান করেছিলেন। তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণ জানতেন যে, অর্জুন তাঁর এই বিশ্বরূপ দর্শনে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলেন না, অর্জুন চেয়েছিলেন তাঁর মাধ্যমে পরবর্তীতে মানুষ যেন ভগবানকে বিশ্বাস করেন, ভগবানের মুখনিঃসৃত প্রতিটি উক্তিকে বিশ্বাস করেন, ভগবান নিরাকার নন, ভগবানের স্মরণেই আমাদের মতো অধমদের মুক্তি।
শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ অর্জুনের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে দান করলেন তা সকলের কাছে শিক্ষণীয় ও মঙ্গলময়। অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা হলঃ
অনন্ত ব্রহ্মান্ড সৃষ্ট হয়েছে মহাবিষ্ণু (করনোদকাশায়ী বিষ্ণু) থেকে, মহাবিষ্ণু থেকে সৃষ্ট গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু আবার প্রতিটি ব্রহ্মান্ড পরিচালনা করেন, আবার গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে সৃষ্ট ব্রহ্মা প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের জীব ও জড় জগত সৃষ্টি করেছেন এবং একইসঙ্গে গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে সৃষ্ট ক্ষীরোদাকশায়ী বিষ্ণু সেই জগত রক্ষনাবেক্ষন করেন ও সমস্ত জীবের হৃদয়ে পরমাত্মা রূপে বিরাজ করেন। পরমেশ্বর ভগবানের হিরণ্যগর্ভ নামক শক্তি থেকে প্রথম জীব রূপে ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়।
এই মহাবিষ্ণুর সৃষ্টি হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ থেকে, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতার নন; হলেন সমস্ত অবতারের উৎস বা অবতারী।
শ্রীমদ্ভগবতগীতার দশম অধ্যায় ‘বিভূতিযোগ’-এ ভগবান বলছেন
শ্লোক ২০
অহম্ আত্মা গুড়াকেশ সর্বভূত আশয়স্থিতঃ।
অহম্ আদিঃ চ মধ্যম্ চ ভূতানাম্ অন্তঃ এব চ ৷৷
অর্থাৎ, হে গুড়াকেশ (অর্জুন), আমিই সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই সমস্ত জীবের আদি, মধ্য ও অন্ত।
শ্লোক ২১
আদিত্যানাম্ অহম্ বিষ্ণুঃ জ্যোতিষাম্ রবিঃ অংশুমান্।
মরীচিঃ মরুতাম্ অস্মি নক্ষত্রাণাম্ অহম্ শশী ৷৷
অর্থাৎ, আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণময় সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র।
শ্লোক ২২
বেদানাম্ সামবেদঃ অস্মি দেবানাম্ অস্মি বাসবঃ।
ইন্দ্ৰিয়াণাম্ মনশ্চ অস্মি ভূতানাম্ অস্মি চেতনা ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, সমস্ত দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্ৰ, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা।
শ্লোক ২৩
রুদ্রাণাম্ শঙ্করশ্চ অস্মি বিত্তেশঃ যক্ষরক্ষসাম্।
বসূনাম্ পাবকশ্চ অস্মি মেরুঃ শিখরিণাম্ অহম্ ৷৷
অর্থাৎ, রুদ্রদের মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি ধনকুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের মধ্যে আমি মেরু।
শ্লোক ২৪
পুরোধসাম্ চ মুখ্যম্ মাম্ বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্।
সেনানীনাম্ অহম্ স্কন্দঃ সরসাম্ অস্মি সাগরঃ ৷৷
অর্থাৎ, হে পার্থ, পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদের মধ্যে আমি কার্তিকেয় এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর।
শ্লোক ২৫
মহর্ষীণাম্ ভৃগুঃ অহম্ গিরাম্ অস্মি একম্ অক্ষরম্।
যজ্ঞানাম্ জপযজ্ঞঃ অস্মি স্থাবরাণাম্ হিমালয়ঃ ৷৷
অর্থাৎ, মহর্ষিদের মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি দিব্য ওঁ-কার। যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়।
শ্লোক ২৬
অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাম্ দেবর্ষীণাম্ চ নারদঃ ৷
গন্ধর্বাণাম্ চিত্ররথঃ সিদ্ধানাম্ কপিলঃ মুনিঃ ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিলমুনি।
শ্লোক ২৭
উচ্চৈঃশ্রবসম্ অশ্বানাম্ বিদ্ধি মাম্ অমৃতোদ্ভবম্ ৷
ঐরাবতম্ গজেন্দ্রাণাম্ নরাণাম্ চ নরাধিপম্ ৷৷
অর্থাৎ, অশ্বদের মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে। শ্রেষ্ঠ হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি রাজা।
শ্লোক ২৮
আয়ুধানাম্ অহম্ বজ্রম্ ধেনূনাম্ অস্মি কামধুক্ ৷
প্রজনশ্চ অস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণাম্ অস্মি বাসুকি ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র; গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। সম্ভান উৎপাদনের কারণস্বরূপ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি।
শ্লোক ২৯
অনন্তশ্চ অস্মি নাগানাম্ বরুণঃ যাদসাম্ অহম্ ৷
পিতৃণাম অর্যমাশ্চ অস্মি যমঃ সংযমতাম্ অহম্ ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি বরুণ। পিতৃদের মধ্যে আমি অমা এবং দণ্ডদাতাদের মধ্যে আমি যম।
শ্লোক ৩০
প্ৰহ্লাদশ্চ অস্মি দৈত্যানাম্ কালঃ কলয়তাম্ অহম্ ৷
মৃগাণাম্শ্চ মৃগেন্দ্ৰঃ অহম্ বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্ ৷৷
অর্থাৎ, দৈত্যদের মধ্যে আমি ভক্তিমান প্রহ্লাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়।
শ্লোক ৩১
পবনঃ পবতাম্ অস্মি রামঃ শস্ত্রভূতাম্ অহম্ ৷
ঝষাণাম্ মকরশ্চ অস্মি স্রোতসাম্ অস্মি জাহ্নবী ৷৷
অর্থাৎ, পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা।
শ্লোক ৩২
সর্গাণাম্ আদিঃ অন্তশ্চ মধ্যম্ চ এব অহম্ অর্জুন ৷
অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাম্ বাদঃ প্রবদতাম্ অহম্ ৷৷
অর্থাৎ, হে অর্জুন, সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমি আদি, অন্ত ও মধ্য। সমস্ত বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ, জল্প ও বিতণ্ডার মধ্যে আমি সিদ্ধান্তবাদ।
তাৎপর্যঃ সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে সমগ্র জড় উপাদান প্রথম সৃষ্টি হয়। আগেই ব্যাখ্যা করেছি, মহাবিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু ও ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু এই জগতের সৃষ্টি ও পরিচালনা করে থাকেন এবং তারপর পুনরায় শিব তার প্রলয় সাধন করেন। ব্রহ্মা হচ্ছেন গৌণ সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের এই সমস্ত প্রতিনিধিরা পরমেশ্বর ভগবানের গুণাবতার। তাই তিনি সমগ্র সৃষ্টির আদি, মধ্য ও অন্ত।
ন্যায়শাস্ত্রে তার্কিকদের মধ্যে তর্কের বিভিন্ন স্তর আছে। বাদী ও প্রতিবাদীর যুক্তিতর্কের সমর্থনে সাক্ষ্য বা প্রামাণিক তথ্যকে বলা হয় জল্প। পরস্পরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টাকে বলা হয় বিতণ্ডা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে বলা হয় বাদ। এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক।
শ্লোক ৩৩
অক্ষরাণাম্ অকারঃ অস্মি সামাসিকস্য চ ৷
অহম্ এব অক্ষয়ঃ কালঃ ধাতা অহম্ বিশ্বতোমুখঃ ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমি অ-কার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব সমাস। সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্ৰহ্মা।
তাৎপর্যঃ সংস্কৃত বর্ণমালার প্রথম অক্ষর অ-কার বৈদিক সাহিত্যের প্রথম অক্ষর। অ-কার ছাড়া কোন শব্দের উচ্চারণ সম্ভব নয়; তাই অ-কার শব্দের সূত্রপাত।
সংস্কৃতে একাধিক শব্দের সমন্বয় হয়, যেমন রাম-কৃষ্ণ, একে বলা হয় দ্বন্দ্ব। রাম ও কৃষ্ণ এই দুটি শব্দেরই ছন্দরূপ এক রকম, তাই তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলা হয়।
সমস্ত বিনাশকারীদের মধ্যে কালই চরম, কারণ কালের প্রভাবে সব কিছুরই বিনাশ হয়৷ কাল শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি; কালক্রমে এক মহা অগ্নি-প্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে।
যে সমস্ত জীবেরা সৃষ্টিকার্যে নিযুক্ত, তাদের মধ্যে চতুর্মুখ ব্ৰহ্মাই প্রধান। তাই তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি।
শ্লোক ৩৪
মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চ অহম্ উদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্ ৷
কীর্তিঃ শ্ৰীঃ বাক্ চ নারীণাম্ স্মৃতিঃ মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভবিষ্যতের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব। নারীদের মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা।
তাৎপর্যঃ জন্মের পর থেকে প্রতি মুহূর্তেই প্রতিটি প্রাণী তথা মানুষকে মৃত্যু গ্রাস করে চলেছে। জীবনের শেষ আঘাতকে মৃত্যু বলে সম্বোধন করা হয়। এই মৃত্যুই শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা পরিচালিত।
জন্মানোর পর প্রতিটি প্রাণীর বিকাশ ঘটে আর এই বিকাশ ছয়টি মুখ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটে — তাদের জন্ম হয়, তাদের বৃদ্ধি হয়, কিছুকালের জন্য তারা স্থায়ী হয়, তারা প্রজনন করে, তাদের হ্রাস হয় এবং অবশেষে তাদের বিনাশ হয়। এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে গর্ভ থেকে সন্তানের প্রসব এবং তা শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তি। প্রথম এই উদ্ভবটিই ভবিষ্যতের সমস্ত কার্যকলাপের উৎস।
এখানে ভগবান সাতটি ঐশ্বর্যের কথা উল্লেখ করেছেন — কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা — সবই স্ত্রীলিঙ্গবাচক হিসাবে বিবেচিত হয়। কোন ব্যক্তি যখন এই ঐশ্বর্যগুলির সব কয়টি বা অল্প কয়েকটিরও অধিকারী হন, তখন তিনি মহিমান্বিত হন। কোন মানুষ যখন ধার্মিক ব্যক্তিরূপে প্রসিদ্ধ হন, তখন তা তাঁকে মহিমান্বিত করে। সংস্কৃত শ্রেষ্ঠ ভাষা, তাই তা অতি মহিমান্বিত। কোন কিছু পাঠ করার পরে কেউ যখন তা মনে রাখতে পারে, সেই বিশেষ গুণকে বলা হয় স্মৃতি। আর বিভিন্ন বিষয়ের উপর বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করে সেগুলিকে হৃদয়ঙ্গম করা এবং প্রয়োজনে প্রয়োগ করার সামর্থ্যকে বলা হয় মেধা এবং এটিও একটি বিভৃতি। যে সামর্থ্যের দ্বারা অস্থিরতাকে দমন করা যায়, তাকে বলা হয় ধৃতি। আর কেউ যখন সম্পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বিনয়ী ও নম্র থাকেন এবং সুখ ও দুঃখে ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হন, তখন সেই বিভূতিকে বলা হয় ক্ষমা।
শ্লোক ৩৫
বৃহৎসাম তথা সাম্নাম্ গায়ত্রী ছন্দসাম্ অহম্ ৷
মাসানাম্ মার্গশীর্ষঃ অহম্ ঋতূনাম্ কুসুমাকরঃ ৷৷
অর্থাৎ, সামবেদের গীতসমূহের মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং সমস্ত ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী। মাসসমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত।
তাৎপর্যঃ ভগবান পূর্বেই বলেছেন যে, সমস্ত বেদের মধ্যে তিনি সামবেদ। সামবেদ হল বিভিন্ন দেবতাদের দ্বারা গীত অপূর্ব সুন্দর সঙ্গীতসমূহ। এই সঙ্গীতগুলির এক একটিকে বলা হয় বৃহৎসাম, যার সুর অপূর্ব মাধুর্যমণ্ডিত এবং যা মধ্যরাত্রে গীত হয়ে থাকে।
সংস্কৃত ভাষায় কবিতাকে ছন্দোবদ্ধ করার কতকগুলি বিশেষ নিয়ম আছে; এবং সেখানে ছন্দ ও মাত্রার সঠিক ব্যবহার করা হয়। সুসংবদ্ধ কবিতার মধ্যে গায়ত্রী মন্ত্র শ্রেষ্ঠ, যা যোগ্যতাসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা গেয়ে থাকেন। শ্রীমদ্ভাগবতে গায়ত্রী মন্ত্রের উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে বিশেষতঃ ভগবানকে উপলব্ধি করা যায়, তাই তা ভগবানের প্রতীক। প্রধানতঃ অধ্যাত্মমার্গে উন্নত মানুষ যদি এই মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেন, তবে তিনি ভগবদ্ধামে প্রবেশ করতে পারেন।
সমস্ত মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ সময় বলে গণ্য করা হয়, কারণ ভারতবর্ষে এই সময়ে ক্ষেতের ফসল সংগ্রহ করা হয় এবং জনসাধারণ এই সময় আনন্দ অনুভব করেন।
অবশ্যই বসন্ত এমনই একটি ঋতু যে, সমগ্র জগতে সকলেই তা পছন্দ করে; কারণ বসন্ত ঋতু নাতিশীতোষ্ণ এবং এই সময় গাছপালা ফুলে ও ফলে শোভিত হয়। বসন্তকালে শ্রীকৃষ্ণের লীলাসমূহের স্মরণ করে অনেক মহোৎসব উদযাপিত হয়, তাই বসন্ত ঋতুকে সর্বাপেক্ষা আনন্দোজ্জ্বল ঋতু বলে গণ্য করা হয় এবং এই ঋতুরাজ বসন্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি।
শ্লোক ৩৬
দ্যূতম্ ছলয়তাম্ অস্মি তেজঃ তেজস্বিনাম্ অহম্ ৷
জয়ঃ অস্মি ব্যবসায়ঃ অস্মি সত্ত্বম্ সত্ববতাম্ অহম্ ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল।
তাৎপর্যঃ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে নানা রকম প্রবঞ্চনাকারী আছে। সব রকম প্রবঞ্চনার মধ্যে দ্যূতক্রীড়া (পাশাখেলা) সর্বোপরি, তাই তা শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। পরমেশ্বররূপে শ্রীকৃষ্ণ যদি কাউকে প্রতারণা করতে চান, তা হলে কেউই তাঁর সে ছলনা এড়াতে পারে না।
বিজয়ীদের মধ্যে তিনি জয়। তিনি তেজস্বীর তেজ। উদ্যমী ও অধ্যবসায়ীদের মধ্যে তিনিই সর্বোৎকৃষ্ট উদ্যমী ও অধ্যবসায়ী। দুঃসাহসীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ দুঃসাহসী এবং বলবানদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ বলশালী। শ্রীকৃষ্ণ যখন এই জগতে প্রকট ছিলেন, তখন তাঁর মতো শক্তিশালী আর কেউই ছিল না। এমনকি তাঁর শৈশবেই তিনি গিরি-গোবর্ধন পর্বত তুলেছিলেন, বহু রাক্ষসকে হত্যা করেছেন। তাঁর মতো প্রবঞ্চক কেউ নেই, তাঁর মতো তেজস্বী কেউ নেই, তাঁর মতো বিজয়ী কেউ নেই, তাঁর মতো উদ্যমী কেউ নেই এবং তাঁর মতো বলবানও কেউ নেই। কেবল কিছু বিষয়ে নয়, ভগবান সব ব্যাপারেই শ্রেষ্ঠ ও মহান।
শ্লোক ৩৭
বৃষ্ণীনাম্ বাসুদেবঃ অস্মি পাণ্ডবানাম্ ধনঞ্জয়ঃ ৷
মুনীনাম্ অপি অহম্ ব্যাসঃ কবীনাম্ উশনা কবিঃ ৷৷
অর্থাৎ, বৃষ্ণিদের মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে আমি অর্জুন। মুনিদের মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি উশনা।
তাৎপর্যঃ এখানে বুঝতে হবে যে, ভগবদ্গীতার এই শ্লোকে যে বাসুদেবের কথা বলা হয়েছে, তিনি বলদেব বা বলরাম। তিনি শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ প্রকাশ (সরাসরি উৎস হয়েছেন), তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন। এই বলরাম থেকে সমস্ত অবতারের উৎপত্তি, বলরামের উৎপত্তি শ্রীকৃষ্ণ থেকে। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ হলেন সকল উৎসের উৎস অর্থাৎ আদি উৎস।
পাণ্ডুপুত্রদের মধ্যে অর্জুন ধনঞ্জয়রূপে বিখ্যাত। তিনি নরশ্রেষ্ঠ, তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি।
মুনি অথবা বৈদিক জ্ঞানে পারদর্শী পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রীল ব্যাসদেব সর্বশ্রেষ্ঠ, কারণ এই কলিযুগের জনসাধারণকে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করার মানসে তিনি বেদকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা তাঁর রচনা। আবার ব্যাসদেবকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতারও বলা হয়; তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি।
কবি তাঁদের বলা হয়, যাঁরা যে কোন বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। কবিদের মধ্যে দৈত্যদের কুলগুরু উশনা বা শুক্রাচার্য শ্রেষ্ঠ। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। এভাবে শুক্রাচার্য শ্রীকৃষ্ণের বিভূতির আর একজন প্রতিনিধি।
শ্লোক ৩৮
দণ্ডঃ দময়তাম্ অস্মি নীতিঃ অস্মি জিগীষতাম্ ৷
মৌনম্ চ এব অস্মি গুহ্যানাম্ জ্ঞানম্ জ্ঞানবতাম্ অহম্ ৷৷
অর্থাৎ, দমনকারীদের মধ্যে আমি দণ্ড এবং জয় অভিলাষকারীদের মধ্যে আমি নীতি। গোপনীয় বিষয়সমূহের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমি জ্ঞান।
তাৎপর্যঃ নানা রকমের দমনকারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে দুষ্কৃতিদের দমনকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুষ্কৃতিদের শাসন করার যে দণ্ড, তা শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক।
মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে বিজয়লাভের প্রচেষ্টা করে, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় নৈতিকতা।
শ্রবণ, মনন ও ধ্যান আদি গুহ্য কার্যকলাপের মধ্যে মৌনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মৌনতার মাধ্যমে অতি দ্রুত পারমার্থিক উন্নতিলাভ করা যায়।
জ্ঞানী তাঁকেই বলা হয়, যিনি জড় ও চেতনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন, অর্থাৎ যিনি ভগবানের উৎকষ্টা ও নিকৃষ্টা প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন। এই জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং।
শ্লোক ৩৯
যৎ চ অপি সর্বভূতানাম্ বীজম্ তৎ অহম্ অর্জুন ৷
ন তৎ অস্তি বিনা যৎ স্যাৎ ময়া ভূতম্ চরাচরম্ ৷৷
অর্থাৎ, হে অর্জুন, আমিই সর্বভূতের বীজস্বরূপ, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোন বস্তুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
তাৎপর্যঃ সব কিছুরই উৎপত্তি শ্রীকৃষ্ণ থেকে। শ্রীকৃষ্ণের শক্তি বিনা কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না; তাই তাঁকে বলা হয় সর্বশক্তিমান। তাঁর শক্তি বিনা স্থাবর ও জঙ্গম কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণের শক্তিতে থাকে না কোনও মায়া, অর্থাৎ ‘যা নয়।”
ভগবান অর্জুনকে বলেছেন (শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ৬/ শ্লোক ৪৭) —
যোগিনাম্ অপি সর্বেষাম্ মদগতেন অন্তরাত্মনা ৷
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যঃ মাম্ সঃ মে যুক্ততমঃ মতঃ ৷৷
অর্থাৎ, সমস্ত যোগীদের মধ্যে যে গভীর শ্রদ্ধা সহকারে মদ্গতচিত্তে নিজের অন্তরাত্মায় আমাকে চিন্তা করে এবং আমার অপ্রাকৃত সেবায় নিয়োজিত থাকে, সেই ব্যক্তি যোগসাধনায় অন্তরঙ্গভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত এবং সেই যোগীশ্রেষ্ঠ। সেটিই আমার অভিমত।” (ভঃ গীঃ ৬/৪৭)
সুতরাং, যিনি সব সময় ভগবদ্ভাবনায় মগ্ন, তিনিই যোগীশ্রেষ্ঠ; তিনি পরম জ্ঞানী এবং একই সঙ্গে সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্তও। ভগবান অর্জুনকে আরও বলেছেন যে, ক্ষত্রিয় হবার ফলে তিনি যুদ্ধ ত্যাগ করতে পারেন না; কিন্তু তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে যুদ্ধ করেন, তা হলে অন্তকালে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে সমর্থ হবেন। তাই আমাদের সর্বতোভাবে শরণাগত হয়ে ভগবানের দিব্য প্রেমময়ী সেবায় নিয়োজিত হতে হবে।
ভগবান অর্জুনকে বর্ণনা করছেন (শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ৮/ শ্লোক ৬) —
যম্ যম্ বা অপি স্মরন্ ভাবম্ ত্যজতি অন্তে কলেবরম্ ৷
তম্ তম্ এব এতি কৌন্তেয় সদা তৎ ভাব ভাবিতঃ ৷৷
অর্থাৎ, যে যেভাবে ভাবিত হয়ে দেহত্যাগ করে, সে নিঃসন্দেহে সেই রকম ভাবযুক্ত দেহপ্রাপ্ত হয়। (ভঃ গীঃ ৮/৬)
তারপর ভগবান অর্জুনকে ব্যাখ্যা করেছেন (শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ৮/ শ্লোক ৮) —
অভ্যাস যোগযুক্তেন চেতসা ন অন্যগামিনা ৷
পরমম্ পুরুষম্ দিব্যম্ যাতি পার্থ অনুচিস্তয়ন ৷৷
অর্থাৎ, অভ্যাসের দ্বারা যে সর্বদা ভগবানরূপে আমার ধ্যানে মগ্ন, বিপথগামী না হয়ে যার মন সর্বদা আমাকে স্মরণ করে, হে পার্থ, সে নিঃসন্দেহে আমার কাছে ফিরে আসবে। (ভঃ গীঃ ৮/৮)
ভগবান অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবতগীতার অন্তিম অধ্যায়ে বলছেন —
(শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ১৮/ শ্লোক ৫৫)
ভক্ত্যা মাম্ অভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ ৷
ততঃ মাম্ তত্ত্বতঃ জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্ ৷৷
অর্থাৎ, শুদ্ধভক্তির দ্বারাই কেবল যথার্থরূপে কেউ স্বরূপতঃ আমাকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে যথার্থরূপে (তত্ত্বতঃ) জেনে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।
কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, তিনিই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে তত্ত্বতঃ জানতে পারেন। এই জ্ঞানলাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কোনোরূপ সাহায্য করতে পারে না।
(শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ১৮/ শ্লোক ৬১) —
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাম্ হৃদ্দেশে অর্জুন তিষ্ঠতি ৷
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্র আরূঢ়ানি মায়য়া ৷৷
অর্থাৎ, হে অর্জুন, পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত জীবের হৃদয়ে অবস্থান করেন (পরমাত্মা রূপে) এবং তিনি তাদের দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান।
(শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ১৮/ শ্লোক ৬৫) —
মন্মনাঃ ভব মদ্ভক্তঃ মদ্যাজী মাম্ নমস্কুরু ৷
মাম্ এব এষ্যসি সত্যম্ তে প্রতিজানে প্রিয়ঃ অসি মে ৷৷
অর্থাৎ, হে অর্জুন, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় তাই আমি তোমার কাছে সত্যি প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি সর্বদা আমার স্মরণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে।
ভগবান আরও বলছেন (শ্রীমদ্ভগবতগীতা অধ্যায় ১৮/ শ্লোক ৬৬)—
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মাম্ একম্ শরণম্ ব্রজ।
অহম্ ত্বাম্ সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ৷৷
অর্থাৎ, সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।
একম্ শাস্ত্রম্ দেবকীপুত্রগীতম্
একো দেবো দেবকীপুত্র এব।
একো মন্ত্রস্তস্য নামানি যানি
কর্মাপ্যেকম্ তস্য দেবস্য সেবা ৷
— (গীতা-মাহাত্ম্য ৭)
বর্তমান জগতে মানুষ আকুলভাবে আকাঙ্ক্ষা করছে একটি শাস্ত্রের, একক ভগবানের, একটি ধর্মের এবং একটি বৃত্তির। তাই
একম্ শাস্ত্রম্ দেবকীপুত্রগীত — সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য সেই একক শাস্ত্র হোক ভগবদ্গীতা।
একো দেবো দেবকীপুত্র এব—সমগ্র বিশ্বচরাচরের একক ভগবান হোন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
একো মন্ত্ৰস্তস্য নামানি — একক মন্ত্র, একক প্রার্থনা, একক স্তোত্র হোক তাঁর নামকীর্তন
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।
আর কর্মাপেকম্ তস্য দেবস্য সেবা — সমস্ত মানুষের একটিই বৃত্তি হোক – পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা।
জয় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়
–:- মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা –:-
করুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে অর্জুন তাঁর সখা শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন, “প্রভু আমায় গঙ্গা স্নানে নিয়ে যাবে? আমি এতো এতো আত্মীয়স্বজনদের, আপন জনকে মারলাম, এতো পাপ করলাম। গঙ্গা স্নানে সকল পাপ মুক্ত হয়ে যাবে।”
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “আমি তোমার রথের সারথী। তুমি আমায় যেখানে নিয়ে যেতে বলবে সেখানেই নিয়ে যাবো।”
গঙ্গা তীরে এসে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “সখা তুমি রথের উপর বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।”
এই বলে রথ থেকে নেমে কৃষ্ণ একটু দূরে গাছের পিছনে আড়াল হলেন। অর্জুনের একটি মহৎগুণ ছিলো তিনি পশুপাখিদের কথা বুঝতে পারতেন। এমন সময় অর্জুন দেখলেন দুজন লোক একটি মৃতদেহকে কাঁধে করে নিয়ে ‘বলহরি! হরিবোল!’ ‘বলহরি! হরিবোল!’ বলতে বলতে শ্মশানে নিয়ে এলো। তারা মড়াটিকে মাটিতে রেখে একটি চিতা সাজালো। এমন সময় একজন অপরজনকে বলছে আগুন তো আনি নি। কিন্তু তারা একা ভয়ে মড়ার কাছে কেউ থাকতে চাইছে না। তাই তারা দুজনেই আগুন আনতে বাড়ি চলে গেলো। অর্জুন একটু দূর থেকে রথের উপর বসে বসে সবই লক্ষ্য করছেন।
এমন সময় একটি জীর্ণ শীর্ণ রোগা শৃগাল মড়ার কাছে এসে মড়ার কান দুটোকে শুকছে আর মাথা নাড়াচ্ছে। মড়ার মুখ শুকছে আর মাথা নাড়াচ্ছে, মড়ার হাত দুটোকে, পা দুটোকে শুকছে আর মাথা নাড়াচ্ছে। শেষে মড়াটিকে ফেলে রেখে জীর্ণ শীর্ণ শৃগালটি চলে যাচ্ছে।
এটা দেখে অন্য একটি মোটা সোটা শৃগাল বললো, “কিরে! মড়াটাকে না খেয়ে চলে যাচ্ছিস যে?”
জীর্ণ শৃগালটি বললো, “খেতে হয় তুই খা! আমি অখাদ্য কুখাদ্য খাই না।”
মোটা শৃগালটি বললো, “তুই এতো খাবার বিচার করিস বলেই তো, তোর এই জীর্ণ শীর্ণ অবস্থা! চল মড়াটির পা দুটোকে খাই।”
জীর্ণ শৃগালটি বললো, “ঐ চরণ দুটি কোনো দিন হরিমন্দিরে প্রবেশ করেনি। আমি খেতে পারবো না।”
মোটা শৃগালটি বললো, “তাহলে চল ঐ মড়াটির হাত দুটিকে খাই।”
জীর্ণ শৃগালটি বলল, “ঐ হাত দিয়ে কোনো দিন সাধুগুরু বৈষ্ণবের সেবা দেয়নি। আমি খেতে পারবো না।”
মোটা শৃগালটি বললো, “চল্ তাহলে কান দুটিকে খাই।”
জীর্ণ শৃগালটি বলল, “ঐ কান দুটি কোনো দিন হরিনাম শ্রবণ করেনি। আমি খেতে পারবো না।”
মোটা শৃগালটি বলল, “চল্ তাহলে জীহ্বাটিকে খাই।”
জীর্ণ শৃগালটি বললো, “ঐ জীহ্বা দিয়ে কোনো দিন হরিনাম উচ্চারণ করেনি। আমি খেতে পারবো না।”
মোটা শৃগালটি তখন বলল, “মড়াটির কিছুই যখন খাবি না, চল্ তাহলে ঐ রথের উপর যে মানুষটি বসে আছে তাকে গিয়ে খাই।”
কথাটি শোনামাত্র অর্জুন বেশ অবাক হলেন। বলে কি?
জীর্ণ শৃগালটি বলল, ” ও তো আরো মূর্খ রে! যাঁর চরণ থেকে গঙ্গার উৎপত্তি তাঁকে কিনা বলে গঙ্গা স্নানে নিয়ে যেতে। ও তো আরো মূর্খ! যিনি করেছেন জগত সৃষ্টি, তাঁকে ভাবে সারথি। দূর! ওকে কি খাওয়া যায়?”
এতোক্ষণ অর্জুন দুই শৃগালের কথা শুনে চৈতন্য হলো। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। একটু পরে কৃষ্ণ বেরিয়ে রথের কাছে এলে তাঁর চরণ দুটিকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “প্রভু আমায় ক্ষমা করো।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শেষ শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই লীলা করেছিলেন। আর এই লীলাই শ্রীকৃষ্ণকে সাহায্য করেছিলো বাবা মহেশ্বর, নন্দী, ভৃঙ্গী আর যোগমায়া। শ্মশানে মড়াটিই ছিলেন মহেশ্বর। মড়াটিকে যারা নিয়ে এসেছিলো, তারা নন্দী আর ভৃঙ্গী। আর দুই শৃগাল ছিলো যোগমায়া।
–:- জেনে রেখো কিছু কথা, কৃষ্ণ বিনা জীবন বৃথা –:-
কোনকালে অবশ্যই আমরা কৃষ্ণ সেবা বর্জন করে সুখ ভোগের প্রতি মনোনিবেশ করেছিলাম, তার ফলে মায়ার দ্বারা দুঃখময় জগতে পতিত হতে হয়েছি।
● জড়জাগতিক দুঃখ হচ্ছে-দেহ ও মন জাত দুঃখ। যে জড় দেহটি ধারণ করে আমরা রয়েছি সেই দেহটি নানা ব্যধি, ব্যাথা বেদনার আঁতুড় ঘর। যার ফলে আমরা দুঃখ পাই। এরপর আছে মনজাত দুঃখ যেমন, দৈহিক সম্বন্ধে সম্বন্ধিত আত্মীয় স্বজনের বিচ্ছদ, মৃত্যুর কারণে দুঃখ, প্রিয় বস্তু হারানো দুঃখ, অপ্রিয় বস্তুর সংযোগে দুঃখ প্রভৃতি।
● আধিভৌতিক দুঃখ হচ্ছে-অন্য জীবের দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখ। যেমন, বিষাক্ত পোকামাকড় বা জীব জন্তুর দংশন, চোর ডাকাতের উৎপাত, প্রতারকের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি আমাদের কষ্ট দেয় কিংবা দুঃখ দেয়।
● আধিদৈবিক দুঃখ হচ্ছে-দেবতাদের দ্বারা সংঘটিত যে দুঃখ। ভুকম্প, ঝড়, প্রবল বৃষ্টি, বন্যা, মহামারী, প্রচন্ড গরম, কনকনে ঠান্ডা, অগ্নিকান্ড ইত্যাদিজনিত দুঃখ।
প্রত্যেকেই কমবেশী এ সমস্ত দুঃখে মর্মাহত হয়। এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেতে হলে সবাইকে শুদ্ধ ভক্তি সহকারে কৃষ্ণভাবনাময় হতে হবে, সাথে
• চার নিয়ম পালন করতে হবে।
• প্রতিদিন কমপক্ষে ১৬ মালা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে হবে।
• প্রতিদিন কৃষ্ণপ্রসাদ খেতে হবে।
• সাধু সঙ্গ করতে হবে।
১. সর্ব প্রকার আমিষ আহার বর্জন / জীব হিংসা বর্জন। যেমন: মাছ, মাংস, ডিম, পেয়াজ, রসূন, মুসূর ডাল ইত্যাদি । (বর্জন না করলে দয়া নষ্ট হয়)
২. সর্ব প্রকার নেশা বর্জন । যেমন: চা, কফি, পান, বিড়ি, সিগারেট, আফিম, ভাং, হেরোইন, মদ, গাঁজা ইত্যাদি । (বর্জন না করলে তপস্যা নষ্ট হয়)
৩. সর্ব প্রকার দূত ক্রীড়া বর্জন । যেমন: তাস, পাশা, জুয়া, বাজি খেলা ইত্যাদি। (বর্জন না করলে সততা নষ্ট হয়)
৪. অবৈধ সঙ্গ/যৌনসঙ্গ বর্জন। (বর্জন না করলে শুচিতা নষ্ট হয়)
–:- ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ –:-
শ্রীভগবান অজ বা জন্মরহিত হয়েও ভক্তদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন নাথ ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্যে যুগে যুগে নবরুপে লীলা করেন। এ লীলার প্রয়োজনে তিনি আপন স্বরুপে যোগমায়ার দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদন করেন। সাধারণ মানুষ তাঁর প্রকৃত রুপ জানতে পারেনা।
শ্রীভগবান যখন সাধারণ মানুষের মতো লীলা বিলাস করেন, তখন মূঢ়রা তা বুঝতে পারেনা। ভক্তদের আনন্দ দেয়ার জন্য শ্রীভগবানের এ রূপ নিত্য বর্ধিত হয়। কিন্ত অভক্তদের কাছে এ রূপ অতি ভয়ংকর।
শ্রীকৃষ্ণ অখিলাত্মা, জ্ঞানীর কাছে তিনি ব্রহ্মা, যোগীর নিকট পরমাত্মা আর ভক্তদের কাছে তিনিই ভগবান। যিনি অদ্বয় জ্ঞান এবং ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও ভগবান, এই ত্রিবিধ শব্দে কথিত হন। তত্ত্ববিদগণ তাঁকেই পরমতত্ত্ব বলেন, জ্ঞানী সাধকের কাছে তিনিই ব্রহ্ম বা ভূমা। অর্থাৎ তিনি বৃহৎতম, তিনি নির্গুন ও নিরাকার, তিনি সর্বব্যাপী ও মর্ত্যের আগে আমরা ছিলাম অজ্ঞান বিমূঢ়, আত্মজ্ঞান বঞ্চিত। দৃষ্ট ও অদৃষ্ট অর্থাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বিষয় বাসনায় চিত্ত আকৃষ্ট থাকায়, আমরা আত্মা ও অনাত্মায় বিবেক বর্জিত।
আবার, যোগীদের কাছে তিনি পরমাত্মা স্বরূপ, তিনি সকলের হৃদয়ে পরমাত্মা রুপে অবস্থান করেন, সবার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি হৃদ্দেশে অবস্থিত থেকেই আমাদেরকে তাঁর সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য অবিরাম আকর্ষণ করছেন।
অন্যদিকে, ভক্তদের কাছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রসময়, লীলাময় নিখিল কল্যাণ গুনের আকার, মাধুর্য্যঘণ। প্রেমঘন ভগবান ভক্ত তাঁর সকল চিন্তা, সাধণ, ভজন, যজ্ঞাদি এবং অন্তরের ভক্তি, বিনম্র শ্রদ্ধা সবকিছুই শ্রীভগবান চরণে সমর্পণ করেন। তখনই ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ব্যবধান অন্তর্হিত হয়। ভগবানের খুশির জন্যই ভক্ত তার কর্মসাধন করে, ভগবানের খুশির জন্যই ভক্ত নিজেকে উজাড় করে ধণ্য হন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের হৃদয়কে লুন্ঠন করার জন্য সদা উৎসুক ভাবে অপেক্ষা করেন। তিনি মাধুর্য্যমন্ডিত রসিক শেখর। তাঁর চারটি মাধুর্য্য হলো, রুপ মাধুর্য্য, বেনু মাধুর্য্য, প্রেম মাধুর্য্য ও লীলা মাধুর্য্য। এ চার মাধুর্য্যে নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র অনন্য সাধারণ। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, জন্ম হীনের জন্ম, দিব্যজন্ম। তাঁর রুপ, অরুপের রুপ। শাশ্বত নিত্যরূপ, নবকিশোর নটবর। সেই রূপেই তিনি জগৎকে ভুলিয়ে রাখেন। তাইতো আমরা তাঁর গুনগান করি সদাসর্বদা। ভগবান করুণাময়, তিনিই তাঁর স্মরণের উপায় বলে গেছেন কলির মানুষদেরকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে। অহর্নিশি হরিনাম জপকীর্ত্তনেই এ যুগের জীবের একমাত্র মুক্তি।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে,
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।