এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব সনাতন ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্ম-এর মধ্যে সম্পর্ক কী?
সনাতন ধর্ম বিশ্বের আদি ধর্ম । সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “ধর্মোমূল হি ভগবান…...” অর্থাৎ এই ধর্মের মূল বা প্রবর্তক হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর। তাই এটাই হচ্ছে প্রকৃত ঈশ্বর নির্দেশিত ধর্ম। এই ধর্ম মুনি-ঋষিদের সাধনালব্ধ সমন্বিত জ্ঞানের ফল। কালের অগ্রগতির সাথে সাথে যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মৌলিক তত্ত্বের কোন পরিবর্তন ছাড়াই এটি ক্রমশঃ বিকশিত হচ্ছে।
‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি পারসিকদের দ্বারা। পারস্য ছিল বর্তমান ইরানের প্রাচীন নাম। পারস্যের অধিবাসীরাই হলো পারসিক। তারা ছিল অগ্নি উপাসক আর্য । তারা ‘স’ এর স্থলে ‘হ’ উচ্চারণ করতো। তারা উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশের সময় সিন্ধু নদের তীরে বসবাসকারীদের বলতো ‘হিন্দু’ । এ থেকে ভারতবর্ষেরও আর একটি নাম হয় ‘হিন্দুস্থান’ । তারা পাঁচ শত বছর ভারতবর্ষ শাসন করে। তখনো ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয় নাই। কাজেই যারা বলে হিন্দু নামটি মুসলমানদের দেওয়া তা ঠিক নয়।
এই হিন্দুদের জীবন প্রক্রিয়া প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়া । এইভাবে নানা নিয়ম এদের জীবনে স্থান নেয়। কোন বিশেষ ব্যক্তি এসব নিয়মের প্রবর্তক নয়। তাই এই জীবন প্রক্রিয়াকে সনাতন প্রক্রিয়া বলে। হিন্দুরা এই সনাতন প্রক্রিয়া ধারন করে বলে তাদের ধর্ম সনাতন।
বৈষম্যমূলক ট্যাক্স জিজিয়া কর প্রয়োগ পরবর্তী ভারতবর্ষে বসবাসকারী উনিশ শতকের হিন্দুরা হিন্দু ধর্মকে সনাতন ধর্মের সাথে জড়িত বলে মনে করে । ভারতের ভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মতাদর্শ নিয়েই জন্ম নিয়েছে হিন্দু ধর্ম। হিন্দুদের ধর্ম তাই ‘হিন্দু’ ও ‘সনাতন’ এই দুই নামেই পরিচিত।
জয় সনাতন হিন্দু ধর্মের জয়। হরে কৃষ্ণ ।।
-: শ্রীবৈষ্ণব প্রণাম :-
বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ।
পতিতানাম্ পাবনেভ্যো বৈষ্ণবেভ্যো নমো নমঃ ॥
অনুবাদঃ
আমি ভগবানের সমস্ত বৈষ্ণব ভক্তবৃন্দদের চরণ-কমলে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি, যাঁরা বাঞ্ছাকল্পতরুর মতো সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ (মনোবাঞ্ছাপূর্ণ) করতে পারেন এবং আমাদের মতো অধোগতিসম্পন্ন আত্মাদের প্রতি অতল সমুদ্রের ন্যায় কৃপা প্রদান করে উদ্ধার করতে পারেন।
► আরো পড়ুন: মঙ্গলাচরণ ইসকন ( Iskcon Mangalacharan in Bengali)
সৃষ্টির আদিতে নারায়ণের নাভী থেকে উত্থিত পদ্ম থেকে ব্রহ্মা আবির্ভূত হন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হতে বৈদিক মন্ত্র ওঁ ধ্বনি সর্ব প্রথম তাঁর কর্নে প্রবিষ্ট হয় অর্থাৎ বেদের আবির্ভাব এবং ব্রহ্মার জন্ম একই সঙ্গে হয়। এই ভাবে ব্রহ্মা পূর্ন বৈদিক জ্ঞান লাভ করেন। ব্রহ্মা থেকেই সমস্ত জগতে এই দিব্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। তাই ব্রহ্মা হলেন আদি গুরু। মুনি ঋষিরা ধ্যানের মাধ্যমে বেদের এই জ্ঞান অনুধাবন করেন। এইজন্য তাঁদেরকে মন্ত্রদ্রষ্টা বলা হয়।
বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু ধর্মের এক অন্যতম আদি শাখা। বৈষ্ণব ধর্মের মূল আরাধ্য ভগবান হলেন বিষ্ণু। এই বিষ্ণুর যারা সেবক বা ভক্ত, তারাই হলেন বৈষ্ণব। বৈষ্ণবধর্মে তখন বিষ্ণুকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মা থেকে প্রথম প্রজাপতিদের এবং কুমারদের সৃষ্টি হল। তারপরে নারদমুনি, এই নারদমুনি হলেন শুদ্ধ বৈষ্ণব এবং সমস্ত জীবের গুরুদেব। নারদমুনির কৃপাতেই সমস্ত জীব বৈষ্ণব হওয়ার শিক্ষা লাভ করেছেন। অতএব সৃষ্টির আদিতেই বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভব।
শ্রীমদ্ভাগবতে দেখা যায় নারদমুনির সান্নিধ্যে এসে অনেকেই বিষ্ণুভক্তি লাভ করেছেন। যেমন প্রহ্লাদ মহারাজ, ধ্র ুব মহারাজ, সবাই নারদমুনির কাছ থেকে বিষ্ণুভক্তি লাভ করেন। নারদমুনি যে বিষ্ণুভক্তি দান করেন, সেটা হচ্ছে শুদ্ধ বৈষ্ণব ধর্ম।
বৈষ্ণব ঐতিহ্যের ইতিহাস দেখলে তাই দেখা যায় সৃষ্টির শুরু থেকেই এই বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান। আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, এই বৈষ্ণবধর্ম অনাদি। এই জগৎ সৃষ্টির আগেও এই ধর্ম বর্তমান ছিল। চিন্ময়-জগতে সকলেই বৈষ্ণব, তাহলে দেখতে পাই এই জগৎ সৃষ্টির পূর্বেও বৈষ্ণবধর্ম ছিল।
চৈতন্যদেব ভক্তির মতাদর্শের সঙ্গে পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা হলেন চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী । গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে মূল হলো রাধাকৃষ্ণ এবং হরিনাম সংকীর্তন।
সমস্ত ধর্ম আচরণের মধ্যে ভক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। আবার ভক্তির মধ্যে শুদ্ধভক্তিই শ্রেষ্ঠ। শুদ্ধভক্তির মধ্যে প্রেমভক্তি শ্রেষ্ঠ। ভক্তিপথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রদর্শিত যে প্রেমভক্তি সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ।
কলিযুগে মহাপ্রভু সেই প্রেমভক্তি দয়া করে আমাদের প্রদান করেছেন। ধর্মের পথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই দানটি কেন সর্বশ্রেষ্ঠ সেটি আমাদের বিচার করতে হবে। এইজন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে–
চৈতন্যচন্দ্রের দয়া করহ বিচার। বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই চমৎকার পন্থাটি বা শিক্ষাটি হচ্ছে–
আরাধ্যো ভগবান্ ব্রজেশতনয়স্তদ্ধাম বৃন্দাবনং।
রম্যা কাচিদুপাসনা ব্রজবধূবর্গেণ যা কল্পিতা ॥
শ্রীমদ্ভাগবতম্ প্রমাণমমলম্ প্রেমা পুমর্থো
মহান শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভোরর্মতমিদম্ তত্রাদরঃ ন পরঃ ॥
আরাধ্য ভগবান হচ্ছেন ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর ধাম হল বৃন্দাবন। ব্রজবধু ব্রজগোপিকারা যে ভাবে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেছিলেন সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। সমস্ত পুরুষার্থ বা সিদ্ধির চরম সিদ্ধি হচ্ছে কৃষ্ণপ্রেম। এটিই হচ্ছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা ।
শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে নিম্নবর্ণের নির্যাতিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত মানুষ সকলে তার ভক্তিধর্মে স্থান পেয়েছে। এই পথে এগোনোর সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল–
শুদ্ধভকত-চরণরেণু ভজন-অনুকূল (শরণাগতি, ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)।
তাই বৈষ্ণব হতে হলে শুধু ভক্ত নয় শুদ্ধ ভক্ত হতে হবে। বিষ্ণুতত্ব বা কৃষ্ণতত্বকে উপলব্ধি করতে হয় ব্রহ্মতত্বকে অতিক্রম করে, এবং তখন তিনি বৈষ্ণব পদবাচ্য হন।
বৈষ্ণব হতে হলে শুধু ভক্ত নয় শুদ্ধ ভক্ত হতে হবে। বিষ্ণুতত্ব বা কৃষ্ণতত্বকে উপলব্ধি করতে হয় ব্রহ্মতত্বকে অতিক্রম করে, এবং তখন তিনি বৈষ্ণব পদবাচ্য হন।
কিন্তু এখনকার বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রভুর ছড়াছড়ি অর্থাৎ সবাই প্রভু। পঞ্চতত্ত্বে তিনজন প্রভু আছেন — চৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ প্রভু ও অদ্বৈত প্রভু। গদাধর ও শ্রীবাস থেকে পৃথিবীতে যত নর নারী গন আছে সবাই গৌরভক্তবৃন্দ।
বর্তমানে পৃথিবীতে হাজার হাজার প্রভু ও ভগবানের সৃষ্টি হয়েছে, তারা নিজেকে সনাতন ধর্মের সহজ সরল মানুষের কাছে প্রভু ও ভগবান বলে পরিচয় দিচ্ছে যেন তাদেরকে মানুষেরা শ্রদ্ধা ভক্তি করে।
তাদেরকে এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা বৈষ্ণব অপরাধের কথা বলে মানুষের মনে একটা ভীতির সঞ্চার করে। এইসব সরল মানুষদের বোকা বানাবার জন্যই অর্বাচীন কনিষ্ঠ বৈষ্ণব ভক্তরা এই প্রতারনামূলক কৌশল প্রয়োগ করে যা ‘বৈষ্ণব কে’ গ্রন্থের ১৯ নং শ্লোকের তাৎপর্যে (পৃ: ১৬১)বলা হয়েছে ।
ব্যাসদেব রচিত সৌর পুরাণে বলা আছে —
মধু দর্ষিতা মার্গেণ পাপিষ্ঠা বৈষ্ণব কলৌঃ ভবিশন্তি তত ম্লেচ্ছা শূদ্র যুতঃ বহিষ্কৃতাঃ।।
মধুর প্রবর্তিত পথে কলিযুগে কিছু পাপিষ্ট বৈষ্ণবের আবির্ভাব হবে এদের উৎপত্তি হবে ম্লেচ্ছ এবং শূদ্র থেকে (সৌর পুরান, আঃ ৩৯, শ্লোকঃ ৭৯)। বর্তমানে তারই বাস্তব রূপ দেখা যাচ্ছে।
‘বৈষ্ণব ধর্মের’ নামে বহু ভেকধারী তিলকধারী বৈষ্ণব গোপনে প্রচার করে বেড়াচ্ছে আপন আপন ইন্দ্রিয় তর্পণ মানসে— “খেয়ে মাছের ঝোল, শুয়ে নারীর কোল, মুখে হরি বোল” ( ভক্তি বেদান্ত বুক ট্রাস্টের ‘প্রশ্ন করুন উত্তর পাবেন’ গ্রন্থের পৃ. ৬৮৮)
এসব বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্যে ‘বৈষ্ণব কে’ গ্রন্থের শ্লোক ১ এবং ২ এ বলা হয়েছে, “তুমি কিসের বৈষ্ণব! শুধুমাত্র বৃথা মান – মর্যাদা আর জড় জাগতিক প্রতিষ্ঠা লাভের উদ্দেশ্যে ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্র জপ করার ভান করছ, কিন্তু এ সবই তোমার কপটতা মাত্র। সস্তা বাহবা পাবার আশায় এমন উচ্চাশা শূকরের বিষ্ঠার সাথে তুলনীয়”।
বর্তমান কলিযুগের বৈষ্ণবরা রাজভোগ সেবন করে রাজ সিংহাসনে বসে ভাগবতের জ্ঞান প্রদান করে থাকেন। আর কিছু কিছু কীর্তনীয়া আছেন তারা আমীষ ভোজীদের একবারে নরকে এমনভাবে ফেলে দেন যেন মনে হয় তারা ভগবদ্ধামে যাওয়ার টিকিট প্রাপ্ত। শ্লোক ১৬ তে এদের বলা হয়েছে ‘ফল্গু-বৈরাগী’ অর্থাৎ ভন্ড-ত্যাগী বৈরাগী। বৃথা অহঙ্কারের জন্যই সে নিজেকে বিরাট ত্যাগী পুরুষ মনে করে। তবে তার শুষ্ক ত্যাগের মাধ্যমে ফল্গু-বৈরাগী কোনদিনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ ভক্ত বা বৈষ্ণব হতে পারে না।
প্রকৃত বৈষ্ণবরাই নিদ্রামগ্ন জগৎকে পরমার্থ চিন্তায় জাগরিত করতে পারেন এবং তাদের অহৈতুকী করুণার ফলেই পাপীতাপী মানুষদের ভগবৎ-ভক্তে পরিনত করতে পারে ।