এই অধ্যায়ে আলোচনা করেছি জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র (Cycle of Birth and Death) ও ৮৪ লক্ষ যোনি ভ্রমন। বিষ্ণুপুরাণে বর্ণনা থেকে জানা যায় ৮৪ লক্ষ রকমের জীবযোনির মধ্যে ৮০ লক্ষ জীবযোনি অতিক্রম করার পর মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে।
জীবের সৃষ্টি (Creation of Life)
অনন্তকোটি সমস্ত ব্রহ্মান্ড বা সমস্ত সৌরজগৎ পরিচালনা করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘মহাবিষ্ণু’ রূপে বিস্তার করেন, আবার প্রতিটি ব্রহ্মান্ড বা সৌরজগৎ পরিচালনার জন্য তিনি মহাবিষ্ণু থেকে ‘গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু’ রূপে বিস্তার করেন, আবার প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহ পরিচালনার জন্য তিনি গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু থেকে ‘ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু’ রূপে নিজেকে বিস্তার করেন। এই ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুই হলেন প্রত্যেক জীবদেহে ‘পরমাত্মা’। গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এই ব্রহ্মান্ডের পরমাত্মা স্বরূপ। মহাবিষ্ণু অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ডের পরমাত্মা স্বরূপ। মহাবিষ্ণুর লোমকূপ থেকে অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু তাঁর নাভিপদ্ম থেকে জন্ম দেন ‘ব্রহ্মা’র।
সুতরাং সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রথম সৃষ্ট জীব হলেন ব্রহ্মা। তিনি গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর ব্রহ্মা ভগবানের আদেশানুসারে বিশ্বের সর্বত্র জীব সৃষ্টি করেন। জীব হল চিৎকণা (চিন্ময় কণা)। সুতরাং জীবদেহ কণাটির উৎসস্থল বা উৎসের কেন্দ্রবিন্দু হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন মুখ্য সৃষ্টি কর্তা, ব্রহ্মা হলেন গৌণ সৃষ্টি কর্তা।
আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন সমস্ত অবতারের অবতারি, অর্থাৎ সমস্ত অবতারের বিস্তার তাঁর থেকে। অবতারের সংখ্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ আছে, কোথাও ১০ অবতার, কোথাও ২২ অবতার, কোথাও বা ২৪ অবতারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে আমরা গীতাতেই এর উত্তর পেয়ে যাব। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৬ থেকে ৮ নং শ্লোক এবং দশম অধ্যায়ের ৪১ নং শ্লোকে ভগবান বলেছেন :
অজঃ অপি সন্ অব্যয় আত্মা ভূতানাম্ ঈশ্বরঃ অপি সন্।
প্রকৃতিম্ স্বাম্ অধিষ্ঠায় সম্ভবামি আত্মমায়য়া।। (গীতা ৪/৬)
অনুবাদঃ যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম্ অধর্মস্য তদাত্মানম্ সৃজামহ্যম্।। (গীতা ৪/৭)
অনুবাদঃ হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।
পরিত্রাণায় সাধূনাম্ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (গীতা ৪/৮)
অনুবাদঃ সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
যৎ যৎ বিভূতিমৎ সত্ত্বম্ শ্রীমত্ ঊর্জিতম্ এব বা ।
তৎ তৎ এব অবগচ্ছ ত্বম্ মম তেজঃ অংশ সম্ভবম্ ।। (গীতা ১০/৪১)
অনুবাদঃ ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন ও মহিমান্বিত সৃষ্টিসমূহ (যত বস্তু আছে) সবই আমার তেজের (শক্তির) অংশসম্ভূত বলে জানবে।
তাহলে কি দাঁড়াল? ভগবান এই বিশ্বের সকল লোকসমাজে সাধুদের (ভক্তদের) পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ হন। সনাতন ধর্ম ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং বিষ্ণুর উপাসকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সার্বজনীন এবং চিরন্তন সত্য। তাই পৃথিবীর সকল ধর্মাচার্যগণকে হিন্দুরা শ্রদ্ধা করে এবং তাঁদের শিক্ষা ও অনুভবকে সত্য বলে মনে করে।
যদিও প্রথম দিকে ব্রহ্মার মন থেকেই বিভিন্ন মুনি ঋষি জন্ম লাভ করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্ত্রী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে সন্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়া তিনি প্রবর্তন করেন।
জীবের দেহটি ক্ষিতি (মাটি), অপ্ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস), ব্যোম (আকাশ) দিয়ে তৈরি। শ্রীব্রহ্মা এই ব্রহ্মাণ্ডে দুই ধরনের জীব সৃষ্টি করলেন। (১) স্থাবর : যারা চলাকেরা করতে পারে না, একস্থানেই থাকে; (২) জঙ্গম : যারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করতে পারে। এইরকম ৮৪ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির জীব সৃষ্টি করলেন, যাদের মধ্যে কেউ জলচর (জলে বাস করে), কেউ ভূচর (মাটিতে বাস করে), কেউ উভচর (জলে ও স্থলে উভয় স্থানেই বাস করতে পারে), কেউ বা খেচর (আকাশে উড়তে পারে)।
৮৪ লক্ষ যোনি (84 Lakh Yoni)
◼️— মানব জীবনের প্রধান চারটি সমস্যা ও সমাধান হল –
১. জন্ম – যদি জন্মই না হয় তাহলে আর অন্য দূঃখ কিভাবে হবে? তাই এটাই প্রধান সমস্যা।
২. মৃত্যু – আমরা মরতে চাই না, তবুও মৃত্যু আসে।
৩. জরা – আর বৃদ্ধ হতে কেউই চাই না। সারা জীবন যুবক-যুবতী থাকবো। তা কি হয়?
৪. ব্যাধি – রোগাক্রান্ত হতে কেউ চাই না, কিন্তু হয়।
মানুষ যতদিন না জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে উদ্ধার পাচ্ছে, ততদিন রোগ, শোক, জড়া, ব্যাধি এগুলো আসবে – যাবে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৮/১৫) বলেছেন – “দূঃখালয়ম্ অশ্বাশ্বতম” অর্থাৎ এই পৃথিবীটা হল দূঃখের জায়গা ও কিছু সময়ের জন্য যাওয়া আসা মাত্র। জড় জগত সম্পর্কে ভগবানের দুটি বিশেষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ
১. দুঃখালয়ম্ : অর্থাৎ দুঃখের আলয় বা দুঃখে পরিপূর্ণ,
২. অশাশ্বতম : অর্থাৎ অনিত্য।
দুটি বিশেষণের তাৎপর্য হলো এই যে, কেউ যদি বলে, আমি তো বেশ সুখে আছি তাহলে প্রশ্ন হল দুঃখালয় কেনো? এই সংশয় দূর করার জন্য পরবর্তী শব্দটির প্রয়োগ, যদি কিছু সুখ পাও তাহলে জেনে রাখো, এই সুখ অনিত্য। এ থেকে বুঝা যায় জড় জগত প্রকৃত পক্ষে দুঃখে পরিপূর্ণ এবং মাঝে মাঝে যে সুখ পাওয়া যায় তা অনিত্য, ক্ষনিকের জন্য।
জেল খানা যেমন শাস্তি, উদ্বেগ ও কষ্ট পাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়, জড় জগতটাও তেমনি। দন্ডভোগের মেয়াদ শেষে যেমন রেহাই পাওয়ার সুযোগ থাকে তেমনি পুনরায় অপরাধ করলে আবার জায়গা হয় এই জেল খানাতেই। মানুষ যা কিছু দেখতে পায় সব কিছুর মালিক হওয়ার একটা প্রবনতা রয়েছে। জড়া প্রকৃতির সম্পদের উপর মিথ্যা মালিকানা দাবি করার এই প্রবনতা ততোক্ষন চলে যতোক্ষন পর্যন্ত প্রকৃতির মৃত্যু এসে এদেরকে বিতাড়িত না করে। এ আমার পুত্র, ও আমার কন্যা, এই সুন্দর বাড়ি-ঘর, বাগান বাড়ি আমার, এরকম মিথ্যা স্বর্গ রচনা করে সৃষ্টির মানসিক তৃপ্তিতে আত্মবিস্মৃত থাকার প্রবনতা রয়েছে এদের মাঝে।
বিজ্ঞান (science) ও প্রযুক্তি বিদ্যার (technology) সাহায্যে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তার সম্পদ ভোগ করার নিরন্তর প্রয়াস কিন্তু সফল হচ্ছে না। কারন প্রকৃতির দান এই জড় দেহটার উপর এক সময় আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। জড় জগতে বদ্ধ জীবের চেতন বিকৃত। তার আকাঙ্ক্ষা সেবা করা নয়, সেবিত হওয়া। মানুষ চায় যশস্বী হবে, সবাই তার গুণগান করবে, তার আদেশ পালন করে তার সেবা করবে। কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করা তার অনাকাঙ্খিত। সে কারোর শরণাগত হতে চায় না বরং চায় সবাই তার শরণাগত হউক। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।
বাস্তবে দেখা যায়, সেবা পেতে গিয়ে বদ্ধজীব অপর জীবের সেবকে পরিণত হয়। যেমন এ জগতের গৃহকর্তা নিজেকে ‘কর্তা’ ভেবে পুলকিত, কিন্তু কার্যত তিনি তার স্ত্রী পুত্রের সেবায় উদয়াস্ত পরিশ্রমে কাতর। যতো বড় প্রভু, ততো বড় তার সেবা দায়িত্ব। কালের স্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন-মান। ফলে চরম হতাশায় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয় সে। ভগবান বা তাঁর প্রতিনিধির কাছে অধীনতা স্বীকার, ভগবৎ চরনে পূর্ণ শরণাগতি ব্যতিত এই মরজগৎ থেকে, দুঃখদায়ী জড়া প্রকৃতির শাস্তিভোগ থেকে নিস্তার নেই কোনো বদ্ধ জীবের।
তাহলে মানব জীবনের প্রধান চারটি সমস্যা এগুলো থাকবে না কোথায়? আমরা সারাজীবন যা কর্ম করছি, তার পূণ্যের ফলে স্বর্গলাভ এবং পাপ কর্মের যাতনা ভোগের জন্য নরকবাস করার পরে আবার এই পৃথিবীতে ৮৪ লক্ষ জীবের কোন একরূপে জন্ম নিতে হবে। এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পেয়ে যেখানে গেলে আর জন্ম নিতে হবে না সেই কৃষ্ণলোক বা গোলক বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্যেই ভক্তিপথ। আমাদের পাপ ও পূণ্য উভয় থেকে মুক্তি পেতে হবে, তবেই আমরা মুক্তিলাভ করে ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তন করতে পারব।
বিষ্ণুপুরাণে বর্ণনা থেকে জানা যায় ৮৪ লক্ষ রকমের জীবযোনির মধ্যে ৮০ লক্ষ জীবযোনি অতিক্রম করার পর মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে।
জলজা নবলক্ষাণি স্থাবরা লক্ষবিংশতিঃ।
কৃময়ো রুদ্রসংখ্যকাঃ পক্ষিণাং দশলক্ষণম্ ।
ত্রিংশল্লক্ষাণি পশবঃ চতুর্লক্ষাণি মানুষা।।
◉ ২০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির বৃক্ষ যোনিতে জন্ম হয়। এই যোনিতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। রৌদ্রের তাপ লাগে, ঝড় বৃষ্টির ফলে ডালপালা ভাঙ্গে। শীতকালে সব পাতা ঝরে যায়, কুঠার বা tree cutter দিয়ে ডালপালা বা গাছটাই কাটা হয়। প্রকৃতি বা মনুষ্য জাতি থেকে আরো অনেক প্রকার কষ্ট পায়।
(তুলসী বৃক্ষ হয়ে জন্মানোর পর বৃক্ষ যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
◉ তারপর ৯ লক্ষ প্রকার প্রজাতির জলচর যোনিতে জন্ম হয়। হাত নেই, পা নেই শুধু দেহ আর মাথা। তবে মাছেরা সামান্য পাখনা দিয়ে বহু গুন ভারী শরীরটাকে বয়ে বেড়ায়। খায় জলজ কীটপতঙ্গ, আগাছা, শ্যাওলা, নোংরা, পচা মাংস আর যা পায়। একজন অন্যজনের মাংস খেয়ে জীবন রক্ষা করে।
(শঙ্খ রূপে জন্ম এবং ভগবানের পূজা অর্চনায় ব্যবহারের পর জলজ জীব যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
◉ তারপর ১১ লক্ষ প্রকার প্রজাতির কীটপতঙ্গ যোনিতে জন্ম হয়।
(মৌমাছি রূপে জন্ম এবং তার তৈরি মৌচাকের মধু ভগবানের পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত হলে কীটপতঙ্গ যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
◉ তারপর ১০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির সরীসৃপ ও পক্ষী যোনিতে জন্ম হয়। তাদের ঘর বাড়ি নেই। গাছে, ফাঁকফোঁকর, গর্তে, কুঠুরিতে বসবাস করে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, পচা গলা খাবার বা দেহাংশ যা পায় তা খায়। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে খায়, কখনও স্বপ্রজাতি স্বপ্রজাতিকে ভক্ষন করে। সাধারনত নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়। যখন সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে চলাফেরা করতে পারে বা উড়তে পারে, তখন আর ফিরেও তাকায় না। যদি কাক, শকুন বা ঈগল হয়ে জন্মায় তবে অনেক দিন বেঁচে থাকে।
(ডিমের মধ্যে জন্ম হতে হতে ময়ূর রূপে জন্ম এবং তার পালক ভগবানের মাথার চূড়ায় বা তাঁর পূজা অর্চনা বা আরতিতে ব্যবহৃত হলে এই যোনি থেকে উদ্ধার হয়)।
◉ তারপর ৩০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির পশু যোনিতে জন্ম হয়। নানা পশু নানা কষ্ট পায়। কোনো পশু হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত। কেউ বা লোকালয়ে লুকিয়ে থাকে। কেউ একে অন্যকে মেরে খায়। কেউবা ঘাস-তৃণ খায়, হাল চষে, গাড়ি টানে। যতো রোগ-শোকই হোক, দিন-রাত মল মূত্রের সাথেই বাস করতে হয়।
(বাঘ, সিংহ, কুকুর, বিড়াল, হায়না, শিয়াল প্রভৃতি জন্ম পার হয়ে গাভী রূপে জন্ম এবং তার থেকে প্রাপ্ত দুধ, মাখন, ঘি ভগবানের সেবায়, ভোগে বা তাঁর পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত হলে তার পশু যোনী বা গর্ভ থেকে মুক্তি ঘটে। সুতরাং গো-যোনিতে জন্ম লাভ পশুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। গো-র শেষ আর পশু জন্ম নেই।)
◉ অবশেষে ৪ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির মনুষ্য যোনিতে জন্ম হয়।
— প্রথমে বন্য মানুষ রূপে জন্ম হয়। তারা বনের মধ্যে বসবাস করে জীবনধারন করে এবং পশুসম খাবার খায়। তাদের আত্ম-পর জ্ঞান নেই।
— তারপর পাহাড়িয়া জাতির জন্ম হয়। নাগা, কুকি, সাঁওতাল ইত্যাদি।
— তারপর জন্ম হয় অধম কুলে। তারা দেবধর্ম মানে না। অপকর্ম করে। মদ্য পান করে।
— তারপর শুদ্রকুলে জন্ম। যা কর্ম করে তা নিজেই ভোগ করে। কেউ অন্ধ, কেউ কানে শুনে না ইত্যাদি হয়। কারো স্বভাব ভাল হয় কর্মগুণে।
— তারপর জন্মায় বৈশ্য জাতি কুলে। কর্ম অনুযায়ি ফল ভোগ করে ওরা।
— তারপর জন্ম হয় ক্ষত্রিয় কুলে। কর্ম ফলে ফল ভাগী হয়।
— অবশেষে ব্রাহ্মণকুলে জন্মায়। এখানে আর একাধিকবার জন্ম হয় না। উত্তম ব্রাহ্মণ জন্ম তার শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মজ্ঞান থাকলেই সে ব্রাহ্মণ। নিজের উদ্ধারে সে আত্মজ্ঞান লাভ করে। শুধু ব্রাহ্মণ কুলে জন্মালেই উদ্ধার হওয়া যায় না। যদি সে জ্ঞান লাভ করতে না পারে, তবে পুনরায় সে চুরাশি লক্ষ যোনি পথে ভ্রমণ করে। বারবার জন্মলাভে কষ্ট পায়। আর কোনো উপায় নেই যদি না ভগবানের শরণাগত হয়। বড় দূর্লভ এই মানব জীবন, অনেক রাস্তা পার করে এখানে আসতে হয়েছে, তাই এই দূর্লভ মানব জীবনকে সফল করা নিজেদের কর্তব্য, দিব্য কৃষ্ণ নাম করে মুক্তির পথ প্রশস্ত করো।
৮০ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির জীবকে মানবেতর প্রাণী বলা হয়।
জীবের জৈব প্রবৃত্তি
প্রত্যেক জীবেরই কতকগুলি প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত জৈব প্রবৃত্তি চার রকমের – আহার, নিদ্রা, দেহরক্ষা, মৈথুন।
(১) আহার – তারা কিছু খাবে। কোনও কিছু খাদ্যরূপে গ্রহণ করে জীবন ধারণ করবে এবং সেজন্য তারা কর্মে প্রবৃত্ত হয়।
(২) নিদ্রা – কর্ম করার ফলে স্থভাবতই তারা ক্লান্ত শ্রান্ত হবে। তাই তারা বিশ্রাম বা নিদ্রা গ্রহণ করে।
(৩) দেহরক্ষা – জাগতিক ত্রিবিধ-ক্লেশ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য সে ঘরবাড়ি বা কোনও সুরক্ষিত আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।
(৪) মৈথুন – বংশবিস্তার করবার জনা সে প্রবৃত্ত হয়।
জীবের বিকার
জড়জগতে জড়শরীর ধারী জীবের ছয়টি বিকার পরিলক্ষিত হয়।
(১) জন্ম – সে জন্মগ্রহণ করে।
(২) অবস্থান – কিছুকাল যে প্রজন্মে জন্মেছে সেই প্রজন্মে থাকে।
(৩) বর্ধন – শিশুরূপে জন্মালেও তার বৃদ্ধি হতে থাকে।
(৪) বিপরিণাম – সে বিশেষরূপে পরিণত হয়, কায়(দেহ)-মনো-বুদ্ধিতে।
(৫) অপক্ষয় – তারপর তাকে জরা (বার্ধক্য জনিত জীর্ণাবস্থা) গ্রস্ত হতে হয়। কায়-মনো-বুদ্ধির ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে।
(৬) বিনাশ – অবশেষে তার দেহত্যাগ বা মৃত্যু হয়।
দেহত্যাগের পর তার জড় শরীরটি পঞ্চভূতে অর্থাৎ ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরূত্ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ) -এ নিশে যায়। আর তার বাসনা, কর্ম ও কর্মফল অনুসারে নতুন প্রজন্মে তাকে গমন করতে হয়।
জীব হচ্ছে চিৎকণা (চিন্ময় আত্মা অর্থাৎ জীবনী শক্তির এক চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ যা প্রত্যেকটি দেহকে ক্রিয়াশীল করে) মাত্র। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কণা। যার পরিমাণ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বর্ণনা করা হয়েছে একটি চুলের অগ্রভাগের হাজার (সহস্র) ভাগের একভাগ মাত্র। এই ব্রহ্মাণ্ডের (অর্থাৎ মহাবিশ্বের) কোনও অণুবীক্ষণ যন্ত্র নেই যার দ্বারা তাকে দেখা যায়। সেই চিৎকণাটি নিত্য। তার বিনাশ নেই। “পরমেশ্বর ভগবান ‘ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু’ রূপে বিস্তারিত হয়ে প্রতিটি জীব দেহে পরমাত্মা বা জীবাত্মা অংশকণা রূপে অবস্থান করেন।”
ভগবতগীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ের (Chapter 15) ৭তম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
মমৈবাংশো জীবালোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ।। (১৫/৭)
এই জড় জগতে যত জীব রয়েছে, সমস্ত জীবই আমার সনাতন (সনাতন শব্দের অর্থ চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়। যা ছিল, আছে এবং থাকবে তাই সনাতন) বিভিন্নাংশ, সমস্ত জীবই সনাতন। অর্থাৎ জীবাত্মা মৃত্যুহীন। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এই জড় জগতে প্রকৃতপক্ষে কঠোর সংগ্রাম করছে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সনাতন শিক্ষায় বলেছেন, ‘জীব নিত্য কৃষ্ণদাস’। প্রতিটি জীব প্রকৃতপক্ষে ভগবানের সেবক। শ্রীকৃষ্ণের বিভূ (পরমেশ্বর) গুণসমূহ অতি সূক্ষ্ম কণা রূপে জীবের মধ্যেও রয়েছে। একমাত্র পার্থকা হচ্ছে ভগবান হচ্ছেন প্রভু (যার মধ্যে ৬৪ গুণ বিদ্যমান) আর জীব হচ্ছে দাস । ভগবান যেমন স্বতন্ত্র (স্বাধীন; পৃথক), জীবও স্বতন্ত্র। বাসনা, কর্ম ও কর্মফলের কারনে কোনও জীব বৈকুষ্ঠ জগতে আবার কোনও জীব জড় জগতে অবস্থান করছে। বৈকুষ্ঠ জগতের সমস্ত জীব নিত্যমুক্ত। কেননা তারা সর্বদাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় মগ্ন। দুঃখ, জড়সুখ, নিজ সুখ ইত্যাদি কখনই তারা জানেন না। ভগবৎ প্রেমই তীদের জীবন। শোক, দুঃখ, মৃত্যু, ভয়, জরা, ব্যাধি প্রভৃতি তাদের স্পর্শ করতে পারে না, তাই তারা এই অনুভূতিগুলি সম্বন্ধে জানেন না। তারা মুক্ত জীব। তাদের সংখ্যাই অধিক।
জড় ব্রহ্মাণ্ড-জগতের জীবদের বলা হল নিত্য বদ্ধ। তারা লক্ষ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির মধ্য দিয়ে এই মনুষ্য জন্ম লাভ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ‘ভগবৎ সেবা-বিমুখ’ থেকেছে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কারনেই পাশবিক প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়, যেমন হিংস্রতা, উগ্রতা, স্বার্থপরায়ণতা, আমিষ আহার ভোজনের প্রবণতা, অতিরিক্ত কামনা-বাসনা-আসক্তি, সর্বদা মায়া-সুখ ভোগের প্রবণতা প্রভৃতি। জড় জগতের বাইরে কোনও জগৎ (আধ্যাত্মিক জগত, চিন্ময় জগত, অশরীরী অন্ধকার জগত প্রভৃতি) বলে যে কিছু আছে তা তারা জানে না, এমনকি মানতেও চায় না।
জীবের চেতনা
জড় ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে বদ্ধ জীবেরা চেতনা অনুসারে পাঁচ প্রকার অবস্থায় অবস্থিত থাকে। যেমন– আচ্ছাদিত চেতন, সংকুচিত চেতন, মুকুলিত চেতন, বিকশিত চেতন, পূর্ণ-বিকশিত চেতন।
(১) আচ্ছাদিত চেতন : গাছপালা ও ঘাসের মধ্যে যে চেতনা তাকে বলে আচ্ছাদিত চেতন। এদের চেতনধর্মের পরিচয় লুপ্ত প্রায়।
(২) সংকুচিত চেতন : পশু, পাখী, সরীসৃপ, মাছ ইত্যাদি জলচর প্রাণী, কীটপতঙ্গ -এর মধ্যে রয়েছে সংকুচিত চেতন। আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন, কোন কিছুর পরোয়া না করে ইচ্ছানুসারে চলাফেরা, নিজের স্বত্ববোধে পরের সঙ্গে বিবাদ করা, অন্যায় দেখলে ক্রোধ প্রকাশ ও আক্রমণ করা প্রভৃতি এ সমস্ত গুণাবলী সংকুচিত চেতনে পাওয়া যায়। যদিও এদের ইহলোক ও পরলোক জ্ঞান থাকে না।
(৩) মুকুলিত চেতন : সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে মুকুলিত চেতন। অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা মানুষের অনুভব ক্ষমতা, চিন্তা করার ক্ষমতা, অতীত -বর্তমান -ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানার মানসিকতা থাকলেও কিছু মানুষ হন নীতিশূন্য, আবার কিছু মানুষ নীতিযুক্ত হলেও তাদের নাস্তিক বা ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞান নেই, উভয় প্রকার মানুষই হল মুকুলিত চেতন।
(৪) বিকশিত চেতন : যে সকল মানুষ নীতিজ্ঞানযুক্ত এবং ঈশ্বর অনুসন্ধানী কিংবা সাধনভক্তির সাথে যুক্ত থাকেন, তাদের চেতনা হল বিকশিত চেতন।
(৫) পূর্ণবিকশিত চেতন : যে সকল মানুষ সাধনভক্তি অনুশীলন করতে করতে ভাবভক্তিতে দৃঢ়রূপে অবস্থিত হন, তাদের চেতনা হল পূর্ণবিকশিত চেতন। জাগতিক বিষয় দ্বারা তারা প্রভাবিত হন না।
মুক্তজীবের প্রকারভেদ
মুক্তজীব (অর্থাৎ মায়ামুক্ত জীব) দুই প্রকারের – নিত্যমুক্ত ও বদ্ধমুক্ত।
১। নিত্যমুক্ত : এই সকল জীবেরা কখনও মায়াবদ্ধ বা জড়জগতের সুখ- দুঃখের কবল গ্রস্ত হন না, তাই এঁদের বলা হয় নিত্যমুক্ত। নিত্য মুক্ত জীব দুই রকমের। ঐশ্বর্যগত ও মাধুর্যগত। (১) ঐশ্বর্যগত নিত্যমুক্ত জীবেরা হলেন বৈকুণ্ঠলোকের বা বিষ্ণুলোকের ভগবৎ পার্ষদ। বৈকুণ্ঠলোক বা বিষ্ণুলোক হলো ভগবান বিষ্ণু ও দেবী লক্ষ্মীর বাসস্থান। অর্থাৎ ঐশ্বর্যগত নিত্যমুক্ত জীবেরা হলেন মহাসঙ্কর্ষণের কিরণকণা। (২) মাধুর্যগত নিত্যমুক্ত জীবেরা হলেন গোলোক বৃন্দাবন ধামের ভগবৎ পার্ষদ। গোলোক বৃন্দাবন ধাম বা কৃষ্ণলোক হল সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ লোক যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা, বলরামদেব বাস করেন। অর্থাৎ সেই সমস্ত জীবেরা হলেন সেই ধামস্থ বলরামের কিরণকণা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দ্বি-ভুজ রূপে সর্বদা গোলোকধামে এবং তাঁর চতুর্ভুজ বিষ্ণু রূপে তিনি সর্বদা বৈকুণ্ঠ লোকে বাস করেন।
২। বদ্ধমুক্ত : এই সকল জীবেরা কখনও মায়াবদ্ধ বা জড়জগতের সুখ-দুঃখের কবলগ্রস্ত হলেও ভক্তিসাধনের দ্বারা মুক্ত হয়েছে। এদেরকে বলা হয় বদ্ধমুক্ত জীব। বদ্ধমুক্ত জীব তিন রকমের। ঐশ্বর্যগত, মাধুর্যগত ও ব্রহ্মজ্যোতির্গত ।
(১) ঐশ্বর্যগত বদ্ধমুক্ত জীবেরা সাধন করার ফলে ঐশ্বর্যপ্রিয় হয়ে বৈকুণ্ঠলোক বা বিষ্ণুলোকে ভগবান বিষ্ণুর নিত্য পার্ষদদের সঙ্গে নিত্য সেবাসুখ লাভ করেন।
(২) মাধুর্যগত বদ্ধমুক্ত জীবেরা সাধন করার ফলে মাধুর্যপ্রিয় হয়ে গোলোক বৃন্দাবনে বা কৃষ্ণলোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য পার্ষদদের সঙ্গে নিত্য সেবাসুখ লাভ করেন।
(৩) ব্রহ্মজ্যোতির্গত বদ্ধমুক্ত জীবেরা সাধন করার ফলে ভগবানের দিব্য অঙ্গজ্যোতিতে মিশে যাওয়ার অভিলাষে ব্রহ্মসাযুজ্যে গতি প্রাপ্ত হন।
মানব জীবনের উদ্দেশ্য কি?
এই ক্ষণিক অথচ দুর্লভ মনুষ্যজন্মে জন্ম -জরা- ব্যাধি-মৃত্যু তথা নানা দুঃখ ও উদ্বেগপূর্ণ জগতে এসে এই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ভগবানের নিত্য সেবায় নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া যাতে আর কখনো ভবচক্রে ফিরে আসতে না হয়।
◼️ — মানব জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি?
মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হল ‘এই জীবনে আমাদের জানা দরকার আমরা পরমেশ্বরের নিত্য দাস, এই জীবনে এই দুঃখময় জগত থেকে সুখের অনুসন্ধান করা মূর্খামি মাত্র। যে প্রকৃত অনুসন্ধান না করে কেবল এই নশ্বর জীবনটার সব কিছুই ভোগ করার জন্য উদগ্রীব থাকে, তার জীবন অনর্থ ও কৃমিকীট।’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শাশ্বত, আর সমস্ত জীবসত্তা তাঁর সনাতন অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি জীবসত্ত্বা চেতন সত্ত্বা বিধায় তার রয়েছে স্বাধীন ইচ্ছা। অংশ হিসেবে পূর্ণের সাথে রয়েছে নিত্য শাশ্বত ভালবাসার সম্পর্ক। সেই ভালবাসা শুদ্ধ নির্মল, বাধ্যতা যুক্ত নয়। ইচ্ছা করলে জীব ভগবানকে ভালবাসতে পারে অথবা নিজে প্রভু বা সেব্য হতে পারে।
ভগবান শুদ্ধ প্রেম আকাঙ্খা করেন, কাউকে বাধ্য করেন না। যারা শুদ্ধ প্রেমানুরাগে ভগবৎ সেবায় দিব্যানন্দ উপভোগ করতে চায় তারা ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তি দ্বারা আবিষ্ট হয়ে চিন্ময় জগতে নিত্যকাল অবস্থান করে। যারা স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করে তারা বহিরঙ্গা জড়া শক্তির কবলীভূত হয়ে জড় জগৎরূপ কারাগারে আবদ্ধ হয়, এদের বলা হয় বদ্ধজীব।
তাই মানব জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তখনই সাধিত হয় যখন আমরা ভগবানের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পন করে, সর্বদা ভগবান সেবায় নিজেদের দেহমনকে নিযুক্ত করতে পারি। আর যারা পরমেশ্বরের শ্রীচরণকমলে আত্মসমর্পন করে সর্বদা সেবা করেন, তারাই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে চিরমুক্তি লাভ করেন।
আমরা কলির জীব অল্প আয়ু, অল্প জ্ঞান, অন্নগত প্রান। তাই অন্যান্য যুগের মানুষের মতো কঠোর তপস্যা করার মতো সময় ও ধৈর্য শক্তি আমাদের নেই, তাইতো পতিত পাবন ভগবান কৃপা করে আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন কলির জীবের মুক্তির একমাত্র পথ নাম মহামন্ত্র, এটি হল কলিকালের নাম যজ্ঞ। তাই আমরা সকলে মহামন্ত্র জপ করে এই জন্ম মৃত্যুর কঠিন চক্র থেকে মুক্তিলাভ করি।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
◼️— মানব জীবনে আধ্যাত্মবিদ্যার কি প্রয়োজন আছে?
— অন্যান্য পশুপাখী কীটপতঙ্গের জীবনের চেয়ে মানব জীবনই শ্রেষ্ঠ বা উন্নত, যেহেতু মানুষ জানতে চেষ্টা করে, আমি কে? কেন আমি জন্মেছি? কেন আমাকে মরতে হবে? কেন চিরকাল এই শরীরে সুখী হতে পারব না? জগৎ কি? কে বানিয়েছেন? জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? জগতের সৃষ্টিকর্তার পরিচয় কি? তার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কি? জন্ম মৃত্যু জরা ব্যাধি আমি চায় না, তবুও এগুলি কেন আমাকে গ্রহণ করতে হচ্ছে? এইগুলিই হল আধ্যাত্মবিজ্ঞানের বিষয়।
— বেদে বলা হয়েছে – অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা। অর্থাৎ আসল বিষয় জানবার চেষ্টা করা। এইগুলি যদি জানবার কারো প্রয়োজন না থাকে তবে তাকে নিছক পশু মাত্র বলেই শ্রীমদ্ভাগবত ব্যাখ্যা করেছে।
— শ্রীমদ্ভগবদগীতায় (১৮ অধ্যায় ৬৬ শ্লোকে) শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ দিয়েছেন –
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ।।
অর্থাৎ জড় জগতের বিচিত্র রকমের কর্তব্য বা ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণাগত যদি হও তবে সমস্ত রকমের পাপ থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করব, সেই জন্য তোমার কোন দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এই রকম দৃঢ় প্রতিশ্রুতি একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া ব্রহ্মান্ডের অন্য কেউ কোথাও প্রদান করেননি। অতএব শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করাই শ্রেয়। শ্রীকৃষ্ণই হলেন সমস্ত জীবের বীজপ্রদ পিতা। তিনিই পরম গুরু।
— শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়েছেন –
‘যে-ই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সে-ই ‘গুরু’ হয়।
– (চৈতন্যচরিতামৃত মধ্য ৮/১২৭)
অর্থাৎ কৃষ্ণতত্ত্ববিদ ছাড়া কেউ ‘গুরু’ হতে পারে না।
চক্ষু দিল যেই জন্মে জন্মে প্রভু
সেই দিব্য জ্ঞান হৃদে প্রকাশিত।
প্রতি জন্ম মাতা পিতা সহজেই লাভ হয়। কিন্তু সব জন্মে পারমার্থিক গুরুকে পাওয়া যায় না।
সকল জন্মে পিতা মাতা সবে পায়,
কৃষ্ণ গুরু নাহি মিলে, ভজহ হিয়ায় ।।
– ( চৈতন্যমঙ্গল)
— চৈতন্যমঙ্গলে আরো বলা হয়েছে –
সেই সে পরম বন্ধু, সেই পিতা মাতা,
শ্রীকৃষ্ণচরণে যেই প্রেমভক্তিদাতা ।।
◼️ — মানব জীবনের চরম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কি?
আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হল – মুক্তি জীবনের মেয়াদ অতি অল্প। সকাল বিকাল অকাল নিয়ে কথা নয়, যে কোন কালেই যে কোন মুহূর্তই আমাদের ইহ জীবনের অন্তিমকাল হতেই পারে। সেই জন্য নারদ মুনি বললেন ‘মনুষ্য-জীবনের সেই আয়ুষ্কাল ধন্য, যে আয়ুষ্কালে সে কৃষ্ণভক্তিতে কৃষ্ণসেবাতে নিযুক্ত আছে।’ কিছু সাধন ভজন করতে হবে যাতে অন্তিম কালে ভগবানের নাম গুনগান করতে করতে মরতে পারি।
কিন্তু যারা বারবার জড় জাগতিক দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে চায় না তারা ভগবদ ভক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে জেলখানা স্বরূপ দুঃখময় জগৎ থেকে ভগবদ্ ধামে উন্নীত হওয়ার প্রয়াস করেন। কিন্তু এই জ্ঞান হতে বহু বহু জন্ম কেটে যেতে পারে।
ভগবান বলেছেন, “বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে।” অর্থাৎ, ‘বহু বহু জন্মের পর জ্ঞানবান ব্যক্তি আমার শরণাগত হয়’। (ভগবতগীতা ৭/১৯) ।
জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল সর্ব সৌন্দর্য-বৈচিত্র-পূর্ণ শাশ্বত ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়াই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গতি বা গন্তব্য লাভ।
অব্যক্তো অক্ষরঃ ইতি উক্তঃ তম্ আহুঃ পরমাম্ গতিম্।
যম্ প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমম্ মম।।
— (ভগবতগীতা ৮/২১)
অর্থাৎ, ”কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।” (ভগবতগীতা ৮/২১) ।
তাই দেহান্তে যন্ত্রণা দায়ক এই জড় জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ভগবানের দিব্য আনন্দময় সান্নিধ্যে ফিরে যাওয়াই প্রকৃত সমাধান। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন ভক্তি আর কৃষ্ণচেতনায় নিমগ্ন থাকা নিশিদিন সর্বক্ষণ।
► আরও পড়ুন: ভগবতগীতায় উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণের নাম ও অর্জুনের নামের অর্থ কি?
► আরও পড়ুন: Bhagavad Gita Mahatmya || ভগবদগীতা মাহাত্ম্য ও তার তাৎপর্য