এই অধ্যায়ে আলোচনা করেছি জীবের কিভাবে জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি লাভ হবে? (Freedom from cycle of Birth and Death)।
সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হল ভক্তি। (Freedom from cycle of birth and death = Bhakti)। ভক্তিতেই মুক্তি।
যারা মৃত্যুর সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে, তার নাম নিতে নিতে দেহ ত্যাগ করে, তারা মুক্তি লাভ করে ভগবত ধামে অর্থাৎ ভগবানের কাছে চলে যায়।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ৮/৫ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
অন্তকালে চ মাম্ এব স্মরন্ মুক্তা কলেবরম্।
যঃ প্রয়াতি সঃ মদ্ভাবম্ যাতি নাস্তি অত্র সংশয়ঃ ৷৷
অনুবাদ : “মৃত্যুর সময়ে যিনি আমাকে স্মরণ করে দেহ ত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ আমার ভাবই প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।” ॥গীতা ৮/৫॥
ভগবানের দেওয়া উপরিউক্ত সুযোগটিকে প্রতিটি মানুষেরই বিশেষভাবে সদব্যাবহার করা উচিত। কোথাও – কোনো ব্যধিগ্রস্ত, মরণাপন্ন ব্যক্তি থাকলে তাকে ভগবানের নাম, লীলা, ভগবদমহিমা বর্ণনা করা উচিত। গীতার শ্লোক শোনানো উচিত। যদি সে বেহুঁশ বা কোমায় থাকে, তাহলে তার কাছে “হরে কৃষ্ণ” মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন করতে হয়, যাতে সেখানকার পরিমণ্ডল ভগবদনামে পূর্ণ থাকে।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
ভগবদ-সম্বন্ধীয় পরিমণ্ডলে যমদূত আসতে পারে না। মৃত্যুর সময় অজামিল ‘নারায়ণ’ নাম উচ্চারণ করায় সেখানে ভগবানের পার্ষদ হাজির হয়েছিলেন এবং যমদূত ফিরে যমের কাছে চলে গিয়েছিলেন। তখন যমরাজ তাঁর দূতকে বলেছিলেন, যেখানে ভগবদনাম জপ-কীর্তন, কথা-মাহাত্ম্য ইত্যাদি হয়, সেখানে তোমরা কখনো যেও না; কারণ সেখানে আমাদের কোনো অধিকার নেই। এই বলে যমরাজ ভগবানকে স্মরণ করে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন যে, আমার দূতের যে অপরাধ হয়েছে তার জন্য ক্ষমা করুন’।
কিন্তু যারা সারা জীবন কৃষ্ণ নাম নেন না, তাদের মৃত্যুর সময় কৃষ্ণ নাম মনে পড়বে না। এইকারনে জীবনভর নিরন্তর অধ্যাবসায়, সংযমের দ্বারা রপ্ত করতে হয়। তাই আমাদের সব সময় হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তন করা উচিত, কারণ আমরা তো জানি না কখন আমাদের মৃত্যু হবে। আর মৃত্যুর সময় কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করলে কখনোই আমাদের মুক্তি লাভ হবে না। গীতা (৮/৬)।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ৮/৬ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন,
যম্ যম্ বা অপি স্মরন্ ভাবম্ ত্যজতি অন্তে কলেবরম্।
তম্ তম্ এব এতি কৌন্তেয় সদা তৎ ভাব ভাবিতঃ।।
অনুবাদ : “হে কৌন্তেয়, অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহ ত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন।”
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
❁ কৃষ্ণ স্মরণে পরিনতি: জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি লাভ ❁
এখন প্রশ্ন হলো —
(১) যে কেউই শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারে কি?
(২) কেউ সারা জীবন পাপাচার করে অন্তিমে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলো, তার পরিনতি কি?
(৩) কেউ সারাজীবন ভক্তি অনুশীলন করে অন্তিমে হরিস্মরণ করতে পারলো না, তার পরিনতি কি?
(৪) মদ্ভাবং যাতি -“আমার ভাব প্রাপ্ত হন” কথাটির অর্থ কি?
(৫) স্মরণশীল ব্যক্তির ভাব কিরকম?
উত্তর (১) : যে কেউই শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারে না। ভক্ত্যাবিশ্য মনো যস্মিন্ (ভাগবত ১।৯।২৩) যাঁর মন ভক্তিসমাহিত হয়ে কৃষ্ণভাবনায় আবিষ্ট, তিনিই স্মরণ করতে পারেন।
যার মন বিষয় ভোগে, আমিষ ভক্ষণে, অবৈধ সঙ্গে, মাদক সেবনে আসক্ত; যার মন ভক্ত নিন্দায় কলুষিত; যার মন আত্মঅহংকারে পরিপূর্ণ, সেই মনে কৃষ্ণস্মৃতি আসে না।
উত্তর (২) : ভাগবতমে ৩।৯।১৫ শ্লোকে ব্রহ্মা বলছেন,
নামানি যে অসু-বিগমে বিবশাঃ গৃণন্তি
তে অনৈক জন্ম শমলম্ সহসা এব হিত্বা
সংযান্তি অপাবৃত অমৃতম্ তম্ অজম্ প্রপদ্যে ।।
অর্থাৎ কেউ যদি দেহত্যাগ কালে অজ্ঞাতসারেও শ্রীভগবানের দিব্য নাম উচ্চারণ করেন, তবে তিনি অবশ্যই তৎক্ষণাৎ জন্ম-জন্মান্তরের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানকে লাভ করেন।
পাপাচারী অজামিল অন্তিমকালে ‘নারায়ণ’ নাম উচ্চারণ করে যমদূতদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন।
উত্তর (৩) : সারা জীবন ভক্তি অনুশীলন করলেও জড়জগতে কোনও কিছুর প্রতি বা কারও প্রতি মন আবিষ্ট থাকার কারণে মরণকালে হরিস্মরণ নাও হতে পারে।
যেমন, ভরত মহারাজ রাজ্য, স্ত্রী-পুত্র, প্রাসাদ, ধনদৌলত ত্যাগ করে এসে বনে হরি (কৃষ্ণের) আরাধনা করেছিলেন। সেখানে এক নবজাত অনাথ হরিণ শিশুকে পালন করেছিলেন। হরিণটি সব সময় তার কাছে থাকতো। মৃত্যুর সময় ‘হরিচিন্তার’ বদলে ‘হরিণচিন্তা’ করতে লাগলেন। তাই পরবর্তীকালে ভরত মহারাজকে হরিণ জন্ম পেতে হলো। হরিণ জন্ম পেলেও অন্য হরিণের সঙ্গে না থেকে ভক্ত মুনিঋষিদের সান্নিধ্যে অবস্থান করে দিন যাপন করতে লাগলেন। পরজীবনে হরি ভজনের ফলে তিনি সমস্ত জড় কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে ভগবতধামে ফিরে যান।
উত্তর (৪) : শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমার ভাব প্রাপ্ত হন” অর্থাৎ আমি (শ্রীকৃষ্ণ) যে রকম পাপকলুষ লেশ শুন্য, আমার স্মরণকারীও সেই রকম। স্মরণকারী ভক্তও শ্রীভগবানের মতোই ‘অপহতপাপ্মাত্বাদি’ গুণ বিশিষ্ট বা কর্মবশ্যতা-গন্ধ-শূন্য অর্থাৎসমস্ত জড় কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত থাকেন এবং অনাবিল সচ্চিদানন্দময় জীবন লাভ করেন।
উত্তর (৫) : যিনি বহুদিন অসহ্য নির্যাতনের মধ্যেও সম্পূর্ণরূপে প্রতিবাদশুন্য হয়ে দিনরাত হরিনামই করে গেছেন, সেই নামাচার্য হরিদাস ঠাকুর কাকুতি করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে বলছেন__
তোমারস্মরণ হীন, পাপ জন্ম মোর।
সফল করহদাসোচ্ছিষ্ট দিয়া তোর।
শচীর নন্দন, বাপ, কৃপা করো মোরে।
কুকুর করিয়া মোরে রাখো ভক্তঘরে || (চৈ.চ-ম ১০|৮৮)
“হে শচীনন্দন! তোমাকে স্মরণ না করার কারণে পাপের মধ্যেই আমার জন্ম। তবুও কৃপাময় তোমার কাছে আমার মিনতি এই যে, তোমার ভক্তদের উচ্ছিষ্ট আমাকে দিয়ে আমার জীবন সাফল্যমণ্ডিত করো। গৃহস্বামী যেমন কুকুরকে উচ্ছিষ্ট ভোজন দিয়ে গৃহরক্ষা কাজে নিযুক্ত করে, তেমনই আমাকে তোমার ভক্তগৃহে প্রতিষ্ঠিত করো ।”
তার এই মিনতি শুনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, “তুমি জগতের শীর্ষস্থানীয় মহাপুরুষ। আমার কাছে কিংবা কোনও বৈষ্ণবচরণে তোমার কোনও অপরাধ হবে না। তোমার ভূত্য রূপে যদি কেউ একদিনও বাস করে, অথবা তুমি কৃপা করে অতি অল্প সময়ের জন্য কারও সাথে বাক্যালাপ করো, তাহলে তারও শ্রীভগবানের চরণপ্রাপ্তি অনিবার্য।
❁ মৃত্যু কালে কৃষ্ণ স্মরণ ❁
(৬) এখানে প্রশ্ন হতে পারে, যে ব্যক্তি সারাজীবনে সাধন-ভজন করেনি, সর্বদা ভগবানে বিমুখ থেকেছে, তার জীবনের অন্তিমকালে কীভাবে শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ হবে এবং কী করে তার কল্যাণ লাভ হবে ?
উত্তর (৬) : তার উত্তর হল যে,
❖ যদি অন্তিমকালে তার ওপর ভগবানের কোনো বিশেষ কৃপা হয় বা কোনো সাধু মহাত্মার দর্শন লাভ হয় তাহলে তার শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ হয়ে কল্যাণ সাধন হবে। তার কল্যাণের উদ্দেশ্যে কোনো সাধক তাকে ভগবদনাম, লীলাচরিত, গীতা পাঠ ইত্যাদি শ্রবণ করায় বা পদ-কীর্তন করে শোনায়, সেক্ষেত্রে তার শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ হয়ে কল্যাণ সাধিত হয়।
❖ যদি মরণাপন্ন ব্যক্তির ভগবতগীতার প্রতি আগ্রহ থাকে, তাহলে তাকে গীতার অষ্টম অধ্যায় শোনানো উচিত। কারণ এই অধ্যায়ে জীবের সদ্গতির বর্ণনা বিশেষভাবে করা হয়েছে। এটি শুনলে তার ভগবানে স্মৃতি ফিরে আসে। কারণ প্রকৃতপক্ষে ভগবানের অংশ হওয়ায় জীবের পরমাত্মার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সম্পর্ক থাকেই।
❖ যদি অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার, কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি কোনো তীর্থস্থানে কারও মৃত্যু ঘটে তাহলে সেই তীর্থস্থানের প্রভাবে তার ভগবানের স্মৃতি জাগ্রত হয়। এইরূপ যে স্থানে ভগবানের নাম, জপ, কীর্তন, কথা, সৎসঙ্গ ইত্যাদি হয়, সেইস্থানে কারও মৃত্যু হলে, সেখানকার পবিত্র পরিবেশের প্রভাবে তার ভগবানের স্মরণ হতে পারে।
❖ যদি মৃত্যুকালে কোনো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন মরণাপন্ন ব্যক্তি ভীত হয়ে ভগবানের স্মরণ করতে পারে।
❖ যদি দেহত্যাগের সময় দেহ, আত্মীয়-স্বজন, অর্থ ইত্যাদি জাগতিক ভাব বা মায়া-মমতা-মুক্ত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সঁপে দেয় ‘হে প্রভু ! তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, শুধু তুমিই আমার’ তাতেও ভগবানের কৃপায় তার কল্যাণ সাধিত হয়।
❖ তেমনই কোনো কারণে কারও যদি হঠাৎ নিজ কল্যাণের ইচ্ছা জাগ্রত হয় এবং ভগবানের স্মরনাপন্ন হয়, তাহলেও তাঁর কল্যাণ হয়ে থাকে।
❖ আবার কোনো সাধক যদি কোনো প্রাণী বা জীব-জন্তুর মৃত্যুকালে ‘এর কল্যাণ হোক’ এই ভাব নিয়ে তাকে ভগবত নাম শোনান, তবে সেই ভগবদ নামের প্রভাবে সেই প্রাণীটির কল্যাণ সাধিত হয়।
শাস্ত্রাদিতে সাধু-মহাপুরুষদের প্রভাবের নানা চমৎকারী কথা শোনা যায় যে, যদি কোনো সাধু-মহাত্মা কোনো মরণাপন্ন ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন অথবা তার মৃতদেহ দেখেন বা তার চিতার ধোঁয়া বা ভস্ম দেখেন—তাহলেও ওই ব্যক্তির কল্যাণ হয়।
এখন কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, “তবে ত বেশ, শাস্ত্রে যখন বলছে মৃত্যুকালে আমি যদি কৃষ্ণ চিন্তা করি, তাহলে আমি ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারব। তাহলে এটি যখন মৃত্যুকালের ব্যাপার, এখন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ কি? এখন মন যা চায়, তেমনি খুশিমতো ভোগবিলাসের মাধ্যমে জীবন উপভোগ করি! যখন মৃত্যুর সময় আসবে, তখন আমি দ্রুত কৃষ্ণে মন নিবিষ্ট করব, ফলস্বরুপ ভগবত ধামে ফিরে যাব। এইভাবে আমি উভয় জগতেরই পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে পারব।” যেসব মানুষ এইরকম চিন্তা করেন, তারা নিজেদেরকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকেও বুদ্ধিমান মনে করেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে প্রতারণা করা সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে তিনি হলেন “সমস্ত ছলনাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” সুতরাং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রতারিত করার সাধ্যি কার আছে?
যে ব্যক্তি আজীবন জড় বিষয়াসক্ত থাকে, সে মৃত্যুকালে কখনো মনকে শ্রীকৃষ্ণে নিবদ্ধ করতে পারে না এমনকি চেষ্টা করলেও নয়। যে ছাত্র পরীক্ষার জন্য সারা বছর কোনো রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করে নি, তার পক্ষে স্টার নম্বর পাওয়া কিভাবে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর সময়ে শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করার আমাদের কোনো সামর্থ্য নেই, কেননা মৃত্যু এক অত্যন্ত মর্মন্তদ যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। আমরা যদি স্বাভাবিক অবস্থায় অবিরাম কৃষ্ণস্মরণ করতে সক্ষম না হই, তাহলে আমরা কি করে ভাবতে পারি যে মৃত্যুর মতো জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক, বিয়োগান্তক মুহুর্তে আমরা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তায় মন নিবিষ্ট রাখতে পারব? তা একপ্রকার অসম্ভব। কেবল শ্রীকৃষ্ণই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন – আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করে। তাঁর সেবা করার ফলে আমাদের অন্তরের ভক্তিভাব দর্শন করে যদি তিনি প্রীত হন, তাহলে মৃত্যু অত্যাসন্ন হলে তিনি আমাদের অনুগ্রহ করেন, আর তাঁর কৃপা-প্রভাবে আমরা ঐ চরম সময়েও তাঁর চিন্তায় মনোনিবেশে সমর্থ হই। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হচ্ছে পারমার্থিক জীবনের সমস্ত বাধা-বিঘ্ন-প্রতিবন্ধকতা সহ্য করেও নিরন্তর হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করে যাওয়া, যাতে জীবনান্তে আমরা কৃষ্ণভাবনামৃতের পূর্ণ ফল লাভ করতে পারি।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
সুতরাং যে ব্যক্তি সারাজীবনে সাধন-ভজন করেনি, সর্বদা ভগবানে বিমুখ থেকেছে, তার জীবনের অন্তিমকালে শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ অসম্ভব, সমস্ত ঘটনাবলী ‘যদি’র উপর নির্ভর। মৃত্যু যন্ত্রণা হল ৪০,০০০ বিষাক্ত বিছা কামড়ানোর সমান। একটা বিছের কামড় মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে সেখানে চল্লিশ হাজার বিছার কামড়! অসহনীয় যন্ত্রণা, শরীরে তীব্র জ্বলন – অনুভব করতে পারছেন! সেই সময় ভগবানের স্মরণ, অসম্ভব! অকল্পনীয়! তাহলে জেনে নিতে হয় “মৃত্যুর স্বাদ কেমন? কিরুপ এর যন্ত্ৰণা ?”
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
❁ মৃত্যুর স্বাদ কেমন? ❁
প্ৰাচীন বৈদিক সাহিত্য ‘গরুড় পুরাণে’ বলা হয়েছে , “৪০,০০০ বিষাক্ত বিছা পোকা একত্ৰে কামড়ালে যে যন্ত্ৰণা হয়, মৃত্যুকালে জীব তার সমান যন্ত্ৰণা ভোগ করে।” সুতরাং, এককথায় বলতে গেলে মৃত্যু যন্ত্ৰণা তীব্র ও ভীষণ ভয়ঙ্কর।
কপিল দেবের মৃত্যু সময়ের বীভৎস অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ভগবান বলেছেনঃ
”সেই রুগ্ন অবস্থায় , ভেতরে বায়ুর চাপে , তার চক্ষু ঠিকরে বেড়িয়ে আসে এবং কফের দ্বারা শ্বাসনালি রুদ্ধ হয়ে যায় । নিঃশ্বাস নিতে তখন খুব কষ্ট হয় এবং গলা দিয়ে ঘর-ঘর শব্দ হয়। এভাবে অত্যন্ত মৰ্মান্তিকভাবে তার মুত্যু হয় ।” ( ভাগবত ৩/৩০/১৬-১৮ )
আধুনিক সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার কৌশলের ওপর অধিক জোর দেওয়া হচ্ছে । মানুষ সব নতুনভাবে আনন্দ উপভোগের ব্যাপারে আগ্রহী, কিন্তু আমাদের জীবনের আসল লক্ষ্য, “মৃত্যুবরণের কৌশল” – এর প্রতি কারও কোনো আগ্ৰহ নেই বললেই চলে!!
পরমেশ্বর ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ বলেছেন আমাদের জীবনের একটি বন্ধন আছে, সে বন্ধনটি কী ?
“জন্ম মৃত্যু জড়া ব্যাধি দুঃখ দোষানুদর্শনম। ” অর্থাৎ জন্ম-বন্ধন। হ্যাঁ, এটাই বড় বন্ধন । মানুষ একে গুরুত্ব দেয় না । জন্ম – শুধু একটা শব্দই এখানে ব্যবহৃত হয়েছে । ‘জন্ম’ শব্দের দ্বারা একটি শিশুর জন্মগ্রহণকে বোঝানো হয় । তবে জন্ম কথাটির অৰ্থ অন্য কিছু। কিন্তু আমরা যদি এর দাৰ্শনিক দিকটি বিচার করি, তাহলে দেখব আত্মার কোনো জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। যেদিন যে মুহূর্তে শিশু জন্মগ্রহণ করে, তখন থেকেই তার শরীরের মৃত্যু প্ৰক্ৰিয়া শুরু হয়।
এই পৃথিবীতে বিভিন্ন কৈতব ধর্ম ও ধর্মমতের আদর্শ হল কিভাবে সুন্দরভাবে বাঁচতে হয়, কিভাবে সুখী হওয়া যায় ইত্যাদি। কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, ”কিভাবে মরতে হবে ? কিভাবে মৃত্যুকে জয় করবে ?”
অন্তকালে চ মাম্ এব স্মরন্ মুক্তা কলেবরম্।
যঃ প্রয়াতি সঃ মদ্ভাবম্ যাতি নাস্তি অত্র সংশয়ঃ ৷৷
━┉┈ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮/৫
তাই কৃষ্ণভক্ত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেন। চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, ”মৃত্যু ভয়কে জয় করতে হলে নিরন্তর কৃষ্ণনাম কৃষ্ণচিন্তা করুন!”
তাই এখন থেকেই নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিন।
❁ কৃষ্ণচেতনাহীন মানুষের বাস্তব পরিণতি ❁
কৃষ্ণচেতনাহীন মানুষের বাস্তব পরিণতি শোচনীয় এবং ভয়ঙ্কর।
💠 পরমেশ্বর ভগবান বললেন ━”মেঘপুঞ্জ যেমন শক্তিশালী বায়ুর প্রভাব জানে না, ঠিক তেমনি জড় চেতনায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি কালের অসীম বিক্রম জানতে পারে না যার দ্বারা সে চালিত হয়।”
💠 “তথাকথিত সুখের জন্য জড়বাদীরা অত্যন্ত কষ্ট স্বীকার করে যে সব প্রয়োজনীয় বস্তু উপার্জন করে, কাল রূপে পরমেশ্বর ভগবান তা সবই বিনাশ করেন, এবং সেই জন্য বদ্ধ জীবেরা শোক করে।”
💠 “পথভ্রষ্ট জড়বাদী ব্যক্তি জানে না যে, তার দেহটি অনিত্য এবং তার দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত গৃহ, ক্ষেত্র এবং সম্পদ- সেইসবও অনিত্য। অজ্ঞতাবশত সবকিছুকে নিত্য বলে মনে করে।”
💠 “জীব এই সংসারে যে যেই যোনিতে জন্মগ্রহণ করে, সেই যোনিতেই সে বিশেষ সন্তোষ লাভ করে, এবং সেই অবস্থায় সে কখনো বিরক্ত হয়না।”
💠 “যে বিশেষ যোনিতে বদ্ধ জীব রয়েছে, তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকে। মায়ার আবরণাত্মক প্রভাবের দ্বারা বিমোহিত হয়ে, নরকে থাকলেও, তার সেই শরীরকে সে ত্যাগ করতে চায় না, কারণ সেই নারকীয় অবস্থাকেই সে সুখকর বলে মনে করে।”
💠 “দেহ, স্ত্রী-পুত্র, গৃহ,পশু, ধন, বন্ধু প্রকৃতির প্রতি গভীর আসক্তির ফলে, জীব তার জড়-জাগতিক জীবনে এই প্রকার সন্তোষ অনুভব করে। এই প্রকার সঙ্গ প্রভাবে বদ্ধ জীব নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে করে।”
💠 “উৎকণ্ঠায় সর্বক্ষণ দগ্ধ হওয়া সত্বেও, এই প্রকার মূর্খেরা তাদের তথাকথিত স্বজনদের ভরণ-পোষণের জন্য দুরাশাগ্রস্থ হয়ে, সর্বদা নানাপ্রকার পাপ কার্যে লিপ্ত হয়।”
💠 “যে রমনী মায়ার দ্বারা তাকে মোহিত করে, তাকেই সে তার হৃদয় এবং ইন্দ্রিয় অর্পণ করে। নির্জন স্থানে সে তার আলিঙ্গন ও গোপন আলাপের দ্বারা তার সঙ্গসুখ উপভোগ করে, এবং শিশুদের আধো-আধো মিষ্টি বুলিতে সে মুগ্ধ হয়ে থাকে।”
💠 ” আসক্ত গৃহব্রত ব্যক্তি কূটনীতি এবং রাজনীতিতে পূর্ণ পারিবারিক জীবনে অবস্থান করে। সর্বদা দুঃখ বিস্তার করে এবং ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কার্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে, সে তার দুঃখ-দুর্দশার নিবৃত্তি সাধনের জন্যই কেবল কর্ম করে। যদি সে সেই দুঃখ-দুর্দশার নিবৃত্তি সাধনে সমর্থ হয়, তখন সে নিজেকে সুখী বলে মনে করে।”
💠 ” সে ইতস্তত হিংসা আচরণ ক’রে ধন-সম্পদ অর্জন করে, এবং যদিও তার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য সে তা করে কিন্তু সে নিজে কেবল সেই অর্থের দ্বারা কেনা খাদ্যের স্বল্পমাত্র অংশই আহার করে, এবং এইভাবে যাদের জন্য সে অন্যায়ভাবে ধন সংগ্রহ করেছিল তাদেরই জন্য সে নরকগামী হয়।”
💠 ভগবান বললেন ━ “যখন গৃহমেধী মানুষ তার জীবিকা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন সে বারবার তার অবস্থার উন্নতি সাধনের চেষ্টা করে, কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টায় সে যখন ব্যর্থ হয় এবং বিনষ্ট হয়, তখন সে অত্যধিক লোভের কারণে অন্যের ধন হরণ করে।”
💠 ” যখন সেই দুর্ভাগা তার পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণে অক্ষম হয়ে হতশ্রী হয়, তখন সে তার ব্যর্থতার কথা চিন্তা ক’রে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ ক’রে শোক করে।”
💠 “তাদের পালন-পোষনে অসমর্থ দেখে তাঁর পত্নী এবং অন্যান্য আত্মীয়রা তাকে আর আগের মত সম্মান করে না, ঠিক যেমন নির্দয় কৃষকেরা বৃদ্ধ বলদকে অযত্ন করে।”
💠 “কিন্তু তা সত্বেও সেই মূর্খ সংসার জীবনের প্রতি বিরক্ত হয় না। যাদের সে একসময় পালন করেছিল তাদেরই দ্বারা অবজ্ঞাভরে সে পালিত হয়। জরার(শরীরের বার্ধক্যদশার) প্রভাবে বিরূপ আকৃতি হয়ে, সে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে।”
💠 ” এইভাবে সে গৃহে ঠিক একটি পোষা কুকুরের মত থাকে এবং অবহেলাভরে তাকে যা দেয়া হয় তাই সে খায়। অগ্নিমান্দ্য, অরুচি আদি নানারকম রোগগ্রস্ত হয়ে, সে কেবল অল্প একটু আহার করে, এবং অক্ষম হওয়ার ফলে, কোন রকম কাজ করতে পারে না।”
❈ কৃষ্ণচেতনাহীন মানুষের মৃত্যু কেমনভাবে হয় ও কেমনভাবে পাপাত্মা নরকে গমন করে? ❈
💠 “সেই রুগ্ন অবস্থায়, ভিতরের বায়ুর চাপে, তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে, এবং কফের দ্বারা তার শ্বাসনালী রুদ্ধ হয়ে যায়। তার নিঃশ্বাস নিতে তখন খুব কষ্ট হয় এবং তার গলা দিয়ে ‘ঘর্-ঘর্’ শব্দ বের হয়।”
💠 “এই ভাবে সে মৃত্যুশয্যায় শয়ন করে। তার আত্মীয় এবং বন্ধুরা তাকে ঘিরে তখন শোক করতে থাকে, এবং যদিও সে তাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তবুও কালপাশের বশবর্তী হয়ে সে আর তাদের কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।”
💠 “এইভাবে অসংযত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কুটুম্বভরণে ব্যাপৃত ব্যক্তি তার আত্মীয়-স্বজনদের এইভাবে ক্রন্দন করতে দেখে গভীর দুঃখে তার প্রাণ ত্যাগ করে। সে অসহ্য বেদনায় অচেতন হয়ে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।”
💠 “মৃত্যুর সময় ক্রোধে উন্মত্ত লাল চক্ষু বিশিষ্ট ভয়ংকর যমদূতদের সে তার কাছে আসতে দেখে, এবং তখন মহাভয়ে সে মলমূত্র ত্যাগ করতে থাকে।”
💠 “রাজ্যের পাহারাদারেরা এরা যেমন অপরাধীকে দণ্ড দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করে, তেমনি যে ব্যক্তি অপরাধজনক ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কার্যে যুক্ত ছিল, তাকে যমদূতেরা একটি শক্ত দড়ি দিয়ে তার গলায় বাঁধে এবং তার সূক্ষ্ম দেহকে আবৃত করে, যাতে তাকে অত্যন্ত কঠোর দণ্ড দেওয়া যায়।”
💠 “এইভাবে যমদূতেরা যখন তাকে নিয়ে যায়, তখন তার হৃদয় বিদীর্ণ হয় এবং তার সর্ব শরীর কাঁপতে থাকে। পথিমধ্যে কুকুরেরা তাকে কামড়াতে থাকে এবং তখন সে তার সমস্ত পাপ কর্মের কথা স্মরণ করে । এইভাবে সে অত্যন্ত ব্যথিত হয়।”
💠 “পাপী আত্মাকে তীব্র সূর্য-কিরণে তপ্ত বালির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, যার দুপাশে দাবানল জ্বলে। সে যখন হাঁটতে অসমর্থ হয় তখন যমদূতেরা তার পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করে, এবং সে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় পীড়িত হলেও দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কোন জল নেই, আশ্রয় নেই এবং বিশ্রামের কোন স্থান নেই।”
💠 “যমালয়ের পথে যেতে যেতে সে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে পড়ে যায় এবং কখনো কখনো সে অচেতন হয়ে পড়ে কিন্তু তাকে জোর করে উঠতে বাধ্য করা হয় । এইভাবে শীঘ্রই তাকে যমরাজের সামনে নিয়ে আসা হয়।”
💠 “এইভাবে দুই-তিন মুহূর্তের মধ্যে তাকে নিরানব্বই হাজার যোজন [৮ মাইলে এক যোজন, (৯৯০০০০×৮= ৭,৯২,০০০মাইল)] পথ অতিক্রম করতে হয় এবং তারপর তাকে তৎক্ষণাৎ ঘোর যন্ত্রণাদায়ক দণ্ডদান করা হয়, যা ভোগ করতে সে বাধ্য হয়।”
💠 ভগবান বললেন ━ পাপী আত্মাকে যমালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ” তাকে জ্বলন্ত অঙ্গারের মধ্যে রেখে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দগ্ধ করা হয়, কখনো কখনো তার নিজের মাংস তাকে খেতে বাধ্য করা হয়, অথবা অন্যেরা তার মাংস খায়।”
💠 “নরকের হিংস্র কুকুর এবং শকুনেরা তার নারী সকল টেনে বার করে, এবং তা সত্ত্বেও সে জীবিত থাকে এবং তা সে নিজের চোখে দেখে সর্প, বৃশ্চিক (বিছা), বিষাক্ত দংশক ইত্যাদি প্রাণী তাকে দংশন করে এবং তার ফলে সে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করে।”
💠 “তারপর তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি খণ্ড-খণ্ড করে কাটা হয় এবং হস্তির দ্বারা বিদীর্ণ করা হয়। তাকে পর্বত শৃঙ্গ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়, এবং জলে অথবা গুহায় তাকে অবরুদ্ধ করা হয়।”
💠 “পুরুষ এবং স্ত্রী যাদের জীবন অবৈধ যৌন আচরণের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়েছিল, তাদের তামিস্র, অন্ধতামিশ্র এবং রৌরব নামক নরকে নানাপ্রকার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।”
💠 “ভগবান বললেন ━ কখনও কখনও বলা হয় যে এই পৃথিবীতেই নরক অথবা স্বর্গের অনুভব হয় কারণ কখনও কখনও এই পৃথিবীতেও নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখা যায়।”
💠 “যে মানুষ পাপ কর্মের দ্বারা নিজেকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করেছিল, এই শরীর ত্যাগ করার পর, তাকে নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, এবং তার আত্মীয়-স্বজনদেরও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।”
💠 “তার বর্তমান শরীর ত্যাগ করার পর, সে একলা নরকের গভীরতম অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে ও সেখানে সে অন্য প্রাণীদেরকে হিংসা করে, যে ধন সারাজীবনে অর্জন করেছিল সব ছেড়ে এখন সে নিঃস্ব, জীবনের সঞ্চিত পাপকে পাথেয় রূপে সে সঙ্গে নিয়ে যায়।”
💠 ” এইভাবে পরমেশ্বর ভগবানের ব্যবস্থাপনায় যমরাজের তত্ত্বাবধনে আত্মীয় স্বজন পোষণকারী ব্যক্তিকে তার পাপ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য নারকীয় অবস্থায় নিক্ষেপ করা হয়, তার অবস্থা তখন হৃত-সর্বস্ব ব্যক্তির মত হয়। অতএব যে ব্যক্তি অবৈধ উপায়ে তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন পালনে অত্যন্ত উৎসুক; সে অন্ধতামিশ্র নামক নরকের গভীরতম অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে।”
💠 “সমস্ত কষ্টকর নারকীয় অবস্থা ভোগ করার পর, এবং ৮৪ লক্ষ যোনির মধ্যে ৮০ লক্ষ যোনি নিম্নতম পশু-জীবন অতিক্রম করে শেষ ৪ লক্ষ যোনি পুনরায় এই পৃথিবীতে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে।”
বিষ্ণুপুরাণে বর্ণনা থেকে জানা যায় ৮৪ লক্ষ রকমের জীবযোনির মধ্যে ৮০ লক্ষ জীবযোনি অতিক্রম করার পর মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে।
জলজা নবলক্ষাণি স্থাবরা লক্ষবিংশতিঃ।
কৃময়ো রুদ্রসংখ্যকাঃ পক্ষিণাং দশলক্ষণম্ ।
ত্রিংশল্লক্ষাণি পশবঃ চতুর্লক্ষাণি মানুষা।।
★ ২০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির বৃক্ষ যোনিতে জন্ম হয়। এই যোনিতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। রৌদ্রের তাপ লাগে, ঝড় বৃষ্টির ফলে ডালপালা ভাঙ্গে। শীতকালে সব পাতা ঝরে যায়, কুঠার বা tree cutter দিয়ে ডালপালা বা গাছটাই কাটা হয়। প্রকৃতি বা মনুষ্য জাতি থেকে আরো অনেক প্রকার কষ্ট পায়।
(তুলসী বৃক্ষ হয়ে জন্মানোর পর বৃক্ষ যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
★ তারপর ৯ লক্ষ প্রকার প্রজাতির জলচর যোনিতে জন্ম হয়। হাত নেই, পা নেই শুধু দেহ আর মাথা। তবে মাছেরা সামান্য পাখনা দিয়ে বহু গুন ভারী শরীরটাকে বয়ে বেড়ায়। খায় জলজ কীটপতঙ্গ, আগাছা, শ্যাওলা, নোংরা, পচা মাংস আর যা পায়। একজন অন্যজনের মাংস খেয়ে জীবন রক্ষা করে।
(শঙ্খ রূপে জন্ম এবং ভগবানের পূজা অর্চনায় ব্যবহারের পর জলজ জীব যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
★ তারপর ১১ লক্ষ প্রকার প্রজাতির কীটপতঙ্গ যোনিতে জন্ম হয়।
(মৌমাছি রূপে জন্ম এবং তার তৈরি মৌচাকের মধু ভগবানের পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত হলে কীটপতঙ্গ যোনি থেকে মুক্তি ঘটে)।
★ তারপর ১০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির সরীসৃপ ও পক্ষী যোনিতে জন্ম হয়। তাদের ঘর বাড়ি নেই। গাছে, ফাঁকফোঁকর, গর্তে, কুঠুরিতে বসবাস করে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, পচা গলা খাবার বা দেহাংশ যা পায় তা খায়। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে খায়, কখনও স্বপ্রজাতি স্বপ্রজাতিকে ভক্ষন করে। সাধারনত নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়। যখন সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে চলাফেরা করতে পারে বা উড়তে পারে, তখন আর ফিরেও তাকায় না। যদি কাক, শকুন বা ঈগল হয়ে জন্মায় তবে অনেক দিন বেঁচে থাকে।
(ডিমের মধ্যে জন্ম হতে হতে ময়ূর রূপে জন্ম এবং তার পালক ভগবানের মাথার চূড়ায় বা তাঁর পূজা অর্চনা বা আরতিতে ব্যবহৃত হলে এই যোনি থেকে উদ্ধার হয়)।
★ তারপর ৩০ লক্ষ প্রকার প্রজাতির পশু যোনিতে জন্ম হয়। নানা পশু নানা কষ্ট পায়। কোনো পশু হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত। কেউ বা লোকালয়ে লুকিয়ে থাকে। কেউ একে অন্যকে মেরে খায়। কেউবা ঘাস-তৃণ খায়, হাল চষে, গাড়ি টানে। যতো রোগ-শোকই হোক, দিন-রাত মল মূত্রের সাথেই বাস করতে হয়।
(বাঘ, সিংহ, কুকুর, বিড়াল, হায়না, শিয়াল প্রভৃতি জন্ম পার হয়ে গাভী রূপে জন্ম এবং তার থেকে প্রাপ্ত দুধ, মাখন, ঘি ভগবানের সেবায়, ভোগে বা তাঁর পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত হলে তার পশু যোনী বা গর্ভ থেকে মুক্তি ঘটে। সুতরাং গো-যোনিতে জন্ম লাভ পশুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। গো-র শেষ আর পশু জন্ম নেই।)
★ অবশেষে ৪ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির মনুষ্য যোনিতে জন্ম হয়।
— প্রথমে বন্য মানুষ রূপে জন্ম হয়। তারা বনের মধ্যে বসবাস করে জীবনধারন করে এবং পশুসম খাবার খায়। তাদের আত্ম-পর জ্ঞান নেই।
— তারপর পাহাড়িয়া জাতির জন্ম হয়। নাগা, কুকি, সাঁওতাল ইত্যাদি।
— তারপর জন্ম হয় অধম কুলে। তারা দেবধর্ম মানে না। অপকর্ম করে। মদ্য পান করে।
— তারপর শুদ্রকুলে জন্ম। যা কর্ম করে তা নিজেই ভোগ করে। কেউ অন্ধ, কেউ কানে শুনে না ইত্যাদি হয়। কারো স্বভাব ভাল হয় কর্মগুণে।
— তারপর জন্মায় বৈশ্য জাতি কুলে। কর্ম অনুযায়ি ফল ভোগ করে ওরা।
— তারপর জন্ম হয় ক্ষত্রিয় কুলে। কর্ম ফলে ফল ভাগী হয়।
— অবশেষে ব্রাহ্মণকুলে জন্মায়। এখানে আর একাধিকবার জন্ম হয় না। উত্তম ব্রাহ্মণ জন্ম তার শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মজ্ঞান থাকলেই সে ব্রাহ্মণ। নিজের উদ্ধারে সে আত্মজ্ঞান লাভ করে। শুধু ব্রাহ্মণ কুলে জন্মালেই উদ্ধার হওয়া যায় না। যদি সে জ্ঞান লাভ করতে না পারে, তবে পুনরায় সে চুরাশি লক্ষ যোনি পথে ভ্রমণ করে। বারবার জন্মলাভে কষ্ট পায়। আর কোনো উপায় নেই যদি না ভগবানের শরণাগত হয়। বড় দূর্লভ এই মানব জীবন, অনেক রাস্তা পার করে এখানে আসতে হয়েছে, তাই এই দূর্লভ মানব জীবনকে সফল করা নিজেদের কর্তব্য, দিব্য কৃষ্ণ নাম করে মুক্তির পথ প্রশস্ত করো।
৮০ লক্ষ প্রকারের প্রজাতির জীবকে মানবেতর প্রাণী বলা হয়।
💠 অতএব উপরোক্ত ভাগবত কথামৃত থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণচেতনাহীন মানুষ পাপ কর্মের ফল ভোগ করার জন্য নরকে গিয়ে অশেষ যন্ত্রনা ভোগ করার পর, ৮০ লক্ষ প্রকার নিম্নযোনিতে (সাপ, ব্যঙ, পোকামাকড়, বৃক্ষাদি) দেহধারন ক’রে অত্যন্ত নিম্নস্তরের জীবন যাপন ক’রে পাপের ফল ভোগ করার পরে পুনরায় মনুষ্য জন্মলাভ করে। সুতরাং একবার গভীরভাবে ভাবুন যে এই মনুষ্য জন্মটা কতটাই মূল্যবান!
যদি আমরা কৃষ্ণচেতনাহীন হয়ে কৃষ্ণভজন না করে ভোগবিলাসের সঙ্গে আত্ম-ইন্দ্রিয়-তৃপ্তি ক’রে মৃত্যুবরণ করি তাহলে বীভৎস পরিনাম প্রাপ্তির ভবিষ্যত নিজেই তৈরি করে নেব। তাই, হে মনুষ্য জাতি! অবহেলা না ক’রে আজই আমরা এখন থেকেই কৃষ্ণচরণে শরণাগত হয়ে তাঁর নিত্য প্রেমময়ী সেবায় নিযুক্ত হয়ে মনুষ্য জন্মকে সার্থক করার শপথ গ্রহণ করি।
► আরও পড়ুন: জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র (Cycle of Birth and Death) ও ৮৪ লক্ষ যোনি
► আরও পড়ুন: ত্রিতাপ ক্লেশ / ত্রিতাপ দুঃখ কি? (What is Tritaap Kleshas)