🕉️ কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি সকলের জন্য শুভপ্রদ, যদিও বৈষ্ণব সমাজের কাছে কার্তিক তথা দামোদর মাসে প্রতিটি ক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ, প্রতিটি দিন শুভ মঙ্গলময়। শাস্ত্র অনুসারে কার্তিক মাসে বা দামোদর মাসে পুণ্য ও পাপ উভয় কর্মের জন্যই শতসহস্র গুণ বেশি পূণ্য ও শাস্তি প্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ পূণ্য করলে শতসহস্র গুণ বেশি পূণ্য প্রাপ্ত হবে এবং পাপ করলে শতসহস্র গুণ বেশি পাপ প্রাপ্ত হবে।
🕉️ এই কার্তিক মাসের কৃষ্ণ-ত্রয়োদশী তিথিতে ধনতেরস (Dhanteras) উৎসব পালন ও যমরাজের উদ্দেশ্যে দীপদান (Yama Deepam) দেওয়া হয়।
✤ ২০২৩: ধনতেরস ও যমরাজের উদ্দেশ্যে দীপদান সময়সূচী ✤
✺ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 11 নভেম্বর 2023 শনিবার ।
✺ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৪শে কার্তিক ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, কৃষ্ণ পক্ষ, ত্রয়োদশী।
✤ কার্তিকে ধনতেরস (Dhanteras) মাহাত্ম্য ✤
🕉️ ধনতেরস বা ধন ত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী হলো হিন্দুদের অন্যতম জনপ্রিয় একটি উৎসব। সারা ভারত জুড়ে সকল ধার্মিক হিন্দুরা এই উৎসবে ভক্তি এবং শ্রদ্ধা সহকারে পালন করে থাকে। এটি ‘ধনাত্রয়োদশী’ বা ‘ধনবত্রী ত্রয়োদশী’ নামেও পরিচিত। “ধন” শব্দের মানে সম্পত্তি। ত্রয়োদশী শব্দের অর্থ হিন্দু ক্যালেন্ডারের ১৩তম দিন।
🕉️ শাস্ত্র অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন ভগবান ধন্বন্তরী অমৃতের কলস, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ও ভেষজাদি হাতে নিয়ে ক্ষীরসমুদ্র থেকে আবির্ভূত হন। এটা বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান বিষ্ণু মহাবিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারের জন্যই ধন্বন্তরীর অবতার রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। পুরাণ মতে ভগবান ধন্বন্তরী হলেন দেবতাদের চিকিৎসক। তার পূজা করলে শরীর রোগমুক্ত হয়।
🕉️ ধন্বন্তরীর আবির্ভাবের স্মরণে প্রতি বছর কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিনে ধনতেরাস উৎসব পালিত হয়। তাই ধনতেরাসকে ধনত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরী-ত্রয়োদশী বলা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় সমস্ত দেবতা এবং অসুরদের দ্বারা যৌথভাবে প্রাপ্ত চৌদ্দ রত্নগুলির মধ্যে ধন্বন্তরী এবং মাতা লক্ষ্মী অন্যতম। ধনত্রয়োদশী মান্যতা আছে যে, ভগবান ধন্বন্তরীর জন্মের দুই দিন পরে দেবী লক্ষ্মী আবির্ভূতা হন, তাই ধনতেরসের দু’দিন পরে দীপাবলি উৎসব উদযাপিত হয়।
🕉️ কালীপূজার আগের দিন যে ত্রয়োদশী তিথি আসে সেটাই ধনত্রয়োদশী বা ধনতেরাস। ধনতেরাসের এই শুভ লগ্নে সকলের সমৃদ্ধি কামনায় গৃহস্থ বাড়িতে কেনা হয় মূল্যবান ধাতু (বিশেষত সোনা বা রূপো) ৷ বলা হয় যে, এই দিন মূল্যবান ধাতুর জৌলুসে আকৃষ্ট হয়ে মা লক্ষী স্বয়ং আসেন গৃহস্থের বাড়িতে।
🕉️ হিন্দু পৌরানিক কাহিনি অনুসারে, দীপাবলি কিংবা ধনতেরাসের দিন যারা গৃহে ১৩টি মাটির প্রদীপ দিয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখে, তার গৃহে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি সারা বছর বজায় থাকে।
🪔🛕 ইন্দ্রকে দুর্বাশা মুনির অভিশাপ ও সমুদ্র মন্থন🛕🪔
===================================
বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে সমুদ্র মন্থনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একবার এক অপ্সরা স্বর্গের ফুল পারিজাতের মালা পরিহিতা হয়ে ভ্রমণ করছিলেন। দুর্বাসা মুনি সেই মালার সৌন্দর্য, সুমধুর গন্ধে এতটাই আনন্দিত হলেন যে, তিনি অপ্সরার থেকে সেই মালা চেয়ে নিলেন। অপ্সরাও স্বেচ্ছায় সেই মালা দুর্বাসা মুনিকে দান করলেন ও প্রণাম করে প্রস্থান করলেন। দুর্বাসা মুনি সেই মালা গলায় পরিধান করে ভীষণ আনন্দিত হলেন এবং নানা স্থানে ভ্রমন করতে লাগলেন।
এমন সময়, দেবরাজ ইন্দ্র, ঐরাবত হাতির পিঠে চড়ে পরিভ্রমন করছিলেন। সেই সময় দুর্বাসা মুনিকে দেখে দেবরাজ ইন্দ্র ভক্তিসহকারে প্রণাম করলেন। ঋষি দুর্বাসা গলার সেই মালা পরিয়ে দিলেন ইন্দ্রের গলায়। কিন্তু রাজা ইন্দ্রদেব তুচ্ছ জ্ঞান করে সেই পুষ্পমাল্য ঐরাবতের গলায় পরিয়ে দিলেন। কিন্তু মালার তীব্র গন্ধ হাতির মধ্যে চাঞ্চল্যতার সৃষ্টি করল। হাতি শূঁড় দিয়ে মালা কন্ঠদেশ থেকে ছিঁড়ে ফেলে মাটিতে আছড়ে ফেলল, তারপর পা দিয়ে পিষ্ট করে দিল।
প্রিয় মালার এই কঠিন পরিনতিতে দূর্বাশা অপমানিত হলেন। রাগে-অপমানে তিনি ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, যেভাবে দম্ভ-অহংকারের কারণে ইন্দ্র তার মালাকে অপমান করে ভূলুন্ঠিত করেছেন, একদিন এই ভাবেই ইন্দ্র সহ সকল দেবতারা শক্তিহীন হবেন এবং তাদের মান-মর্যাদা, দম্ভ ভূলুণ্ঠিত হবে।
দুর্বাশা মুনির শাপে স্বর্গ একদা শ্রীহীন বা লক্ষ্মী-ছাড়া হয়ে যায়। সেই সুযোগে অসুররা দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে ত্রিভুবন দখল করতে লাগলেন। তখন ভগবান বিষ্ণুর পরামর্শে স্বর্গের ঐশ্বর্য ফিরে পাবার জন্য দেবগণ অসুরদের সাথে নিয়ে সমুদ্র-মন্থন শুরু করেন। মন্থন রজ্জু হলো বাসুকী নাগ। মন্থন দন্ড হলো মন্দার পর্বত। মন্থন দন্ডটি সাগরে নিমজ্জিত কূর্মদেব নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেন। মন্থনকারীরা দুই দলে বিভক্ত হলেন ━ বাসুকীর অগ্রভাগে দৈত্যগণ এবং পুচ্ছভাগে দেবতাগণ ।
🕉️ মন্থন করতে থাকলে কালকূট নামক ভয়ংকর বিষ উঠে এল। দেবাদিদেব শিব সেই বিষ পান করে জগতকে রক্ষা করলেন, কারন তিনি হলেন পরম বৈষ্ণব, ভগবান বিষ্ণু হলেন আরাধ্য। ব্রহ্মাকে জড় জগত সৃষ্টি, শিবকে সংহারের দায়িত্ব দিয়ে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন। একদিকে অসময়ে অকারনে ধ্বংস থেকে জগতকে রক্ষা করার সেবা, অন্যদিকে আরাধ্য ভগবানকে তুষ্ট করার সেবা ━ কেমন করে এক পরম বৈষ্ণব বঞ্চিত থাকতে পারেন। বিষ পান করে শিব হলেন নীলকণ্ঠ।
🕉️ সুরভী গাভী উঠে এল। সুরভী ঋষিগণ সেই গাভী গ্রহণ করলেন।
🕉️ উচ্চৈঃশ্রবা নামক এক উজ্জ্বল শ্বেত বর্ণের ঘোড়া উঠে এল। দৈত্যরাজ বলী সেই অশ্ব গ্রহণ করলেন।
🕉️ ঐরাবত নামে শ্বেত বর্ণের চার দাঁতওয়ালা হাতী উঠে এল। ইন্দ্র সেই হাতী গ্রহণ করলেন।
🕉️ কৌস্তুভ ও পদ্মরাগ মণি উঠে এল। ভগবান বিষ্ণু সেগুলি গ্রহণ করলেন। সমুদ্র হল অশেষ ধন-রত্নের আধার অর্থাৎ পরিপূর্ণ বলে সমুদ্রকে রত্নাকরও বলা হয়।
🕉️ পারিজাত নামক বৃক্ষ উঠে এল, ইন্দ্র তা গ্রহণ করলেন। অপ্সরাগণ উঠে এল, ইন্দ্র তাদেরকেও গ্রহণ করলেন।
🕉️তারপর লক্ষ্মীদেবী উঠে এলেন। সমুদ্র থেকে দেবীর উদ্ভব বলে দেবীকে বলা হয় সমুদ্রোদ্ভবা। কিশোরী কুমারী লক্ষ্মী অতুলনীয় সৌন্দর্যময়ী। সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবী ক্ষীর সমুদ্রকে পিতারূপে বরণ করে আবির্ভূতা হলেন। তিনি ঘটনাস্থলে স্বয়ংবর অনুষ্ঠান করে তাঁর পতি মনোনয়ন করতে অভিলাষ করলেন। সেখানে সুদর্শন ও ক্ষমতাশালী বড় বড় অসুরগণেরা ও বড় বড় দেবতারা সারিবদ্ধ হয়ে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মী বরণমাল্য নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। প্রত্যেককে পরীক্ষা করলেন। তাঁর আশ্রয় হওয়ার উপযুক্ত কাউকেই খুঁজে পেলেন না।
তারপর লক্ষ্মীদেবী দেখতে পেলেন, শ্রীহরি সবেমাত্র সভায় প্রবেশ করলেন। অমনি লক্ষ্মীদেবী তাঁর দিকেই দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাঁকে বরণ মালা পরিয়ে দিয়ে এমনভাবে সলজ্জভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন যাতে শ্রীহরি তাঁর বক্ষে লক্ষ্মীকে আকর্ষণ করে নেন।
🕉️এরপর স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু মোহিনী অবতারে অসুরদের মোহাচ্ছন্ন করলেন, সেই সুযোগে সমুদ্র মন্থন থেকে প্রাপ্ত অমৃত দেবতারা পান করলেন এবং হারানো শক্তি আবার ফিরে পেলেন। সেই অমৃত কলসের প্রতীক রূপে ধনতেরাস উৎসব পালন করা হয়। ধাতুর বাসন, সোনার অলংকার কেনাকে এই দিন সৌভাগ্যের প্রতীক বলে ধরা হয়ে থাকে। হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনার উপাসনাই হচ্ছে ধনতেরাস। ধনতেরাসে শ্রীলক্ষ্মীর আরাধনার মাধ্যমে সূচনা হয় দীপাবলী উৎসবের।
🪔🛕 রাজা হিমের পুত্রের কাহিনী🛕🪔
=======================
কথিত আছে রাজা হিম তার পুত্রের কুষ্টি বিচার করে জানতে পারেন যখন তার পুত্র ১৬ বছর হবে তখন বিয়ের সময়ে চতুর্থ রাতে সর্প দংশনে তার মৃত্যু হবে এমনই ছিল বিধাতা পুরুষের ভাগ্য লিখন। কিন্তু নববিবাহিতা স্ত্রী সেকথা শুনে মেনে নিতে নারাজ। সেই অভিশপ্ত দিনে তাদের স্বয়ং কক্ষের দরজায় যাবতীয় সোনা রুপোর গয়না স্তুপ করে রেখে চারিধারে প্রদীপ জেলে রাখল। তারপর গল্প আর গান করে স্বামীকে সারারাত জাগিয়ে রাখল। ঘুমোতে দিল না সারারাত।
এদিকে সাপের ছদ্মবেশে কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রদীপের আলোয় সোনার ছটায় যমরাজের চোখ গেল ধাঁধিয়ে। সোনার স্তুপ এর উপর দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলেন ঠিকই কিন্তু নববধূর গল্প আর গান শুনে মোহিত হয়ে তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে উঠে লজ্জিত হয়ে রাজপুত্রের প্রাণ না নিয়েই ফিরে গেলেন যমরাজ। সোনার ছটায় মৃত্যুর হাত থেকে রাজপুত্রের রক্ষা পাবার এই ঘটনাকে সামনে রেখেই পালিত হয় ধনতেরাস উৎসব । অর্থাৎ এখানেও সেই সৌভাগ্যের আহ্বান করা হয়।
✤ কার্তিকে যমরাজকে দীপদান (Yama Deepam) মাহাত্ম্য ✤
🕉️ পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে- “যখন কার্তিক মাসের কৃষ্ণ-ত্রয়োদশী তিথিতে কেউ গৃহের বাইরে যমরাজের উদ্দেশ্যে একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ অকালমৃত্যুর বিপদ থেকে মুক্ত হন।”
তাই এই দিন সন্ধ্যায় সবাই গৃহের বাইরে অর্থাৎ তুলসী তলায়, উঠানে বা বাড়ির ছাদে যমরাজ এর উদ্দেশ্যে দীপ দান করবেন।
🪔🛕 যমরাজকে দীপদান মন্ত্র 🛕🪔
=======================
❝মৃত্যুণা পাশ দণ্ডাভ্যাম্ কালঃ শ্যামলয়া সহ।
ত্রয়োদশ্যাম দীপদানাৎ সূর্য্যজঃ প্রিয়তাম্॥ ❞
অনুবাদ: ‘কৃষ্ণ-ত্রয়োদশী তিথিতে এই দীপদানের দ্বারা যেন সূর্য্যপুত্র ও মূর্তিমান কালস্বরূপ যমরাজ আমার ওপর প্রসন্ন হন। তিনি পাশ, দণ্ড ও স্বয়ং মৃত্যুকে ধারণ করেন ও স্বয়ং দুর্গাদেবী তাঁর সঙ্গে অবস্থান করেন।’
► আরও পড়ুন: Kola Bou || নবপত্রিকা (কলা বউ বা কলা বৌ) কে? কেনো একে পূজা করা হয় ??
► আরও পড়ুন: Who is Devi Durga? দেবী দুর্গা কে? দশ হাতে অস্ত্র কি কি?