Join to Our Community
Community Grows With You

পিতৃপক্ষ (Pitru Paksha)✤মহালয়া (Mahalaya)✤দেবীপক্ষ (Devi Paksha) কি?

মহালয়া মানেই পিতৃপক্ষের অবসান, দেবীপক্ষের শুরু। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া।

১ (এক)-এ চন্দ্র এবং ২ (দুই)-এ পক্ষ একথা আমরা সবাই জানি। অর্থাৎ চাঁদ হল একটি এবং এই চন্দ্রকলার হ্রাস ও বৃদ্ধির ফলে দুটি পক্ষ তৈরি হয়। এই পক্ষদুটি হচ্ছে শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষ। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে চাঁদ এক কলায় হ্রাস পায়, আবার এক কলায় বৃদ্ধি পায়। এখানে কলা হচ্ছে চাদের ১৬টি ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ১৬ কলা মিলে তৈরি হয় এক একটি পক্ষ।

চাঁদ যে পক্ষে হ্রাস পায় সেটি হলো কৃষ্ণপক্ষ। এই পক্ষে চাঁদ ক্ষয় হতে থাকে এবং অমাবস্যায় সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্যদিকে যে পক্ষে চাঁদ বৃদ্ধি পায় সেটি হলো শুক্লপক্ষ। এই পক্ষে চাঁদের আকার ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পূর্নিমায় পূর্ণচন্দ্রে পরিনত হয়। অন্যদিকে তিথি হচ্ছে চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধি দ্বারা সীমাবদ্ধ কাল। যেমন প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া এভাবে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা পর্যন্ত এ তিথি বিস্তৃত।

এমনিভাবে বছরের ১২মাসে মোট ২৪টি পক্ষ রয়েছে, তার মধ্যে ২টি পক্ষ বিশেষভাবে তাৎপৰ্যপূৰ্ণ। এই পক্ষদুইটি হচ্ছে পিতৃপক্ষ দেবীপক্ষ। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা থেকে শুরু করে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা পর্যন্ত স্থায়ী হয় পিতৃপক্ষ বা অপরপক্ষ। এবং এই পিতৃপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ অমাবস্যাকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়ার পরের দিন (অর্থাৎ প্রথমা বা প্রতিপদ) থেকে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত স্থায়ী হয় দেবীপক্ষ। অর্থাৎ মহালয়া হচ্ছে পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের মিলনক্ষণ।

শুক্লপক্ষের দিনগুলি হল — 

(১) প্রথমা বা প্রতিপদ (২) দ্বিতীয়া (৩) তৃতীয়া (৪) চতুর্থী (৫) পঞ্চমী (৬) ষষ্ঠী (৭) সপ্তমী (৮) অষ্টমী (৯) নবমী (১০) দশমী (১১) একাদশী (১২) দ্বাদশী (১৩) ত্রয়োদশী (১৪) চতুর্দশী (১৫) পূর্ণিমা

কৃষ্ণপক্ষের দিনগুলি হল — 

(১) প্রথমা বা প্রতিপদ (২) দ্বিতীয়া (৩) তৃতীয়া (৪) চতুর্থী (৫) পঞ্চমী (৬) ষষ্ঠী (৭) সপ্তমী (৮) অষ্টমী (৯) নবমী (১০) দশমী (১১) একাদশী (১২) দ্বাদশী (১৩) ত্রয়োদশী (১৪) চতুর্দশী (১৫) অমাবস্যা

─•••━━━━━●•⊱♦️✥♦️⊰•⊰❃*❀❁❁❀*❃⊱⊱♦️✥♦️⊰●•━━━━•••─

👣 পিতৃপক্ষ ও তর্পণ কি? 👣

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা থেকে শুরু করে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা পর্যন্ত স্থায়ী হয় পিতৃপক্ষ বা অপরপক্ষ

◼️ পিতৃপক্ষ বা অপরপক্ষ (Pitru Paksha) ◼️

🕉️ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, কোন জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে অবস্থান করেন।───এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান।পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গ বা নরকে গমন করেন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

🕉️ শাস্ত্রমতে পিতৃপক্ষে পরলোকগত পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে তর্পণ (জলদান) করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। যারা পরলোকগত পূর্বপুরুষের মৃত্যুতিথিতে বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে না পারেন, তাঁদের জন্য পিতৃপক্ষের নির্দিষ্ট মৃত্যুতিথিতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করার বিধান শাস্ত্রসম্মত।

🕉️ অমাবস্যা তিথি প্রেতকর্মের জন্য শুভ বা প্রশস্ত হওয়ার কারণে পিতৃপক্ষের অমাবস্যা তিথি পরলোকগত পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জলদানের পক্ষে শুভ। যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে এ সময় পিতৃ পুরুষেরা আসেন। তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল, দান করা হয়। এবং তাহাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদান করা হয়। হরিদ্বার, গয়া ইত্যাদি স্থানে পিণ্ডদান করলে পূর্বপুরুষরা প্রসন্ন হন এবং তৃপ্তি লাভ করেন। পিতৃপক্ষে পরলোকগত পূর্বপুরুষকে জল দান করলে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদে সংসারে বাধাবিঘ্ন নাশ হয়, সংসারে শান্তি আসে, শ্রী বৃদ্ধি হয়।

🕉️ শাস্ত্রমতে, মহালয়া তিথিতে দেবী দুর্গা মর্তে আগমন করেন। এই অর্থে মহালয়া তিথি পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ। আশ্বিনের অমবস্যার পরবর্তী তিথি প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা এবং শেষ হয় আশ্বিনের পূর্ণিমাতে যাকে কোজাগরী পূর্ণিমা বলা হয়। শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গা মহিষাসুর নিধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এই মহালয়া তিথিতে।

◼️ তর্পণ (Mahalaya Tarpan) ◼️

তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি হল তৃপ + অনট। ‘তৃপধাতুর অর্থ তৃপ্তি সাধন করা। এখানে তৃপ্তি সাধন বলতে দেব-ঋষি- পিতৃ-মনুষ্যগণের তৃপ্তিসাধনকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণভাবে মৃত পূর্বপুরুষগণকে জলদান করাকেই তর্পণ বলা হয়। মৃত পূর্বপুরুষ শব্দে যাদের সপিণ্ডীকরণ (বাৎসরিক শ্রাদ্ধ) করা হয়েছে তাদের বোঝাবে। কিন্তু কোনও জীবৎপিতৃক (যার পিতা জীবিত আছে) ব্যক্তি তর্পণ করতে পারবে না। আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের বংশধরগণের কাছে পিণ্ড ছাড়াও জল কাঙ্খা করেন।

কারণ হিন্দু শাস্ত্রানুসারে দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। তাই আমাদের পিতৃগণের দেহে যে আত্মা ছিলেন তিনি এখন যে শরীরেই অবস্থান করুন সেই শরীরেই জলক্রিয়া ও শ্রাদ্ধের দ্বারা তিনি তৃপ্তি লাভ করে থাকেন। শাস্ত্রমতে তর্পণ জলের ও শাস্ত্রীয় দ্রব্যের পরমাণু অর্থাৎ সূক্ষ্মতম কণা মন্ত্রবলে তাঁর বর্তমান দেহের ভক্ষ্য বস্তুর পরমাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে। তাই দেব-ঋষি-পিতৃ-মনুষ্যগণের তর্পণ করলে তাঁরা খুশি হন ও বিনিময়ে তাঁরা আমাদের সুখ, সমৃদ্ধি, সাফল্য, পরিপাকশক্তির বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু দান করেন।
তর্পণ প্রতিদিনই করা উচিত। কিন্তু নানা কাজে মানুষ ব্যস্ত থাকায় পিতৃপক্ষের (ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা থেকে শুরু করে আশ্বিন মাসের অমাবস্যা পর্যন্ত অর্থাৎ মহালয়া পর্যন্ত) পনেরো দিন তর্পণ করে থাকে। যারা তাতেও অক্ষম তারা মহালয়ার দিন তর্পণ করে। স্নানাঙ্গ-তর্পণ স্নানের পরে করতে হয়। স্নান শেষে পূর্বমুখে নদীতে নাভিমাত্র জলে দাঁড়িয়ে, তিলক ধারণ করবেন।
তর্পণ হল ধর্ম অনুযায়ী “জলের দ্বারা কৃত পিতৃপুরুষ এবং দেবতাদের তৃপ্তি বিধায়ক একটি অনুষ্ঠান”, একে অনেকে পিতৃযজ্ঞও বলে থাকেন। এই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রমুখ দেবতা, সনক-সনন্দ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ যম ও দ্বাদশ পূর্বপুরুষ (পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহীবৃদ্ধপ্রমাতামহী) এবং ত্রিভুবনের উদ্দেশ্যে জল দেওয়া হয়। পিতৃপক্ষের সময় তিলতর্পণ অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ তিল-মেশানো জলে তর্পণ হয়। তর্পণ শাস্ত্রমতে নিত্যকর্তব্য, তবে আজকের এই ব্যস্ততম যুগে রোজ বাপ-ঠাকুরদাদের স্মরণ করা সম্ভব হয় না বলে, লোকে পিতৃপক্ষে এবং বিশেষ করে – সর্বপিতৃ অমাবস্যায় (যে দিনটিকে আমরা ‘মহালয়া’ বলে থাকি) তিলতর্পণ করেই পিতৃকৃত্য সেরে থাকে।
তর্পণ মানে খুশি করা। ভগবান শ্রীরাম লঙ্কাবিজয়ের আগে এই দিনে এমনই করেছিলেন। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে প্রয়াত পূর্বপুরুষকে স্মরণ করে, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করা হয়।

◼️ তর্পণ বিধি  ◼️

তর্পণকারীকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধূতি পরে শ্রাদ্ধ করতে হয়। গঙ্গাতে স্নান উত্তম। 

শ্রাদ্ধের পূর্বে তর্পণকারীকে কুশাঙ্গুরীয় (কুশ ঘাসের আঙটি) ধারণ করতে হয় দুই হাতের অঙ্গুরীয় আঙ্গুলে। এরপর সেই আঙটিতে পূর্ব পুরুষদের আবাহন করা হয়। স্নানাঙ্গ-তর্পণ স্নানের পরে করতে হয়। স্নান শেষে পূর্বমুখে নদীতে নাভিমাত্র জলে দাঁড়িয়ে, তিলক ধারণ করবেন।

আচমন ও বিষ্ণু স্মরণ
=================

হাত জোড় করে তর্পণের শুরুতে আচমন ও বিষ্ণু স্মরণ করবেন

ওঁ কেশবায় নমঃ, ওঁ নারায়ণায় নমঃ, ওঁ মাধবায় নমঃ
ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্॥

ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ।


আচমন শেষে হাতজোড় করে বলবেন

নমো বিষ্ণুঃ, নমো বিষ্ণুঃ, নমো বিষ্ণুঃ।

❝ ওঁ অপবিত্র পবিত্রবা সর্বাবস্থাং গতোঽপিবা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ॥ ❞ 

 তীর্থ আবাহন 
=============

দক্ষিণ অভিমুখে হাতজোড় করে নিচের মন্ত্রে তীর্থ আবাহন করবেন

❝ ওঁ নমঃ কুরুক্ষেত্রং গয়া-গঙ্গা-প্রভাস-পুষ্করাণি চ।
পুণ্যান্যেতানি তীর্থানি তৰ্পণ-কালে ভবস্তিহ॥ ❞ 

দেব-তর্পণ 
============

এরপর করতে হবে দেব-তর্পণ ━

পূর্বমুখী হয়ে প্রথমে দেবতর্পণ করতে হয়। বাম হাত ও দক্ষিণ হাতের আঙ্গুলের করজোড়ে তাম্রকোষ ধরে তিল ও তুলসি সহযোগে নিচের মন্ত্রে প্রত্যেককে এক অঞ্জলি জলপ্রদান করবেন।

❝ ওঁ ব্রহ্মাস্ তৃপ্যতাম্।
ওঁ বিষ্ণুস্তূপ্যতাম্।
ওঁ রুদ্রস্তূপ্যতাম্।
ওঁ প্রজাপতিস্তূপ্যতাম্। ❞

এরপরে নিম্নলিখিত মন্ত্র মন্ত্র পড়ে পূর্বদিকে মুখ করে এক অঞ্জলি জল, তিল ও তুলসী সহযোগে প্রদান করবেন।

❝ ওঁ নমঃ দেবা যক্ষাস্তথা নাগা, গন্ধবর্ব-অপ্সরা-সোহসুরাঃ।
ক্রূরাঃ সর্পাঃ সূপর্ণাশ্চ তরবো জিহ্মগাঃ খগাঃ ॥
বিদ্যাধরা জলাধারা- স্তথৈবাকাশগামিনঃ।
নিরাহারাশ্চ যে জীবাঃ পাপে-ধমের্ম রতাশ্চ যে।
তেষাং আপ্যায়নায়ৈতৎ দীয়তে সলিলং ময়া॥ ❞

অনুবাদ: দেব, যক্ষ, নাগ, গন্ধবর্ব, অপ্সরা, অসুর, ক্রুরস্বভাব জন্তু, সর্প, সুপর্ণ (গরুড়জাতীয় পক্ষী), বৃক্ষ, সরীসৃপ, সাধারন পক্ষী, বিদ্যাধর (কিন্নর; দেবলোকের গায়ক জাতি), জলচর, খেচর, নিরাহার (ভূতাদি ) এবং পাপে ও ধর্মকার্য্যেরত যত জীব আছে, তাহাদের তৃপ্তির জন্য আমি এই জল প্রদান করছি।

মনুষ্য-তর্পণ 
=============

এরপর ডানদিকে ঘুরে (দক্ষিণাবর্তে), উত্তরপশ্চিম মুখে (বায়ুকোণে) নিবীত হয়ে (পৈতাকে মালার ন্যায় ঝুলিয়ে) নিচের মন্ত্র দুইবার পাঠ করে দুই অঞ্জলি তিল ও তুলসীযুক্ত জল অর্পণ করবেন

❝ ওঁ নমঃ সনকশ্চ সনন্দশ্চ, তৃতীয়শ্চ সনাতনঃ ।
কপিলশ্চাসুরিশ্চৈব, বোঢ়ুঃ পঞ্চশিখস্তথা ।
সর্বেব তে তৃপ্তিমায়ান্তু, মদ্দত্তে-নাম্বুদা সদা॥ ❞

অনুবাদ:  সনক, সনন্দ, সনাতন, কপিল,আসুরি, বোঢ়ু ও পঞ্চশিখ প্রভৃতি সকলে মদ্দত্ত জলে সর্বদা তৃপ্তিলাভ করুন।

ঋষি-তর্পণ 
============

এরপরে দক্ষিণ অভিমুখে পুনরায় পূর্ববাস্য হয়ে নিচের মন্ত্র পাঠ করে দৈবতীর্থ দ্বারা প্রত্যেককে এক অঞ্জলি তিল-তুলসী যুক্ত জল অর্পণ করবেন

❝ ওঁ মরীচিস্তৃপ্যতাং, ওঁ অত্রিস্তৃপ্যতাং, ওঁ অঙ্গিরাস্তৃপ্যতাং ওঁ পুলস্তস্তৃপ্যতাং, ওঁ পুলহস্তৃপ্যতাং,
ওঁ ক্রূতুম্ভৃপ্যতাং, ওঁ প্রচেতাস্তৃপ্যতাং, ওঁ বশিষ্ঠস্তৃপ্যতাং, ওঁ ভৃগুস্তৃপ্যতাং ওঁ নারদস্তৃপ্যতাং।❞

 

দিব্য পিতৃ তর্পণ 
==============

বামদিকে ঘুরে দক্ষিণ মুখে, পৈতা দক্ষিণ স্কন্ধে নিয়ে নিম্নোক্ত সাতটি মন্ত্র পড়ে প্রত্যেককে এক অঞ্জলি তিল-তুলসী যুক্ত জল অর্পণ করবেন

১। ওঁ অগ্নিষ্বত্তাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
২। ওঁ সৌম্যাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
৩। ওঁ হবিষ্মন্তঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
৪। ওঁ উষ্মপাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
৫। ওঁ সুকালিনঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
৬। ওঁ বর্হিষদঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।
৭। ওঁ আজ্যপাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তা- মেতৎ সতিল-গঙ্গোদকং তেভ্যঃ স্বধাঃ।

 

যম তর্পণ  
===========

নিম্নলিখিত মন্ত্রস্থ নামগুলির প্রত্যেকের যথাক্রমে পিতৃতীর্থদ্বারা দক্ষিণ-মুখে প্রাচীনাবীতি হয়ে ওঁ যমায় নমঃ বলে এইভাবে তিন অঞ্জলি করে তিল-তুলসী যুক্ত জল অর্পণ করবেন।

❝ ওঁ নমঃ যমায় ধর্ম্মরাজায়, মৃত্যবে চান্তকায় চ, বৈবস্বতায় কালায়, সর্ব্বভূতক্ষয়ায় চ।
ঔডুম্বরায় দধ্নায়, নীলায় পরমেষ্ঠিনে, বৃকোদরায় চিত্রায়, চিত্রগুপ্তায় বৈ নমঃ॥ ❞

পিতৃ আবাহন  
===========

তর্পণ সমাপ্তি পর্যন্ত দক্ষিণ মুখে প্রাচীনাবীতী অবস্থায় পরম ভক্তিসহকারে করজোরে বলবেন –

ওঁ আগচ্ছন্তু মে পিতরঃ ইমং গৃহ্ণন্ত্বপোহঞ্জলিং। (গৃহ্ণন্তু অপঃ অঞ্জলিং)

অনুবাদ:  হে আমার পিতৃগণ (পূর্ব্বপুরুযগণ) আসুন, এই অঞ্জলি পরিমিত জল গ্রহণ করুন।

আবাহনের পরে পিতৃতীর্থযোগে নিম্নলিখিত প্রকারে গৌত্র, সম্বন্ধ ও নাম উল্লেখ করতঃ ভক্তিসহকারে পিতা, পিতামহ (ঠাকুরদাদা), প্রপিতামহ (ঠাকুরদাদার পিতা), পিতামহী (ঠাকুরমা), প্রপিতামহী (ঠাকুরদাদার মাতা), মাতা, মাতামহ (মায়ের পিতা), প্রমাতামহ (মায়ের দাদু), বৃদ্ধপ্রমাতামহ (মায়ের দাদুর পিতা)  এই নয়জনের প্রত্যেককে তিন অঞ্জলি করিয়া সতিল জল দিবেন, মন্ত্রও যথাক্রমে তিনবার পাঠ করবেন।

পরে মাতামহী (মায়ের মাতা), প্রমাতামহী (মায়ের দিদা), বৃদ্ধপ্রমাতামহী (মায়ের দিদার মাতা), প্রভৃতিকে এক এক অঞ্জলি জল দিয়ে, গুরু, জ্যেঠা, খুড়া, বিমাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী, জ্যেঠী, খুড়ী, পিসি, মাসী, মামা, মামী, শ্বশুর, শাশুড়ী, ভগ্নিপতি, জ্ঞাতি, প্রভৃতি প্রত্যেককে এক অঞ্জলি সতিল-জল অর্পণ করবেন।

গঙ্গাজলে তর্পণ করলে  “এতৎ সতিল-গঙ্গোদকং” বলবেন নচেৎ সতিলোদকং বলতে হবে।

ওঁ বিষ্ণুরোঁ     অমুক         গোত্রস্য পিতা     অমুক         দেবশর্ম্মা তৃপ্যতামেতৎ সতিলগঙ্গোদকং তস্মৈ স্বধাঃ।
” ” ” পিতামহ ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” প্রপিতামহ ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” মাতামহ ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” প্রমাতামহ ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” বৃদ্ধপ্রমাতামহ ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” গোত্রা মাতা অমুকী দেবী ” ” ” ”
” ” ” পিতামহী ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” প্রপিতামহী ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” মাতামহী ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” প্রমাতামহী ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” ” “
” ” ” বৃদ্ধপ্রমাতামহী ” ” ” ” ” ” ” ” ” “

বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই যে, উপরে উল্লেখিত দ্বাদশ জনের কেউ জীবিত থাকলে তাঁকে বাদ দিয়ে তার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে ধরে দ্বাদশ সংখ্যা পূরণ করতে হবে।

অতঃপর নিম্নলিখিত মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক অঞ্জলিত্রয় সতিল জল, জলাভাবে একবার মাত্র সতিল জল অর্পণ করবেন, যথা–

❝ ওঁ নমঃ অগ্নিদদগ্ধাশ্চ যে জীবা, যেহপ্যদগ্ধাঃ কুলে মম।
ভূমৌ দত্তেন তৃপ্যন্তু, তৃপ্তা যান্ত পরাং গতিং॥❞

অনুবাদ:  আমার বংশে যে সকল জীব অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হয়েছেন, (অর্থাৎ যাঁদের দাহাদি-সংস্কার হয়েছে) এবং যাঁরা দগ্ধ হন নাই (অর্থাৎ কেউ তাঁদের দাহাদি-সংস্কার কার্য করেনি) তাঁরা তৃপ্ত হন ও স্বর্গ লাভ করুন।

❝ ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ।
তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ॥❞

অনুবাদ: যাঁরা আমাদের বন্ধু ছিলেন, এবং যাঁরা বন্ধু নন, যাঁরা জন্ম-জন্মান্তরের আমাদের বন্ধু ছিলেন, এবং যাঁরা আমাদের কাছ থেকে জলের প্রত্যাশা করেন, তাঁরা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তিলাভ করুন।

পিতৃ স্তুতি 
===========

❝ ওঁ নমঃ পিতা-স্বর্গঃ পিতা-ধর্ম্মঃ, পিতাহি পরমং তপঃ।
পিতরি প্রীতি-মাপন্নে, প্রীয়ন্তে সর্ব্ব-দেবতা ॥❞
অনুবাদ: (স্তুতি) পিতাই স্বর্গ, পিতাই ধর্ম্ম, পিতাই পরম তপস্যা (অর্থাৎ পিতা সেবাই তপস্যা) পিতা প্রসন্ন হলে সকল দেবতাই প্রীত হন।
❝ ওঁ নমঃ পিতৃন্নমস্যে দিবি যে চ মূর্ত্তাঃ,
স্বধাভুজঃ কাম্যফলাভিসন্ধৌ।
প্রদানশক্তাঃ সকলেপ্সিতানাং, বিমুক্তিদা যেহনভিসংহাতেষু ॥❞
অনুবাদ: যাঁরা স্বর্গে মূর্ত্তি ধারণ করে বিরাজ করছেন, যাঁরা শ্রাদ্ধান্ন ভোজন করেন, অভীষ্ট-ফলের কামনা করলে যাঁরা সকল বাঞ্ছিত-ফল দান করতে সমর্থ এবং কোন ফলের কামনা না করলে যাঁরা মুক্তি প্রদান করেন, সেই পিতৃগণকে প্রণাম করি।
সূর্য্যার্ঘ্য
===========
সূর্য্যদেবের উদ্দেশে পূর্ব্বদিকে মুখ করে একবার জল অর্পণ করবেন ━
❝ ওঁ নমো বিবস্বতে ব্রহ্মণ, ভাস্বতে বিষ্ণু তেজসে।
জগৎসবিত্রে শুচয়ে, সবিত্রে কর্ম্মদায়িণে, ইদমর্ঘ্যং ওঁ শ্রীসূর্য্যায় নমঃ ॥❞
অনুবাদ: হে পরম ব্রহ্মস্বরূপ সবিত্রিদেব! আপনি তেজস্বী, দীপ্তিমান; বিশ্বব্যাপী তেজের আধার, জগতের কর্ত্তা, পবিত্র, কর্ম্মপ্রবর্ত্তক; আপনাকে প্রণাম করি।।
সূর্য্য প্রণাম
===========
❝ ওঁ নমঃ জবাকুসুম-সংঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং।
ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং ॥❞
অনুবাদ: জবাফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ, কশ্যপের পুত্র, অতিশয় দীপ্তশালী, তমোনাশী, সর্ব্বপাপ নাশকারী দিবাকরকে প্রণাম করি।।
অচ্ছিদ্রাবধারণ
=============
অর্থাৎ যে কর্ম্ম করা হল, সেটা যে অচ্ছিদ্র অর্থাৎ ছিদ্রহীন, নির্দোষ ভাবে সম্পন্ন হল সেই বিষয়ে অবধারণ করাকে (নিশ্চয় করাকে) অচ্ছিদ্রাবধারণ বলে। সুতরাং করজোড়ে বলবেন ━
❝ ওঁ কৃতৈতৎ তর্পণকর্ম্মাচ্ছিদ্রমস্তু ॥❞
বৈগুণ্য সমাধান
=============
অচ্ছিদ্রাবধারণের পরে বৈগুণ্য-সমাধান করতে হয় । বামহস্তে সংযুক্ত করে দক্ষিণ হস্তে জল, হরীতকী, কুশ স্পর্শ করে (নদীতে তর্পণ করলে, কেবল জল স্পর্শ করবেন), তারপরে বলবেন ━
বিষ্ণুরোঁ তৎসৎ অদ্য   অমুক মাসে    অমুক  পক্ষে  অমুক  তিথৌ    অমুক গৌত্রঃ শ্রী    অমুক    দেবশর্ম্মা কৃতেহহস্মিন্ তর্পণকর্ম্মণিষদ্বৈগুণ্যং জাতং তদ্দোষ প্রশমনায় শ্রীবিষ্ণু স্মরণষ্মহং করিষ্যে।
এরপরে নিচের মন্ত্র দশবার জপ করবেন ━
❝ ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং, সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততং। ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ ॥❞

এরপর বাড়িতে রাধা-মাধবকে ভোগ নিবেদন করে মৃত ব্যাক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা, উদ্ধার ও ঊর্ধ্বগতি কামনা করবেন। ভগবান করুনাময়, তিনি ভক্তের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না। এরপর সেই মহাপ্রসাদ পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে প্রদান করবেন। পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত কলা পাতার উপর দেওয়া হয়। 

এই খাদ্য সাধারণত ছাদে রেখে আসা হয়। যদি কোনো কাক এসে সেই খাদ্য খেয়ে যায়, তাহলে ধরা হয় যে খাদ্য পিতৃগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। মনে করা হয়, পাখিটি আসলে যম বা পিতৃগণের আত্মার প্রতিনিধি। গোরু ও কুকুরদেরও খাওয়ানো হয়।

অনুষ্ঠান শেষে ব্রাহ্মণদের দক্ষিনা দিতে হয়। কোথাও কোথাও ব্রাহ্মণদের ভোজনও করানো হয়। পূর্বপুরুষ (কাকের বেশে) এবং ব্রাহ্মণেরা ভোজন করলেই তবে পরিবারের সদস্যরা অন্ন গ্রহণ করেন।

কোনো কোনো পরিবারে পিতৃ পক্ষে ভাগবত পুরাণ, ভগবদ্গীতা বা শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করা হয়।

অনেকে পূর্ব পুরুষের মঙ্গল কামনায় ব্রাহ্মণদের দান করেন।

◼️ কর্ণের তর্পণ কাহিনী ◼️

মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের দ্বারা কর্ণের মৃত্যু হলে বিভিন্ন দান, সেবা পুণ্য কর্মের কারনে তার আত্মা স্বর্গে গমন করে। স্বর্গের অধিপতি হলেন ইন্দ্র। সেখানে খাবারের পরিবর্তে কর্ণকে শুধু খেতে দেওয়া হল সোনা, আর অনেকরকমের ধনরত্ন।

কর্ণ অবাক হয়ে এর কারন জিজ্ঞেস করেন ইন্দ্রকে (মতান্তরে যমরাজকে)। তখন ইন্দ্রদেব তাকে বললেন ━ “হে কর্ণ! তুমি জীবিতকালে যথেষ্ট সোনাদানা, ধনরত্ন দান করেছ, কিন্তু পিতৃপুরুষকে কখনও জল দান করোনি, তাই তোমার জন্যে এই ব্যবস্থা।”

তখন কর্ণ বললেন – “এতে আমার কি দোষ? আমি তো আমার প্রকৃত পিতৃপুরুষের কথা জানতে পারলাম এই সেদিন।  এর আগে তো অধিরথকেই নিজের পিতা বলে জানতাম। যুদ্ধ শুরুর আগেরদিন রাতে মাতা কুন্তী এসে বললেন আমি নাকি তাঁর ছেলে, শ্রীকৃষ্ণও সেই কথা বললেন। পরবর্তীকালে যুদ্ধে নিজের ভাইয়ের হাতেই মরতে হল, পিতৃ তর্পণের আর সুযোগ বা সময় পেলাম কই?”

ইন্দ্র বুঝতে পারলেন এতে কর্ণের কোন দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্যে মর্ত্যলোকে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন আর বললেন এই এক পক্ষকাল তিনি যেন মর্ত্যলোকে অবস্থান করে পিতৃপুরুষদেরকে জল দেন, এতেই তাঁর পাপস্খালন হবে।

যে পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই সময় আমাদের স্বর্গত পিতৃপুরুষগণ স্বর্গলোক ছেড়ে নেমে আসেন মর্ত্যলোকে, এই সময় প্রথম পক্ষেই হিন্দুদের পিতৃতর্পণ করতে হয়।

মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী অমাবস্যা

─•••━━━━━●•⊱♦️✥♦️⊰•⊰❃*❀❁❁❀*❃⊱⊱♦️✥♦️⊰●•━━━━•••─

👣 মহালয়া (Mahalaya) কি? 👣

পিতৃপক্ষ (কৃষ্ণপক্ষ) ও দেবীপক্ষ (শুক্লপক্ষ)-এর  সন্ধিক্ষণেই মহালয়ার সূচনা। সনাতনী শাস্ত্র ও সংস্কারে মহালয়ার একাধিক তাৎপর্য্য আছে।

বসন্তকালে আসলে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে অর্থাৎ শরৎকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য।  শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধন বলা হয় ।

সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষদেরদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন।

‘মহালয়া’ অর্থ মহা + আলয় = ‘বৃহৎ আলয়’ মানে ‘বিরাট জায়গা বা স্থান’।  সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত পূর্ব পুরুষদের অমুক্ত আত্মার যে মহা সমাবেশ হয় তাকে মহালয় বলা হয়। এই মহালয় থেকেই মহালয়া। এদিনে আমরা সকল অমুক্ত আত্মার শান্তি কামনায় তর্পণ ক্রিয়া করি।

প্রজাপতি স্মৃতিতে মহালয়ায় তর্পণ মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে ━
❝ শ্রাদ্ধং কৃতং যেন মহালয়েহশ্মিন্‌ পিব্রোঃ ক্ষযাহে গ্রহণে গয়ায়াম্‌ |
কিমশ্বমেধৈঃ পুরুষৈরনেকৈঃ পুণ্যেরিমৈরন্যতমৈঃ কৃতৈঃ কিম্‌ ॥❞
 ━━┉┈┈‌(প্রজাপতি স্মৃতিঃ ২০)
অনুবাদ: মহালয়ার দিন, মাতা ও পিতার মৃত্যুতিথিতে, গ্রহণের সময়ে এবং গয়ায় যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ তর্পণ করেন, তাহার বহুপুরুষসাধ্য অশ্বমেধ বা (তজ্জাতীয়) অন্যান্য পুণ্যকার্য্য সম্পাদনের কি প্রয়োজন আছে ?

মহালয়ার এই পূণ্য তিথিতে দেবীপক্ষের আরম্ভে জগজ্জননী দুর্গা ঋষি কাত্যায়নীর আশ্রমে তাঁর কন্যারূপে অবতীর্ণ হয়ে শুম্ভূনিশুম্ভূকে বধ করেন। যেহেতু এই দিনে আদ্যাশক্তি মহামায়ার আগমন তাই এই দিনটিতেই দেবীপক্ষের শুরু। মহালয়ার শুরু তাই মায়ের আগমনী সুর।

মহালয়া ‘ শব্দটির আরেকটি অর্থ- ‘মহান যে আলয় বা আশ্রয়‘। মহালয়’ শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয় । কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলােকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয় । এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয় ।

পিতৃপক্ষের শেষক্ষণ ও মাতৃপক্ষের সূচনাকালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়। এককথায় পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধক্ষিণ হচ্ছে মহালয়া। প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর কানের মোম থেকে মধু কৈটভ নামে দুই দৈত্যে নির্গত হয় এবং সেই সময় বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে সৃষ্ট ব্রক্ষ্মা মহাবিশ্বের সৃষ্টির কথা চিন্তা করছিলেন। তারা স্থিত ব্রক্ষ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল।  ব্রহ্মা তখন আত্মরক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তিনি ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। কিন্তু ভগবান যোগ নিদ্রায় মগ্ন। তিনি জাগলেন না। ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন ভগবান বিষ্ণু যোগমায়ার প্রভাবে যোপ নিদ্রায় আছন্ন। তাই যোগমায়া ভগবান বিষ্ণুকে প্রভাব মুক্ত না করলে তিনি জাগবেন না। তাই ব্রহ্মা সেই আদ্যাশক্তির স্তব করতে লাগলেন।

ব্রহ্মার বন্দনায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া বিষ্ণুর দেহ ছেড়ে বেরিয়ে এলে শ্রীবিষ্ণু জাগরিত হন।  তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হয়েও কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারলেন না। ভগবান বিষ্ণু ভাবলেন এই দুই অসুর দেবী মহামায়ার কাছে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন । তাই এদের বধ করা অসম্ভব।

এরপর ভগবানের ইচ্ছায় মহামায়া দুই অসুরকে ভ্রমিত করলেন। দুই অসুর গর্বে বিষ্ণুর যুদ্ধদক্ষতার প্রশংসা করেন এবং বিষ্ণুকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। উত্তরে বিষ্ণু বলেন যে, ‘তোমরা আমার হাতে বধ্য হও , এই আমার অভিলাষ’। 

বর প্রার্থনা করার কথা বলে মধুকৈটভ যে ভুল করেছিল, তা সংশোধনের জন্য কৌশল নিলেন। তাঁরা দেখলেন সমগ্র পৃথিবী জলমগ্ন। তাই তারা বিষ্ণুকে বলেন যে– তুমি আমাদেরকে জলহীনস্থানে (অর্থাৎ স্থলে) হত্যা কর। এরপর বিষ্ণু তাঁর শরীরকে দ্বিগুণ করলেন এবং তাঁর হাটুর উপর উভয় অসুরকে রেখে সুদর্শন চক্র দ্বারা তাঁদের শিরোশ্ছেদ করেন। পরে এই দুই অসুরের দেহের মেদ থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে বলে– হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে পৃথিবীর অপর নাম মেদিনী। 

◼️ মহালয়ার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ ◼️

🕉️ মহালয়া‘ মানে ‘মহা আলয়‘ মানে ‘কোনো মহৎ আলোতে প্রবেশ করার প্রন্থা

🕉️ শ্রীশ্রীচণ্ডীর এই শ্লোক উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় শুভ মহালয়া। শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার আবাহনই হলো মহালয়া। এর মাধ্যমে মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। সূচনা হয় দেবীপক্ষের। সনাতন ধর্মের বহুবিধ তত্ত্বের মধ্যে মহালয়া তত্ত্ব সুগভীর যোগতাত্ত্বিক দর্শন তত্ত্ব।

যোগতাত্ত্বিক দর্শন তত্ত্বে দেবী শক্তিকে পূজা করার জন্য তথা দেবী ভাবনায় আত্মনিমগ্ন হওয়ার তিথি হচ্ছে মহালয়া। সাধক যখন কুণ্ডলিনী শক্তিকে মূলাধারে জাগ্রত করে ক্রমে ক্রমে বৃহত্‍ কূটস্থে প্রবেশ করেন তখন তা মহাশক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তির সাহায্যে সাধক তখন মহিষাসুর বধ করতে পারেন। ‘মহী‘ অর্থাৎ ‘ভূমি‘; যে পৃথিবীকে উগ্রভাবে ভোগ করতে চায় সেই ব্যাক্তি হচ্ছে মহিষ বা মহিষ বৃত্তিসম্পন্ন। উল্লেখ্য, মহিষ ক্রোধী জীব, ভোগ করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে সে ক্রোধিত হয়। সাধকের কাজ হল তখন বৃহত্‍ কূটস্থে বা মহতের আলয়ে বা মহালয়ে প্রবেশ করে জাগ্রত দেবীশক্তির সাহায্যে সেই ভোগপ্রবৃত্তি রূপ মহিষাসুরকে পরাজিত করা। মহিষাসুরের সঙ্গে লড়াই করার যোগ্যতা সাধকের তখনই অর্জিত হবে যখন সে মহালয়াতে প্রবেশ করবে। তাই মহালয়া অমাবস্যার পরদিন থেকেই দেবীপক্ষের শুরু হয়। দেবীপক্ষ মানে অসুরের বিরুদ্ধে দেবীর সংগ্রামের পক্ষ তথা শুভত্বের বিজয় যাত্রা

─•••━━━━━●•⊱♦️✥♦️⊰•⊰❃*❀❁❁❀*❃⊱⊱♦️✥♦️⊰●•━━━━•••─

👣 দেবীপক্ষ (Devi Paksha) কি? 👣

🕉️ পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ এই পক্ষদুটির সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকলেও অমাবস্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবীপূজার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। তাই দেবীপূজার পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ। মহালয়া হচ্ছে পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং মহালয়া অমাবস্যার পরদিন থেকেই দেবীপক্ষের শুরু হয়। দেবীপক্ষ মানে অসুরের বিরুদ্ধে দেবীর সংগ্রামের পক্ষ, সংগ্রামে দেবীর জয়ের পক্ষ। দেবী পক্ষের শুরুর পূর্ব দিন। পিতৃপক্ষে আত্মসংযম করে দেবী পক্ষে শক্তি সাধনায় প্রবেশ করতে হয়। দেবী হলেন শক্তির আদিশক্তি, তিনি সর্বভূতে বিরাজিত। তিনি মঙ্গল দায়িনী করুণাময়ী। সাধক সাধনা করে দেবীর বর লাভের জন্য, দেবীর মহান আলয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পান বলেই এ দিনটিকে বলা হয় মহালয়া।

পুরাণ মতে এই দিনেই দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। এদিন অতি প্রত্যুষে চণ্ডীপাঠ করার রীতিও রয়েছে সনাতন সমাজে। মহালয়ার পর প্রতিপদ তিথি থেকে শুরু হয় এই দেবী আদ্যাশক্তির বন্দনা। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবও এই দেবী আদ্যাশক্তির বন্দনা তথা শারদীয়া দুর্গাপূজা।

❝ যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥॥❞ 

অনুবাদ: যে দেবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল প্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা,  তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার।

যে দেবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল প্রাণীতে শক্তির আধাররূপে (যথা প্রানশক্তি) অবস্থিতা,  তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার।

(সর্বভূত বলতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত জীব প্রাণী আছে সব প্রাণীকে এক কথায় ভূতপ্রাণী বলা হচ্ছে)।

🕉️ চণ্ডীপূজা, চণ্ডীপাঠ ইত্যাদি ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে মহালয়া উদযাপিত হয়। এই সকল ধর্মানুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য সাধনার মাধ্যমে মহতের আলয়ে অর্থাত মহালয়ে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হওয়া। এ দিন মন্দিরে মন্দিরে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি। পুরোহিতগণের শান্ত, অবিচল ও গম্ভীর কন্ঠ থেকে ভেসে আসে সুমধুর চণ্ডীপাঠ। এই মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে দেবতারা দুর্গাপূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করেন। তারা সমস্বরে দেবীকে আহ্বান জানান পৃথিবীর ঘোর অন্ধকার দূরীভূত করে মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মহালয়া সূচিত হয় ঘোর অমাবস্যায়। এবং দেবী আদ্যাশক্তির মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয় ধীরে ধীরে।

🕉️ এছাড়াও এই পক্ষকে দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ বলার আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারন হচ্ছে, মহালয়ার পরের প্রতিপদ থেকে শুরু করে নবমী পর্যন্ত দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া নয়টি আলাদা আলাদা রূপে মর্ত্যে পুজিতা হন। ধারাবাহিকভাবে প্রতিপদে মাতা শৈলপুত্রী, দ্বিতীয়ায় মাতা ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয়ায় মাতা চন্দ্রঘণ্টা, চতুর্থীতে মাতা কুষ্মাণ্ডা, পঞ্চমীতে দেবী স্কন্ধমাতা, ষষ্ঠীতে মাতা কাত্যায়নী, সপ্তমীতে মাতা কালরাত্রি, অষ্টমীতে মাতা মহাগৌরী এবং নবমীতে মাতা সিদ্ধিদাত্রী পূজিতা হন।

এছাড়াও এই পক্ষের শেষ তিথি তথা পূর্ণিমাতে পূজিতা হন আদ্যাশক্তির আরেক রূপ দেবী শ্রীলক্ষ্মী । দেবীপক্ষের এই পূর্ণিমাকে বলা হয় কোজাগরী পূর্ণিমা। এই তিথিতে ভক্তের হৃদয়ের অর্ঘ্য দ্বারা কোজাগোরী লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে বাংলায় দুর্গাপূজার সুচনা ঘটে ষষ্ঠী তিথিতে এবং শেষ হয় বিজয়া দশমী তিথিতে মাতৃবিসর্জনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিপদ থেকে দুর্গাপূজার শুভ সুচনা ঘটে।

 🌸 জয় মা দুর্গা 🌸

        🌸 জয় শ্রীরাধা গোবিন্দ 🌸

আরও পড়ুন: Kola Bou || নবপত্রিকা (কলা বউ বা কলা বৌ) কে? কেনো একে পূজা করা হয় ??

আরও পড়ুন: Who is Devi Durga? দেবী দুর্গা কে? দশ হাতে অস্ত্র কি কি?

আরও পড়ুন: দশেরা (Dussehra) কি?✤ বিজয়া দশমীর (Bijaya Dashami) মাহাত্ম্য

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.