প্রতি তিনবছরে একবার পুরুষোত্তম মাস আসে। আমাদের ভারতীয় চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর ১০ দিন অতিরিক্ত থাকে। তাই প্রতি তিনবছর অন্তর একটি অধিক মাস যোগ হয়। এই মাস ক্রন্দন করছিলেন, কারণ এই মাসে কোন পুণ্যকর্ম করা হয়না। তিনি বলছিলেন যে মানুষেরা তাকে খারাপ খারাপ নামে ডাকে। তাই কৃষ্ণ তাকে বললেন আমি তোমাকে গ্রহণ করবো এবং তুমি ‘পুরুষোত্তম মাস‘ নামে পরিচিতি লাভ করবে। যারা যারা এই মাসে পারমার্থিক কার্য সম্পাদন করবে তারা প্রত্যেকেই ১০০০ গুণ অধিক ফল লাভ করবে। এই মাসে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন, কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে দীপ নিবেদন করুন। আপনি কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে যেকোনো সেবা করতে পারেন, কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে দান করতে পারেন, কিছু সেবা করতে পারেন, যা কিছুই আপনি করবেন তার একটি পারমার্থিক গুরুত্ব থাকবে, আপনি ১০০০ গুণ অধিক ফল লাভ করবেন। এটি একটি দুর্লভ সুযোগ।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাস ২০২৩ : সময়সূচী ✺
(Purushottam Month 2023 : Timing)
১৮ই জুলাই থেকে ১৬ই আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত লীলাপুরুষোত্তম ভগবানের প্রিয়তম পুরুষোত্তোম মাস।
পুরাণে বারো মাসের মধ্যে তিনটি মাসকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন— বৈশাখ মাস, মাঘ মাস ও কার্তিক মাস। এই তিনটি মাসের থেকে আরো গুরুত্ব প্রদান করেছেন ‘পুরুষোত্তম মাস’ বা ‘অধিমাস’ বা ‘মল মাস’ কে।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাস কী ? ✺
সৌর বছরকে সাধরণত ভাবে গনণা করা হয় ৩৬৫ দিনে, প্রক্ষান্তরে চন্দ্র বছর গণনা করা হয় ৩৫৫ দিনে। ফলে ৩৬৫ থেকে ৩৫৫ দশ দিনের পার্থক্য সৃষ্টি হয় সৌরদিবস ও চান্দ্র তিথির মধ্যে। তাহলে তিন বছরে এর পার্থক্য দাঁড়ায় ৩০ দিনে এবং ৩০ দিনে হয় একমাস। এ কারণে ভারতে বৈদিক যুগে প্রতি ৩ বছর অন্তর একটি বাড়তি মাস যুক্ত করে চান্দ্র বছরের সাথে সৌর বছর সমন্বয় করা হয়। এটি ভগবৎপ্রণীত। একে পুরুষোত্তম মাস বা অধিমাস বলে।
এ মাসে কোন কোন সকামকর্মীয় কাজ হয় না। যেমন বিবাহ, পূজা এবং অনন্য অনুষ্ঠানাদি। তাই এই মাসটি মলমাস নামে পরিচিত।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাস কেন হয়? ✺
◉ সৌরবছর ও চান্দ্রবছর কী?
বছর দু’রকম, সৌরবছর এবং চান্দ্রবছর । পৃথিবী সূর্যকে ৩৬৫.২৫৮৭ দিনে পরিক্রমণ করে। একে এক সৌরবছর বলে। সুতরাং বারো মাসের প্রতি মাসে সূর্যের চারপাশে ৩৬০ ডিগ্রির ৩০ ডিগ্রি পথ অতিক্রম করে পৃথিবী, একে সৌরমাস বলে। গড়ে প্রতি সৌরমাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন ১০ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড বা ৩০.৪৩৬৮৫ দিন।
এখন চান্দ্রবছরের হিসাব অন্য। চন্দ্র পৃথিবীকে পরিক্রমণ করে ২৭.৩ দিনে, এই সময়কালকে একটি চান্দ্র মাস বলা হয়। তাই চান্দ্র মাস আর সৌরমাসের হিসেবে গরমিল হয়। সৌরমাসের হিসেব ৩০.৪৩৬৮৫ দিনের আর চান্দ্রমাস ২৭.৩ দিনের।
প্রতিটি চান্দ্র মাস আবার দুটি পক্ষে বিভক্ত: – শুক্ল পক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষ। অমাবস্যার পর শুক্লা প্রতিপদ (অমাবস্যা ও পূর্ণিমার পরের দিন/তিথিকে প্রতিপদ বলে) থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত শুক্ল পক্ষ এবং পূর্ণিমার পর কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত কৃষ্ণ পক্ষ।
প্রতি পক্ষেই ১৫ টি তিথি অর্থাৎ চান্দ্র দিন থাকে, অর্থাৎ একটি চান্দ্র মাসে ৩০ টি তিথি বা চান্দ্র দিন থাকে। চান্দ্র মাসের গণনা আরম্ভ হয় কৃষ্ণ পক্ষের প্রতিপদ থেকে আর শেষ হয় পূর্ণিমা তিথির অবসানে।
✺ কৃষ্ণ পক্ষের তিথি বা চান্দ্র দিনগুলি হল:-
কৃষ্ণা প্রতিপদ , দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, অমাবস্যা।
✺ শুক্ল পক্ষের তিথিগুলি হল :-
শুক্লা প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, পূর্ণিমা।
এই ভাবে একটি চান্দ্র মাস শেষ হয়।
বারোটি চান্দ্র মাসে একটি চান্দ্র বৎসর হয়।
কিন্তু আমরা জানি সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন থাকে, অপর দিকে একটি চান্দ্র বৎসরে ৩৫৪ দিন ৩ ঘন্টা অর্থাৎ প্রায় ৩৫৫ দিন হয়।
অতএব, ১ সৌর বৎসর = ১ চান্দ্র বৎসর + ১০ দিন ২১ ঘণ্টা
(এজন্যই আমরা দেখি পূজা প্রতি বৎসর ১০ দিন এগিয়ে যায়, কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়া যাতে অনন্তকাল ধরে না চলে সেজন্যই মল মাসের অবধারণা, নাহলে এগোতে এগোতে আশ্বিন মাসের পূজা বৈশাখে চলে আসত।)
সুতরাং, ৩ সৌর বৎসর = ৩ চান্দ্র বৎসর + ৩০ দিন ( = ১ মাস)
অতএব দেখা যাচ্ছে ৩ টি সৌর বৎসর অতিক্রম করলে ৩ টি চান্দ্র বৎসরের সঙ্গে ১ টি গোটা চান্দ্র মাস অতিরিক্ত (extra) পাওয়া যাচ্ছে। এই বাড়তি একমাসকে অধিমাস রূপে গণ্য হয়। বৈষ্ণবরা আবার এই মাসকে পুরুষোত্তম মাস হিসাবে গণ্য করেন।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম নামের মহিমা ✺
পুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একটি নাম। ‘পুরুষ’ অর্থাৎ ভোক্তা বা ভগবান; ‘উত্তম’ মানে আধ্যাত্মিক। পুরুষোত্তম মানে ‘আধ্যাত্মিক পরম ভগবান’। ভগবদগীতার ১৫তম অধ্যায়কেও পুরুষোত্তম যোগ বলা হয়।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম ব্রত মাহাত্ম্য (স্কন্ধপুরাণ ও পদ্মপুরাণ থেকে) ✺
◼️ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ :
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অধিমাস প্রসঙ্গে বলেছেন “আমি যেভাবে পুরুষোত্তম নামে পরিচিত, এই অধিমাসও তেমনি সারা বিশ্বে পুরুষোত্তম মাস নামে খ্যাত হবে। আমার সকল গুণ এই মাসের মাঝে প্রবেশ করবে। আমারই মত, এই মাস সকল মাসের মাঝে শ্রেষ্ঠ হবে। এই মাস পূজনীয় এবং স্তুতির দ্বারা প্রশংসার যোগ্য। অন্য সকল মাস সকাম, জাগতিক বাসনায় পরিপূর্ণ। এই মাস নিষ্কাম, জাগতিক বাসনাবিহীন। যদি কেউ অকাম বা জাগতিক বাসনা ব্যতীত, অথবা সকাম বা জাগতিক বাসনাযুক্ত হয়ে এই মাসের আরাধনা করে, তাহলে তার সকল কর্মফল নিঃশেষ হয়ে যায় এবং সে আমাকে লাভ করে। আমার ভক্তেরা অনেক সময় অপরাধ করে ফেলে, কিন্তু এই মাসে কোন অপরাধ হয় না। এই মাসে যারা সবচেয়ে নির্বোধ এবং কোন জপ ও দান প্রভৃতি করে না, নিজের পারমার্থিক উন্নতির জন্য যারা কোন কর্ম করে না এবং যারা স্নানাদি করে না, এবং যারা দেবতাগণ, পবিত্র ধাম ও ব্রাহ্মণদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, এই সকল দুষ্ট, অসাধু, মন্দভাগ্য লোকেরা, অন্যের সম্পদের উপর জীবন নির্বাহ করে, তারা তাদের স্বপ্নেও সুখ লাভ করে না। এই পুরুষোত্তম মাসে, যিনি প্রেম ও ভক্তিসহকারে আমার আরাধনা করেন, তিনি সম্পদ ও পুত্রাদি লাভ করে, সুখ ভোগ করে, সবশেষে গোলকবাসী হয়।“
ভগবান আরও বলেছেন ”পুরুষোত্তম ব্রত পালনকারী ব্যক্তি আমার সমস্ত আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন। যিনি পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তাঁর পূর্ব জন্মকৃত সমস্ত পাপকর্মের ফল বিনষ্ট হয়। পুরুষোত্তম ব্রত পালন ব্যতীত কেউ শুদ্ধভক্তি যাজন করতে পারে না। বেদোক্ত সমস্ত তপস্যাদি ও ধর্মীয় কার্যকলাপ থেকেও পুরুষোত্তম ব্রত পালন অধিক গুরুত্ববহ। যে ব্যক্তি পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি তার জীবনের অন্তিমে আমার ধাম, গোলক বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করেন।”
ভগবান অধিমাস প্রসঙ্গে আরও বলেছেন “যারা এমাসে সৎ কর্ম অনুষ্ঠান করবে তারা অচিরে দূঃখ কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে। সেই সঙ্গে যারা কৃচ্ছসাধন করবে তারা ইন্দ্রিয়গণকে জয় করতে সক্ষম হবে। অন্য মাস গুলিতে সৎ কর্ম করলে স্বর্গ লাভ হয় কিন্তু ফল ভোগ শেষ হলে আবার পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। এ ভাবে জন্ম মৃত্যুর চক্র হতে মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু প্রক্ষান্তরে এ মলমাসে সৎ কর্ম করলে মোক্ষ লাভ হয়। তথা পূনর্জন্ম হতে মুক্ত হয়।”
◼️ লক্ষ্মীদেবী :
লক্ষ্মীদেবী বললেন, “এই পরম শ্রব্য (শ্রবণযোগ্য), পবিত্র থেকেও পবিত্রতম, দুঃস্বপ্নহর, পুণ্য আখ্যান শ্রোতৃগণের পরম যত্নে শ্রবণীয়। শ্রদ্ধাযুক্ত ব্যাক্তি (ভক্ত) যদি এর শ্লোক বা শ্লোকার্ধ পরিমাণও পাঠ করেন, তৎক্ষণাৎ কোটি কোটি মহাপাতক (ঘোর পাপ) থেকে মুক্ত হয়ে যায়। পক্ষীগণের মধ্যে যেমন গরুড়, নদীগণের মধ্যে গঙ্গা এবং তিথিসমূহের মধ্যে দ্বাদশী শ্রেষ্ঠ, তেমনি মাসসমূহের মধ্যে এই পুরুষোত্তম মাসই সর্বোত্তম। •••••••••┈┉━ (পদ্মপুরাণ, উত্তরখণ্ড, ৬২/২৬-২৮)
◼️ নারদ মুনি :
”পুরুষোত্তম মাস সমস্ত মাস, ব্রত এবং তপস্যার মধ্যে সর্বোত্তম। শুধুমাত্র বিশ্বাস সহকারে পুরুষোত্তম মাসের মাহাত্ম্য শ্রবণের মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারেন এবং তৎক্ষণাৎ সমস্ত পাপকর্মের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হতে পারেন। যে ব্যক্তি যথাযথভাবে পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি অসীম সুকৃতি লাভ করেন এবং চিন্ময় জগতে ফিরে যান।”
◼️ দুর্বাসা মুনি :
”পুরুষোত্তম মাসে শুধুমাত্র কোন পবিত্র নদীতে স্নান করার মাধ্যমেই যে কেউ পাপমুক্ত হতে পারেন। অন্যান্য মাসসমূহের মহিমা পুরুষোত্তম মাসের মহিমার ষোল ভাগের এক ভাগের সমানও নয়। পুরুষোত্তম মাসে পবিত্র কোন স্থানে বাস করা, দান করা এবং শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নাম জপ করার ফলে সমস্ত দুঃখের বিনাশ ঘটে। তিনি সর্বসিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং তাঁর সমস্ত বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।”
◼️ বাল্মীকি মুনি :
”পুরুষোত্তম ব্রত পালনের মাধ্যমে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞেরও অধিক সুফল লাভ করা যায়। সমস্ত পবিত্র স্থানসমূহ পুরুষোত্তম ব্রত পালনকারী ব্যক্তির দেহে বিরাজ করে। যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে পুরুষোত্তম ব্রত পালন করেন, তিনি গোলক বৃন্দাবন লাভ করবেন”।
◼️ নৈমিষারণ্যের মুনিগণ :
”পরম করুণাময় পুরুষোত্তম মাস ভক্তদের সমস্ত বাঞ্ছা পূরণার্থে কল্পতরুর ন্যায় কাজ করে।”
◼️ সচ্চিদানন্দ শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর :
পরমার্থ-শাস্ত্র অধিমাসকে পারমার্থিক কার্যে সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ হিসাবে গণ্য করে। জীবন অনিত্য। জীবনের কোনো অংশই বৃথা যাপন (নষ্ট) করা উচিত নয়। সর্বক্ষণ হরিভজনে থাকাই জীবের কর্তব্য। সুতরাং প্রত্যেক তৃতীয় বৎসরে যে অধিমাস হয়, তাহাও হরিভজনে উপযোগী হোক – এটাই পরমার্থ-শাস্ত্রের নিগূঢ় চেষ্টা। আবার কর্মিগণ ঐ মাসকে সমস্ত সৎকর্মশূন্য বলে নির্দ্ধারিত করলেন। পরমার্থ শাস্ত্র মতে, “হে জীব! কেন অধিমাসে হরিভজনে আলস্য কর? এই মাস শ্রীমদ্ গোলোকনাথ-দ্বারা স্থাপিত হয়েছে। এমনকি, এটি কার্তিক, মাঘ ও বৈশাখ এই তিন মহা-পুণ্যমাস থেকেও শ্রেষ্ঠ । এইমাসে বিশেষ ভজন-বিধির সাথে শ্রীরাধাকৃষ্ণের অর্চ্চন করলে সমস্ত লাভ হবে।”
পরমার্থী তিন প্রকার- স্বনিষ্ঠ, পরিনিষ্ঠিত ও নিরপেক্ষ । পূর্বোক্ত কার্যসকল স্বনিষ্ঠ পরমার্থীর পক্ষেই ন্যায়সঙ্গত। পরিনিষ্ঠিত ভক্তমণ্ডলী নিজ নিজ আচার্য দ্বারা নির্দিষ্ট কার্তিক মাস ব্রত পালনের নিয়মানুসারে পুরুষোত্তম ব্রত পালন করতে অধিকারী। নিরপেক্ষ ভক্তগণ ঐকান্তিক প্রবৃত্তি (ইচ্ছা) দ্বারা শ্রীভগবৎপ্রসাদ সেবন, নিয়মের সহিত অহরহ সাধ্যানুসারে শ্রীহরিনাম শ্রবণ-কীর্তন দ্বারা সমস্ত পবিত্র মাস যাপন করে থাকেন। তবে ভক্তগণ স্বনিষ্ঠ, পরিনিষ্ঠিত ও নিরপেক্ষ একান্তভাব-ভেদে যথাধিকার শ্রীপুরুষোত্তম মাস পালন করবেন। ভগবান ব্রজনাথ শ্রীকৃষ্ণ এই মাসের অধিপতি। সুতরাং ‘অধিমাস’ ভক্তমাত্রেরই প্রিয় মাস, যেহেতু ঘটনাক্রমে এই মাসে কোনো কর্মকাণ্ডের পীড়ন নেই সেহেতু ভক্তির ব্যাঘাত হবে না ।
•••••••••┈┉━ (শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের প্রবন্ধাবলী, দ্বিতীয় অধ্যায়- অভিধেয় তত্ত্ব, পুরুষোত্তম-মাস-মাহাত্ম্য)
◼️ শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ :
কার্তিক মাসের বিশেষত্ব হচ্ছে এমাসে কৃষ্ণভাবনাবিহীন ব্যক্তিরাও কিছু সেবা করার প্রেরণা পায়। যারা কৃষ্ণভাবনাময় কোনোকিছু করে না, তারা এ মাসে আন্তরিকভাবে সেবা করার অনুপ্রেরণা লাভ করে। এ বিষয়ে একটি ভালো উদাহরণ দেওয়া যায়, অনেক সময় বড় দোকানগুলো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মূল্যছাড় দেয়। কিন্তু যারা দোকানের নিয়মিত ক্রেতা, তাদের জন্য এমন ছাড় গুরুত্বপূর্ণ নয় । কারণ তারা পণ্যটির গুরুত্ব বোঝে, তাই যেকোনো মূল্যে তা ক্রয় করবে। তেমনি যারা ভগবানের শুদ্ধভক্ত তারা কোনোরকম ছাড়ের অপেক্ষা না করেই বছরের ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত থাকে ।
•••••••••┈┉━ (জয়পতাকা স্বামীকে পত্র, জানুয়ারি ৩০, ১৯৬৯)
[শ্রীল প্রভুপাদ যদিও কার্তিক মাস প্রসঙ্গে এটি বলেছিলেন, পুরুষোত্তম মাসের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য । ]
◼️ শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজ :
বছরের সকল মাসের মধ্যে কার্তিক মাস বা দামোদর মাসে ভক্তিমুলক সেবা অন্যান্য সাধারণ মাসগুলোর চেয়ে একশত গুণ বেশি ফল প্রদান করে। কিন্তু পুরুষোত্তম মাস যা কিনা তিন বছরে একবার আসে, তার গুরুত্ব দামোদর মাসের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি। তাই এ মাসটি সকলের কাছে হরিনাম করার, ভগবৎসেবা করার অথবা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রদীপ দেখানোর একটি মহান সুযোগ। এই প্রকারে তারা তাদের পারমার্থিক সেবা বৃদ্ধি করতে পারে অথবা শুরু করতে পারে। পুরুষোত্তম মাস চলাকালীন সময়ে স্মার্ত মতে কোনো সংস্কারাদি অথবা বিবাহের কোনো অনুমোদন নেই। স্মার্তরা এই মাসকে পছন্দ করে না কিন্তু এ মাসে পারমার্থিক কার্যাবলীর মাধ্যমে অধিক সুকৃতি আদায় করা যায় ।
•••••••••┈┉━ প্রবচন, জুন ২৮, ২০১৫, বসন্ত কুঞ্জ, দিল্লী
আমরা জানি যে, দামোদর মাসের চেয়ে ‘পুরুষোত্তম মাসটি’ হাজার গুণ বেশি উপকারী, উপরন্তু এই শ্রীবৃন্দাবন ধামে বসে যেকোনো কিছুই আমরা করি না কেন তা এক হাজার গুণ বেশি ফল প্রদান করে। সুতরাং তা হলো এক সহস্র গুণের সহস্র গুণ, অর্থাৎ দশ লক্ষ বার। যা ঠিক দশ পয়সা খরচে আমেরিকা যাবার মতো।
•••••••••┈┉━ প্রবচন, জুলাই ১৩, ২০১৫, বলরাম হল, বৃন্দাবন, উত্তর প্রদেশ ।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ দামোদর মাস এই পুরুষোত্তম মাসের ১/১৬ অংশও না ✺
আগত পুরুষোত্তম মাসটি অন্য সকল মাসের মতো না। এই পুরুষোত্তম মাসে কোন শুভ কর্ম করতে বলা হয়নি। কোন বিবাহ কোন পুণ্যকর্মাদি অনুমোদিত নয় । কেবলমাত্র শুদ্ধভক্তি। কিন্তু ভক্তদের এই মাসটি অত্যন্ত বিশেষ মাস। এই মাসে কৃষ্ণের আরাধনা করার জন্য, এই মাসে রাধা কৃষ্ণের আরাধনা করার জন্য বিশেষভাবে অনুমোদিত । এটি আগামী অমাবস্যা থেকে শুরু হবে। স্মার্ত ব্রাহ্মণেরা এটিকে মলমাস বলে থাকে। কিন্তু ভক্তদের জন্য এই পুরুষোত্তম মাস সবচেয়ে বিশেষ মাস। বছরের মধ্যে দামোদর মাস শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু দামোদর মাস এই পুরুষোত্তম মাসের ১/১৬ অংশও না। যদি আপনারা এই পুরুষোত্তম মাস খুবই সতর্কতার সাথে পালন করেন, তাহলে আপনারা এই জীবন খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারবেন এবং এই জন্ম শেষে গোলোক বৃন্দাবনে ফিরে যেতে পারবেন ।
পূর্বজন্মে দ্রৌপদী মেধা ঋষির কন্যা ছিলেন। দুর্বাসা মুনি তাকে পুরুষোত্তম মাসের গুণকীর্তন করেছিলেন, “পরমপবিত্র পুরুষোত্তম মাসটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বাধিক প্রিয়। এ মাসে কেবল একবার পূণ্যস্নান করেই যেকোনো নর-নারী সমস্ত পাপ হতে মুক্তিলাভ করতে পারে। এই মাস সকল মাস হতে শ্রেষ্ঠ। অন্য সমস্ত মাসের মহিমা এ মাসের এক কলা বা ষোলো ভাগের এক ভাগেরও সমান নয়। এ মাসে এমনকি মাত্র একবার কোনো পুণ্যতীর্থে স্নান করলে বারো হাজার বছর ধরে গঙ্গাতে স্নান করার সমান ফল বা বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে গঙ্গা বা গোদাবরী স্নানে যে ফল লাভ হয়, তা প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে। যদি তুমি এ মাসে একবার স্নান কর, দান কর এবং কৃষ্ণনাম কর, তাহলে তোমার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে। তুমি সর্বসিদ্ধি লাভ করবে এবং তোমার সকল মনোবাসনা পূর্ণ হবে। দয়া করে আমার উপদেশ অনুসরণ কর। দয়া করে আসন্ন পুরুষোত্তম মাসকে যত্নসহকারে পূজা করতে ভুলো না।”
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাসের প্রয়োজনীয় মন্ত্রাবলী ✺
✤ অর্ঘ্য মন্ত্র ✤
দেব দেব নমস্তভ্যং পুরাণ পুরুষোত্তম।
গৃহাণার্ঘ্যং ময়া দত্তং রাধয়া সহিত হরে ॥
✤ আরতি (নীরাজন) মন্ত্র ✤
নীরাজয়ামি দেবেশমিন্দীবর-দলচ্ছবিম্।
রাধিকারমণং প্রেম্না কোটীকন্দর্প সুন্দরম্ ॥
✤ ধ্যান মন্ত্র ✤
অন্তর্জ্যোতিরত্ন রত্নরচিতে সিংহাসনে সংস্থিতম্।
বংশীনাদ-বিমোহিত-ব্রজবধু-বৃন্দাবনে সুন্দরম্॥
ধ্যায়েদ্ রাধিকয়া সকৌস্তুভমণি-প্রদ্যোতিতোরস্থলম্।
রাজদ্ রত্নকীরিট-কুণ্ডলধরং প্রত্যগ্রপীতাম্বরম্ ॥
✤ প্রণাম মন্ত্র ✤
(৩৩ বার প্রণাম নিবেদন করুন)
বন্দে নবঘনশ্যামং দ্বিভুজং মুরলীধরম্।
পীতাম্বরধরং দেবাং সরাধাং পুরুষোত্তমম্।।
✤ পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র ✤
(এই মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রতিদিন রাধা কৃষ্ণের চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করুন)
নৌমি নবঘনশ্যামং পীতবাসসমুচ্যতম্ ।
শ্রীবৎসভাসিতোরস্কং রাধিকাসহিতং হরিম্।।
✤ জপমন্ত্ৰ মন্ত্র ✤
(৩৩ বার জপ করুন)
গোবর্দ্ধনধরং বন্দে গোপাল গোপরূপিণম্।
গোকুলৎসবমীশানং গোবিন্দং গোপিকাপ্রিয়ম্ ।।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ কেন স্মার্ত ব্রাহ্মণেরা এই মাসটিকে পছন্দ করে না? ✺
এটি কৃষ্ণভাবনামৃতে অগ্রগতির জন্যে বিশেষভাবে উপযোগী। কেউ একজন গৃহস্থ হতে পারেন, তাঁর পুত্র-কন্যাদি থাকতে পারে এবং জীবনের শেষে তিনি গোলোকে যাবেন। মূলত, আপনি যদি কৃষ্ণভাবনাময় হতে চান, তার জন্যে মাসটি খুবই ভালো । কিন্তু আপনি যদি স্বর্গে যেতে চান অথবা কোন পুণ্যকর্ম অর্জন করতে চান, তবে মাসটি খুব একটা ভালো নয় । একারণেই অধিকাংশ স্মার্ত ব্রাহ্মণেরা মাসটিকে পছন্দ করেন না । তাঁরা সকাম কর্মের প্রতি আসক্ত । কিন্তু ভক্তেরা এই মাসটি ভালোবাসে এবং মাসটি নিষ্কাম কর্মের জন্যে খুবই ভালো। •••••••••┈┉━ প্রবচন, শ্রীল জয়পতাকা স্বামী, ১০ই মে, ২০১৮; চেন্নাই, ভারত।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “অন্য সকল মাস সকাম, কিন্তু এই ‘পুরুষোত্তম মাস’ নিষ্কাম। যিনি সকল প্রকার কামনা শূন্য বা সকল কামনা যুক্ত হয়েও এই মাসে আমার সেবা করবে সে সমস্ত কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। যদিও আমার ভক্তদের কদাচিৎ অপরাধ হয়, কিন্তু এই পুরুষোত্তম মাসে ভক্তদের কখনই অপরাধ হবে না। যে সকল মহামূঢ় এই অধিমাসে জপ-দানাদি বর্জিত ও সৎকর্ম-স্নানাদি থেকে বিরত থাকে এবং দেব, তীর্থ ও দ্বিজগণের প্রতি বিদ্বেষ করে, সেই সকল দুষ্ট দুর্ভাগা পরভাগ্যোপজীবী হয়ে স্বপ্নেও কোনো সুখ পায় না। এই পুরুষোত্তম মাসে যে আমাকে ভক্তিপূর্বক অর্চন করবে, তিনি ধন-পুত্রাদি-লাভে সুখ ভোগ করে অবশেষে গোলোকবাসী হবে (অর্থাৎ আমার ধামে ফিরে আসবে)।”
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ শ্রীশ্রী যুগল অষ্টকম্ ✺
—– শ্রীল জীব গোস্বামী
কৃষ্ণ প্রেমময়ী রাধা, রাধা প্রেমময় হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥১॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা, শ্রীকৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেমের জন্য সৃষ্ট এবং শ্রীহরি, শ্রীমতীরাধার বিশুদ্ধ প্রেমের জন্য সৃষ্ট।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ : আমার চিরন্তন আশ্রয়।
কৃষ্ণস্য দ্রবীনম রাধা, রাধায়াঃ দ্রবীনম্ হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥২॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য এবং শ্রীহরি হলেন রাধার ঐশ্বর্য।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ : আমার চিরন্তন আশ্রয়।
কৃষ্ণ প্রাণময়ী রাধা, রাধা প্রাণময় হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৩॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের জীবনীশক্তি, তাঁর প্রাণ এবং শ্রীহরি হলেন শ্রীমতী রাধার জীবনীশক্তি, তাঁর প্রাণ।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ : আমার চিরন্তন আশ্রয়।
কৃষ্ণ দ্রবময়ী রাধা, রাধা দ্রবময় হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৪॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা, শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন, ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, সম্পূর্ণভাবে মিলিত এবং শ্রীহরি, শ্রীমতী রাধা থেকে অভিন্ন, ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, সম্পূর্ণভাবে মিলিত।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ : আমার চিরন্তন আশ্রয়।
কৃষ্ণ গেহে স্থিতা রাধা, রাধা গেহে স্থিতঃ হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৫॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা, শ্রীকৃষ্ণের দেহে অবস্থিত এবং শ্রীহরি, শ্রীমতীরাধার দেহে অবস্থিত।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ : আমার চিরন্তন আশ্রয়।
কৃষ্ণ চিত্ত স্থিতা রাধা, রাধা চিত্ত স্থিত হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৬॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা, শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়ে অবস্থিত এবং শ্রীহরি, শ্রীমতীরাধার হৃদয়ে অবস্থিত।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ: আমার চিরন্তন আশ্রয়।
নীলাম্বর ধর রাধা, পীতাম্বর ধর হরিঃ ।
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৭॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা নীল রঙের বস্ত্র পরিধান করেন এবং শ্রীহরি হলুদ রঙের বস্ত্র পরিধান করেন।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ: আমার চিরন্তন আশ্রয়।
বৃন্দাবনেশ্বরী রাধা, কৃষ্ণ বৃন্দাবনেশ্বরঃ
জীবনে ন ধনে নিত্যম্, শ্রীরাধাকৃষ্ণ গতির্মম ॥৮॥
অনুবাদ: শ্রীমতী রাধা হলেন বৃন্দাবনের অধীশ্বরী এবং শ্রীকৃষ্ণ হলেন বৃন্দাবনের অধীশ্বর।
জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ রাধা এবং কৃষ্ণ: আমার চিরন্তন আশ্রয়।
পুরুষোত্তম মাসে প্রদীপ নিবেদনের সময় প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই অষ্টকম্টি কীর্তনটি করুন।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ শ্রীশ্রী চৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম্ ✺
—– শ্রী বিল্বমঙ্গল ঠাকুর
ব্রজে প্রসিদ্ধম্ নবনীতচৌরম্, গোপাঙ্গনানাম্ চ দুকূলচৌরম্।
অনেক জন্মার্জিত পাপচৌরম্, চৌরাগ্রগণ্যম্ পুরুষম্ নমামি ॥১৷৷
অনুবাদ: যিনি ব্রজে মাখন চোর রূপে খ্যাত এবং যিনি গোপীদের বস্ত্র চুরি করেন এবং যিনি তাঁর আশ্রয় গ্রহণকারী ভক্তদের বহু জন্ম ধরে সঞ্চিত পাপগুলি চুরি (হরণ) করেন, সেই চোর শিরোমনিকে আমি প্রণাম নিবেদন করি।
শ্রীরাধিকায়া হৃদয়স্য চৌরম্, নবাম্বুদশ্যামলকান্তিচৌরম্।
পদাশ্রিতানাম্ চ সমস্ত চৌরম্, চৌরাগ্রগণ্যম্ পুরুষম্ নমামি ॥২॥
অনুবাদ: যিনি রাধিকার হৃদয় (চিত্ত) চুরি (হরণ) করেন, যিনি সদ্য সৃষ্ট বাদলের আঁধার কালো মেঘের শোভা (কান্তি) চুরি করেন ও যিনি তাঁর চরণে আশ্রয় গ্রহণকারী ভক্তগণের সর্বস্ব পাপ ও কষ্ট চুরি (হরণ) করেন, সেই চোর শিরোমনিকে আমি প্রণাম নিবেদন করি।
অকিঞ্চনীকৃত্য পদাশ্রিতম্ যঃ, করোতি ভিক্ষুম্ পথি গেহহীনম্।
কেনাপ্যহো ভীষণচৌর ঈদৃগ, দৃষ্টঃ শ্রুতো বা ন জগত্রয়েহপি ॥৩॥
অনুবাদ: যিনি তাঁর চরণে আশ্রয় গ্রহণকারী ভক্তগণদের নিঃস্ব দরিদ্র করে (তাদের স্ত্রী-পুত্র, ধনাদি সর্বস্ব হরণ করে) তাদেরকে গৃহহীন ও পথের ভিক্ষুক করে দেন, আহা! এমন ভয়ঙ্কর চোর তিন জগতে কেউ কখনও দেখেও নি বা শোনেও নি।
যদীয় নামাপি হরত্যশেষম্, গিরি-প্রসারানপি পাপরাশিন্ ।
আশ্চর্যরূপঃ ননু চৌর ঈদৃগ্, দৃষ্টঃ শ্রুতো বা ন ময়া কদাপি ॥৪॥
অনুবাদ: শুধুমাত্র তাঁর নাম উচ্চারণ করা মাত্রেই জীবের পর্বত প্রমাণ পাপরাশি তিনি নিঃশেষে হরণ (চুরি) করেন – এমন আশ্চর্যজনক বিস্ময়কর চোর আমি কোথাও দেখিনি বা শুনিনি!
ধনম্ চ মানম্ চ তথেন্দ্রিয়াণি, প্রাণাংশ্চ হৃত্বা মম সর্বমেব ।
পলায়সে কুত্র ধৃতোহন্দ্য চৌর, ত্বম্ ভক্তিদাম্নাসি ময়া নিরুদ্ধঃ ॥৫৷৷
অনুবাদ: ওহে চোর! তুমি আমার ধন (সম্পদ), আমার মান (সম্মান), আমার ইন্দ্রিয়, আমার প্রাণ (জীবন) এবং আমার সবকিছু চুরি করে কোথায় পলায়ন করছ? আমি তোমাকে ভক্তির বাধন দিয়ে বেঁধে রাখব।
ছিনৎসি ঘোরম্ যমপাশবন্ধম্, ভিনৎসি ভীমম্ ভবপাশবন্ধম্ ।
ছিনৎসি সর্বস্য সমস্তবন্ধম্, নৈবাত্মনো ভক্তকৃতম্ তু বন্ধম্ ॥৬॥
অনুবাদ: তুমি ঘোর যমরাজের ভয়ানক বাঁধন ছিন্ন করতে পার, তুমি জড় জগতের ভয়ঙ্কর বাঁধন ছিন্ন করতে পার। এমনকি সকলের সবরকম বাঁধনই ছিন্ন করতে পার; কিন্তু তুমি তোমার ভক্তদের ভক্তির বাঁধন থেকে নিজেকে ছিন্ন করতে পার না।
মন-মানসে তামসরাশিঘোরে, কারাগৃহে দুঃখময়ে নিবদ্ধঃ।
লভস্ব হে চৌর! হরে! চিরায়, স্বচৌর্যদোষোচিতমেব দণ্ডম্ ॥৭॥
অনুবাদ: ওহে আমার সর্বস্ব হরণকারী! ওহে চোর! আজ আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের অন্ধকারময় দুঃখজনক কারাগারে চিরকালের জন্য বন্দী করে রাখব যা আমার অজ্ঞতার কারণে অত্যন্ত ভয়ানক অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সেখানে তুমি নিজের চৌর্যকার্যের (চুরি করার) অপরাধে উপযুক্ত শাস্তি (দণ্ড) পাবে!
কারাগৃহে বস সদা হৃদয়ে মদীয়ে, মদ্ভক্তিপাশদৃঢ়বন্ধন-নিশ্চল সন্।
ত্বাম্ কৃষ্ণ হে! প্রলয়কোটিশতান্তরেহপি, সর্বস্বচৌর হৃদয়ান্নহি মোচয়ামি ॥৮॥
অনুবাদ: ওহে কৃষ্ণ! আমার সর্বস্ব হরণকারী! তুমি আমার হৃদয় কারাগারে আমার ভক্তির বাঁধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হয়ে সর্বদা নিশ্চলভাবে অবস্থান কর। শতকোটি প্রলয়াবসানেও হৃদয় কারাগার হতে তোমাকে মুক্ত করব না।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ শ্রী নন্দ নন্দনাষ্টকম্ ✺
সুচারুবক্ত্রমণ্ডলং সুকর্ণরত্নকুণ্ডলম্ ।
সুচর্চিতাঙ্গচন্দনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ১॥
অনুবাদ: আমি সেই নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যার মুখমন্ডল অত্যন্ত আনন্দময়, যার সুন্দর কানে রত্নখচিত কানের দুল এবং যার সমস্ত শরীর সুগন্ধি চন্দনের গন্ধে স্নাত (অভিষিক্ত)।
সুদীর্ঘনেত্রপঙ্কজং শিখীশিখণ্ডমূর্ধজম্ ।
অনন্তকোটিমোহনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ২॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যার চোখ সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত (পূর্ণ বিকশিত) পদ্মের চেয়েও সুন্দর; যার মস্তক ময়ূর পালকের বিন্যাসে সুন্দরভাবে শোভিত; এবং যিনি লক্ষ লক্ষ কামদেবকে (প্রেমের দেবতা) মোহিত করেন।
সুনাসিকাগ্রমৌক্তিকং স্বচ্ছদন্তপঙ্ক্তিকম্ ।
নবাম্বুদাঙ্গচিক্কণং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৩॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যার সুন্দর নাক থেকে একটি হস্তী-মুক্তা ঝুলেছে; যার দাঁত অত্যধিক উজ্জ্বল; যাঁর গাত্র বর্ণ সদ্য সৃষ্ট বাদলের মেঘের চেয়েও সুন্দর এবং উজ্জ্বল।
করেণবেণুরঞ্জিতং গতিঃ করীন্দ্রগঞ্জিতম্ ।
দুকূলপীতশোভনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৪॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যিনি পদ্মের থেকেও সুকোমল হাতে বাঁশি ধারণ করে; যার মন্থর (ধীরস্থির) চলনভঙ্গি একটি আবেগপ্রবণ হাতিকেও পরাজিত করে; এবং যার শ্যামঘন গাত্রবর্ণ (অঙ্গ প্রত্যঙ্গ) হলুদ শাল দ্বারা অত্যাধিক শোভিত হচ্ছে।
ত্রিভঙ্গদেহসুন্দরং নখদ্যুতিঃ সুধাকরম্ ।
অমূল্যরত্নভূষণং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৫॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যার ত্রিভঙ্গ দেহভঙ্গিমাটি অত্যন্ত সুশ্রী, নিখুঁত সৌন্দর্যপূর্ণ, অত্যন্ত সুন্দর; যার পায়ের নখের সৌন্দর্যতা, উজ্জ্বলতা চাঁদকেও লজ্জা দেয়; এবং যিনি অমূল্য রত্ন খচিত অলঙ্কার পরিধান করেন।
সুগন্ধ অঙ্গসৌরভং উরো বিরাজি কৌস্তুভম্ ।
স্ফুরত্ শ্রীবত্সলাঞ্ছনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৬॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম নিবেদন করি, যার শরীরের লোমকুপ থেকে নিঃসৃত অতীব সুন্দর বিশেষ সুগন্ধি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে; এবং যার প্রশস্ত বক্ষ কৌস্তুভ মনি এবং ত্রিভুজাকার ‘শ্রীবৎস চিহ্ন’ দ্বারা শোভিত।
বৃন্দাবনসুনাগরং বিলাসানুগবাসসম্ ।
সুরেন্দ্রগর্বমোচনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৭॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম নিবেদন করি, যিনি বৃন্দাবনের এক দক্ষ প্রেমিক যাঁর নিখুঁত বিনোদন নিষ্কলঙ্ক; নির্দোষ; পবিত্র; এবং যিনি সেইসব বিনোদনের জন্য উপযুক্ত পোশাক পরেন এবং যিনি ইন্দ্রের অহংকারকে ধূলিসাৎ করেন।
ব্রজাঙ্গনাসুনায়কং সদা সুখপ্রদায়কম্ ।
জগন্মনঃপ্রলোভনং নমামি নন্দনন্দনম্ ॥ ৮॥
অনুবাদ: আমি নন্দনন্দনকে প্রণাম জানাই, যিনি ব্রজ গোপীদের প্রেমিক হিসাবে চিরকাল তাদের আনন্দ দেন এবং যিনি সমস্ত জীবের মনকে মোহিত করেন।
শ্রীনন্দনন্দনাষ্টকং পঠেদ্যঃ শ্রদ্ধয়ান্বিতঃ ।
তরেদ্ভবাব্ধিদুস্তরং লভেত্তদঙ্ঘ্রিয়ুক্তকম্ ॥ ৯॥
অনুবাদ: যে ব্যক্তি নিয়মিত এই (শ্রী নন্দ-নন্দনস্তকম) পাঠ করবে সে সহজেই বস্তুগত অস্তিত্বের আপাতদৃষ্টিতে অদম্য সমুদ্র অতিক্রম করবে এবং কৃষ্ণের পদ্মের চরণে অনন্ত বাসস্থান লাভ করবে।
ইতি শ্রীনন্দনন্দনাষ্টকং সম্পূর্ণম্ ।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাসে করণীয় ✺
স্মার্তগণ পুরুষোত্তম মাস বা অধিমাসকে ‘ মলমাস ’ বলে এই মাসে সমস্ত শুভকার্য পরিত্যাগ করে থাকেন । কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসকে পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য অন্য সকল মাস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নির্ণয় করেছেন । তিনি নিজের নামানুসারে এই মাসের নাম ‘পুরুষোত্তম ’ মাস রেখেছেন।
শ্রীবাল্মীকি – দৃঢ়ধন্বা সংবাদে উক্ত আছে —
পুরুষোত্তম মাসস্য দৈবতং পুরুষোত্তমঃ ।
তস্মাৎ সম্পজয়েদ্ভক্ত্যা শ্রদ্ধয়া পুরুষোত্তমম্ ॥
অনুবাদ: হে দৃঢ়ধন্বা ! পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণই পুরুষোত্তম মাসের অধিদেবতা । অতএব সেই মাসে প্রতিদিন ভক্তিশ্রদ্ধাপূর্বক পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে ষোড়শোপচারে পূজা করবে ।
নৈমিষারণ্যে শ্রীসূত গোস্বামী সমবেত ঋষিদেরকে বললেন,
ভারতে জনুরসাদ্য পুরুষোত্তমমূত্তমং।
ন সেবন্তে ন শৃণ্বতি গৃহাসক্তা নরাধমাঃ ॥
গতাগতং ভজন্তেহত্ৰ দুৰ্ভগা জন্মজন্মনি।
পুত্রমিত্র কলত্ৰাপ্ত-বিয়োগদ্দুঃখভাগিনঃ ॥
অস্মিন্মাসে দ্বিজশ্রেষ্ঠা নাসচ্ছাস্ত্রান্যুদাহরেৎ।
ন স্বপ্নেৎ পরশয্যায়াং নালপেৎ বিতথং ক্বচিৎ ॥
পরপবাদন্ন কথঞ্চিৎ কদাচন।
পরান্নঞ্চ ন ভুঞ্জীত ন কুর্বীত পরক্রিয়াম্ ॥
বিত্তশাঠ্যং কুর্বাণোদানং দদ্যাদ্দিজাতয়ে ।
বিদ্যমানে ধনে শাঠ্যং কুর্বাণো রৌরবং ব্রজেৎ ॥
দিনে দিনে দ্বিজেন্দ্রায় দত্ত্বা ভোজনমুত্তমম্।
দিবসস্যাষ্টমে ভাগে ব্রতী ভোজনমাচরেৎ ॥
ইন্দ্ৰদ্যুম্নঃ শতদ্যুম্নো যৌবনাশ্বো ভগীরথঃ।
পুরুষোত্তমমারাধ্য যযুৰ্ভগবদন্তিকম্ ॥
তস্মাৎ সর্বপ্রযন্তেন সংসেব্যঃ পুরুষোত্তমঃ।
সর্বসাধনতঃ শ্রেষ্ঠঃ সবাৰ্থফলদায়কঃ ॥
গোবর্দ্ধনধরং বন্দে গোপাল গোপরূপিণম্।
গোকুলোৎসবমীশানং গোবিন্দং গোপীকাপ্রিয়ম্ ॥
কৌণ্ডিন্যেন পুরাপ্রোক্তমিমং মন্ত্ৰং পুনঃ পুনঃ ।
জপন্মাসং নয়েদ্ভক্ত্যা পুরুষোত্তমমাপ্নুয়াৎ ॥
ধ্যায়েন্নবঘনশ্যামং দ্বিভুজং মুরলীধরম্।
লসৎপীতপটং রম্যং সরাধং পুরুষোত্তমম্ ॥
ধ্যায়ং ধ্যায়ং নয়েন্নাসং পূজয়ন পুরুষোত্তমম্।
এবং যাঃ কুরুতে ভক্ত্যা স্বাভীষ্টং সর্বমাপ্নুয়াৎ ॥
✺ “ভারতভূমিতে জন্মলাভ করে যে গৃহাসক্ত নরাধমগণ শ্রীপুরুষোত্তম ব্রতকথা শ্রবণ ও ব্রত পালন করে না, সেই দুর্ভাগাগণ জন্ম-মরণ এবং পুত্র-মিত্র, পত্নী ও নিজজন বিয়োগজনিত দুঃখভাগী হয়।”
✺ “হে দ্বিজবরগণ! এই পুরুষোত্তম মাসে বৃথা কাব্যালঙ্কারাদি অসৎ-শাস্ত্র আলোচনা করবে না, পরশয্যায় শয়ন এবং সর্বদা বিষয় সম্পদ নিয়ে চিন্তা বা আলাপ আলোচনা করবে না; পরনিন্দা, পরান্নভোজন ও পরকার্য করবে না, কৃপণতা পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মণকে দান করবে। ধন (অর্থ) থাকা স্বত্বেও কৃপণতা করলে রৌরব নামক ভয়ঙ্কর নরকে যেতে হয়।”
✺ “প্রতিদিন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদেরকে উত্তম (উৎকৃষ্ট) ভোজন দেবে। ব্রতী (ব্রত পালনকারী) সর্বদা নিজে দিবসের অষ্টম ভাগে ভোজন করবে।
✺ ইন্দ্রদ্যুম্ন, যৌবনাশ্ব ও ভগীরথ প্রমুখ রাজারা শ্রীপুরুষোত্তমকে আরাধনা করে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। সর্বপ্রকার যত্নের সাথে পুরুষোত্তমের সেবা করবে। এই সেবা সকল সাধন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বার্থফলপ্রদ।
✺ ‘গোবর্দ্ধন ধরং’ এই মন্ত্র জপ করে কৌণ্ডীন্য মুনি শ্রীপুরুষোত্তমকে প্রাপ্ত করেছিলেন।
✺ “নবঘন-দ্বিভুজ মুরলীধর, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধার সাথে নিয়ত ধ্যান করতে হবে। যিনি পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক এরূপ করেন, তিনি সকল অভীষ্ট (আকাঙ্ক্ষা) লাভ করেন।”
পুরুষোত্তম মাসে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সাধনের উদ্দেশ্যে নানারকম ব্রতনিয়ম গ্রহণ করা যেতে পারে। কীভাবে সময়ের সর্বোচ্চ উপযোগ করে ভগবানের সেবা করা যায় সেটাই সংকল্প হওয়া উচিত। তবে সর্বদা খেয়াল রাখা উচিত যে, নিয়মগুলো (ব্রতের সংকল্প) যেন শুধু লোকদেখানো বা নিয়মাগ্রহ না হয়ে থাকে। ব্রতের সময়সীমা পর্যন্ত যেন সেগুলো পালন করা যায় সেটাও বিবেচনা করবে।
ওঁ বিষ্ণুপাদ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের গৌড়ীয় পত্রিকার ১৪ই জুলাই ১৯২৮ সংখ্যার একটি প্রবন্ধ হতে এবং শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের কিছু উক্তি থেকে জানা যায় –
সর্বোচ্চ যত্ন সহকারে পুরুষোত্তম ভগবানের সেবা করুন। পুরুষোত্তমের প্রতি এই সেবাই সর্বোচ্চ সাধনা এবং সর্ববৃহৎ ফল দান করে। ভক্তির সাথে মন্ত্র উচ্চারণ করুন গোবর্ধনধরং মন্ত্র বা জপ মন্ত্র
গোবর্দ্ধনধরং বন্দে গোপাল গোপরূপিণম্।
গোকুলৎসবমীশানং গোবিন্দং গোপিকাপ্রিয়ম্ ।।
এভাবে আপনি পুরুষোত্তমদেবকে লাভ করবেন। রাধারাণীর সাথে কৃষ্ণের ধ্যান করুন যিনি নবঘনশ্যাম বর্ণ ধারণ করে দুই হাতে মুরলী বাঁশি ধারণ করেছেন এবং পীত বসন পরিধান করেন । যেভাবে দামোদরব্রত পালন করা হয়, সেভাবেই এই ব্রত পালন করা উচিত, পুরুষোত্তমের প্রীতির জন্য দীপ দান করা উচিত, ঘৃত প্রদীপ বা সামর্থ্য না হলে তিলের তৈলের প্রদীপ। সম্ভব হলে, ব্রতপালনকারীর ব্রাহ্মমূহূর্তের পূর্বে স্নান করা উচিত, এরপর আচমন করে গোপীচন্দন দ্বারা তিলক, শঙ্খ ও চক্র ধারণ করা উচিত।
এই মাসে রাধা-কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে আরাধনা করা উচিত। পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসের প্রধান আরাধ্যদেব । আরো সেবা আছে যা এই মাসে করা যেতে পারে যেমন- শ্রীকৃষ্ণকে ষোড়শ উপাচার দ্বারা পূজা করা, ভোরে স্নান করা ইত্যাদি, ভক্তিভরে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করা, শালগ্রামশিলার অর্চনা করা । যিনি এই ব্রত পালন করেন, তার মাঝে সকল পবিত্ৰ ধাম ও দেবতারা বাস করেন। এই মাসে বৈষ্ণবদের সেবা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
যারা সাধারণত ভাগবতধর্ম পালনে শতভাগ সময় অতিবাহিত করেন, এই পুরুষোত্তম মাসে, এককভাবে নিয়ম অনুসারে এবং লক্ষ্য অনুসারে শ্রীভগবৎ প্রসাদ গ্রহণ করে ভক্তিতে নিমজ্জিত হওয়া, হরি-শ্রবণ কীর্তনে যুক্ত হওয়া উচিত।
যারা শতভাগে ভক্তিমূলক সেবায় জড়িত নয়, ব্রত পালনের ভিন্ন পদ্ধতি ও নিয়ম রয়েছে। অনেকে এই মাসে হবিষ্য গ্রহণ করে । সূত গোস্বামী বলেন, দুর্ভাগ্য এড়াতে এই মাসে ব্ৰত পালন করা উচিত।
সীমাহীন আশীর্বাদ লাভের জন্য পুরুষোত্তম মাসে করণীয় হল —-
❃ এ মাসে নিম্নলিখিত এই চারটি পাপকর্ম অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা উচিত।
◉ আমিষ আহার
◉ নেশা খাওয়া
◉ দ্রুতক্রিয়া (জুয়া খেলা)
◉ স্ত্রীসংঙ্গ
– পুরুষোত্তম মাসে দেবতা, বেদ, গুরু, গো, ব্রতী, স্ত্রীলোক, রাজা ও মহাজনদের নিন্দা পরিত্যাগ করবে।
❃ ব্রহ্মমুহূর্তে (সূর্য উদয়ের পূর্বে) স্নান
এই মাসে শুধুমাত্র সূর্যোদয়ের পূর্বে স্নান করলেই দশ হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়।
এ মাসে এমনকি একবার তীর্থস্নান করলে বারো হাজার বছর ধরে গঙ্গাতে স্নান করার সমান ফল লাভ হয় বা বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে গঙ্গা বা গোদাবরী স্নানের ফল লাভ হয়। এ স্নানের ফলে সকল দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়।
❃ মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ
❃ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন
পুরুষোত্তম মাসে প্রতিদিন নির্ধারিত সংখ্যামালার অতিরিক্ত (৮, ১৬, ২৪, ৩২, ৩৩, ৪৮, ৬৪ বা তদূর্ধ্ব মালা) জপ করা উচিত এবং যতবেশি সম্ভব হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করা উচিত।
❃ স্তোত্র পাঠ ও বৈষ্ণবীয় ভজন-কীর্তন
এ মাসে প্রতিদিন ‘শ্রীশ্রী যুগল অষ্টকম্’, ‘শ্রীশ্রীচৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম’, ‘জগন্নাথাষ্টকম’, ‘রাধা-কৃষ্ণ কৃপাকটাক্ষস্তোত্রম’ , ‘নন্দনন্দনাষ্টকম‘, প্রভৃতি স্তোত্রবলী পাঠ ও পূর্বতন আচার্যবৃন্দদের দ্বারা কৃত ভজন কীর্তন (এককথায়, বৈষ্ণবীয় ভজন-কীর্তন) করা উচিৎ।
❃ বিশেষ সংখ্যা: ৩৩
এ মাসে ৩৩ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন সেবায় ৩৩ সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
◉ তাই প্রতিদিন অবশ্যই শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ৩৩বার দন্ডবৎ প্রণাম নিবেদন করা উচিৎ।
◉ ৩৩ টি প্রদীপ দান, ৩৩ টি ফল ও পুষ্প নিবেদন করা উচিৎ।
◉ ৩৩বার রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে পরিক্রমা করা উচিত।
◉ ৩৩ বার তুলসী পরিক্রমা করা উচিত।
(পুরানে বর্ণিত আছে, এ মাসে কৌশিক মুনি ও তাঁর পুত্র মৈত্রেয় মুনি ব্রাক্ষনগনকে ৩৩টি আপুপ -দান করেছিলেন। আপুপ হল আতপচাল, চিনি ও ঘি দিয়ে তৈরি পিঠে)।
❃ তুলসী পরিক্রমা ও জল দান
❃ সন্ধ্যায় দীপ দান
এই মহাপবিত্র মাসে রয়েছে একসাথে একলক্ষ প্রদীপ নিবেদনের সুযোগ!
পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য প্রতি সন্ধ্যায় ঘৃত বা তিল-তৈলের সাথে কর্পূর মিশ্রিত প্রদীপ প্রদান করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত-প্রদীপ, নতুবা তিল তৈল-প্রদীপ দেওয়া উচিত।
প্রদীপ নিবেদন ভগবানের চরণে ৪ বার, নাভিকমলে ২ বার, মুখমন্ডলে ৩ বার এবং সর্বাঙ্গে ৭ বার ঘড়ির কাঁটার ন্যায় ডানদিকে থেকে দেখাবেন এবং ‘শ্রীশ্রী যুগল অষ্টকম্’, ‘শ্রীশ্রীচৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম’ অষ্টকমটি কীর্ত্তন করবেন।
যোগো জ্ঞানং তথা সাংখ্যং তন্ত্রাণি সকলানপি।
পুরুষোত্তমদীপস্য কলা নাহন্তি ষোড়শীম্ ॥
অনুবাদ: অষ্টাঙ্গযোগ, ব্রহ্মজ্ঞান ও সাংখ্যজ্ঞান এবং সমস্ত তান্ত্রিক ক্রিয়া পুরুষোত্তম মাসে দীপ দানের ষোড়শী কলারও তুল্য হয় না।
পদ্মপুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে, যদি কেউ শুষ্ক তুলসী কাষ্ঠের মাধ্যমে ভগবানকে শ্রীকৃষ্ণকে প্রদীপ নিবেদন করে, তাহলে সাধারণ প্রদীপ নিবেদনের চেয়ে ভগবান এক্ষেত্রে লক্ষগুণ বেশি সন্তুষ্ট হন।
সহজভাবে বলা হলে, সাধারণ প্রদীপ ১ লক্ষ বার নিবেদন করা হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যতটা সন্তুষ্ট হন, একটি তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করা হলে ভগবান তার চেয়েও বেশি সন্তুষ্ট হন।
আগত পুরুষোত্তম মাসে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে চৌরাগ্রগণ্যপুরুষাষ্টকম্ কীর্ত্তনের সাথে সাথে প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য। সেক্ষেত্রে সকলেই তুলসীকাঠের প্রদীপ নিবেদন করতে পারেন।
◼️ কীভাবে তৈরী করবেন তুলসীকাঠের প্রদীপ?
১. প্রথমে শুকনো তুলসীবৃক্ষ খোঁজ করতে হবে।
অনেকেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকসময় তুলসীবৃক্ষ শুষ্ক হয়ে যায়, সব পাতা ঝরে যায়, তুলসী প্রাপ্তি বা দেহত্যাগ করেন, সেই শুষ্ক বৃক্ষ জলে ভাসিয়ে বা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। প্রদীপের জন্য এরকম শুষ্ক তুলসী সংগ্রহ করতে হবে। যদি তাজা বৃক্ষ থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হয়, সেটাতে হিতে বিপরীত হবে!
২. শুকনো তুলসীর ডাল ধুয়ে শুকিয়ে নিতে পারেন।
৩. শুকনো ডাল গুলো ৬ বা ৭ ইঞ্চি করে কেটে নিতে হবে। (আরো বড় কাটা যেতে পারে, কিন্তু বেশি ছোট কাটা হলে প্রদীপের আগুনের আঁচ হাতে লাগতে পারে)
৪. এবার তুলা নিয়ে একেকটি ডালে সমানভাবে পেচাতে হবে। সবগুলো ডালে তুলো পেচিয়ে এভাবে সলিতা বানিয়ে রেখে দিতে পারেন।
৫. প্রদীপ নিবেদনের আগে তুলা পেচানো তুলসীর ডালের সলিতাগুলো ঘিয়ে ডুবিয়ে তারপর অতিরিক্ত ঘি সরিয়ে দিয়ে সলিতাগুলোর মাথায় কর্পূর লাগাতে হবে।
৬. এরপর কর্পূরে আগুন জ্বালালে আস্তে আস্তে পুরো সলিতাটিয় জ্বলে উঠবে, সেক্ষেত্রে আগুন জ্বালানোর শুরু থেকেই প্রদীপ নিবেদন শুরু করা উচিত।
৭. নতুনদের জন্য সতর্কতা হিসেবে পুরুষোত্তম প্রদীপ নিবেদনের আগেই একদিন সলিতা তৈরি করে প্রদীপ নিবেদন করে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, সলিতার জন্য তুলসী কাঠ আরো বড় করে কাটা লাগবে কিনা, বা তুলা আরো বেশি পেচাতে হবে কিনা, ঘি আরো অধিক লাগবে কিনা ইত্যাদি। প্রয়োজনে প্রদীপের মধ্যেও তুলসীকাঠের সলিতাগুলো নিয়ে নিবেদন করতে পারেন।
৮. আরতি নিবেদনের জন্য, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীনিতাইগৌর, শ্রীনৃসিংহদেব, শ্রীবিষ্ণুকে চরণে চারবার, উদরে দুইবার, মস্তকে তিনবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। আর, শ্রীমতী রাধারাণী, শ্রীলক্ষ্মীদেবী, শ্রীতুলসীদেবীকে সর্বাঙ্গে সাতবার প্রদীপ নিবেদন করা উচিত। শ্রীরাধাকৃষ্ণের পর শ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রাকে (প্রত্যেককে সাতবার করে), এরপর শ্রীনৃসিংহদেব ও তারপর শ্রীনিতাইগৌরকে প্রদীপ নিবেদন করতে হয়। এরপর তুলসীদেবীকে নিবেদনের পর শ্রীগুরুপরম্পরাকে। গুরুপরম্পরায় প্রত্যেককে সাতবার বা পাঁচবার নিবেদন করতে হবে। তবে, যেহেতু প্রদীপ ইতোমধ্যে ভগবানকে নিবেদন করা হয়েছে, তাই এটি গুরুপরম্পরা, যেহেতু জীবতত্ত্ব তাই তাদের কেবল মুখমণ্ডলে প্রদীপ নিবেদনের জন্য আচার্যগণ বলে থাকেন। সকল আরতির ক্ষেত্রেই এই নিয়ম প্রযোজ্য।
সময়স্বল্পতা থাকলে (গৃহে বা মন্দিরে না থাকলে, বা কোনো প্রয়োজন থাকলে) কেবল শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন ও শ্রীগৌরনিতাইকে তথা অন্য ভগবৎ বিগ্রহকে প্রদীপ নিবেদন করতে পারেন।
নিজে তুলসীকাঠের সলিতার প্রদীপ নিবেদনের মহিমা জেনে ভগবানকে নিবেদন করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান করুন, অন্যকে জানিয়ে উৎসাহিত করে তার ও আপনার নিজের ভগবানকে আরো অধিক সন্তুষ্ট করার সুযোগ গ্রহণ করুন।
◼️ অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন তুলসীকাঠের প্রদীপ গুরুপরম্পরাকে নিবেদন ঠিক হবে কি না?
আসলে, যেকোনো আরতিই ভগবানকে নিবেদনের পর গুরুপরম্পরাকে ভগবানের প্রসাদরূপে দেখানো হয়। ধূপ, দীপ ইত্যাদি, পুষ্পব্যাতীত সকল আরতিই তুলসীযুক্ত জলে প্রৌক্ষণ করে ভগবানকে নিবেদন করা হয়, ঐ তুলসীযুক্ত আরতিই প্রসাদরূপে গুরুপরম্পরাকে নিবেদন করা হয়। এমনি তুলসীযুক্ত ভগবত মহাপ্রসাদও গুরুপরম্পরাকে দেওয়া হয়। এতে কোনো শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ হয়না। কারণ তা প্রসাদরূপে নিবেদিত হয়। আর আরতিসমূহ এক্ষেত্রে গুরুপরম্পরাকে বক্ষ পর্যন্ত নিবেদিত হয়। তাই এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
❃ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ
এ মাসে প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত ও অন্য সদগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করা উচিত । বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধে বর্ণিত ব্রহ্মস্তুতি ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চদশ (১৫ নং) অধ্যায় পাঠ করুন।
শ্রীমদ্ভাগবতং ভক্ত্যা শ্রোতব্যং পুরুষোত্তমে ।
তৎপুণ্যং বচসা বক্তৃং বিধাতা হি ন শক্নুয়াৎ ॥
অনুবাদ: পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক শ্ৰীমদ্ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ করবেন। ভাগবত শ্রবণের পুণ্য, বিধাতাও বলতে পারে না। ভক্তগণ শ্রীশালগ্রাম শিলার অর্চন করবেন।
❃ হবিষ্যান্ন গ্রহণ
অবশ্যই নিরামিষ খাদ্যবস্তু ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করবেন।
সম্ভব হলে মন্দিরে ভগবানের ভোগ নিবেদন ও ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবদের ভোজন করানো উচিত।
❃ প্রজল্প (অযথা কথোপকথন) বর্জন
শাস্ত্র অমান্যকারী বা শাস্ত্র বিরোধী ব্যক্তির সাথে আলাপ করবে না।
❃ অধিক গ্রন্থ অধ্যয়ন ও অধিক শ্রবণ
পুরুষোত্তম মাসে বেশি বেশি ভক্তিপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত কথা শ্রবণ করবেন ।
এ মাসে ব্রত শতক্রতু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । কেননা ক্রতু (এক প্রকার যজ্ঞ) করে স্বর্গ লাভ হয়। কিন্তু যিনি পুরুষোত্তম ব্রত করেন, তাঁর দেহে সকল তীর্থক্ষেত্র ও দেবতাগণ অবস্থান করেন ।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাসে দীপদানের মাহাত্ম্য ✺
❏❖ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ভালো ব্যক্তি ছিলেন না। তাই তাকে তার পরিবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু তার একজন সুপত্নী ছিল। তিনি তার পত্নীকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বনে বাস করতে থাকেন।
❏❖ কোনও একদিন তিনি একজন সাধুকে পথে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেলেন। সেই সময়ে তার হৃদয়ে সমবেদনা এল। তিনি সাধুকে তার কোলে তুলে নিয়ে তাকে নিজের গৃহে এলেন।
❏❖ গৃহে তিনি এবং তার পত্নী সাধুকে সেবা করে সুস্থ করার চেষ্টা করছিল। তারা পাখা দিয়ে অনবরত হাওয়া করছিল এবং থেকে থেকে জল পান করাচ্ছিল। একটু সুস্থ হলে সাধু বলেন তিনি পুষ্কর তীর্থে যাচ্ছিলেন। গরম ও উপবাস থাকার ফলে দুর্বলতার কারনে তিনি পথে অজ্ঞান হয়ে যান। তিনি ছিলেন কৃষ্ণের একজন মহান ভক্ত। ব্রাহ্মণ পরিবারের সেবায় তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন।
❏❖ সাধু জিজ্ঞেস করলেন, “কেন আপনারা বনে এমন দুর্দশায় বাস করছেন?” ব্রাহ্মণ বললেন, “আমি অত্যন্ত পাপী মানুষ। আমি লোকেদের সাথে খারাপ আচরণ করেছি। আপনি তো অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বলতে পারেন, আমাকে বলুন কেন আমি এইভাবে যন্ত্রণা ভোগ করছি এবং তার সমাধান কী?
❏❖ সাধু বললেন ───যাই হোক সে এক লম্বা কাহিনী, তবে আপনি পুরুষোত্তম মাসে কৃষ্ণকে একটি প্রদীপ দান করার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারেন। সাধারণত ঘৃত প্রদীপ নিবেদন করা উচিত, কিন্তু বনে থেকে আপনি ঘি নাও পেতে পারেন। তবে আপনি তিলের তেল ব্যবহার করতে পারেন, যখন আপনার অবস্থা ভালো হবে, তখন আপনি ঘি ব্যবহার করতে পারেন।
❏❖ এরপর ব্রাহ্মণ প্রতিদিন রাধা-কৃষ্ণকে একটি করে দীপদান করলেন। ফলে তিনি কৃষ্ণলোকে ফিরে গেলেন। কৃষ্ণকে আরাধনা করার জন্য এটি খুবই বিশেষ মাস।
মূলকথা── পুরুষোত্তম মাস হল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠার ডিসকাউন্ট মাস।
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ পুরুষোত্তম মাসের ব্রত মহিমা ✺
স্মার্ত ও পরমার্থ ভেদে বৈদিক শাস্ত্রে দুই রকমের বিধি আছে— একটি কর্মকাণ্ডীয় বিধি আর একটি পরমার্থ বিধি। কর্মকান্ডীয় মতে এই অধিমাস কে ‘মল মাস’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে এবং কোন শুভ কার্য করা হয় না। কিন্তু পরমার্থ বিধি অনুসারে এই অধিমাসকে ‘পুরুষোত্তম মাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন কি এই মাসে যদি কেউ কোন শুভ কার্য করে থাকেন তা হলে তার অন্য যে কোন মাসের থেকে অধিক ফল লাভ করবেন।
এই প্রসঙ্গে নারদীয় পুরাণে ৩১ অধ্যায়ে অধিমাসের মাহাত্ম্য উল্লেখ আছে। এই অধিমাস নিজের অপমান (লোকেরা ‘মল’ মাস বলে ঘৃণা করে) এবং অন্যান্য বারো – মাসের আধিপত্যের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে বৈকুন্ঠের অধিপতি ভগবান নারায়ণের কাছে গিয়ে নিজ দুঃখের কথা জানান। বৈকুণ্ঠপতি নারায়ণ কৃপা করে অধিমাসকে সঙ্গে নিয়ে গোলোকপতি কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন। অধিমাসের কাহিনী শ্রবণ করে দয়ার্দ্র শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেন,
অহমেতৈর্যথালোকে প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।
তথায়মপি লোকেষু প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ॥
অস্মৈ সমর্পিতাঃ সর্বে যে গুণাময়ি সংস্থিতাঃ।
মৎসাদৃশ্যমুপাগম্য মাসানামধিপো ভবেৎ ॥
জগৎপূজ্য জগদ্বন্দ্যো মাসোহয়ং তু ভবিষ্যতি ।
সর্বে মাসাঃ সকামশ্চ নিষ্কামোহয়ং ময়া কৃতঃ ॥
অকামঃ সর্বকামো বা যোহধিমাসং প্রপূজয়েৎ।
কর্মাণি ভষ্মসাৎ কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ম্ ॥
কদাচিণ্মম্ ভক্তানামপরাধোহতিগণ্যতে।
পুরুষোত্তম ভক্তানাং নাপরাধঃ কদাচন ॥
য এতস্মিন্মহামূঢ়া জপ দানাদি বর্জিতাঃ ।
সৎকর্ম স্নানরহিতা দেব-তীৰ্থ-দ্বিজ-দ্বিষঃ ॥
জায়ন্তে দুর্ভাগা দুষ্টাঃ পর ভাগ্যেপজীবিনঃ।
ন কদাচিৎ সুখং তেষাং স্বপ্নেহপি শশশৃঙ্গবৎ ॥
যেনাহমর্চ্চিতো ভক্ত্যা মাসেহস্মিন্ পুরুষোত্তমে।
ধন পুত্র সুখং ভুংজ্ঞা পশ্চাদ্গোলোকবাসভাক ॥
“হে রমাপতি! আমি যেমন এই জগতে পুরুষোত্তম নামে বিখ্যাত — এই অধিমাসও তেমন ত্রিলোকে পুরুষোত্তম রূপে বিখ্যাত হবে। আমার যে সমস্ত গুণ আছে, সে সব আমি এই মাসে অর্পণ করলাম। আমার সদৃশ হয়ে এই অধিমাস অন্য সকল মাসের অধিপতি হবে। এই মাস জগৎপূজ্য ও জগবন্দ্য। অন্য সকল মাস সকাম, কিন্তু এই ‘পুরুষোত্তম মাস’ নিষ্কাম। যিনি সকল প্রকার কামনা শূন্য বা সকল কামনা যুক্ত হয়েও এই মাসে আমার সেবা করবে সে সমস্ত কর্ম বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। যদিও আমার ভক্তদের কদাচিৎ অপরাধ হয়, কিন্তু এই পুরুষোত্তম মাসে ভক্তদের কখনই অপরাধ হবে না। যে সকল মহামূঢ় এই অধিমাসে জপ-দানাদি বর্জিত ও সৎকর্ম-স্নানাদি থেকে বিরত থাকে এবং দেব, তীর্থ ও দ্বিজগণের প্রতি বিদ্বেষ করে, সেই সকল দুষ্ট দুর্ভাগা পরভাগ্যোপজীবী হয়ে স্বপ্নেও কোনো সুখ পায় না। এই পুরুষোত্তম মাসে যে আমাকে ভক্তিপূর্বক অর্চন করবে, তিনি ধন-পুত্রাদি-লাভে সুখ ভোগ করে অবশেষে গোলোকবাসী হবে (অর্থাৎ আমার ধামে ফিরে আসবে)।”
একসময় শ্রীপাদ জননিবাস প্রভু বলেছিলেন। গীতার ১৫ অধ্যায় পুরুষোত্তম যোগ পড়া ভালো এবং বেশী সংখ্যক জপ ও গঙ্গায় স্নান করলে ভালো। এই মাসের মাহাত্ম্যে উল্লেখ আছে যদি সম্ভব হয় হবিষ্যান্ন খেতে পারেন। আমিষ আহার সম্পূর্ণ বন্ধ।
কথিত আছে, মেধা ঋষির কন্যা ‘পুরুষোত্তম’ মাসের মাহাত্ম্য শ্রবণ করেও ঐ মাসকে অবহেলা করেছিল, – তার ফলে তাকে বহু কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। পরজন্মে সেই ঋষিকন্যা দ্রুপদ (Dhrupada) রাজার কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন – নাম হয় দ্রৌপদী। তারপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে পান্ডবেরা দ্রৌপদীর সঙ্গে ‘পুরুষোত্তম’ মাস ব্রত পালন করে সমস্ত বনবাস দুঃখ অতিক্রম করেছিলেন। নৈমিষারণ্যে সূত গোস্বামী ঋষিদেরকে বলেন, ভারতে জন্ম নিয়ে যে গৃহাসক্ত নরাধমেরা ‘পুরুষোত্তম’ ব্রত পালন করে না, সেই দুর্ভাগারা বারংবার জন্ম-মৃত্যুর যাতনা ভোগ করে এবং স্ত্রী-পুত্র-মিত্র ও কুটুম্বাদির বিয়োগজনিত দুঃখ লাভ করে। এই মাসে পরনিন্দা, পরচর্চা, পর অন্ন ভোজন, অসৎ শাস্ত্র পাঠ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সম্ভব হলে বৈষ্ণব সেবা করতে পারেন।
✤ ব্রত কথা ১ ✤
একবার নৈমিষারণ্যে হাজার হাজার ঋষি সমবেত হয়ে তপস্যা করছিলেন। সৌভাগ্যবশত শ্রীসুত গোস্বামী তাঁর শিষ্যগণের সাথে সেখানে উপস্থিত হলেন। মুনিগণ তাঁকে দর্শন করে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন এবং একটি উত্তম ব্যাসাসন প্রদান করলেন।
মুনিগণ করজোড়ে বলতে লাগলেন, “হে সুত গোস্বামী! আমরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চমৎকার এবং আশ্চর্য লীলাকথা শ্রবণ করলাম । বৈদিক জ্ঞান অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। তাই প্রশ্ন, কীভাবে এই ভবসমুদ্র থেকে উদ্ধার পেয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারব?”
শৌনকাদি ঋষিগণের অনুরোধে সুত গোস্বামী বলতে লাগলেন, “হে মুনিবৃন্দ! শ্রবণ করুন। আমি সর্বপ্রথম পুষ্কর তীর্থে (বর্তমানে ভারতের রাজস্থানের আজমীর স্টেশন থেকে ১১ কি. মি উত্তরে অবস্থিত হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান। যা ‘আদিতীর্থ’ বা প্রথম তীর্থস্থান নামে খ্যাত) গিয়েছিলাম। এরপর হাজার হাজার তীর্থ ভ্রমণ করে হস্তিনাপুরে পৌঁছাই। সেখানে গঙ্গার তীরে পরীক্ষিত মহারাজ অসংখ্য ঋষিগণের সঙ্গে প্রায়োপবেশনে (সন্ন্যাসগ্রহণপূর্বক উপবাস করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর অপেক্ষায় উপবেশন) ছিলেন।” তখন শুকদেব গোস্বামী সেখানে উপস্থিত হলেন এবং দর্শন কড়া মাত্রই সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে সম্ভাষণ জ্ঞাপন করলেন। তাঁরা শুকদেব গোস্বামীকে উচ্চ আসনে বসতে দিলেন। তিনি পরীক্ষিত মহারাজকে ভাগবত কথা শ্রবণ করালেন। এখন আমি আপনাদেরকে ভগবানের সর্বাকর্ষক লীলাকথা বর্ণনা করছি।
একবার শ্রীনারদ মুনি বদরিকাশ্রমে শ্রীনারায়ণ ঋষির কাছে গিয়েছিলেন । তাঁর পাদপদ্ম থেকে অলকানন্দা প্রবাহিত হচ্ছিল। নারদ মুনি নারায়ণ ঋষিকে দণ্ডবৎ প্রণাম নিবেদনপূর্বক প্রার্থনা করলেন, “হে দেবেশ্বর! হে দয়ানিধে! হে লোকস্রষ্টা! আপনি পরমসত্য। আপনাকে আমার প্রণাম নিবেদন করছি। হে প্রভু! এই জড়জগতে সবাই ইন্দ্রিয় সুখে কতই না ব্যস্ত। তারা জীবনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে। তাই এ সমস্ত গৃহস্থ এবং আমার ন্যায় পরিব্রাজক সন্ন্যাসীগণের আচরণীয় এমন কোনো একটি পন্থা বলুন, যাতে আত্মোপলব্ধি লাভ করে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া যায়।”
শ্রীনারদের মধুর বচন শ্রবণ করে শ্রীনারায়ণ মৃদু হেসে বললেন, “হে নারদ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা শ্রবণ কর। এতে তোমার পাপরাশি ধ্বংস হবে। আমি জানি তুমি তা পূর্ণরূপে অবগত আছো। কিন্তু জনকল্যাণের স্বার্থে আবারও জিজ্ঞাসা করছ। তাই আমি তোমাকে পুরুষোত্তম ব্রতের মহিমা বলছি। এটি শুধু জাগতিক সুখই প্রদান করে না, ভগবদ্ধামে ফিরে যাবার যোগ্যতাও প্রদান করবে।”
নারদ বললেন, “হে ভগবান! আমি কার্তিক, চৈত্ৰ প্ৰভৃতি সকল মাসেরই মহিমা শুনেছি। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসটি কীরূপ? হে দয়ানিধি, আমাকে এই পবিত্র মাস সম্পর্কে বলুন। কীভাবে এ মাসকে মহিমান্বিত করা উচিত? আমি কি মন্ত্রই বা জপ করব? আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন।”
শ্রীনারায়ণ বললেন, “হে নারদ! পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। একবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর সাম্রাজ্য, রাজপ্রাসাদ এমনকি দ্রৌপদীকেও পাশাখেলায় পণ রেখেছিলেন। সেই খেলায় দুর্যোধনের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর ভরা রাজসভায় দুঃশাসন দ্বারা দ্রৌপদী অপমানিত হয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বস্ত্রহরণজনিত লজ্জা থেকে দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন। যুধিষ্ঠির মহারাজ তখন স্ত্রী ও ভ্রাতাগণসহ কাম্যবনে বাস করতে শুরু করেন।
✤ ব্রত কথা ২ ✤
একবার দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ, সেই বনে পাণ্ডবদের দেখতে যান। পাণ্ডবেরা ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করলেন। তাদের দুঃখ দেখে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত বিমর্ষ হলেন। তিনি দুর্যোধনের প্রতি সক্রোধ বচন বলতে লাগলেন। তখন মনে হলো ভগবান যেন সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করে দেবেন। তাই পাণ্ডবগণ ভগবানের কাছে বিনম্র চিত্তে প্রার্থনা নিবেদন করলেন। অর্জুনের বিনম্র প্রার্থনা শুনে ভগবান শান্ত হলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘হে অর্জুন! তোমাদের সবাইকে দর্শন করে এবং তোমাদের ভক্তিতে, ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে আমি এখন তোমাদের পুরুষোত্তম মাসের অত্যাশ্চর্য মহিমা বর্ণনা করব।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে পুরুষোত্তম মাসের মহিমা শ্রবণ করতে পাণ্ডবগণ অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর দিকে করুণাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্জুনকে বলতে লাগলেন, “হে পুরুষব্যাঘ্র, তোমরা কি তোমাদের দুঃখের কারণ জানো? তোমরা আমার প্রিয় ও অত্যন্ত দুর্লভ পুরুষোত্তম ব্রত পালন করনি। এজন্যই তোমরা দুঃখ পাচ্ছ। তোমরা ব্যাসদেবের উপদেশে সমস্ত বর্ণাশ্রমোচিত আচার পালন করেছ। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসের পূজা না করা পর্যন্ত আমার প্রতি শুদ্ধভক্তি লাভ করতে পারবে না।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “আমি এখন দ্রৌপদীর পূর্ব জন্মবৃত্তান্ত বলব। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী মেধা ঋষির কন্যা ছিলেন। শৈশবেই তার মাতৃবিয়োগ হলে তিনি পিতার তত্ত্বাবধানে পালিত হন। তিনি দিনে দিনে যৌবন প্রাপ্ত হলেন। তিনি খুব সুন্দরী হলেও পিতা তাঁর বিবাহের কোনো বন্দোবস্ত করতে আগ্রহী ছিলেন না। বান্ধবীদের পতি-পুত্রসহ সুন্দর সংসার দেখে তার দুশ্চিন্তা আরও বৃদ্ধি পেল। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন তার পিতৃবিয়োগ হলো ।
তখন তার অবস্থা আরও শোচনীয় হলো। সৌভাগ্যক্রমে একদিন দুর্বাসা মুনি সেখানে আগমন করলেন। মহান মুনিকে দর্শন করে তিনি প্রণতি নিবেদন করে ফল-মূলাদি ও পুষ্প নিবেদন করলেন। দুর্বাসা মুনি আশীর্বাদ দিতে উদ্যত হলে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন। মুনিবর তখন তার শোকের কারণ জানতে চাইলেন। সেই ব্রাহ্মণকন্যা বলতে লাগলেন, “হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছুই জানেন। এ জগতে আমার কোনো আশ্রয়দাতা নেই। আমার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন গত হয়েছেন। আমার পিতা কিংবা কোনো বড় ভ্রাতা নেই। আমার স্বামীও নেই যে আমাকে রক্ষা করবেন। হে মুনিবর, আমাকে এ সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি দান করুন।”
তার প্রার্থনা শ্রবণ করে ও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে দুর্বাসা মুনি তাকে কৃপা করতে মনস্থ করলেন। দুর্বাসা মুনি বললেন, “হে সুন্দরী, আগামী তিন মাসের মধ্যে পরমপবিত্র পুরুষোত্তম মাস শুরু হবে। এই পবিত্র মাসটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বাধিক প্রিয়। এ মাসে কেবল একবার পূণ্যস্নান করেই যেকোনো নর-নারী সমস্ত পাপ হতে মুক্তিলাভ করতে পারে। এই মাস সকল মাস হতে শ্রেষ্ঠ। অন্য সমস্ত মাসের মহিমা এ মাসের এক কলা বা ষোলো ভাগের এক ভাগেরও সমান নয়। এ মাসে এমনকি মাত্র একবার কোনো পুণ্যতীর্থে স্নান করলে বারো হাজার বছর ধরে গঙ্গাতে স্নান করার সমান ফল বা বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে গঙ্গা বা গোদাবরী স্নানে যে ফল লাভ হয়, তা প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে। যদি তুমি এ মাসে একবার স্নান কর, দান কর এবং কৃষ্ণনাম কর, তাহলে তোমার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে। তুমি সর্বসিদ্ধি লাভ করবে এবং তোমার সকল মনোবাসনা পূর্ণ হবে। দয়া করে আমার উপদেশ অনুসরণ কর। দয়া করে আসন্ন পুরুষোত্তম মাসকে যত্নসহকারে পূজা করতে ভুলো না।”
এ কথা বলে দুর্বাসা ঋষি চুপ করলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই ব্রাহ্মণকন্যা তাঁর কথায় বিশ্বাস করলেন না। বরং ক্রোধান্বিত হয়ে নিন্দাপূর্ণ বাক্য করতে লাগল, “হে মহামুনি, আপনি মিথ্যা বলছেন। কীভাবে এই অতিরিক্ত মাসটি, যাকে মলমাস বলা হয়, তা অন্য সকল মাস এমনকি, কার্তিক বা মাঘ বা বৈশাখ হতেও শ্রেষ্ঠ হবে? আমি আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারি না । আপনি আমাকে প্রতারিত করার চেষ্টা করছেন। এই অতিরিক্ত মাসে সব রকম শ্রেষ্ঠ কর্ম অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয় ।”
তার এসকল কথা শুনে দুর্বাসা ঋষি ক্রোধান্বিত হলেন। তাঁর চোখ উত্তপ্ত তাম্ৰগোলকের ন্যায় লাল হয়ে গেল। কিন্তু বালিকাটির অসহায় অবস্থা বিবেচনা করে তিনি নিজেকে সংবরণ করে বলতে লাগলেন, “ওরে দুর্মতি! তোর পিতা আমার বাল্যবন্ধু। তাই তোকে অভিশাপ দিচ্ছি না। তার উপরে এখন তোর নিতান্ত করুণ অবস্থা। মুর্খেরা বৈদিক সিদ্ধান্ত হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। আমার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য আমি কোনো অপরাধ নিচ্ছি না। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অবজ্ঞার কোনো নিস্তার নেই। আগামী জন্মে নিশ্চয়ই তোকে এর ফল ভোগ করতে হবে।” দুর্বাসা মুনি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলতে লাগলেন, “হে অনঘ! দুর্বাসা মুনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে সেই ব্রাহ্মণকন্যা তার সমস্ত ঐশ্বর্য হারাল । পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অপরাধের ফলে সে কুৎসিত দেহ লাভ করল । তখন সে মহাদেব শিবের আরাধনা করতে মনস্থ করল। “
ধ্যানে তার নয় হাজার (৯০০০) বছর অতিক্রান্ত হলে শ্রীশিব তার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন । বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শিবের দিব্যপ্রভাবে সে পুনঃযৌবন প্রাপ্ত হলো। তার সকল দৈহিক বৈকল্যও দূরীভূত হল। তাকে আবারও আগের মতো দেখতে লাগল। সে বৈদিক মন্ত্রে শিবের স্তুতি করতে লাগল। তখন শিবজী বলতে লাগলেন, “হে তপস্বীনি! সৌভাগ্যবতী হও। তুমি বর কামনা কর। আমি তোমার তপস্যায় সন্তুষ্ট। তুমি যা ইচ্ছা চাইতে পার।”
শিবের পদ্মমুখ হতে এসকল বাক্য শ্রবণ করে সে দারুণ খুশি হয়ে ভাবল তবে এতদিনে তার সাধনা সফল হয়েছে, এ দুঃখ থেকে সে এরপর মুক্তি পাবে। সে উত্তেজনার বশে একই কথা পাঁচবার বলে ফেলল, “হে দীনবন্ধু! আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন! আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন! আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন! আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন! আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন!” তখন শিব বললেন, “যেহেতু তুমি, বর হিসাবে পাঁচবার এ কথাটি বলেছ, তাই তোমার পঞ্চস্বামী হবে।” শিবের বাক্য শুনে কন্যার সম্বিত ফিরলে সে অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে অনুরোধ করতে লাগল, “হে প্রভু! একজন কন্যার পাঁচজন স্বামী থাকাটা খুবই নিন্দাজনক। দয়া করে আপনার বাক্য ফিরিয়ে নিন।”
শিব তখন গম্ভীরভাবে বিবেচনা করে বললেন, “এটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমার কাছে যা চেয়েছ, তাই পাবে। তুমি পরবর্তী জন্মে পাঁচজন স্বামী পাবে। পূর্বে দুর্বাসা মুনির করুণাপূর্ণ উপদেশ না মেনে তুমি পুরুষোত্তম মাসকে অবজ্ঞা করে অপরাধ করেছ। হে ব্রাহ্মণপুত্রী! দুর্বাসা ও আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ব্রহ্মাদি সকল দেবতা ও নারদ প্রভৃতি সকল মুনি-ঋষি এই ব্রত পালন করে। পুরুষোত্তম ব্রত পরায়ণ ভক্ত এ জীবনে সকল সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং জীবনান্তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধাম গোলোক বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করেন। এই পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অপরাধের ফলে তুমি পরবর্তী জীবনে পাঁচ স্বামী পাবে।” এ বলে শিব অন্তর্হিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণী কন্যা অত্যন্ত বিষণ্ণ হলেন। এভাবে কিছুকাল পর সে দেহত্যাগ করল।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন – “হে অর্জুন! ইতিমধ্যে রাজা দ্রুপদ একটি যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে ঐ ব্রাহ্মণ কন্যা রাজা দ্রুপদের কন্যারূপে আবির্ভূত হলেন। মেধা ঋষির সেই কন্যাই দ্রৌপদী হিসেবে জগতে বিখ্যাত হয়েছেন। পূর্ববর্তী জন্মে পুরুষোত্তম মাসের নিন্দার ফলে কুরুসভায় তাঁকে তাঁর পঞ্চস্বামীর সম্মুখেই দুঃশাসনের দ্বারা অপমানিত হতে হয়েছিল । সৌভাগ্যবশত আমাকে স্মরণ করে আমার আশ্রয় গ্রহণের ফলে আমি তাকে সবথেকে লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করি । হে পাণ্ডবগণ ! দয়া করে আসন্ন পুরুষোত্তম ব্রত পালনের কথা ভুলো না। যে ব্যক্তি পুরুষোত্তম মাসের নিন্দা করে সে কখনই সৌভাগ্য লাভ করবে না। তাই পুরুষোত্তম মাস তোমাদের সকল ইচ্ছা পূরণে এবং সমস্ত দুঃখ দূরীকরণে সমর্থ । এখন তোমাদের চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষ হতে চলেছে । নিষ্ঠার সাথে এই ব্রত পালন কর , যাতে সকল সৌভাগ্য লাভ করতে পার।”
এভাবে পাণ্ডবদের সান্ত্বনা প্রদান করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। কিছুদিন পর পুরুষোত্তম মাসের আগমন হলে যুধিষ্ঠির মহারাজ তার অনুজ ভাইদের এবং দ্রৌপদীকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তারা সকলেই বিভিন্নভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার মাধ্যমে পুরুষোত্তম মাস অতিবাহিত করলেন। এই ব্রতপ্রভাবে তারা তাদের হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অবশেষে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হলেন।
একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত কোনো শুদ্ধভক্তের মুখনিঃসৃত কৃষ্ণকথা শ্রবণে নিজেকে নিয়োজিত করা। এভাবে একজন ভক্তের কর্তব্য , সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা ও তার লীলাবিলাস সম্বন্ধে অন্য ভক্তদের নিকটে আলোচনা করা। হৃদয়ে সর্বদা কৃষ্ণচিন্তা করার মাধ্যমে তৃপ্ত হওয়া যায় । যদি কেউ গৃহস্থ হন তবে তার সৎ ও শান্তিপূর্ণভাবে গৃহস্থালি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা উচিত। তার কোনোরকম বিবাদে জড়ানো উচিত নয় এবং সাধুদের প্রতি ভক্তিমান ও দরিদ্রের প্রতি দয়ালু হওয়া কর্তব্য। গোরক্ষা , সদালাপ , দয়া এবং অহিংসা- এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলো গৃহস্থদের অনুসরণীয় হওয়া উচিত।
সুত গোস্বামী নৈমিষারণ্যের ঋষিদের সম্মুখে ভগবান নারায়ণ ও নারদমুনির এই কথোপকথন বর্ণনা করে চললেন। তিনি বললেন , “হে ঋষিগণ ! ভগবান নারায়ণের নিকটে এই পুরুষোত্তম মাসের মহিমা শ্রবণ করে নারদ মুনি অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি বারবার দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন করে বলতে লাগলেন, “এই পুরুষোত্তম মাস সকল মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি যদি কেউ ভক্তিভরে কেবল এই ব্রত মাহাত্ম্য শ্রবণও করে, সে অচিরেই ভগবৎসেবা লাভ করেন এবং সকল পাপ কর্মফল থেকে মুক্ত হন। পুরুষোত্তম ব্রত প্রভাবে অচিরেই সকল সৌভাগ্য লাভ করে গোলোক বৃন্দাবনে গমন করেন। ”
নারদ মুনি বললেন , “ হে ভগবান ! এখন আমার হৃদয় ও মন সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হলো । আপনি জয়যুক্ত হোন। ” এভাবে পুরুষোত্তম মাসের মহিমা বর্ণনা করার পর গঙ্গাস্নান ও অন্য কৃত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য সুত গোস্বামী সমবেত মুনিদের নিকটে প্রার্থনা নিবেদন করলেন । তারা কৃতজ্ঞতার সাথে সম্মত হলেন এবং তিনি তখন তাদের প্রণতি নিবেদন করে গঙ্গাস্নানে গেলেন । নৈমিষারণ্যের ঋষিগণ তখন পরস্পর বলতে লাগলেন , “ ওহ ! এই পুরুষোত্তম মাস সবথেকে মহিমাপূর্ণ এবং এর ইতিহাস অতি প্রাচীন । এটি কল্পতরুর ন্যায় ভক্তদের সমস্ত বাসনা পূরণে সমর্থ । পুরুষোত্তম মাসের জয় হোক । ”
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
✺ আধ্যাত্মিক মূল্যায়ন ✺
৮৪ লক্ষ যোনীর মধ্যে ৮০ লক্ষ যোনী পার করে জীবাত্মা মানবজন্ম পায়। মানবজন্মেই বিবেক-বুদ্ধি পাওয়া যায়। ভগবান মানুষকে ভালমন্দ বিচারবোধ দান করে থাকেন। মানুষ তার স্বতন্ত্র ইচ্ছাক্রমে কর্মক্ষেত্রে সদাচার বা কদাচার করতে থাকে। মানুষের সমস্ত কর্মের সাক্ষী থাকেন ১৪ জন তাদের নাম মহাভারতের আদিপর্বে উল্লেখ রয়েছে। এখন আপনি বিশ্বাস করুন, আর না করুন ক্যামেরায় তা ধরা পড়বেই – ভাগবত ৬। ১। ৪২ নং শ্লোকে তা উল্লেখ আছে।
সূর্যোহগ্নিঃ খং মরুদ্দেবঃ সোমঃ সন্ধ্যাহনী দিশাঃ।
কং কুঃ স্বয়ং ধর্ম ইতি হ্যেতে দৈহ্যস্য সাক্ষিণঃ।।
যথা- (১) সূর্য, (২) চন্দ্র, (৩) বায়ু, (৪) অগ্নি, (৫) আকাশ, (৬) পৃথিবী, (৭) জল, (৮) দিন, (৯) রাত্রি, (১০) ঊষা, (১১) সন্ধ্যা, (১২) ধর্ম, (১৩) কাল, (১৪) পরমাত্মা।
এক সময় একটি নাস্তিক শিক্ষিত মানুষ, শ্রবণ করে বললেন সত্যি আপনাদের ভগবান ভয় দেখিয়েও আমাদেরকে ধর্মপথে আনতে পারছে না। প্রচারক ভক্তটি বললেন, সেটি আসল কথা নয়। আসলে এই জ্ঞান সমুদ্রের কাছে আমরা যে সকলেই মূর্খ সেটি স্বীকার করতে চাই না —- নিজেকে বড় জ্ঞানী বলে মনে করি।
স্কুলে পড়েছিলাম আস্তিক বিজ্ঞানী বিশ্ববিখ্যাত স্যার আইজ্যাক নিউটন নিস্কপটে স্বীকার করেছেন -‘অবোধ বালকের ন্যায় জ্ঞান সমুদ্রের তীরে নুড়ি নিয়ে নাড়া-নাড়ি করছি মাত্র; কিন্তু সামনের রহস্য কিছুই বুঝতে পারি নি।’ এছাড়াও – একসময় বিচিত্র জ্ঞানের অধিকারী এরিষ্টটল তাঁর এক ছাত্রকে পড়ানোর সময় লক্ষ্য করলেন, সে নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে করছে। তাই তিনি শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে মহামূর্খ বলে ভর্ৎসনা করলেন। তাতে ছাত্রটি খুবই ব্যথিত হলো। কিন্তু পরক্ষণেই এরিষ্টটল নিজেকেও মূর্খ বলে আখ্যায়িত করলেন, তখন ছাত্রটি আরো দুঃখ পেলো। এরিষ্টটল সেই দৃশ্যটা দেখে বুঝিয়ে বললেন ‘আসলে এই অসীম জ্ঞান সমুদ্রের কাছে তুমি ও আমি উভয়ই মূৰ্খ; তবে আমি যে মূর্খ তা আমি জানি। কিন্তু তুমি যে মূর্খ তা তুমি জানো না।’ এটাই পার্থক্য।
তাই আস্তিক জগতে বাস করেও জ্ঞানের অভাবে নিজেকে নাস্তিক বলে মনে করে দুঃখ ভোগ করছেন। তাই সকলেই যাতে ভক্তিপথে অগ্রসর হতে পারে তার জন্য ভগবান নানারকম ডিসকাউন্টের বন্দোবস্ত করেছেন। তাই আসুন আমরা সকলেই এই ‘পুরুষোত্তম’ মাস যত্নের সঙ্গে পালন করি এবং আনন্দ উপভোগ করি।’
◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆━━━━━━━━━━━━━━━━━━◆❃◆
► আরও পড়ুন: কিভাবে জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি লাভ হবে? (Freedom from cycle of Birth and Death)
► আরও পড়ুন: জীবের জন্ম-মৃত্যু চক্র (Cycle of Birth and Death) ও ৮৪ লক্ষ যোনি