Join to Our Community
Community Grows With You

🪔What is Diwali/Dipabali✸দীপাবলি কি ও দীপের মাহাত্ম্য কি?🪔

TABLE OF CONTENTS

Toggle

দীপাবলি কি?

(What is Diwali/Dipabali)

দীপ = প্রদীপ; আবলি বা আবলী = সমষ্টি, সারিবদ্ধ। সুতরাং “দীপাবলি” শব্দটির অর্থ “প্রদীপের সারি বা সমষ্টি বা ‘আলোর উৎসব’ বা ‘দীপোৎসব’। আলোর কারণে আমরা চোখ দিয়ে দেখতে পাই, এই আলোর কারণে প্রকৃতি বেঁচে আছে। আলো আমাদের জীবনে স্বচ্ছতা দেয়, স্বচ্ছতা আমাদের মধ্যে অস্পষ্টতা এবং বিভ্রান্তিগুলি দূর করতে অনুপ্রাণিত করে।

দীপাবলির তাৎপর্য হল অন্ধকার মুছে আলোকপাত ঘটানো, অজ্ঞতার উপর জ্ঞানের বার্তা দেওয়া এবং অশুভ ও অমঙ্গলকে বিতাড়িত করে শুভ শক্তির প্রভাব বিস্তার করা। এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে তেল বা ঘি দিয়ে ছোটো মাটির প্রদীপ সারিবদ্ধভাবে জ্বালান। অন্য অর্থে এই প্রদীপ জ্বালানো হল অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক। এই উৎসবে, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী এবং জ্ঞানের দেবতা গণেশকে পূজা করা হয়।

◼️ দীপাবলি কবে পালিত হয়? ◼️

🌸 কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যা তিথিতে উদযাপিত হয় দীপাবলি। এ বছর পালিত হবে ━

ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী 01-নভেম্বর-2024 (শুক্রবার)
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৫ই কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

◼️ দীপাবলি কত দিন ধরে পালিত হয়? ◼️

🌸  দীপাবলি আসলে ৫ দিনের উৎসব:

দীপাবলীর উৎসব শুরু হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন, ধনতেরাস পালনের মাধ্যমে। আর শেষ হয় শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় অর্থাৎ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটার দিন।

দীপাবলীর প্রথম দিন (কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী) ━  পালন করা হয় ধনতেরাস

দীপাবলীর দ্বিতীয় দিন (চতুর্দশী) ━ দীপাবলীর আগের দিনের চতুর্দশীকে বলা হয় নরকা চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী। 

দীপাবলীর তৃতীয় দিন (অমাবস্যা) ━ পালন করা হয় দীপাবলি, দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজা হয়। এই দিন পশ্চিমবঙ্গে কালীপূজা হয়। যদিও এই কালীপূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধিগ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তার সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন।

দীপাবলীর চতুর্থ দিন (কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রতিপদ) ━ পালন করা হয় গোবর্ধন পূজা অন্নকূট মহোৎসব

দীপাবলীর পঞ্চম দিন (দ্বিতীয়া) ━ পালন করা হয় যমদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্তণ করে, কপালে ফোঁটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়। এই দিনে নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়।

◼️ দীপাবলির অন্যান্য নাম ◼️

🌸 দীপাবলির অন্যান্য নামগুলি হল ━ 

দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি।

─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

দীপাবলিতে দীপের মাহাত্ম্য কি?

দীপাবলিতে আমরা মূলত আলোর পূজা করি।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে, প্রদীপকে সত্য এবং জ্ঞানের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এটি নিজে জ্বলে কিন্তু অন্যকে আলোকিত করে। প্রদীপের এই বিশেষত্বের কারণে বিভিন্ন পুরাণে ব্রহ্মার স্বরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

মান্যতা আছে ‘দীপদান’ শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি জোগায়। যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না, প্রদীপের আলো সেখানে পৌঁছায়। এই আলো ইঙ্গিত করে জ্ঞানের আলো, এই আলো ইঙ্গিত করে সভ্যতার আলো, এই আলো ইঙ্গিত করে শুদ্ধতার আলো। তাই ঋগবেদ সংহিতার ৫/৪০/৫ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে ━ অহংকার হলো জ্ঞানের পথে প্রতিবন্ধক। চন্দ্র যেমন সূর্যের আলো ঢেকে পৃথিবীকে বিকট অন্ধকার করে দেয়, অহংকারও তেমনি বিদ্যানের বুদ্ধিনাশ করে দেয়। অর্থাৎ আলোর উৎসবে আমরা উগ্রতা ও অহংকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আলোর প্রকাশরূপ জ্ঞানের পূজাও করি।

ধর্মীয় গ্রন্থ ‘স্কন্দ পুরাণ’ অনুসারে, দীপকের জন্ম যজ্ঞ থেকে। যজ্ঞ হল দেবদেবী ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগের একটি মাধ্যম, যজ্ঞের আগুন থেকে জন্ম নেওয়া প্রদীপ পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

দীপাবলির মাহাত্ম্য কি?

১. এইদিন শ্রীরামচন্দ্রের বনবাস থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন

এইদিন শ্রীরামচন্দ্র বনবাস থেকে অযোধ্যায় ফিরে আসেন।

🌸 হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ অনুসারে, ত্রেতা যুগে অযোধ্যার রাজা ছিলেন দশরথ, তিনি ছিলেন বীর ও ধার্মিক। সেই সময় অযোধ্যা ছিল ধনী ও সমৃদ্ধশালী শহর, সর্বত্র সুখ বিরাজমান। তার তিন পত্নী  বা রাজমহিষী ছিলেন। কৌশল্যা, কৈকেয়ী সুমিত্রা। কৈকেয়ী ছিল তার প্রিয়। কৈকেয়ী খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটি যুদ্ধে তার জীবন রক্ষা করেছিলেন। দশরথ তার জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে দুটি বর প্রদান করেছিলেন।

🌸 রাজা দশরথ ও কৌশল্যার প্রথম কন্যা সন্তান হলো শান্তা। কৌশল্যার বোন বর্ষিণী যিনি কিনা অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের স্ত্রী ছিলেন, তিনি নিঃস্বন্তান হওয়ায় দশরথ এই কন্যাকে পৌষ্যপুত্রীরূপে দান করেন। ব্যাক্তিগত জীবনে শান্তা বেদাদি শাস্ত্রে পারদর্শিনী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। রোমপাদ শান্তাকে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের সাথে বিবাহ দেন ।

🌸 পুত্রের কামনায় দশরথ পুত্রকামেষ্টিযজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞের পুরোহিত ছিলেন তার জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। সেই যজ্ঞ থেকে পায়সে পরিপূর্ণ পাত্র হাতে নিয়ে এক প্রজাপতি প্রেরিত দৈবপুরুষ উঠে আসলেন এবং দশরথকে বললেন, হে মহারাজ! এই দেবনির্মিত সন্তানদায়ক পায়স আপনার পত্নীদের খেতে দিন। তারপর দশরথ ঐ পায়সের অর্ধাংশ কৌশল্যাকে, অবশিষ্ট অর্ধেকের অধাংশ সুমিত্রাকে এবং অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধাংশ সুমিত্রাকে খেতে দিলেন অর্থাৎ ১৬ ভাগের ৮ ভাগ কৌশল্যাকে, ৪ ভাগ কৈকেয়ীকে এবং ২ ভাগ সুমিত্রাকে খেতে দিলেন। আহারকালে কৈকেয়ী আবার তার ভাগের অর্ধেক সুমিত্রাকে খেতে দেন। এর ফলে যজ্ঞের দ্বাদশ মাস পরে চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে বড়রাণী কৌশল্যার গর্ভে রামের, পুষ্যা নক্ষত্রে মেজরাণী কৈকেয়ীর গর্ভে ভরতের এবং ছোটরাণী সুমিত্রা দুই ভাগ পায়স ভক্ষণের ফলে অশ্লেষা নক্ষত্রে তার গর্ভে লক্ষ্মণশত্রুঘ্ন নামে দুই যমজ সন্তানের জন্ম হয়।

🌸 রাম সবার বড় এবং প্রিয় ছিল। পরবর্তীতে, শৈশব পেরিয়ে যৌবনে রাম হরধনু ভঙ্গ করে মিথিলার রাজা জনকের কন্যা সীতাকে বিবাহ করার সময়ে ভরত, লক্ষ্মণ এবং শত্রুঘ্নেরও একইসাথে বিবাহ হয়। রাজা জনকের পালিত কন্যা হলেন সীতা, যদিও তার ও স্ত্রী সুনয়নার একমাত্র কন্যা ছিলেন ঊর্মিলা, সুতরাং  সম্পর্কে তিনি  সীতার ছোট বোন। জনক রাজার ছোট ভাই হলেন কুশদ্বজ এবং কুশধ্বজের দুই কন্যাসন্তান হলেন মাণ্ডবীশ্রুতকীর্তি

🔹 রাম সীতাকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই পুত্রের নাম ছিল লবকুশ। 

🔹 লক্ষ্মণ সীতার কনিষ্ঠা ভগিনী ঊর্মিলাকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই পুত্রের নাম ছিল অঙ্গদধর্মকেতু। 

🔹 ভরত মান্ডবীকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই পুত্রের নাম ছিল তক্ষপুষ্কল

🔹 শত্রুঘ্ন শ্রুতকীর্তিকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই পুত্রের নাম ছিল সুবাহুশত্রুঘাতী

🌸 একবার দেবাসুর যুদ্ধে শম্বরাসুরকে বধ করতে গিয়ে দশরথ ভীষণ ভাবে আহত হন, কৈকেয়ী তাঁকে সেবার মাধ্যমে সুস্থ করেছিলেন। তখন দশরথ তাঁকে একই সময়ে দুটি বর দেবার প্রতিশ্রুতি করেন। কিন্তু কোন অভাব না থাকায় তিনি নেননি। এসময় দশরথ তাকে একই সময়ে দুটি বর দেবার প্রতিশ্রুতি করেন। রামের রাজ্যাভিষেকের সময় মন্থরা কৈকেয়ীকে মনে করিয়ে দিল, যুদ্ধে যখন কৈকেয়ী রাজা দশরথের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, তখন তিনি তাঁকে দুটি বর দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। দশরথ রামের রাজ্যাভিষেকের সংবাদ জানাতে গিয়ে দেখলেন কৈকেয়ী রাগে-দুঃখে অস্থির হয়ে রয়েছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি দশরথের কাছ থেকে বর দুটি চেয়ে নিলেন। 🔹 প্রথম বরে, তাঁর পুত্র ভরত হবেন অযোধ্যার রাজা। 🔹 আর দ্বিতীয় বরে রাম যেন চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসী হয়। এই কথা শুনে দশরথ এতটাই মর্মাহত হলেন যে তিনি জ্ঞান হারালেন। দশরথ মহারাজ নিতান্ত অনিচ্ছায় এই বর দেন। রাম পুরো ঘটনাটি জেনে স্বেচ্ছায় ভরতকে রাজা বানিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে চলে যান এবং রামের বনবাসের ষষ্ঠ দিন দশরথ মহারাজ দেহত্যাগ করেন।

🌸 ত্রেতা যুগের পূর্বে সত্যযুগে বেদবতী ছিলেন হরিপ্রানা, তাই বিষ্ণুকে স্বামীরূপে পেতে পুষ্কর তীর্থে ব্রহ্মার তপস্যা করতে থাকেন। ব্রহ্মা বর দেন, এই জন্মে না হলেও পরজন্মে তিনি বিষ্ণুকে স্বামী রূপে পাবেন। বিষ্ণুকে স্বামী রূপে না পেয়ে বেদবতী গন্ধমাদন পর্বতে বিষ্ণুর তপস্যায় মগ্ন থাকেন। অসুররাজ রাবণ সেই পথে যেতে গিয়ে দেখলেন বেদবতীকে এবং কামের বশবর্তী হয়ে অপহরণ করার চেষ্টা করেন। অপমানিত হয়ে বেদবতী রাবণকে অভিশাপ দিলেন, এক নারীর কারণে সবংশে তার বিনাশ হবে। এই অভিশাপ দিয়ে বেদবতী গঙ্গা নদীতে আত্মাহুতি দিলেন।

🌸 ত্রেতা যুগে বেদবতী অযোনিজা কন্যা রূপে (অর্থাৎ তিনি গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন নি) পরজন্ম লাভ করলেন। জাতিষ্মর সেই কন্যা সীতা নামে জনক রাজার ঘরে বড় হলেন। কয়েক বছর বনবাসে থাকাকালীন দেবতারা রামচন্দ্রকে পূর্বাভাষ দেন, সীতাকে রাবণ অপহরণ করতে চলেছেন। যদিও ভগবান এ বিষয়ে অবগত ছিলেন, তবু লীলা বিলাসের জন্য তিনি দেবতাদের অংশগ্রহণ করিয়েছিলেন, যেমনটা ভগবান বিভিন্ন লীলাতে করে থাকেন। এরপর রামচন্দ্র লীলাবিলাসের জন্য সীতা ও অগ্নিদেবের সাথে এক সুন্দর পরিকল্পনা করেন। রাক্ষস রাজা রাবণ ভিখারির বেশে অপহরণের উদ্দেশ্যে আসলে সীতামাতা ভিক্ষা দানের জন্য রাবণের দিকে অগ্রসর হন। কামুকগ্রস্ত রাবণ তড়িঘড়ি লক্ষণরেখা অতিক্রম করতে উদ্যত হলে অগ্নিদেব প্রচণ্ড অগ্নিতেজ প্রকাশ করেন, ফলে কিছু সময়ের জন্য রাবণের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তখন তিনি তাঁর ছায়াকে অর্থাৎ ছায়া সীতাকে বা মায়া সীতাকে কাজে লাগান, প্রকৃতপক্ষে তিনি হলেন লক্ষ্মীর অংশ। ছায়া সীতাই দ্বাপর যুগে হলেন দ্রৌপদী। মুহূর্ত সময়ের মধ্যে আসল সীতা অগ্নিতে প্রবেশ করেন এবং অগ্নিদেবের আশ্রয়ে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে রাবণ ছায়া সীতাকে অপহরণ করেন।              

🌸 রাম, ভ্রাতা লক্ষ্মণ, হনুমান, সুগ্রীব ও  বানর সেনাদের সাহায্যে রাবণকে বিজয়া দশমীর দিনে পরাজিত করেন এবং সীতারূপী ছায়া সীতাকে লঙ্কাপুরীর অশোকবাটিকা থেকে উদ্ধার করেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পিতৃ আজ্ঞা পালন করে চৌদ্দ বছর বনবাস কাটিয়ে এই দীপাবলি তিথিতে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন ভ্রাতা লক্ষণ, পত্নী সীতার সাথে পুষ্পক রথে চড়ে। সাথে আসেন হনুমান, সুগ্রীব ও বানর সেনা। ফেরার পথে লোকপালগণ সুগন্ধি পুষ্প বর্ষণ করে তাঁকে সম্বৰ্ধনা জানিয়েছিলেন, এবং ব্রহ্মা আদি দেবতারা তখন মহা আনন্দে তাঁর চরিত্র কীর্তন করেছিলেন। যতদিন রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন কোনপ্রকার আনন্দ অনুষ্ঠান আলোকসজ্জা কিছুই হয়নি অযোধ্যা নগরীতে। অযোধ্যাবাসীগণ ভগবান রামচন্দ্রের আগমনে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তাই  অযোধ্যাবাসীগন ঘোর কালিমা ঘুচিয়ে তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে অযোধ্যার গৃহচূড়ায়-বাতায়নে-মাঠেঘাটে নগরীর প্রাসাদে সারি সারি ঘিয়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে তাঁদের প্রভুকে বরণ করেছিলেন। সেই উৎসব স্মরণেই দীপাবলি উৎসব পালিত হয়

🌸 সীতার অগ্নি পরীক্ষার সময় ছায়া সীতা অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করেন এবং আসল সীতাকে অগ্নিদেব রামের কাছে ফিরিয়ে দেন। এর পর রাম সীতা ১১০০০ বছর রাজত্ব করেন।

ছায়াসীতাকে অপহরণের উপাখ্যান বাল্মীকি রামায়ণে সূক্ষ্মভাবে উল্লেখ থাকলেও বহু বহু শাস্ত্রে বিস্তারিতভাবে বর্ণন রয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণের ওপর বিভিন্ন আচার্যের টিকাতে তা সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্রগুলি হল যেমন-

১) শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,প্রকৃতিখন্ড, অধ্যায় ২৪

২) কূর্মপুরাণ, উপরিভাগ, অধ্যায় ৩৪

৩) ব্রহ্মান্ডপুরাণ, উত্তরখন্ড, রামাখ্যানভাগ – যা আধ্যাত্ম-রামায়ণ নামে পরিচিত।

৪) স্কন্দপুরাণ

৫) চৈতন্য চরিতামৃত

৬) রামচরিতমানস

 

সীতামাতাকে অপহরণ করা কি রাবণের পক্ষে সম্ভব ছিল?
============================================

কখনই না। যখন সীতামাতা অনেক ছোট ছিলেন তখন তিনি শিব ধনুক ‘হরধনু’ দিয়ে অনায়াসে বাগান থেকে ফল পারতেন, সেই ধনুক ছোট্ট সীতামাতার কাছে খেলনার মতো ছিলো ━ একবার জনক মহারাজ তা লক্ষ্য করে আশ্চর্যচকিত হয়েছিলেন, কারণ ওই হরধনু সরাতে ৩০০ জন মুষ্ঠী পালোয়ান হিমশিম খেত।

পরবর্তীকালে জনক মহারাজ তাই ঘোষণা করেছিলেন যে, যেই রাজকুমার এই দিব্য হরধনু তুলে ধরতে পারবে এবং তাতে গুন পড়াতে পারবে একমাত্র সে’ই তার কন্যা সীতাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণের যোগ্য৷ এই শর্ত রাখার পিছনে কারণ হল কেউ যদি হরধনু তুলতে পারে তবে সে হবে তার কন্যার সমতুল্য শক্তিমান, কিন্তু তা যদি গুন পড়াতে পারে তবে সে হবে অধিক শক্তিমান, তবে কিনা সেই ব্যাক্তি তার কন্যাকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে। 

জনক আয়োজিত সীতার স্বয়ম্বরসভায় রাবন সেই ধনুক সামান্য ওঠাতে অসমর্থ হয়। তাহলে ভাবুন সীতামাতা যখন বড় হন তখন তাঁর বাহুবল রাবনের থেকে অনেক অনেক বেশি ছিলো তাহলে রাবন কেমন করে সীতামাতাকে অপহরণ করতে পারবে? কখনই না, কারন সীতামাতা রাবনের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন। অযোধ্যার রাজকুমার ভগবান রাম শুধু ধনুক তুললেনই নয়, তাতে গুন পরানোর সময় সেই হরধনু ভেঙ্গেও ফেলেন। শিবের ধনুক কোন সাধারণ ধনুক নয়, তাকে ভাঙবার সাধ্যি কেবল ভগবানেরই আছে। স্বাভাবিকভাবেই শক্তি-শক্তিমান অর্থাৎ রাম-সীতার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

তাছাড়া রাবন যদি নিজের অসৎ স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সীতা মাতাকে স্পর্শ করতেন মূহুর্তেই তার তেজ ও দিব্যজ্যোতিতে পুড়ে ছাই হয়ে যেতেন। ভগবান রাম আগে থেকেই জানতেন রাবণের অসৎ ইচ্ছা, অপহরণের পরিকল্পনা, তাহলে তো তিনি রাবণকে অনায়াসেই মেরে ফেলতে পারতেন। কেন মারলেন না? তাহলে প্রভু শ্রীরামের লীলা সম্পূর্ন হতো না। আমাদের মতো অধমদের শিক্ষা দিতেন কেমন করে! 

উপনিষদেও দীপাবলির উল্লেখ আছে। সেখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দীপাবলির মাধ্যমে উপনিষদের আজ্ঞা সুদৃঢ়ভাবে চরিতার্থ হয়ে ওঠে, যথা ──

❝ অসতো মা সৎ গময়।
 তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
ওঁ শান্তিঃ! ওঁ শান্তিঃ! ওঁ শান্তিঃ! ❞

অনুবাদ:  অসৎ হইতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে অমরত্বে লইয়া যাও। সর্বত্র যেন ছড়াইয়া পড়ুক শান্তির বার্তা।

১৪ বছর বনবাসের পর রাম ও সীতা অযোধ্যায় ফিরে আসেন। তাদের সম্মানেদীপাবলি উদযাপন করা হয়।

এই অনুষ্ঠানটি প্রভু রামচন্দ্রের রাজ্য অযোধ্যার বাসিন্দারা পালন করেছিলেন, যখন ভগবান রামচন্দ্র তাঁর পিতার আদেশে ১৪ বছর নির্বাসনের কারণে তাঁর রাজ্যের বাইরে ছিলেন। তাঁর কনিষ্ঠ সৎ ভাই ভরত, রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যেদিন ভগবান রামচন্দ্র তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে আবার দায়িত্ব ফিরিয়ে নেন এবং সিংহাসনে বসেন, এই দিনটিকে দীপাবলি হিসাবে পালন করা হয়।

এছাড়াও এইদিন বিশেষ মহিমান্বিত বিভিন্ন কারনে। কারণগুলি হল:

____________________________________________

২. নৃসিংহদেবের দ্বারা হিরণ্যকশিপু হত্যা

এই দিনে ছোট্ট প্রহ্লাদের আহ্বানে শ্রীবিষ্ণু নরসিংহের (নৃসিংহের) রূপ ধারণ করে অসুররাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করেছিলেন। হরিভক্ত প্রহ্লাদ ছিলেন হিরণ্যকশিপুর পুত্র। অসুররাজের মৃত্যুতে, লোকেরা ঘি প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি উদযাপন করেছিলেন।

✸ ৩. লক্ষ্মী-নারায়ণের বিবাহ

লক্ষ্মী-নারায়ণের বিবাহ এইদিনে সম্পাদিত হয়।

সমুদ্র মন্থনের সময়, ক্ষীরসাগর থেকে ধনসম্পদ ও অর্থের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব হয় এবং মহালক্ষ্মীর ইচ্ছায় তিনি ভগবান নারায়ণকে বিবাহ করেন। দিনটি ছিল দীপাবলির দিন। এরপরে, আনন্দ প্রকাশ করার জন্য সর্বত্র প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং তারপর থেকে দীপাবলি উৎসব উদযাপিত হয়।

✸ ৪. ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দামোদর লীলা

এই তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দামোদর (= দামবন্ধন) লীলা সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এই দিনে মাতা যশোদার বাৎসল্য প্রেমের বন্ধনে শ্রীকৃষ্ণ আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রামঅবতারে বানরদের সাহায্যের ঋণ পরিশোধ করেছিলেন মাখন, লাড্ডু খাওয়ানোর মাধ্যমে।

✸ ৫. নলকূবের এবং মনিগ্রিব উদ্ধার

এই দিনে কুবেরের দুই পুত্র নলকূবের এবং মনিগ্রিব তাদের পূর্বকৃত কর্মের ফলে নারদ মুনি দ্বারা অভিশাপপ্রাপ্ত হয়ে বৃক্ষযোনি  লাভ করেছিলেন। এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক তারা উদ্ধার পেয়েছিলেন।

👣কুবেরের পুত্রদ্বয় নলকুবের ও মণিগ্রীবের উদ্ধার কাহিনী 👣
===========================================

🌸 ভগবান দামোদর লীলার দিনে দু’টি অর্জুন বৃক্ষকে উদ্ধারের মাধ্যমে বৃক্ষযোনি থেকে কুবেরের পুত্রদ্বয় নলকুবের ও মণিগ্রীবের উদ্ধার করেছিলেন।

🌸 মা যশোদা তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ছেলে শ্রীকৃষ্ণকে উদুখলে বেঁধে রেখে গৃহকর্মে ব্যস্ত হলেন। তখন উদুখলে বাঁধা শ্রীকৃষ্ণ বাড়ির প্রাঙ্গনে দু’টি অর্জুন গাছ দেখতে পেলেন। এ দু’টি গাছ কোন সাধারণ গাছ নয়। এরা ধনপতি কুবেরের পুত্রদ্বয় নলকুবেরমণিগ্রীব। সাক্ষাৎ শিবের অনুচর হওয়া সত্ত্বেও এদের মাথায় কুবুদ্ধি প্রবেশ করে। তারা বারুণী নামক সুধাপানে উন্মত্ত হয়ে নগ্ন (দিগম্বর) অবস্থায় জলে নেমে, অত্যন্ত আসক্ত হয়ে উন্মত্ত হাতির মতো দেবাঙ্গনাদের (দেবতাদের কন্যার) সাথে জলক্রীড়া করতে লাগল। তখন দেবর্ষি নারদ মুনি সেই পথে আসছিলেন। তা দেখে দেবাঙ্গনারা তড়িঘড়ি তাদের স্বীয় বস্ত্র পরিধান করল। কিন্তু সেই পাষণ্ডদ্বয় নারদ মুনিকে উপেক্ষা করল। কিন্তু নারদ মুনি তাঁদের দুরাবস্থা দেখে অত্যন্ত ব্যাথিত ও করুণার্দ্র হলেন এবং বৃক্ষ যোনি প্রাপ্ত হয়ে চিরকাল নগ্ন থাকার অভিশাপ দিলেন। এরপর তাদের সম্বিত ফিরলে তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এতে দেবর্ষি নারদ শান্ত হলেন এবং ক্ষমা স্বীকার করে বললেন ━━“ঠিক আছে, দ্বাপর যুগে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রকট হয়ে লীলা বিলাস করবেন, ভগবানের ইচ্ছাতেই তোমাদের মুক্তি সম্ভব হবে।” এই বলে মহর্ষি প্রস্থান করলেন। বহু যুগ ধরে তারা পাশাপাশি দুই অর্জুন বৃক্ষরূপে মর্ত্যলোকে ভগবানের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। কৃষ্ণ ভাবলেন, “যদিও এরা কুবেরের পুত্র, এতে কিছু যায় আসে না। যেহেতু নারদ মুনি এদের উদ্ধার করতে মনস্থ করেছেন, তাই এদের উদ্ধার করতে হবে।” সেই সঙ্গে স্বয়ং বন্দী কৃষ্ণ তাদের বন্দী দশার কষ্ট অনুভব করলেন। 

🌸 এখান থেকে শিক্ষণীয় হল ভগবানের প্রতি ভক্তের ভাব কেমন হওয়া উচিৎ। দেবর্ষি নারদ হলেন ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত, পরম সেবক। তিনি জানেন তিনি কোন ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভগবান তা রাখবেনই রাখবেন। সেক্ষেত্রে তিনি বলতে পারতেন “ভগবান তোমাদের উদ্ধার করবে”, কিন্তু পরিবর্তে তিনি বললেন “ভগবানের ইচ্ছাতেই তোমাদের মুক্তি সম্ভব হবে”। আপাতদৃষ্টিতে একই কথা, কিন্তু এখানে ভাবটা আলাদা। প্রথম কথাটির মধ্যে ঔদ্ধত্য রয়েছে, দাবী ভাব রয়েছে, যখন আমি বলেছি ভগবান তা মানবেন বা মানতে বাধ্য হবেন। দ্বিতীয় কথাটির মধ্যে দাসত্ব ভাব, সেবা ভাব রয়েছে, ভগবানের প্রাধান্যই প্রধান; ভগবান যদি ইচ্ছা করেন তবেই তোমাদের উদ্ধার হবে, নচেৎ নয়। একজন ভক্তের ভাব এমন হওয়া উচিত; অনেক রুচিসম্মত, অনেক মার্জনীয়। ভগবান ভক্তের জন্য কত করুণাময় অজস্র উদাহরণের মধ্যে এটি একটি। ভক্তের প্রেম ভাবে তিনি আবদ্ধ হন, ভক্তের কামনা কখনও অপূর্ণ রাখেন না; এক্ষেত্রে তার অন্যথা হয় কেমন করে।               

🌸 তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিলেন, বাঁধা উদুখল টানতে টানতে গাছ দুটির মাঝখান দিয়ে যেতে শুরু করলেন। অর্থাৎ ভগবান কষ্ট করলেন, কিন্তু কেন? তিনি চাইলেই ত তারা উদ্ধার হয়ে যেত, কিংবা সামান্য স্পর্শেই উদ্ধার হয়ে যেত। তিনি পরম নিয়ন্ত্রতা, তবু কষ্ট করলেন কেন? এখান থেকে শিক্ষণীয় হল, ধনপতি কুবেরের পুত্রদ্বয়ের কার্যকলাপে কষ্ট পেয়েছেন তাঁর বিশিষ্ট ভক্ত দেবর্ষি নারদ, দেবর্ষি নারদের কারণে বহুকালযাবত কষ্ট পেয়েছে কুবেরের পুত্রদ্বয়, তাদের কারণে ভগবান যে কত কষ্ট পেয়েছেন, তারই বহিঃপ্রকাশ করেছেন এই কষ্টের মাধ্যমে। 

🌸 ভগবান চলেছেন টানতে টানতে এবং পেছনে বাঁধা উদুখলটি দুই বৃক্ষের মাঝে আটকে গেল। এরপর তিনি হেঁচকা টান দিতেই দুটো গাছ উপড়ে পড়ল মাটিতে।  তৎক্ষণাৎ বৃক্ষদুটির মধ্য থেকে অগ্নির মতো দুই মহাপুরুষ অবির্ভূত হলেন। তাঁদের সৌন্দর্যের ছটায় সর্বদিক আলোকিত হয়ে গেল এবং তাঁরা অবনত মস্তকে শ্ৰীকৃষ্ণকে প্রণতি জানিয়ে স্তুতি করতে লাগলেন।

🌸 শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন, “দেবর্ষি নারদ অত্যন্ত কৃপাময়। ধনমদে (ধনগর্বে) অন্ধ হয়ে মিথ্যা অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে দেবর্ষিকে অপমানের কারণে তোমাদের দু’জনকে অভিশাপ দিয়ে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর মহৎ কৃপা প্রদর্শন করেছেন । যদিও তোমরা স্বর্গ থেকে অধঃপতিত হয়ে বৃক্ষ যোনি প্রাপ্ত হয়েছিলে, তবুও তোমরা নারদমুনির অনুগৃহীত। সূর্যের আগমনে যেভাবে চক্ষুর অন্ধকার দূরীভূত হয়, তেমনি ঐকান্তিকভাবে আমার শরণাগত এবং আমার সেবায় কৃত সঙ্কল্প ভক্তের সাক্ষাৎকারের ফলে, কারো আর জড় বন্ধন থাকতে পারে নাতোমরা দু’জনে এখন গৃহে ফিরে যেতে পার। তোমরা যেহেতু সর্বদা আমার ভক্তিতে মগ্ন হতে চেয়েছিলে, তাই তোমাদের বাসনা পূর্ণ হলো, আর সেই স্তর থেকে তোমাদের কখনো অধঃপতন হবে না।”

🌸 তখন তাঁরা কৃষ্ণকে প্রদক্ষিণ করে চলে গেলেন । কিন্তু আশেপাশের ক্রীড়ারত বালকেরা সব দেখছিল। এদিকে প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে গাছ পড়ে যাওয়াতে নন্দ মহারাজ সহ আদি গোপেরা নতুন বিপদের আশংকা করে সেখানে এলেন। কিন্তু দুটি গাছকে পড়ে থাকতে দেখে সকলে আতঙ্কে শিউরে ওঠে, কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই শক্তপোক্ত দুটি গাছ উপড়ে পড়ল কিভাবে তার কারণ নির্ণয় করতে অসমর্থ হলেন।  কৃষ্ণ তো একইভাবে উদুখলে বদ্ধ হয়ে আছে। তবে কে এই কাজটি করল?

🌸 তখন সেই ছোট বালকেরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু খুলে বলল। গভীর বাৎসল্য প্রেমের ফলে নন্দ মহারাজ প্রমুখ গোপেরা বিশ্বাস করতে পারেননি যে, শ্রীকৃষ্ণ এত আশ্চর্যজনকভাবে বৃক্ষ দু’টি উৎপাটন করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ ভাবতে লাগলেন, “যেহেতু ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কৃষ্ণ নারায়ণের সমতুল্য হবে, তাই সে এই কার্য করেও থাকতে পারে।”

🌸 নন্দ মহারাজ দেখলেন তাঁর পুত্র রজ্জুবদ্ধ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টায় উদুখল সমেত টানাটানি করছে, তা দেখে হাসতে হাসতে তাঁকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। এই দুটি লীলার মাঝেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ‘ভক্তবশ্যতা’ গুণ প্রদর্শন করলেন।

✸ ৬. বলি মহারাজের থেকে ভগবান বামনদেবের ত্রিপাদ ভূমি দানস্বরূপ গ্রহণ

হিরণ্যকশিপু বধের পর প্রহ্লাদ অসুরকূলের রাজা হয়েছিলেন। এরপর তাঁর পুত্র বিরোচন ও তারপর বিরোচনের পুত্র বলি অসুর সম্রাট হন। বলি মহারাজা হিসাবে খুবুই ধার্মিক, প্রজাহিতৈষী, দাতা ছিলেন। কিন্তু জাতের স্বভাব ও অসুর গুরু শুক্রাচার্য্যের কুমন্ত্রণার কারণে তিনি বারংবার দেবতাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

অন্যদিকে কশ্যপপত্নী অদিতি (দেবতাদের মাতা) দেবতাদের করুন দুর্দশা দেখে ভগবান হরির আরাধনা করেন। ভগবান হরি (শ্রীবিষ্ণু) দেবমাতা অদিতির পুত্র রূপে আবির্ভূত হন। পাঁচ বছর বয়সে মহর্ষি কশ্যপ তাঁর এই পুত্রের মেধা দেখে গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষা দান করলেন। সেই শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও তাঁর দেহ খর্ব ও পাঁচ বছরের শিশুর মতোই হয়ে থাকলো। তাই তিনি ‘বামন’ নামে পরিচিত হলেন।

বলি মহারাজ দেবতাদের সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত করবার জন্য নর্মদা নদীর তীরে ভৃগুকচ্ছ নামক স্থানে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। দৈত্যগুরু শুক্র ছিলেন সেই যজ্ঞের পরিচালক। সেখানে বেদজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ, দরিদ্র সকলেই এসে স্বীয় ইচ্ছা মতো দান নিয়ে বলিকে আশীর্বাদ দিতে লাগলেন। মহারাজ বলি কার্পণ্য না করে সকলের ইস্পিত বস্তু দান করতে লাগলেন। সেই সময় হরির অবতার ভগবান বামনদেব একটি ছাতা মাথায় উপস্থিত হলেন। মহারাজ বলি সাদরে স্বাগত জানালেন, চরণ ধুয়ে আসন ও ভোজন করতে দিলেন।

ভগবান বামনদেবকে বন্দনা পূর্বক বলি মহারাজ দান নিতে অনুরোধ জানালেন। অপরদিকে শুক্র বুঝতে পারলো যে ভগবান হরি বামন রূপে এসেছেন। তিনি বলিকে দান দিতে নিষেধ করলেন। বামনদেব স্মিত হেসে কেবল ত্রিপাদ ভূমি চাইলেন। দান দেওয়ার সঙ্কল্পের সময় অসুর গুরু শুক্র যোগবলে ক্ষুদ্র দেহ ধারন করে কুমণ্ডলের ছিদ্র রোধ করলে বামনদেব অঙ্কুশ দ্বারা ছিদ্রমুখ পরিষ্কার করার সময় শুক্রের এক চোখ নষ্ট হয়।

বলি মহারাজা ত্রিপাদ ভূমি দান দিলেন। বলির গুরুদেব শুক্র তাকে অভিশাপ দিয়ে প্রস্থান করলেন। এরপর খর্ব ভগবান বামনদেবের শরীরের পরিবর্তন হলো। এক চরণ দ্বারা তিনি সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা পবিত্র বারিধারা দ্বারা সেই চরণ অভিষেক করলেন, অপর চরণ দ্বারা পৃথিবী আবৃত্ত করলেন। আর এক চরণ কোথায় রাখবেন ?

বলি মহারাজ ভগবান বামনদেবের সামনে করজোড়ে বসে নিজ মস্তকে এক চরণ রাখতে বললেন। ভগবান বামনদেব তাঁর তৃতীয় চরণ বলি মহারাজের মস্তকে রাখলেন। বলি মহারাজকে বরপ্রদান করলেন ━তুমি অসুরদের নিকেতন সুতলপুরীতে আজ থেকে থাকবে। আজ থেকে তুমি অমর হবে। আজ হইতে আমি তোমার রাজ্যের দ্বার রক্ষা করবো।

বলি মহারাজ তাঁর শরণাগতি ভক্তি দ্বারা ভগবান শ্রীহরির পরম দুর্লভ শ্রীচরণ লাভ করেছিলেন। বলির দর্প হরণ করে ভগবান বামনদেব শান্তি ও ধর্ম বাণী প্রচার করলেন। এর ফলে অসুরেরা তাদের আসুরিক প্রবৃত্তি ত্যাগ করে ধর্ম পথ গ্রহণ করলো।

সুতরাং দীপাবলির এই দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন, এই দিনেই ভগবান বামনদেব রূপে বলি মহারাজের কাছ থেকে ত্রিপাদ ভূমি দানস্বরূপ গ্রহণ করেন এবং বামনদেব বিশাল রূপ ধারণ করে তিনটি জগৎ গ্রহণ করেন। এরপর সুতল রাজ্য বলি মহারাজকে দেওয়া হয়। বালি যখন সুতল রাজ্য পায়, সেখানে একটি আনন্দ উৎসব পালিত হয়, তখন থেকেই দীপাবলি শুরু হয়।

✸ ৭. কৃষ্ণ দ্বারা নরকাসুর বধ

 দ্বাপর যুগে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে নরকাসুর (ভূদেবী ও বরাহর পুত্র) অত্যাচার শুরু করেন। স্বর্গ ও মর্ত্যবাসীকে মুক্ত করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দীপাবলির একদিন আগে চতুর্দশীতে প্রাগজ্যোতিষপুরে (আসাম) অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করেন। নরকাসুরের কবল থেকে উদ্ধার করে আনেন দেবমাতা অদিতির কর্ণকুন্ডলসহ একাধিক সামগ্রী। সেই সাথে নরকাসুর দ্বারা অপহৃত ১৬১০০ (বিষ্ণুপুরাণ)  বা ১৬০০০ (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবতম, কালিকাপুরাণ) রাজকন্যাকে উদ্ধার করেন তিনি এবং দ্বারকায় এনে তাদের সম্মান রক্ষার্থে স্ত্রীর মর্যাদা দেন (শ্রীমদ্ভাগবতম)। প্রত্যেকে ‘ভাগবতী-বৈভব-পূর্ণ’ নিজ নিজ বাসগৃহে লাভ করেন পরিপূর্ণ গার্হস্থ্য, লাভ করেন স্বামীর পরিপূর্ণ সাহচর্য, পরিপূর্ণ দাম্পত্য, পরিপূর্ণ বাল্লভ্য তথা পরিপূর্ণ মর্যাদা। অবতারলীলার অবসানে স্বামীর সঙ্গেই নিত্যলীলায় প্রত্যাবর্তন করেন তাঁরা। তাঁরা প্রত্যেকেই নিত্য-রমা, তবু অবতার-লীলায় তাঁরা হয়েছিলেন নরকাসুরের বন্দিনী।

নরক চতুর্দশীর এই দিনটি ছোটি দিওয়ালী বা ছোট দীপাবলি নামে পালিত হয়,  আর পরের দিন তিনি ফিরে আসেন দ্বারকায়। পরের দিন তিনি দ্বারকায় ফিরলে দ্বারকাবাসী প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করতে থাকেন।

✸ ৮. মোট ১৩ বছরের বনবাস সেরে পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তন

দ্বিতীয় হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতেও দীপাবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌরবদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে পাণ্ডবরা অমানুষিক কষ্টকর ১২ বছর বনবাস ও  ১ বছর অজ্ঞাতবাস অতিক্রান্ত করলেন পাঞ্চালরাজের কন্যা পাঞ্চালী (দ্রৌপদী)-কে নিয়ে ৷ মোট ১৩ বছরের বনবাসের মেয়াদ শেষ হলে তারা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করে দীপাবলির দিনে ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে৷ হস্তিনাপুরবাসী তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন প্রদীপ জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করে, আলোর উৎসবের মধ্য দিয়ে ৷

✸ ৯. পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে আকাশপ্রদীপ প্রজ্বলন

মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন বলে, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়। এ কারণে ঐ দিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয়। কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় মোতবাতি জ্বালায়; কেউ বা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোট ঘরে প্রদীপ জ্বালায়; একে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আকাশপ্রদীপ। যাতে পিতৃপুরুষগণ ওই আলো দেখে  মর্তে আসতে পারেন।

✸ ১০. মহাবীরের মোক্ষ লাভ

জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন।

✸ ১১. শিখ ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দজী সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে অমৃতসরে প্রত্যাবর্তন

১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দজী দীপাবলীর দিনে অমৃতসরে ফিরে আসেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে ৫২ হিন্দু রাজাকে মুক্ত করেন- তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ পালন করেন; তারা এই দিনকে ‘বন্দী ছোড় দিবস’ও বলেন।

✸ ১২. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিবস

আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে। তারা এই দিনটি “শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি” হিসেবেও পালন করেন।

─•━━━━•⊰❁*❀❁❁❀*❁⊱•━━━━•─

শুভ দীপাবলির তাৎপর্য

🪔 দীপাবলির তাৎপর্য হল “ভগবানকে হৃদয়ে আহ্বানের প্রস্তুতি!“

প্রভুপাদ বলেছেন, আমরা যদি ভগবানের বিরহ অনুভব করি, তাহলে আমাদের জীবন সার্থক হবে। ভগবানের বিরহ অনুভব করার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই আমরা জড়জগতের সবকিছু থেকে বিরক্তি অনুভব করব। তো তা হচ্ছে প্রেমের লক্ষণ, আমাদের কৃষ্ণের বিরহ অনুভব করতে হবে।”

🪔 অন্ধকারের ওপর আলোর জয়, অজ্ঞতার ওপর জ্ঞান এবং মন্দের (অসত্যের) ওপর ভালোর (সত্যের) বিজয় উদযাপন করাই হল পবিত্র উৎসব দীপাবলি।

দীপাবলির আলোগুলি আমাদের সমস্ত অন্ধকার আকাঙ্ক্ষা, চিন্তাভাবনা, কাম, ক্রোধ, লোভ, আসক্তির মতো অন্তরের অন্ধকারকে ধ্বংস করার, অন্ধকারময় অশুভ ছায়া এবং মন্দকে দূর করার সময় নির্দেশ করে।

🪔 যেখানে প্রেমের প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়, শ্রীরামও অযোধ্যায় থাকেন হৃদয় রূপে।  অথবা শ্রী রাম যখন হৃদয়ের সিংহাসনে উপবিষ্ট হন, তখন মানুষের মধ্যে সত্য, প্রেম ও করুণার আলো আপনাআপনি ছড়িয়ে পড়ে।

🪔 আমাদের সবাইকে আমাদের জীবনে একটা ছোট্ট পরিবর্তন আনতে হবে যে দীপাবলিতে শুধু মিষ্টিই নয় ভালোবাসাও বিতরণ করা উচিত, শুধু পটকা নয়, খারাপ গুণগুলোও পোড়ানো উচিত এবং শুধু ঘর নয় হৃদয়কেও সাজাতে হবে, তারপর জীবন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।এতে বেশি সময় লাগবে না।  যেখানে ধর্মের রূপে রাম বা নারায়ণ আছেন, মা লক্ষ্মী সেখানে আপনা আপনি আগমন করেন।

🪔 পবিত্র উৎসব দীপোৎসব আপনাদের সকলের সুখ, সমৃদ্ধি ও আনন্দে পরিপূর্ণ হোক।

আরও পড়ুন: শ্রীকৃষ্ণের ৬৪ গুণ (64 Qualities of Krishna)✸রাধারানীর ২৫ গুণ (25 Qualities of RadhaRani)

Join to Our Community
Community Grows With You
x

This website uses cookies.